কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪৬
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
জামিলের বেসুরো গলার গানে মহাবিরক্ত হলো সার্থ। কাঁধ থেকে ঝট করে নামিয়ে দিলো হাতটা। থমথমে স্বরে বলল,
“ ডোন্ট টক রাবিশ। আমি কোনো প্রেমে -ট্রেমে পড়িনি।”
জামিল গা দুলিয়ে হাসল এবার।
বলল,
“ জানতাম এটাই বলবি। সাইন্স বলে চোরও কখনো কখনো চুরির কথা স্বীকার করতে পারে,কিন্তু সার্থ আবরার মনের কথা? নাহ,কোনোদিন স্বীকার করবে না।”
সার্থ বোম মেরে রইল।
কপালে ত্যক্ত ভাঁজ। জামিল বলল,
“ চল এখন। আন্টি ডাকছেন মনে হয়।”
ও সামনের দিকে হাঁটলও কয়েক পা। সার্থ ডাকল হঠাৎ,
“ শোন…”
ফিরল ছেলেটা।
“ কী?”
“ তুই শিয়র আমি প্রেমে পড়েছি?”
“ ফিল করতে পারছিস না?”
“ না।”
“ পারবি,সময় দে নিজেকে। এজন্যেই সাইন্স বলে জীবনে একটা হলেও প্রেম করা উচিত। যাতে প্রেমের নাড়ি-নক্ষত্র সব মুখস্থ থাকে। এই যে এখন প্রথমবার বলে কিছই বুঝতে পারছিস না। অথচ তোর হাবভাব দেখে আমি মাত্র কয়েক ঘন্টায় সব কেমন চুটকিতে বুঝে ফেললাম।”
সার্থ ঠোঁট কামড়ে চিন্তায় ডুবে গেল।
জামিল বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আরে ভাই,এত ভেবে চুল পাকিয়ে লাভ নেই। তোরই তো বউ,প্রেমে পড়লে পড়েছিস। দিস ইজ নট আ বিগ ডিল। এখন চল ভাই,প্রচুর খিদে পেয়েছে। কিছু খাই।”
জামিল গেলেও,ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সার্থ। অবিশ্বাসের একটা কিলবিলে পোকা এখনো তার মাথার ভেতর ঘুরছে। ও আসলেই সেই মেয়েটার প্রেমে পড়ল,যাকে দুদিন আগে গিয়ে মুখের ওপর বলে এলো তোমার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই?
সার্থর মনে হলো এর থেকে মানহানীর আর কিছু হয় না। জামিলের কথা যদি সত্যি হয়,তাহলে এখন থেকে চোরটার দিকে তাকাবে কী করে ও?
আত্মসম্মানে খোঁচা লাগবে না? না চাইতেও এ যেন একটা মস্ত ব্লান্ডার হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে অহেতুক কারণে বিরাটাকার আকাশটা বোঝার মতো ভেঙেচূড়ে জেকে বসেছে ঘাড়ে।
সার্থ অস্থিরতায় ছটফট করে। শ্বাস নেয়। ঘাড় ডলতে ডলতে বিড়বিড় করে,
“ মাই গুডনেস, এ-এস-পি সার্থ আবরার কিনা শেষমেশ এখন চোরের প্রেমে পড়বে! শেইম অন হিম,যাস্ট শেইম অন হিম।”
আইরিন খুব লাফাচ্ছে আজ৷ শাড়ির আঁচল দুলিয়ে দুলিয়ে ছোটাছুটি করছে।
তুশি তখন গাট হয়ে সোফায় বসে ছিল। চোখ নাক কুঁচকে, দাঁতকপাটি চেপে আইরিনকেই দেখছিল সে। উহ,হাসি যেন ধরে না। কী একটু কেক খাইয়ে দিয়েছে,তাতে লেজ কাটা শেয়ালের মতো করছে দ্যাখো।
পরপরই তুশির ভেতর থেকে একটা আক্ষেপ খসে পড়ল। কেউ একজন হুতাশ করে বলল,
“ ও তো তাও ওনার হাতে কেক খেতে পারল,তুই তো ওটুকুও পেলি না রে হতভাগী!”
তুশি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতেই সোজা হলো আবার। গলার জোর বাড়িয়ে উত্তর পাঠাল,
“ ওনার হাতে কেক খেতে না পারলে কী হবে? ওনার কোলে তো উঠেছি। ডাইনিটা তো আর তা পারেনি।”
তুশির মন খারাপ তাও গেল না। পুরোনো যুক্তিরা মানল না ওসব। মনে হলো সার্থর হাতে কেক খেতে না পারাটাই এই মূহুর্তে ওর ইহজগত ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফের কটমট করে আইরিনের দিকে চাইল সে।
বাড়িতে পায়েস রান্না হয়েছিল। সবার জন্মদিনেই হয়। আইরিন এক বাটি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খাচ্ছে। শাড়িটা এত পাতলা! কোমরের এক ভাগ স্পষ্ট ভাবে চেয়ে আছে প্রায়। তুশি মেজাজের দহরমমহরম দশা নিয়ে খিটমিট করে নজর সরাল এবার।
কিন্তু আইরিন ঘুরেফিরে এসে বসল ঠিক ওর সামনের আসনে। তার মাঝে আনন্দের ফুলকো জোয়ার থৈথৈ করছে। সার্থ যে তুশিকে কেক খাওয়ায়নি ঢেড় খেয়াল করেছে ও। নিশ্চয়ই বস্তির মেয়েটার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে এখন? ইস,এটাই যে চাইছিল আইরিন।
আচমকা ওর কানে এলো তুশি গুনগুন করে দাঁত পিষে গাইছে,
“ তোরে দেখলে মনে হয়,
জুতা খুইলা মুজা দিয়া,
তোরে পিটাই ডাইনি,
তোরে পিটাই।”
হতভম্বতায় পায়েস আইরিনের মাথায় উঠে গেল। খুকখুক করে কেশে উঠল সে৷ মুখ থেকে বাইরে ছিটকেও এলো কিছুটা।
তুশি ঠোঁট চেপে হাসল। রোকসানা মেয়ের অবস্থা দেখে ছুটে এলেন৷ কী হয়েছে বেইবি, বলে ফ্যানা তুললেন মুখে। আইরিন কোনোরকমে নিজেকে সামলে চোখ রাঙিয়ে চাইল তুশির পানে। গজগজিয়ে বলল,
“ গানটা কি তুমি আমাকে উদ্দেশ্য করে গাইলে?”
তুশি সরল গলায় শুধাল,
“ কোন গান?”
রোকসানাও শুধালেন,
“ কোন গান? ও আবার তোমাকে নিয়ে কী গাইল?”
আইরিন চুপ করে গেল। এই লজ্জাজনক গানের কথা সে কাউকে বলা তো দূর,মুখেও আনতে চায় না। নাক ফুলিয়ে বলল,
“ কিছু না।”
আইরিন আর বসল না৷ তুশিকে একবার ক্ষিপ্ত চোখে পরোখ করে জায়গা ছেড়ে গেল।
সার্থ যখন বসার ঘরে এলো তখন সোফাসেট গোটা পরিবার দিয়ে ভরতি। আড্ডায় মজেছে সকলে। জামিল আসাতে রেশটা আরো বাড়ল তার। এত মজার মজার কথা বলে ছেলেটা! যে কোনো জায়গা দু মিনিটেই মাতিয়ে দিতে পারে।
এর মাঝে একবার ওপরে গিয়ে শওকতের সাথেও সাক্ষাৎ সেরে এসেছে জামিল। এসব ছোটোখাটো কাজে তার কক্ষনো ভুল হয় না।
সার্থ ভেবেছিল এখানে বসবে না। তাই সোজা হাঁটা ধরল ঘরের দিকে৷ তক্ষুনি উদগ্রীব হয়ে ডাকল আইরিন,
“ ভাইয়া, কোথায় যাচ্ছেন? সবাই তো এখানে।”
রোকসানা ফিসফিস করে বললেন,
“ ও যেখানে ইচ্ছে যাক,তোমার কী? চুপ করে বসো।”
“ প্লিজ মাম্মা,আজ অন্তত বকো না। আজ ভাইয়ার বার্থডে।”
রোকসানা কিছু বলতে নিলেই নাসীর শুধালেন,
“ এনি প্রবলেম হানি?”
সহাস্যে কথাটুকু গিলে নিলেন তিনি।
“ না না ঠিক আছি।”
জামিলও ডাকল সার্থকে,
“ কী রে ব্যাটা,আমরা এখানে আড্ডা দিচ্ছি আর তুই ঘরে গিয়ে খিল দিয়ে থাকবি? তাহলে আমি এত কষ্ট করে এলাম কেন হ্যাঁ?”
তনিমা বললেন,
“ আয় না,বোস এখানে।”
সার্থর কান সবার কথার দিকে থাকলেও দৃষ্টিজোড়া অন্য কোথাও। অয়ন -তুশি সেন্টার টেবিলের এপাড়-ওপাড় বসেছে। চানাচুর,থেকে ভাজাপোড়া এটা ওটা নিয়ে মেয়েটাকে সাধছে অয়ন। তুশি মানা করলেও শুনছে না। কেমন যেচেপড়ে বলছে,
“ একটা কিছু অন্তত নাও,তুশি।”
আশ্চর্য তুশি কী নেবে কী নেবে না সেটা তুশির সিদ্ধান্ত। অয়নের এত আদিখ্যেতা কীসের?
সার্থ ঘরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলাল।
এসে বসল কাউচে।
জয়নব হঠাৎ বললেন
“ তা জামিল, বিয়ে টিয়ে কবে কী করবে? ভাবলে কিছু?”
“ ভেবেছি দিদুন। একজনকে তো ভালো লাগে। দেখি, সে চাইলে খুব শীঘ্রই সব এগোব।”
রেহণূমা সাগ্রহে শুধালেন,
“ ওমা তাই! তা মেয়ে কী অস্ট্রেলিয়ার নাকি?”
জামিল কেমন রহস্য করে হাসল। বলল,
“ জানাবো আন্টি। আপনাদেরই সবার আগে জানাবো।”
তুশি মুখ কুঁচকে ফেলল।
“ এই লোকটা সুবিধের নয়। কী সব আজেবাজে কথা বলছিল তখন। যদি কোনোভাবে ওর দিকে নজর দেয়,একেবারে চোখ গেলে দেবে হুহ।
আচ্ছা,উনি কি ওনার বন্ধুকেও ওদের বিয়ের কথা বলেননি? নাহ,বলেননি নিশ্চয়ই। বললে তখন ছেলেটা এসব ওসব গদগদ কথাবার্তা বলতো না। তাহলে বিটকেলটা যে তখন ওনাকে ওভাবে টেনেটুনে নিয়ে গেলেন? তারপর কী হলো? দুজনের আলাপ শুনে তো মনে হচ্ছে না সিরিয়াস কিছু ঘটেছে।”
জামিল বলল,
“ আচ্ছা এসব এখন বাদ। খালি মুখে আড্ডা জমছে না। একটু মিউজিক -টিউজিক তো দরকার নাকি!”
মিন্তু উচ্ছ্বল হয়ে বলল,
“ সাউন্ড সিস্টেমটা বাজাব?”
“ আরে,না না। আমাদের এই সভায় যেখানে দু-দুজন ভালো গায়ক মজুদ আছে সেখানে সাউন্ড সিস্টেম লাগবে কেন? কী রে সার্থ,তুই তো ভালো গান গাইতি এক সময়। সেই আমাদের আড্ডার কথা মনে আছে? রবীন্দ্র সরোবরে কত সন্ধ্যায় সবাই এক সাথে গিটার বাজিয়ে গাইতাম। গা না আজকে একটা!”
তুশি ঠোঁট বেঁকিয়ে ভাবল,
“ হুহ,গান না ছাই। এই খচ্চুরে লোকের কণ্ঠে আবার সুরও আছে নাকি! নিশ্চয়ই ভাঙা রেডিওর মতো কিছু একটা ক্যা ক্যা করে গায়।”
আইরিন আহ্লাদে গলে গলে বলল,
“ হ্যাঁ ভাইয়া প্লিজ গান না। আমি কখনো আপনার গান শুনিনি।”
তুশি ভেঙচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
সার্থ ফটাফট নাকচ করল প্রস্তাবটা। ছোটো করে বলক,
“ না,মুড নেই।”
সাইফুল বললেন,
“ কেন রে,গা না।”
“ ইচ্ছে করছে না চাচ্চু। অন্য একদিন।”
কেউ আর জোর করল না। তবে সবারই একটু মন খারাপ হলো। চাইছিলেন সার্থ গেয়ে শোনাক কিছু একটা । এর মাঝেই মিন্তু একটা কাজের কাজ করেছে। এক ছুটে ঘরে গিয়ে গিটার নিয়ে এসেই, বুক ফুলিয়ে জানাল,
“ গিটার এনেছি। কে গাইবে এখন?”
জামিল হতাশ কণ্ঠে বলল,
“ বার্থডে বয় তো গাইছে না। এনেই যখন ফেলেছ, তাহলে দ্বিতীয় গায়ক অয়ন আবসার গাইবে।”
মৃদূ চমকে চাইল অয়ন,
“ আমি? না না আমি না। অনেক দিন গাই-টাই না। গলার অবস্থা ঠিক নেই।”
জামিল গিটার ওর কোলে দিয়ে বলল,
“ আমাদের ঠিকের দরকারও নেই। যা গাইবে তাই শুনব। রাইট ইউশা?”
ইউশা বসেছিল চুপ করে। নড়েচড়ে তাকাল। হেসে বলল,
“ হু? হ্যাঁ। ”
অয়ন গিটার হাতে নিলো। তারে আঙুল বোলাতেই শব্দ হলো একটু।
তারপর ফট করে বলল,
“ গাইব এক শর্তে,যদি তুশিও আমার সাথে গায়।”
নীরব হাওয়ার মাঝে ঝপাৎ করে বাঁজ পড়ল যেন। অমনি খ্যাপাটে চোখে মুখ তুলল সার্থ। যেন এমন বাজে কথা এর আগে সে কোনোদিন শোনেনি।
তুশি সজোরে মাথা নেড়ে বলল,
“ এমা না না। আমি গান জানি না।”
তনিমা বললেন,
“ একদম মিথ্যে বলবি না। সারাদিন যে গুনগুন করে গাইতে থাকিস,আমরা সবাই কিন্তু শুনি।”
ও মিনমিন করে বলল,
“ সেটা আর এটা কি এক নাকি! সবার সামনে গাইব কী করে? আমার লজ্জা লাগে।”
হাসনা এবার মুখ খুললেন।
“ উহ, লজ্জাবতি আইছে রে।
পুরা বস্তিতে গলা ফাডাই ফাডাই গান গাইতি, তোর গানের যন্তরনায় তিন্নির মা অহোনো দুই বেলা গাইল পারে। আর হেয় কয় গান জানি না।”
সবাই হুহা করে হেসে ফেলল অমনি। তুশি ঠোঁট উল্টাল।
ইউশা গাঢ় গলায় বলল,
“ গাও না তুশি। এরকম আড্ডা তো প্রতিদিন হয় না। গাও।”
তারপর ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল মেয়েটা। খুব করে চাইল, ওর যেন এখন কষ্ট না হয়। একদম যেন চোখ ছলছল না করে।
তুশি আর আপত্তি করল না। মাথা নাড়ল আস্তে। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারের হাতল হাতের তালুতে চেপে ধরল সার্থ। জামিল একবার আড়চোখে দেখে নিল তাকে।
মিটিমিটি হেসে গলা ঝেরে বলল,
“ তাহলে শুরু করা যাক। প্রিয় শ্রোতা,এখন আমাদের মাঝে গান গেয়ে শোনাবেন সৈয়দ অয়ন আবসার এবং তুশি।”
উল্লাসে সবাই হাত তালি দিলো। আইরিন চ সূচক শব্দ করে বলল,
“ গড,এখন বসে বসে কুকুরের ঘেউঘেউ শুনতে হবে।”
তার কথা কারো কানে এলো না। সবাই উৎসুক হয়ে বসল।
অয়ন গিটারে মন দেয়।
একটা দুটো করে তার বাজিয়ে আস্তে আস্তে সুর ধরে। মধুর এক হাওয়ায় মিলিয়ে দেয় ভরাট গলার স্বর। গেয়ে ওঠে সজোরে,
“ আমার স্বপ্ন জুড়ে তুই,
আর তোর চিন্তারা শুধুই,
ঘুরেফিরে যাচ্ছে বারবার,
আর কোনো রাস্তা নেই আমার,
বল না তোর দোহাই, প্রেম ভাসাই কোন জলে?
ও মাই লাভ,
আদুরে আলাপ,
ছুঁয়ে তোর আঁচলে এলাম বলে।
বি মাই লাভ,
একটা গোলাপ,
চুপিসারে রেখে গেলাম তোর কোলে।
ইউশার ঠোঁটে নিষ্প্রভ হাসিটা বড়ো টেনেটুনে ধরে রাখা। ভেতর ভেতর গোল উত্তাপ হয়ে অকথ্য যন্ত্রণারা ঘুরছে। অয়ন কেমন কেমন চোখে তুশিকে দেখে গাইছে,সে জানে,বোঝে। গানের প্রতিটা লাইন তুশির জন্যে তাও জানে সে। আর এই প্রেমিকসুলভ চাউনিটাই ইউশা মেনে নিতে পারে না। না চাইতেও বুক দুমড়েমুচড়ে যায়। ইউশা অন্যদিকে ফিরে চোখের জল খুব আড়ালে মুছে ফেলল।
এদিকে ভেতর ভেতর চিড়বিড় করছে সার্থ। ওপরের দাঁত, নিচের দাঁতে ঘষছে। শরীরের রোমকূপ অবধি জ্বলছে তার। অয়ন তুশির সাথে ডুয়েট গাইছে ভালো কথা,এরকম গান গাইবে কেন? ও মাই লাভ,বি মাই লাভ,এসব কী শব্দ? পৃথিবীতে কি আর কোনো গান ছিল না? একটা দেশত্ববোধক গান গাইলেও তো পারতো।
এরপরপরই তার কান ঝাঁঝিয়ে দিতে গানের লাইন ধরল তুশি,
“ মনেরই দেওয়ালে, খামোখা খেয়ালে আঁকি-বুকি তোর ছবি।
ও জাগিয়ে চলে যা, তবু তো বলে যা কবে রে আমার হবি!” গাইতে গাইতে চোরা চোখের কোণ তুলে সার্থকে দেখল সে। চওড়া বুক অবধি পৌঁছাল নজর। ঢোক গিলে পরপরই নুইয়ে নিলো মাথাটা। অয়ন ফের গায়,
তোর উত্তরের-ই আশায়,
প্রশ্নেরা চিহ্ন ভুলে যায়,
আবেগের ব্যস্ত পারাপার,
আর কোনো রাস্তা নেই আমার,
বলনা তোর দোহাই, প্রেম ভাসাই কোন জলে…
সার্থর আর সহ্য হলো না। সবাই যখন গানের সুরে বিভোর ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। অয়ন পরের লাইন গাইতে গিয়ে থমকাল এতে। চাইল ওর পানে। এবার তাকাল বাকিরাও।
অয়ন দেখল সার্থ তিতিবিরক্ত চোখে ওকেই দেখছে। শুধাল,
“ কিছু হয়েছে ভাইয়া?”
সার্থ হাস্যহীন বলল,
“ গিটারটা দে।”
জয়নব বললেন,
“ গিটার দিয়ে কী করবে দাদুভাই?”
অয়নের দেয়ার অপেক্ষায় সার্থ রইল না। নিজেই ওর হাত থেকে কেমন ছিনিয়ে নিয়ে এলো। ফের এসে বসল আগের জায়গায়।
কুঁচকে থাকা কপালেই জবাব দিলো,
“ এখন আমি গাইব।”
সবাই বিস্ময়াবহ হয়ে চেহারা টানটান করে ফেলল। জামিল উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“ সত্যি, গাইবি তুই?”
সার্থ উত্তর না দিয়ে এক পল তুশির দিকে তাকায়। মেয়েটা কেমন নিষ্পাপ চোখে টুকটুক করে দেখছে।
সার্থর প্রথম বার মনে হলো তুশির মুখটায় আশ্চর্য রকম মায়া! কাকভোরে সদ্য ওঠা সূর্যের রশ্মি,কিংবা ময়ূরের পেখমের মতো সৌন্দর্য তাতে।
এই সৌন্দর্যই কি তবে এতদিন সার্থকে অস্থির করে তুলতো? এই চোখ,এই তাকানো এসবই কি ওর সমস্ত নীতি, সব শক্তপোক্ত বাধ ভেঙে দিতো ওর?
সার্থ উত্তর জানে না। তবে গিটারের তারে আঙুল চালিয়ে নিরেট,জমাট স্বর নামিয়ে গলা ছেড়ে গাইল,
“ ধোঁয়াটে- কুয়াশা ভরা রাস্তার মাঝখানে,
কেন যে দাঁড়িয়ে প্রেম হাতরাস, কে জানে!
মনের অলি গলি, হয়ে কেন পালালি,
রাতেও মরিচিকা, দেখছি একা একা,
গিয়েছে ঘুম উড়ে, বুক পুড়ে, ছাই উড়ে,
লা লা লালা লা….
ওহো হোহো হো হো …..
ওহো হোহো হো হো ……
ও হো হো হোওওওওওও।”
আইরিন গালে হাত দিয়ে বসে আছে । তার চোখে অপার মুগ্ধতা। সার্থ ভাই এত ভালো গায়? একটা মানুষের এত গুণ কেন থাকবে? এজন্যেই তো ও এত দিওয়ানা ওনার জন্যে। মাম্মাম যে কেন এসব বোঝে না।
তবে এর থেকেও বাজে অবস্থা তুশির। মেয়েটার রাঙা ঠোঁট ফাঁকা হয়ে গেছে। চোখমুখে ফ্যালফ্যালে বিস্ময়।
সার্থর ওই গৌড় বর্ণের মুখ থেকে নজর সরানো যাচ্ছে না। কী দারুণ গান উনি! কী চমৎকার গলা!
তুশি কি নতুন করে আবার প্রেমে পড়ছে? ওর বুকের ভেতরটা কি ধুকপুক করছে আবারও? হ্যাঁ করছে। এইত ও পরিষ্কার টের পাচ্ছে কী নিঁখুত যাতনায় চিড়েখুড়ে হৃদপিণ্ডটা বাইরে আসার যোগাড়। চারটে অলিন্দই ধুপধাপ গতিতে কানে কানে বলছে,
“ তুশি,
তোর আর শক্ত থাকা হবে না। এই যে তুই আবার গলে যাচ্ছিস। এই যে তুই আবার মরছিস ওনার তরে।
এখন দেহ থেকে প্রাণটা না যাওয়া অবধি এই সর্বনাশ থেকে নিস্তার পাওয়ার কথা ভুলে যা তুই, তুশি। একদম ভুলে যা।”
অয়ন সন্দিহান চোখে একবার তুশিকে দেখল,একবার সার্থকে। ভাইয়ের ওপর তুশির নিষ্পলক চাউনিটা স্পষ্ট মনে বিঁধল তার। তুশি এইভাবে ভাইয়াকে কেন দেখছে?
সার্থ তখনো দুনিয়াদারীর সব কিছু শিকেয় তুলে মন দিয়ে গাইছিল,
“ খুঁজেছি তোকে রাত বেরাতে, জ্বলেনি আলো স্বপ্নে,
লুকিয়ে চিঠি তোকে লেখা, তুলে রেখেছি যত্নে।
মনের অলি গলি, হয়ে কেন পালালি।
রাতেও মরিচিকা দেখছি একা একা।
গিয়েছে ঘুম উড়ে, বুক পুড়ে, ছাই উড়ে ।
লা লা লালা লা।”
আচমকা ওর খেয়াল পড়ল অয়ন তুশির দিকে তাকিয়ে আছে। সেসময় তুশিও তাকাল। সোজাসুজি চোখাচোখিটায় ঠোঁট টেনে হাসল অয়ন। একটা মানুষ হাসলে তো আর মুখ গোমড়া করে রাখা যায় না। সৌজন্যবোধে তুশিও হাসল একটু। সার্থর মেজাজের জ্বলন্ত শিখায় এই হাসিই যেন এক ফোঁটা ঘি। হিংসার দাবদাহে শতভাগ পুড়ে গেল সে। সঙ্গে সঙ্গে গান থামিয়ে গিটার নামিয়ে রাখল। তারপর দুম করে উঠে এসেই, কেমন চিলের মতো থাবা মেরে ধরল তুশির কনুইটা। নিশ্চুপ মেয়েটা চমকে উঠল খুব। তাকাল হকচকিয়ে।
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪৫ (২)
সার্থ কোনো শব্দ করল না। জিভ খসে একটা টু-ও বাইরে এলো না তার। সবার বিস্মিত নজরের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা অবধি না করেই, তুশির শীর্ণ শরীরটা হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল কোথাও।
