অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৮

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৮
ইসরাত জাহান ফারিয়া

ইহসানের ধারণা জান তার আশেপাশেই আছে
কিন্তু সে-ই কোনো হদিস পাচ্ছে না। চাওয়া জিনিস না পাওয়ার ক্ষোভে নিশ্চয় ওর মাথা বিগড়ে আছে, যেকোনো সময় একটা অঘটন ঘটিয়ে বসবে। জীবনে দ্বিতীয়বার কখনো প্রস্তাব দিয়ে সে রিজেক্ট হয়েছে, এখন নিশ্চয় চুপ করে বসে থাকবে না। যদিও আজিজ শেখ হাজতে আছেন, চাইলেও সাহায্য করতে পারবেন না ছেলেকে, তারপরেও ইহসানের শঙ্কা কমে না এই চিন্তা করে যে, এলিজটার না কোনো ক্ষতি হয়ে যায় এসবের চক্করে পড়ে।

সংসার গোছানোর জন্য নতুন বাসাতেও তাই শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না তাদের। ইজহান যখন শুনল নতুন বাসার ব্যাপারটা, ফোন করে একদিন বলল, “নতুন বাড়িতে উঠবি না, তো পার্মানেন্টলি ঘরজামাই থেকে যাবি আর মানুষকে যন্ত্রণা দিবি?”
কথাটা বেশ গায়ে লাগল ইহসানের। আগে নীলুফুপি ধরেবেঁধেও একরাত রাখতে পারত না তাকে। পারলেও বেশ কসরত করতে হতো। এখনো সে চায় না এখানে থাকতে। কিন্তু সাধে তো পড়ে আছে না এখানে, কারণবশত আছে! এটাকে কি ঘরজামাই থাকা বলে? দাঁতে দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “তাতে তোর কোনো সমস্যা?”
”আমার কেন কোনো সমস্যা থাকবে? সমস্যা তো এলিজের।”
“ওর সমস্যা তোকে বলেছে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গা জ্বালানো হাসি হেসে ইজহান বলল, “সব কথা মুখে বলতে হবে কেন? তুই ওর স্বাধীনতা হরণ করেছিস, আর এটাও বুঝতে পারিসনি? এই সারাদিন আমার বোন, আমার বোন বলে ফেনা তুলিস? আমি তো ওর মুখ দেখেই বুঝে গেছি! তুই নিজে থেকে খাটছিস, অন্যদিকে বেচারি নিজেকে বোঝা ভাবছে!”
ইহসান বিরক্ত হয়ে শক্ত গলায় বলল, “এসব বলতে যদি ফোন করে থাকিস তাহলে ফোন রাখছি, বাই।”
ইজহান ক্যাটক্যাটে স্বরে বলল, “আমি তো কথা
বলছি তোর সঙ্গে, বেয়াদব! বড়ো ভাইয়ের মুখের উপর ফোন কেটে দেওয়ার হুমকি দিতে লজ্জা করে না? টনা-মনার সঙ্গে কথা না বলিয়ে ফোন কেটে দেখ তোর আর টনার কী হাল করি, টুনটুনি কেটে এরপরে তিন টাকায় হাটে বেচব! অবশ্য কেউ কিনবে কিনা কে জানে…”

ইহসান ওর আজেবাজে কথা শুনে ভয়ংকর রেগে গেল। ভীষণ ত্যক্ত হয়ে ধমকানো কণ্ঠে বলল, “তুই আমার চুল করবি, বা* করবি কারণ তুই নিজেই একটা বা*!”
বাচ্চারা নীলু ফুপির কাছে ছিল। ইহসান ভিডিয়ো কলে সংযুক্ত করে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে মেজাজ খারাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সৃজাকে খুঁজতে। পেল ওকে রান্নাঘরে। বাচ্চাদের জন্য খিচুড়ি বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, সবজি কাটাকুটি করে সবে হাতটা ধুয়েছে তখনি ইহসান দরজায় থাবা বসিয়ে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে চাপা স্বরে ক্ষোভ নিয়ে বলল, “আমি তোদের বাড়ির ঘরজামাই? তোর বোন আমার উপর বিরক্ত? আজ তাহলে একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক! নয়তো এক্ষুনি বেরিয়ে যাব আমি।”

বলে ফুঁসতে লাগল সে। সৃজা আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইল ওর দিকে। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারল না। বিভ্রান্ত হয়ে বলল, “এসব আজেবাজে
কথা কে বলেছে তোমাকে? খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নেই? ঘরজামাই হতে যাবে কেন তুমি? তুমি তো আমার আম্মুর মেয়েজামাই, আমার বর!”
বলেই জিভ কাটল। এই লোকটার সামনে এমন কথা স্বীকার করা মানে এই মুহূর্তের হাতের কাজে দেরি করা। কিন্তু ইহসানের কি হয়েছে? এসব উদ্ভট প্রশ্ন করছে কেন? মনের প্রশ্ন মুখে আনতে যাবে তার আগেই খেয়াল করল ইহসান ওর খুব নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে, বড়ো বড়ো চোখ করে ওকে দেখছে! সৃজা থতমত খেয়ে বলল, “কী সমস্যা! দূরে দাঁড়াও! রান্নাঘর এটা, ছোঁকছোঁকানি করার জায়গা না।”
বলে আলতো করে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।আর তাতেই যেন ইহসানের রাগটা বৃদ্ধি পেল। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “আমি ছোঁকছোঁকানি করি?”
”পুরুষমানুষ মাত্রই ছোঁকছোঁকানি খোর! সুযোগ পেলেই মেয়েমানুষের উপর হামলে পড়ে। তুমিও তার ব্যতিক্রম নও।”

ইহসানের কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে গেল, “এইতো দেখিয়ে দিলি আসল রুপ! তোর বাড়ি আছি বলেই তো গলার এত জোর, ধমকে কথা বলছিস! বোঝা হয়ে গেছি আমি তোর কাছে, তাই না? তা সোজাসুজি বলে দিলেই তো পারিস, মনে এক রেখে মুখে আরেক বলে সান্ত্বনা দেওয়ার দরকার কী?
এতো হিপোক্রেসি জানিস তুই, ভাবতেই পারিনি।”
লোকে বলে, মেয়েরা নাকি কথা প্যাঁচায়! তারা এসে দেখে যাক, পুরুষমানুষ কথা প্যাঁচিয়ে কথার লতা বানিয়ে দিতে পারে! সৃজা নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“ঘরে যাও, এসে শুনছি কী হয়েছে তোমার!”
অদৃশ্য চপেটাঘাত যেন ইহসানের গালে পড়ল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “এখন শুনলে কী সমস্যা?”
“আরে বাবা, কাজ করছি তো! বাচ্চাদের মতো জ্বালাচ্ছ কেন তুমি?”

ইহসান আর একটা কথা বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সে জ্বালায়? সে বাচ্চাদের মতো জ্বালায়? মেয়েটা মুখের উপর এতবড় কথা বলে দিতে পারল? শ্বশুরবাড়ি পড়ে থাকার এই পরিণাম, কথা তো শুনতেই হবে। সব ঐ কু* বাচ্চা জানের জন্য! সারাটা জীবন জ্বালিয়ে গেল। একে, তাকে জ্বালিয়ে নিজে পালিয়ে বেড়ায়। অবশ্য কতদিন আর পালিয়ে বেড়াবে? একদিন না একদিন তো গর্ত থেকে বেরুতেই হবে। আর সেই দিনটাই হবে ওর জীবনের শেষ দিন। ভাই বলে আর কোনো সহমর্মিতা দেখাবে না সে, একেবারে মেরে দরকার হলে আজীবন জেল খাটবে, ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে। প্রয়োজন নেই তার এমন ভাইয়ের, যার জন্য সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকতে হয়। এলিজের মতো একটা মেয়েকে নিয়ে, যে খুব ভালো একটা জীবন ডিজার্ভ করে। এলিজের কথা মনে হতেই ইহসান ওর ঘরের দিকে গেল, একবার নক করতেই এলিজের ব্যস্ত গলা শোনা গেল, “ভেতরে এসো ভাইয়া।”

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ইহসান প্রশ্ন করল ওকে, “কীভাবে বুঝলি আমিই এলাম?”
গাঁদার ডাল কেটে অন্য একটা টবের মাটিতে পুঁতে দিতে দিতে এলিজ জবাব দিলো, “আপু বা ফুপি দরজায় নক করে না।”
ভীষণ ব্যস্ত দেখাল ওকে। ফুলগাছের প্রতি মেয়েটার এতো টান, টবে ভর্তি বারান্দাটায় দাঁড়ানোর জায়গাটাও মনে হয় আর কিছুদিন পর থাকবে না। ইহসান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ওর সঙ্গে কাজে হাত লাগাল। বিমর্ষ গলায় বলতে লাগল, “আমি তোকে সেফটি দিচ্ছি, আর তুই নাকি নিজেকে বোঝা মনে করছিস? এসব ভাবা কি ঠিক লিজ?”
“এসব তোমাকে কে বলল?”

”আগে বল, আমি তোকে একা কোথাও যেতে এলাউ করি না, এতে তুই আমাকে নিয়ে খুব বিরক্ত?”
হাতের কাজ থামিয়ে এলিজ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। ইদানীং কোথাও ওকে একা যেতে দেয়া হয় না৷ ইউনিভার্সিটিতে পর্যন্ত ওকে আনা-নেওয়া করে ইহসান। ওর শত অনুরোধ, বারণ কিছুই সে কানে তোলেনি। সারাদিন কাজবাজ নিয়ে এত দৌড় ঝাপের পর ছোটোদের মতো ওকে ট্রিট করাতে, এলিজের অস্বস্তি লাগে, নিজেকে পরনির্ভরশীল মনে হয়। এই নিয়ে ক্লাসমেটরা হাসাহাসি করে, অনেকে করে কটুক্তি। এসবে যদিও এলিজের কিছু যায় আসে না, তবুও এসবের জন্য দায়ী হিসেবে আরসালান শেখের উপর প্রতি মুহূর্তে তার ঘৃণার পারদ বাড়তেই থাকে।
এই একটা লোকের জন্য তাদের জীবনের এমন অস্থিরতা, আর সে কি-না দিব্যি তাকে শায়েরি লিখে পাঠাচ্ছে? বদমাশের বাচ্চা একটা! ভীষণ কুৎসিত একটা গালি দিয়ে সহজ গলায় এলিজ ইহসানকে বলল, “আমি তোমার অসুবিধার কথা ভেবে কয়েকবার মানা করেছি, বিরক্ত বলে নয়। তেমনটা হলে আমি তোমাকেই বলব, অন্য কাউকে নালিশ করতে যাব কোন দুঃখে?”

ইহসান তাও মুখ কালো করে রইল, “আমাকে কী তোদের বাড়ির ঘরজামাই বলে মনে হয়?”
এলিজ কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে এরপর হেসে ফেলল, “নিশ্চয় ভাইয়ের থেকে খোঁচা খেয়ে এসব অবান্তর কথাবার্তা বলছ? কিন্তু আমার তো সত্যিকার অর্থে তোমাকে ঘরজামাই নয়, বড়ো ভাই টাইপ ফিল পাচ্ছি। যে পরিবারে সেফটি দিতে পারবে কিনা এসব ভেবে শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।”
ইহসান চট করে ওর দিকে তাকাল৷ নিচু গলায় বলল, “অথচ তোর বোন আমাকে বোঝে না। বলে আমি নাকি বাচ্চা!”
এলিজ হাসিতে ফেটে পড়ল ওর মুখভঙ্গি দেখে, “এই তোমার কী হয়েছে! ইজহান ভাইয়ার ভূত ভর করল নাকি? আসলেই তুমি ইহসান শেখ তো?”

অস্বস্তিতে পড়ে গেল ইহসান। কী বলবে ভেবে না পেয়ে চট করে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঠিক তখনি ওর ফোন বেজে উঠল। তার আইনজীবীর ফোন। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল ওর। কলটা রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে যা শুনল তাতে মাথাটা বিগড়ে গেল ওর।পুরোটা না শুনেই তাই কল কেটে দিলো। এত এত ব্যর্থতা তার, শুনতে ইচ্ছে করে না। ইহসান চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা দেখতে শুরু করল! ঘরে যাওয়ার তাড়াহুড়োয় সামনে এগুতেই ধাক্কা খেল বেসিনের সাথে। পায়ের আঙুল ফুলে মুহূর্তেই রক্ত জমে গেল। রান্নাঘর থেকে শব্দ শুনে ছুটে এলো সৃজা, ওর কাহিনী দেখে কতক্ষণ থমকে রইল। এরপর ধমকে বলল, “আজ তোমার হলোটা কী? লাফালাফি করছ ছোটোদের মতো, খেয়াল করবে না সামনে কী আছে? বিরক্তিকর একটা লোক!”

একশো একটা কথা শুনিয়ে ওকে এনে শোয়ার ঘরে বসিয়ে বরফ ঠান্ডা পানিতে পা ভিজিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়ে আরো কিছুক্ষণ বকাবকি করল সৃজা। ইহসানের অসহ্য লাগছিল ভেতরটা, টেনে এনে ওকে পাশে বসিয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলল, “এত কথা বলছিস কেন? বাচাল কোথাকার!”
সৃজা শান্ত হলো, হয়েই প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে এবার বলো তো?”
অনেককিছুই হয়েছে, আরো হওয়া বাকি। তার জীবনে শুরু হওয়া ঝড়ের সবে শুরু, পুরোটাই বাকি। কিন্তু সেসব বলে তো ভড়কে দেয়া যাবে না সৃজাকে, তাই ওর প্রশ্ন নাকচ করে দিয়ে নিচু স্বরে বলল,“ভেতরটা খুব অস্থির লাগছে।”
সৃজা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিছু কী হয়েছে?”
“ভালো লাগছে না। আমি আমার ঘরটাকে খুব মিস করছি।”
ওর উদাসীনতা খেয়াল করে সৃজা বোঝার চেষ্টা করছে ওকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ইতস্তত করে বলল, “বাড়ি যেতে চাইছ?”

“উহু, চাইছি না। তবুও মিস করছি, ওই বাড়িটা, আমার ঘরটা, আর বাকি সবাইকে, আমার কপিক্যাটকেও। ওকে একটা লাথি দিতে পারলে শান্তি লাগতো। আচ্ছা, তোর কি মনে হয় ও আমার ভাই হওয়ার যোগ্য? আমাকে কী বলে জানিস, আমার টুনটুনি নাকি কেটে দেবে! ওর কী ধারণা, আমি ওরটা আস্ত রাখব?”
অবলীলায় কথাটা বলে দেওয়াতে সৃজার কাশি উঠে গেল। ইহসান ওর পিঠে হালকা চাপড় দিতে দিতে বলল, “আমার ছেলে নাকি ওর মেয়েজামাই। অথচ ওর টুনটুনিও কেটে দিতে চায়। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি থাকলে এমন করার চিন্তাভাবনা করতে পারত না…”

বলে একচোট হেসে ফেলল ইহসান। সৃজা ওর মুখ চেপে ধরে নাক সিঁটকে বলল, “তোমার খুব বুদ্ধি,
তাই এসব জঘন্য কথাবার্তা আমাকে বলছ! সব
ক’টা ভাই পাগল!
অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে তাকে পাগল আখ্যা করায় ইহসান ক্ষিপ্ত চোখে চেয়ে রইল ওর দিকে। তবে এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সৃজা মোটেও ভুল কিছু বলেনি। সে পাগলের বংশধর!

আজিজ শেখ বরাবরই নিজেকে নিয়ে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলেন৷ তার ধারণা ছিল, খুব সহজেই এ মামলা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন তিনি। কিন্তু যখন দেখলন প্রমাণ, সাক্ষ্য, প্রত্যক্ষদর্শী সবই প্রতিপক্ষের পক্ষে, আর বিশ্বস্ত কর্মচারীরাই তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে তখন তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হলেও প্রচন্ড দিশেহারা বোধ করছিলেন। চারদিক থেকে চেপে আসা পরিস্থিতিতে যখন তিনি এবং তার ব্যক্তিগত আইনজীবি কেসের কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখনই ধূর্ত ও নামকরা এক আইনজীবী মোটা অঙ্কের বিনিময়ে কেসটি নিজের হাতে নেন। যিনি আজ পর্যন্ত কোনো কেস হারেননি। যাকে সবাই ডাকে দ্য গেম চেঞ্জার হিসেবে। যিনি আইন বোঝেন কেবল বইয়ের ধারায় নয়, বোঝেন মানুষের ভয়, দুর্বলতায়ও।

জেরা করার সময় তার চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রতিপক্ষ সাক্ষীকে এমনভাবে ভড়কে দেয়, ফলে সাক্ষীর সত্যটাকেও মিথ্যা বলে প্রমাণ করতে পারেন তিনি নিপুণভাবে। আজিজ শেখের কেসটা তার জন্য চ্যালেঞ্জিং হলেও প্রথমেই তিনি প্রমাণের উৎসের উপর জোর দিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ উপস্থাপন করে দেখান, হত্যার কাজে যেসব অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে আজিজ শেখের কারখানার ভেতর থেকে, দেখা যায় তার আগের রাতেই সেসব অস্ত্র কেউ ভেতরে ঢুকিয়েছে আজিজ শেখকে ফাঁসাতে। এমনকি তার সাবেক হিসাবরক্ষকের বক্তব্যকে দুর্বল প্রমাণ করতে ক্রস-এক্সামিনেশনে তার অতীতের আর্থিক অনিয়ম তুলে এনে প্রমাণ করেন, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ থেকে সে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে। জামিন মঞ্জুরের জন্য সর্বশেষ চালটা ছিল সবচেয়ে বেশি কার্যকরী, যেখানে এক অডিও রেকর্ডে প্রতিপক্ষের প্রভাবশালী এক ব্যক্তি কীভাবে আজিজ শেখকে ফাঁসাতে নিজের লোকেদের নির্দেশ দিচ্ছে!

সত্যকে ছাপিয়ে মিথ্যা আড়াল গড়ায় পারদর্শী রাশেদ জামান ব্যাপারগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করেন যেন পুরো ঘটনাটিই ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ব্যবসায়িক ষড়যন্ত্রের ফল, যেখানে আজিজ শেখের নাম জড়ানো হয়েছে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করার জন্য। প্রতিপক্ষের প্রতিটি নথিতে এমন সূক্ষ্ম অসঙ্গতি বের করেন, যার ফলে ধীরে ধীরে অভিযোগের ওজন নড়তে শুরু করে এবং তার তৈরি করা আইনি ব্যাখ্যার মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং পুরো কাঠামোটাকেই দুর্বল করে দেয়। এক পর্যায়ে পুরো মামলাটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ায় আজিজ শেখকে হাজত থেকে বের করে আনা খুব একটা কঠিন হলো না।

বড় এক বিপদ থেকে বেঁচে এসে আজিজ শেখ যেন নিজের পুরোনো রূপ ফিরে পেলেন, যেন এক অভিজ্ঞ খেলোয়াড় অচেনা মাঠেও নিজের জায়গা খুঁজে নিয়েছে। অবশ্য তার পেছনে কারণও আছে। যারা তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিল, তিনি ফিরে আসতেই তাদের অনেকেই দেশ ছেড়েছে, কেউ আত্মগোপনে, কেউ সর্বস্ব হারিয়ে ধ্বংস। কিন্তু একজন আছে, যে বিন্দুমাত্র মূল্য দেয়নি তাকে। বরংচ অবজ্ঞার চোখে দেখছে। সে তার নিজের ছেলে, ইহসান শেখ। বাবাকে আইনি জটিলতায় ফাঁসিয়ে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর পরেও ইহসানের প্রতিটি আচরণ প্রকাশ্যে জানিয়ে দেয়,
সে আজিজ শেখকে কতটা তুচ্ছ করে দেখে– তাচ্ছিল্যে, করুণায়, ঘৃণায়। আর এটাই আজিজ শেখকে ভিতর থেকে পোড়ায়। যে ছেলেকে এত বড় করেছেন, সেই ছেলের চোখের এই ঘৃণা, অবজ্ঞা আগে কিছু না মনে হলেও এবার আজিজ শেখের অহংকারে কাঁটার মতো বিঁধে আছে।

বড় মুখ করে ছেলেকে বলেছিলেন, “আইনের মারপ্যাঁচ তুমি বোঝো না। আমাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সহজ না আব্বাজান। অহেতুক পেছনে লাগছ!”
অহেতুক লাগেনি, হেতু ছিল বলেই লেগেছিল। কিন্তু এখন সেই কথাগুলো তার বুকের ভেতর প্রতিধ্বনি তুলে তাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তাই ছাড়া পাওয়ার উচ্ছ্বাসটাও তিনি ঠিকঠাক অনুভব করতে পারছেন না। বুকের ভেতরটা সূক্ষ্ম, চিনচিনে অনুভূতিতে দলা পাকাচ্ছে বারবার। ক্রোধে তার মস্তিষ্কটাতে কিলবিল করছে অসংখ্য পোকার দল। ছেলে হিসেবে জান, তার কাছে একটা জিনিস চেয়েছে, আর তা স্বাভাবিকভাবে এনে দিতে তিনি ব্যর্থ; এ ব্যাপারটাই তাকে ক্রোধিত করছে!

আজিজ শেখ এখন মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, তার
জীবনের প্রতিটি গোলযোগের কেন্দ্রে একটাই নাম, সৃজা রেহমান। এই মেয়ের জন্যই ইহসান তার উপর এতোটা হিংস্রতা দেখিয়েছে। তার সংসার আবার উলটপালট, ছেলের চোখে বরাবরের চেয়েও আরো বেশি বিষাক্ত তিনি। তার নাতি-নাতনিকে দূরে ঠেলে রেখেছে এই মেয়ে। এলিজকে জানের করে আনতে গিয়ে যে বাধাটা তিনি প্রথমেই পেয়েছে, তার মূলেই আছে এই সৃজা। শুধুমাত্র ইহসানের সঙ্গিনী বলে এতদিন তিনি বরদাস্ত করেছেন মেয়েটাকে। তবে আর কোনো দয়া নয়। আজিজ শেখ কোনো দয়ার ধার ধারে না। তার নীতি সহজ, যে আঘাত করবে, তাকে ধ্বংস করতে হবে এমনভাবে, যেন সে আর কখনও উঠে দাঁড়াতে না পারে। ইহসান তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। কিন্তু সেই প্রতিপক্ষই তার প্রাণাধিক প্রিয়।

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৭

তাকে আঘাত করা অসম্ভব, কিন্তু শিক্ষা তো দেওয়াই যায়। এমন একটা শিক্ষা, যা ছেলেকে কষ্ট দিলেও তার জীবনের অর্ধেক ঝামেলা মিটিয়ে দেবে। কিন্তু অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়তে গেলে যে নিজেরও সেই গর্তে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে, সেই ব্যাপারটা কি তিনি জানেন? কোনো কালেই না!

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here