তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৭

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৭
নীল মণ

প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেছে হাসপাতাল থেকে তিয়াশা বাড়িএসেছে ,এতদিনে সে অনেকটাই সুস্থ। ডাক্তার বলেছিল, সময় লাগবে, কিন্তু যেন সময়ের নিয়ম ভেঙে দ্রুত সেরে উঠছে তিয়াশা। আর এর পেছনে একটাই কারণ জায়নের অমানুষিক যত্ন আর ভালোবাসা। ওষুধের থেকেও বড় কাজ করেছে তার সারাক্ষণ পাশে থাকা, তাকে এক মুহূর্তের জন্যও একা না ছাড়া।

জায়নের নতুন অফিস ইতিমধ্যেই জমকালোভাবে ওপেন হয়েছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সে নিজেই এখনো একদিনও অফিসে পা রাখেনি। যেন অফিস, ব্যবসা, বাইরের পৃথিবী সবকিছু তার কাছে অর্থহীন হয়ে গেছে। তার সমস্ত মনোযোগ, সমস্ত ভালোবাসা, এমনকি সমস্ত জীবন যেন বন্দী হয়ে আছে তার এই ভালোবাসার রমনীর চারপাশে। তাকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে শাওয়ার দেওয়া, মাথা আঁচড়ে চুল বেঁধে দেওয়া সবকিছুই করছে জায়ন। তিয়াশা প্রায় অবাক হয় যে মানুষটা আর কি কি ভাবে তার ভালোবাসা দেখাবে , তাদের বিয়ের এক মাসপার হয়ে গেল , বিয়ের প্রথমে ভুল বোঝাবুঝির কারনে হয়তো জায়ন নিজেকে শারিরীক ভাবে দূরে রেখেছিল , কিন্তু যত্ন ভালোবাসো তে কখনো অবহেলা
করেনি । জায়ন নিজেকেও কেমন যেন বদলে নিয়েছে যেই বউ কে দেখলেই চোখে মাদকতার নেশা ভর করত, যে মানুষটা তার সৌন্দর্যে পাগল হয়ে যেত, সেই মানুষ এখন নিজের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা ভুলে গিয়ে কেবল তাকে বাচ্চার মতো আগলে রাখছে।
তিয়াশা আজকে ধীরে ধীরে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

__”আমি তো এখন অনেকটাই ঠিক আছি, আমার নিয়ে আর এত দুশ্চিন্তা কোরো না। সবাই তো আছে পাশে। তুমি অফিস যাওয়া শুরু করো প্লিজ।”
তার কণ্ঠে সত্যিই ছিল চিন্তার ছাপ। কারণ সে জানে, এতদিন যদি অফিসকে এভাবে ফেলে রাখা হয়, তাহলে নতুন ব্রাঞ্চ এর অনেক ক্ষতি হবে।
কিন্তু জায়ন তার বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে মাথা নিচু করল। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
__”তুই কি ভয় পাচ্ছিস, যে তোর বর গরিব হয়ে যাবে?”
তিয়াশা ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করে উত্তর দিল,
__ধুর, আমি কি সেটা বলেছি নাকি?”
তার অভিমানী মুখটা দেখে জায়নের বুকটা নরম হয়ে গেল। সে হাত বাড়িয়ে মুখটা টেনে নিল কাছে, হাসল, তারপর শান্ত স্বরে বলল,

__”শোন, ফর ইউর টেনশন আমি বলছি তোর বর এই তিন বছরে যা করেছে, তাতে আমাদের ব্লাড লাইন দুই পুরুষ নিশ্চিন্তে খেতে পারবে। চিন্তা করিস না, জান। তুই আমার সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি, আমার দুই অফিসে যদি কিছু হয়ও, তাতে কিছু আসে যায় না, আমার কাছে তুই ই সব।”
তিয়াশা থমকে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখের ভেতর এক অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল। যেন সে প্রথমবার নতুন করে দেখছে তার মানুষটাকে। কি মনে হলো, হঠাৎ সে ঝুঁকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল জায়নকে।
জায়নের বুক কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর যেন হৃদস্পন্দন গুনগুন করে বাজতে লাগল। তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল এক অদ্ভুত শিহরণ,তবুও সে ধৈর্য ধরে শক্ত করে আগলে ধরল তিয়াশাকে। কিছুক্ষণ বাদে তিয়াশা সরে এসে মায়াবী চোখে তাকাল জায়নের দিকে। সেই দৃষ্টির গভীরতায় জায়নের বুক যেন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার গলায় অ্যাডামস আপল ওঠানামা করছে বারবার। কণ্ঠ কাঁপতে কাঁপতে সে বলল,

__”কি… কি করছিস জান?”
তিয়াশা এবার তার কলার ধরে নিজের কাছে টেনে নিল। তার চোখে এক মিশ্র অনুভূতির ঝড় ,অভিমান, আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা আর গভীর আকুলতা। ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ধীর গলায় বলল,
__””আমার বর তো আজকাল আর আদরই করে না। আগে তো সারাক্ষণ আমার পিছন পিছন ঘুরত, একটুও সুযোগ পেলেই আদর করত। আর এখন এতদিন কেটে গেল, বরের আদর পাচ্ছি না।”
জায়নের বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত হলো।,শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠল, ঠোঁট শুকিয়ে এলো। তিয়াশার ঠোঁট যখন ছোঁই ছোঁই করছে, তখন তার শরীর যেন কারেন্ট খেয়ে লাফিয়ে উঠছে। সে চোখ শক্ত করে বন্ধ করল, হাত মুঠো করে ফেলল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, হঠাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত উঠে গেল ওয়াশরুমে।

ভেতরে ঢুকেই শাওয়ার অন করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝরনার নিচে মাথা নুইয়ে রাখল, দুই হাত ঠেসে দিল মার্বেল দেওয়ালে। বুক ওঠানামা করছে হাপরের মতো। ঠান্ডা পানি গায়ে পড়ছে, কিন্তু শরীরের ভেতরের আগুন যেন কিছুতেই নিভছে না। প্রতিদিন এখন তাকে দিনের মধ্যে তিন চারবার শাওয়ারের নিচে দাঁড়াতে হয় নিজেকে সামলানোর একমাত্র উপায় এটুকুই।নিজের ভেতরের আগুন নিভিয়ে রাখার জন্য,নিজেকে সামলানোর জন্য।
সে লুকিয়ে রাখতে পারে নিজের উন্মাদনাকে,

নিজের ভেতরের বেপরোয়া দহনকে
এদিকে তিয়াশা হতবাক হয়ে বসে আছে। তার উন্মাদ, পাগল বর হঠাৎ এরকম করছে কেন? কয়েকদিন ধরেই সে খেয়াল করছে যখনই সে একটু ঘনিষ্ঠ হতে চায়, যখনই ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতে যায়, জায়ন পালিয়ে যায়। আজও তাই হলো। তার বুকের ভেতর নতুন করে জন্ম নিল এক অনিশ্চয়তার ভয়।
অন্যদিকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে জায়ন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সে চিৎকার করতে চায়, কাঁদতে চায়, কিন্তু পারে না। কারণ তার বুকের ভেতর একটাই কথা বাজছে,
__” ওহ গড ইটস ফা**কিং হেল, আই কান্ট গিভ হার এনি মোর পেইন নাউ। ”
তাই সে নিজের সমস্ত উন্মাদনা, সমস্ত বেপরোয়া আকাঙ্ক্ষা চাপা দিয়ে, ভেতরে ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে।
আর বাইরে বসে তিয়াশা বুঝতে পারছে না তার মানুষটা তাকে আগলে রাখছে ভালোবাসা দিয়ে, এদিকে আবার তাকে ইগনোর ও করছে।

আজ আট দিন হলো রায়ান আর অনন্যার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষার দিন ইউভি নিকেই হাতে অনন্যাকে সেন্টারে পৌঁছে দিয়ে আসে, আর রায়ান যায় বাসার ড্রাইভারের সঙ্গে। সবার ব্যস্ততা এখনো পরীক্ষার ঘিরেই, কিন্তু শুক্রবারের দুপুরে ড্রয়িং রুমে একসঙ্গে বসেছে সবাই—প্রান্তিক সাহেব, প্রণয় সাহেব, তাহসান সাহেব আর বাড়ির গিন্নিরা।
তিয়াশা যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিল, তখন যেন পুরো বাড়িটাই এক অদ্ভুত শূন্যতায় ডুবে গিয়েছিল। সবার মুখে লেগে থাকত কান্নার ছাপ, বুকের ভেতর জমে থাকত একরাশ বেদনা। কেউ ঠিকমতো হাসত না, কেউ প্রাণ খুলে কথা বলত না। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে। তিয়াশা সুস্থ হয়ে ফিরেছে, আর পরিবারের মানুষজনের মুখে আবারো সেই পুরোনো হাসি ফুটতে শুরু করেছে।
এই সময়ে প্রণয় সাহেব হঠাৎ কথার সূত্র ধরে বললেন

__”বড় ভাই, ছোট আম্মুর তো পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আজ সবাই একসাথে আছি, তাহলে ওদের বিয়ের তারিখটা ঠিক করলে হয় না? তাছাড়া আমার মেয়েটাও এখন অনেকটাই ভালো আছে।”
প্রণয় সাহেবের কথায় প্রান্তিক সাহেবের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর পাশে বসা গিন্নিদের ঠোঁটেও ফুটল হাসি। কেবল তাহসান সাহেব একটু গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। তবে তিয়াশার দুর্ঘটনার পর থেকেই ইউভি আর জায়নের উপর তার যে একরকম অকারণ অভিমান ছিল, তা অনেকটাই মুছে গেছে। এখন আর সে বিরক্ত নয়, বরং মনের ভেতরে স্বস্তি অনুভব করছে যে, সবার জীবন ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক পথে ফিরছে।
প্রান্তিক সাহেব গালভরা হাসি নিয়ে বললেন—

__”আরে, সত্যিই তো, মাথা থেকে পুরোপুরি বেরিয়েই গিয়েছিল বিষয়টা। এটা হলে খুব ভালো হয়, এতদিন ধরে শুধু আমার মা টার চিন্তায় বুকটা হাহাকার করত।”
তারপর তিনি সোজা সুরাইয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন,
__”এই যে ছোট বউমা, ছোট আম্মুর পরীক্ষা শেষ কবে?”
সুরাইয়া বেগম মুখে মিষ্টি হাসি রেখে ভদ্রভাবে উত্তর দিলেন,
__”বড় ভাইয়া, অনুর পরীক্ষা শেষ হতে এখনো ষোল দিন বাকি।”
সুরাইয়া বেগম কথার পর প্রান্তিক সাহেব কিছু বলার আগেই মেহজাবীন বেগম খুশি হয়ে বলে উঠলেন,
__””ও মা, তাহলে তো আর বেশি দেরি নেই, তবে আরোহী আম্মুর বাবার সঙ্গেও একবার কথা বলে নিয়েন আপনারা , তাদেরও তো জানানো দরকার।

মেহজাবীনের কথায় প্রান্তিক সাহেব তৎক্ষণাৎ সায় দিলেন, আর প্রণয় সাহেব এর দিকে তাকিয়ে বললেন,
__”হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। তাহলে এক কাজ করো প্রণয়, আজ বিকেলেই মোজাম্মেল আর আয়েশাদের একবার এখানে আসতে বলো। আজকেই ডেটটা ফাইনাল করে ফেলি। ছোট, তোর তো কোনো সমস্যা নেই?”
তাহসান সাহেব সামান্য থেমে হালকা হাসার ভান করে বললেন,
__”না না বড় ভাই, আমার কোনো আপত্তি নেই। তোমরা যা ভালো বোঝ, সেটাই করো।”
এই কথার মাঝেই রূহেনা বেগম খিলখিল করে হেসে উঠলেন। চোখে মুখে দুষ্টুমিভরা আনন্দ নিয়ে বললেন,
__”আরে, আমার ভাগ্য দেখুন না একবার,আমার দুই জা, আর আমার দুই বিয়ান।”
তার কথায় ড্রয়িং রুম ভরে উঠল হাসিতে , হাসির স্রোতে ভেসে গেল কিছুক্ষণের গম্ভীরতা। আর রুহেনা বেগম এর তালে তাল মিলিয়ে যোগ দিলেন প্রণয় সাহেব,

__”হ্যা, ঠিক তাই। আমার দুই ভাই ও আর আমার দুই বিয়াই হা হা হা”
এই ছোট্ট কথাতেই যেন পুরো বাড়ির আবহাওয়া উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একসময়ের কান্না আর দুঃখে ভরা এই বাড়ি আবার হাসি আনন্দে ভরে উঠছে, আর সবাই মিলে নতুন করে ভবিষ্যতের খুশির প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সূর্য তখন ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে ডুবছে, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে এক অদ্ভুত লালচে আভা। আকাশের বুকজুড়ে কমলা আর নীলের মিশ্র আলো যেন সন্ধ্যার আলপনা এঁকে দিচ্ছে। সেই মোহনীয় মুহূর্তে ব্যালকনির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইউভি, জায়ন আর আকাশ। চারপাশের হাওয়া কেমন যেন হালকা, তবু আকাশের ভেতরে চলছে ঝড়।
আকাশ এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলো,
__”বড় ভাই, আমার তো এখন ভীষণ টেনশান হচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি বিয়ের কথা শুনেই পেটের ভেতর কেমন গুরগুর করে উঠছে, ভয় লাগছে বড় ভাই।”
ওর এমন সরল আর ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে ইউভির ঠোঁটের কোণে ইতিমধ্যেই হাসি ফুটে উঠেছিল, কিন্তু জায়ন একেবারেই অন্য রকম উত্তর দিল। ভ্রু সামান্য কুঁচকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

__”তাহলে বিয়ে করতে হবে না। চল, নিচে তোর শশুর মশাই বসে আছেন, আমি এখনই গিয়ে বলে আসি তুই রাজি না বিয়েতে তারপর ওনার খুশি দেখার মত হবে আর উনি আমার পিন্ডি চটকানো ও বন্ধ করবেন।”
জায়নের এহেন কথা শুনে আকাশের চোখ যেন থালা হয়ে গেল। ব্যালকনির চেয়ার থেকে হকচকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো ,মুখে একেবারে অসহায় চাহনি। আর এই দৃশ্যটা দেখে ইউভি হেসে কুটোপাটি খেয়ে যাচ্ছিল, এত হাসছিল যে প্রায় লুটিয়ে পড়ার উপক্রম। জায়নের ঠোঁটের কোণাও মুচকি হাসিতে ভরে উঠলো, কিন্তু সে নিজের গম্ভীর ভঙ্গিটা ধরে রাখল।
আকাশ থতমত খেয়ে, গলার স্বর কাঁপিয়ে বলে উঠলো,

__”আরেহ ভাইয়া, আমি এমন কখন বললাম! আমার এই অসহায় মুখ দেখে তোমরা এমন আনন্দ পাচ্ছো? খুব ভালো, খুব ভালো, মজা লুটো তোমরা আমার!”
ওর এই অগোছালো প্রতিবাদ শুনে ইউভি আবারও হেসে উঠলো। এবার ঠাট্টার সুরে বলল,
__”বেটা তুমি বিয়েও করবে, আবার ভয়ও পাবে? তোমার দাবিকৃত জলপরীকে একটু জিজ্ঞেস করো দেখি, সে কী বলে তোমার এই ভয়ের ব্যাপারে।”
আকাশ তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল,

__”না না ইউভি ভাই, ওসব ডেঞ্জারাস কাজ আমি করবো না। যদি সত্যিই ওই ডেঞ্জারাস মাইয়া, মানে আমার বউ শুনে ফেলে, তাহলে সে সত্যি সত্যিই বিয়ে ক্যান্সেল করে দেবে।”
কথাটা শেষ হতেই জায়নের ধৈর্য ভেঙে গেল,সে ভ্রু আরও কুঁচকে আকাশের দিকে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হালকা কিন্তু দৃঢ় একটা গাট্টা দিয়ে বলল,
__”দুদিন বাদেই বিয়ে করবি, আর তুই এখনই নিজের হবু বউকে ডেঞ্জারাস মাইয়া বলছিস? সাবধান আকাশ, তোকে চাপকে সোজা করে দেব আমি। আরোহী আমার ছোট বোনের মতো। শা* আমার বউ
কে নিজের জান ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনা সেখানে তুই আমার ভাই হয়ে বউকে ডেঞ্জারাস বলবি ।”
আকাশ ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে গুনগুন করতে করতে মনে মনে বলে উঠলো,

__”মানে সবাই আমাকে ভাঙ্গা টিন পেয়ে গেল নাকি? সব সময় শুধু বিয়ে ক্যান্সেল এর হুমকি! কেউ নেই আমার পক্ষে দাঁড়ানোর, সবাই একেকজন মীরজাফর হয়ে যাচ্ছে।”
ওর গজগজ করা মুখটা দেখে ইউভি আর জায়ন আবারও হেসে উঠলো। ব্যালকনির ওপরে তখন সন্ধ্যার হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, আকাশটা লালচে কমলা আলোয় ডুবে আছে, আর ভেতরে তিনজনের এই হাসিঠাট্টা যেন বাড়ির পরিবেশে নতুন প্রাণ সঞ্চার করলো।

__” দোস্ত আমার বরের কোন সমস্যা দেখা দিছে ,
আমি খুব চিন্তায় আছি ।”
বাইরের সন্ধ্যার নরম আলোয় চার বান্ধবীর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ কলে আজ যেন অদ্ভুত এক পরিবেশ। তিয়াশার গলায় চিন্তার ভার ঝরে পড়ছিল,তার এমন কথায় আরোহী আর রুবিনা হেসে উঠলেও পরির মুখে একটুও হাসি ছিল না। বরং আরও বেশি গম্ভীর হয়ে কাঁপা গলায় গর্জে উঠল,
__” তোরা একটু হাসাহাসি বন্ধ করবি , আমার ভালো
লাগছে না ।”
পরির এমন আচরণে তিন বান্ধবী হতভম্ব, সবাই বুঝলো, সাধারণ মুড খারাপ হলে এভাবে পরি আচরণ করে না। নিশ্চয়ই ভেতরে কিছু ঘটেছে, রুবিনা হালকা করুণা মেশানো কন্ঠে বিস্ময় হয়ে প্রশ্ন করল,

__” কি হয়েছে আমার প্রাণ ভ্রমরা বলবি তো ? তা
না হলে বুঝবো কি করে ? আমার নিজের ও তো
এই বিদেশে এসে একটুও মন ভালো নেই কত কিছু
ঘটে যাচ্ছে । তোদের সঙ্গেই তো একটু হাসাহাসি করি।”
রুবিনার কথায় সবাই একটু অবাক হলেও এখন পুরো
ধ্যান পরি কে দিতে হবে, কিন্তু পরি নীরব। এতটা চুপ থাকা তার স্বভাবে নেই। আরোহী অস্থির হয়ে উঠল, তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,

__” আরে বা* বলবি তো কি হয়েছে চুপ করে না থেকে।”
এবার পরি বিরক্তি চেপে ধীরে ধীরে বলে উঠল,
__” আজকে আমায় এক ছেলের পরিবার দেখতে এসেছিল , পরশু আমার আকদ।”
বাকিরা যেন হিম হয়ে গেল। হোয়াটসঅ্যাপ স্ক্রিনের ওপারে তিনজনের চোখ একই সঙ্গে বড় হয়ে উঠল। তিয়াশা যদিও পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করল, ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু মজা করে বলল,
__” বাহ আমার কি লাক দেখলি পরশু তোর বিয়ে খাবো , রুবিনা দেশে ফিরলে ওর ও তো ওর কাজিনের
সঙ্গে বিয়ে তাহলে তখন ওটার মেন্যু টেস্ট করব। আবার এক মাস পর আমার রুহী বেবীর বিয়ে… হাহা, বিয়ের খাবার খেলেই তো আমি মোটা হয়ে যাবো।”

তিয়াশার হাসি-ঠাট্টা পরির ভেতরের ঝড় একচুলও কমাল না। ওর মুখ আগের মতোই মলিন। এরমধ্যেই
রুবিনা দাঁত চেপে কষ্ট ভরা বিরক্তি গলায় বলল,
__” ভাই রে ভাই আমি কোন দুঃখে যে এই বিদেশে ঐ বিদেশী অ্যানাকোন্ডা টার বিয়ে খেতে আসলাম , কোথায় নিজের বিয়ের শপিং করবো এখন এই আমার
আম্মুর জন্য না…….. ।”
আরোহী এই কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকালো তারপর ছুঁড়ে দিল রুবিনার উদ্দেশ্যে এক প্রশ্ন,
__” ঐ লোকটা না তোর কেমন মামা হয় , অ্যানাকোন্ডা
বলছিস কেন?”
রুবিনা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ পরি হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল। গলা ভারী হয়ে এল, কান্নার দমকে কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না, তবুও তার বেদনাভরা কণ্ঠে ভেসে এল

__” তোরা একটু চুপ করবি প্লীজ । আমার ভালো লাগছে না আমি এই বিয়ে করতে চাই না । আমি তো অন্য কাউকে …….”
বাক্য শেষ করতে পারল না। আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল। তিন বান্ধবীর বুক কেঁপে উঠল, এক অদ্ভুত মায়ায় ভরে গেল পরিবেশ। তিয়াশা কণ্ঠে স্নিগ্ধতা এনে নরম স্বরে বলল,
__” তুই কি জেমস ভাই এর কথা বলছিস ?তুই কি জেমস ভাই কে কি সত্যি সত্যি পছন্দ করিস ।”
পরি কিছু বলতে পারছে না , শুধু কান্না ভেজা গলায় চাপা কন্ঠে বলে উঠলো,
__” হুমমম…..”

এবার তিনজনই নীরব হয়ে গেল, পরিস্থিতি একটু গুরুতর। বান্ধবীর চোখের জল তারা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছে না। তখন হঠাৎ আরোহীর মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল,সে উত্তেজনায় কণ্ঠ উঁচু করে তিয়াশাকে বলল,
__” আরে বেবি তুই একবার জায়ন ভাই এর সঙ্গে কথা বল না, ভাইয়া নিশ্চই কোন উপায় বের করে ফেলবে।”
আরোহীর এই প্রস্তাবে যেন তিন জনের মনেই আসার আলো জ্বেলে উঠলো, আরোহীর এই কথায় রুবিনা ও সঙ্গ দিয়ে উঠল। তিয়াশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের চুল ঘেঁটে হালকা চিন্তামুখে বলল,

__” আমার বর এই কথা শুনলে এমনিতেই উনি
আর পরিকে অন্য কোথাও বিয়ে হতে দেবে না,
জেমস ভাইয়া আর আমাদের পরি বেবীর বিয়ে
যে করেই হোক দিয়ে ছাড়বে ।”
তিয়াশার মুখ থেকে কথাটা বের হতেই পরির ভেজা চোখে মৃদু হাসির ঝলক ফুটে উঠল। সেই হাসিতে যেন একটা ভরসা, একটা আশ্রয়ের খোঁজ মিলল, তখনই তিয়াশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর হয়ে বলল,

__” কিন্ত আমার বর তোদের বিয়ে দিতে দিতে নিজের বিয়েই ভুলে যাচ্ছে, আমার বরের মধ্যে কোন সমস্যা হয়েছে যা নিয়ে আমি ভীষন চিন্তিত।”
___” ভাইয়া আমাদের বেস্ট , বেবি তুই কি সমস্যা খুঁজে বেড়াচ্ছিস ভাইয়ার মধ্যে ।”
আরোহীর কথায় তিয়াশা একটু অসহায় মুখ করে এক আবারো এক গভির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,
__” আমার মনে হচ্ছে আমার বরের ‘ কলিকাতা হারবাল ওয়েল ‘ এর প্রয়োজন বুঝলি দোস্ত ।”
কথাটা মুখ থেকে বের হতেই হঠাৎ,
ঠাসসসসসস!

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৬

কাচের গ্লাস পড়ার শব্দ ভেসে এলো পেছন দিক থেকে। তিয়াশা চমকে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাল। বাকিরা বিস্ফারিত চোখে তিয়াশার পেছন দিকে দৃষ্টি দিয়েই হা হয়ে আছে, তিয়াশা আস্তে করে পেছনে তাকাতেই দেখে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়া দুধ, আর ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে জায়ন। তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেছে, মুখ হাঁ হয়ে আছে, যেন নিজের কানে কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here