তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১৫

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১৫
ভূমিকা তালুকদার

আলহামদুলিল্লাহ! কবুল!
গুলির বিকট শব্দ হতেই বিয়ে বাড়ির সকলে তাকালো দরজার দিকে। আলো,ঝলমলে গেট দিয়ে প্রবেশ করছে লম্বা, কঠিন দেহী এক পুরুষ ,কালো স্যুটে, চোখে আগুনের মতো দৃষ্টি, পায়ে ধীর অথচ ভারি পদক্ষেপ।
জায়ান খান।

পুরো হলঘরে স্রেফ নিস্তব্ধতা। অতিথিরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে, কেউ শ্বাস নিতে ভুলে গেছে। কাজির মুখ থমকে গেছে মাঝপথে। লিয়ানা নিজের অজান্তেই সোফা আঁকড়ে ধরল, চোখ বড়ো হয়ে গেলো বিস্ময়ে আর ভয়ে।জায়ান ধীরে ধীরে ভেতরে এগিয়ে আসছে, যেন প্রতিটি পদক্ষেপে মঞ্চ কেঁপে উঠছে। জায়ানের চোখ সরাসরি লিয়ানার উপর,কোনও কথা নেই, শুধু তীব্র দহনভরা দৃষ্টি।এবং পুরো পরিবেশে বাজতে থাকে নীরবতা নামের এক ভয়ানক সুর।স্টেজের দিকে জায়ান খান ধীর পায়ে এগোতেই পুরো হলঘর যেন কেঁপে উঠলো, প্রতিটি পদক্ষেপে তার চারপাশে বয়ে যাচ্ছে এক অদৃশ্য ঝড়, পর্দা, সাজসজ্জার ফুল উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। মাইকের শব্দ কেঁপে কেঁপে থেমে যাচ্ছে, বাতিগুলো একবার জ্বলছে, একবার নিভে যাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জায়ান হাত উঁচু করতেই,
পেছন থেকে উঠে এলো অদ্ভুত সব ছায়া। লম্বা দেহী, কালো রঙা, চোখে আগুন জ্বলা দানবসদৃশ বডিগার্ডেরা। কালো টাইট শার্ট আর কমব্যাট প্যান্ট পরে তারা ছুটে এলো, একে একে বিয়েবাড়ির মানুষদের ঘিরে ফেললো। আতঙ্কে অতিথিরা চিৎকার করলেও মুহূর্তেই থেমে গেল তাদের গলা,কারণ প্রতিটি মানুষ যেনো শক্ত করে আটকে গেছে এই ভয়ঙ্কর প্রহরীদের মুঠোয়।
ঘরের ভেতরে শুধু ভেসে আসছে চেয়ার ভাঙার শব্দ, ফুলের মালা ছিঁড়ে পড়ছে মাটিতে
কিন্তু জায়ান
সে ধেয়ে যাচ্ছে ঝড়ের বেগে। এক লাফে মঞ্চে উঠে পড়লো।
ইশান শেখ চমকে দাঁড়াতেই জায়ান বজ্রপাতের মতো এক ঘুষি মারলো তার মুখে। মুহূর্তেই ইশান মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। জায়ান তার কলার চেপে ধরে চোখ লালচে আগুনের মতো জ্বলছে।অবিরাম ঘুষির আঘাতে কেঁপে উঠছে পুরো মঞ্চ। প্রতিটি আঘাতের সাথে কাঁচ ভাঙার মতো শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, লাইটের ঝাড়বাতি একের পর এক পড়ে যাচ্ছে।

লিয়ানা
এমন দৃশ্যে দেখে সে ভয়ে স্থির হয়ে গেছে। গলা চেপে ধরা চিৎকার বের হতে চাইছে কিন্তু বেরোচ্ছে না। দু’হাত মুখে চাপা দিয়ে থরথর করে কাঁপছে, চোখ ছানাবড়া হয়ে তাকিয়ে আছে জায়ানের ভয়ঙ্কর রূপের দিকে।অন্যদিকে পরিবার,কেউ সামনে আসতে পারছে না।কেউ চেষ্টা করলেও কালো বডিগার্ডদের ভয়ঙ্কর গ্রিপ থেকে বের হতে পারছেনা । হলঘরের প্রতিটি কোণায় ভাসছে ভয়ের ভারী বাতাস। শোরগোল নেই, আছে শুধু ধ্বংসের শব্দ,চেয়ার ভাঙার শব্দ, টেবিল উলটে যাওয়া, কার্পেটের ওপর র*ক্তের ফোঁটা পড়া।আর কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে,দানবসদৃশ জায়ান খান।তার বুক ওঠানামা করছে তীব্র শ্বাসে, হাত র*ক্তে ভিজে যাচ্ছে, চোখে জ্বলছে রুদ্র আগুন। যেনো মানব নয়,এক অপ্রতিরোধ্য ঝড়, এক ধ্বংসের প্রতীক।

মঞ্চের পাশে লিয়ানা নিজেকে আঁকড়ে ধরেছে, চোখ বন্ধ করে কেঁপে উঠছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেদ করে শুধু শোনা যাচ্ছে এক দানবের প্রলয়ংকরী নিঃশ্বাস,অনবরত ঘুষির আঘাতে ইশানের নাক-মুখ র*ক্তে ভিজে যাচ্ছে। মেঝেতে ছিটকে পড়ছে রক্তের ফোঁটা, কার্পেট লাল হয়ে উঠছে। ইশান জায়ানের হাত ধরে থামাতে চাইছে, কিন্তু জায়ানের পেশল মুঠি যেন ইস্পাত এর মতোন ভাঙছে না, থামছে না।
ঠিক তখনই,
ভিড়ের ফাঁক ভেঙে উঠে এলো রিনা শেখের গলা।
জায়ান!
কান্নাভেজা চিৎকারে কেঁপে উঠল হলঘর,
ছেড়ে দাও আমার ছেলেকে! আর ইউ ক্রেজি?! সন্ত্রাস, গুন্ডামি করতে এসেছো?! ছাড়ো! আমার ছেলের কিছু হলে আমি তোমাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবো!
এই কথা যেন ছুরির মতো বিঁধলো জায়ানের কানে।সে ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল রিনার দিকে। চোখে আগুনের শিখা, ঠোঁটে ভয়ঙ্কর হাসি।একটা অমানুষিক, বিষাক্ত হাসি,যা শুনে ঘরের সবাই শিউরে উঠল।
সিরিয়াসলি?

গলা ফাটানো দানবীয় হাসি ফেটে বের হলো তার মুখ থেকে।তাহলে তো আরও আগেই মেরে ফেলা উচিত । দেখবো আপনি কার কাছে গিয়ে আমার নামে কেস লড়েন, দুনিয়ার কোন আদালতে আমাকে ফাঁসিতে ঝুলান।
ভেরি ইন্টারেস্টিং হবে!
কথা শেষ হতেই,
সে পিশাচের মতো হাসতে হাসতে আবার ইশানের দিকে ফিরল। চোখ লালচে রক্তে ভরা, যেন আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলছে।অবিরাম ঘুষির বজ্রাঘাতে আবার কেঁপে উঠলো মঞ্চ।জায়ান চিৎকার করে,
মাদার*ফাকার!
তোর এত সাহস?! তোকে তো সেদিন মেরে মাটি চাপা দিয়ে দেয়া উচিৎ ছিলো! মানবতার খাতিরে তোর মতো ঘৃণিত মুখটা বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। আফটার অল,এককালের বন্ধু!
এক ঝটকায় থুতু ছুঁড়ে দিল ইশানের মুখে,

ইয়াক্‌ক! থু!
মুহূর্তেই আবার তার কলার শক্ত করে চেপে ধরলো। চোখে আগুন, গলায় গর্জন।
কু*ত্তার বাচ্চা! আমি আমার পুরো ক্যারিয়ার তোকে দান করে দিয়েছিলাম, আর তুই শেষে কিনা আমার কলিজায় হাত দিয়েছিস?! আজকে আমি তোর ওই কলিজা ছিঁড়ে দেখবো,ঠিক কত বড়ো!!!
ঘরের বাতাস জমে গেল।
লিয়ানা নিস্তব্ধ হয়ে কেঁপে উঠছে, অঝোরে কাঁদছে, আর চারপাশের মানুষজন চিৎকার করলেও বডিগার্ডদের গ্রিপে বাঁধা পড়ে অসহায়।

জায়ানের হাত থেকে রক্ত ঝরছে, চোখে পিশাচের নাচানাচি, হাসি ও চিৎকার মিশে পুরো হলঘর এক আতঙ্কের রাজ্যে পরিণত হলো।ঘরের ভেতর মুহূর্তেই অদ্ভুত এক শীতলতা নেমে এলো। সবার মুখে একই অভিব্যক্তি,অবিশ্বাস, আতঙ্ক আর নিস্তব্ধতা। জায়ান ঠিক এইমাত্র যা বললো, তা যেনো কারও মাথায় ঢুকছে না।
জায়ান এর এমন ভয়ানক রুপ আার বলা প্রতিটা কথা লিয়ানার অন্তরে অন্তরে প্রশ্ন গর্জে উঠলেও উচ্চারণ করলো না। আর সবাই শুধু অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।কিন্তু জায়ান যেনো অন্য এক জগতে। তার চোখ দুটো লালচে, কণ্ঠে এমন এক হুকুমের ঝড়, যেনো সে কাউকে কাঁপিয়ে দিতে এসেছে। ঘরের প্রতিটি মানুষ তার আচরণে আতঙ্কিত। মনে হচ্ছে, এ কেবল কোনো পারিবারিক বিবাহ,বিষয়ক অস্বস্তি নয়,এর ভেতরে আছে কোনো গভীর ছায়া, কোনো অজানা ভয়।ঠিক সেই সময়, মেঝেতে পড়ে থাকা ইশান হঠাৎই কেঁপে উঠলো। দুর্বল শরীরটা যেনো আর সামলাতে পারছে না। কাঁপতে কাঁপতে ভাঙা গলায় ফিসফিস করে বললো

আমি কীভাবে জানবো, লিয়ানা যে তোর কাজিন? আমি তো কোনোদিন ওকে দেখিনি,না,দেখেছি আগে কখনো, শুধু নাম শুনেছি তোর মুখেই,বাচ্চা একটা মেয়ে ছিলো।কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখ ভিজে উঠছে। নিঃশ্বাস যেন ভারি হয়ে গেছে।
কিন্তু এখন আমি, আমি লিয়ানাকে ভালোবাসি। ভীষণভাবে ভালোবাসি। প্রথম দেখাতেই,ও আমার সবকিছু হয়ে গিয়েছে। জানার পরেও যে ও তোর কাজিন,এই বাড়ির মেয়ে, আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি, জায়ান পারিনি।
ঘরের ভেতর আবারো নেমে এলো শীতল নীরবতা। যেন কারও বুকের ভেতর থেকে বাতাস টেনে নেওয়া হয়েছে।ইশানের স্বর এখন আর্তনাদের মতো,

যা ইচ্ছা কর কিন্তুশুধু বিয়েটা হতে দে। প্লিজ, আমি সত্যিই ওকে হারাতে চাই না।মেরে ফেলতে চাস আমায়,মারিস বিয়েটা হয়ে যাক।এমনিতেও তোর ঝামেলা আমার সাথে,যদি চাস কোনোদিন ও তোর সামনে আসবো না,লিয়ানাকে নিয়ে দূরে চলে যাবো।এমনিতেও তোর তো ওকে সহ্য হয়না, আই নো।
জায়ানের ঠোঁট বাঁকা হাসিতে দেখা গেলো। গভীর, কর্কশ কণ্ঠে কলার চেপে ফিসফিস করে-
তোর কাছে কি আমি অতীতের কাহিনী শুনতে চেয়েছি?Bitch!
তুই শুধু আরেকবার বল,কি ভালোবাসা? কার সামনে দাঁড়িয়ে কি বলছিস মাথায় আছে তো?
ইশানের গলাটা শুকিয়ে গেছে, কিন্তু সে প্রতিবাদ করবার আগেই জায়ান চাপা রাগে গর্জে উঠে-
Fine! fine! fine! চল, ভালোবাসতে বাসতে আজ শহীদ হ।ইতিহাস সাক্ষী হয়ে যাক একজন ভালোবেসে মরেছে,আরেকজন ভালোবেসে মেরেছে।

জায়ানের ঠাণ্ডা আঙুল যখন বন্দুককের ট্রিগার চেপে ধরে ইশানের বুক বরাবর তখনই,
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লিয়ানার চোখ ছলছল করে উঠলো। এতক্ষণ কেবল কেঁদে, মুখ চেপে ধরে ভয়ে কাঁপছিলো সে। কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছিলো না,কিন্তু হঠাৎ যেন তার ভেতরে সব বাঁধ ভেঙে গেলো। বুকের ভেতরটা বিদীর্ণ হয়ে উঠল।এক মুহূর্ত দেরি না করে সে ছুটে এল। লাল শাড়ির আঁচল উড়ে গেলো বাতাসে, পায়ের নূপুর কেঁপে উঠলো, আর ভিড় ঠেলে সে সরাসরি জায়ানের পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে আটকাতে চায়।
তার কান্নাভেজা কণ্ঠে হাহাকার ভরে উঠে-

আল্লাহর দুহাই লাগে! এম’ন পাপে পা বাড়াবেন না,দয়া করে,দয়া করে ছেড়ে দিন ওনাকে।
চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে লিয়ানার মুখ। ভয়ে-আর্তি,আর ঘৃনায় সে কেঁপে উঠছে, তবুও শক্ত করে জায়ানকে আঁকড়ে ধরে আছে, যেন তার স্পর্শই এই অগ্নিঝরা মুহূর্তটাকে থামিয়ে দিতে পারে।সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে,কেউ নড়তেও পারছে না। শুধু সেই মেয়েটির কান্নার আওয়াজ আর জায়ানের নিশ্বাসের ভারী শব্দ মিলেমিশে একটা অসহনীয় উত্তেজনা তৈরি করেছে ঘরে।সেই অট্টালিকার ভেতর নিস্তব্ধতা যেনো ছুরি দিয়ে কেটে নেওয়া যায়,শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ, আতঙ্কে চেপে রাখা কান্না, আর জায়ানের ভয়াল গর্জন।
জায়ান হঠাৎ ঝড়ের বেগে ইশানকে ছেড়ে দিয়ে ফিরে দাঁড়ালো লিয়ানার দিকে। এক ঝটকায় তার হাত উঠে চড়ের বজ্রাঘাত লিয়ানার গালে সপাটে পড়লো। শব্দটা যেনো পুরো হলঘরটায় প্রতিধ্বনিত হলো। এত জোরে আঘাত যে লিয়ানা দুলে গিয়ে পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো, কাঁপতে কাঁপতে গাল চেপে ধরে নিঃশব্দে অঝোরে কাঁদতে লাগলো।

কিন্তু জায়ান থামলো না। সে ক্ষিপ্ত সিংহের মতো এগিয়ে এলো,হাঁটু গেরে বসে, দু’হাত দিয়ে লিয়ানার কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে ঝাঁকাতে লাগলো। তার চোখ দুটো লাল অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে—
পাপ?! আমি করছি নাকি তুই?! এই বা*ন্দি এই বিয়ের পিড়িতে বসতে যাচ্ছিস?! এতো শখ তোর বিয়ে করার?! চুপ থাকিস না বল! কেন করছিলি এমন??…..
বিয়ে করতে চাস তাই না??চল! তোর শখ মিটিয়ে দিবো আজ।
সে লিয়ানার হাত মুচড়ে টেনে তুললো মেঝে থেকে। ভয়ে ঘর জমে গেছে, কেউ এগিয়ে আসতে পারছে না। জায়ান তর্জন গর্জন করে কণ্ঠে বজ্রধ্বনি ঝরাল,

কাজি সাহেব! বিয়ে পড়ান! আহা, ভয় পাবেন না,আপনাকে মারবো না। আপনার ছাড়া আমার বিয়ে কীভাবে হবে?!
কাজি সাহেবের হাত কাঁপছে, চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। লোকটা বিয়ে পড়াতে এসেই বিপদে পড়ে গেলো।আর লিয়ানা হাত ছাড়াতে ছাড়াতে ঘৃণা চাহনিতে,
করবো না আমি আপনাকে বিয়ে।
করবি না?
না!..
কথাটা কানে যেতেই,জায়ান চিৎকারে করে গর্জে উঠে –
খোদার কসম!এই মুহূর্তে যদি তুই আমায় বিয়ে না করিস।আজ খান বাড়িতে তিনটে লাশ পড়বে! একটা তোর ওই হবু স্বামীর! আরেকটা তোর! আর…..
আমার!

পুরো ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল।লিয়ানা স্থির হয়ে গেল। তার চোখ ভিজে গেছে, ঠোঁট কাঁপছে,তবুও সে সাহস সঞ্চয় করে জায়ানের চোখে চোখ রাখল। কণ্ঠ কেঁপে উঠল তবু সে বলে-
চলে যান,প্লিজ। কেন করছেন এমন? আর কত তামাশা বানাবেন? এটা আমার জীবন,কোনো পুতুল খেলা না,যে যা মন চাইলো তাই করবেন।
তার সেই করুণ দৃষ্টিতে মুহূর্তের জন্য থেমে গেল জায়ান। তার রক্তিম চোখে এক অদ্ভুত অস্থিরতা, হাহাকার, আর জেদ মিশে উঠল।
গভীর শ্বাস টেনে জায়ান ফিসফিস করে –
চলে যাবো? তারপর কী করবি? ওই ইশানকে বিয়ে করবি?

সে হঠাৎ হাতের পিস্তলটা উঁচিয়ে পেছনের দিকে তাক করলো ইশানের দিকে। তার ঠোঁটে হালকা বাঁকা হাসি,
ভালোবাসিস ওকে?? একবার বল,ভালোবাসিস?এত টান এই বাস্টা*র্ড টার জন্যে??
লিয়ানা তার সামনে দাড়িয়ে থাকা পুরুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে । তার বুক ওঠানামা করছে, চোখে অঝোর জল। কিন্তু ঠোঁট খুলেও কোনো শব্দ বের হলো না। সে শুধু মাথা নাড়লো ডানে-বাঁয়ে, না বোঝানোর মতো।
এক পলকের জন্য শূন্য হলঘরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো।জায়ান হো হো করে হেসে উঠলো। হাসির শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠলো। তার চোখের হিংস্র আগুনে এবার একফোঁটা প্রশান্তির ঝিলিক ফুটে উঠল।বন্দুক নিচে নামিয়ে বলে –

বেঁচে গেলো।
তার কণ্ঠ প্রতিধ্বনির মতো ছড়িয়ে গেলো চারপাশে।
তারপর হঠাৎ,
বাড়ির মধ্যে ঘটলো এক অপ্রত্যশিত দৃশ্যে।এমন দৃশ্য চোখ পড়তেই সকলে নিজেদের দৃষ্টি সরিয়ে নিল,কেনোনা,
জায়ান এক ঝটকায় লিয়ানার মুখ চেপে ধরে, তারপর প্রবল শক্তিতে টেনে নিয়ে এসে দেয়ালে আছড়ে দিল। লিয়ানার পিঠ ঠাস করে ঠেকে গেলো ঠাণ্ডা দেয়ালে, আর চোখের সামনে হঠাৎ ঝাপসা হয়ে উঠলো সবকিছু।
কোনো পূর্বাভাস ছিলো না, কোনো শব্দ ছিল না,শুধু এক বজ্রাঘাতের মতো অপ্রত্যাশিত চুম্বন।
লিয়ানার উষ্ট অধর জায়ানের করাল আঁকড়ে আটকে গেল, যেন শতাব্দীর ক্ষুধা জমে আছে তাতে। লিয়ানার বুকের ভেতর জমাট বরফের মতো স্তব্ধতা, নিঃশ্বাস আটকে গেল,দু’হাত দিয়ে পাগলের মতো জোর করে ঠেলতে লাগলো, কিন্তু জায়ান যেন পাথরখণ্ড—এক ইঞ্চিও নড়লো না।তার কাঁধের ভার, তার গায়ের তাপ, আর ঠোঁটের সেই অদম্য দখল লিয়ানাকে পুরোপুরি বন্দি করে ফেলল।এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত যেন সময় থেমে গেল। তারপর হঠাৎ
লিয়ানা বুকের সবটুকু শক্তি একত্র করে ধাক্কা দিলো, ধড়ফড় করে নিজেকে সরিয়ে নিল তার থেকে। হাঁপাতে হাঁপাতে বুক ধরে দাঁড়ালো, চোখ কাঁপছে, ঠোঁট কাঁপছে, গাল লাল হয়ে উঠেছে লজ্জা আর আতঙ্কে।এভাবে এতগুলো মানুষদের চোখের সামনে এমন দৃশ্য সত্যিই লজ্জার।সকলের চোখে-মুখে অস্বস্তি থাকলেও কেউ সেই দৃশ্যের সাক্ষী হতে চাইলো না।

আর জায়ান?
সে এক ফোঁটা অনুতাপ ছাড়াই তাকিয়ে রইল লিয়ানার দিকে,ঠাণ্ডা, স্থির, অথচ চোখে এমন আগুন যেন ঘোষণা করে দিল,
এটা কেবল শুরু।
তবে রিহান এইবার আর চুপ না থেকে ঢুক গিলে বলে-
আরে.. আরেএ ভাইয়া! বিয়ের দিন বউয়ের কপালে চুমু খেতে হয়।না..মানে তুমি ত..
তো কিহহহ??My wife my rules!(বাকা হেসে)
তারপরই লিয়ানার হাত শক্ত করে টেনে নিয়ে যায় জায়ান। চারদিক নিস্তব্ধ, কারও সাহস নেই এগোনোর।
ঠিক তখনই,
সোলেমান খান প্রবল রাগে ভিড়ে বডিগার্ডদের ধাক্কা মেরে সামনে চলে এলেন। তাঁর চোখ রক্তিম, কণ্ঠস্বর গর্জনের মতো,জায়ানের পথে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই।
ক্লিক!

জায়ান বন্দুক উঁচিয়ে সোজা সোলেমান খানের কপালের মাঝ বরাবর ঠেকিয়ে দিলোঘরের বাতাস জমে গেল। নিস্তব্ধতা এমন যে কারও নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে।সোলেমান খান এক মুহূর্ত তাকালেন তাঁর স্ত্রীর দিকে। চোখে যন্ত্রণা, তবু কণ্ঠে বজ্রগর্জন,
দেখলে, নাফিসা? কেমন জানো*য়ার জন্ম দিয়েছো? দেখো, নিজের বাপের কপালে আজ পিস্তল ধরেছে তোমার ছেলে!
এই এক বাক্যে পুরো খান পরিবার জমে গেলো মূর্তির মতো। কারও পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব হচ্ছিল না,এসব তাদেরই বাড়ির ভেতর ঘটছে।

জায়ানের চোখে লাল আভা ফুটে উঠেছে । সে গর্জে উঠল,
আমার রাস্তায় আটকাবেন না মি.সোলেমান !এর পরিণতি মুটেও ভালো হবেনা।
সোলেমান খান থামলেন না, উল্টো তীব্র কণ্ঠে বললেন—
মাস্তানি শিখেছিস কবে থেকে? এখন বন্দুক সঙ্গে ঘুরিস?তোকে নিজের ছেলে বলতেও ঘৃণা হচ্ছে।ছেহ!এই বাড়ির মান ইজ্জত সব ধুলোয় মিশিয়ে দিলি,এখন নিজের জেদের বশে একটা মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি শুরু করলি।আমি তা হতে দিবো না।
জায়ান এইবার বন্দুকটা নামিয়ে নিজের সামনে ধরে সেটার দিকে তাকিয়ে বলে,
Uhmmm, Dad! It’s totally legal for me…আর আজ থেকে আপনার ভাতিজীও আমার লিগাল সম্পদ হবে।

তারপর হাতে ইশারা করতেই সাথে সাথে দুজন বডিগার্ড সোলেমানকে ঘিরে ফেলে,আর এক ঝটকায় আবার লিয়ানার হাত চেপে ধরে সামনে টেনে নিল সে। পিছন থেকে পুরো লাইনজুড়ে দাঁড়িয়ে গেল বডিগার্ডরা, কারও পক্ষে পথ আটকানো অসম্ভব।চারপাশে আতঙ্ক, কান্না, শ্বাসরুদ্ধ নীরবতা। লিয়ানা হাঁপাতে হাঁপাতে কাঁপছে, বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে, কেন সবসময় তার সাথেই এমন হচ্ছে?জায়ান সোজা মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলো।জায়ানের কণ্ঠ বজ্রপাতের মতো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে
কাজী সাহেব! বিয়ে পড়ান।এখনই শুরু করুন।

কাজীর হাত কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, তবুও সেই শীতল নীরবতা ভেদ করে ধীরে ধীরে বিয়ের আয়াত পড়তে শুরু করলেন।লিয়ানার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, ঠোঁট কাঁপছে,সে জানে না এই ভয়ংকর খেলার শেষ কোথায়।সে জানে না, এটাই কি তার জীবনের বাঁধন নাকি শিকল?
টেবিলের ওপরে সাদা রঙের রেজিস্টার খোলা। পাতার মাঝখানে কালো কালি দিয়ে ছাপা অক্ষরে লেখা “Marriage Registration”শব্দগুলো যেন লিয়ানার চোখের সামনে কুয়াশার মতো ভেসে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। পাশে কলমটা রাখা, একেবারে চুপচাপ, অথচ আজ তার ভার যেন হাজার মণ।জায়ান ধীরে ধীরে কাগজের পাতা ঘুরিয়ে নিজে সািন করে তার সামনে ঠেলে দিলো। কোনো শব্দ নেই ঘরে, শুধু দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দটা কানে কাঁটার মতো বিঁধছে।

লিয়ানার চোখে কাগজের অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। হাত দুটো এমন কাঁপছে যেন অচেনা কোনো ঝড় বয়ে গেছে শিরদাঁড়া বেয়ে। কলম ধরার শক্তি পর্যন্ত নেই তার আঙুলে। আঙুলের গিঁটগুলো সাদা হয়ে গেছে আঁকড়ে ধরা চেষ্টার চাপে।শ্বাসটা হঠাৎ ভারি লাগছে। বুকের ভেতর যেন বালির স্তূপ জমে গেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট। চোখদুটো জ্বালা করছে ঘুম না হওয়া রাতের চিহ্নে, সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ, একটার পর একটা ঘটনার অভিঘাতে দম ফেলার অবকাশ পায়নি সে। তাছাড়া,গত কদিন ভালো করে খাওয়া দাওয়া হয়নি, শরীর এমনিতেই দুর্বল,মাথাটা কেমন দুলছে। সামনে রাখা সাদা পাতাটা সরে সরে যাচ্ছে চোখের সামনে, অক্ষরগুলো সাপের মতো বেঁকে যাচ্ছে। শব্দগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি থেকে। শূন্য শূন্য লাগছে সব।

হাত তুলল সে,কিন্তু আঙুলের ডগা যেনো শূন্যে ভাসছে। কলমটা ধরার চেষ্টা করতেই মনে হলো মাটিটা তার পায়ের তলা থেকে সরে গেছে। এক অদ্ভুত অন্ধকারের স্রোত ধীরে ধীরে এসে গলা পর্যন্ত ঢেকে ফেলছে। চোখদুটো গড়িয়ে আসছে বন্ধ হয়ে,তার কি খুশি হওয়া উচিত কি-না তাও বুঝছে না
শরীরের ভেতর শেষ আলোটা নিভে যাওয়ার আগে তার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো ফিসফিসে নিঃশ্বাস আটকে গেলো।

সবকিছু ঘুরছে।আমি পারছি না।
জায়ান গম্ভীর অথচ মাদকতা মেশানো গলায় বলে উঠে
ওহহো,সময় চলে যাচ্ছে বেবি! ফাস্ট কর! আর কয়েক ঘণ্টা পরেই আজকের দিনটা শেষ হয়ে যাবে,তুই কি বাসর করতে চাইছিস না? টাইম চলে যাচ্ছে তো।
শব্দগুলো যেন বাতাস কেটে ছুটে এলো লিয়ানার কানে। তার গাল লালচে হয়ে উঠলো, বুকের ভেতর ধুপধাপ শব্দ বাড়তে লাগল। অথচ সে কিছু না শুনতে পাওয়ার ভান করে নামের পাঁচটা অক্ষর শেষ করতে চেষ্টা করল। হাত কাঁপছে, কলমের কালির দাগ মুছছে ঘামে ভেজা আঙুল।শেষ অক্ষরটাও লিখতে গিয়ে চোখ ঝাপসা হতে লাগল। মাথা যেন হঠাৎ ভারী হয়ে এলো। আরেক মুহূর্ত পরেই পুরো শরীর হেলে পড়তে লাগল পাশের দিকে।কিন্তু মেঝেতে পড়ার আগেই, এক ঝটকায় শক্ত দু’টো বাহু তাকে ধরে ফেলল।

জায়ান!তাকে এক নিমিষে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো । ধীরে ধীরে তাদের চারপাশের পৃথিবীকে ব্লার করে দিয়ে শুধু শোনা যাচ্ছে জায়ানের গভীর নিঃশ্বাস, আর লিয়ানার অস্পষ্ট গুঞ্জন অর্ধ চোখ খোলা।জায়ান কোনো কিছু না বলেই তাকে সোজা কোলে তুলে নেয়। তার হাতের মুঠোয় লিয়ানার কোমল শরীর নিস্তেজ হয়ে আছে, লম্বা চুল গলার পাশে ঝুলছে।

জয়ানের গম্ভীর মুখে কোনো ভাবের ছাপ নেই। হাতের রগগুলো টানটান, চোখে তীব্র আগুন। লিয়ানার দেহ এখনো তার বাঁ হাতে ঝুলে আছে, নিস্তেজ। সে এক মুহূর্ত থামে না, নিঃশব্দে নিজের ব্লেজারের ভেতরের পকেট থেকে মোটা টাকার বান্ডেল টেনে বের করে। ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে সেই টাকা লিয়ানার মুখের চারপাশে ঘুরিয়ে কাজির হাতে ধরিয়ে দিয়ে,কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা গেটের দিকে হাঁটা দেয় জায়ান। পদক্ষেপে এত ভার যেন মাটি কেঁপে ওঠে। পেছনে সারি সারি দেহরক্ষী নিঃশব্দে অনুসরণ করছে, কারও সাহস নেই চোখ তুলে তাকানোর। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ, শুধু জুতোর ধ্বনিত হচ্ছে ঠাণ্ডা মার্বেল ফ্লোরে।ঠিক তখনই, হঠাৎ কর্কশ এক আর্তনাদ চিরে ফেলে সেই নীরবতা।
জাস না বাবা! জাস না
নাফিসা খানের গলা। বুক ফাটানো কান্নায় কাঁপছে প্রতিটা অক্ষর। চোখ উন্মত্ত হয়ে আছে, দৌড়ে আসে তিনি। জায়ানের সামনে এসে ছুটে দাঁড়ায়, দুই হাত বাড়িয়ে।
চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু, কণ্ঠ কাঁপছে,

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১৪

যা হওয়ার হয়েছে, আমি সবাইকে বুঝিয়ে বলবো। কেউ কিছু বলবে না আজকের পর থেকে,সবাই মেনে নিবে। শুধু তুই আমার বুক ফাঁকা করে যাস না বাবা।
সেই হাহাকার মুহূর্তের জন্য থামিয়ে দেয় জায়ানের গতি। তার চোখে ক্ষীণ এক কম্পন, ঠোঁটের কোণে অদৃশ্য কষ্ট। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে জায়ানএক লাইনের একটা কথাটা শেষ করেই পাশ কাটিয়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খোলে। মুহূর্তের মধ্যে কালো গাড়িটা গর্জন তুলে গেট পার হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় অন্ধকার রাতের ভেতর।
“এই বাড়িতে থাকা আমার জন্য শুভা পায় না।”

তোকে ছুয়েছি আঁধারে পর্ব ১৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here