তোমার নামে নীলচে তারা পর্ব ৭
নওরিন মুনতাহা হিয়া
সকাল প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। মেঘের রুমের দরজায় অনাবরত কড়া নেড়ে যাচ্ছে আবিহা, মেঘ দরজা খুলছে না।কাল রাতে কান্না করতে করতে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মেঘ, এখন তার ঘুম ভাঙ্গে নি। কিন্তু অপরপক্ষে মেঘের কোনো রেসপন্স না পেয়ে, আবিহার টেনশন বেড়ে যাচ্ছে। কালকে রাত থেকে মেঘের এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ, সে বুঝতে পারছে না৷ আবিহা আবার মেঘের রুমের দরজায় জোরে জোরে শব্দ করে, মেঘকে ডাকতে থাকে। দরজায় অনাবরত কড়া নাড়ার শব্দ শুনে, মেঘের ঘুম ভেঙে যায়। বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায় সে, বেলকনি থেকে সকালের রোদের ঝলমলে আলো আসছে। যা দেখে মেঘ বুঝতে পারে, সকাল হয়ে গেছে।
বিছানা থেকে উঠে মেঘ, দরজার কাছে যায়। রুমের দরজা খুলে দেওয়া সাথে সাথেই আবিহা, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মেঘকে। আবিহার এমন কাণ্ডে, মেঘ কিছুটা অবাক হয়ে বলে __
“- কি হয়েছে তোর আবিহা? এমন সকাল সকাল দরজায় নক করছিস কেনো?
মেঘের কথা সম্পূর্ণ কথার আগই আবিহা চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠে __
“- তোর কিছু হয় নি তো মেঘ? কাল রাতে রিসোর্ট থেকে এমন করে চলে আসলি কেনো? এরপর রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আসিস যার কারণে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছি।তুই কি কাল রাতের ঘটনার কারণে আমার উপর রাগ করেছিস? বিশ্বাস কর, ওই সয়তান কাজিনরা সব করেছে.
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আবিহার কথা শুনে মেঘ মৃদ্যু হাসি দিয়ে বলে উঠে __
“- কালকের ঘটনা নিয়ে তোর উপর রাগ করে নি আমি। আসলে তখন হঠাৎ করে আমার প্রচুর মাথা ব্যাথা করছিল, যার জন্য চলে এসেছি। আর রাতে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে নাই, যার জন্য দরজা খুলি নাই __.
মেঘের কথা শুনে আবিহার বিশ্বাস হয় না, আবিহা সিউর হতে মেঘকে বলে __
“- সত্যি তুই আমার উপর রাগ করিস নি?
“- হুম সত্যি __.
মেঘের কথা শুনে আবিহা চিন্তা মুক্ত হয়, কাল রাতে সে সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মেঘ আবিহাকে মিথ্যা বলে, কারণ সে চাই না। আদ্রিয়ান আর তার সম্পর্কের বিষয়ে, আবিহা জানুক। আবিহা মেঘের সাথে অল্প সময় গল্প করে, যাতে ওর মন খারাপ দূর হয়ে যায়। মেঘ প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনার অভিনয় করে। কিছুক্ষণ কথা বলার মাঝে মেঘের মনে পড়ে, আজ তার মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার লাস্ট ডেট। মেঘের স্কলারশিপ এসেছিল প্রায় এক মাস আগে। কিন্তু মেঘের আমেরিকায় আসতে দেরি হয়, কারণ তার ভিসা আর জামান সাহেবকে রাজি করাতে দীর্ঘদিন সময় লেগে যায়। আমেরিকায় মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার লাস্ট ডেট ছিল আজ, যদি সে আজ ভর্তি হতে না পরে তবে আর কখন এডমিট হতে পারবে না।
মেঘ আবিহাকে তার মেডিক্যালের এডমিশনের কথাটা বলে। আবিহা প্রথমকে তাকে যাওয়ার অনুমতি দেয় না, কারণ আজ তার মেহেদী অনুষ্ঠান। তবে মেঘের এডমিট হওয়ার লাস্ট ডেট শুনে, তাকে যাওয়ার অনুমতি দেয়। আর আবিহার গায়ে মেহেদী অনুষ্ঠান, শুরু হবে রাতে মেঘ এর আগেই বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু আজ আবিহা বা কারান কেউ, মেঘের সাথে যেতে পারবে না। যার জন্য আবিহা বলে
“- মেঘ আজ রাতে মেহেদী অনুষ্ঠান। যার জন্য আমি বা কারান কেউ তোর সাথে যেতে পারবে না। তুই একা একা কি করে যাবি? আমেরিকার রাস্তাঘাট কিছুই তোর পরিচিত না __.
মেঘ একা যাওয়ার কথা শুনে হাসে। সারাজীবন তো সে তার শত দুঃখ, কষ্ট ,যন্ত্রণা সব একাই সয্য করেছে। যে তার সমগ্র জীবন একাই কাটিয়ে দিয়েছে, তার আর একাকিত্বর ভয় হয় না। মেঘ বলে __
“- তোকে টেনশন করতে হবে না আবিহা, আমি একাই চলে যেতে পারব। আর আমি বাচ্চা নয়, যে রাস্তাঘাট ভুলে গিয়ে কোথাও হারিয়ে যাব __.
“- যদি সত্যি রাস্তাঘাট ভুলে কোথাও হারিয়ে যাস, তখন কি হবে? আমেরিকার মতো এতো বড়ো শহরে কি তোকে খোঁজে পাওয়া যাবে?
কাল থেকে মেঘ চাই, কোথাও হারিয়ে যেতে৷ এখান থেকে বহুদূর, কোনো জনমানবহীন জায়গায় একটু আশ্রয় চাই তার। এই পরিচিত আর অপরিচিত মানুষের ভীড়ে, সে আর থাকতে চাই না। মুক্তি চাই তার, মানুষের সৃতির মায়াজাল থেকে। কিন্তু মেঘ তা পারবে না, দিনশেষে তাকে সৃতির বেড়াজালে বন্ধী থাকতে হবে৷ বাহির থেকে যতই ভুলে যাওয়ার মিথ্যা নাটক করুক না কেনো, তার অন্তর যানে কতটা ভালোবাসে সে তার প্রিয় মানুষটাকে। মেঘ যখন তার চিন্তার জগতে হারিয়ে গিয়েছিল, তখন হঠাৎ করে আবিহার মনে পড়ে গাড়ির কথা। মেঘ যদি বাড়ির গাড়ি করে, ভার্সিটিতে যায়। তবে সে হারিয়ে যাবে না, বাড়ির গাড়ি করে যাবে আবার এডমিট হয়ে গেলে গাড়ি করেই ফিরে আসবে।
আবিহা তার মাথায় একটা থাপ্পড় দেয়, এত সহজ আইডিয়া তার মাথায় আসল না কেনো এতোখন৷ আবিহা বলে __
“- মেঘ তোকে টেনশন করতে হবে না। বাড়ির গাড়ি করে তুই, মেডিক্যালে যাবি। যতখন না তোর এডমিশন শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ ড্রাইভার তোর জন্য কলেজ গেইটে অপেক্ষা করবে। বুদ্ধিটা কেমন বল?
মেঘ আবিহার বুদ্ধি শুনে, মৃদ্যু হাসে। এরপর শক্ত করে আবিহাকে জড়িয়ে ধরে বলে __ __
“- দারুণ বুদ্ধিটা আমার বেস্ট টু __.
সকাল প্রায় দশটা। মেঘ তার রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, পরিপাটি হয়ে রেডি হচ্ছে। আমেরিকায় আসবে বলে, সে জামাকাপড় আগে থেকেই কিনে রেখে ছিল। যদিও বাংলাদেশে থাকতে মেঘ থ্রিপিস, বা কামিজ জাতীয় জামা পড়ে কলেজে যেত। কিন্তু আমেরিকায় সে এইসব পড়তে পারবে না, যার জন্য মেঘ কিছু লং ড্রেস আর স্কার্ট আগে থেকেই কিনে রাখে। মেঘ এখন সাদা আর কালোর সংমিশ্রণে তৈরি, একটা লং জামা আর সর্টশ পড়ে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, আর হাতে ঘড়ি পড়ে নিজেকে পরিপাটি করে সাজায়৷ এরপর তার গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ব্যাগে ভরে নেয়, এরপর রুম থেকে বের হয়ে যায়।
ড্রয়িং রুমে বসে সকালের নাস্তা করছে প্রতৈকে। ফারহানা বেগম সহ রিসর্টের স্টাফ মেম্বার, খাবার বেড়ে দিচ্ছে। আবিহার এখন ও বিয়ে হয় নি, কারানের সাথে। যার জন্য তাকে ঘরের কাজ করতে, বারণ করে দিয়েছেন ফারহানা বেগম। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে মেঘ, ড্রয়িং রুমে সকলে বসে নাস্তা করছে। মেঘ টেবিলের কোণায় দাঁড়িয়ে যায়, ফারহানা বেগম মেঘকে দেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে __
“- আরে মেঘ তুমি ঘুম থেকে উঠে পড়েছ? টেবিলের কোণায় দাঁড়িয়ে আছো কেনো? টেবিলে বসো, সকলের সাথে নাস্তা করো __.
ফারহানা বেগমের কথা শুনে, মেঘ চেয়ার টান দিয়ে খাবার টেবিলে বসে যায়। কারান মেঘকে দেখে, হাসি মুখে বলে __ __
“- গুড মনিং মেঘ __.
মেঘ মিষ্টি হাসি দিয়ে জবাব দেয় __
“- গুড মনিং কারান ভাই।
ফারহানা বেগম মেঘের প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়। কিন্তু হঠাৎ করে ওনার চোখ যায়, মেঘের ব্যাগে রাখা কাগজপত্রর দিকে। ফারহানা বেগম বিস্ময়ের সাথে বলে উঠে __
“- মেঘ তুমি ব্যাগে কাগজপত্র নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?
ফারহানা বেগমের প্রশ্ন শুনে মেঘ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আবিহা মেঘের হয়ে জবাব দেয়। আবিহা বলে __
“- মা মেঘ মেডিক্যাল কলেজে এডমিট হতে যাচ্ছে, আজই এডমিশনের লাস্ট ডেট।
“- কিন্তু মেঘ একা একা এডমিট হতে যাবে? আমেরিকায় নতুন ও, রাস্তাঘাট কিছুই পরিচিত না ওর। যদি কোথায় হারিয়ে যায়?
ফারহানা বেগমের চিন্তিত কণ্ঠ শুনে, মেঘ বলে উঠে _
“- টেনশন করবেন না আন্টি। আমি বাড়ির গাড়ি করেই যাব। আর এডমিট হতে বেশি সময় লাগবে না, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসব __.
“- ওহ আচ্ছা। তবে সাবধানে যে ও __.
“- জি অবশ্যই আন্টি __.
ফারহানা বেগম মেঘের খাবার দেয়, মেঘ সহ বাড়ির সকলে খাবার খেয়ে নেয়। মেঘ সকলকে বিদায় জানিয়ে, বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। আবিহা আগে থেকেই ড্রাইভারকে বলে রেখেছিল, মেঘের কথা।
অন্যদিকে আদ্রিয়ান সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে। বিছানায় শুয়ে কিছু সময় ঘুম ছাড়িয়ে, ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। প্রায় দশ মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বাহির হয়, ঘড়ির কাটায় তখন সময় সাড়ে দশটা। আদ্রিয়ান সাধারণ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু কাল রাতে তার ঘুমাতে দেরি হয়ে যায়, এর মূল কারণ তার কাজ। হাসপাতাল থেকে ছুটি নেওয়ার পর, যদিও তার কাজের চাপ অনেক কমে গিয়েছে। তাই অবসর সময়ে বিভিন্ন সার্জারি সহ বড় বড় ডক্টরের জ্ঞানমূলক ভিডিও সে দেখে। আদ্রিয়ান নিজে ও একজন হার্ট সার্জন।
এক ঘণ্টা পর আমেরিকার মেডিক্যাল কলেজে উপস্থিত হয় মেঘ। গাড়ি থেকে দাঁড়ায় মেঘ, তবে সামনে দাঁড়িয়ে সে অবাক হয়ে যায়। এইটা সত্যি কলেজ না, কোনো বিশাল রাজ্য। চারপাশ কত সুন্দর করে সাজানো, আর কি বিশাল মাঠ কত ছাএ ছাএী। মেঘ যা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। মেঘ কলেজের ভিতরে ঢুকে যায়, এরপর এডমিশন নিতে অফিস রুমে চলে যায়। মেঘ এডমিট হয়ে বাহির হয়, কিন্তু কলেজের অন্য যারা ছাএ ছাএীদের ভর্তি প্রায় শেষ। যার ফলে সকলের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, মেঘ এখন তাদের সাথে ক্লাস করতে হবে। অনন্ত প্রথম ক্লাস, মেঘের অবশ্যই করতে হবে।
মেঘ আবিহাকে মেসেজ করে, তার ক্লাস করার বিষয়টা জানিয়ে দেয়। আবিহা টেনশন করতে পারে। আমেরিকার সকলে ইংরেজ থাকার কারণে, মেঘের চারপাশে শুধু সাদা চামড়ার মানুষ ঘুরছে। মেঘ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তার ক্লাস রুমের দিকে, অগ্রসর হয়। ক্লাস রুম ঢুকেই মেঘ আবার অবাক হয়ে যায়, শত শত শিক্ষার্থী একই ক্লাসে বসে পড়াশোনা করছে। বাংলাদেশের তুলনায় আমেরিকার, ক্লাস রুমের আয়তন বিশাল। মেঘ প্রথম সারিতে সিট ফাঁকা দেখে, সেখানে বসে যায়। সকলের ভিড়ে মেঘ বেশ অপ্রস্তু ফিল করে, তখনই তার পাশে থাকা একজন মেয়ে বলে উঠে _
“- এই তুমি কি বাঙালি? বাংলাদেশ থেকে স্কলারশিপে এসেছ পড়াশোনা করতে?
বাংলা ভাষায় কথা প্রশ্ন শুনে, মেঘ তার পাশে ঘুরে তাকায়। সেখানে একজন মেয়ে বসে আছে, পোশাকসজ্জা দেখে তাকে বাঙালি মনে হচ্ছে। মেঘ উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে –
“- হুম আমি বাঙালি। তুমি ও কি বাঙালি? বাংলাদেশ থেকে এসেছ?
পাশে থাকা মেয়েটা সম্মতি দিয়ে বলে উঠে __
“- হুম আমি ও বাঙালি আমার নাম নূহা __.
“- আমার নাম মেঘ __.
মেঘ আর নূহা একে অপরের মাঝে কথা বর্তা বলা শুু করে দেয়। খুব শীঘ্রই তারা খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায়। তবে ক্লাসের সকলে যখন হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে যায়, তখন মেঘ বুঝতে পারে স্যার আসছে। মেঘ ও দাঁড়িয়ে যায়, সাথে নূহা ও। মেঘ লক্ষ্য করে আশেপাশের সকলে, তাদের জামাকাপড় আর সাজসজ্জা ঠিক করছে৷ যা দেখে মেঘ অবাক হয়ে নূহাকে বলে __
“- আচ্ছা স্যার আসার কথা শুনে, সকলে এমন জামাকাপড় ঠিক করা শুরু করে দিয়েছে কেনো?
মেঘের কথা শুনে নূহা বলে __
“- আরে মেঘ আজ মেডিক্যালে নতুন টিচার্র আসবে, ক্লাস করাতে। আমাদের আগের টির্চারের, বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওনি বাংলাদেশে চলে গেছেন। আর ওনার দায়িত্ব তার বন্ধুর উপর দিয়েছেন। আজ সকালে গ্রুপে সকলে তার ছবি দেখেছে, নতুন ভীষণ সুর্দশন আর সম্মার্ট। যার জন্য সকলে একটু, তাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে __.
মেঘ নূহার কথা বুঝতে পারে, মেঘ বলে __
“- ওহ ওকে __.
ক্লাস রুমের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে আদ্রিয়ান। মেঘ যখন সালাম দেওয়ার উদ্দেশ্য, দরজার দিকে তাকায়। তখন হঠাৎ করে আদ্রিয়ানকে দেখে থমকে যায়, তার চক্ষু জোড়া সেখানে স্থির হয়ে যায়। মেঘের চারপাশের সকলে, নতুন প্রফেসরকে স্বাগত জানায়। কিন্তু মেঘের কণ্ঠ দিয়ে একটা ধ্বনি ও উচ্চারিত হয় না, শুধু ফ্যালফ্যল করে তাকিয়ে থাকে। আদ্রিয়ান আজ প্রথম শিক্ষার্থীদের ক্লাস করাবে, সকালে তার বন্ধু রায়ান ফোন করে বলে যে তার বাবা অসুস্থ। যার জন্য তাকে বিশ তিরিশ দিনের জন্য দেশে, ফিরে যেতে হবে। এই কয়েকদিন যাতে আদ্রিয়ান, তার ক্লাস করায়।
আদ্রিয়ান সাধারণ আগে প্রচুর ব্যস্ত থাকত।তার হাসপাতাল আর সার্জারি নিয়ে। কারণ হাসপাতালে খুব বেশি হার্ট সার্জন ছিল না। কিন্তু এখন হাসপাতালে নতুন কয়েকজন ডক্টর নিয়োগ করা হয়েছে, যার ফলে তার কাজের চাপ কিছুটা কমে গেছে। যখন রায়ান তার বাবার অসুস্থতার কথা বলে, তখন আদ্রিয়ান আর না করে থাকতে পারে না। ক্লাসের সকল স্টুডেন্টকে আদ্রিয়ান হাতের ইশারা দিয়ে বসতে বলে, সকলে বসে যায় শুধু মেঘ ছাড়া। মেঘকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, নূহা ওকে ডাক দেয়। মেঘের এতোখন পরে খেয়াল হয়, সে সিটে বসে যায়। আদ্রিয়ান ক্লাসের উদ্দেশ্য কিছু কথা বলতে থাকে, যেহেতু সে আজ প্রথম ক্লাস নিবে।
মেঘ যার থেকে বাঁচতে কলেজে এসেছে, তার সাথেই দেখা হয়ে গেলো তার। ওইদিন রিসোর্টে আদ্রিয়ানকে খুব ভালো করে দেখতে পারে নাই, আজ মনোযোগ সহকারে আদ্রিয়ানকে দেখছে। সাত বছর আগের মানুষটা, আর পরের মানুষটার মধ্যে কত তফাত। নূহা লক্ষ্য করে মেঘ অনেক সময় ধরে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে, নূহা মেঘকে ধাক্কা দিয়ে বলে ___
“- কি মেঘ স্যারকে প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে গেলে না কি?
নূহার মজা করে বলা কথাটা, মেঘের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। মেঘ আদ্রিয়ানের প্রেমে পড়েছে, প্রায় সাতবছর আগে। এখন আর নতুন করে কি পড়বে, কিন্তু মেঘ এইসব কি ভাবছে। সে কেনো আদ্রিয়ানকে নিয়ে ভাবতে যাবে, আদ্রিয়ান কে হয় তার? মেঘ তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, আদ্রিয়ানের উপর থেকে। নূহা আবার মজা করে বলে উঠে –
“- আন স্যার কিন্তু ভীষণ সুর্দশন। আর কি বডি ফিটনেস, কথা বলার ধরণ সত্যি অসাধারণ। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো, কিলার লুক আছে আন স্যারের.
মেঘ নূহার সকল কথা না শুনলে ও, একটা শব্দ শুনে তা হলো ” আন “। এই আন নামটা আবিহা তাকে বলেছিল, যখন সে বিমানে ছিল। বিমানবন্দর থেকে তাকে রিসিভ করার কথা ছিল, ” আন নামের মানুষটার। যিনি কারান ভাইয়ের মামাতো ভাই হয়। মেঘ নূহাকে প্রশ্ন করে __
“- আন স্যার মানে? ওনার নাম তো আদ্রিয়ান তাই না?
– হুম আদ্রিয়ান রেদোয়ান শর্ট ফর্ম আন। ডক্টর ঃ আন। যিনি একজন বিখ্যাত হার্ট সার্জন __.
মেঘের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তার মানে আদ্রিয়ান, কারানের দূরের আত্মীয় নয়। বরং ওর আপন ফুফাতো ভাই। আর আদ্রিয়ান আমেরিকায় তার মামার বাসায় থেকে পড়াশোনা করে, সেই মামা আর কেউ না কারানের বাবা। আর তার মামি হলেন ফারহানা বেগম। মেঘের গলা শুকিয়ে আসছে, মাথা পুরোটা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। যার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য মেঘ, কলেজে এসে পড়েছে। সেই তার কলেজের টির্চার। যার সাথে জীবনে একবার দেখা হোক সেটাই সে চাই নি, এখন থেকে বাড়ি কলেজ সকল জায়গায় তাকেই দেখতে হবে। মেঘের এখন প্রচুর আর রাগ হচ্ছে তার উপর, মেঘ তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হাত দিয়ে টেবিলে জোরে শব্দ করে।
শব্দটা বেশ জোরে করায়, আদ্রিয়ান তা শুনতে পায়। আদ্রিয়ান মেঘের দিকে তাকায়, মেঘ রাগের বশে কি করে ফেলেছে তা বুঝতে পারে। মেঘ মাথা নিচুঁ করে চুপচাপ বসে যায়, আদ্রিয়ান হয়ত মেঘকে কাল রাতে দেখেছে। তবে এতটা খেয়াল করে নি। আদ্রিয়ান মেঘের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, এরপর ক্লাসে মনোযোগ দেয়। আদ্রিয়ান সকল টপিক খুব সুন্দর করে বোঝায়, মেঘ ও তার বই বের করে পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়। সকল ছাএ ছাএীর ভিড়ে, যতবার মেঘের উপর আদ্রিয়ানের চোখ পড়েছে। মেঘ তার চোখ সরিয়ে নিয়েছে, আদ্রিয়ান হয়ত বিষয়টা খেয়াল করে তবে কিছু বলে না।
ক্লাস শেষ করে আদ্রিয়ান তার বাড়িতে ফিরে আসে৷ মেঘ ও প্রথম ঘণ্টা করে, বাড়ির গাড়ি করে বাড়িতে ফিরে আসে। বিকাল প্রায় সাড়ে পাঁচটা, রিসাের্টের ড্রয়িং রুমে সকলে ডান্স রিহার্সাল করছে। মেঘ কলেজ থেকে এসে খাওয়া দাওয়া করে শেষ করে, বিশ্রাম নেয়। আদ্রিয়ানের সাথে মেঘের আর দেখা হয় না, আর মেঘ দেখা করতে ও চাই না। মেঘ সিঁড়ি দিয়ে নিচে ড্রয়িং রুমে কাছে চলে যায়,সকলে আমেরিকার ইংরেজি গানে ডান্স করছে। যা দেখে মেঘ বিরক্ত হয়, আর তাদের ডান্স দেখে মনে হচ্ছে এইটা কোন পার্টি। মেঘ সকলের থেকে দূরে এক কোণায় বসে থাকে।
কারান সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে সকলের নাচ দেখছিল, আবিহা এখন তার রুমে রেডি হচ্ছে। আদ্রিয়ান তার হাতে কফির মগ নিয়ে রুম থেকে, বের হয়ে আসে। সিঁড়ির মধ্যে কারানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আদ্রিয়ান বলে __
“- এমন মনোযোগ সহকারে, নিচে কি দেখছিস? আবিহাকে?
আদ্রিয়ান তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে __
“- না আবিহাকে দেখছি না। বরং ওর সুন্দরী বন্ধুদের দেখছি __.
“- আবিহা যদি এইটা দেখে, তবে তোকে খুন করে ফেলবে __.
“- আবিহা এখন মেহেদীর অনুষ্ঠানের জন্য রেডি হচ্ছে। এখানে আসার কোন চান্স নাই __.
“- ওকে গুড দেখতে থাক __.
“- আমি একা কেনো দেখব, তুই ও দেখ.
“- কি দেখব?
“- আমার সুন্দরী শালিদের কে দেখ __.
আদ্রিয়ান একবার নিচের দিকে তাকিয়ে, সকলের নাচ দেখে। এরপর মুখ ঘুরিয়ে ফেলে, মেয়েদের প্রতি তার আগ্রহ বরাবরই কম। আর এমন উশৃঙ্খল মেয়েদের সে খুবই অপছন্দ করে, আদ্রিয়ান বলে __
“- মেয়েদের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট কখন আসে নি, আর আসবে ও না। সুন্দরী নারীর সাথে প্রেম করা যায়, কিন্তু সংসার করার জন্য গুণবতীর দরকার হয়।
“- আরে তাই বলে কি তুই কখন বিয়ে করবি না? আচ্ছা নিচে দেখ, ওই সাদা ড্রেস পড়া মেয়েটা সুন্দর না?
কারানের কথায় আদ্রিয়ান আবার নিচে তাকায়, তবে সকলের ভিড়ে তার চোখ যায় মেঘের উপর। যে শান্ত, আর ভদ্র, হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আদ্রিয়ান বলে _
“- হুম লাল রঙের ড্রেস পড়া মেয়েটা সুন্দর __.
কারান নিচে তাকিয়ে দেখে যার কথা সে বলছে, তার পড়নে সাদা রঙের ড্রেস। কারান বলে __
“- লাল রঙের ড্রেস কোথায় দেখলি তুই?
আদ্রিয়ান হাতের ইশারা দিয়ে, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘকে দেখিয়ে দেয় __
“- ওই যে দূরে এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা _.
“- মানে মেঘ। তোর মেঘকে পছন্দ?
“- আমার কাউকে পছন্দ না। আমি শুধু উদাহরণ দিয়ে বললাম, এইরকম শান্ত, ভদ্র, মেয়েরা সবসময় সুন্দরী হয় __.
কারান আর আদ্রিয়ান কিছুসময় কথা বলে, এরপর কারান চলে যায় রেডি হতে। আদ্রিয়ান কফির মগে ঠোঁট ছুঁয়ায়, আর মেঘের দিকে একবার দেখে। মেঘ ও হঠাৎ করে উপরে তাকায়, তখনই তাদের দুই চোখ মিলিত হয়। মেঘ দ্রুত তার চোখ সরিয়ে নেয়, এরপর আবার সকলের নাচের দিকে তাকায়। আদ্রিয়ান কফি খাওয়া শেষ করে, তার রুমে চলে যায়।
রাত প্রায় সাতটা। বাড়িতে মেহেদীর অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। মেঘ গোলাপি রঙের শাড়ি, আর হালকা লিপস্টিক দিয়ে নিজেকে মানানসই সাজায়৷ এরপর সে আবিহার পাশে বসে, সকলে গান বাজনা আর নাচ করছে। আবিহা মেঘকে বলে __
“- মেঘ তুই ও হাতে মেহেদী দে, সকলে দিচ্ছে যখন __.
মেঘকে একজন মহিলা হাতে মেহেদী দিয়ে দেয়। আদ্রিযান তার রুমে বসে ছিল, কিন্তু বাহিরের গান বাজনার কারণে তার কাজে মনোযোগ দিতে পারল না। আদ্রিয়ান রেডি হয়ে নিচে নেম আসে, তখনই ড্রয়িং রুমে তার ফারহানা বেগম সাথে দেখা হয়৷ মেঘের চোখ যায় আদ্রিয়ানের উপর, যে এখন ফারহানা বেগমের সাথে কথা বলছে। মেহেদী পড়ানো মহিলা মেঘকে জিজ্ঞেস করে __
“- ম্যাম আপনার স্বামী বা বয়ফ্রেন্ড আছে কি? তার নাম কি?
মেঘ আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার কিছু খেয়াল করতে পারে না। যার ফলে মেঘ বলে __
“- আদ্রিয়ান রেদোয়ান __.
মেঘের কথা শুনে, মহিলা ওর হাতের ঠিা মাঝে বড়ো করে আদ্রিয়ান রেদোয়ান নাম লিখে দেয়। মেঘ এই বিষয়টা দেখে না, তার খেয়াল ও নাই৷ প্রায় দশ মিনিট পর মেঘের হাতে মেহেদী দেওয়া শেষ হয়, মেঘ সেখান থেকে উঠে দূরে গিয়ে দাড়াঁয়। আবিহার সকল কাজিন এখন মেহেদী দিবে। মেঘ দূরে সুইমিংপুলের কাছে যায়, তার হাতের মেহেদী দেখতে থাকে। হঠাৎ করে মেঘের চোখ যায়, তার হাতের মাঝে বরাবর আদ্রিয়ান রেদোয়ান নাম লেখা। মেঘ নামটা দেখার সাথে সাথে চমকে যায়, একটু আগের ঘটনার কথা মনে পড়ে তার।
যদি এখন কেউ মেঘের হাতে আদ্রিয়ানের নাম দেখে, তবে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মেঘ সবাইকে কি উত্তর দিবে। মেঘ তাড়াতাড়ি করে তার মেহেদীর মুছতে শুরু করে, কিন্তু এইটা উঠে না। মেঘ সুইমিংপুলের পানির মধ্যে, তার হাত ভিজায়। এরপর মেহেদী তুলতে থাকে, আদ্রিয়ান এতোখন ফারহানা বেগমের বকা শুনছিল। কারণ সে সারাদিন বাসায় ছিল না, তবে অনেক সরি, আর অযুহাত দিয়ে সে ফারহানা বেগমের মুক্তি পায়।
আদ্রিয়ান সুইমিংপুলের এইদিকে আসে, কারণ এত গান বাজনা শব্দ তার ভালো লাগছিল না। আদ্রিয়ান দেখে একজন মেয়ে, সুইমিংপুলের পানির মধ্যে তার হাত ধুয়ার চেষ্টা করছে। যা দেখে সে তার কাছে এগিয়ে যায়, আদ্রিযান বলে __
তোমার নামে নীলচে তারা পর্ব ৬
“- আপনি সুইমিংপুলের পানির মধ্যে হাত পরিস্কার করছেন কেনো? রিসোর্টে কি ওয়াশরুম নাই? এখানের পানি কেনো নোংরা করছেন?
আদ্রিয়ানের কণ্ঠ শুনে তাড়াতাড়ি মেঘ তার হাত ধুয়েঁ, উঠে পড়ে। তবে আদ্রিয়ান তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকায়, মেঘ তার বুকের সাথে ধাক্কা খায়। মেঘ যখন টাল সামলাতে না পেরে সুইমিংপুলো পড়ে যেতে লাগে, তখন আদ্রিয়ান দ্রুত তার হাত ধরে ফেলে। শক্ত করে। আদ্রিযান মেঘের কবজি ধরে, তখনই তার চোখ যায় মেঘের হাতে লেখা তার নামের দিকে। যেখানে বড়ো বড়ো করে স্পষ্ট করে লেখা আছে ” আদ্রিয়ান রেদোয়ান। আদ্রিয়ান অবাক হয়ে বলে __
“- আপনি আমার নাম ‘ আদ্রিয়ান রেদোয়ান আপনার হাতে লিখছেন কেনো?
মেঘ যেটার ভয় পেয়ে ছিল, তাই হয়েছে। মেঘ মনে মনে বলে __
“- সর্বনাশ __।
