তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১৪
ভূমিকা তালুকদার
(ফ্রান্স, প্যারিস)
ফ্রান্সে সবচেয়ে ব্যস্ততম শহর প্যারিসে দাঁড়িয়ে আছে কাচ ঢাকা এক আকাশচুম্বী বিল্ডিং। বাইরের চকচকে গ্লাসে শহরের আলো ঝলমল করে প্রতিফলিত হয়, আর ভেতরে পা দিলেই বোঝা যায় এটা শুধু কোনো অফিস নয়, বরং ক্ষমতার দুর্গ।প্রবেশদ্বারেই কালো স্যুট পরা রিসেপশনিস্টরা বসে থাকে। প্রতিটি দেয়ালে সাজানো থাকে ভারি ভারি আইনি বই, পুরনো রুলিংস, আর আন্তর্জাতিক আইনের ভলিউম কিন্তু সেই সঙ্গে কোণে কোণে আছে নিঃশব্দ সিসি ক্যামেরা,যেন প্রতিটি পদক্ষেপ রেকর্ড করা হচ্ছে।ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে ল-ফার্ম এর লোগো, সোনালী অক্ষরে খোদাই করা,
“Ibonhart law firm ”
প্রতিটি কনফারেন্স রুম যেন যুদ্ধক্ষেত্রের মতো সাজানো। দীর্ঘ টেবিলের একপাশে বসে থাকেন আইনজীবীরা, আর অপর পাশে বসে থাকে ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ,কখনও, কখনও মাফিয়া, কখনও রাজনীতিবিদ। টেবিলের মাঝখানে রাখা থাকে প্রমাণের ফাইল, কিন্তু সেই ফাইলের ভেতরেও থাকে লুকোনো রহস্য,কারণ এই ল- ফার্ম শুধু আইনের ভাষায় লড়াই করে না, বরং পিছনের দরজা দিয়ে তৈরি করে গোপন সত্যে।জায়ানের কেবিন অন্য সবার থেকে আলাদা। কাচে ঘেরা সাউন্ড প্রুফ, বিশাল টেবিল, দেওয়ালে কালো-সাদা ফ্রেমে সাজানো বড় বড় অপরাধ মামলার ছবি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তার টেবিলে সবসময় ছড়ানো থাকে কেস ফাইল, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়,একটাও পুরো খোলা থাকে না, যেনো ইচ্ছা করেই অর্ধেক লুকিয়ে রাখা।কেবিনের এক পাশে বুকশেলফ,যেখানে আইনি বইয়ের সাথে সাথে রাখা আছে সিগার, ওয়াইন, আর ছোট্ট এক ড্রয়ার,যেটা কেউ কখনও খোলতে পারবেনা জায়ান ছাড়া। জায়ান যখন সেখানে বসে থাকেন, তার চারপাশে এমন এক অদৃশ্য চাপা উত্তাপ ছড়ায়, যেন পুরো রুমটাই নীরব হয়ে যায়। জুনিয়র লয়াররা তার সামনে দাঁড়ালেই অকারণে নার্ভাস হয়ে পড়ে।এখানে প্রতিটি কেস শুধু মামলা নয়,এক একটা যুদ্ধ।কেউ এখানে বিচার পেতে আসে, আবার কেউ আসে নিজের অপরাধ মুছে ফেলতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত,যা-ই হোক না কেনো, বিজয় প্রায় সবসময় জয়ানের হাতে চলে যায়।কারণ এই ল-ফার্মএ ন্যায়বিচার শুধু একটি ধারণা, আর বাস্তবে,এখানে ন্যায়বিচার মানেই ক্ষমতাকে অস্ত্র বানিয়ে টাকা,প্রভাব।
(কেবিন অফ মাহতাব বীন মার্কো)
কেবিনটা গ্লাসের দেয়াল ঘেরা ঠিক জায়ানের কেবিনের পাশে।ভেতরে মার্কো স্যুট-টাই পরে বসে আছেন। টেবিলের ওপারে গম্ভীর মুখে বসে আছেন একজন অপরিচিত লোক,চোখে অস্বস্তি, কণ্ঠে আতঙ্ক।
মি.মার্কো,এইটা খুব সেনসিটিভ ক্রিমিনাল কেস । রে*প কেস।
মার্কো সামনের দিকে ঝুঁকলো,
দেখুন, সবাই জানেন আমাদের সিনিয়র মি.জায়ান গত ২ মাস ধরে কোমায় আছেন। এত বড়ো ক্রিমিনাল কেস, তাও গ্যাংস্টারের বিরুদ্ধে। এটা জায়ানকে ছাড়া আমরা কেউ হাতে নিতে পারবো না।
প্লিজ মি. মার্কো, কেসটা আর্জেন্ট হয়ে যাচ্ছে।
আমরা কেসটা অবশ্যই নেবো, তবে মি. জায়ান ফিরে এলে। যেহেতু উনিই প্রথম কেসটা হাতে নিয়েছিলেন, উনিই হ্যান্ডেল করবেন। টাই টু আন্ডারস্টেন্ড এটা ভীষণ রিস্কি কেস।
তারপর
হঠাৎ
মার্কোর ফোন বেজে ওঠে।স্ক্রিনে ভেসে ওঠে নাম,এলেনা।মার্কো ভ্রু কুঁচকে ফোন ধরলেন।
হ্যালো
ফোনের ওপাশে কাঁপা কণ্ঠস্বর,
মার্কো প্লিজ আয় প্লিজ! হসপিটালে চলে আয় এখনই,জায়ানের কন্ডিশন ভীষণ খারাপ।
কথাটা কানে যেতেই, মার্কোর মুখ জমে গেল, গলা শুকিয়ে এলো। চেয়ার থেকে ধাম করে,উঠে এক দৌড়ে গাড়িতে উঠে ফুল স্পিডে গাড়ির গতি বাড়িয়ে হসপিটালে এসে হাজির হলো।চারদিকে সাদা আলোয় ঝলসে ওঠা দেয়াল, নার্সদের তাড়াহুড়োর পায়ের শব্দ, দূরে কোথাও শিশুর কান্না,সব মিলিয়ে মুহূর্তটা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠলো।
সে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করলো,
ডক্টর লিওনেল!
ডক্টর লিওনেল সাথে সাথে ছুটে এলো। জায়ানকে স্ট্রেচারের ওপর শুইয়ে দ্রুত মনিটরের সাথে সংযুক্ত করা হলো। অবস্থা ভিষনই গুরুতরো,কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্ক্রিনে সোজা দাগ ভেসে উঠলো,
বিপপপপপ,বিপপপপ!
একেবারে সোজা লাইন,হৃদস্পন্দন একেবারে থেমে গেছে জায়ানের।
নার্স আতঙ্কিত গলায় চিৎকার করে উঠলো,
নো পাল্স ডক্টর!…
ডাক্তার লিওনেলর চোখ মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেলো, তারপর সে গম্ভীর কণ্ঠে নার্সদের নির্দেশ দিলো,
স্টার্ট সি পি আর! নাও
একজন জুনিয়র ডাক্তার জায়ানের বুকে সজরে চাপ দিতে শুরু করলো,
আরেকজন ওষুধ প্রস্তুত করতে লাগলো। করিডোরজুড়ে আতঙ্ক আর তাড়াহুড়ো। মনিটরের পর্দায় এখনও সেই সোজা রেখা, যেনো মৃত্যুর ঘোষণা দিচ্ছে।মার্কো অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে,বাকিরাও প্রানপ্রনে গড এর নিকট প্রে করে চলেছে।এমনটাতো হওয়ার কথা ছিলোনা।তাদের চোখের সামনে জায়ানের এমন মর্মান্তিক দৃশ্যে সহ্য করার মতো না।সকলের ঘাম ভেজা মুখ, কাঁপা ঠোঁট ফুটপ উঠলো। মনে হচ্ছিল সময় থেমে গেছে, শব্দগুলো যেনো আর কানে ঢুকছে না, শুধু সেই বিপপপ! বিপপপপ!…. ধ্বনি যেনো হৃদয় ভেদ করে ঢুকে চলছে।
ডাক্তার লিওনেল আবার চাপ দিতে লাগলো এবার জায়ানের বুকে আরও জুড়ে।সঙ্গে ইঞ্জেকশন প্রবেশ করানো হলো । পুরো রুম নিস্তব্ধ, শুধু সেই যান্ত্রিক শব্দ।
বিপপপপপ! বিপপপপপ! বিপপপ!
মনিটরে এখনো কোনো ঢেউ নেই।হাসপাতালের করিডরটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে, শুধু সাদা দেয়ালে প্রতিফলিত ঠান্ডা আলো আর দূরে দূরে ছুটোছুটি করা নার্সদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। মার্কো হাঁপাতে হাঁপাতে ভেতরে ঢোকার সময় চোখে পড়ে,কাঁচের ওপাশে জায়ান শুয়ে আছে। চারপাশে ডাক্তাররা ঝুঁকে আছে, মেশিনের লাল আলো হঠাৎই বিপ্ বিপ্ বিপ্ থেকে থেমে গিয়ে সোজা হয়ে গেছে। সারা ঘর নিস্তব্ধ হয়ে যায়, যেন কেউ হৃদস্পন্দনটা ছিঁড়ে ফেলেছে হঠাৎ ডাক্তাররা আবার আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে
ক্লিয়ার! ক্লিয়ার!
বৈদ্যুতিক শক মেশিন টানা হচ্ছে। নার্সের হাত কাঁপছে, সবার চোখে ভয়ের ছাপ।
হি ইজ নট রেসপন্ডিং!
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এলেনা,নাদিয়ার মুখ শুকিয়ে যায়, বুকের ভেতরটা যেন ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। ভেতরে ডাক্তাররা আরেকবার শক দিলো—ধররররররররররররররররররররররর—কিন্তু মেশিন এখনও ফ্ল্যাট লাইন দেখাচ্ছে।চারপাশে হাহাকার ভেসে ওঠে। একজন ডাক্তার হাল ছেড়ে দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,
Time of death! mark it
*ঠিক তখনই,তখনই
সারা রুমটা কেঁপে ওঠে মেশিনের তীব্র বিপ্প্প্প্প্প্প্প্! আওয়াজে।
ফ্ল্যাট লাইন থেকে হঠাৎ একটুকরো ঢেউ উঠে গেলো।
একটা স্পন্দন,
আরেকটা,তারপর একের পর এক দ্রুত বিপ্ বিপ্ বিপ্ শব্দে যেনো রুমটা
জীবনের গানে ভরে গেল।
ডাক্তাররা চমকে ওঠে।
ওয়েট পার্লস! হি’স বেক! হি’স বেক।
মেশিনের লাইট ঝলমল করছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে এনেছে মৃত্যুর কিনারা থেকে। জায়ানের বুক ওঠানামা করতে শুরু করলো, শ্বাস নিতে লাগলো ধীরে ধীরে, যেন মৃত্যুর অন্ধকার থেকে উঠে এসেছে।
একজন নার্স অবিশ্বাসে ফিসফিস করে বলল,
দিস্ ইজ… আ… মিরাকল।
মার্কোর চোখ ছলছল করে উঠলো। কাঁচের ওপাশ থেকে সে দু’হাত তুলে কপালে ঠেকালো, চোখ বন্ধ করলো এমন একটা মুহূর্ত, যা বিজ্ঞানেরও কাছে ব্যাখ্যা নেই।উপরওয়ালা চাইলে কি না পারে।
গেট দা অক্সিজেন, কুইকলি।
পুরো হসওিটালে এখন প্রাণের স্পন্দন, ডাক্তারদের কণ্ঠস্বর, আর মেশিনের বেঁচে ওঠা হৃদয়ের বিপ্ বিপ্ বিপ্,যেনো মৃত্যুর মঞ্চ থেকে জীবনের নাটক আবার শুরু হলো নতুন অধ্যায়ে তবে তা কি এতো সহজ হতে চলেছে?? রুমের ভেতর এখন অক্সিজেন মেশিনের শোঁ শোঁ আওয়াজ।
জায়ান শুয়ে আছে সাদা বিছানায়। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, শরীর জুড়ে তার, আর মনিটরে হার্টবিটের দাগ ওঠানামা করছে।
হাত হালকা কাঁপছে…আঙুল নড়ছে..একটু পরেই পুরো শরীর কেঁপে উঠলো, মাথা হালকা এদিক-ওদিক দুলছে জায়ানের।
মার্কো দৌড়ে এসে বিছানার পাশে দাঁড়ালো।সাথে এলেনা,এলেক্স,নাদিয়া পিছন পিছন এলো,
জায়ান!জায়ান! কেন ইউ হেয়ার মি??
প্লিজ! ডোন্ট লিভ আস,কাম বেক ব্রো।
ধাম!
জায়ানের চোখ হঠাৎ বড় করে খুলে গেলো,সে এক টানে অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে ফেলে, হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসলো।দুই হাত মাথায় দিয়ে কাতর গলায় বললো,
আঃহ… ওওও নো! আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে,কানে এক অদ্ভুত ভোঁ ভোঁ আওয়াজ কি হয়েছে আমার?
সবাই শকড। নার্সের হাত থেকে ফাইল মাটিতে পড়ে গেলো। ডাক্তার তোতলাতে তোতলাতে বললো,
Unbelievable ! এটা তো মেডিকেলি পসিবল না! মিরাকেল।
জায়ান চোখ মিটমিট করে চারপাশে তাকালো, বিভ্রান্ত কণ্ঠে-
কাল,কাল রাতে কী হয়েছিলো? আমি শুধু মনে করতে পারছি না একটা ভয়ঙ্কর কার ক্র্যাশ,তারপর কিছুই মনে নেই,এই তো কালকের ঘটনা, তাই না?
ডা.লিওনেল: কাল?!মিস্টার জায়ান, আপনি গতকাল না, পুরো দুই মাস ধরে কোমায় ছিলেন! আজই জ্ঞান ফিরেছে।
জায়ানের মুখ,তার চোখ জ্বলজ্বল করছে,যেন অন্ধকার ভেদ করে আবার ফিরেছে নতুন এক শক্তি নিয়ে।শুধু জায়ানের শেষ কথা প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে থাকে
WTF! দুই মাস?!
লিয়ানা!ওওওহহহ গড,বাংলাদেশ যেতে হবে।কোন শো*য়র এই কাজ করলো তার হিসাব পরে নিবো এসে।
মার্কোরা চারপাশে সোজা দাঁড়িয়ে আছে, চোখ বড়, মুখ অচেতনকেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।তারা তো বাংলাদেশের খবর পেয়েছেই।তারা তো বুঝতেই পারেনি,ঝড় বয়ে যাওয়ার আগে ঘূর্ণিঝড় জায়ান কাম বেক করে ফেলবে।এখন কি হবে জায়ানকে কীভাবে বলবে যে মিস. লিয়ানা খানের বিয়ে আজ তাও কয়েকঘন্টা বাকি।কীভাবে কি করবে, জায়ানকে কি জবাব দিবে তা জানা না থাকলেও জায়ান যে কি তোলকালাম বাঁধিয়ে বসবে তা
হারে হারে জানে সকলেই।নাদিয়াদের মূখে গম্ভীর আতঙ্ক, হাত কাঁপছে।
তারা সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে যা ঘটেছে, তা কোনো মেশিনের হিসাবের বাইরে।কিছুই জানানো যাবেনা।তাদের চোখে ভয়, ধ্বংসের ভয়। তারা জানে, জায়ানের শরীর দুই মাস কোমায় ছিল।যা এক মুহূর্তে ফিরে এসেছে,তবে উত্তেজিত হয়ে পড়লে brain hemorrhage হতে পারে।
জায়ানের শরীর হালকা হিলছে, মাথা কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে। ফিসফিস করে নিজের কণ্ঠে,
নাও আই এম ফাইন, মার্কো,কল দা ডক্টর,এন্ড ডিসচার্জ মি রাইট নাও।
কথাটা বলেই জায়ান ধীরে ধীরে বেড থেকে উঠতে যাচ্ছিল, হঠাৎই মার্কো এসে তার কাঁধ শক্ত করে ধরে ফেলে
শুন জয়ান! তোর শরীর এখনও ভালো নেই, দুর্বল। আজকে অন্তত হাসপাতালেই থাক। Please।
জায়ান ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে, কিন্তু কণ্ঠে ইস্পাতের দৃঢ়তা—
Ooohooo… ঠিক আছে,
তবে বাংলাদেশ গিয়ে একটা অসম্পূর্ণ কাজ সেরে আসি আগে।
আর আমি এখন পুরো ফিট জায়ান খান, এতটা দুর্বল নই। সর!আমি ডক্টর লেওনেল এর কাছে যাচ্ছি।
ঠিক তখনি।
হঠাৎ পিছন থেকে এলেনা চিৎকার করে উঠে
কেন করিস এমন? নিজের কী হাল হয়েছে দেখ না? ওই মেয়ের জন্যই সব। যাবি না! আমি যেতে দেবো না!
জায়ান হঠাৎ থেমে, চোখে আগুনের ঝলকানি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো-
How dare you! Don’t cross your limit.এলেনা।
এলেনার চোখ ভিজে গেলেও গলাটা শক্ত রাখলো
কেন? ভুল বলছি আমি? শুন,কেন এই শরীর নিয়ে দেশে যেতে চাচ্ছিস? এত বছর তো গেলি না। এখন যাবি? কার জন্য?তোর ওই কাজিন? হ্যাঁ হ্যাঁ,আমি জানি, সব জানি,,আমরা তোর বিয়োগান্ত অতীত পাস্ট, তোর অতৃপ্ত ফিলিংস্, সব জানি।এত বছর বুঝে এসেছি, মেনে নিয়েছি
কিন্তু শুনে রাখ,তোর ওই লিয়ানা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিয়ের পিড়িতে বসতে চলেছে। অন্য এক পুরুষকে বিয়ে করছে ও।কি করতে পারবি?এখন গেলেও লাভ হবেনা।
এলেনার কথা শুনেই চারপাশের সবাই স্তব্ধ।তারা লুকাতে গিয়েও পারলোনা সত্যেটা।মার্কো চোখ নামিয়ে ফেলে। এলেক্স আর নাদিয়া একে অপরের দিকে তাকায়, কিন্তু কিছু বলে না।তবে মার্কো চেয়েছিলো লিয়ানাকে তুলে নিয়ে আসতে, তবে এলেনার জন্যে তা পারেনি।
এলেনা হঠাৎ দৌড়ে এসে জায়ানের হাত ধরে কেঁদে ফেলল,
ভুলে যা,ভুলে যা ওকে!
ওই মেয়েকে,ওই মেয়েকে ভুলে যা, জায়ান!
কথাগুলো যেন ছুরি হয়ে জায়ানের হৃদয় ভেদ করলো।ঠিক যেনো কেউ বিষ গুলিয়ে তাকে বলছে নে বিষটা খেয়ে নে মরবিনা।তার কানে প্রতিটা শব্দ বারবার বাজতে থাকলো
অন্য পুরুষ!অন্য পুরুষ!
জায়ানের চোখ ততক্ষণে আগুন ঝলসে উঠল, গলাটা ঠান্ডা কিন্তু
ধারালো,এক জটকায় এলেনাকে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিলো।
How lame are you, ফাজলামো করিস আমার সাথে!
তোর এসব নাটকে আমি বিরক্ত। আমাকে রাগাস না, সরে যা!
তখন নাদিয়া এগিয়ে এসে গলাটা নরম করে বলে—
এলেনা ঠিকই বলছে, কিন্তু please, control yourself, জায়ান।
তোর শরীর এখনও প্রপার ভাবে ঠিক হয়নি। একটা ভুল ধাক্কা, উত্তেজনা সব শেষ করে দিতে পারে।
রুমের ভেতর মুহূর্তেই নিস্তব্ধতা।ততক্ষণে জায়ান হাত শক্ত করে মুঠো বানালো,হাতের কেনেলাটা ঠাসসস করে টান দিয়ে ছিড়ে ফেলে, যা দিয়ে ফিনফিনিয়ে র*ক্ত ঝড়তে লাগলো।চোখ উপরে ছাদের দিকে তুলে নিলো, যেনো নিজেকে খুব কস্টে নিয়ন্ত্রণ করে চলছে যেখানে অশ্রুর আগুন একসাথে ঝলকাচ্ছে।দাঁতে দাঁত পিষে কেবিনে থাকা টেবিলটা সজরে দেয়ালে বারি মারে,বেডের চাদর উলটে পালটে ছিঁড়ে ফেলে,মার্কো,এলেক্স থামাতে এলে তাদের এক ধাক্কায় সরিয়ে দেয় ততক্ষণে জায়ান পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গিয়েছে।মাথায় দুহাত চেপে ধরে কিছুক্ষণ পরেই দেয়ালে নিজের র*ক্তাক্ত হাতটা দিয়ে গুষি মারে।হাতটা পুরোই থেঁতলে গিয়ে অঝরে র*ক্ত ঝরে ফ্লোরে পড়ছে।লেপ্ট আচে দেয়ালের গায়ে।
বিয়ের নামটা শুনে যেনো হৃদয় ছিঁড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। চোখ লাল, রক্তের আলো তার হালকা কাঁপা র*ক্তমাখা হাত থেকে বের হচ্ছে।চিৎকারে করে –
ফা*ক! এই জানো*য়ারের বাচ্চাগুলো আমাকে অমানুষ বানিয়েই ছারবে।আমিও দেখানো আমি যে কি জিনিস.. বিয়ে বাড়িকে কিভাবে শ*শান বাড়ি করতে হয় তা শেখাবো।
জায়ানের মুখে ফুটে উঠে এক পৈচাশিক হাসি-
আর ওই বা*ন্দির বাচ্চারে যদি না খাইছি আমিও জায়ান খান না।
হঠাৎ যেনো প্রবল ঘূর্ণি শক্তিতে ঘূর্ণন করতে শুরু করে। বাতাস টর্নেডো এর মতো ঘুরছে।জায়ানের হাত আরও শক্ত করে মুঠ হয়ে যায়। র*ক্ত তার হাত থেকে ফুঁটা ফুঁটা ঝরে ঠিকি, চোখে আগুন।
তারপর হঠাৎ,
মার্কো…… আই সেইড,ইমিডিয়েটলি,রেডি এ মেরিজ রেজিস্ট্রার পেপার,একশো বি এম ডাবলিও,দুইশো মার্সিডিজ কার, পঞ্চাশ বাইক এন্ড পাচশো বডিগার্ড, এর ব্যাবস্থা কর(ফর বাংলাদেশ) ! জাস্ট দশ মিনিট টাইম দিলাম, আই সেইড জা্সট দশ,তা না হলে বিসমিল্লাহ বলে তোকে খু*ন করবো আগে।আর হ্যাঁ আমার প্রাইভেট জেট টা নিয়ে আয় ওইটা দিয়েই যাবো।বিয়েটা হবার আগে, আমি যেভাবেই হউক দেশে যেতে হবে, যেভাবেই হউক!
(ঢাকা,বাংলাদেশ)
শুক্রবার,
ঢাকা উত্তরা। রাস্তাজুড়ে হালকা যানজট, কিন্তু দূর থেকেই চকচক করছে এক বিশাল আলোকিত গেট।
গেটের ওপরে ঝুলছে সোনালী লাইটে লেখা বড় বড় অক্ষরে,
✨ “ISHAN WEDS LIYANA” ✨
গেটের ঠিক মাঝখানে খোদাই করা ঝকঝকে পিতলের নামপ্লেট—
“KHAN MANSION”গেটের দুইপাশে সাজানো রাজকীয় ফুলের তোড়া— সাদা অর্কিড, লাল গোলাপ আর নীল অ্যান্থুরিয়ামের মিশেল। মেঘলা আকাশে হালকা বাতাস বইছে, লাইটগুলো ঝিলমিল করে যেন প্রতিটি বাতাসের সাথে নেচে উঠছে।বড়সড় সোনালী রঙের গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়বে এক বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ি।বাড়ির সামনে পুরো উঠোনটা ঢাকা পড়েছে কার্পেট আর ঝাড়বাতির আলোয়।বারান্দার দিক থেকে নেমে আসছে সিঁড়ি, সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে জ্বলছে ছোট ছোট মোমবাতি।দুইপাশে সাজানো ফেয়ারি লাইটে
বাড়ির বাইরের দেওয়ালে ঝুলছে বড় বড় ব্যানার দূর থেকে বাজছে শেহনাই
যা যেন প্রতিটি অতিথিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, আজ খান বাড়ি তে হচ্ছে বছরের সবচেয়ে রাজকীয় আয়োজন।প্রবেশমুখে লম্বা লাল কার্পেট বিছানো।
অতিথিরা একে একে প্রবেশ করছেপুরুষেরা শেরওয়ানি, স্যুট, কোট-পাঞ্জাবিতে জমকালো সাজে।মহিলারা শাড়ি আর লেহেঙ্গায় ঝলমল করছে।সোনালী কাঁচের ঝাড়বাতি থেকে নেমে আসা আলোয় যেন প্রতিটি গয়না হাজারগুণ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।সবচেয়ে নজরকাড়া হলো আসল ওয়েডিং স্টেজ।মঞ্চটা তৈরি করা হয়েছে রুপালী আর সোনালী ঝাড়বাতির নিচে, সাদা পর্দা আর লাল গোলাপে মোড়া।মঞ্চের মাঝখানে রাখা আছে রাজকীয় সোফা।ঠিক তখনই সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নামছে লিয়ানা পড়নে লাল বেনারসি । দুই পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেরিন আর রিমা। পেছনে নিস্তব্ধ মুখে আরিশা, মাইশা আর রিহান। কারও ঠোঁটে ম্লান হাসির আভাসও নেই, নেই কোনো খুনসুটি বা আনন্দের ঝলক। লালচে আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ছে নিস্তব্ধতা।লিয়ানা যেনো আর পাঁচজনের মতো নয়। তার মুখ পুরো ঢাকা লাল দুপাট্টা চোখও স্পষ্ট নয়,মনে হচ্ছে যেনো ওর চারপাশ থেকে আলোটা নিভে গেছে। প্রতিটি পা ফেলা যেনো কষ্টের, নিস্তরঙ্গ জলের ঢেউয়ের মতো ধীরে ধীরে নামছে সিঁড়ি বেয়ে। ওর চারপাশে উৎসব থেকেও নেই, আছে অদ্ভুত ভারী একটা শূন্যতা।দূর থেকে ইশান দাঁড়িয়ে লিয়ানার আসাকে দেখছে। তার চোখে লুকোনো আবেগের ঝড়। এতদিন, যত স্বপ্ন, যত অপেক্ষা—আজ সব যেন রূপ নিচ্ছে বাস্তবে। লিয়ানাকে সে দেখছে আর মনে মনে বলছে,
“এতোদিন যাকে শুধু কল্পনায় দেখেছি, আজ সে আমার। আমি কতটা ভাগ্যবান,পৃথিবীর সবকিছু হারালেও যদি আজ তাকে পাই, আমি জিতে যাব।”
ইশানের বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ বাড়ছে। ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে, ।পুরো হলঘরে করতালি আর শোরগোল। ফটোগ্রাফারের ফ্ল্যাশ লাইটে মুহূর্তগুলো জমে যাচ্ছে ছবিতে।স্টেজে এসে ইশানের পাশে বসলো লিয়ানা। তাঁর হাত কেঁপে উঠছে, অথচ মুখে একটুকু হাসি আঁকতে চেষ্টা করছে।
এবার কাজি সাহেব মাইকে ঘোষণা করলেন,
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম… আজ ইশান শেখ ও লিয়ানা খানের মধ্যে নিকাহ সম্পাদন করা হবে।
হলঘরে নীরবতা নেমে এলো। অতিথিরা তাকিয়ে আছে স্টেজের দিকে। সোলায়মান খান, পরিবারের প্রধান, সামনের কাতারে বসে আছেন, চোখে গর্ব আর প্রশান্তি।
কাজি লিয়ানার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
লিয়ানা খান, আপনাকে মহর ধার্য করে ইশান শেখের সাথে বিবাহ দেওয়া হচ্ছে। আপনি কি কবুল করেছেন?
লিয়ানার বুক ধড়ফড় করছে, ঠোঁট কাঁপছে,হাত কাপছে,সে পারবেনা বলতে,কি করে বলবে। কিন্তু শব্দ বের হবার আগেই –
তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১৩
হঠাৎ
একটা বিকট গুলির আওয়াজ চারিদিকে ছড়িয়ে পরলো।
পেছন থেকে কর্কশ কণ্ঠে মাইকের ভেতর ভেসে এলো কোনো পুরুষের আজান ধ্বনির মতো গর্জন-
আলহামদুলিল্লাহ… কবুল!
