Death or Alive part 7

Death or Alive part 7
priyanka hawlader

রাতটা ছিল গভীর কালো, অথচ আকাশে চাঁদ ছিল অপার মোহে ভাসমান।
চাঁদের আলো মধুপুরগড়ের গহন জঙ্গলকে রুপালি ছায়ায় ঢেকে দিয়েছিল। পাতার ফাঁকে ফাঁকে সোনালি রঙের মতো ছিটকে পড়ছিল আলো, আর ঘন অন্ধকারে কখনো ছায়া, কখনো আলো মিলে এক অদ্ভুত বিভ্রম সৃষ্টি করছিল।
ঝিরঝিরে বাতাসে গাছের পাতারা যেন নিঃশব্দে ফিসফিস করছিল কারো আগমনের পূর্বাভাস।
সেই রাতের অন্ধকারে ক্যালিয়ন তার —নেকড়ে রূপে—জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে।
তার বিশাল শরীর, চকচকে কালো পশমে ঝলসে উঠছে চাঁদের আলো। চোখদুটো আগুনের মতো লাল, তীক্ষ্ণ আর সতর্ক।
সে জানে, অর্ষা অপেক্ষা করেছে সারাদিন এখন তার ধরা দেওয়ার পালা।
অন্ধকার যতই গভীর হোক, তার ভালোবাসার পথ সে থেমে যেতে দেবে না।
হঠাৎ…

এক মুহূর্তে সব শব্দ থেমে গেল। বাতাসটা যেন ভারি হয়ে এলো।
চারপাশের গাছেরা হঠাৎ স্তব্ধ। পাখিরা চুপ।
এক অদ্ভুত ঠান্ডা ছায়া যেন ছড়িয়ে পড়ল জঙ্গলের বুকে।
ক্যালিয়ন থেমে দাঁড়ালো। বুকের ভেতর হালকা একটা গর্জন জমে উঠল।
তার সামনে…
চাঁদের আলোয় ছায়াময় অবয়ব।
একজন বিশালদেহী, কালো পোশাকে মোড়া পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় হুড, মুখ দেখা যায় না। কিন্তু পোশাকের নিচ থেকে বেরিয়ে থাকা আঙুলগুলো অস্বাভাবিক দীর্ঘ ও কালো।
ক্যালিয়নের চোখ রক্তলাল হয়ে উঠলো।
সে চিনে ফেলেছে…

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জিনদের বাদশা, কায়াস্থদের উত্তরাধিকারী—ওয়াজফান কায়াস্থ।
তার সবচেয়ে বড় শত্রু।
যার হাত ধরে শুরু হয়েছিল তার পরিবার ধ্বংসের ইতিহাস।
ক্যালিয়নের মুখে হালকা গর্জন, দাঁত বেরিয়ে এসেছে।
সে প্রস্তুত।
কিন্তু একটাই প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে—
“সে এখানে কী করছে? এত বছর পর… আর এখন এখানে তার কি কাজ ?”
ক্যালিয়নের চোখ ছলকে ওঠে আগুনে।
সেই রাতের জঙ্গল যেন মুহূর্তে রক্তাক্ত ইতিহাসের স্তব্ধ সাক্ষী হয়ে ওঠে।
রাত গভীর। জঙ্গলের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
হঠাৎ যেন সেই নীরবতা ভেঙে ছিন্নভিন্ন করে দেয় একটি দৃষ্টির তীব্র আগুন।
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্যালিয়ন।
তার চোখ জ্বলছে—

চাঁদের আলোতে ঝিলমিল করছে লালাভ আভা,
আর মুখে এক ঠান্ডা, ভয়ঙ্কর প্রশান্তি।
ওয়াজফান তখনও ছিল উল্টো দিকে—
নিজের জাদু শক্তির হিসেবনিকেশে ব্যস্ত।
কিন্তু হঠাৎ একটা অনুভব, একটা ছায়া, একটা শ্বাস তাকে ঘুরে তাকাতে বাধ্য করে।
সে ঘুরতেই চোখে পড়ে…
নেকড়ে রূপে দাঁড়িয়ে আছে ক্যালিয়ন!
তার দেহে কালো পশম, দাঁতগুলি যেন রক্ত পিপাসায় জ্বলছে,
আর বুক ফুলে আছে প্রতিশোধের শপথে।
ওয়াজফানের চোখ রাগে জ্বলে উঠে—
সে মুহূর্তেই তার চোখ সোনালী বর্ণ ধারণ করে।
তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে তার চোখেমুখে।
সে ধীরে ধীরে ফিসফিস করে,
তুই … অবশেষে এখানে কি করছিস ,
এক লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে সে উঠে দাঁড়ায়।

তার হাত দুটো শক্ত হয়ে ওঠে, আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা পুরনো মন্ত্র ফিসফিস করে বলতে থাকে—
হাওয়ার গতিপথ বদলে যায়। গাছের পাতা একসাথে কাঁপতে থাকে।
জঙ্গলের গা ছমছমে বাতাস যেন সাক্ষী হতে চায় এই দ্বৈরথের।
এদিকে ক্যালিয়ন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে ওয়াজফানের দিকে।
পায়ের নিচে পাতার শব্দ যেন সময়ের কাউন্টডাউন।
ওয়াজফানও প্রস্তুত, তার পুরো দেহ থেকে তপ্ত জাদুশক্তির ঝলক বেরিয়ে আসছে।
দু’জনে চোখে চোখ রাখে।
তাদের মাঝে বাতাস থমকে গেছে।
একটি যুদ্ধ, বহু পুরনো রেষারেষির প্রতিশোধ, এবং অদৃশ্য ইতিহাস—
সব আজ ছায়ায় দাঁড়িয়ে শ্বাস নিচ্ছে।

এই জঙ্গলের নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গাছেরা, তারা জানে…
রক্ত ঝরবে। আর হয়তো আজ রাতেই ধ্বংস হবে কেউ।
জিন আর নেকড়ে—দুই অন্ধকার প্রজাতির চিরশত্রু।
তাদের সম্পর্ক যেন সাপ আর নেউলের মতো—
যেখানে দেখা মাত্রই শুরু হয় যুদ্ধ, আর শেষ হয় রক্ত ঝরিয়ে।
নেকড়েরা জিনদের গন্ধ পেলে দশ হাত দূর থেকেই বুঝে যায়,
আর তারপর…
শিকারের মতো বসে খেয়ে ফেলে তাদের।
তাদের দাঁত শুধু মাংস ছিঁড়ে না,
চুষে নেয় জিনের শক্তিও—
যার ফলে তারা আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে,
আরও অন্ধকারময়।

তবে সব জিন এত সহজে বসে খাওয়ার মতো নয়…
কারণ বাদশার মতো শক্তিশালী জিনের সাথে পসরা সাজানো এতটা সহজ না।
তার রক্তে আগুন, চোখে হাজার বছরের অভিশাপ, আর মন্ত্রে এমন শক্তি যা নেকড়ে বংশ শেষ করে দিতে পারে।
যুগ যুগ ধরে চলছে এই ভয়াল সংঘর্ষ,
অন্ধকার বন, পরিত্যক্ত প্রাসাদ, আগ্নেয় গুহা কিংবা মরুভূমির নীচে গোপন বৃত্তে,
জিন আর নেকড়ের এই রক্তাক্ত লড়াই থামেনি কখনো।
কখনো জিনেরা রাজত্ব করেছে, নেকড়েদের নিধন করেছে।
আবার কখনো নেকড়েরা দাপটের সাথে শিকার করে গেছে,
জিনের রক্তে ভিজেছে জঙ্গলের মাটি।
এই যুদ্ধের কোনো শেষ নেই।
কারণ এই যুদ্ধ শুধু শক্তির নয়—
এটি অস্তিত্বের লড়াই।
(জিন বা নেকড়ে যেই মানুষ রুপে থাকুক না কেন অপরজন তাকে অনায়েসে চিনে ফেলে আর সেটা কে বা কোন জিন বা কোন নেকরে তাও বুঝে যায়।)

ঘন জঙ্গলের মাঝে শুরু হয়েছে ভয়াল সংঘর্ষ—
জিন আর নেকড়ে দুই চিরশত্রুর ভয়াল লড়াই।
একদিকে সোনালী চোখের রহস্যময় জিন ওয়াজফান,
অন্যদিকে নেকড়ে রূপে ভয়ঙ্কর ক্যালিয়ন।
একবার ক্যালিয়ন ঝাঁপিয়ে পড়ে ওয়াজফানের উপর,
তার তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে জঙ্গলের বাতাস কেঁপে ওঠে।
ওয়াজফানও পাল্টা আক্রমণ চালায়—
কখনো আগুনের ফুলকি, কখনো অদৃশ্য ধাক্কা,
তবুও আজ যেন তার জাদু শক্তিতে কিছু একটা ঘাটতি…
সে দুর্বল।

হয়তো দীর্ঘ সময় ধরে ভাইকে খোঁজার জন্য নিজের জাদুশক্তি অনেক বেশি প্রয়োগ করার কারণে ,
ক্যালিয়ন এটা বুঝে ফেলে।
সে ডাক দেয় তার বড় বড় নেকড়ে সঙ্গীদের।
কালো ছায়ার মতো ঘিরে ধরে তারা চারপাশ।
তারপর…
ক্যালিয়ন নিজের হাতের ধারালো নখ বাড়িয়ে
এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওয়াজফানের ওপর,
বুকের এক পাশে তীব্র আঁচড় বসিয়ে দেয়!
ওয়াজফানের শরীর কেঁপে ওঠে।
সে দু’পা পিছিয়ে যায়।
তার মাথার হুডটা পড়ে যায় পেছনে।

চাঁদের আলোয় ঝলসে ওঠে তার সেই কিংবদন্তি সোনালী চোখ…
যা কপালের সামনের চুল দিয়ে ঢেকে আছে।
তার মুখে একটা কালো মুখোশ এখনো আছে—
তাই তার আসল চেহারা এখনো এক রহস্য!
কিন্তু ক্যালিয়ন থেমে থাকে না।
সে এবারই সুযোগ ভেবে আবারও তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যায়,
তার থাবা ঠিক ওয়াজফানের গলায় এসে পড়ার আগমুহূর্তে…
থররররররর!
এক প্রচণ্ড গর্জন!

ক্যালিয়নের শরীর আচমকা আছড়ে পড়ে একপাশে!
তাকে কেউ খুব জোরে আঘাত করেছে।
ঘন জঙ্গলের মাঝে চারদিক নিস্তব্ধ।
একদিকে ক্ষতবিক্ষত ওয়াজফান, অন্যদিকে দাঁড়িয়ে আছে ক্যালিয়ন—
তার গা থেকে রক্ত ঝরছে, তবুও চোখে আগুন।
হঠাৎ, ঠিক পিছন থেকে
এক তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার শ্বাসরুদ্ধ করা স্পর্শ!
ছুরি!
ক্যালিয়নের দেহ জমে যায়।
সে আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ায়…
তার চোখে অবিশ্বাস…
তার ঠোঁট কাপছে…
আর সামনে দাঁড়িয়ে সেই মুখ…

অর্ষা!
তার হাতে একটিমাত্র ছুরি—
যার ডগায় রক্ত…
ক্যালিয়নের রক্ত!
তার চোখে ভয়, রাগ, আর হতাশার এক অদ্ভুত মিশ্র আবেগ।
ক্যালিয়ন স্তব্ধ।
তার চোখে যেন সময় থেমে গেছে।
একপলক চেয়ে থাকে সেই মুখের দিকে
যার জন্য এতটা লড়াই, এতটা ত্যাগ, এতটা পাগলামি।
তবে সে জানে সে নেকড়ে রূপে তাই অর্ষা তাকে আঘাত করেছে।
সে কিছু বলতে চায়… কিন্তু শব্দ হারিয়ে যায়।
তারপর ধীরে ধীরে
এক পা… দু’ পা…
সে পিছিয়ে যায়।

তবুও চোখ নামায় না অর্ষার দিক থেকে।
তার চোখে এখনো ভালোবাসা… কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারছে না ।
তারপর সে চোখের ইশারায় কিছু একটা জানায় তার সঙ্গীদের।
নেকড়ে দল একে একে সরে যেতে শুরু করে।
সেও ঘুরে দাঁড়ায়।
শেষবারের মতো একবার পিছনে তাকায়…
অর্ষা তখনো দাঁড়িয়ে, নিঃশব্দে, চোখেমুখে দ্বন্দ্ব।
ক্যালিয়ন ছুটে চলে যায়—
নিচে, জঙ্গলের অন্ধকারে।
তার পেছন পেছন নেকড়ে দল মিলিয়ে যায় ছায়ার মাঝে।
চাঁদের আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে…
শুধু বাতাসে ভেসে থাকে এক অদৃশ্য প্রশ্ন—
ভালোবাসায় কি নতুন কোন মোর আসতে চলেছে।
না ধ্বংসের কোন কাহিনী।
রাত তখন গভীর।

মিরাদের বাড়ি থেকে নিজের পথ ধরে ফিরছিল অর্ষা।
চাঁদের আলোয় জঙ্গলের ছায়া আরও বেশি রহস্যময় হয়ে উঠেছিল।
হঠাৎ, কিছু একটা শব্দ… পাতার কাঁপন, হাওয়ার অস্বাভাবিক গতি।
সে থেমে দাঁড়ায়।
দূর থেকে চোখে পড়ে ভয়াল এক দৃশ্য—
এক বিশাল নেকড়ে, এক মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে!
অর্ষার বুক ধক করে ওঠে।
সে চিনতে পারেনি ক্যালিয়নকে, কারণ সে তখন নেকড়ে রূপে…
আর সেই মানুষটি—ওয়াজফান—সে ছিল তার মানুষ রূপে।
অর্ষার চোখে এ ছিল এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য—
এক পশু একটি নিরীহ মানুষকে আঘাত করছে!
সে আর দেরি না করে
নিজের ছোট ছুরিটা বের করে ছুটে যায় সেই নেকড়ের দিকে।
জোরে, সাহসে, আর অজানা ভয় নিয়ে…
একই মুহূর্তে তার ছুরির তীক্ষ্ণ ফল বসে ক্যালিয়নের শরীরে।
নেকড়ে থেমে যায়।
ধীরে ধীরে ঘুরে তাকায়…
আর দেখে সেই মুখ—
অর্ষা!

কিছু না বলে ক্যালিয়ন পিছিয়ে যায়।
তার চোখে অভিমান, তীব্র যন্ত্রণা আর নিঃশব্দ প্রশ্ন।
তবুও সে কিছু না বলে সরে যায়,
অর্ষা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
তার বুক ধকধক করছে।
সে ধীরে ধীরে সামনে গিয়ে সেই মানুষটার কাছে পৌঁছায়—
অর্ষা তাকিয়ে দেখে মানুষটা এত বেশি লম্বা যেন তার সামনে ৫ ফুট ইঞ্জির অর্ষাও খুব ছোট লাগছে, মনে হচ্ছে কোন লম্বা খাম্বার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে।
ওয়াজফান তখন অর্ধ-অচেতন।
রক্তে ভিজে আছে তার বুক।
সে ওয়াচ ফান কে ধরে গাছের শিকড় এ বসায়। এরপর,অর্ষা কিছু না ভেবে,
নিজের গলার স্কার্ফ খুলে নেয়
আর আস্তে করে বেঁধে দেয় ওয়াজফানের ক্ষতস্থানে।
তার হাত কাঁপছে, কিন্তু চোখে দয়া।
সে তখনও জানে না—
সে যে নেকড়ে রূপীকে আঘাত করেছে,
সে-ই তার মনের সেই রহস্যময় মানুষ…
ক্যালিয়ন।

আর ওয়াজফান—
যাকে সে রক্ষা করেছে—
সে-ই হয়তো বা তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদ। হবে।
ওয়াজফান স্থির দাঁড়িয়ে ছিল। পুরো শরীরে যেন এক মুহূর্তের জন্য শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্যটা অবিশ্বাস্য। এক সাধারণ মেয়ে হয়ে—একটা নেকড়েকে এক মুহূর্তে কাবু করে ফেলল! সে কীভাবে করল, কী শক্তি ব্যবহার করল, সেই ভাবনা আসার আগেই তার চোখ আটকে গেল মেয়েটির উপর।
অর্ষা নেকড়েটাকে সামলে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে স্কার্ফ খুলে তার ক্ষত জায়গাটাতে বেঁধে দিতে শুরু করে। সেই মুহূর্তে ওয়াজফান তার চোখ সরাতে পারে না। যেন পৃথিবীর সমস্ত শব্দ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, চারপাশের প্রকৃতি থমকে গেছে শুধু একটিমাত্র দৃশ্য দেখার জন্য—অর্ষা।
তার চুল বাতাসে উড়ছে, চোখের কোণে শীতল আত্মবিশ্বাস, ঠোঁটের নরম নড়াচড়া, নিঃশ্বাসের ঘন স্পন্দন… ওয়াজফানের চোখে সবকিছু যেন ধীরে চলা কোনো মায়াবী সিনেমার দৃশ্য। এতটা নরম, এতটা অপার্থিব সুন্দর লাগছিল তাকে, যেন অন্ধকার জগতের মধ্যে এক ফালি আলো।

অর্ষা যখন স্কার্ফ বাঁধা শেষ করে ওয়াজফানের চোখে চোখ রাখে, তখন সে থমকে যায়। ওয়াজফানের চোখের মণি তখন লাল, হালকা রাগ, বিস্ময় আর মুগ্ধতা একসাথে জ্বলছে। চুল কিছুটা চোখের উপর এসে পড়েছে। মুখে কালো মাস্ক, তবু তার সেই গভীর দৃষ্টি বোঝায়, সে এখন সম্পূর্ণভাবে অর্ষার প্রতি মগ্ন।
দুজনের মাঝখানে এক অদ্ভুত নীরবতা জমে ওঠে।
একটা বিদ্যুৎরেখা যেন দু’জনের মাঝখান দিয়ে ছুটে যায়—নিভৃত, কিন্তু তীব্র। ওয়াজফানের শ্বাস একটু ঘন হয়ে আসে, সে কিছু বলতে চায়… কিন্তু শব্দ আটকে যায় গলার কাছেই।
ওয়াজফান হঠাৎ ছোট্ট করে বলে ওঠে, “Little monster…”
অর্ষা তা সঙ্গে সঙ্গেই শুনে ফেলে। কৌতূহল ভরা চোখে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কিছু বললেন?”
ওয়াজফানের যেন ধ্যান ভেঙে যায়। তার দৃষ্টিতে ক্ষণিকের জন্য ঝলকে ওঠে বিস্ময়, তারপর বিরক্তি। সে মনে মনে গজগজ করে ওঠে—

এই দুর্বল, তুচ্ছ মানবীর দিকে আমি এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম কেন? কি এমন আছে ওর মধ্যে? নিশ্চয়ই কোনো কালো জাদু জানে! জিনদের বশ করার ক্ষমতা না থাকলে, আমি—আমি কেন তার দিকে এতটা আকৃষ্ট হবো?
ওরা সব পারে… বশ করতেও পারে… ধ্বংস করতেও। ঘৃণা করি আমি এদের… এরা একেকটা মনস্টার!
তার চোখে ঘৃণা ছায়া ফেলল মুহূর্তে। আর কোনো কথা না বলে বসা থেকে উঠে অর্ষার পাশ কাটিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে গেল।
অর্ষা হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল তার পেছন দিকে। মনে মনে বলল,
একটা ধন্যবাদও দিল না! জীবন বাঁচালাম, আর সে এমন মুখ করে চলে গেল? মানুষগুলো আজকাল এত অদ্ভুত কেন? প্রতিদিনই নতুন একরকম পাগলের দেখা মেলে!
দূরের ঘন ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ক্যালিয়ন নিঃশব্দে সব কিছু দেখছিল। সে ভেবেছিল চলে যাবে, আর ফিরবে না… কিন্তু পারল না। এই ভয়ংকর, অদ্ভুত শক্তির জিনের হাতে সে কীভাবে অর্ষাকে একা ফেলে যায়? তার মনটা মানেনি, পা দুটো টেনে এনেছে ফিরে—সেই ঝোপের আড়ালে।
তবে সে যা দেখল, তা তার হৃদয়ে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো আঘাত করল।

অর্ষা… তার অর্ষা… তার চোখের সামনে অন্য কারও স্পর্শে জড়িয়ে পড়ছে। ওয়াজফানের অন্ধকার চুম্বন, কাঁপানো কণ্ঠে বলা কথা, আর অর্ষার সেই নির্বাক স্থিরতা—সব কিছু যেন ক্যালিওনের হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দিল।
সে জানে, অর্ষা তাকে চিনে না। জানে না তার নেকড়ে রূপ, জানে না এই নেকড়ের আড়ালে সেই ক্যালিয়ন । তবুও, সেই না-বলা ভালোবাসা, সেই সব অর্পণ করা অনুভূতির গভীরতা—সব যেন আজ ভেঙে চুরমার।
তার দু’হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ হলো। গাল ঘেঁষে একফোঁটা গরম জল ঝরে পড়ল। এরপর হঠাৎ সজোরে সে আঘাত করল পাশের মোটা গাছের গায়ে—”ঢাস!”
চামড়া ফেটে রক্ত ঝরলো, কিন্তু সেই যন্ত্রণাও যেন হার মানে হৃদয়ের যন্ত্রণার কাছে।
আস্তে আস্তে ক্যালিওন ঝোপের আড়াল থেকে পিছিয়ে এল। তার কাঁধ নুয়ে পড়েছে, চোখে বেদনার ছায়া।
“ভালোবাসি… ফিসফিস করে বলল সে।

ওদিকে, ওয়াজফান চলে গেলে অর্ষাও থামেনি। চুপচাপ সেখান থেকে চলে গেল নিজের বাড়ির দিকে। তার চোখে ভয়, দ্বিধা আর অজানা আবেগ। যেন কিছু ভেঙে পড়েছে তার ভিতরে… অথচ সে বুঝতে পারছে না, ঠিক কী।
গভীর রাত্রি। হিমেল হাওয়া গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। দূর থেকে ঘুঙুরের শব্দ যেন আসছে, আবার মিলিয়েও যাচ্ছে। এই রহস্যময় পরিবেশে ধীরে ধীরে নিজের বাংলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জিনদের বাদশা — ওয়াজ ফান।
আজ তার চেহারায় সেই আগের রুদ্রতা নেই। চোখে ক্লান্তির ছাপ, ঠোঁটের কোণে এক অনুচ্চারিত বেদনা। শরীর দুর্বল, মনের ভিতরে এক প্রবল ঝড়। তবুও তার গম্ভীর মুখে রাজাধিরাজের মতো কঠিন শাসন বজায়।
বাংলোর দরজায় পৌঁছাতেই, ভেতর থেকে ছুটে আসে তার অনুগত আয়রাক।
বাদশা! আপনি কি… প্রিন্স জ্যামকে খুঁজে পেয়েছেন?”
ওয়াজ ফান চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত নিঃশ্বাস নেয়। তারপর নিচু স্বরে বলে,
হ্যাঁ… সে আছে… এই জঙ্গলেই, এক গুহায়।

তাকে আটকে রেখেছে এক সাধু — এক কুচক্রি ব্ল্যাক ম্যাজিক চর্চাকারী।
সে জানে জ্যাম সাধারণ জিন নয় — সে আমার ভাই, রাজরক্তের বাহক।
তাই সে চেয়েছে, আমার ভাইকে দিয়ে কু-তন্ত্র সাধতে।
তাকে বন্দি করে রেখেছে এক অভিশপ্ত বোতলে।
আয়রাক বিস্ময়ে বলে ওঠে,
এ কী ভয়ংকর দুঃসাহস! সে কি জানে না কার ভাইকে সে ছুঁয়েছে?”
ওয়াজ ফান এবার চোখ মেলে তাকায়।
তার চোখে লেলিহান আগুন।
সে জানে না। জানলেও আজ আর কাজে আসবে না।

আমার ভাইকে ছোঁয়ার অপরাধে… আমি তাকে জীবিত রাখবো না।”
একটা দীর্ঘ নীরবতা নামে। বাতাস থমকে যায়। এরপর ধীরে ধীরে ওয়াজ ফান সামনে এগিয়ে এসে বলে।
প্রস্তুত থাকো আয়রাক। কাল আমরা বেরোব।
সেই সাধুর দুঃসাহসের শাস্তি হবে।
আমার ভাইকে আমি ফিরিয়ে আনবো — আগুনের শপথ আমি তাকে রক্তে ধুয়ে দেবো।
কাল… হবে সেই রাত্রি, যেদিন জিনের আগুনে জ্বলবে এক মরণপূজার ঘি।
আয়রাক মাথা নত করে বলে,
যেমন হুকুম, বাদশা… আগুনের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হবেই।
সন্ধ্যা আবার ঘনিয়ে আসে। এক নিস্তব্ধ রাত্রির ভেতর বজ্রের মতো শপথে কাঁপে জিনদের বাংলো।

রাত অনেক হয়ে গেছে। অর্ষা বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরের নিস্তব্ধতায় কেবল ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ আর মাঝেমাঝে বাইরে দিয়ে হালকা বাতাসে পর্দার ফিসফাস।
মোবাইলটা পাশে পড়ে আছে, নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ—যেন তার মতোই।
ক্যালিওনের কোনো মেসেজ নেই।
কোনো কলও না।
হাহ, ঠিকই তো,” অর্ষা নিজেকে বলে, ঠোঁট কেটে একরকম করুণ হাসি দেয়, “আমি কেন অপেক্ষা করছি? আমি তো এমনটা কখনও করিনি।
তার মন অস্থির, কিন্তু সে নিজেকেই ধমক দেয়—

তুই অর্ষা। একটা ট্রমের মধ্য দিয়ে গেছিস, তবুও ভেঙে পড়িসনি। ভার্সিটির সময় কত ছেলে তোকে প্রপোজ করতে চেয়েছে… তুই কি কাউকে পাত্তা দিয়েছিস? না। উল্টো, কেউ কাছে আসলেই দুমদাম কেলিয়ে দিয়েছিস।
সে চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে নিঃশ্বাস নেয়, যেন নিজেকে সামলাতে চাইছে।
“আর আজ? আজ তুই কিনা একটা ছেলের জন্য মন খারাপ করছিস? ছিঃ অর্ষা!”
একটা আঘাত করা তাচ্ছিল্য মিশে আছে নিজের গলায়।
এত অধঃপতন! এত দুর্বলতা! ক্যালিওন কে? একটা ছেলে মাত্র! আর তুই?
সে উঠে বসে, মাথা নিচু করে নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে। তারপর আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে, চোখ দুটো বারবার বন্ধ করার চেষ্টা করেও পারে না। ক্যালিওনের কথা মনে পড়ছে—তার হাসি, তার চোখ, তার চুপ থাকা, আবার হঠাৎ হঠাৎ কেয়ার দেখানো।

Death or Alive part 6

“না, আমি আর ভাবব না ওকে। নয় মানে নয়।”
নিজেকে বোঝাতে বোঝাতে কখন যে ঘুম এসে গেছে, অর্ষা জানে না।
তার মুঠোয় তখনও অদৃশ্য এক অভিমানের আগুন জমে আছে।

Death or Alive part 8

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here