ডার্কসাইড পর্ব ৪

ডার্কসাইড পর্ব ৪
জাবিন ফোরকান

কড়াইয়ে আলুভাজিটা কষিয়ে কিছুটা লবণ ছিটিয়ে দিলো রোযা। দ্রুত হাতে উল্টে দিলো অপর চুলায় প্যানে বসানো পরোটাটি। কিছুটা দূরে জীর্ণ প্লাস্টিকের টেবিলের উপর যান্ত্রিক মেয়েলী কণ্ঠস্বর বেজে চলেছে তার অ্যান্ড্রয়েড ফোনে।
“ ফেরোমন হলো প্রাণী কর্তৃক নিঃসৃত একটি রাসায়নিক পদার্থ যা সাধারণত এক প্রাণীর সঙ্গে অন্য প্রাণীর যোগাযোগ রক্ষা এবং তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। পিঁপড়া এবং মৌমাছি ফেরোমন নিঃসরণের মাধ্যমে নিজ গোত্রের অপর সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে থাকে।”

ঠিক যেমনটা নিজের বায়োলজী বইয়ে পড়েছিল।মনে মনে ভাবলো রোযা।পরোটা হয়ে আসতেই প্যানে কিছুটা তেল ছিটিয়ে দ্বিতীয়টা চাপিয়ে দিলো সে।
“ শিকারী প্রাণীসমূহ ফেরোমনের মাধ্যমে নিজের সঙ্গী নির্বাচন করে থাকে।এর দ্বারা প্রাণী একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। তাই ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনে শিকারী প্রাণীদের আকৃষ্ট করতে ফেরোমনের ব্যবহার প্রচলিত। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।”
যান্ত্রিক কন্ঠস্বর থেমে গেলো।তবে তা রোযার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটাতে সক্ষম হলোনা।তার হৃদয়ে ঘুরেফিরে সাজেকের সেই অরণ্যের মাঝে কাটানো রাত্রির প্রতিচ্ছবি ভাসছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আসমান শুধুমাত্র অত্যা*চার করেই ক্ষান্ত হয়নি, পরিশেষে হিং*স্র পশু দ্বারাও খু*বলে খু*বলে নিঃশেষ করেছে নাবিলকে।নিজের মাঝে কতটা আক্রোশ জমা থাকলে একজন মানুষ অপর মানুষের সঙ্গে এত উচ্চ পর্যায়ের নৃশং*সতা চালাতে পারে?যেসব দৃশ্য বইয়ের পাতায় পড়ে কল্পনা করেও শরীর শিউরে ওঠে, সেসব দৃশ্যের বাস্তবায়ন ঘটাতে কারো হৃদয় কিভাবে একটি বারের জন্যও কম্পিত হয়ে ওঠেনা?ঠিক কতখানি বিকৃত মানসিকতার অধিকারী হলে মানুষ এতটা নিচে নামতে পারে?
পরোটা পু*ড়ে উঠতেই হন্তদন্ত হয়ে রোযা সেটা তুলে নিলো প্লেটে।জোরপূর্বক মাথা নাড়িয়ে নিজের মস্তিষ্ক থেকে ওই দানব কিংবা তার সম্পর্কিত সকল চিন্তা বাদ দিতে চাইলো।তার যা লাভ করার সে করেছে। অতীত ভেবে আর কাজ নেই।এবার পুনরূদ্যমে এগিয়ে যাওয়া পালা।

টেবিলে আলুভাজি পরোটা, এবং উষ্ম ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা নিয়ে বসে নিজের মোবাইলে ইউটিউব অন করল রোযা।তাতে প্রথমেই শোভা পেলো দেশের অন্যতম বিখ্যাত গণমাধ্যম চ্যানেলের একটি খবর,
“ সাজেক ভ্যালিতে ঘুরতে গিয়ে চিতাবাঘের আ*ক্রম*ণে নিহ*ত কে বি গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর নাবিল কায়সার। ”
ভিডিওটি দেখতে ইচ্ছা হলোনা রোযার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ডোরেমনের একটি এপিসোড চালু করলো।তারপর সকল চিন্তা দূরীভূত করে খাবারে মনোযোগ দিলো।
খাওয়া শেষে দ্রুত তৈরী হয়ে নিলো রোযা। নিজের পছন্দের কচুপাতা বর্ণের কামিজ পরিধান করে সকালে তৈরী করা নাস্তা একটি টিফিন বক্সে ভরে নিলো।নিজের হ্যান্ডব্যাগটিতে প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে দরজায় তালা আটকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে আরম্ভ করলো নিচে। একটি চারতলা বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠার এক কক্ষবিশিষ্ট ঘরে গত দেড় বছর যাবৎ বসবাস করে আসছে রোযা।

দুই তলায় পৌঁছে কাঠের উপর চিত্রখচিত শৈল্পিক সৌন্দর্যের অধিকারী দরজাটিতে কড়া নাড়লো রোযা।পাক্কা দুই মিনিট অপেক্ষার পর গোলগাল শরীরের এক মহিলা দরজা খুলে দিলো। রোযাকে দেখেই তার ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত হয়ে উঠল ঘৃণায়।তার বিরক্তি উপলব্ধি করা সত্ত্বেও মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করলো রোযা।তারপর নিজের ব্যাগ থেকে একটি খাম বের করে এগিয়ে দিলো,
– গত দুই মাসের ভাড়াটা আন্টি।
রীতিমত ছো মে*রে রোযার হাত থেকে খামটি নিয়ে তৎক্ষণাৎ তার সামনেই মহিলা টাকা গুণতে আরম্ভ করলো।তাতে বিব্রতবোধ করা সত্ত্বেও রোযা কোনোপ্রকার শব্দ উচ্চারণ করলোনা।টাকা গোণা সমাপ্ত করে খানিক সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে রোযার দিকে চাইলো মহিলা।

– ব্যাপার কি বলো তো?এইবার তাগাদা দেয়ার আগে আগেই ভাড়া দিয়ে দিলে যে? নতুন চাকরি হয়েছে নাকি?
অস্বস্তির সাথে হাসলো রোযা।সে মুখ খোলার পূর্বেই মহিলা অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে শুধালো,
– নাকি আবার কোনো অনৈতিক কাজে জড়িয়েছ?
রোযার হাত চেপে বসলো তার ব্যাগের হাতলে, নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় লিপ্ত হলো সে।মহিলা নির্বিকার চিত্তে বলে চলেছে,

– দারোয়ান জানিয়েছে রাত করে বাড়ি ফেরো।অত রাতে কিসের অফিস তোমার?আমি যা ভাবছি তাই?কদিন আগে তো কিছুদিনের জন্য উধাও হয়ে গিয়েছিলে।ব্যাপার কি?
– দেখুন।আপনি এই বাড়ির মালিক এবং আমি আপনার ভাড়াটিয়া।কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আপনি আমার ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে এভাবে জেরা করতে পারেন কিংবা আমাকে অপমানিত করতে পারেন।
শক্ত কন্ঠে জানালো রোযা।তার দৃষ্টির কাঠিন্য লক্ষ্য করে কিছু মুহূর্তের জন্য ভড়কে গেলো বাড়িওয়ালী মহিলা।কিন্তু পরক্ষণেই আবার পানের রসে লাল হয়ে ওঠা ঠোঁটে ঢেউ খেলিয়ে হেসে বললো,
– ব্যাচেলর ভাড়া দেইনা।তার উপর একলা মেয়ে কোনো প্রশ্নই আসেনা।কিন্তু তোমার অসহায়ত্ব দেখে কষ্ট লেগেছিল তাই দিয়েছি।তার প্রতিদান হিসাবে এমন ব্যবহার চাইনি ঠিক আছে? তিন চার মাসের ভাড়া জমা থাকে। কোথায় না কোথায় কাজ করো তাও জানিনা। সন্দেহ হওয়া কি অস্বাভাবিক?

রোযা চুপ করে রইলো।তার কাছে দেয়ার মত কোনো জবাব নেই। এই মহিলা যেদিকে ইশারা করছে তেমন কোনো কাজ রোযা না করলেও ঠিক নৈতিক কোনো কাজও করেনি। হ*ত্যা করতে সাহায্য করেছে!এমন কিছু সুশীল কোনো ব্যক্তির নিকট কাম্য নয় তা রোযা খুব ভালো করেই জানে।
– এক মাস সময় দিচ্ছি।আগামী মাসে চিলেকোঠার ঘর ছেড়ে দেবে।আমার কলেজপড়ুয়া ভাইপো থাকবে।
এটুকু বলেই মহিলা রীতিমত রোযার মুখের উপর দরজা আটকে দিলো।হতভম্ব হয়ে নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকলো রোযা।সম্পূর্ণ এক মিনিট পর যেন তার বোধোদয় ঘটলো।সিক্ত হয়ে ওঠা আঁখিজোড়া ওড়নার প্রান্ত দিয়ে দ্রুত মুছে নিয়ে উল্টো ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলো সে।আজকের কাজ বেড়ে গেলো।নতুন করে থাকার জায়গারও সন্ধান করতে হবে!

সি এন জি ভাড়া মিটিয়ে হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশ করতে রোগী এবং তাদের আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা চোখে পড়ল রোযার।নিজের ওড়নাটা গুছিয়ে নিয়ে সে চললো লিফটের উদ্দেশ্যে।নবম তলার বোতাম চেপে পৌঁছানোর পর নির্দিষ্ট কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে নিজেকে শান্ত করলো।চেহারায় উৎফুল্ল মনোভাব এবং অধরে ফুটিয়ে তুললো সমুজ্জ্বল হাসি।দরজা ঠেলে ঢুকতেই নীল পোশাক পরিহিত নার্সকে একপাশে দাঁড়িয়ে একটি ক্লিপবোর্ডে কিছু নোট করতে দেখলো সে।তারপরই বিছানায় দৃষ্টি পড়লো তার।
ধবধবে সাদা চাদর বিছানো বিছানায় শুয়ে রয়েছে একজন বৃদ্ধ।পরনে হাসপাতালের আরামদায়ক বস্ত্রের শুভ্র পোশাক।মাথায় চুল বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই, শুধুমাত্র চকচকে এক চাদি।দুর্বল চেহারার চামড়া কুঁচকে এসেছে অনেকখানি,বয়সের ভার এবং অসুস্থতার প্রভাবে শরীর এতখানি শুকিয়ে এসেছে যে পাঁজরের হাড়গুলোও নজরে পরে স্পষ্ট।হাতের কব্জিতে সংযুক্ত ক্যানোলা, নাকের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে নাসাল ক্যানোলা, যা দিয়ে ক্রমাগত অক্সিজেন প্রবাহিত করা হয়।
মানুষটার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে জোরপূর্বক নিজের অশ্রুকে বাঁধা প্রদান করলো রোযা।অনতিবিলম্বে ঠোঁটে সুবিস্তৃত হাসি ফুটিয়ে সে বিছানার কাছে ছুটলো,

– দাদু!
বৃদ্ধ চোখ বুজে শুয়েছিলেন। সম্বোধনটি তার কর্ণগোচর হতেই তাকালেন। রোযাকে দেখেই তার দুর্বল চেহারার শুষ্ক অধরে হাসির ধারা ছড়িয়ে পড়লো।
– আমার চড়ুই, তুমি এসেছ!
তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে নিজের দাদুকে আলিঙ্গন করলো রোযা।হৃদয়ে জাগ্রত হওয়া বিষাদের পর্বত যেন অতি আপন এই মানুষটার সামান্য ছোঁয়াতেই রূপান্তরিত হলো স্নেহের উষ্ণতায়।
– কেমন আছো দাদু?
– একদম ফিট!এই দেখো…
বিছানায় উঠে বসে নিজের শীর্ণ বাহুতে চাপড় মেরে জানালেন বৃদ্ধ।তাতে খিলখিল করে হাসতে আরম্ভ করলো রোযা।

– হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি।খুব শীঘ্রই তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে এবং এই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরবে। জানো দাদু, কি হয়েছে?
নিজের সাথে করে আনা টিফিন বক্স থেকে খাবার বের করে থালায় সাজিয়ে রাখতে রাখতে রোযা রাজ্যের গল্প করতে শুরু করলো।যে কয়েকদিন সে দাদুকে দেখতে আসেনি সে কয়েকদিন তার জীবন কেমনভাবে কেটেছে প্রত্যেকটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলো।অবশ্যই আসমান সম্পর্কিত সকল কথা বাদ দিয়ে।
অপরদিকে অতি উৎসাহের সঙ্গে নিজের নাতনীর সকল কথা শুনতে থাকলেন ইউনূস রহমান।তিনি খুব ভালোমতই অবগত যে রোযার তার সুস্থ হওয়া এবং বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার বক্তব্য সত্যি নয়। গত দেড় বছর যাবৎ তিনি এই হাসপাতালের চার দেয়ালে ঘেরা কেবিনে খাঁচায় বন্দী পশুর ন্যায় আবদ্ধ হয়ে রয়েছেন।তার শরীরে বাসা বেঁধেছে ম*রণব্যাধি ক্যান্সার। ডাক্তার বহু আশার বাণী শোনালেও সেসব যে শুধুমাত্র মিথ্যা আশ্বাস সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত।বর্তমানে যা হচ্ছে তা তার মৃ*ত্যুকে বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা ব্যাতিত আর কিছুই নয়।কিন্তু নিজের কোলেপিঠে করে মানুষ করা একমাত্র নাতনীকে তিনি কিছুতেই বোঝাতে সক্ষম নন।

—আমার দেহে সর্বশেষ র*ক্তবিন্দু থাকতে আমি তোমার কিছু হতে দেবোনা দাদু…..
মেয়েটির সেই শপথের জোরেই হয়ত আজ সম্পদ, স্বাস্থ্য সকলকিছু হারিয়েও জীবনযু*দ্ধে লিপ্ত রয়েছেন ইউনূস রহমান।
নিজের দাদুর সঙ্গে প্রায় দুপুর পর্যন্ত সময় পার করলো রোযা।অতঃপর ডাক্তার কেবিনে রেগুলার চেকআপের জন্য এলে দাদুকে বিদায় জানিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে তার কক্ষে আসলো রোযা।চেয়ারে বসতেই ডাক্তার একটি ডায়েরীতে কিছু লিখতে লিখতে রোযাকে জানালেন,
– আপনার দাদুর স্বাস্থ্য আপাতত স্থিতিশীল রয়েছে।তবে কতক্ষন থাকবে তার গ্যারান্টি দেয়া দুষ্কর। এই মুহূর্তে আমাদের চিকিৎসায় অগ্রসর হতে হবে।

– জ্বি অবশ্যই। আমি টাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছি ডক্টর। আপনি প্লীজ যথাযথ চিকিৎসার আয়োজন করুন।
উদগ্রীব হয়ে ব্যক্ত করলো রোযা।ডাক্তার কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেন।পরমুহুর্তে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– মিস রোযা।অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আপনাকে জানাতে হচ্ছে যে বর্তমানে শুধুমাত্র থেরাপির উপর নির্ভর করে আপনার দাদুকে রক্ষা করা যাবেনা।
নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে টাকার বান্ডিল বের করতে করতেই থমকে গেলো রোযা।হতভম্ব দৃষ্টিতে চাইলো ডাক্তারের উদ্দেশ্যে।বয়স্ক অথচ কঠোর ব্যক্তিত্বের অধিকারী পুরুষটির দৃষ্টির মাঝেও কিছুটা বিষাদ প্রকাশ পেলো।
– মেডিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যান্সারের জন্য লেটেস্ট একটি ঔষধ বের হয়েছে।এখনো বহুলভাবে ব্যবহার আরম্ভ হয়নি।আমার কিছু সোর্স আছে, আমেরিকান ল্যাবরেটরির সাথে যুক্ত।আমি যোগাযোগ করে সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে পারি।কিন্তু…

– কিন্তু?
একটি ঢোক গিললো রোযা।ডাক্তার নিজের হাতের আঙুলের দিকে তাকালেন।বছরখানেক ধরে পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি, এই মেয়েটি নিজের একমাত্র পারিবারিক সদস্যকে রক্ষার জন্য কি না করছে!বয়স কত হবে তার? বাইশ…খুব বেশিতে চব্বিশ?কিন্তু তাতেই সে এতকিছু করেছে যা অভিজ্ঞ কারো পক্ষেও হয়ত করা সম্ভব হতোনা কোনোদিন। হাল ছাড়তে রাজি নয় সে। প্রয়োজনে যেন যমের সঙ্গেও যুদ্ধে লিপ্ত হবে! এই মুহূর্তে এসে তাই মেয়েটিকে পুনর্বার চাপ দিতে একজন মানুষ হিসাবে তার হৃদয় বাঁধছে।তবুও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় পাথরকাঠিন্য ধারণ করা হৃদয়কে নাগালে নিয়ে তিনি বললেন,

– নিউলি লঞ্চড প্রোডাক্ট।অনেক দাম পড়বে। তাছাড়া এর সাইড এফেক্ট সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই যেহেতু ব্যবহার হয়েছে খুবই কম।কিন্তু ঝুঁকি না নিলে হয়ত আপনার দাদুকে বাঁচানো সম্ভব হবেনা।
মাথা ঝুলে পড়ল রোযার। তার সম্পূর্ণ পৃথিবী যেন এক নিমিষেই শূন্যতায় ছেয়ে গিয়েছে।কোনপ্রকার অনুভূতিও সে অনুভব করতে পারছেনা।তার দৃষ্টির সামনে যেন শুধুই আঁধার। ব্যাগ চেপে ধরে বসে থাকলো রোযা।ডাক্তার তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন।পানিটুকু পান করে সহসাই উঠে দাঁড়ালো সে।ডাক্তার বিড়বিড় করলেন,

– আমি আপনাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারি।কিন্তু…
– ধন্যবাদ ডক্টর।আপনি ইতোমধ্যেই আমার জন্য অনেক করেছেন।নিজেকে আর ঋণী করতে চাইনা।
রোযার শীতল কন্ঠে থমকে পড়লেন ডাক্তার।নিজের কপালে ছড়িয়ে পড়া চুল কানের পিছনে গুঁজে রোযা হড়বড় করে বলল,
– আমি টাকা জমা করে দেবো।আপনি আপাতত রেগুলার থেরাপি জারি রাখুন।আর নতুন ঔষধের ব্যাপারে….আমায় কিছুটা সময় দিন।আমি ঠিক একটা ব্যবস্থা করবো।
এটুকুই।ডাক্তারের সঙ্গে দৃষ্টি মেলানোরও সাহস করলোনা রোযা।সোজা হেঁটে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।তার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার।তারপর মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলেন নিজের রিপোর্ট তৈরিতে।

আধুনিক সব আসবাবপত্র এবং শৈল্পিক নিদর্শনে সজ্জিত ঘরটি একদম নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে রয়েছে এক রমণী। শূণ্য তার চোখের দৃষ্টি।যদিও মাত্র কিছুদিন পূর্বেই সে নিজের স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হয়েছে, তার লেশমাত্র নেই অবয়বে।চুলের যত্নের অভাব ঘটেনি, পোশাকেও আভিজাত্য, এমনকি তীক্ষ্ণ নখেও জ্বলজ্বল করছে কালো বর্ণের নেইলপলিশ।শুধুমাত্র দৃষ্টিই কিঞ্চিৎ বিষন্ন, এই যা।
নিজের পুত্রবধু লামিয়া হাওলাদারের দিকে চেয়ে অন্তরে অদ্ভুত এক বিস্বাদ অনুভব করলেন বাদশাহ কায়সার।তার স্ত্রী পুত্র হারানোর শোকে যেখানে রীতিমত শয্যাশায়ী সেখানে পুত্রের স্ত্রীর এমন বহিঃপ্রকাশ তাকে যারপরনাই অবাক করছে।নিজের শ্বশুরের দিকে চাইলো লামিয়া।ভয় কিংবা সম্মানের চিহ্নটুকুও নেই তার মাঝে।

– আপনি জানতেন সে কোথায় যাচ্ছে এবং কার সাথে যাচ্ছে।তাইনা বাবা?
জবাব দিলেন না বাদশাহ।চেয়ে রইলেন অদূরপানে।তার ঈষৎ কুঞ্চিত চেহারায় অব্যক্ত অনুভূতি প্রকাশ পেলো।
– আপনিই তাকে মৃ*ত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন বাবা।
যথারীতি কোনো উত্তর নেই।লামিয়া অপেক্ষা করলোনা। উঠে দাঁড়িয়ে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলে গেলো নিজের রুমের দিকে।অপরদিকে সোফায় হেলান দিয়ে নিঃশব্দে বসে রইলেন বাদশাহ।
যদিও নাবিলকে সন্তান হিসাবে এক কথায় কুলাঙ্গার বলে সম্বোধন করবেন তিনি, তবুও!নিজের ছেলেই তো, নিজের র*ক্ত!কি কৌতুকপূর্ণ আত্মবিসর্জনই না সে দিলো। চিতাবাঘের আ*ক্রমণ?!
অর্থ এবং ক্ষমতার জোরে ছেলে সম্পর্কিত যেকোনো অভিযোগ, কেলেংকারী থেকে তিনি সর্বদা রেহাই পেয়েছেন। এই জোরই তাকে সাহায্য করেছে অহেতুক কেইস এবং পোস্ট মর্টেম থেকে রেহাই পেতে।কিন্তু তিনি জানেন, তার মন বলছে, তার ছেলে দুর্ঘ*টনার শিকার নয়…..এর পিছনে ভিন্ন কোনো কাহিনী রয়েছে।

ঠিক কত সময় পেরিয়েছে তিনি ঠাওর করতে পারলেন না।হঠাৎ কারো পদশব্দে তিনি চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন। নাবিলের সেক্রেটারি এবং তার নিজের অতি বিশ্বস্ত লোক আকাশ তার সামনে এসেই মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করলো।তারপর একটি ফাইল বাড়িয়ে দিলো বাদশাহ কায়সারের দিকে।
ফাইলটি নীরবে হাতে নিয়ে খুলতেই সর্বপ্রথম এক রমণীর হলুদ শাড়ী পরিহিত একটি ছবি তার দৃষ্টি কাড়লো।
– রোযা রহমান চড়ুই। ছদ্মনাম সুমি। সাজেক ভ্যালিতে এই মেয়ের সঙ্গেই গিয়েছিলেন স্যার।
– হেহ! ডু ইউ থিঙ্ক শি কি*ল্ড মাই সন্?
আকাশ মেঝের দিকেই তাকিয়ে রইলো।পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় জবাব দিলো,

ডার্কসাইড পর্ব ৩

– ইট ওন্ট হার্ট টু বি শিওর।
– হুম। কে বি ইন্ডাস্ট্রির শত্রু, সে যত ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতরই হোক না কেনো, যথাযথ শাস্তি তাকে পেতেই হবে। আফটার অল, উই অলওয়েজ ক্রিয়েট অ্যান এক্সাম্পল!
ছবিটার দিকে তাকিয়ে নিজের পুত্রের মৃ*ত্যুর পর এই প্রথম হাসলেন বাদশাহ কায়সার।

ডার্কসাইড পর্ব ৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here