অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৫
নুসাইবা ইভানা
সময়ের দৌড়ে কেটে গেছে ছয় মাস। সময় এত দ্রুত চলে যাচ্ছে, মনে হয় চোখের পলক ফেলার আগেই দিন শেষ!
জেলখানার অন্ধকার ঘরে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে জিয়ান। পাইলট জিয়ান রেজা চৌধুরী। একসময় যার জন্য কত মেয়ে পাগল ছিল। সেই মানুষটাই আজ যেন বিধ্বস্ত এক প্রাণ। তার বেঁচে থাকার কোনো আগ্রহ নেই, জীবনের প্রতি কোনো চাওয়া বা আক্ষেপ নেই। জীবন যেন তাকে সবচেয়ে বড় শাস্তি দিচ্ছে। নিজের প্রাণপ্রিয় অর্ধাঙ্গিনীর হত্যা মামলার আসামি সে। জানা নেই, এর সঙ্গে আরো কত কত মামলা জড়িয়েছে তার নামে! হাসিখুশি জীবনটা বিষাদে ভরে গেছে। রাত গড়িয়ে দিন যায়, তবুও জিয়ানের মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। আজ তার মামলার শুনানি। এ নিয়ে তিনবার কোর্টে উঠেছে মামলা। তবে ফলাফল শূন্য। মিথ্যার সয়লাবে সত্য যেন ধুলোকণা। কোনো উকিল জিয়ানের মুখ থেকে একটি কথাও বের করতে পারেনি। সে যেন প্রাণহীন দেহ মাত্র।
মিতা বেগম চিৎকার করে বলেন, “আমি কিছুই বুঝতে চাই না। যেভাবেই হোক, আমার রেজাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনো। এইটুকু কাজও করতে পারছ না! এত নাম, টাকা-পয়সা, এসব দিয়ে কী হবে? আমি আমার ছেলেকে চাই।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নাজিম চৌধুরী শান্ত স্বরে বললেন, “ধৈর্য ধরো। এটা সহজ নয়। তালুকদাররা এমনভাবে মিথ্যা প্রমাণ সাজিয়েছে যে আমরা বারবার পরাজিত হচ্ছি। মামলা যদি একটু শিথিল হয়, তখন হয়তো কিছু করা যাবে। তার ওপর আছে মিডিয়া। এরা কি টাকা দিয়ে সাংবাদিকতা শিখেছে? একেকটাকে মনে হয় জোকার! যা ইচ্ছা ছাপিয়ে দেয়। ন্যূনতম কমনসেন্সও তাদের আছে বলে মনে হয় না। একজন মানুষ সম্পর্কে কোনো প্রমাণ বা তদন্ত ছাড়াই যা খুশি প্রচার করে! একজন নিরপরাধ মানুষকে কীভাবে কুখ্যাত অপরাধী বানানো যায়, সেটা এদের কাছ থেকে শেখা যায়।”
জাহিন বলল, “বাবা, আমি বুঝতে পারছি না। তুমি কেন চুপ করে আছ? ওই তালুকদারদের সাহস কীভাবে হয় চৌধুরীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর? তাদের তো কথা বলার আগে ভাবা উচিত ছিল, সামনে কারা দাঁড়িয়ে আছে!”
“হাতি গর্তে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে,” নাজিম চৌধুরী জবাব দিলেন।
“বাবা, তুমি শুধু আমাকে একটু সুযোগ দাও। আমি দেখে নেব কীভাবে ওদের দমাতে হয়।”
“তোমার মতো ছেলের ওপর আমার কোনোকালেই ভরসা ছিল না, এখনো নেই। রক্তারক্তি, খুনখারাপি করা সহজ। কিন্তু বুদ্ধি দিয়ে কাজ করা কঠিন। নিজে থেকে এগিয়ে কিছু করতে যাবে না। এখানে তোমার গুন্ডামির কোনো জায়গা নেই। তুমি গোয়েন্দা কর্মকর্তা না হলে এই মামলার তদন্ত করছ কেন?”
জাহিন যেন মুহূর্তে ফ্রিজ হয়ে গেল। তার বাবা এ কথা জানলেন কীভাবে! অন্তর ছাড়া তো তার পরিচিত কেউ এটা জানে না।
“এসব কী বলছ বাবা?”
“জাহিন, তুমি আমাকে জন্ম দাওনি, আমি তোমাকে জন্ম দিয়েছি। আমার সঙ্গে চালাকি করবে না। ভুলে যেয়ো না, আমি তোমার জন্মদাতা পিতা। তোমার বিষয়ে অনেক খবর আমার জানা। এবার যদি উকিল কিছু করতে না পারে, তাহলে তুমি এই মামলার তদন্ত করবে। তুমি বের করবে তোমার ভাইকে।”
মিতা বেগম কিছুই বুঝতে পারছেন না। এসব কী হচ্ছে!
নয়না বসে আছে বাঁশ আর কাঠের তৈরি খোলা বারান্দায়। সামনে বিশাল বড় বড় সবুজ পাহাড়। বারান্দার দুই পাশে বাগানবিলাস। তক্তার ওপর মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে নয়না। তার জীবন যেন এক গণ্ডির মধ্যে থেমে আছে। আকাশ, বাতাস, চাঁদ, সূর্য, তারা আর গাছপালা ছাড়া নয়নার কোনো সঙ্গী নেই। মাঝে মাঝে আকাশের সঙ্গে কথা বলে, কখনো বাগানবিলাস গাছের সঙ্গে। উত্তর পাবে না জেনেও কত শত প্রশ্ন করে।
থলামুয়ানা ডাক্তার ঈশানকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে নাম ধরে ডাকলেন, “অলিভিয়া!”
নয়নার নাম জানতে না পেরে থলামুয়ানা নিজের মেয়ের নামেই তাকে ডাকেন।
নয়না উঠে দাঁড়াল। গায়ে বোনা একটি সবুজ শাড়ি জড়ানো। মুখে কোনো প্রসাধনীর ছিটেফোঁটা নেই। স্নিগ্ধ মায়াবী মুখশ্রীতে রাজ্যের মলিনতা।
“মিস অলিভিয়া, আপনার অবস্থা এখন কেমন?” ঈশান জিজ্ঞেস করলেন।
নয়না নিম্ন স্বরে উত্তর দিল, “আগের চেয়ে ভালো।”
“ঘরে চলুন, আপনার সঙ্গে বসে কথা বলি।”
থলামুয়ানাও সঙ্গে এলেন। তিনজন চেয়ারে বসলেন।
ঈশান বললেন, “মিস অলিভিয়া, আপনার নাম কী? আপনার পরিচয় কী? কে আপনাকে এভাবে ফেলে রেখেছিল? আপনার অতীত নিয়ে কিছু বলুন।”
নয়না চুপ করে রইল। কিছু বলতে তার ইচ্ছে করছে না। মনে মনে ভাবল, তার নাম কি তবে সুনয়না? এই নাম কি এখনো জীবিত আছে? সবাই নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে সে মৃত। তাহলে এই নাম বলার কী আছে? যে নামে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে, সে নামের তো আর কোনো মূল্য নেই।
“কী ভাবছেন?” ঈশান বললেন। “দেখুন, চার মাস আপনি অচেতন ছিলেন। আপনি হয়তো জানেন না, চাচা আপনাকে পাহাড়ের এক ঝোপঝাড় থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন। আপনার শরীরে বিভিন্ন ক্ষত ছিল, মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন। আপনি অচেতন ছিলেন। চাচা আপনার চিকিৎসা করিয়েছেন, নিজেও যতটুকু সম্ভব সেবা-যত্ন করেছেন। এই মানুষটা খুব ধনী নন। পাহাড়িরা ওনাকে ‘থালভা’ ডাকে, মানে দয়াশীল। কিন্তু তিনি এত টাকাওয়ালা নন যে দিনের পর দিন আপনার চিকিৎসার খরচ বহন করবেন। চাচা গাছগাছড়া দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন। এরপর আমাকে খবর দিয়ে ডেকে পাঠান। আমার বাসা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। আমি এখানে পাহাড়িদের ডাক্তার। মাঝে মাঝে চাচার বাসায় এসে থাকি। এখান থেকে প্রকৃতি উপভোগ করা যায়। সেই সুবাদে আমি আপনার চিকিৎসা করেছি। যতটুকু সম্ভব, আমিও ছাড় দিয়েছি। আপনাকে দেখে ভদ্র পরিবারের মনে হয়। দয়া করে আমাদের আপনার ব্যাপারে কিছু বলুন।”
নয়না চুপ। এমনভাবে অন্যমনস্ক হয়ে আছে, যেন তার চারপাশে কেউ নেই।
ঈশানের এবার রাগ হলো। উচ্চস্বরে বললেন, “মিস অলিভিয়া, প্লিজ কথা বলুন। এভাবে চুপ করে থাকলে আমরা আপনাকে পুলিশের হেফাজতে দিতে বাধ্য হব।”
নয়না মনে মনে বলল, “আমি আর বাঁচতে চাই না। বেঁচে থাকা আমার জন্য অভিশাপ। যত্ন করে, ভালোবেসে কেউ আমার অস্তিত্ব মুছে দিয়েছে পৃথিবী থেকে। আমি যেন থেকেও কোথাও নেই!” চোখ থেকে অশ্রু ঝরে গাল গড়িয়ে পড়ছে।
“দেখুন, মিস, কান্না না করে কিছু বলুন,” ঈশান বললেন।
নয়না থলামুয়ানার হাত আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
থলামুয়ানা বললেন, “থাক বাবা, এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করো না। ওর যখন ইচ্ছে হবে, ও নিজেই বলবে। অলিভিয়া আমার একমাত্র মেয়ের নাম, আমি এমনি এমনি ওকে এই নামে ডাকিনি। আমি ওকে আমার মেয়ে হিসেবে মেনে নিয়েছি। আমি খেলে আমার মেয়েও খাবে। আমি না খেয়ে থাকলে আমার মেয়েও না খেয়ে থাকবে। যাও মা, তুমি নিজের ঘরে যাও।”
নয়না চুপচাপ ঘরে এসে খাটের কোণে বসল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখল, আকাশে একটি প্লেন উড়ে যাচ্ছে। নয়না দ্রুত বারান্দায় এসে প্লেনের দিকে তাকিয়ে রইল। যতক্ষণ প্লেনটি তার চোখের আড়াল না হলো, ততক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বসে পড়ল। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। তার কান্না চিৎকারে পরিণত হল।
ঈশান আর থলামুয়ানা দ্রুত ভেতরের ঘরে এলেন। নয়নাকে সেখানে না পেয়ে কান্নার শব্দ অনুসরণ করে বারান্দায় এসে দেখলেন, নয়না আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে।
ঈশান এগিয়ে এসে ডাকলেন, “মিস অলিভিয়া, আপনি ঠিক আছেন?”
কয়েকবার ডাকার পরেও নয়নার কোনো সাড়া নেই। সে একইভাবে কাঁদছে। কিছুক্ষণ পর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
ঈশান তাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে এলেন। বিছানায় শুইয়ে স্টেথোস্কোপ দিয়ে হার্টবিট পরীক্ষা করে বললেন, “ভয়ের কিছু নেই, চাচা। জ্ঞান হারিয়েছে। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরবে। আমি ইনজেকশন পুশ করে দিচ্ছি।”
অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৪
“তুমি আর কখনো ওর কাছে কিছু জিজ্ঞেস করবে না, বাবা। এত বড় একটা দুর্ঘটনার পর মেয়েটা হয়তো ভয় পেয়ে গেছে,” থলামুয়ানা বললেন।
ঈশান চুপ করে নিজের কাজে মন দিলেন। নয়নার ইনজেকশন পুশ করে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি তোমার খারাপ চাই না, অপরিচিতা। আমি শুধু তোমার পরিচয় জানতে চাই।”
