স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৪

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৪
সানজিদা আক্তার মুন্নী

নাজহা পড়েছে মুশকিলে। হাত-পা তিরতির করে কাঁপছে আর কাঁপবেই না কেনো? ইকরাব যে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। আজ ওদের তালুকদার বাড়ি থেকে শিকদার বাড়িতে টিফিন নিয়ে এসেছেন ওর চাচা নাদের আর নাহিদ, সাথে ওর দুই ভাতিজা সাফওয়ান আর জিবরান। এরা নাজহার বয়সেরই, দুই ভাগনাও এসেছে, এরা ওরই বয়সের, ঐ দু এক মাস ব্যবধান ফাইজ আর রায়াদ। এদের সাথে ইকরাবও এসেছে।

শিকদার বাড়ির বড় লিভিং রুমের সোফায় বসে আছেন সবাই, সাথে নাজহার দাদাশ্বশুর তুওয়াঈদ শিকদারও আছেন, নাজহার শ্বশুর তৌশিকুর শিকদার আর তৌসির নাযেম চাচা, মিনহাজ মামাও আছেন। তৌসিরের বিবিজান, তুওয়াঈদ শিকদারের বেগম নূরজাহান হাতুনও আছেন।‎নাজহাকে চা দিয়ে পাঠানো হয়েছে নিজের বাড়ির লোকের সাথে কথা বলতে। নাজহা ইকরাবকে দেখেই স্তব্ধ হয়ে গেছে, আর কি চা দিবে আর স্তব্ধ হয়েছে কারণ ও জানে ইকরাব ওকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসে। ইকরাব যে ঠিক আছে, এটাই অনেক নাজহা খুঁজে পাচ্ছে না ইকরাব কবে এলো? যদিও নাজহার ইকরাবকে ওতটা পছন্দ নয়, কিন্তু ও জানে ভালো করেই ইকরাব ওর জন্য দিওয়ানা। চারদিকে চোখ বুলিয়ে নাজহা নিজের মাস্টার চাচ্চু আর ছোট চাচ্চুকে সালাম দিয়ে তাদের হাতে চা তুলে দেয়। মুচকি হাসার ভান করে ইকরাবের দিকে এগোতেই ইকরাব বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ওকে উঠতে দেখে নাজহা সহ ওর বাড়ির লোকরা ভয় পেতে শুরু করেন, কি জানি কি করে। নাহিদ চাচ্চুরা তো ওকে নিয়ে আসতে চাননি, কিন্তু বেপরোয়া হয়ে এসেছে, কথা দিয়েছে উল্টাপাল্টা কিছু করবে না, শুধু নাজহাকে একটিবার দেখতে চায়।
নাজহা ইকরাবের দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে ওর দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলে,‎ক কেমন আছো মাস্টার ভাই?
ইকরাব নাজহার মুখের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিতে নিতে বলে‎ আছি, তুই কেমন আছিস? সেই ছোট্ট তুইকে রেখে গিয়েছিলাম, আর আজ তোর শ্বশুরবাড়িতে এলাম!

নাজহা ইকরাবের কথা শুনে মাথা নিচু করে নেয়। ইকরাব চায়ের কাপটা রায়াদের হাতে দিয়ে নিজের পকেট থেকে কি একটা বের করতে থাকে। নাজহা এটা দেখে ভয় পেয়ে মাস্টার চাচ্চুর দিকে তাকায়, ভীমড়ি খেয়ে উনি মাথা নাড়িয়ে বোঝান কিছু জানেন না। ইকরাব নিজের পকেট থেকে একটা রিং এর বক্স বের করে নাজহার হাতের চায়ের ট্রেতে রেখে বলে “তোর বিয়েতে থাকতে পারিনি, এটা আমার পক্ষ হতে তোর বিয়ের সালামি!
নাজহা এটা শুনে হতবাক হয়ে ইকরাবের দিকে তাকায় এ লোক কি চাচ্ছে পাগল হয়ে গেলো নাকি। নাজহা মাথা নাড়িয়ে বলে “শুকরিয়া ভাইয়া” এটা শুনে ইকরাব হাত বাড়িয়ে নাজহার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে “তুই ভালো থাকিস ফুল” নাজহা ভয় পেয়ে মুখ তুলে নিজের কালচে সবুজ নয়নায় বিষণ্ণ চোখে তাকায় ইকরাবের চোখের ন্যায়। ইকরাব ওর চাহনি দেখে ওর চোখের ন্যায় নিস্তেজ চোখে তাকিয়ে থাকে।

তাদের এই তাকানো দেখে তৌসির নিজের পাশে নাযেম চাচাকে কুনই দিয়ে গুতা মারে। এতে নাযেম চাচা চারদিকে এক নজর তাকিয়ে ওর দিকে ঝুঁকেন। তৌসির ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে “ও চাচা, এই গাদ্দার আমার বউয়ের দিকে এমন আশিক নজরে ক্যান তাকায়?”
নাযেম চাচা ওর এমন ইজ্জতহীন কথা শুনে ফিসফিসিয়ে ধমকে বলেন “বেইজ্জতি বাণী বন্ধ কর, সাউয়ার নাতি, এরা ভাই বোন।”

তৌসির এটা শুনে বুক ভরে শ্বাস টেনে বলে “আমি সাউয়ার নাতি হলে তোর বাপ সাউয়া হালা গাদ্দারের জরম্মা!”
নাযেম চাচা আর কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই নাজহা চা এগিয়ে দেয়। তৌসির মনে করে ওকে দিচ্ছে, কিন্তু নাজহা তৌসিরের হাতে না দিয়ে আগে নাযেম চাচার হাতে দেয়, তারপর তৌসিরের হাতে এগিয়ে দেয়। নাজহার এই ছিছকামি দেখে তৌসিরও চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে একটু নাড়া দেয়, এতে তৌসিরের হাতেই চা অল্প পড়ে যায়। চা পড়তেই তৌসির শব্দ করে বলে ওঠে “ইস, গরম চা পইড়া গেলো।

নাজহা দাঁত চেপে তৌসিরের সামনে বসে ট্রেটা টি টেবিলে রেখে হাত ধোয়ার জন্য বাটিতে যে পানি রাখা আছে , সেই পানিতে নিজের ওড়নার এক কোণ ভিজিয়ে তৌসিরের বাঁ হাতে ভিজে ওড়নাটা চেপে ধরে। তৌসির এটা দেখে ঠোঁটের এক কোণে শয়তানি হাসি টেনে নাজহার দিকে তাকায়, তারপর ডান হাত বাড়িয়ে অতি যত্নে নাজহার মাথায় ওড়নাটা টেনে দিতে থাকে। তৌসিরের ছোঁয়ায় শরীর জ্বলে যাচ্ছে নাজহার, কিন্তু কিছু করতে পারছে না। তৌসির নাজহার মাথার ওড়না ঠিক করে দিয়ে ওর মাথায় হাত আলতো করে বুলিয়ে দিতে দিতে ইকরাবের দিকে ক পলক হিংসুক চোখে তাকায়, যে কিনা ওদের পানে আহত নয়নে তাকিয়ে আছে। তৌসির ইকরাব কে চোখের চাহনি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় “তুমি যতই আশিক হও না ক্যান, হালার পুত, বউ কিন্তু আমার।”

ইকরাব নিজের চোখ সরিয়ে নেয়, অন্তর জ্বলে যাচ্ছে, নাজহার হাতে তৌসিরের নামের চুড়ি দেখে ভেতর খা খা করছে। ইকরাব হাঁসফাঁস করে চারদিকে তাকায়, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ইতস্তত গলায় বলে “আ আমি তাহলে আসি, একচুয়ালি অনেক কাজ আছে। এই বাড়ি এলাম তো, আর বাড়ি এসে কারো সাথে দেখা করিনি, এবার যেতে হবে।”
এ বলেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইকরাব বেরিয়ে যায়। মাস্টার চাচ্চু পরিস্থিতি সামলাতে বলে “আসলে ও গতকালই এসেছে, অঘুমা হয়েছে, তাই… তাহলে আমরাও আসি।”
নাজহা তাদের কথা শুনে উঠে দাঁড়ায়, মাস্টার চাচ্চুর দিকে এগিয়ে এসে আমতা আমতা করে বলে “চ চাচ্চু, তালহা ভাই এলেন না? বিয়ের সময়ও ছিলেন না তো!”

ছোট চাচ্চু উঠতে উঠতে বলেন “আসবে একদিন, আসবে নে, আজ সবাই আসা সম্ভব হয়নি!”
নাজহা মাথা নাড়ায়। মাস্টার চাচ্চু আর ছোট চাচ্চু দুজন দুদিক দিয়ে ওকে জড়িয়ে দিয়ে ওর মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে বলেন “ভালো থাকিস, আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমায় বলিস ফোন করে!”
নাজহা দুই হাতে দুজনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে “তোমরা চিন্তা করো না!”
এ বলে ছোট চাচ্চুর বুকে মাথা ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলে “আর মাস্টার ভাইয়াকে এখানে আসতে দিও না বেশি।”
ছোট চাচ্চু চারদিকে তাকিয়ে মেকি হেসে ওকে ফিসফিসিয়ে বলেন “তুই চিন্তা করিস না!”
মাস্টার চাচ্চু তৌসিরের দিকে তাকিয়ে বলেন “আচ্ছা, নাজহার ফোন ওকে দিলে কোনো সমস্যা হবে!”
তৌসির উঠে দাঁড়িয়ে মেকি হেসে বলে “না না, সমস্যা হবে কেনো, দিতে পারেন!”
মাস্টার চাচ্চু অনুমতি পেয়ে নাজহার হাতে নিজের পকেট থেকে নাজহার ফোনটি তুলে দিয়ে বলেন “তোর ফোন!”
নাজহা ফোনটা হাতে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে “হুম””

নাজহার ফোনটা ওর সাহেব চাচ্চু দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া থেকে। ফোন দেখেই নাজহার উনার কথা মনে পড়ে গেলো।
নাজহারা সবাই বিদায় নিয়ে চলে যান। নাজহাও সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে মাথা নিচু করে রুমের দিকে পা বাড়ায়। নাজহা যেতেই মিনহাজ মামা তৌসিরকে বলেন “তোর কপাল ভালো, নইলে তোর মতো অভদ্রের কপালে এমন ভদ্রা মাইয়া, সত্যি ভাগ্যের খেলা”
তৌসির মিনহাজ মামার কথায় উনার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,” ভদ্রতা তোমাদের দেখায় কিন্তু ঝাল ঝাড়ে আমার উপরে।”
এ বলে নিজের লুঙ্গির নিচের এক কোণ হাতে তুলে রুমের দিকে পা বাড়ায়, পার্টি অফিসে যেতে হবে, বিয়ের তালে কাজকর্ম সব চাঙ্গে।

ইকরাবরা গাড়িতে উঠছে। শিকদার বাড়ির বড় উঠানের এক সাইডেই গাড়ি দাঁড় করানো। ইকরাব গাড়ির দরজা খোলে উঠতে নেয়, কিন্তু কী একটা মনে করে উপরের দিকে তাকায়। তাকাতেই চোখ পড়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা থ্রিপিস পরিহিত ওর নিজের ফুলকে যে কিনা আজ অন্য কারো আঙিনায় গুচ্ছিত। ইকরাবের বুকের ভেতরখানা মুচড়ে উঠে, চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না, তবে এমন কেন হলো? ইকরাব কিছু সময় তাকিয়ে তিক্ত হাসি দিয়ে গাড়ির ভেতর উঠে বসে। আর গাড়ি স্টার্ট হয়। ইকরাব গাড়ির ভেতর থেকেও পিছনে তাকায়, আরেকবার দেখবে বলে, কিন্তু আর দেখতে পায় না। ইকরাব সামনে তাকাতেই দেখে ওর ছোট চাচ্চু ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন। ইকরাব উনার চাওয়া দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিজের চোখের পানিটুকু মুছে নেয়। কিন্তু নাহিদ চাচ্চু নিজেকে সামলাতে পারেন না উনি ইকরাবের গলা টেনে ধরে কেঁদে উঠে বলেন,”মাফ করে দিস রে বাবা, আমরা কিচ্ছু করতে পারিনি!”

ইকরাব একটু সায় পেয়ে হুহু করে কেঁদে উঠে বলে,”ছোট চাচ্চু, তেমায় আমি বলতে পারব না, বুঝাতে পারব না আমার অন্তরের যন্ত্রণা!”
মাস্টার চাচ্চু সামনের সিটে বসে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলেন,”এক বাড়িতে আমার ছোট্ট নাজহা ছটফট করছে আর অন্য বাড়িতে তুই, ঐদিকে অস্ট্রেলিয়ায় দাদাভাই। আমি ট্রমার মধ্যে চলে যাচ্ছি।”
সাফওয়ান মাস্টার চাচ্চুকে বলে,”আচ্ছা দাদাভাই, কেমন হয় যদি মণিকে আমরা পালিয়ে নিয়ে মাস্টার চাচ্চুর লগে বিয়ে দিয়ে দেই?”

সাফওয়ানের এমন বেকুবি বাণী শুনে মাস্টার চাচ্চু ওর দিকে চোখ গরম করে তাকান, সাফওয়ানের মুখ সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায়। জিবরান বলে,”আল্লাহ তোকে এক মগজ দিছে ভাই, যা ভালো কাজে কখনো কাজ করে না।”ফাইজ বলে,”মগজ থাকলে না কাজ করবে?”
নাজহা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গেটের পানে। ইকরাবের আহাজারি নাজহা স্পষ্ট ওর চোখে দেখেছে, কিন্তু এতে নাজহার বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছে না। ওর তো প্রাণ চলে যাচ্ছে নিজের শ্যামপুরুষের জন্য যাকে আজ চারদিন অবধি চোখের দেখা দেখেনি। নাজহা শুধু একবার ওকে দেখতে চায়, শুধু দেখতেই চায়, আর কিছু না। নাজহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই নিজেকে বলে,”দূরে গেলেই কি পর হয়ে যাবেন? দূরত্বে আর যাই হোক, ভালোবাসা কমবে না।”

“কিতা লো, তালুকদারের মাইয়া, তোমার এই চাচাতো ভাই তোমার আশিক-টাশিক নাকি? এমনে মরণ হইয়া গেলো ক্যান ওর?”
একটু দুঃখও প্রকাশ করতে পারল না নাজহা এর আগেই তৌসির পিছন থেকে টিটকারি দিয়ে এই কথাটা বলে ওঠে। নাজহা বিরক্ত হয়ে পিছনে ঘুরে তৌসিরের পানে ঘৃণাচ্ছন্ন চাহনি নিয়ে তাকিয়ে বিষে ভরা গলায় বলে,”আপনি এত নিকৃষ্ট কেন? এত বাজে কেন? আপনি একটু ভালো চিন্তাভাবনা করতে পারেন না?”

তৌসির নাজহার এমন সাপের মতো ফুঁসফুঁসানি দেখে গা ছাড়া ভাব নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে,”কোনো বাল জিগাইলেই এমন ফ্যাতফ্যাত করো ক্যান? আর তোমার চাচাতো ভাইয়ের অবস্থা দেখেই আমি কইলাম!”
নাজহা তৌসিরের কথায় সোজা জবাব দেয় এবার,”হ্যাঁ, মাস্টার ভাই আমায় পছন্দ করেন, আমার উনার সাথেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল আর তাই উনি কষ্ট পাচ্ছেন!”
তৌসির নাজহার কথায় কিছু বলে না, চুপচাপ কিছু সময় নাজহার দিকে তাকিয়ে চোখ নিচু করে বা হাতের আঙুল দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে কী একটা ভাবে, তারপর আবার নাজহার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে,”তুমিও পছন্দ করো?”

নাজহা তৌসিরের কথায় চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিজের দুই হাত বুকে বাজ করে নিয়ে গুঁজতে গুঁজতে বলে,”না।”
নাজহার কথা শুনে তৌসির খানিকটা থমকায়, তারপর আড়ো চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি অন্য কাউরে পছন্দ করো নাকি?”
তৌসিরের প্রশ্নে নাজহা কিছুটা ভরকে যায়, কিন্তু মিথ্যা নাটক করার মেয়ে নাজহা নয়, তাই সত্যিটা বলে দেয়,”হ্যাঁ, করি।”
ওর উত্তর শুনে তৌসির ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করে,”তার কাছে যাইতে চাও?”
নাজহা তৌসিরের কথায় কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে এই তৌসির রেগে গেল না কেন? সত্যিটা জানার পর তো দু-একটা গালি দেওয়া উচিত, কিন্তু কই, কিছুই তো বলছে না, উল্টো জিজ্ঞেস করছে এক অদ্ভুত কথা। নাজহা শান্ত চোখে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি আমায় তালাক দেবেন?”

“না!”
“তাহলে এ কথা আর দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করবেন না। আর আরেকটা কথা ভাববেন না আমি চরিত্রহীন। তাকে আমি পছন্দ করতাম, কিন্তু আমার আর তার কখনো কোনো সম্পর্ক ছিল না!”
তৌসির এটা শুনে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“তাহলে ঠিক আছে, তোমার এই আবেগি প্রেমটেম জানলা দিয়া উড়াল দিবো, বছরে বছরে আমার পক্ষ হইতে বাচ্চা দু-একটা গিফট পাইলে!”
নাজহা তৌসিরের কথায় রুক্ষ চোখে ওর দিকে তাকায়। তৌসিরের কথা কর্ণপাত হতেই গা জ্বলে যাচ্ছে খা-খা করে। নাজহা তৌসিরের দিকে ঠাণ্ডা ঘেন্না মেশানো চোখে তাকিয়ে ঘৃণাচ্ছন্ন গলায় বলে,”আপনি এত খারাপ কেন? এত নিকৃষ্ট কেন? একটু ভালো হতে পারেন না?”

তৌসির নাজহার কথা শুনে ওর দিকে দু কদম এগিয়ে এসে তাচ্ছিল্য করে বলে,”আমার ১৪ গোষ্ঠীর সবগুলাই সন্ত্রাস, তাইলে আমি কেমনে ভালো হমু? দুঃখিত, আমার পক্ষ ভালো হওয়া অসম্ভব।”
“ভালো হবেন কেন? শয়তান তো শয়তানি থাকবেন আপনারা তো মনে হয় ইবলিশের মানুষরূপি বংশধর!”
“এই চুপ, এত কথা না। আমরা শয়তান হইলে তোমার বাপ-চাচা শয়তানের পার্টনার। খালি পার্থক্য হইলো, আমরা যা করি প্রকাশ্যে, আর তোমার গাদ্দার বাপ-চাচারা তলে তলে!”
নাজহা এটা শুনে তৌসিরের দিকে এক কদম রুক্ষ দৃষ্টি তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে কাঁটা ফুটানো গলায় বলে,”প্রকাশ্যে করেন? এত প্রকাশ্যে করেন? আরে, এই যে নারীদেহ ব্যবসা, এগুলো তো নাটক মাত্র তলে তলে হাসপাতালের ভেতর দাঁতের লেবের আড়ালে যে নেশাদ্রব্য চালান দেন, সেটা কি?”
তৌসির নাজহার মুখে এটা শুনে ভয় পাওয়ার ভান করে তাচ্ছিল্য করে বলে,”ও আল্লাহ! তুমি আমার পিছনে কুত্তা-টুত্তা লাগাই দিছো নাকি? এত কিছু জানো?”

“হ্যাঁ, জানি! আপনারা প্রকাশ্যে যে শয়তানি করেন, তার থেকে ডবল শয়তানি চলে আড়ালে।”
তৌসির এটা শুনে চারদিকে তাকিয়ে নাজহার দিকে একটু ঝুঁকে বলে,”হুস, আস্তে বলো। আর সবকিছু প্রকাশ্যে করতে হয় না বুঝলা, তালুকদারের মাইয়া।”
নাজহা তৌসিরের কথা শুনে রাগি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনার মতো মানুষ আমার মাহরাম ভাতেই ঘেন্না লাগছে আমার!”

তৌসির নাজহার কথা শুনে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, তারপর কিছু একটা ভেবে কিছু মুহূর্ত চুপ থাকে, তারপর শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,” মাহরাম কইয়া ভালো কথা মনে করাইলা আমাদের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু আমি তোমার উপর স্বামীর অধিকার ফলাই নাই। এখন সেটা কি দিবা নাকি অস্বীকার করবা?”
নাজহার সারা শরীর কেঁপে উঠে তৌসিরের এই বিষে ভরা কথা শুনে। কিন্তু তাও ঘাবড়ে না গিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,
“দিব না কেন? আপনার বাড়িতে, আপনার ঘরে, আপনার বউ হয়ে থাকছি তো এতে অস্বীকার করব কেন? আপনার যা ইচ্ছে করুন, কিন্তু আমি মন থেকে কখনোই আপনাকে মানব না!”
তৌসির নাজহার কথায় হেসে দিয়ে বলে,”মানবো না মানবো না বইলা দেখবা, একদিন কয়েক বাচ্চার মা হইয়া গেছো!”
নাজহা তৌসিরের কথায় ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়। তৌসির ওর তাকানো দেখে নাক-মুখ ছিটকে বলে,”হইছে, বাদ দাও। তুমি নিজেই আগে বড় হও, আর বাচ্চা মারাইবার দরকার নাই। আর আমার তোমার মতো বউয়ের থাইকা ঐসব কিছু লাগবও না!”

নাজহা এটা শুনে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,”লাগবে কেন? যারা কন্ট্রাক্টে নারীদেহ বিকায়, তাদের কিছুর অভাব হয়? আপনার তো সব শখ মনে হয় অন্য দিকেই পূরণ হয়ে যায়, তাই না?”
তৌসির নাজহার কথায় ওর দিকে রাগি চোখে তাকায়। এতক্ষণ একটু রাগ হয়নি ওর, নাজহার এইসব কথায়, কিন্তু এখন রাগ হচ্ছে। তৌসির দাঁত চেপে বলে,”ঠাস করে যেমনে থাপ্পড় মারমু, ওমনে দাঁত সবগুলা ছেলছেলাইয়া খুইলা পড়ব, সাউয়ার মাইয়া! নিজের এই এক হাত লম্বা থুতা সামলা!”

নাজহা তৌসিরের ধমক শুনে ভয় পায় না, উল্টো জিদ ধরে বলে,”আমি তো ভুল কিছু বলিনি। আমি যা বলেছি, একদম খাঁটি বলেছি। কয় নারীর লগে নিজের শখ পূরণ করছেন? কয়জন হিসাব আছে? আপনার মতো অপবিত্র মানুষ আমার শরীর ছোঁবে এটাই আমার হাজারবার বিষে ডুবে মরার জন্য যথেষ্ট!”
তৌসির দাঁত চেপে নাজহার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুই দেখছোস আমি কারো লগে কিছু করছি? তুই দেখছোস কারো লগে শুইতে আমারে? তুই এত বড় কথা আমার ব্যাপারে না জেনে কিভাবে বললি? তোর থুতা ফাইরা নিতে কিন্তু দুই মিনিটও লাগবো না!”

“যে অন্যের বিছানায় নারীদের টাকার জন্য বিলিয়ে দেয়, সে নিজে বিলাসিতা করবে না? আমি দুধের বাচ্চা না! এবার বলবেন না আপনি এসব করেননি, কারণ আমি মরে গেলেও এটা বিশ্বাস করব না!”
তৌসির নাজহার এমন বেপরোয়া ব্যবহার দেখে ঠান্ডা গলায় বলে,”নাজহা, তুমি এখনো অনেক ছোট, তোমার বুঝ কম। তুমি যা ভাববে এখন, তাই বিশ্বাস করবে আমি সত্যিটা বললেও অবিশ্বাস করবে।”
এরপর কিছু মুহূর্ত থেমে গিয়ে বলে,”যদিও আমি নিকৃষ্ট, তারপরও আমি আমার স্ত্রী, অর্থাৎ তোমায়, সম্মান করি। মন থাইকা একটু পছন্দও করি। তাই দয়া কইরা তোমার মুখটা সামলে নাও, কারণ আমার রাগ তীব্র বিষাক্ত যে বিষের প্রভাব তুমি সহ্য করতে পারবা না।”

নাজহা আর কিছু বলে না এমন ঠান্ডা গলার কথা শুনেও যদি ও এখন কাউকাউ করে, তো এটা নিতান্তই বোকামি। নাজহা চুপচাপ বেলকনি থেকে চলে যেতে থাকে, কিন্তু কথায় আছে না সময় দেখলে ব্যাঙও ঠ্যাং মেলে তো নাজহার অবস্থা আজ এমন। যেতে গিয়ে টাশ করে টি-টেবিলের সাথে উষ্টা খেয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে ধপাস করে পড়ে যায়।তৌসির নাজহাকে পড়ে যেতে দেখে পিছনে ঘুরে নাজহার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বলে,
“ঝাল ঝাড়ো, আরো বেশি করে!”

নাজহা নিজের ব্যথাচ্যুত হাঁটু চেপে ধরে তৌসির দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে,”তাতে আপনার কী?”
তৌসির নাজহার কথা শুনে চারদিকে ভুরু কুচকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,”এক বালের ঝাল মরিচ জুটছে ঠাঁডা পড়া কপালে!”
তৌসির নাজহার সামনে বসে ওর হাঁটু থেকে হাত সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলে,”দেখি, হাত সরাও তো আমি দেখি কিতা অইছে।”
এ বলে নাজহার আঙুল ধরে ওর হাত সরাতে নেয়, তখনই তৌসিরের চোখ পড়ে নাজহার হাতের পাতায় থাকা মেহেদি রঙের দিকে। সারাজীবন দেখেছে, নতুন বউরা হাত-মা মুড়িয়ে মেহেদি দেয়, কিন্তু নাজহার হাতের তালুই একটু মেহেদি ছোঁয়ানো তাও চলে যাচ্ছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেহেদি দিয়েই ধুয়ে নেওয়া হয়েছে! নাজহা নিজের হাত তৌসিরের থেকে সরাতে চেষ্টা করে বলে,”ছাড়ুন হাত!”
তৌসির ওর কথায় সত্যি সত্যি হাত ছেড়ে দেয় আর বলে,

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৩

“বেশি ব্যথা পাওনি, উঠে দাঁড়াও, দাঁড়িয়ে গিয়ে একটু হাঁটো ঠিক হয়ে যাবে।”
নাজহা তৌসিরের কথায় উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে চারদিকে কিছু সময় তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়, তারপর সামনে পা বাড়ায়। কিন্তু পা বাড়িয়েই আবারো পড়ে যেতে নেয়, সোফার পায়ায় পা লেগে। কিন্তু পড়ে না তৌসির পিছন থেকে ওর হাত টেনে ধরে। নাজহার এই বারবার পড়ে যাওয়া দেখে তৌসির ঠোঁট হালকা করে হেসে উঠে। নাজহা নিজের হাতের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, তারপর তৌসিরের দিকে তাকায়। তৌসিরের হাসি দেখে লজ্জায় পড়ে যায় এত বড় অপমান, বারবার পড়ে যাচ্ছে। নাজহা চোখ তুলে তৌসিরের চোখের দিকে তাকায়, ওকে হাসতে দেখে সংকোচ বোধে মেকি-হাসি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
তৌসির এই প্রথম নাজহাকে হাসতে দেখল। নাজহার হাসি দেখে তৌসির আপন মনে বলে উঠে,
“মাইয়াডার হাসি সুন্দর আছে।”

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here