তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭২
নীল মণ
সেই রাতের ঝড়ো ঘটনার পর আজ ঠিক পাঁচটা দিন কেটে গেল, কিন্তু সেই পাঁচ দিনের প্রতিটা মুহূর্ত যেন জায়নের কাছে অভিশাপের মতো লেগেছে, কারণ যতই সে বউ এর রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেছে, যতই সে জোর করে কাছে টেনে নেবার চেষ্টা করেছে, তিয়াশা মুখে একটাও কথা বলেনি, একটাও মিষ্টি শব্দ উচ্চারণ করেনি, অথচ তিয়াশা মনের গভীরে সে সেই রাতেই অভিমান ডুবিয়ে দিয়েছিল , রাগটাকে মুছে ফেলেছিল, কিন্তু একটাই উদ্দেশ্যে মুখ বন্ধ করে রেখেছে—যেন জায়ন এর সেই অস্থির, নিয়ন্ত্রণহীন হাতকে একবার হলেও থামাতে পারে। আর অন্যদিকে জায়ন, বউয়ের রাগ ভাঙ্গানোর জন্য ফুলে ভরে দিয়েছে ঘর, চকলেট গিফটে সাজিয়ে রেখেছে টেবিল, নানান ছোট্ট ছোট্ট চমক এনে দিয়েছে, তবুও তার বউয়ের মুখ থেকে একটা শব্দ বের করতে পারছে না, একটা হালকা হাসিও দেখতে পাচ্ছে না।
এর মধ্যেই ঘনিয়ে এসেছে উৎসবের দিন, আগামীকাল চৌধুরী বাড়িতে হবে একসাথে দুইটা বিয়ে, সারা বাড়ি সেজে উঠেছে ফুলের সঙ্গে সঙ্গে নানান রকম ফেয়ারি লাইট এ । তাই সারা বাড়ি এখন কোলাহলে মুখর, হাসিতে গানে নাচে ভরে গেছে প্রতিটা কোণ, রান্নার সুঘ্রাণে উঠোন থেকে বারান্দা পর্যন্ত যেন এক অদৃশ্য মায়ার পর্দা টানানো, কারো হাতে রঙিন ফুলের ঝুড়ি, কারো হাতে হলুদের বাটি, আর ছোট ছোট বাচ্চারা এদিক ওদিক নেচে গেয়ে একেবারে মাতিয়ে রেখেছে পরিবেশ, কারণ আজ অনুর আর ইউভির গায়ে হলুদ, সেইসঙ্গে আরোহী আর আকাশেরও গায়ে হলুদ, তাই আনন্দের মাত্রা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
এমন ভিড়ভাট্টার মাঝে হঠাৎ রায়ানের কণ্ঠ ভেসে এলো, তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ডেকে উঠল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
__”ওই শাকচুন্নি! এদিকে আয়!”
ডাক শুনে হুট করে থেমে গেল মারিয়া, এতক্ষণ সে ছুটোছুটি করে এদিক-ওদিক সাহায্য করছিল, হঠাৎ ডাক শুনেই ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। মনে মনে বিড়বিড় করল,
__”এই গন্ডারের বাচ্চা আবার কি নতুন ঝামেলা বাঁধাবে, কদিন ধরে এত জ্বালাচ্ছে।”
রায়ান আবারও গলা চড়িয়ে বলল,
__”কি হল শুনতে পাচ্ছিস না? ডাকছি তো। নাকি কান ধরে টেনে আনবো?”
মারিয়া এবার আর চুপ থাকতে পারল না, মুখ বাঁকিয়ে বলল,
__”আসছি তো, এত রাগ দেখানোর কি আছে?”
এই বলে মুখ গোমড়া করে এগিয়ে এল, আর রায়ান কিছু না বলে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল সাইডে। মারিয়া হাঁটতে হাঁটতে লম্বা গাউনের একপাশ ধরে উঁচু করল, আর বিরক্ত গলায় বলল,
__”আরে রায়ান ভাই, কোই নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?”
রায়ান কোন উত্তর না দিয়ে একেবারে নিজের রুমের সামনে এসে দাঁড়াল, হাত ছেড়ে দিয়ে একদম গম্ভীর স্বরে বলল,
__”তুই বড় হোস নি?”
মারিয়া ভ্রূ কুঁচকে অবাক হয়ে জবাব দিল,
__”মানে?”
রায়ান কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
__”এত লাফালাফি করছিস কেন সারা বাসা জুড়ে ? এখন আর তুই ছোট বাচ্চা নোস, নিজেকে যত বাচ্চা করে রাখবি আমার তাহলে সময়ের থেকে বেশি অপেক্ষা করতে হবে। আর আমি অপেক্ষা জিনিস টা মোটেই পছন্দ করি না । জানি তুই এখনো বাচ্চা আছিস কিন্তু তুই বড় হ তখন তোর সব বাচ্চামো আমার সঙ্গে দেখাস। ”
রায়ানের মুখের দিকে চেয়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেল মারিয়া, কথাগুলো তার মাথায় ঢুকল না, তাই হতবম্ব হয়ে বলল,
__”মানে?”
রায়ান ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি রেখে মাথা নেড়ে বলল,
__”বললাম না তোকে, তুই কখনোই বড় হবি না, তুই তো বাচ্চাই থেকে যাবি, সবসময়।”
মারিয়া আরও অবাক, তাই এবার একটু ঝুঁকে রায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার ছলে বলল,
__”তুমি কি রায়ান ভাই ওইটা খাইস নাকি?”
রায়ান চমকে এক পা পিছিয়ে গেল, মারিয়ার গরম নিঃশ্বাস শরীরে লাগতেই বুকের ভেতর অজানা এক শিহরণ জেগে উঠল, মুহূর্তেই সামলে নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
__”একদম এত কাছে আসবি না, আর এইটা ওইটা। কোন কিছু খাই নাই, শুধু পেট ভরে ভাত খেয়েছি।”
মারিয়া মুখ ঘুরিয়ে বলল,
__”আমার কি বয়ে গেছে তোমার কাছে আসতে! গেলাম আমি।”
মরিয়া এই বলে পা বাড়াতে লাগলো সিঁড়ির দিকে নামার জন্য কিন্তু এমন সময় রায়ান তার হাত ধরে থামিয়ে দিল টেনে নিল নিজের দিকে, তারপর গম্ভীর স্বরে বলল,
__”আমি কি তোকে যেতে বলেছি? এখানে দুই মিনিট চুপচাপ দাঁড়া।”
এই বলে সে ঘরে ঢুকে গেল, ।কিন্তু হঠাৎ করে এরকম ভাবে রায়ান মারিয়ার হাত টানায় মারিয়ার বুক টা কেমন কেঁপে উঠলো, এরকম কেনো হলো বুঝে পারছে না , বুকের মধ্যে কেমন যেন ধুকপুক করছে । কিছুক্ষণের মধ্যে দুটো প্যাকেট হাতে নিয়ে ফিরে এল। মারিয়ার হাতে প্যাকেটগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলল,
__”ধর, এটা তোর জন্য।”
অবাক হয়ে মারিয়া বড় বড় চোখে তাকাল, হতবম্ব কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
__”এগুলো কার?”
রায়ান মাথায় টোকা দিয়ে হেসে বলল,
__”শাকচুন্নি, যখন তোর হাতে দিলাম, তখন তো এটা তোরই!”
মুহূর্তেই মারিয়ার চোখে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠল, একগাল হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে, সে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
__”সত্যি?”
রায়ান মুচকি হেসে জবাব দিল,
__”না, মিথ্যে গাধী! কালকে বিয়েতে এইটাই পরবি।”
মারিয়া মুখ ভরে হাসতে লাগল, প্যাকেট দুটো ওলটপালট করে দেখতে লাগল, তার ওই নিষ্পাপ হাসির মধ্যে লুকিয়ে ছিল একদম নির্মল একটা মন, যে মন এখনো কিছুই বোঝে না, জানেই না যে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অষ্টাদশ বছরের কিশোর ছেলেটির মনে সে আস্তে আস্তে অজান্তেই বাসা বেঁধে ফেলছে।
রায়ানও কিছু বলল না, শুধু মুচকি হেসে তাকিয়ে থাকল মারিয়ার দিকে, চোখ ভরা এক অদ্ভুত টান নিয়ে। হঠাৎ মারিয়া কৌতূহলী কণ্ঠে বলল,
__”তুমি এত টাকা কই পেলে? এগুলো তো অনেক দামি মনে হচ্ছে।”
রায়ান দুষ্টুমি করে তার কান টেনে হাসতে হাসতে জবাব দিল,
__”এখন থেকেই এত চিন্তা করিস কেন? তোর হবু শশ সরি, আমার বাপের কি কম টাকা আছে? তবে হ্যাঁ, এইটা আমার নিজের টাকায় কেনা। পরে বলব কেন বলছি নিজের টাকায়। এখন বিদায়, আর বেশি লাফা ঝাঁপা করতে দেখলে কিন্তু পা ভেঙে দেবো!”
এই বলে রায়ান ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আর রায়ান এর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মারিয়া তখনো একভাবে দাঁড়িয়ে রইল, হাতে প্যাকেট দুটো শক্ত করে ধরে, বুকের ভেতর অজানা কাঁপুনি নিয়ে, নিজের অজান্তেই ঠোঁটে একটানা হাসি খেলে যাচ্ছিল।
হলুদ সাজে বসে আছে আয়নার সামনে অনু আর আরোহী, তাদের মুখমণ্ডলে যেন আলো ঝলমল করছে, পাশে রয়েছে বৃষ্টি, মারিয়া, পরি, আর তিয়াশার কোলে খেলা করছে ছোট্ট মহারানী। রুবিনা আজ আসতে পারেনি, কারণ সে ফোন ধরছেই না, দুই দিন হলো সে শুধু একটাই মেসেজ পাঠিয়েছিল সে পরে যোগাযোগ করবে, এখন এই মুহূর্তে পারছে না। আরোহী, পরি , তিয়াশা তার জন্য মন খারাপ করলেও আবার অনু আর আরোহীকে ঘিরে হাসি আনন্দে মেতে উঠলো।
আকাশ আর ইউভির হলুদের অনুষ্ঠান হবে আয়েশা বেগমের বাড়ি, আর অনু আর আরোহীর হলুদ হচ্ছে এই চৌধুরী বাড়িতেই। মোজাম্মেল সাহেব চেয়েছিলেন তার মেয়ের হলুদ যেন তাদের বাসায় হয়, কিন্তু সবার জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন এই বাড়িতেই হলুদ এর ব্যবস্থা করার জন্য । এখন এই বিশাল চৌধুরী বাড়ি যেন উৎসবের আলোয় ঝলমল করছে।
অনু আর আরোহীকে দেখে সত্যিই মনে হচ্ছিল তাদের শরীরে বিয়ের ছোঁয়া লেগেছে, সোনালি সাজে তারা দুজন যেন পরীর মত লাগছে। চারপাশের সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, কি অপূর্ব লাগছে আজ তাদের।
__” এই যে সুন্দরীরা, তোমাদের জামাই গুলার কি রাগ কমেছে না কি এখনো রেগে আছে?”
তিয়াশা মহারানীর মাথায় আলতো করে হাত বোলাতে বোলাতে দুষ্টু হাসি দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল অনু আর আরোহীর দিকে। আরোহী লাজুক মুখে হেসে ঠোঁট কামড়ে উত্তর দিলো,,
__” তোর ভাইয়া টাস্কি খেয়ে পারে না, রাগ কি করবে? আমি বরং আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি।”
আরোহীর সেই খুনসুটি ভরা উত্তর শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে হো হো করে হাসির রোল উঠলো, সবাই মিলে যেন থেমে থেমে আবার হেসে উঠলো। হাসির স্রোতে ভেসে গেলো সাজগোজের ভারী পরিবেশ।
এদিকে বৃষ্টি হঠাৎ অনুর দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে এক দুষ্টু টান টেনে বললো,
__” এই যে বনু কাম ভাবি, এবার তুমি বলো তো আমার ভাইয়ার কি রাগ কমেছে?”
বৃষ্টির মুখে ‘ভাবি’ ডাক শুনেই অনুর মুখ লাল টকটকে হয়ে গেল, সে সাথে সাথে লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেললো দুই হাত দিয়ে। তার এই লজ্জার ভঙ্গি দেখে আবারো সবাই হেসে উঠলো, হাসির উল্লাসে যেন হলুদ সাজের ঘরটা আরও আলোকিত হয়ে উঠলো।
কিন্তু এই আনন্দের মাঝেই হঠাৎ অনুর মনে পড়ে গেল গত রাতের কথা। যখন আর না পেরে সে নিজেই ছুটে গিয়েছিল ইউভির রুমে, কারণ তার প্রাণপ্রিয় পুরুষের রাগ সে আর সহ্য করতে পারছিল না। গত রাতের সেই দৃশ্য যেন আবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। অনু দাঁড়িয়েছিল দরজার বাইরে, কাঁপা কাঁপা গলায় নক করতে করতে বলছিল,
__” ইউভি ভাই…. ইউভি ভাই, রুমে থাকলে একবার দরজা টা খুলবেন প্লিজ?”
হঠাৎ করেই দরজা খুলে গেল, ইউভি দরজা খুলেই গোমরা মুখ করে ভেতরে চলে গেল, যেন শুধু দরজা খোলার জন্যই এসেছিল। অনু ধীরে ধীরে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।
ইউভি জানত, তার হৃদয়পাখি ঠিক তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই ইউভি টের পেল তার হৃদয়পাখির দুই বাহু তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। ঠিক তখনই কানে ভেসে এলো কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর, সেই কণ্ঠস্বর শুনেই ইউভির বুক কেঁপে উঠলো।
__” আপনি কথা বলছেন না কেন আমার সঙ্গে? কাল বাদে পরশু তো আমি সারাজীবনের মতো আপনার হতে চলেছি। কিন্তু আপনি আমাকে এত উপেক্ষা করছেন যে আমার ভয় লাগছে আমাদের আগামী জীবন ভালো যাবে কিনা। এই উপেক্ষা আমি মেনে নিতে পারছি না ইউভি ভাই।”
অনন্যার এই ভাঙা ভাঙা কান্নাভেজা কথা শুনে ইউভি চমকে উঠলো, মনে মনে ভাবলো
__”এই রে, আবার না বিয়েই ক্যান্সেল করে দেয়! রাগ তো ছিলাম কিন্তু সেটাও পরে গিয়েছিল। সবই তো আকাশের আইডিয়া ছিল এখন নাকি রাগ করে থাকলেই আমার পাখি নিজে থেকে কাছে আসবে। তাই তো হলো, সে এলো, কিন্তু আমি তার চোখের পানি দেখতে পারবো না। শা* হারামজাদা খালি উল্টা
পাল্টা বুদ্ধি দেয় ।”
মুহূর্তেই ইউভি ঘুরে দাঁড়ালো, নিজের হাত দিয়ে অনুর চোখের পানি মুছে দিয়ে গভীর আবেগে বললো,
__” তুই পাগল হয়েছিস পাখি? এসব কখনো ভাবিস না। তোকে একবার পুরোপুরি পেয়ে গেলে শুধু একবার আমার ভালোবাসাটা দেখবি, কখনো কষ্ট দেবো না তোকে কক্ষনো না ।”
অনু কান্নায় ভিজে যেতে যেতে হিচকি তুলে ইউভির দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলে উঠলো,
__” তাহলে আমাকে কষ্ট কেন দিচ্ছিলেন?”
ইউভি অনুকে বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো। বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছেড়ে সে ফিসফিস করে বললো,
__” এই যে এই শান্তিটা পাওয়ার জন্য।”
ইউভির বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এই আশ্বাস, এই ভালোবাসা শুনেই অনুর ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক মিষ্টি হাসি। সে বুকের ভেতর আরও গভীরে ডুবে গেলো, হাত রেখে দিলো ইউভির বুকে, যেন এই স্পর্শের ভেতরেই তার সমস্ত দুঃখ মিলিয়ে গেছিলো।
__” এই যে ম্যাডাম কোন জগৎ এ ডুবে আছেন, জামাই এর জগৎ এ বুঝি?”
পরির ঠাট্টা ভরা কণ্ঠ কানে আসতেই অনু যেন আচমকা নিজের ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এল, ঠিক যেন হঠাৎ করে কারও ঝাঁকুনি খেয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসা। সে তো একেবারে ডুবে গেছিল ইউভির কথা ভেবে, এতটাই ডুবে যে চারপাশের হাসি–আড্ডার শব্দও কানে আসছিল না। পরির কথাটা যেন তার বুকের ভেতরের সব লুকোনো কথা ধরে ফেলল, আর সঙ্গে সঙ্গেই অনুর মুখ গরম লাল হয়ে উঠল। একরকম অসহায় হাসি চাপতে গিয়ে সে বুঝে গেলো, তার মুখের অভিব্যক্তি দেখেই সবাই বুঝে ফেলবে ঠিক কি নিয়ে সে ভাবছিলো।
এরমধ্যেই তিয়াশা চুপ করে থাকতে পারল না, হালকা দুষ্টুমি মেশানো কণ্ঠে বলে উঠলো,
__” দেখ দেখ সবাই ভাইয়ার কথা ভাবছিল এতক্ষণ, কেমন লাল হয়ে গেছে দেখ মুখটা!”
তিয়াশার এই মন্তব্য যেন ঘরে বসে থাকা সবার কাছে এক নতুন খোরাক যোগালো। সবাই মুচকি হাসি চাপতে গিয়ে আবারো হো হো করে হেসে উঠলো। অনু তো আরও বিব্রত, এই কথার ঝড় থেকে বাঁচতে গিয়ে সে তিয়াশার দিকে একটু লজ্জা মাখা চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
__” আপু কি করবো বলো? তোমার মতো পাষাণ হতে পারি না, তোমার ঘরে ফুলে ভরে গেলো তবুও ভাইয়ারে মাফ করতেছ না।”
অনুর ঠোঁট থেকে এই কথাগুলো বের হতেই পুরো ঘরে যেন এক নতুন ঢেউ খেলে গেলো। সবাই হঠাৎ করেই চুপ করে গেলো, কারও ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি, আবার কারও চোখে মুগ্ধ বিস্ময়। অনুর মুখের সরল স্বীকারোক্তি যেন কারও কারও বুকেও এক অদ্ভুত আলোড়ন তুলল।
তিয়াশা প্রথমে কটমট করে তাকাল অনুর দিকে। চোখ দুটোতে জেদ, ঠোঁটে রাগের কড়া রেখা। তারপর এক মুহূর্তে গম্ভীর মুখে বলে উঠলো,
__” যখন তোর ভাইয়া মারল তখন মনে ছিল না, আর তাছাড়া আমি রাগ করে নাই তোর ভাইয়া কে একটু সায়েস্তা করতে চাই।”
সবাই তিয়াশার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ঠিক তখনই পরি, যে সবসময়ই নিজের খুনসুটি দিয়ে পরিবেশকে আরো হালকা করে দেয়, হেসে কটাক্ষের ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
__” সোনা ভাইয়া কে আর কষ্ট দিস না, বেচারা জ্বলে যাচ্ছে, তোর মায়া হয় না নাকি? হি হি।”
পরির মুখে এই নির্দোষ দুষ্টুমি মাখা কথাগুলো বের হতেই ঘরটা আবারো কাঁপতে শুরু করলো হাসির শব্দে। কারও হাসি চাপা, কারও হো হো করে ফেটে পড়া, আবার কারও চোখ ভিজে উঠলো মনের ভেতর জমে থাকা আবেগে। হাসির ঢেউয়ের মাঝেও কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তিয়াশা সত্যিই রাগে ফুঁসছে। তার বুকের ভেতরে যেন ঝড় বইছে, বাইরের হাসি আড্ডার মধ্যে দাঁড়িয়েও সে নিজের ক্ষোভ চেপে রাখতে পারছে না। মুখটা লাল, চোখে রাগ, ঠোঁটে আঁকড়ে ধরা অভিমান।
এই মুহূর্তে ঘরের প্রতিটা মানুষ যেন আলাদা আলাদা আবেগে ভরে উঠলো কেউ হাসিতে মশগুল, কেউ অনুর লাজুক মুখ দেখে আবেগাপ্লুত, কেউ আবার তিয়াশার ক্ষোভ বুঝে নিঃশব্দে চিন্তায় ডুবে গেলো। একসাথে সব আবেগ, হাসি মজা, রাগ অভিমান মিলেমিশে যেন ঘরটাকে এক জীবন্ত ছবিতে পরিণত করলো।
ছেলেরা সব এখন বনানী তে আয়েশা বেগম এর বাসায়, চারপাশ ভরে উঠেছে হলুদের সাজে। সবার পরনে একরঙা হলুদ পাঞ্জাবী আর সাদা পায়জামা, যেন একসাথে দাঁড়িয়েই একটা আলাদা আভা ছড়াচ্ছে। হাসি-আড্ডার মাঝেই চোখে পড়ছে তাদের ভেতরের উত্তেজনা, উৎসবের আমেজে ভরে গেছে পুরো বাড়িটা। কিন্তু এই ভিড়ের মাঝেও আলাদা করে চোখে পড়ছিল জায়নকে চোখে সানগ্লাস, পরনে গাঢ় হলুদ পাঞ্জাবী আর সাদা পায়জামা, হাতে দামী রিস্টওয়াচ, গায়ে রাজসিক ভাব তবু মন মেজাজ ভালো নেই। আজ চার দিন হয়ে গেলো বউ না তো কথা বলে, না তো ছুঁতে দেয়, ছুঁতে গেলেই মুখ ঘুরিয়ে থাকে। এ কষ্ট তার বুকের ভেতরে আগুনের মতো জ্বলছে।
__” কি হইছে মামা এরকম বাংলার পাঁচ করে রাখছিস কেনো মুখ টা?”
সাগরের কথা হাওয়ায় মিলতেই জায়ন কটমট করে তাকালো তার দিকে। সেই দৃষ্টির তীব্রতা দেখে সাগর কিছুটা আঁতকে উঠল, বুঝতে পারল এখন একটু বাড়াবাড়ি হলে পরিস্থিতি খারাপ হবে।
তখন পাশ থেকে আকাশ মুচকি হাসি দিয়ে কথা জুড়ে দিলো, তার ঠোঁটে খুনসুটি মেশানো রসিকতা,
__” কি করে ভালো থাকবে মুখ, সেদিন রাতের আমার তিয়াশা বনু কথা বলা ছাড়োন দিসে।”
আকাশের কণ্ঠে স্পষ্ট দুষ্টুমি ছিল, যেন ইচ্ছে করেই আগুনে ঘি ঢালছে।
এই বলতেই পলাশ হেসে গিয়ে বলে উঠলো,
__” একদম ঠিক আছে, শা* কি মার না দিলো ভাবীরে। একদম ঠিক করছে ভাবী।”
পলাশের ঠোঁটে খোলামেলা হাসি থাকলেও জায়নের চোখে সেই মুহূর্তে এমন এক দৃষ্টি জ্বলে উঠলো যে মনে হলো এখনি পলাশের টুটি ছিঁড়ে ফেলবে। সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি দেখে চারপাশে থাকা সবাই একবারে চুপ হয়ে গেলো, ঠোঁটে জমে থাকা হাসিটা থেমে গেল, বাতাস ভারী হয়ে উঠলো।
কিন্তু জায়ন কিছু বলল না, শুধু রাগে চোয়াল শক্ত করে, দুই হাত মুঠো করে গটগট করে বেরিয়ে যেতে লাগলো। তার সেই দৃপ্ত ভঙ্গি, রাগ মেশানো হেঁটে যাওয়া দেখে ইউভি, আকাশ, জেমস, রায়ান, আহান, নাজিম, পলাশ, সাগর সবাই হা করে তাকিয়ে রইল। প্রত্যেকের চোখে একটাই প্রশ্ন ভাসছিল,
__” আবার কি হলো, কোই যাচ্ছে ভাইয়া?”
ঠিক তখনই রান্নাঘরের পাশ থেকে আয়েশা বেগম উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ডাক দিলেন,
__” কি রে বাবা কোথায় যাচ্ছিস? একটু পরেই তো অনুষ্ঠান শুরু হবে।”
তখন জায়ন যেতে যেতে গম্ভীর কণ্ঠে একটাই বাক্য ছুঁড়ে দিলো,
__” বউ এর রাগ ভাঙ্গাতে।”
এই বলে সে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে গেটের সামনে দাঁড়ানো নিজের বাইকটায় উঠে স্টার্ট দিলো। চারপাশের সবকিছু তার চোখে এখন অচেনা, কানে কোনো শব্দ ঢুকছে না, তার মাথায় এখন শুধু একটাই কথা যেভাবেই হোক বউ এর রাগ ভাঙাতেই হবে, এভাবে আর সহ্য করা সম্ভব না।
হঠাৎ করে বাইক টা এসে থামল এক জ্যামে, জায়নের মুখে বিরক্তির ছাপ জমে উঠলো, কপালের ভাঁজে স্পষ্ট ধরা পড়ল দিনের চাপ আর ক্লান্তি। ঠিক সেই মুহূর্তেই ভিড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে এলো এক ১১ ১২ বছরের বাচ্চা মেয়ে, মাথায় পুরনো ঝুড়ি, তাতে সাজানো রঙবেরঙের কাঁচের চুড়ি। শিশুসুলভ সরলতায় দাঁড়িয়ে সে বলল,
__” ভাইয়া চুরি নিবেন? ভাবি বা আপির জন্য, নেন না সবাই খুশি হয়ে যাবে। আমার একটাও চুরি বিক্রি হয় নাই সকাল থেইকা, আপনি নেবেন ভাইয়া?”
জায়নের চোখ ভ্রুকুটি থেকে সরে গিয়ে একদম আটকে গেল সেই ঝুড়ির রঙিন চুড়িগুলোর দিকে। তার বিরক্ত ভরা মুখে যেন হঠাৎই বদলে গেল আবহাওয়া, রাগ আর অস্থিরতা কোথায় মিলিয়ে গেল। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর ম্লান কিন্তু অদ্ভুত কোমল এক হাসি দিয়ে বলল,
__” তোমার ঝুড়ি থেকে আমায় সব রঙের চুরি এক সেট করে দিয়ে দাও।”
বাচ্চা মেয়েটার চোখে-মুখে হঠাৎ করেই যেন আলোর ঝিলিক নেমে এলো, এত সহজ একটা কথাতেই সে খুশিতে ভরে উঠল, গলায় আনন্দের কাঁপুনি নিয়ে বলে উঠল,
__” জী ভাইয়া, এক্ষুনি দিচ্ছি।”
মেয়েটি তাড়াহুড়ো করে রঙিন চুড়িগুলো আলাদা করতে লাগল, সেই সময় জায়ন বাইকটা রাস্তার এক পাশে দাঁড় করিয়ে দিল, যেন শান্ত মনে চুরি গুলো নিতে যায় । কিছুক্ষণ পর মেয়েটা প্যাকেটটা হাতে ধরিয়ে দিল জায়নের হাতে, তখনই জায়ন পকেট থেকে দশ হাজার টাকা বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিল।
মেয়েটা টাকা দেখে যেন ঘাবড়ে গেল, আতঙ্কিত চোখে হকচকিয়ে পিছিয়ে গিয়ে বলল,
__” এ কি করছেন ভাইয়া? এই সব চুরি মিলিয়ে চারশো টাকাও দাম না, আর আপনি এত গুলো টাকা দিচ্ছেন!”
জায়ন হেসে ফেলল, তার হাসিতে ছিল এক অদ্ভুত নিশ্চিন্ততা আর মমতা। শান্ত স্বরে বলল,
__” যার জন্য চুরি গুলো নিচ্ছি, সে যদি খুশি হয়ে যায় তাহলে তোমায় আমি আরো কিছু গিফ্ট করব।”
কৌতুহলী চোখে মেয়েটি আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
__” কার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন ভাইয়া, ভাবির জন্যে?”
জায়ন প্যাকেটটা হাতে নিয়ে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, চোখের কোণায় হালকা আর্দ্রতা ভেসে উঠল। ফিসফিস করে বলল,
__” হ্যাঁ, আমার জানের জন্য।”
শিশু চোখে ভরে উঠল উৎফুল্লতা। সে খুব ইচ্ছা করল এই ‘ভাইয়ার জান’ কে একবার দেখার। মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে সে আবারও বলল,
__” ভাইয়া, আপনি বরং ভাবির জন্যে চুরি গুলো এমনিই নিয়ে জান, তবুও আমি এত টাকা নিতে পারব না, আমার আম্মু বলেছে কারো থেকে বেশি টাকা না নিতে।”
জায়ন সেই ছোট্ট মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল কত কষ্টের মধ্যেও ভদ্রতা, পারিবারিক শিক্ষা, সততার এতটুকু অভাব নেই। হৃদয়টা নরম হয়ে এলো। সে চোখ ভরে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে স্নেহমাখা কণ্ঠে বলল, __” পাগলি, ভেবে নে তোর বড় ভাই তোকে খুশি হয়ে দিচ্ছে। তোর এমনি দিতে হবে না, তুই যে বলেছিস এতেই তোর ভাবি খুশি হয়ে যাবে।”
মেয়েটা খানিকটা আমতা আমতা করল, তারপর চোখেমুখে ছোট্ট একরাশ খুশি নিয়ে বলল, __” ঠিক আছে বড় ভাই।”
জায়ন হেসে জিজ্ঞেস করল,
__” নাম কি তোর?”
__” রাইমা ভাইয়া।”
“বড় ভাই” ডাকটা শুনতেই জায়নের বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল বৃষ্টি, অনন্যা, মারিয়ার মুখগুলো। এই বাচ্চা মেয়েটিও তো মারিয়ারই সমবয়সী! বুকের ভেতরে অজানা ব্যথা জমে উঠল। শান্ত গলায় আবার জিজ্ঞেস করল,
__” তোর বয়সি আমারও বোন আছে বাসায়, জানিস? তোর বাসায় কে কে আছে?”
রাইমা মাথা নিচু করে ফিসফিস করে উত্তর দিল,
__” আমি, আম্মু আর ছোট ভাই আছে বড় ভাই। আব্বু আজ এক বছর হইলো মারা গেছে। তারপর থেকে আমরা একেবারেই অসহায় হয়ে গেছি ভাইয়া। আমার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। আম্মু বাসায় ভাইকে দেখে, আর আমি সারাদিন চুরি বিক্রি করি।”
বলতে বলতে তার চোখ বেয়ে নেমে এলো অশ্রু। এক মুহূর্তেই মনে হলো যেন সে আর শিশু নেই, সময় আর দুঃখ তাকে জোর করে বড় করে দিয়েছে।
জায়নের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। গভীর মমতায় ভরা গলায় হঠাৎ করেই সে বলে উঠল,
__” আবার পড়াশোনা করবি?”
রাইমা কাঁদতে কাঁদতেই এক অসহায় হাসি দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, গলায় জমে থাকা যন্ত্রণার শব্দ ভেসে এলো,
__” কি করে করবো বড় ভাই? আত্মীয়রা একবার দেখতেও আসে না। সারাদিন চুরি বিক্রি করে যা টাকা পাই, তা দিয়েই আম্মু সন্ধ্যায় বাজার করে। কোন দিন হয়, কোন দিন হয় না।”
জায়ন থেমে থেমে শুনছিল। তার মনে হচ্ছিল, পরিস্থিতি মানুষকে কত দ্রুত বড় করে দেয়! তারপরই এক শান্ত হাসি দিয়ে স্নেহভরা কণ্ঠে বলল,
__” এই বড় ভাই তোকে পড়াবে। এখন বাসায় যা। কাল থেকে আর চুরি বিক্রি করতে হবে না। তোর আম্মু আর ভাইকে নিয়ে কালকে আমাদের বাসায় আসিস। আমার ভাই-বোনদের বিয়ে, তুই তোর ভাবিকেও দেখে নিস। তোদের বাসার অ্যাড্রেস দিস, আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব।”
রাইমা অবিশ্বাসে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোখে জল, মুখে কেবল বিস্ময়। কাঁপা গলায় বলল,
__” হ্যা ভাইয়া, আমি সত্যি ভাবি কে দেখার জন্য আশপাশ করতেছি। বড় ভাইয়া, আপনি মজা করছেন তাই না? ভাইয়া, আমরা অনেক গরীব… এরকম মজা কইরেন না।”
জায়ন এবার কোমল অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
__” আমি কোন মজা করছি না রে বোন। এখন বাসায় যা, আর তোর বাসার অ্যাড্রেস টা দিয়ে যা।”
রাইমা তখনও দ্বিধায় ভুগছিল। মুখে ‘কিন্তু-কিন্তু’ ভাব। জায়ন বুঝতে পেরে বলল,
__” এত ভাবিস না বোন, বড় ভাইয়ের উপরে ভরসা রাখিস।”
রাইমার চোখ ভিজে গেল। আনন্দে, অবিশ্বাসে, কৃতজ্ঞতায় সে কান্না করতে করতে ধন্যবাদ জানাতে লাগল। কিন্তু জায়ন চোখ ফেরাল, তার ধন্যবাদের দরকার নেই। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
__” বড় ভাই ধন্যবাদ চায় না। পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করে দেখাতে হবে।”
রাইমার চোখ চকচক করে উঠল। দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল, __” জী বড় ভাইয়া, জী, নিশ্চয়ই কইরা দেখাবো।”
জায়ন তখন আরেকবার পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিতে গেল। রাইমা নিতে চাইছিল না, কিন্তু জায়ন জোর করেই ধরিয়ে দিল। শিশুটি তখন খুশিতে ভরপুর চোখে জল মুছতে মুছতে ফিরে গেল তার বাসার পথে।
আর জায়ন আবার বাইকের হ্যান্ডেলে প্যাকেট বেঁধে উঠল। চোখে ভেসে উঠল জানের মুখ, মনে ভেসে উঠল তার রাগ ভাঙানোর দৃশ্য। এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে সে চলল তার ভালোবাসার রমনীর কাছে, কারণ জানকে খুশি করা ছাড়া তার জীবনের আর কিছুতেই আর কোনো মানে নেই।
জায়ন বাসায় ফিরে ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল কিন্তু আশেপাশের এত লোকজন, হৈচৈ, হাসি ঠাট্টার মাঝেও তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠল কারণ যে মানুষটার মুখ দেখার জন্য এত তাড়াহুড়ো, যে মানুষটার রাগ ভাঙানোর জন্য এত কষ্ট, এই পথ ছুটে আসা সেই তিয়াশা কোথাও চোখে পড়ল না। বুকের ভেতরটা মুহূর্তেই কেমন করে উঠল, একধরনের অস্থিরতা গ্রাস করল তাকে, তাই আর এক মুহূর্তও না ভেবে দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে নিজের রুমের দিকে চলে গেল।
রুমে ঢুকেই চোঁখ পড়তেই তার নিঃশ্বাস থমকে গেল, যেন বুকের ভেতর জমে থাকা সব রাগ, ক্লান্তি, বিরক্তি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার বউ, তার জান, তার সবকিছু তিয়াশা। গায়ে হলুদ মস্লিন জামদানি শাড়ি, সঙ্গে রানী রঙের ব্লাউজ, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাজল লাগাচ্ছে বড় বড় কালো চোখে, আর লম্বা চুল আলগা খোপা করে বাঁধা, সেখানে গুঁজে দেয়া সাদা জুই ফুলের মালা যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোন পরীকে চোখের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে ফেলল জায়ন। হাতে রানি রঙের চুড়ি, তার ঝনঝন শব্দে যেন পুরো ঘর ভরে গেল, সেই শব্দ কানে যেতেই জায়নের চোখ আটকে গেল, বুকের ভেতরটা অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠল।
তিয়াশাও বুঝে গেল, তার বাঘের বাচ্চা বর এসে গেছে, সেই আগুনমাখা উপস্থিতি চারদিক কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তাই সে আয়নার সামনে থেকে সরে মুখ গম্ভীর করে পাশ কেটে বাইরে চলে যেতে চাইছিল। কিন্তু জায়ন কি আর সেই সুযোগ দেয়? মুহূর্তেই এগিয়ে এসে তার হাতটা শক্ত করে টেনে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিল, পাশের টেবিলে রেখে দিল চুরির প্যাকেটটা।
তিয়াশা মুখ ভার করেই নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল, দাঁত কিড়মিড় করে সেই ডাগর ডাগর বড় বড় চোখে তাকাল জায়নের দিকে, কিন্তু জায়ন কিছুতেই ছাড়ল না। জায়ন অসহায় হয়ে, প্রায় ভেঙে পড়া চোখে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
__”প্লীজ জান, আর রাগ করে থাকিস না, তুই যদি কথা না বলিস তো আমার বুকের ভেতরটা দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কিছুই ভালো লাগছে না।”
তবুও তিয়াশা মুখ ঘুরিয়ে রইল, চুপচাপ, জেদি। অথচ জায়ন নিজের সব অহংকার ফেলে আরও কাছে টেনে নিল, ঢেউ খেলানো মেদহীন কোমর নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল, আলতো হাতে মুখ ঘুরিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল,
__”দেখ জান, আমি জানি রাগে তোকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি, আঘাত করে ফেলেছি কিন্তু কি করব বল, তোকে ওই অবস্থায় দেখে, ওই পর পুরুষের চোখে তোকে দেখে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি,পাগল হয়ে গেছিলাম। প্লীজ সোনা, একবার কথা বল। তোর এই নীরবতা আমায় টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে, তোর শব্দ না শুনে আমি পানি ছাড়া মাছের মত ছটফট করছি। তোকে ছুঁতে পারছি না, তোকে শুনতে পারছি না আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না জান প্লীজ বোঝার চেষ্টা কর।”
এই কথাগুলো শুনে তিয়াশার বুকটা কেঁপে উঠল, বুক ফেটে যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। সে জানে আর বেশি শক্ত হয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না, অথচ ভয়ও আছে যদি আবারো জায়ন রাগের মাথায় সব কিছু ভুলে যেয়ে পাগলামি করে বসে? তাই সে চোখের পানি আটকাতে চেষ্টা করছে, নিজেকে শক্ত করে রাখছে।
জায়ন এবার চুপচাপ হাত বাড়িয়ে টেবিলে রাখা প্যাকেট থেকে এক সেট হলুদ কাঁচের চুড়ি বের করল। বুক ভারী হয়ে আসছে, চোখ লাল, কণ্ঠ রুদ্ধ, যেকোন মুহূর্তে কান্না বেরিয়ে আসবে। তবুও কষ্ট চেপে নিয়ে তিয়াশার ডান হাতে একে একে চুড়ি পরাতে পরাতে নিচু গলায় বলল,
__”জানিস, এই চুড়ি গুলো আমি কিনেছি রাস্তায় এক ছোট বোনের কাছ থেকে। ও ঝুড়ি ভরে চুড়ি নিয়ে বসেছিল, সকাল থেকে একটাও বিক্রি হয় নি। কিন্তু ওই চুড়ি গুলোর মধ্যে আমি শুধু তোকে দেখছিলাম, তোর হাসি, তোর রঙ, তোর হাত। মনে হচ্ছিল এই চুড়িগুলো আমার জানের জন্যই।”
জায়ন মাথা নিচু করে এবার ডান হাত ছেড়ে এক এক করে বা হাতে চুড়ি পরাচ্ছিল, । কণ্ঠ কেঁপে উঠল আবার,
__”বাচ্চা মেয়েটার বাবা নেই পরিবারে ওর আম্মু ও আর ওর ছোট ভাই। পড়াশোনা করতে চায় ওর উপর খুব মায়া হলো কেন জানিস ? ওর সকাল থেকে একটাও চুরি বিক্রি হয়নি……..”
এইসব শুনে তিয়াশার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, চোখ ভিজে উঠছিল কান্নায়। জায়ন এর মাথা এখনো নিচু হয়ে আছে ,তারপর আবারো বলতে লাগলো ,
__” ওর চুরির দাম আন্দাজে বেশি টাকা দিতে চাইলাম নিতে চাইছিল না জানিস । তারপর যখন আমি ওকে তোর কথা বললাম ও বলে ভাইয়া চুরি গুলো ভাবীকে তুমি এমনিই দিও , তবুও আমি এত বেশি টাকা নেব না। এই চুরি গুলোর মধ্যে অনেক মায়া জড়ানো জান এই এক একটা চুরি আমি দাম দিয়ে না মন দিয়ে এনেছি । এখন তুই যদি আমাকে ফিরিয়ে দিস , তোর কন্ঠ যদি শুনতে না পারি , তোকে যদি ছুঁতে না পারি….. ”
আর ঠিক তখনই জায়নের হাত থেকে একটা চুড়ি মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সেই ভাঙার শব্দটা যেন জায়নের বুক ভেঙে যাওয়ার শব্দ হয়ে বাজল তিয়াশার কানে।জায়ন ভাঙ্গা চুড়ির দিকে একবার তাকিয়ে তিয়াশার দিকে তাকিয়ে পরল , তাকাতেই তিয়াশা কেঁপে উঠলো কারন জায়ন এর চোঁখে পানি , জায়ন কাপা কন্ঠে বলে উঠলো,
__”ঠিক এইভাবেই ভেঙে যাব যদি তুই আমায় ফিরিয়ে দিস। আমি আর পারছি না জান। আর আঘাত করব না তোকে, চেষ্টা করব নিজেকে সামলাতে, কারণ তোর অভিমান আমায় জ্বালিয়ে দিচ্ছে, হয়তো একদিন ছাই করে দেবে জা…. ”
কথাটা শেষ হবার আগেই তিয়াশা হঠাৎ করে পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে দুই হাত দিয়ে জায়নের পাঞ্জাবীর বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে কাঁপা ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিল। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু, বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু আর শক্ত থাকা তার পক্ষে সম্ভব হলো না। আল্লাহ তাকে এত শক্তি দেন নি।
জায়নের চোখ বড় বড় হয়ে গেল, অবাক, শরীর কেঁপে উঠল এই হঠাৎ ঝড়ে। তিয়াশা ঠোঁট আলগা করে ভেজা কন্ঠে কাঁপা কন্ঠে ফিসফিস করে বলল,
__”আমি আর রাগ করে নেই বর, আল্লাহ আমায় এত শক্তি দেন নি যে তোমার সামনে ভেঙে পড়ব না। কারণ তোমায় আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।”
এই কথা শোনা মাত্রই জায়ন পাগলের মত তিয়াশাকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, কাঁপা কন্ঠে বলতে লাগল,
__”লাভ ইউ জান, লাভ ইউ সো মাচ, লাভ ইউ টু মাচ। তুই ছাড়া আমি অন্ধকার, কোন আলো চাইলেও খুঁজে পাবো না।”
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭১ (২)
এরপর আর কিছু নয়, শুধু উন্মত্ত ভালোবাসা জায়ন পাগলের মত তিয়াশার চোখে, মুখে, ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল আর তিয়াশাও তার সব অভিমান, সব কষ্ট, সব রাগ গলিয়ে দিয়ে পাগলের মত জায়নকে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগল।
ঘরের বাতাসে ভেসে উঠলো দুটো মানুষের ভালোবাসার নিশ্বাসের শব্দ।
