তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭৫ (২)
নীল মণ
দুই মাস পেরিয়ে গেছে চৌধুরী বাড়িতে। এই অল্প সময়ে অনেক কিছুই বদলে গেছে। জায়নের আগের মতো রাগ এখন আর নেই অন্তত চেষ্টা করছে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তবু এক জায়গায় সে বদলাতে পারেনি, বরং দিন দিন আরও বাড়ছে বউয়ের প্রতি তার পাগলামি, তার অবসেশন। তিয়াশা একটুও কিছু খেতে পারে না, খেতে গেলেই বমি উঠে আসে, যখন তখন জিদ করে বসে তিয়াশা অথচ তার সেই ছোট ছোট আবদারগুলো জায়ন এত যত্নে পূরণ করছে যে মনে হয় পৃথিবীতে এরচেয়ে সুখী মেয়ে আর কেউ নেই। বউয়ের পা মাটিতে পড়তে দেয় না, সবসময় আগলে রাখে, যেন তার শ্বাস প্রশ্বাসও এখন তিয়াশার সুস্থতার ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু আজকের দিনটা চৌধুরী বাড়িতে অন্য রকম। সবার মন খারাপ, গিন্নিদের চোখ ভিজে আছে, আঁচলে বারবার চোখের পানি মুছে নিচ্ছে। কারণ একটাই এই বাড়ির ছোট ছেলে, তাসনিন রায়ান চৌধুরী, আজ দেশ ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি দিচ্ছে পাঁচ বছরের জন্য। কিছুদিন আগেই সে নিজে থেকে জায়নের কাছে প্রস্তাবটা রেখেছিল। জায়ন অবাক হয়নি, চুপচাপ মাথা নেড়েছিল, কিন্তু বাকিরা গোটা পরিবার যেন বজ্রাহত হয়েছিল। এত বড় সিদ্ধান্ত, তবু রায়ানের মুখে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই, কোনো নড়চড় নেই।
আকাশে আজ বৃষ্টি নেমেছে। হয়তো পরিবারের এই বিদায়বেলাকে আরও ভারী করতে প্রকৃতিও সঙ্গ দিয়েছে। এমন দিনে আবার বাড়িতে এসেছে আয়েশা বেগম আর মারিয়া। বিশেষ করে মারিয়ার বুকটা আজ অকারণে ভারী হয়ে উঠছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রায়ানের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে, নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে ভেতরে। রায়ান তখন ব্যস্ত, লাগেজ গুছোচ্ছে। চোখ তুলে হঠাৎই মারিয়াকে দেখে তার বুক কেমন হঠাৎ ধক করে উঠল। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে, টলমল করছে, কিন্তু সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর। গলাটা শুকিয়ে এলেও কঠিন ভঙ্গিতে বলল,
__” রুমে আয় ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস ?”
রায়ানের গলা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মারিয়া চমকে উঠল। মনে হলো বুক কেঁপে উঠল তার। মাথা নিচু করে ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকে এল। চোখে পানি, ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই। এমন অবস্থায় তাকে দেখে রায়ান ভ্রু কুঁচকে নরম স্বরে বলল,
__” কি হয়েছে? এরকম মুখ কেন করে রেখেছিস?”
মারিয়ার চোখে তখন এক মায়াবী দৃষ্টি। বুক ভরা কষ্ট, অথচ মুখে বলতে পারছে না কিছুই। সে শুধু তাকিয়ে থাকে রায়ানের দিকে। সেই দৃষ্টি যেন রায়ানের বুক ভেঙে দিচ্ছিল। তাই কষ্ট চেপে হেসে উঠল, কিন্তু গলায় ভারী সুরে বলল,
__” এরকম ভাবে তাকাস না, যেতে পারব না তো?”
এই কথা শুনে যেন সময় থমকে দাঁড়াল। মারিয়ার মাথায় তখনো কথাগুলো গিয়ে পৌঁছায়নি। অবাক হয়ে হতবুদ্ধির মতো জিজ্ঞেস করল,
__” মানে?”
রায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানার কিনারায় বসে পড়ল। চোখ নামিয়ে হালকা হেসে বলল,
__” যেদিন আমার কথার জবাবে ‘মানে’ শব্দটা আর জিজ্ঞেস করবি না, সেদিন সব মানের উত্তর পেয়ে যাবি।”
তার ঠোঁটে হাসি, অথচ চোখে ব্যথা। যেন প্রতিটা শব্দের আড়ালে লুকিয়ে আছে অজস্র অপ্রকাশিত অনুভূতি।
মারিয়া তখনো দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু করে দুই হাতের আঙুল নিয়ে খেলছে। গলাটা শুকিয়ে গেছে, তবু কষ্ট করে বলল,
__” এখনো বুঝলাম না তুমি কি বললে রায়ান ভাই।”
ঘরটা তখন ভারী হয়ে আছে নিঃশব্দে, একদিকে বিদায়ের কষ্ট, অন্যদিকে না বলা অনুভূতির বোঝা। দুজনেই হাসতেও পারছে না, কাঁদতেও পারছে না শুধু একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকছে।
রায়ান এক কষ্টভরা হাসি দিয়ে হঠাৎই বলে উঠলো,
__” শাকচুন্নি, তোর কাছে একটা জিনিষ চাইবো… দিবি?”
মারিয়া চমকে উঠলো। এত অদ্ভুতভাবে কখনো শোনেনি এই ডাক। ঠোঁটে চাপা কাঁপুনি নিয়েই সে জবাব দিলো,
__” কি বলো? যদি আমার কাছে থাকে, নিশ্চই দেবো।”
রায়ানের গলায় কেমন যেন অদ্ভুত ভারী টান, চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু আড়াল করেও যেন আর আড়াল করা যাচ্ছিল না। সে ধীরে ধীরে বলল
__” তোর পায়ের নূপুর… শুধু একটা দিবি আমায়?”
কথাটা শুনে মারিয়ার বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো। মনে মনে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো এই ছেলে নূপুর দিয়ে কি করবে? তাও আবার একটা? তার হাত-পা যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল, অজানা এক শিহরণ ছড়িয়ে পড়লো শরীর জুড়ে। কীসব হচ্ছে ওর সঙ্গে, নিজেই বুঝতে পারছে না। তবুও কৌতূহলে, কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
__” নূপুর দিয়ে কি করবে রায়ান ভাই… তাও আবার একটা?”
রায়ান কোনো জবাব দিল না। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মারিয়াকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল। টেবিলে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে মারিয়ার সামনে এনে বলল,
__” পানি খা ।”
মারিয়া কোনো কথা বলল না। নীরবতায় ভরা বুক নিয়ে রায়ানের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ছোট ছোট চুমুকে পানি খেয়ে নিল। তারপর গ্লাসটা ফেরত দিতে গেলো রায়ানের হাতে। হঠাৎই রায়ান সেই গ্লাসে বেঁচে থাকা একটু পানি তুলে নিয়ে মারিয়ার যে দিক দিয়ে খাওয়া, সেই দিক দিয়েই পানিটা শেষ করে ফেললো, রায়ান এর বুকের গভীরে চলছে এক বিশাল ঝর আর চোখের দৃষ্টি ছিল মারিয়ার দিকে , গলার অ্যাডাম আপলস পানির ঢোকের সঙ্গে কেঁপে উঠছে, আর এই সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে এই অধিকার শুধু তার।
মুহূর্তেই মারিয়ার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। বুকের ভেতর হঠাৎই ধকধক শব্দ শুনতে পেলো। গলা শুকিয়ে এলো। ঠোঁট কাঁপতে লাগল। তবুও কিছু বলতে পারলো না।
রায়ান এবার গ্লাসটা রেখে মারিয়ার সামনে এসে হঠাৎই হাঁটু গেড়ে বসলো। মাথা নিচু করে ধরা কাঁপা হাতে মারিয়ার এক পা আলতো করে ধরলো। মুহূর্তেই কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। মারিয়া আঁতকে উঠে আমতা আমতা করে কাঁপা ঠোঁটে বলল,
__” এ কি করছো রায়ান ভাই? মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি?”
কিন্তু রায়ান কোনো উত্তর দিলো না। তার চোখে তখন হাজারো আবেগ, বুকের ভেতর ঝড়, কিন্তু ঠোঁটে শব্দ নেই। ধীরে ধীরে মাথা নিচু করেই মারিয়ার পা থেকে নূপুর খুলতে শুরু করলো। কণ্ঠস্বর কাঁপতে কাঁপতে বলল,
__” আমি চলে যাচ্ছি শাকচুন্নি… আর তোকে জ্বালাবো না। তবে ভাবিস না, তোর খবর পাবো না। তাই সাবধানে থাকবি।”
কথাগুলো শুনে মনে হলো, কেউ যেন মারিয়ার বুকটা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি শব্দ যেন তলোয়ারের মতো বিদ্ধ করলো হৃদয়ে। গলার ভেতর দলা পাকিয়ে থাকা কান্না থামানোই কঠিন হয়ে গেল।
রায়ান এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা থেকে নূপুরটা খুলে নিয়ে হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরলো। তারপর গলাটা ভারী করে আবারো বলল,
__” এই নূপুর আমি আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। অপেক্ষায় থাকবি এই পায়ে আমি আবার একদিন এই নূপুর নিজ হাতে পরিয়ে দেবো। এই পায়ে যেন অন্য কারো নামের নূপুর না ওঠে, যদি ওঠে তাহলে এই রায়ানকে আর কখনো খুঁজে পাবি না।”
তার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলো, গলায় কান্নার সুর মিশে গেল। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট যেন ফেটে পড়ছে।
এদিকে মারিয়া স্থির হয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর থেকে যেন সবকিছু ভেঙে পড়ছে। সে বুঝতে পারছে না কেন তার এত কষ্ট হচ্ছে, কেন তার শ্বাস নিতে এত ভারী লাগছে। চোখ ভিজে আসছে, অথচ সে কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না।
রায়ান তখন ধীরে ধীরে মাথা তুলে মারিয়ার দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে ভেসে উঠলো সব অনুভূতি দুঃখ, ভালোবাসা, অভিমান, আর বিদায়ের গভীর যন্ত্রণা আর লালচে চোঁখে পানির অশ্রুবিন্দু। আর তাতেই শিউরে উঠলো মারিয়ার শরীর। বুকটা হঠাৎ ধপ করে কেঁপে উঠলো। চাইতেও পারলো না চোখের জল থামাতে। টলটল করতে করতে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।
কিন্তু রায়ান আর এক সেকেন্ডও দেরি করলো না। নীরব মুখে নূপুরটা পকেটে রেখে লাগেজ হাতে তুলে নিলো। পিঠটা সোজা করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। পায়ের শব্দ ভারী হয়ে উঠলো ঘরের মেঝেতে।
মারিয়া ভিজে চোখে চেয়ে রইলো। বুকটা চেপে আসছে। ঠোঁট কাঁপছে, অবশেষে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, গলা ভেঙে চিৎকার করে উঠলো,
__” রায়ান ভাই….”
তার কণ্ঠে বুকভাঙা কান্না, অঝোর অশ্রু আর অদ্ভুত এক অসহায় ডাক। কিন্তু রায়ান আর একবারও তাকালো না। সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেলো। প্রতিটি পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে যেন বাড়িটার বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, আর মারিয়ার বুক থেকে নিঃশব্দে ভেঙে যাচ্ছিলো সমস্ত সাহস।
চৌধুরী ভিলার ড্রয়িং রুমে এখন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। হাসিখুশি সেই সংসারে যেন অঝোর বৃষ্টি নেমেছে। বাড়ির প্রতিটি কোণে কান্নার সুর, বুক ফেটে যাওয়া দীর্ঘশ্বাস, আর বিদায়ের ব্যথা ছড়িয়ে আছে।
সুরাইয়া বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। যেন বুকের ভেতর থেকে প্রাণটাই ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। তাঁর কান্নার সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে উঠলেন মেহজাবীন বেগম, রুহেনা বেগম, আয়েশা বেগমও। চোখের কোণ ভিজে উঠলো সব মা চাচিদের। এই দৃশ্য যেন কারো চোখের আড়ালে থাকলো না। মনে পড়ে গেলো, আজ থেকে ঠিক তেরো বছর আগে এমনই এক ভোরবেলায় এই বাড়ি কেঁদেছিল। তখন বড় ছেলে জায়ান দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছিল। আজ সেই একই দৃশ্য ছোট ছেলের জন্য পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
এবার অন্যদিকে বোনদের মন খারাপের সীমা নেই। অনন্যা, যে প্রতিদিন খুঁটিনাটি নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে, হাসি-ঠাট্টায় ভরিয়ে রাখে, সে আজ বুক ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েছে। বৃষ্টি আর তিয়াশার চোখও অশ্রুভেজা। তাদের প্রাণের ছোট ভাই চলে যাচ্ছে এতদূরে, পাঁচটা বছরের জন্য।
রায়ান মায়াভরা দৃষ্টিতে এগিয়ে গিয়ে অনন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
__” আমার এই ছোট্ট বোনের চোখে যেন কোন কারনে পানি না দেখি। যে পানি ঝরাবে তাকে আগে আমার সামনে আসতে হবে। বুঝলি ,,?”
কিন্তু অনন্যা কোনো জবাব দিতে পারলো না। কাঁপতে থাকা ঠোঁট দিয়ে শুধু কান্নার শব্দ বের হচ্ছিলো।
তারপর রায়ান এগিয়ে গেলো তিয়াশার সামনে। চোখে জল, বুক কাঁপছে তবুও সে মাথা উঁচু করে জায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
__” বড় ভাই একবার পারমিশন দেবে আমার আপু কে একটু জড়িয়ে ধরার।,”
কথার ভেতর কেমন অদ্ভুত কষ্ট লুকানো ছিল। চোখ ভেজা, গলায় কম্পন, তবুও বড় ভাইয়ের বউকে ছোঁয়ার আগে পারমিশন চাইছে। জায়ান এর ও এই মুহূর্ত খুব পরিচিত তাই আজ আর মানা করল না মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।
সঙ্গে সঙ্গে রায়ান তিয়াশাকে বুকের ভেতর চেপে ধরলো। তিয়াশা আর ধরে রাখতে পারলো না, হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ভেজা কণ্ঠে বলে উঠলো,
__” খুব দরকার ছিল কি ভাই আমাদের ছেড়ে যাওয়ার? আমাদের তো খুব কষ্ট হচ্ছে।”
কথাগুলো শুনে সবার বুক ভারী হয়ে উঠলো। এ যেন ভাইবোনের সম্পর্কের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী মুহূর্ত।
রায়ান আলতো করে তিয়াশাকে ছেড়ে দিলো। তার চোখ তখন সবার মাঝে কাউকে খুঁজছে। অস্থির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকালো, কিন্তু সে মুখ যার খোঁজে আজ বুকটা হাহাকার করছে তার কোনো চিহ্ন ড্রইং রুমে নেই। হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিয়াশার হাত ধরে ধীর গলায় বলল,
__” তাকে পাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে আপু। তোমাদের সবার ভরসায় রেখে যাচ্ছি । আর আমার জিনিস যেন আমারই থাকে আপু। আর তুমি একদম কাঁদবে না। আমাদের লিটল ওয়ার্ল্ড কষ্ট পাবে তো।”
তিয়াশা চোখের জল মুছে হাত বুলিয়ে দিলো রায়ানের মাথায়। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
__” কোন চিন্তা করবি না, আমি আর তোর বড় ভাইয়া তোর আমানত কে সেহি সালামত রাখবো।”
এই কথায় রায়ান সামান্য মুচকি হাসলো। চোখে জল থাকলেও ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো। তারপর বৃষ্টির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়ালো। এক এক করে বড় আব্বু, মেজ আব্বু আর নিজের আব্বুকে জড়িয়ে সালাম নিলো। সেই আলিঙ্গনে ছিল বিদায়ের ভার, বুক ফেটে যাওয়া ভালোবাসা, আর এক অদ্ভুত শক্তি।
অবশেষে বেরিয়ে পড়লো এক অজানা পথে। রায়ানের সঙ্গে রওনা দিলেন তাহসান সাহেবও
ওখানে ছেলে সবকিছু সেটেল করে নেবে, তারপর তিনি ফিরবেন। রায়ান যাবে বড় ভাই জায়ানের ক্যালিফোর্নিয়ার সেই বাসায়।
এয়ারপোর্ট পর্যন্ত তাকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে জায়ান, ইউভি আর আকাশ।
বেরোনোর সময় জায়ান হঠাৎ থেমে গেলো। তিয়াশার পেটে হাত রেখে কপালে চুমু খেলো। নরম গলায় বললো,
__” আর কাদবি না, তোর কাদার জন্য আমার ব্ল্যাডলাইন যেন কষ্ট না পায় বলে দিলাম। এখন গিয়ে আরাম করো যাও।”
তিয়াশা চোখ ভিজে হাসলো। আলতো করে নিজের বেবি বাম্পে হাত বুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
__” এখন সব ভালোবাসা শুধু ব্লাডলাইনের জন্য বুঝি।”
জায়ান সঙ্গে সঙ্গে মুচকি হেসে বললো,
__” পাগলী তুই আমার। তুই আমার জান সোনা। নেক্সট টাইম এগুলো বলবিনা।”
কান্নাভেজা পরিবেশেও দুজনের এই খুনশুটি যেন মুহূর্তের জন্য সবার বুকের কষ্ট হালকা করে দিলো।
গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে রায়ান শেষবারের মতো চোখে খুঁজলো তার শাকচুন্নিকে। বুকের ভেতর হাহাকার উঠলো, কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলো না। চোখের আড়ালে থেকেও সেই মেয়েটি যেন রায়ানের বুকের প্রতিটি ধাপে ধুকপুক করে বাজছিলো।
ঠিক তখন জায়ান রায়ানের কাঁধে হাত রেখে পিঠ চাপড়ে দিলো। কণ্ঠে দৃঢ়তা মিশিয়ে বললো,
__” পেছনে তাকালে আর যেতে পারবি না। পুরোপুরি পেতে গেলে ক্ষণিকের জন্য নিজেকে সামলে নে।”
কথাগুলো রায়ানের কানে ঢুকতেই বুকটা কেঁপে উঠলো। চোখ ভিজে এলেও আর পিছনে তাকালো না। এক নিশ্বাসে গাড়িতে উঠে গেলো।
গাড়ি চলে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে। আর উপরের ঘরে দাঁড়িয়ে ছিল মারিয়া। সেই বিছানার পাশে, যেখান থেকে কিছুক্ষণ আগেই তার পায়ের নূপুর খুলে নেওয়া হয়েছিল। বুক ভরা কষ্টে, চোখ ভেজা অশ্রুতে এখনো দাঁড়িয়ে আছে সে। তার ঠোঁট কাঁপছে, চোখ বেয়ে নিরবেই গড়িয়ে পড়ছে কান্না। আর বাজছে একটাই
কথা,
__” অপেক্ষা ……”
পেরিয়ে গেল এক একটা দিন, এক একটা মাস। এই করেই কেটে গেল আরও ছয়টা মাস।
রায়ানের অনুপস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে সবার কাছে। যদিও সে প্রতিদিন নিয়ম করে দুই থেকে তিনবার কল দেয়, সবার খবর নেয়, তিয়াশার খোঁজখবর নিতে ভোলে না।
অন্যদিকে, পুরো বাসার মানুষের কাছে এখন সবচেয়ে বড় ভয়ের নাম—তিয়াশার মুড-সুইং।
এক মুহূর্তে সে খুশি, হাসছে, পরের মুহূর্তেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠছে, আবার কখনো ঝগড়া করে, চেঁচায়, আরেক সময় একেবারে আদুরে হয়ে যায়।
সবাই অবাক, বিরক্ত, ক্লান্ত কেবল জায়ন ছাড়া।
জায়নই একমাত্র ধৈর্য ধরে, ভালোবেসে, সামলে নিচ্ছে তার প্রতিটি খামখেয়ালিপনা।
এখন পুরোপুরি নয় মাসের বেবি বাম্প নিয়ে তিয়াশা।
গোলগাল চেহারায়, একটু ফুলে যাওয়া মুখে, দুষ্টু চোখের কোণে কেমন যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ। আগের থেকেও অনেক বেশি সুন্দর, অনেক বেশি মায়াময় লাগছে তাকে।
কখনো মাঝরাতে তার মন চাইছে KFC-এর চিকেন খেতে,
কখনো সকালে ঘুম ভেঙে গিয়ে প্রচুর ভাত খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে।
আবার কখনো হুট করেই কান্না জুড়ে দিচ্ছে, কেউ কিছু না বললেও।
আর কখনো আবার জায়নের উপর রেগে ঝড় তুলছে গালাগাল করছে, অভিমান করছে।
এভাবেই পুরো বাড়ি মাথায় নিয়ে চলছে তার দিনরাত।
সবাই মজা পায়, আবার বিরক্ত হয়, কিন্তু জায়নই একমাত্র যে প্রতিটি মুহূর্তে তাকে হাসিমুখে সামলাচ্ছে।
সেই রাতেও ঠিক এমনই এক কাণ্ড হলো।
রাত তখন তিনটে পনেরো।
পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ, কেবল রাতের হালকা হাওয়ার শব্দ।
জায়ন গভীর ঘুমে, শরীর এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়।
হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো তিয়াশার ডাক,
__”বর আমি খানদানি খানাপিনার সি ফুড খাবো।”
ঘুমন্ত চোখ খুলে তাকাতেই জায়ন দেখল তিয়াশা ঠিক বাচ্চাদের মতো বিছানায় বসে আছে।
বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, মুখটা ফুলে আছে, আবার একরকম আদুরেও লাগছে।
নয় মাসের ভারী পেট নিয়ে কেমন যেন গুটিসুটি মেরে বসে আছে সে।
জায়ন চোখ মুছে, আধঘুমে হেসে বলল,
__”এই সময় বাইরের খাবার খাওয়া মানা তোমার সোনা। কালকে সকালে আমি ফ্রেশ সি ফিস নিয়ে এসে নিজে হাতে তোমায় সি ফুড বানিয়ে দেব। এবার আসো শুয়ে পরো জান।”
এই বলে জায়ন তাকে কাছে টেনে নিতে গেল।
কিন্তু কথাটা কানে যেতেই তিয়াশার মুখ উল্টে গেল।
সে এক ঝটকায় জায়নের হাত সরিয়ে দিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠল,
__”আমি ওই খানদানি খানাপিনার সি ফুড ই খাবো আর এখন ই খাবো।”
বেচারা জায়ন তখন পুরো বিপদে।
রাত তিনটা পেরিয়ে গেছে, বাইরে কোনো রেস্টুরেন্ট খোলা নেই,
আর এই সময় সি-ফুডের মতো খাবার পাওয়াও অসম্ভব।
ঘুম একেবারে উড়ে গেল জায়নের।
সে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তিয়াশার গালে হাত রেখে কোমল স্বরে বলল,
__”সোনা আমার জান আমার ,এই রাতে তো কোন খানদানি খানাপিনা খোলা নেই? দেখো সোনা, রাত তিনটা বাজে, জেদ করে না, চলো ঘুমাই।”
কিন্তু তিয়াশার মুখে তখন অভিমান জমে গেছে।
চোখ লাল হয়ে উঠছে, ঠোঁট ফুলে আছে, কান্নার স্বরও বাড়ছে।
তিয়াশা জায়নের দিকে ভেজা চোখে, একেবারে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে বলল,
__” ওহ এখন রাত তিনটে, তাহলে বর আমায় একটু আচার খাওয়াবে ?”
বেচারা জায়ন হেসে ফেলল। ক্লান্ত চোখে মমতার ঝিলিক, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি, সে আস্তে বলল,
__” হ্যা জান আমি এখনি নিয়ে আসছি রান্না ঘর থেকে।”
এই বলে সে উঠে পড়তে যাবে, হঠাৎ তিয়াশা একেবারে বাচ্চার মতো চিৎকার করে উঠল,
__” ইবলিশ আমাকে বানিয়ে খাওয়াবে তুমি।”
জায়ন থমকে গেল। মাথা ঘুরে গেলো তার। মনে মনে কেবলই বিড়বিড় করতে লাগল,
__” হায় আল্লাহ! আমার বউকে এখন আচার কি করে বানিয়ে খাওয়াবো? আমি তো এই জন্মে আচার বানাই নাই।”
কপালে হাত দিয়ে, ঠোঁট কামড়ে একদম হাল ছেড়ে দেওয়া স্বরে আমতা আমতা করে বলে উঠল,
__” জান সোনা, তোমায় এই রাতে কি করে আচার বানাবো?”
তিয়াশার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। ঠোঁট কেঁপে উঠছে। অভিমান জমে রাগে গলে গেলো আর সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল,
__” আমার বর আমায় আর ভালোবাসে না, আমার বর ভালো না।”
এই কথায় জায়নের বুকটা কেঁপে উঠল। সে এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুটে গেল তিয়াশার কাছে। দুই হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে দ্রুত বলল,
__” সোনা, এরকম বলে না জান। আমি তো তোমায় ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসি না সোনা। কান্না করে না।”
তবুও তিয়াশা থামল না। কাঁপা কাঁপা গলায় পেট ধরে ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে বলে উঠল,
__” আমি কি এমনি এমনি কান্না করছি? আমার পেটে ব্যথা করছে।”
আর মুহূর্তের মধ্যেই এক তীব্র চিৎকার
তিয়াশার কপালে ঘাম, ঠোঁট কাঁপছে, চোখ বন্ধ করে ছটফট করছে।
জায়নের বুকটা ধক করে উঠল। তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মাথা ঘুরে গেল ভয়ে।মনে মনে আবার এক আলাদা ঝড় বইছে
__”এতদিন ধরে, এতগুলো মাস দিন ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম… তাহলে কি সে আমাদের কাছে আসছে?”
কিন্তু তিয়াশার হাহাকার ভেসে এলো,
__” এই ফকিনজির বাচ্চা কি ভাবিস? আমার ব্যথা করছে।”
এই অদ্ভুত কথাটা শুনেই জায়ন নিজের স্বপ্ন ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো। অস্থির গলায় তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল,
__” এই যে সোনা, এই যে… আমি এক্ষুনি তোমায় ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাচ্ছি।”
তারপর জায়ন তিয়াশার পেটে হাত রেখে বলে উঠলো,
__” ডার্লিং মাম্মা কে বেশি কষ্ট দিয়ো না , মাম্মা অনেক কষ্ট পাবে ।”
তারপর এক মুহূর্ত দেরি না করে জায়ন তিয়াশাকে নিজের বুকের ভেতর তুলে নিল।
তার শরীর কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে আসছে, তবুও শক্ত হাতে বুকে চেপে ধরে আছে তিয়াশাকে।
ভালোবাসা আর আতঙ্ক মিশে গেছে তার চোখে।
কাঁপা গলায় সে চিৎকার শুরু করল,
__” ইউভি! ইউভি….
__” মা! মেজো মা….”
জায়নের সেই চিৎকারে পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল।
ঘুম ভাঙা চোখে সবাই দৌড়ে বেরিয়ে এলো।
মুখে আতঙ্ক, চোখে ভয়, কপালে ভাঁজ কেউ কিছু বুঝতে পারছে না।
এদিকে তিয়াশা ক্রমেই চিৎকার করে যাচ্ছে, ব্যথায় হাউমাউ করছে,
__” ওহ মা গো… এই ফকিন্নির বাচ্চা… ও মা গো…”
এক মুহূর্তের জন্য যেন সবাই থমকে গেল।
জায়ন তবুও ঠোঁটের কোণে জোর করে একটুখানি হাসি ফুটিয়ে তুলল, তিয়াশার মুখের দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
__” এই যে জান, এই যে বাচ্চা…”
তারপর সবার দিকে ঘুরে কণ্ঠ ভারী করে বলল,
__” ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ইউভি, কুইক, গাড়ি বের কর।”
ইউভি তখনও ঘুমঘুম চোখ ডলছে, তবুও দৌড়ে গেল গ্যারেজের দিকে।
গাড়ির শব্দ উঠল বাইরে।
জায়ন তিয়াশাকে বুকে আঁকড়ে ধরে বেরোতে লাগল, তার প্রতিটি পদক্ষেপে বুকের ভেতর দোলা দিচ্ছে ভয় আর প্রত্যাশা।
পেছন পেছন ছুটে এলো বাড়ির বড়রা, গিন্নিরা।
কেউ কেঁদে ফেলল, কেউ সান্ত্বনা দিতে চাইল, কেউ শুধু নিঃশ্বাস আটকে দৌড়াচ্ছে।
পুরো বাড়ি তখন এক অদ্ভুত অস্থিরতায় ভরা
কান্না, আতঙ্ক, তাড়াহুড়ো, আর একই সাথে অজানা আনন্দের গোপন আশায় বুক ধকধক করছে সবার।
হাসপাতালের করিডোরে স্ট্রেচারে করে তিয়াশাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিয়াশার চিৎকার ভেসে যাচ্ছে চারপাশে শ্বাস আটকে, ব্যথায়, ভয়ের সঙ্গে, যেন পুরো হালকা দম বন্ধ হয়ে গেছে। সঙ্গে রয়েছে মহিলা ডাক্তার এবং দুজন নার্স, যারা পেশাদার ভঙ্গিতে কাজ করছে, কিন্তু চোখে তাদেরও উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে।
জায়ন তিয়াশার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে, প্রতিটি মুহূর্তে হাতের আঙ্গুলে আঙুল মিলিয়ে রাখছে যেন তার স্পর্শে তিয়াশা সাহস পায়। রুহেনা বেগম তিয়াশার মাথায় হালকা হাত বোলাতে বোলাতে কণ্ঠ কাঁপিয়ে বলছে,
__”কিছু হবে না মা, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
জায়নের কণ্ঠও কেঁপে উঠছে, চোখে চিন্তার রেখা, কিন্তু বলছে,
__”সরি জান, সরি অনেক কষ্ট হচ্ছে আমি জানি।”
তিয়াশার শরীর ঘামে ভেজা, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, হাঁপাচ্ছে, তবুও নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠছে,
__”বর, তোমার ব্লাডলাইন আসলে আমার ভালোবাসা কমে যাবে না তো?”
জায়ন তিয়াশার হাত অজস্র চুমু খেতে খেতে কণ্ঠে উষ্ণতা ও প্রশান্তি ভরে বলল,
__”জান, তুই আমার আত্মার আসক্তি জান, আমার কলিজা এসব বলে না, জাস্ট ব্রেড নিতে থাকো সোনা।”
এই কয়েক মুহূর্তে তাদের ভালোবাসা, ভয়, উদ্বেগ, প্রেম একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে পুরো করিডোরে ফুটে উঠেছে। মুহূর্তের পর মুহূর্তে জায়ন তিয়াশার পাশে থেকে সাহস দিচ্ছে, শান্তি দিচ্ছে, কিন্তু নিজের ভিতরের আতঙ্ক চাপিয়ে রাখছে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তিয়াশাকে নিয়ে যাওয়া হলো লেবার রুমে। করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে ইউভি, অনন্যা, মেহজাবীন বেগম, রূহেনা বেগম, রুহেনা বেগম প্রান্তিক সাহেবও আছে, যদিও তাকে সাধারণত প্রবেশে মানা করা হয়েছে, কিন্তু নাতি-নাতনির জন্য কেউ তাকে আটকাতে পারল না। প্রণয় সাহেব, তাহসান সাহেব পুরো চৌধুরী পরিবার একত্রিত।
সবার চোখ-মুখে চিন্তার রেখা, কিন্তু বুকের ভেতরে এক ছোট্ট, আনন্দের ঝড় বইছে। প্রত্যেকের হৃদয়ে এক অদৃশ্য উত্তেজনা ভয় ও আশা, দায়িত্ব এবং ভালোবাসা সব মিলেমিশে এক গভীর আবেগ তৈরি করছে।
এদিকে জায়ন ছুটে গেল নামাজের রুমে। বিছানা বিছিয়ে বসে বারবার দোয়া পড়ছে, কণ্ঠ ভেসে যাচ্ছে ভয়ে, ভালোবাসায়, অস্থিরতায়। চোখের পানি গলে গলে পড়ছে, হৃদয় জুড়ে দগদগে প্রেম।
জায়নের কণ্ঠে উচ্চারিত দোয়া:
__”হে আল্লাহ, আপনি তো আরহামুর রাহিমীন।
আমার প্রাণের টুকরো এই বউকে আপনি নিরাপদ রাখুন।
তার প্রতিটি ব্যথা আপনি সহজ করে দিন, পারলে আমাকে দিন, প্রতিটি অশ্রু আপনি শান্তিতে রূপান্তর করুন।
হে আল্লাহ, তার গর্ভে যে আমার অমূল্য আমানত আপনি দিয়েছেন, সেই সন্তানকে সুস্থ, নেক ও আলোয় ভরা জীবন দিন।
আমার জানের টুকরো আমার সন্তান হোক আমাদের দাম্পত্যের পূর্ণতা, হোক এই সংসারের রহমত।
আল্লাহ, আমি অক্ষম, আমি দুর্বল। আমি শুধু আপনার দোয়া চাই।
আমার জানের টুকরোদের রক্ষা করুন, আমার সন্তানকে রক্ষা করুন। আমাদের ঘরকে করুন শান্তির নীড়, করুন ইবাদতের ঠিকানা। হে আল্লাহ, আমার এই দোয়া যেন অশ্রুর স্রোতে পৌঁছে যায় আপনার দরবারে।”
লেবার রুম থেকে তিয়াশার চিৎকার ভেসে আসছে,
__”ওহ আল্লাহ, আর পারছি না।”
করিডোরে দাঁড়ানো সবাই ছটপট করছে। চোখে পানি, মুখে উদ্বেগ, বুক দগদগ করছে, কিন্তু হৃদয়েও এক অদৃশ্য আনন্দের ঢেউ। প্রত্যেকের চোখে ভয়, প্রত্যাশা, প্রেম ও দায়িত্ব সব একসাথে মিলেমিশে পুরো করিডোরকে আবেগময় করে তুলেছে।
জায়ন একের পর এক দোয়া পড়ছে, চোখের পানি ফেলছে, প্রতিটি দোয়ায় ভরে যাচ্ছে ভালোবাসা, ভয়, শক্তি এবং প্রতিশ্রুতি যেন তার সমস্ত হৃদয় তিয়াশা ও তাদের সন্তানের নিরাপত্তায় উৎসর্গ হয়ে গেছে।
প্রত্যেকের হৃদয়ে এক গভীর অনুভূতি ভয় ও প্রেম, আশা ও অস্থিরতা, সব মিলেমিশে এক অবর্ণনীয় আবেগের ঢেউ, যা এই মুহূর্তের নীরবতা এবং চিৎকারের মধ্যেই ফুটে উঠছে।
ভোরের নরম আলো হাসপাতালের করিডোরে ছুঁইছুঁই হাওয়া বইছে। কিন্তু জায়নের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উত্তেজনা, চিন্তা আর আশঙ্কার সমুদ্র ভেঙে যাচ্ছে। তিয়াশার প্রতিটা চিৎকার যেন তার হৃদয়ের প্রতিটি কোণে আঘাত করছে। সে আর সহ্য করতে পারছে না প্রতি মুহূর্তে তিয়াশার কষ্ট, ব্যথা এবং আতঙ্ক তার মনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
হঠাৎ তিয়াশার এক ভয়ানক চিৎকার ভেসে আসতেই জায়ন ছটপট করতে লাগল, কণ্ঠে ভীষণ অনুনয় ও আতঙ্ক,
___”কি হয়েছে আমার জানের, আমায় ভেতরে যেতে দিন প্লীজ, প্লীজ?”
করিডোরে জায়নের চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পরিবার তাকে সামলাতে পারছে না। তাহসান সাহেব বলেই উঠলেন, কণ্ঠে সতর্কতার ছাপ,
__”জায়ন, এরকম পাগলামি করিস না।”
মেহজাবীন বেগম শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন, মুখে আলতো হাসি আর অভিজ্ঞতার উষ্ণতা,
“আমার কলিজা, এরকম করেন সোনা, সব মায়েদের এই কষ্ট সহ্য করতে হয়। আমরাও করেছি।”
কিন্তু জায়ন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না, কণ্ঠে আবেগের ঢেউ ভেসে উঠল,
__”মা, ও কষ্ট পাচ্ছে খুব, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”
হঠাৎ তিয়াশা আবারো এক জোরে চিৎকার করল। তারপর ভেসে এল নতুন এক চিৎকার যে চিৎকার জায়নের হৃদয়ের অংশ, তার পৃথিবীর নতুন সুর। করিডোরে উপস্থিত প্রত্যেকের চোখে জল, মুখে হাসি। বুকের ভেতর আনন্দের এক ঝড় বয়ে গেল।
জায়ন ছুটে গেল মায়ের কাছে, চোখে পানি, কণ্ঠে আবেগের স্রোত,
__”মা, তুমি শুনতে পেলে? আমার জানের টুকরো চিৎকার করল। কিন্তু আমার জান পাচ্ছি না কেন মা?”
মেহজাবীন বেগম চোখের পানি মুছে মুছে প্রাণ খোলা হাসি দিয়ে বললেন,
__”হ্যাঁ বাবা, শুনতে পেয়েছি আমার কলিজার আওয়াজ। আমার আম্মু ঠিক আছে, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো সোনা।”
করিডোরে সবাই এক অদ্ভুত আনন্দের স্রোতে ভেসে গেল। কেউ বলছিল, “আমার কলিজা এত কষ্টের মধ্যে এক নতুন জীবন দিচ্ছে!”
আর কেউ মুচকি হেসে বলছিল, “দেখছি, খুশির জোয়ার বয়ে গেছে।”
চোখ ভেজা, মুখে হাসি, বুকের ভেতরে উচ্ছ্বাস সবার আবেগ একসাথে মিলিত হয়ে পুরো করিডোরকে আনন্দে ভাসিয়ে দিল। কেউ হাওয়ায় হাত নাড়ছিল, কেউ চুপচাপ কণ্ঠে দোয়া করছিল।
এই মুহূর্তে সবকিছু ভয়, ব্যথা, উত্তেজনা, হাসি, কান্না, দোয়া মিলে এক অপূর্ব আবেগময় দৃশ্য তৈরি করেছিল। প্রত্যেক হৃদয় একসাথে ধুকধুক করছে, প্রত্যেক চোখে জল আর আনন্দের মিলন।
জায়নের মন কিছুতেই শান্ত হলো না , দরজায় এক ধাক্কা দিয়ে সে ভেতরে ঢুকল। চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার নজর গেল এক ফুটফুটে, অপূর্ব সুন্দর শিশুর দিকে, যাকে নার্স কোলে ধরে রেখেছেন। জায়নের বুক কেঁপে উঠল, চোঁখ জ্বলজ্বল করছে। অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল,
__”জানমাম্মা!”
কিন্তু পর মুহূর্তের জন্যই নজর ঘুরল তিয়াশার দিকে। ডাক্তার এবং নার্স দুজনেই চমকে বলে উঠলেন,
__”আরে স্যার, কি করছেন বাইরে জান?”
জায়ন ছুটে গেল তিয়াশার কাছে, মাথায় হাত বুলিয়ে কাপা কন্ঠে বলল,
__”আমার ওয়াইফের আওয়াজ পাচ্ছি না, ও ঠিক আছে তো, বলেন ও ঠিক আছে?”
মহিলা ডাক্তার জায়নের পাগলামো দেখে এক মুচকি হাসি দিলেন এবং বললেন,
__”মিস্টার আবরার, মিসেস জায়ন ইস ওকে। সি ইস জাস্ট টু মাচ টায়ার্ড। কংগ্রাচুলেশন, আপনার মেয়ে হয়েছে, রাজকন্যা এসেছে আপনার রাজপ্রাসাদে। এন্ড বিলিভ মী, সি ইস সো মাচ বিউটিফুল।”
এই মুহূর্তে জায়ন হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো তারপর তিয়াশার কপালে চুমু খেয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
__”থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ জান, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ লাভ। তুমি শুনলে আমাদের জানমান্মা এসেছে।”
তিয়াশার চোখ হালকা খোলা, মুখে এক প্রাণ খোলা হাসি। এত কষ্টের মাঝেও সে যেন এক মা হওয়ার আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে। শরীর ক্লান্ত, নিঃশ্বাস কষ্টকর, তবুও চোখে রঙিন আনন্দ, মুখে মৃদু হাসি মায়ার গন্ধ মিশ্রিত সুখ।
নার্সটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, জায়নের দিকে নবজাত শিশুটিকে তুলে দিতে। সেই মুহূর্তে জায়ন যেন খুশির উচ্ছ্বাসে পাগলের মত করতে লাগল । জায়ন তার মেয়ে কে হতে পেতেই কেমন তার হাত কাপতে লাগলো,কিন্তু বুকে কেঁপে উঠল এক প্রশান্তির ঢেউ, জায়ন হাউ হাউ করে কান্না করতে লাগল।
জায়নের কোলে এখন এক ফর্সা, গোলাপি গাল আর ডাগর ডাগর চোখের অপূর্ব সুন্দর শিশু। তার ছোট্ট হাত আর পায়ের নখের নরম নরম দাগগুলো যেন কোনো শিল্পীর অঙ্কন। সে আলতো করে জাপটে ধরছে, চোখ ভেজা কান্না করে, আর ছোট্ট কণ্ঠে বলছে,
__”মা, আমার মাম্মা তুমি,আমার কলিজার টুকরো তুমি , আমার বাচ্চা তুমি আমার বাচ্চা আমার জানমাম্মা। ওহ আল্লাহ, আমায় কি দান করলেন? আমি আমার পরি কে, আমার এঞ্জেল কে, আমার বুকে আগলে রাখবো।”
জায়ন মুহূর্তেই তিয়াশার দিকে এগিয়ে গেল, চোখ জলে ভিজে, হৃদয় উচ্ছ্বাসে মাতাল হয়ে, গলা কাপা করে বলল,
__”জান রে, তুই আমায় কি গিফ্ট করলি জান? আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে, জায়ন তিয়াশার কাছ থেকে ফিরে এল, তারপর চিৎকার করে বাইরে পরিবারের দিকে বলল,
__”মা, বাবা, দেখো আমার পরি কে, আমার মাম্মা কে , দেখো আমার জান আমাকে পরি গিফ্ট করেছে !”
পরিবারের সবাই ছুটে এলো। করিডোরে এক আনন্দের ঝড় বইতে লাগল। হাসি, উচ্ছ্বাস, অশ্রু সব মিলেমিশে এক হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া দৃশ্য।
রুহেনা বেগম ও মেহজাবীন বেগম তার নাতনিকে কোলে নিতে এগিয়ে গেলেন, কিন্তু জায়ন তৎক্ষণাৎ পেছনে সরে বলল,
__”না মা, এখন না, আমার কোলে আরেকটু থাক না মা।”
__” দে না বাবা আমাদের একটু , আমার কলিজা কে একটু ধরি দে ।”
মেহজাবীন বেগম এর কোন জোরাজুরি তে কাজ হলো না নাছর বান্দা জায়ন কিছুতেই তার মেয়ে কে দিবেনা । জায়নের পাগলামো দেখে ইউভি একটু বিরক্তি মেশানো কণ্ঠে বলল,
__”ভাইয়া, আমাদের কলিজাকে একটু ধরতে দেও।”
কিন্তু জায়ন কিছুতেই দিচ্ছে না। সে শুধু নিজের বুকের আনন্দে মাতাল, চোখে আবেগের জল আর মুখে অগাধ প্রেম তার মেয়ের জন্য ।
প্রান্তিক সাহেব, চোখে আনন্দের ঝলক, মুখে হাসি দিয়ে বললেন,
__”গর্ধব, আগে বউ নিয়ে পাগল ছিল, এখন আমার কলিজাকে নিয়ে পাগলামি করছে।”
এরমধ্যেই জায়ন ইউভির উদ্দেশ্যে বলল ,
__” আমার জানমান্মার ছোট চাচু কে কল দিয়ে দেখা ওর লিটল ওয়ার্ল্ড কে ।”
ইউভি একগাল হাসি দিয়ে ,
__” জী ভাই ।”
বলেই রায়ান কে কল দিল , ওপাশ থেকে রায়ান কল এ আসতেই , ইউভি একটু দুর থেকেই ফোন টা জায়ন আর তিয়াশার মেয়ের দিকে করে বলে উঠলো,
__” কে বলতো?”
ফোনের স্ক্রীন এ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে রায়ান এর খুশী , এক মিনিট ও সময় লাগলো না তার বুঝতে ,সে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলো,
__” ইউভি ভাই প্রিন্স না প্রিন্সেস ?
ইউভি কি জবাব দেবে তার আগেই জয়ন বলে উঠলো,
__” এঞ্জেল আমার এঞ্জেল রে রায়ান ।”
ভাগ্নীর কথা শুনতেই রায়ান এর খুশী যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল ।
সেখানে উপস্থিত সবাই মেহজাবীন বেগম, ইউভি, অনন্যা, তাহসান সাহেব, রুহেন্স বেগম প্রান্তিক সাহেব সবার চোখ ভেজা, মুখে হাসি, হৃদয়ে এক অসীম আনন্দের ঢেউ। প্রতিটি মানুষ নিজের অভ্যন্তরীণ আনন্দ, ভালোবাসা ও আশীর্বাদ মিশিয়ে এই মুহূর্তকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে।
জায়নের কোলে থাকা শিশু সত্যিই অপুর্ব। তার কোমল গালগুলো লালিমা ছড়াচ্ছে, ছোট্ট নাকটা একেবারে নিখুঁত, ফর্সা ত্বক যেন আলোর মৃদু ঝলক। ডাগর-ডাগর চোখগুলো আলোয় ঝিলিক করছে, আর মুখে হালকা হাসি সেই হাসি যা সমস্ত ক্লান্তি, কষ্ট, ভয় সবকিছুকে একেবারে ভুলিয়ে দেয়। যেন সে শুধু আনন্দের ও আলোয় ভরা এই পৃথিবীতে এসেছে, তার একমাত্র উদ্দেশ্য জায়ন এবং তিয়াশার জীবনে আনন্দের ঢেউ ছড়ানো।
করিডোরের প্রতিটি মুহূর্ত এখন এক আনন্দময়, হাসি আর কণ্ঠের মিলন। শিশু, মা, বাবা সবাই একে অপরের আনন্দে ভেসে যাচ্ছে। হৃদয়ের গভীর আনন্দ আর সন্তুষ্টি, চোখে অশ্রু, মুখে হাসি সব মিলিয়ে এক অপার আনন্দের মুহূর্ত।
এক একে করে বৃষ্টি নাজিম, আয়েশা বেগম, মারিয়া, আশরাফ সাহেব আবার অন্যদিকে পরি জেমস , সাগর, পলাশ, আহান সকলে উপস্থিত হলো হাসপাতালের করিডোরে । ধীরে ধীরে আসছিল আকাশ আর আরোহী। আকাশ আরোহীর হাত ধরে হাঁটছে, কারণ আরোহী এখন তিন মাসের গর্ভবতী।
সেদিন যখন আকাশ জানতে পেয়েছিল আরোহী প্রেগনেন্ট, সে প্রায় তার চুল ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল কারণ আকাশের মেডিকেল স্টাডি শেষ হতে এখনও দুই বছর বাকি। কিন্তু তারপরেও তারা দুজনেই পরিবার সহ আনন্দের ছোঁয়ায় সেই নতুন জীবনের স্বাগত জানায়। ছোট্ট জীবনের আগমন যেন তাদের ভবিষ্যতের আশা ও সুখের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
ইউভি, যতবার সুযোগ পায়, খিল্লি উড়াতে থাকে আকাশের দিকে। আকাশ মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে যায়, কিন্তু তার চোখে তখনও সেই ছোট্ট আনন্দ ও উদ্দীপনার ঝলক আছে।
__”হায় রে আমাদের ডাক্তার বাবু দান চালিয়ে দিল, বলছি কি ভাই তোরে দেখলে বোঝা যায় না তোর মধ্যে এত তেজ ।”
ইউভির কথা শুনে আকাশ গটগট করে তাকিয়ে বলে উঠল,
__” ইউভি ভাই ভালো হচ্ছে না কিন্তু, আমি বাপ হচ্ছি একটা সম্মান আছে আমার বুঝলে।””
আকাশের কথা শুনে ইউভি সাগর পলাশ আহান জেমস সবাই হো হো করে হেসে উঠলো, সাগর তো নিজের মুখ বন্ধ করে রাখতেই পারল না ,
__” না আকাশ ভাই সত্যি তোরে দেখলে বোঝা যায় না তুই খাট ভাঙ্গা পাবলিক ।”
সাগরের কথা শেষ হতেই আকাশের মুখে অমাবস্যা
নেমে এলো, নাজিম হাসতে হাসতে আকাশের কাঁধ চেপে বলে উঠলো,
__” আমরা চাই তুমি আরো খাট ভাঙ্গো ভবিষ্যতে।”
করিডোরে হাসির শব্দে কেঁপে উঠছে এদিকে আকাশ বুঝতে পারছে আজ সবাই মিলে তার কাঁছা খুলে ছাড়বে , তবুও নিজেকে বাঁচাতে বলে উঠলো,
__” আমার কোন দোষ নাই বড় ভাইয়া কি চকলেট
যে দিয়েছিল আল্লায় যানে।”
সঙ্গে সঙ্গে জেমস উত্তর দিল ,
__”ইটস কলড হ*র্নি চকলেট ব্রো হি হি ।”
জেমস এর দিকে সবাই ভ্রু কুঁচকে তাঁকিয়ে পড়ল জেমস সেটা বুঝে একটু দূরে সরে গিয়ে বলে উঠলো,
__”না না এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই ব্রাদার্স আমি ইউজ করি না , বাট আমাদের কান্ট্রি তে খুব পপুলার।,”
তারপর আবার সবাই হো হো করে হেসে আকাশের
দিকে তাকিয়ে আহান বলে উঠলো,
__” তুমি আর লোক পাও নি জায়ন এর কাছে গেছো সলিউশন নিতে , যে ব্যাটার মাথায় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পঁচিশ ঘণ্টা থাকে রোমান্স ।”
আহানের কথা শেষ হতেই নাজিম কাশী দিয়ে বলল,
__” সে যাই হোক , আমার বৌমা কিন্তু সেই সুন্দরী হয়েছে দেখতে।”
সবাই চমকে উঠলো নাজিমের কথায় , ওর বৌমা আসলো কোথা দিয়ে , ওর ছেলের বয়স তো চার তাহলে ? পলাশ না পেরে বলেই উঠল,
,__” তোর বৌমা আবার কে ?,”
নাজিম গর্ধবের মত হেসে নিজের ইচ্ছা সবার সামনে রাখল,
__” আমার ছেলের বউ বানাবো আমাদের জায়ন এর মে……”
বলতে পারল না তার আগেই পেছন থেকে এক গুরু গম্ভীর স্বরে ভেসে আসলো,
__” বাপ ছেলের দুটোর ই বাসায় আসা বন্ধ করে দেব নেস্কস্ট টাইম এই কথা মুখে আনলে।”
সবাই পেছনে তাকাতেই দেখল দু জোড়া আগুন চোখ।
আকাশ তো সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
__” নাও হয়ে গেল আগে ছিল শুধু বউ এখন বউ এর সঙ্গে মেয়ে আমাদের প্রিসেন্স ও যোগ হলো।
অন্যদিকে পরি , বৃষ্টি , অনন্যা , আরোহী এদের কান্ড দেখে হাসা হাসি করছে । বাকি পরিবারের সবাই ও সেই হাসিতে যোগ দিয়েছে ।
সকালের আলো ঝলমলে ছড়িয়ে আছে হাসপাতালের করিডোরে। তিয়াশা শুয়ে আছে, আর পাশে জায়নের কোলে থাকা তাদের প্রিন্সেস। জায়ন এক মুহূর্তও তার জানের টুকরো কেডি নিজের কাছ থেকে আলাদা রাখার কথা ভাবছে না।
তিয়াশা কাঁপা গলায়, মৃদু কন্ঠে বলল,
__”এ এইই যে মে মেয়ের পাপা, মেয়ে কে ক্রিবে রাখবেন নইলে খাবে ডাক্তার এর কাছে বকা।”
জায়ন মেয়ের দিকে তাকিয়ে, চোখে আনন্দের ঝিলিক, কপালে আলতো চুমু দিয়ে বলল,
__”আমার কলিজার পাপার কোল থাকতে ওটায় কেন থাকবে?”
তিয়াশা হালকা হাসি দিয়ে বলল,
__”মেয়ের নাম রাখবে না?”
জায়ন কথাটা শুনেই তিয়াশার দিকে এগিয়ে গেল, কোমলভাবে মেয়েকে কোলে নিয়েই, তারপর তিয়াশার কপালে চুমু দিয়ে বলল,
__”আমার মেয়ে রোদের আর জায়ন এর জান এর টুকরো, তাই আমার রাজকন্যার নাম রোজা। রিহানা রোজা চৌধুরী, ডটার অফ মিস্টার আবরার জায়ন চৌধুরী এন্ড তিয়াশা রোদ চৌধুরী।”
করিডোরে উপস্থিত সবাই আয়েশা বেগম, মারিয়া, আশরাফ সাহেব, বৃষ্টি নাজিম, আকাশ, আরোহী চোখে আনন্দের জল, মুখে হাসি, হৃদয়ে এক অপার আনন্দের ঢেউ।
প্রত্যেকের মুখে আনন্দ, হৃদয়ে এক অমলিন উচ্ছ্বাস। কেউ কেউ হেসে খুশি, কেউ কেউ চোখের জল মুছছে সবাই অনুভব করছে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। নতুন শিশু, নতুন আশা, পরিবারের একতা, প্রেম এবং আনন্দ এক সাথে মিলে পুরো করিডোরকে আনন্দময় বাতাবরণে ভরিয়ে দিয়েছে।
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭৫
ছোট্ট রিহানা রোজা চৌধুরী তার নরম গাল, ডাগর ডাগর চোখ, ফর্সা ত্বক আর শান্ত মুখ মুহূর্তে সকলের হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই ছোট্ট প্রাণ যেন এই পরিবারের সুখ, প্রেম এবং ভবিষ্যতের আলো হয়ে উপস্থিত হয়েছে।
জায়ন আর তিয়াশা, দুই হৃদয় মিলিত, তাদের চোখে আনন্দের জল, মুখে হাসি, হাতে হাত, আর কোলে তাদের ছোট্ট রাজকন্যা সব মিলিয়ে এক অপার আনন্দের চিত্র, যা প্রত্যেকের মনে স্থায়ী হয়ে থাকবে।
