The Silent Manor part 12
Dayna Imrose lucky
নিস্তব্ধ রাতে ফারদিনা আর কিছু ভাবতে চাইলো না। সুফিয়ান পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।মদ এর নেশা না থাকলে এতটা তীব্র ঘুম তার কখনোই হত না। সুফিয়ান ফারদিনার এতটা কাছে অথচ দুজনেই যেন চুপচাপ। সুফিয়ান না চাইতেও ঘুমে,আর ফারদিনা চেয়েও তাঁর সাথে গল্পগুজব করতে পারছে না।সে ঘরের মধ্যেই বড্ড বিরক্তি নিয়ে পায়চারি করছে।
রাত ঠিক শেষ পর্বের কাছাকাছি। ঝিলমিল উপস্থিত হল।হাতে আঙুর ফল। ঘরের চারদিকে মোমবাতি,আর মশাল। সুফিয়ান এর মুখটি এখন সোনালী রঙের মত জ্বলজ্বল করছে। ঝিলমিল তাঁর দিকে এগিয়ে গেল।ফারদিনাকে উদ্দেশ্যে করে রং ঢং করে বলল “এই রাইতের সুযোগ হাত ছাড়া কেন করতেছো? তারে জাগাও। এরপর চাঁদনী রাতে ঘুরতে যাও।’
‘কি বলছিস,নেশার ঘোরে আছে।ডাকলেই জাগব নাকি?
‘আমি জাগামু!
‘কিভাবে?
‘হাকিমরা নেশা কাটানোর জন্য কি করে জানোছ না!দই ছাছ অথবা তেঁতুল এর তৈরি করা জড়িবুটি।এতে নেশা কাটে।’
‘যা জলদি নিয়ে আয়।’
‘কিন্তু প্রতিটি কাজের ই পারিশ্রমিক আছে।আমিও এই কাজটা পারিশ্রমিক নিয়াই করতে চাই।’
‘উফ কি চাস তুই!
‘আমারে সোনার একখান আংটি দিতে হইবো।ক দিবি ?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘দিব যা এখন।’ ঝিলমিল চলে গেল জড়িবুটি আনতে। পনেরো মিনিট পর হাজির হয়।রাত এখন ঠিক চারটা । ঝিলমিল জড়িবুটি ফারদিনার হাতে তুলে দিয়ে চেয়ারে হাঁটু ভাঁজ করে বসে মনের আনন্দে আঙুর ফল খাচ্ছে।
জড়িবুটির জল সুফিয়ান এর মুখে চামচের সাহায্যে দেয়া হল।যতই ঘুমে থাকুক না কেন হাকিম এর মতে মদ এর নেশা কাটানোর জন্য এই জড়িবুটি যখন এক চুমুক পেটে যায় তাঁর নেশা তখন কাটতে শুরু করে। সুফিয়ান নড়চড় শুরু করল।ফারদিনার মুখে হাঁসি আসল।জড়িবুটি পুনরায় মুখে দিল।
সময় চলে যাচ্ছে। সুফিয়ান এর সেভাবে ঘুম কাটছে না। ঝিলমিল বলল ‘চিন্তা করিস না। তাঁর ঘুম কাইটা যাইবো।একটু ডাক,গায়ে হাত দে। উঠে যাইবো।’
সত্যিই তাই। সুফিয়ান চোখ মেলে চাইল। আশেপাশের সবকিছু যেন তাঁর কাছে অচেনা মনে হল।কোন শত্রুতা হয়ত আক্রমণ করেছে। এরকম ঘরে তো তাঁর থাকার কথা নয়।মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন পর তাঁর হুঁশ ফিরেছে।
“তুমি এখানে? সুফিয়ান ঘুম ঘুম চোখে প্রশ্ন ছুঁড়ল।
‘আমি এখানে না। তুমি এখানে!’
‘কিভাবে এলাম?
“এই ঘরে এসেছো মদ এর ঘোরে। তাঁর আগের কথা আমি বলতে পারব না।’
সুফিয়ান এর মনে পড়ল পাঁচুর কথা।ও নিখোঁজ।ওর জন্যই আদিব এর সাথে আলাপ করার জন্য এখানে সে এসেছে। এরপর বাইজি দের চক্করে পড়েছিল।
সময় এখন চারটা ত্রিশ। সুফিয়ান কে হাত মুখে জল দেয়ার জন্য ঝিলমিল একটা হাঁড়িতে জল নিয়ে আসল। সুফিয়ান মুখে জলের ঝাপটা দিল। এখন বেশ সতেজ লাগছে তাঁর। মদ্যপান সে আগে কখনো করেনি। হঠাৎ মদ পান এর জন্য সে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
‘আমি বাড়ি যাব। আগামীকাল আসব।একটা কাজেই এসেছিলাম।’
‘এত রাতে কেন যাবে? বিপদ হতে পারে।’ ফারদিনা বলল।
“হোক।ঘুম যখন ভেঙ্গেই গেছে আর এই দেয়ালের মাঝে ঘুম হবে না। আমার পর্যাপ্ত ঘুম দরকার।’
‘তার চেয়ে চলো আমরা বাইরে থেকে ঘুরে আসি। যাবে?
‘এত রাতে?
‘ভয় পাচ্ছ? বলে ফারদিনা হেসে উঠল।
“বললাম তো,আমি ভয় পাই না। তোমাকে নিয়ে ভয়!
‘কেন?
‘কলঙ্ক লাগবে।পাপ হবে।’ সুফিয়ান কোনভাবেই যেন যেতে রাজি হইল না। ঝিলমিল তখন মায়ার দিকে এগিয়ে গেল।গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল ‘যাগ কে।বাদ দে।তোর মামাতো ভাই শুনেছি আগামীকাল চলে আসবে। তাঁর সাথেই রাইতে ঘোরার ইচ্ছা টা পূর্ণ করবি।’
‘চলো’ সুফিয়ান রাজি হল। জমিদার বাড়ির পেছনের পথ ধরে দুজনে বাইরে বের হয়। চারদিক থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে।যে পথে এগোচ্ছে সে পথে ধানের সারি। বাতাসে দুলে ওঁরাও যেন চাঁদনী রাত উপভোগ করছে। ধানের মাঠ এর চারপাশে বড় বড় গাছের সারি। নির্জন এরকম একটি রাত ফারদিনা এর আগে উপভোগ করেনি।আজ করছে। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে তাঁর।চোখ তুলে একবার সুফিয়ান এর দিকে তাকাল। “তোমার ভালো লাগছে না?
‘লাগছে’
‘তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি।দিব?
‘দাও’
ফারদিনা সিগারেট বের করে দিল। সুফিয়ান হাত বাড়িয়ে নিল। ‘ধরাবো কিভাবে?
‘লুসিফার ম্যাচ এনেছি।আমি ধরিয়ে দেই?
‘দাও।’
‘আমি দেখব তোমার সিগারেট এর ধোঁয়া কোনদিকে উড়ে যায়।’
‘এতে কি হবে?
‘তোমার সিগারেট এর ধোঁয়া যদি আমার দিকে আসে তবে ধরে নেব তুমি কাউকে ভালোবাসো?
‘এটা অযৌক্তিক।আর ধোয়াও তোমার দিকে যাবে না।’
সুফিয়ান ধোঁয়া ছাড়ল।আর ধোঁয়া ফারদিনার দিকে উড়ে গেল।সে হেসে ফেলল। তাঁর হাঁসি দেখল সুফিয়ান।নিজেও মৃদু হাসল। ‘আমি বলেছিলাম না,আমি বুঝে ফেলব।’
সুফিয়ান হাসল। কিচ্ছুটি বলল না।ফারদিনাও চুপচাপ। আবহাওয়া ঠান্ডা হয়ে গেল। কুয়াশা পড়ছে। ঠান্ডার গতি শক্তি যেন বেড়ে গেল। ধানের মাঠ পেরিয়ে একটা বড় গাছ দেখল।যার শিকড় গুলো চিরদিকে গোল হয়ে ছড়িয়ে আছে। তাঁরা দুজন সেখানে বসল। সুফিয়ান প্রথম ফারদিনার ডান দিকে বসে,ঘুরে আবার ডান দিকে বসল।
“এপাশে কেন আসলে?
“ওপাশ থেকে সিগারেট এর ধোঁয়া তোমার নাকে আসত। অসুবিধে হত।’
‘আমার তো বেশ ভালো ই লাগছে।’
‘গল্প শুনবে?
‘শুনব। কেমন গল্প?
“বাস্তব গল্প।এক ছিল রাজকুমারী।ভারী সুন্দরী ছিল। তাঁর রুপে সবাই মুগ্ধ হত।সে চঞ্চল এবং রাগী ছিল।খুব সহজে রাগ দেখাত না।সাত ভাইয়ের এক বোন ছিল। তাঁর মা ছিল না।ছিল দুধ মা।মা আগেই মারা যায়। রাজকুমারী ছিল সাত ভাই ও তাঁর বাবার ভীষণ আদদের।’ সুফিয়ান থামল। সিগারেট শেষ পর্যায়ে।
‘তারপর কি হল?
“রাজকুমারী এক সাধারণ প্রজার প্রেমে পড়ে।প্রজা ছিল সুদর্শন পুরুষ।যার রাগ,তেজ আত্মসম্মান বোধ ভারী কঠোর ছিল।’
‘তারপর কি হল?
‘রাজকুমারী তাঁর ভালোবাসার কথা প্রকাশ করলে প্রজা রাজি হয়। এভাবে কিছুদিন সবকিছু ভালোভাবে চললেও হঠাৎ একদিন রাজকুমারী অসুস্থ হয়ে পড়ে।…’ সুফিয়ান থেমে গেল।সে চোখের কর্ণার থেকে আপছা কারো ছায়া দেখতে পেল।গল্পটা অসমাপ্ত থাকল।
রাত এখন শেষ এর দিকে। সুফিয়ান ফারদিনাকে চুপ থাকার ইঙ্গিত দিয়ে,নিজের পিছনে নিয়ে গাছটার পেছনের দিকে খুঁজতে শুরু করল আপছা ছায়া গুলোকে।
ওঁরা ছায়া না।চার চারটে মানুষ। সুফিয়ান কে দেখে একজন দৌড়ে পালাল।আর একজন দৌড় এর জন্য প্রস্তুত হল।বাকি দু’জনকে সুফিয়ান ধরে ফেলল। ওঁরা দু’জন কাপা কাঁপা গলায় মাফ চাইছে।
‘আমাদের কিছু করবেন না।আর এরকম কিছু করব না’
ওঁরা কি বলতে চাইছে সুফিয়ান বুঝতে পারল না। প্রশ্ন করল। “কি করবি না? এখানে লুকিয়ে ছিলিস কেন? আমাদের চুপচাপ দেখছিলি কেন?
ওঁরা দু’জন দু’জনের দিকে দেখল। কন্ঠ ভারী।দেহ ভারী।চুল গুলো বড় বড়।মনে হচ্ছে অনেক দিন কাটে না। কন্ঠে ধরা গেল বয়স আনুমানিক চল্লিশ।
‘জবাব দে!”
‘আমরা চোর।গরু চোর।আজ রাতে একটাও গরু চুরি করতে পারি নাই।তাই তালুকদার বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম।এমন সময় আপনাদের দেখি।’
ফারদিনা হেসে বলল ‘তোমরা সত্যিই চোর! তাহলে আমিই তোমাদের গরু চুরি করতে সাহায্য করব।’
‘এগুলো কি বলছো! তুমি সাহায্য করবে মানে? সুফিয়ান জিজ্ঞেস করল।
‘কারণ আমাদের খামার থেকে কিভাবে গরু চুরি করা যাবে সেটা আমিই ভালো জানব।তাই না?
চোর দুটো নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে বলল “জমিদার এর মেয়ে কি আধা পাগল?
অপরজন বলল ‘মনে হয় পুরোটাই পাগল’
সুফিয়ান ফারদিনার কথা উপেক্ষা করে চোর দুটোকে বলল “চুরি করা অন্যায় জানিস তো?বল, এখন পর্যন্ত কত গরু চুরি করেছিস? আমি কিন্তু তোদের চিনে ফেলেছি।সত্য না বললে কিন্তু কালই রশীদ তালুকদার এর কাছে সব সত্য বলে দেব’
‘এরকম টা করবেন না। এখন পর্যন্ত ত্রিশ টার উপরে গরু চুরি করেছি।সব বিক্রি করে টাকা খরচ করে ফেলেছি।’
সুফিয়ান ওদের কলার ছেড়ে দিল। গাছের শিকড়ের উপর বসল। ওদেরও বসতে বলল।ওঁরা হাঁটু ভাঁজ করে বসে। সুফিয়ান দৃঢ় কন্ঠে বলল “চুরি করা মানে অন্যর হক ছিনিয়ে নেয়া।সব পাপের মধ্যে এটাও অন্যতম পাপ।এখন পর্যন্ত অনেক এর হক মেরে খেয়েছিস।আমি তোদের সত্য বলব না একটা শর্তে!’
‘কি শর্ত?
‘তোরা আর চুরি করবি না।হালাল পথে চলবি!ধর্ম কর্ম পালন করা হয়?
দু’জন একসাথে দুই ধরনের জবাব দিল। একজন বলল হয় অন্য জন বলল না। সুফিয়ান না’ ধরে নিল।
‘ধর্মকর্ম পালন করতে হবে। চুরি ছেড়ে দিতে হবে।’
‘কিন্তু আমরা খাব কি করে?
‘কৃষিকাজ করে। আমাদের সাধারণ মানুষ এর জন্য কৃষিকাজ রয়েছে।’
‘কৃষিকাজ এর জন্য জমি দরকার। নিজেদের না হলেও বর্গা দরকার।কে দিবে জমি,কার জমিতে ফসল ফলাব?
‘আমি দেব।তোরা আমার সাথে কাজ করবি।করবি?
ওঁরা ভেবে জবাব দিল “করব।’
‘তোদের সাথে যে দু’জন ছিল ওদের ও আগামীকাল নিয়ে আসবি আমার বাড়িতে। নিয়ে আসবি তো?
“আসব’
‘তোদের বাড়িঘর আমি চিনি।তোরাই যে চোর তা জানতাম না। এখন বল তোদের নাম কি?
ওঁরা ভেবে বলল ‘আমার নাম বদরু কালাই।’ অপরজন বলে ‘হাবলু লাঠিয়াল।’
‘লাঠিয়াল? সুফিয়ান নিচু স্বরে বলল।
‘আগে আমি লাঠিয়াল দলে ছিলাম।সময় এখন আমায় গরু চোর বানিয়ে দিয়েছে।’
‘অসাধারণ।’ সুফিয়ান হাঁফ ছেড়ে বলল। অসাধারণ বলায় হাবলু দাঁত বের করে হিহি করে হেসে উঠলো।
‘হাসছিস কেন?
‘ঐ যে আপনি অসাধারণ বললেন!’
‘তোদের পূর্ব পরিচয় শুনে অবাক হলাম।যাক গে, ভোর বেলার কাছাকাছি সময়।আজ চলে যা। আগামীকাল তোরা চারজন আমার বাড়িতে আসবি।মনে থাকবে?
‘থাকবে’। ওঁরা চলে যায়।
ফারদিনা এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। এতক্ষণ পড়ে সবে মুখ খোলার সময় হলে যেন তাঁর।কিছু বলার আগেই সুফিয়ান বলল ‘তুমি ওদের চুরি করার জন্য উস্কানি দিচ্ছেলে কেন?
‘ওরা যদি আজ গরু চুরি করত, আগামীকাল সেসব নিয়ে ভাইয়েরা ব্যস্ত থাকত। কিছুদিন হয় চুরি নিয়ে অভিযোগ আসছে। তাঁরা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকত।আর আমি এদিকে তোমার সাথে সময় কাটাতে পারতাম। ভালো হত না?
‘মোটেই না।’ বলে সে হাঁটা শুরু করল তালুকদার বাড়ির দিকে।
‘কেন?
‘ভাগ্যিস ওঁরা আজকে আমার কাছে ধরা পড়েছে। যদি তোমার ভাইদের কাছে পড়ত তাহলে আস্ত রাখত না।’
‘তাহলে তুমি ওদের ছেড়ে দিলে কেন?
‘প্রতিটা মানুষকেই ভালো হওয়ায় একটা সুযোগ দিতে হয়। ওদের ও দিয়ে দেখি।’
‘ওরা কখনোই আসবে না তোমার কাছে।আর চুরি করাও বন্ধ করবে না। তুমি কি ওদের সত্যিই চেনো ?
‘না’
‘তাহলে মিথ্যা বললে কেন?
‘ওদের চিনে ফেলেছি বলছি দেখে ওরা ভয় পেয়েছে। আগামীকাল নিশ্চিত আসবে।!’
‘আমি নিশ্চিত আসবে না।আসলে কি তোমার ক্ষেতে কাজ দিবে?
‘দেব’
‘ওরা তোমাকে ঠকাবে।’
‘দেখা যাক।
বলতে বলতে তালুকদার বাড়ির পেছনে চলে আসে তাঁরা দুজন। সুফিয়ান ফারদিনার দিকে চেয়ে বলল ‘সারারাত ঘুমোয় নি। এখন গিয়ে বিশ্রাম নাও।’
‘তুমি চলে যাবে?
‘যেতে তো হবেই।’
‘আবার কবে দেখা হবে আমাদের?
‘এমন ভাবে বলছো আমি যেন বিদেশ থাকি।আমি আসব আদিব ভাইয়ের সাথে কথা বলতে।’
সুফিয়ান চলে যেতেই ফারদিনা দাঁড় করিয়ে দেয়। ‘শোনো’
‘বলবে কিছু?
‘অন্যদিন।’ বলে ফারদিনা প্রাচীর এর ছোট্ট দরজা থেকে ভেতরে প্রবেশ করতেই সুফিয়ান শোনো বলে দাঁড় করিয়ে দিল’।ফারদিনা ঠোঁটের ফাঁকে হাঁসি এনে বলল ‘কিছু বলবে?
‘জড়িবুটি দিয়ে মদ এর নেশা কাটানোর জন্য ধন্যবাদ।’
আজ রোববার। চৌরঙ্গী হাট বাজার বসেছে। রশীদ তালুকদার শহর থেকে ফিরেছেন।বাড়ির বিশ্বস্ত কাজের লোক কুদ্দুস। রশীদ এর কাছে নামটা বেশ বড় মনে হয়।তাই সে ছোট্ট করে কালু ডাকে।দেখতে শুনতেও কালো। উচ্চতা চার ফুট দশ ইঞ্চির মত।ওকে কিছু টাকা এবং বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছে।তাজা মাছ, মাংস, সবজি সবকিছু আনতে বলেছে। ‘কালু,তোর বাজারে এর আগের বার ভুল ছিল।ওজনে। পাঁচশো গ্রাম আলু কম ছিল। কিন্তু টাকাও পাইনি।টাকা তুই মেরে দিয়েছিস। ০.৫ পয়টা টাকা। মেরেছিস কিনা?
“মেরেছি’
‘এর জন্য শাস্তি দরকার কি না?
‘দরকার।’
রশীদ সিগার ফুকল। কিছু টাকা কুদ্দুস এর দিকে এগিয়ে দিল।
‘এখন আমি যাব?
‘আমি না থাকাকালীন কেউ এসেছিল?
‘এসেছিল!’
‘কে এসেছে?বলিসনি তো।’
‘ডাকরানার’
‘কে চিঠি পাঠিয়েছে?
‘একজন দারোগা।’
‘কই দে দেখি’
‘আপনার না পড়াই ভালো। খারাপ লাগবে!’
রশীদ রেগে গেলেন। ‘দে বলছি।’
কুদ্দুস চিঠি দিল। রশীদ মিনিট পাঁচেক ধরে চিঠি পড়ল।পরা শেষে মৃদু হাসল।
‘কি বুঝলেন পড়ে? কুদ্দুস জিজ্ঞেস করল।
‘যা বুঝলাম, দারোগার নিব কলমের কালির অভার।সাথে সাতটা বানান ভুল।’ বলে হেসে উঠলো।
‘আপনাকে তো আজেবাজে কথা বলল উনি। জমিদারি ঠিক মত ইদানিং পালন করছেন না।আর আপনি হাসছেন?’
‘শোন কালু, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বেশি বেশি হাসতে হয়।খারাপ সময় একটু বেশিই হাসতে হয়।এতে কি হয় জানিস?
‘আপনি বললে জানব’
‘মন সতেজ হয়।যা এক কাপ চা নিয়ে আয়।’
‘বাজারে যেতে দেরী হবে না?
‘হবে না।আগে বাজার না আমি?
‘আপনি।’ কুদ্দুস জানে রশীদ এর কথার পাল্লায় পড়লে শেষ।
চা নিয়ে আসে কুদ্দুস।চা হাতে নিয়ে চুমুক দিল রশীদ। কুদ্দুস বলল ‘এখন আমি যাই?
‘আগে আমি চা পান করি।চায়ে ভুল থাকতে পারে।’
‘চায়ে ভুল থাকে?
‘থাকে।চায়ে চিনি,মশলা, চা পাতা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখা উচিত।নয়ত অতিথি যখন আসবে তাদের যদি এভাবে ভুলভাল দিস, তাঁরা তখন অসন্তুষ্ট হবে।হবে কি না?
‘হবে।’
‘চা ঠিক আছে। এখন যা বাজারে।’
সুফিয়ান ঘরের সামনে বসে বসে লিখছে।পাশেই এক কাপ চা।পরনে হালকা ধূসর রঙের ফতুয়া। এবং পাজামা।শীত ঠেকাতে শাল পড়েছে।ফারদিনা এবং ঝিলমিল তাঁর বাড়ির উপস্থিত হয়।ফারদিনা আজ পড়েছে লাল রঙের মসলিন শাড়ি। কপালে কালো ছোট্ট টিপ।চুল একপাশে রেখে বেনুনি করা।সুফিয়ান তাঁদের দেখে লেখা বন্ধ করল।খাতা পাশে রেখে দিল। ‘তোমরা সকাল সকাল এখানে?
ফারদিনার জবাব এলো “সুযোগ পেয়েছি।তাই চলে এসেছি।আব্বা আজকে আসছেন।ভাইরা তাঁর সাথে ব্যস্ত।’
‘এখানে কেন এলে?
‘তোমার চোর গুলো এসেছে কিনা দেখতে আসছিলাম।এসেছে?
‘আসলে তো দেখতেই!’
‘আমি নিশ্চিত ওরা আসবে না। তোমাকে ধোঁকা দিয়ে গতকাল পালিয়েছে।’ বলে ফারদিনা মাটির বারান্দায় বসে।
‘আমি কখনো হারি না।ঐ যে ওরা এসেছে।’
ফারদিনা চোখ তুলে দেখল।বদরু,হাবলু কে দেখা যাচ্ছে। সাথে আরো দু’জন। সুফিয়ান মসৃণ হাসে। ওঁরা এসে দাঁড়ায় তাদের সামনে।পরনে চারজনের সাদা লুঙ্গি।সাদা আর সাদা নেই। ময়লা জমে কালচে হয়ে গেছে।গায়ে পুরাতন ফতুয়া।চুল দাড়িতে ভরপুর। সুফিয়ান একটা পাটি দিল। ওঁরা চারজন পাটিতে বসে।
সুফিয়ান বলল ‘তোরা আমার সম্মান রক্ষা করেছিস।তোরা চোর। কিন্তু বয়সে আমার থেকে বড়।আমি তোদের তুই ডাকছি।যেদিন ভালো কোন কাজ করতে পারবি ওদিন তুমি বলব।বুঝেছিস?
‘বুঝেছি।’ বদরু বলল।
‘চুরি বাটপারি এসব অন্যায়।আজ থেকে এসব বন্ধ। তোদের আমি কাজ দেব।ফসল চাষ এর।করবি তো?
‘করব।’ হাবলু বলল।
‘এবার বল,তোরা চারজন মিলে কিভাবে গরু চুরি করতি?
বদরু নিজের দলের দিকে চেয়ে নিল। এরপর বলল ‘লাল মিয়া। আমার পেছনে বসা।ওর কাজ ছিল রাতে সবার বাড়ির আনাচে কানাচে চোখ রাখা।সোলেমান,যারা গরুর ব্যবসা করত তাদের সাথে ভালো বন্ধুত্ব করত। তাঁদের ঠিকানা জানত।হাবলু আর আমি গরু চুরি করতাম।চুরির রাতে আমরা একসাথে ই থাকতাম।চুরির পরদিন নদী পথ ধরে গরু গুলো শহরে নিয়ে বিক্রি করতাম।’
‘তোদের কৌশল আমার ভালোই লেগেছে।’এতটুকু বলে থামতেই ফারদিনা বলল ‘শোনো, তুমি তোমার বৈঠক শেষ কর।আমি রাতে অপেক্ষায় থাকব।’
ফারদিনার কথা শুনে হাবলু আর বদরু কানা ফুসফুস করে বলল ‘মেয়েটা সত্যিই পাগল।’কথাটি সোলেমান শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো।
‘হাসলি কেন? সুফিয়ান প্রশ্ন করল। ততক্ষণে ফারদিনা ও ঝিলমিল চলে যায়।ওঁরা চুপচাপ রইল।
‘শোন, তোদের কাজ আমি ভাগ ভাগ করে দেব।’
‘আজ্ঞে’ বলুন।বদরু বলল।
‘সোলেমান, তোর কাজ হচ্ছে সন্ধ্যা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত পুরো গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখা।’
‘গ্রাম ঘুরে দেখার কি আছে? বলে আবার হেসে উঠলো সোলেমান।
‘নজর রাখতে হবে। এবং কোথায় কি ঘটে সে ব্যাপারে আমাকে খবর দিতে হবে।এক কথায় গোয়েন্দাদের মত।পারবি?
The Silent Manor part 11
‘পারব’
তাঁদের বৈঠক এর মাঝে মজিদ মিয়া উপস্থিত হয়। কাঁধে গামছা।চোখে মুখে আতংকের ছাপ। ‘সুফিয়ান হুনছো?
‘কি হয়েছে চাচা?
‘সামসুল এর পোলাডা আইজ সকালে পাওয়া গেছে।’
‘ভালো সংবাদ। কোথায় ছিল?কি অবস্থা পাঁচুর?
‘বাইচা থাকলে তো ভালো থাকত।কেউ মাইরা ফালাইছে।’
‘কি বলছেন?
‘হ,শরীরে এক ফোঁটা রক্ত নাই। মুন্ডু আলাদা’
