তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৮

তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৮
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

তাজদার যখন বাড়ি ফিরলো তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। মেজবানের খাওয়াদাওয়া শেষ। বাবুর্চিরা টাকাপয়সার হিসাব বুঝে নিয়ে চলে গিয়েছে। মেহমান অর্ধেক চলে গিয়েছে। অর্ধেক থেকে গিয়েছে।
উঠোনে প্যান্ডেলের নিচে লাল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সবাই গল্পগুজবে মেতে উঠেছে। দুই বাড়ির মেহমানই আছে সেখানে।

তাজদারকে দেখে সবাই একসাথে ফিসফিস করে উঠলো। শাইনার খালারা বলল,”জামাই এসেছে।”
তাজদারের হাতে কিছু জিনিসপত্র ছিল। তিতলি এসে সেগুলো হাতে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। তাজদার এসে সবার সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে একটা চেয়ার টেনে বসলো। সবাই নড়েচড়ে বসেছে জামাইয়ের সাথে কথা বলতে। শাইনা মেঝ খালা বলল,”জামাইয়ের গল্প করার জন্য থেকে গেলাম। খাওয়াদাওয়া তো করলেন না।”
তাজদার মাথা নেড়ে বলল,”না খেয়েছি। খাব না কেন? আপনারা থাকুন। সবসময় তো আসেন না। বাড়িতে গিয়েছেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হ্যাঁ। চা খেয়েই এলাম। আপনার মা দাদীর সাথে কথাবার্তা বললাম। আর ক’দিন আছেন দেশে?”
“দুই দিন।”
“আর বোধহয় থাকা যাবে না।”
“না, অনেক বেশিই থেকেছি। এতদিন থাকার কথা ছিল না। আপনারা থাকুন কয়েকদিন।”
“কালই চলে যাব বাবা। বড়ো মেয়েটার একটা ছেলে হয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ি যাব। মেয়েটার একা একা কষ্ট হয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ির মানুষ তেমন দেখভাল করেনা। আচ্ছা, আপনি যান। বাড়ির সবাই টেনশন করছে।”
তাজদারের মামীরা বলল,”মামা শ্বশুরের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু।”
তাজদার বলল,”পরেরবার দেশে এলে যাব। এবার পাঁচ মাসই হাসপাতাল কাটিয়ে ফেললাম।”

“এটা কোনো কথা! নতুন জামাইয়ের ব্যাপারই তো আলাদা।”
“সমস্যা নেই। নতুন জামাই সেজে যাব।”
“ঠিক আছে। আমরা মনে রাখলাম।”
তাজদার তাদের সাথে কথাবার্তা বলা শেষে বাড়িতে গেল। কেউ এখন কিছু বলছেনা আর। সবাই তাকে দেখে আরো চুপ হয়ে গেছে যেন সে ভাত খায়নি এটা নিয়ে কারো তেমন ভাবনা নেই।
ঘরে ঢুকতেই শাইনা ঝড়ের মতো ছুটে এল,
“আমাকে বকুনি না খাওয়ালে আপনার শান্তি লাগেনা তাই না?”
তাজদার কপাল কুঁচকে তাকাল। স্বরটা ভারী, সংযত।

“কে কী বলেছে?”
“সবাই এমনকি আমার বাপের বাড়ির লোকজনও বলে যাচ্ছে আমি কেন তাদের জামাইকে বোঝাইনি?”
“অদ্ভুত কথা! আমি কি বাচ্চা ছেলে? আমাকে কেউ বোঝাবে কেন? আর তুমি আমাকে বোঝাবে? ওদের মাথা খারাপ?”
শাইনাও রাগে কাঁপতে লাগল।
“মানে? আমি আপনাকে বোঝাতে পারি না?”
তাজদার হালকা গলায় বলল,”তুমি আমাকে বোঝাতে গিয়ে নিজেই ফায়ার হয়ে যাও।”
“আপনার সঙ্গে আমি আর একটা কথাও বলব না!”
বলতে বলতে শাইনা দরজার দিকে ঘুরতেই তাজদার ঠান্ডা গলায় বলল,

“ওটাই চেয়ে এসেছ সবসময়। এখন আরও সুবিধা হবে। দিনের পর দিন কথা না বলে থাকা যাবে।”
শাইনা থেমে ধীরে ঘুরে তাকাল। কিছুক্ষণ নীরবে তাজদার সিদ্দিকীর মুখখানা লক্ষ্য করল। মুখটা অসম্ভব গম্ভীর। একদমই মনে হচ্ছে না মজা করে কথা বলার মুডে আছে। অথচ কিছুদিন আগেও সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। হাসত, ঠাট্টা করত, এমনকি নিজের কথায় নিজেই হেসে উঠত।
হুট করে কিছু একটা বদলে গেছে। গোরু-মহিষের সেই ইস্যুটা নিয়েই এমন অস্থির? নাকি অন্য কিছু চলছে মাথার ভেতর যে সে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি?

“রাগ করেছেন? আমি সিরিয়াসলি বলিনি।”
তাজদার শান্তভাবে বলল,“তোমার সিরিয়াস না হওয়াটাও একধরনের সিরিয়াস ব্যাপার। রাগ করিনি আমি।”
শাইনা বলল,”তবু চেহারায় রাগ ফুটে আছে।”
“তুমি সেটা দেখতে পেয়েছ এইটুকু আমার সৌভাগ্য। সালাম নাও।”
শাইনা অবাক গলায় বলল,
“আমি এমন কী বলেছি যে আপনি এভাবে…
তাজদার এবার তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল,”বলেছি তো রাগ করিনি। এখন যাও যেখানে যাওয়ার। মাথা খেওনা।”
শাইনা বিছানার উপর শপিং ব্যাগটা দেখলো। হেঁটে এসে সেটা ধরবে তখুনি তাজদার বাঁধা দিয়ে বলল,”ওটা নেবে না খবরদার।”

শাইনা হাত গুটিয়ে নিল। মন খারাপ করে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখুনি তাজদার বলল,”আমি এমন কিছু বলিনি যেটা শুনে তোমার মন খারাপ করবে।”
শাইনা বলল,”আপনাকে বুঝতে পারছিনা বলেই হয়তো মন খারাপ হচ্ছে। অন্য কারণে নয়। যাইহোক এইসব কথা থাক। আপনি দুপুরে আর কিছু খাননি বোধহয়। আমি কিছু নিয়ে আসছি।”
“খিদে লাগলে আমি নিজে নিয়ে খাব। এত বদভ্যাস তৈরি হলে পরে আমাকেই ভুগতে হবে।”
শাইনা অবাক হয়ে গেল। এতক্ষণ পর হয়তো সে বুঝতে পারছে তাজদার সিদ্দিকীর রাগের আসল কারণটা। হঠাৎ বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। সে কি অজান্তেই তাজদার সিদ্দিকীর কাছ থেকে রাগ করার অধিকারটা ছিনিয়ে নিয়েছে?

যে মানুষটা একসময় নিঃসংকোচে রাগ প্রকাশ করত আজ সে রাগ দেখাচ্ছে সাবধানে, মাপজোক করে। নিজেই এখন নিজের রাগের অনুমতি নিচ্ছে। শুধু সে কষ্ট পাবে বলে? এই ভাবনাটাই তাকে হঠাৎ অপরাধী মনে করাল। সে তো কখনো এমন সম্পর্ক চায়নি যেখানে সবসময় ভান করতে হবে, মেকি আচরণ করতে হবে, নিজের অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রাখতে হবে। রাগ, খুশি, সবকিছুই সাবধানে মাপতে হবে যেন কেউ কষ্ট না পায়। কিন্তু তারপরও?
তাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাজদার সিদ্দিকী ব্যাগটার দিকে আঙুল তাক করে বলল,”ওটা দেখে নিতে পারো।”

শাইনা ধীরপায়ে হেঁটে শপিং ব্যাগটা হাতে নিল। খুলে দেখলো নিজের জন্য কিছু কেনাকাটা করেছে তাজদার সিদ্দিকী। সাথে তার জন্যও একটা লাল শাড়ি। তবে এটাতে কালো ফুল আছে। অন্যরকম, আরামদায়ক হবে। নিজের অজান্তেই শাইনার ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটল।
কিন্তু তাজদারের দিকে তাকাতেই হাসিটা মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। তার চেহারা এমন গম্ভীর যে শাইনার হাসিটা সেখানে বেমানান।
“আবার আমার জন্য কেনাকাটা কেন?”

তাজদার তার চোখ বরাবর তাকালো প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে। শাইনা বিচলিত হয়ে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,
“পছন্দ হয়েছে খুব। থ্যাংকস!”
বলেই সে শপিং ব্যাগটা আলমারির ভেতরে রেখে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল। তাজদারের চোখ আলমারির দিকে আটকে রইল। চাপা রাগ, অপ্রকাশিত অভিযোগগুলো তার চেহারায় কড়াকড়ি কাঠিন্যেতা সৃষ্টি করেছে। শাইনা বাকি জিনিসগুলো দেখলো না!
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল, কিন্তু মনের ভেতরের অচেনা উত্তেজনা আর অব্যক্ত অভিমান চোখের কোণে রাগ হয়ে ঝলমল করতে লাগল। যত চেষ্টাই করুক তা ঢেকে রাখা তার জন্য আর সম্ভব হলো না।

ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে শুধু ল্যাপটপের কি-বোর্ডের মৃদু শব্দ। তাজদার মনোযোগ দিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কপালের কাছে কয়েকটা চুল এলোমেলো হয়ে এসেছে, আর বাঁ হাতটা অভ্যাসবশত কানের কাছে রাখা হেডফোনটা একটু আলগা করে দিয়ে সে জটিল ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যাজ কোড কনফিগারেশনে মগ্ন।
ঠিক তখুনি দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরে এলেন দাদীমা আনোয়ারা বেগম। হাতে একটা ছোট বাটিতে দুধে চুবানো চালের পিঠা।

নরম গলায় ডাকলেন, “তাজ!”
তাজদার এত মনোযোগে ছিল যে দাদীমার আগমন টেরই পায়নি।
দাদীমা দ্বিতীয় বার ডাকতেই সে চমকে উঠে তাড়াতাড়ি হেডফোনটা খুলে ল্যাপটপের স্ক্রিনটা সামান্য আড়াল করার চেষ্টা করল।
তারপর উঠে এসে দাদীমার হাত থেকে বাটিটা নিলো।
“তিতলি কোথায়?”
“তৌসিফের সাথে কোথায় গেছে কে জানে। এত শয়তান হয়েছে, এক জায়গায় শান্তিতে বসেনা।”
“শাইনা?”

“রান্নাঘরেই আছে। কাজবাজ করছে বোধহয়।”
তাজদার চুপচাপ খেতে লাগলো।
“তোমার মামী শ্বাশুড়ি এনেছেন এই পিঠা। কেমন?”
“ভালো। একটু বেশিই মিষ্টি হয়েছে। খেতে ভালো লাগছে। খারাপ না।”
দাদীমা একটু থেমে বললেন,
“যাওয়ার আগে এইসব করার কোনো দরকার ছিল?”
“কোনসব?”
“এই যে আজ খেলে না সবার সাথে বসে?”
“সবসময় উচিত কাজ করা যায়?”
দাদীমা হতাশ হয়ে বললেন,
“শাইনার দুলাভাইরা তো বলেই দিল তাদের সাথে খেতে তোমার আপত্তি আছে তাই তুমি না খেয়ে চলে গিয়েছ।”
তাজদার চামচ মুখে না তুলে বলল,”এইসব বাড়াবাড়ি রকমের কথাবার্তা।”
আনোয়ারা বেগম শান্তভাবে বললেন,”এটাই তো স্বাভাবিক। ওরা তো আর জানেনা বাড়িতে কি হ’য়েছে। তোমার এটা করা উচিত হয়নি। যাইহোক এইসব কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তোমার দাদাভাই আর দাদাশ্বশুরের কবর জেয়ারত করিয়েছ আজকে?”
তাজদার বলল,”হ্যাঁ।”

“ভালো করেছ। এবার রাগটাগ বাদ দাও। আর দুটো দিন আছ। ভালো ভালো সময় কাটাও। বউয়ের সাথেও এখন কোনো রাগ দেখিওনা। তুমি চলে গেলে ওর-ও খারাপ লাগবে।”
তাজদার সোজাসাপ্টা বলল,”আমি সিউর ওর খারাপ লাগবে না।
“এটা তোমার রাগের মাথায় বলা কথা।”
তাজদার বলল,”সেটা হতেই পারে তবে এটাই সত্যি।”
দাদীমা হেসে ফেললেন।
“ওর খারাপ লাগলেই তো সমস্যা। তখন তোমার ওখানে মন টিকবেনা। আর সবাই তো একরকম না। ও হয়তো দেখাতে পারেনা। কিন্তু বর দূরে গেলে কষ্ট হবে, সেই বর যদি শত্রু হয় তবুও।”
“তাহলে ভালোই।”

দাদীমা আবারও হেসে ফেললেন।
“মেয়েদের মন বোঝা এত সহজ না। আবার এতটা কঠিনও না। সবাই সবকিছু প্রকাশ করতে পারেনা। আবার অনেকে কথায় না বলে কাজেকর্মে, আচার-আচরণে তা বুঝিয়ে দেয়। শুধু বুঝে নিতে হয়।”
“কেউ আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছে এইসব আমার কাছে বিরক্তিকর। এত পেইন নিতে চাই না আমি।”
“এজন্যই তো তোমার জন্য কষ্ট হলেও সবাই তা দেখাতে ভয় করে। এভাবে বলতে আছে নাকি?”
“আমার জন্য কাউকে কষ্ট পাওয়ার ভান করতে হবে না। এইসব ফেইক ইমোশনাল সিন দেখতে চাই না আমি। সেভ দ্যাট ইমোশনাল অ্যাক্ট ফর সামওয়ান হু কেয়ার্স।”
“এত কঠিন কথা বলতে আছে?”
“আমি বলি।”

তখুনি দরজার কাছে শাইনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো তাজদার। শাইনা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। বলল,”দাদুকে বড়ো আব্বু ডেকেছেন।”
আনোয়ারা বেগম একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর তাজদারের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তাজদার শাইনার উদ্দেশ্যে বলল,”ভেতরে এসো।”
শাইনা কথা না শুনেই চলে যাচ্ছিল। তাজদার এক লহমায় শাইনার হাত ধরে ঘরের ভেতর টেনে এনে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই শাইনা বলল,”ফেইক ইমোশনাল সিন দেখতে চাচ্ছেন?”

কথাটা গরম সীসার মতো তাজদারের কানে বাজল। সে তৎক্ষণাৎ শাইনার হাত ছেড়ে দিল। সে ভুলভাল কথা বললে সেটা শোনার জন্য চলে আসে। কিন্তু তার যে এত খারাপ লাগছে এটা বুঝতে পারছেনা।
তার ভেতরের সব জেদ নতুন করে জমাট বাঁধল। সে দ্রুত হেঁটে গিয়ে দরজাটা আবার খুলে দিল। এবার ইশারায় শাইনাকে চলে যেতে বলল। তার চোখেমুখে চূড়ান্ত বিতৃষ্ণা। শাইনা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। চোখে জল নিয়ে ক্ষোভের দৃষ্টিতে তাকাতেই তাজদার বলল,”এই যে ঘর থেকে বেরোলে আমি দেশ ছাড়ার আগে আর একদম ভেতরে আসবে না।”

শাইনা তার কথা অমান্য করে জেদ দেখিয়ে ভেতরে ঢুকে এসে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকের কাছে। কিল, খামচি আর এলোমেলো ধাক্কায় তাজদার দু’পা পেছনে সরে গেল। মুখটা যন্ত্রণায় কুঁচকে গেল।
“কী হচ্ছেটা কী। শাইনা!”

তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৭

শাইনা শান্ত হওয়ার মেয়ে নয়। তাজদার শেষমেশ তার হাত দুটোকে শক্ত করে চেপে ধরে শরীরটাকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এক ঝটকায় শাইনার মাথাটা আলতো করে কাত হয়ে গেলে সে সরাসরি ঠোঁটের উপর ঝুঁকে শক্ত একটা চুমু খেয়ে বলল,
“থামো। বাড়াবাড়ি করো না। রিল্যাক্স!”

তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here