Death or Alive part 16
priyanka hawlader
রাজপ্রাসাদ, অপরাহ্নের স্নিগ্ধ আলোয় মোড়া—
দিগন্তব্যাপী বিস্তৃত রাজপ্রাসাদের অলিন্দজুড়ে হঠাৎ যেন হুলস্থুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। সভাসদ, সেনাপতি, দাস-দাসীরা ছুটোছুটি করছে মহলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। রাজার সভায় ধ্বনিত হতে লাগল একটিমাত্র নাম—
“ভাবী রানী এসে গেছেন!”
সোনালি আলোর রেশ ধরে প্রাসাদের রাজদ্বার দিয়ে প্রবেশ করেছেন এক রাজকীয় নারী। তাঁর অলঙ্কার যেন রোদ্দুরে মিশে সোনালী আগুন ছড়াচ্ছে, তাঁর পায়ের নূপুরের শব্দ যেন রাজ্য জয়ের ঘণ্টাধ্বনি। চারদিকে শুধু তার প্রশংসা, সম্ভাষণ, আর অভ্যর্থনার ছটায় ভেসে যাচ্ছে রাজপ্রাসাদ।
আর এই সময়েই—
প্রাসাদের এক নির্জন কক্ষে, জানালার পাশে চুপচাপ বসে আছে অর্ষা।
তার চোখে নেই কৌতূহল, নেই কোনো উৎসাহ। বাইরের কোলাহল যেন তার অন্তর্লোকে কোনো স্পর্শই রাখে না। সে কেবল জানালার ফাঁক গলে দেখা সূর্যের শেষ আলোয় ডুবে থাকা মহলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ, তার ভাবনার মাঝখানে পর্দা সরিয়ে এক দাসী প্রবেশ করে।
— “অর্ষা মেমসাহেবা, আপনাকে ডাকা হয়েছে।” দাসীটি কাঁপা গলায় বলে।
অর্ষা ধীরে চোখ ফেরায়, ঠোঁট নেড়ে প্রশ্ন ছোঁড়ে, “কে ডাকছে আমায়?”
দাসী কিছুটা ইতস্তত করে উত্তর দেয়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “এই রাজ্যের ভাবী রানী… মানে বাদশা ওয়াজফান কায়স্থ-এর ফিয়ান্সে। তিনি এসেছেন কিছুক্ষণ আগেই। শুনেছি, আপনাকে এক নজর দেখতে চান।”
এক মুহূর্তের জন্য সময় থমকে গেল।
‘ভাবী রানী’, ‘ওয়াজফান-এর ফিয়ান্সে’— শব্দগুলো কাঁটার মতো বিঁধে গেল অর্ষার মনে।
কিন্তু কেন বিধল তা তার জানা নেই,
তার বুকের গভীরতম কুঠুরিতে যেন হঠাৎ চাপ পড়ে গেল। চোখের পলকে কত চিত্র ভেসে উঠল—ওয়াজফানের মুখ, তাকে জোর করে কিস করার মুহূর্তগুলো।
সে মনে মনে ভাবতে থাকে নির্লজ্জ বেহায়া লোক নিজের কিছুদিন পর বিয়ে হবে নিজের ফিয়ান্সে আছে তবু অন্য একটা মেয়েকে জোর জবরদস্তি কিস করে।
দুশ্চরিত্র এরপর শুধু কোনদিন আমার কাছে আসলে সেদিন বুঝাবো অনেক সহ্য করেছি আর না।
এরপর আবার দাসীটাকে,
সে ফিসফিস করে বলে উঠল,
— “আমাকে দেখার মতো কী আছে তার? আমার কী এমন রূপ, কী এমন গুরুত্ব?”
দাসীটি নিচু কণ্ঠে জবাব দেয়,
— “সেটা তো আমি জানি না মেমসাহেবা। তবে তিনি খুব স্পষ্টভাবে বললেন—‘অর্ষাকে নিয়ে এসো, আমি তাকে নিজে দেখতে চাই।’ তাই আমি এসেছি।”
অর্ষা চুপ করে থাকে।
মনের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়।
কে এই মেয়ে? কেন সে অর্ষাকে দেখতে চায়?
ওয়াজফান কি সত্যিই তাকে… ভালোবাসে?
জানালার ফাঁক গলে তখনও আলো এসে পড়ছে তার মুখে। কিন্তু তার চোখের সামনে ছায়া নেমে এসেছে। এক অজানা কাঁপুনি তার সারা শরীরজুড়ে।
দাসী আবারও ভয়ে বলে ওঠে,
— “চলবেন না মেমসাহেবা?”
অর্ষা ধীরে উঠে দাঁড়ায়, ঠোঁট কামড়ে বলে,
— “চলো। দেখা যাক এই ‘ভাবী রানী’ কে…
অর্ষার পায়ের শব্দ নিঃশব্দে ভেসে যাচ্ছে রাজপ্রাসাদের লম্বা মার্বেলের করিডোরে। হাঁটতে হাঁটতে সে এসে দাঁড়ায় সেই কক্ষটির সামনে—যেখানে রাখা হয়েছে রানীকে।
দরজার গায়ে হাত রাখতেই একটা শীতল শিহরণ বয়ে যায় তার শরীরে। ধীরে ধীরে ঠেলে দেয় দরজাটি। শব্দহীনভাবে ফাঁকা হয়ে যায় প্রবেশপথ। আর ঠিক তখনই…
তার দৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত হয় এক অপরূপ দৃশ্য।
একটি তরুণী, যেন চাঁদের নির্মল আলো থেকে গড়া। তার লম্বা রূপালী চুল নেমে এসেছে কোমর ছুঁয়ে, যেন রুপালি নদীর মতো তরঙ্গ তুলছে বাতাসে। গায়ে অদ্ভুত কারুকাজে বোনা নীলাভ রঙের একটি পোশাক, যেন নীল পদ্মের পাঁপড়ির মতো নরম। চোখ দুটো বড়, দীপ্তিময়—সেই চোখে যেন লুকিয়ে আছে আকাশের বিশুদ্ধতা।
অর্ষা এক পা, দুই পা করে ভিতরে ঢুকতেই তরুণী হেসে বলে ওঠে,
— “Hi! তুমি তো সেই মানবকন্যা, তাই না? যাকে ওয়াজফান মানবরাজ্য থেকে নিয়ে এসেছে?”
অর্ষা থমকে যায়। বিস্ময়, কৌতূহল আর একরাশ ভয় একসাথে খেলে যায় তার চোখে মুখে। মেয়েটির কণ্ঠে ছিল বন্ধুত্বের উষ্ণতা, কিন্তু অর্ষার মনে তখন ঝড়। ওয়াজফান… আর এই অপরূপা?
মেয়েটি আবার বলে,
— “তোমাকে দেখার আমার অনেক ইচ্ছে ছিল। যেদিন শুনেছিলাম, সেদিন থেকেই মনে হচ্ছিল, একবার তোমার সাথে দেখা হলে কত কথা বলব। এতদিন শুধু শুনেছি—মানবকন্যারা কেমন! আজ তোমায় দেখে বোঝা যাচ্ছে, গল্পগুলো মিথ্যে নয়।”
অর্ষা নির্বাক। মেয়েটি আরও এগিয়ে আসে। তার ঠোঁটে এক কোমল হাসি।
— “আচ্ছা, আমি তো তোমার সঙ্গে ঠিকঠাক পরিচয়ই করিনি।”
সে একবার মাথা নিচু করে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে,
— “আমি এলিনা। প্রিন্সেস এলিনা। এই রাজ্যের হবু রানী এবং…”
একটি ছোট্ট থেমে নেয় সে, এরপর স্বচ্ছ অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
— “ওয়াজফানের ফিয়ান্সে।”
এই কথাটা যেন বিদ্যুতের মতো আঘাত হানে অর্ষার বুকে। মুহূর্তেই তার মুখের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে আসে। হৃদয়ের গভীরে কেমন এক খচখচে চিনচিনে যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ে। যেন কেউ অদৃশ্য শীতল হাত দিয়ে তার বুকের মাঝখানে কিছু একটা টেনে ধরছে।
কিন্তু অদ্ভুত অদ্ভুত অনুভূতির কারণ অর্ষা বুঝতে পারছে না এটা কি শুধুই ওয়াচ পান তাকে ঠিক করেছে সেই রাত থেকেই হচ্ছে নাকি অন্য কিছু।
এরপর আবার নিজেই ভাবে নানা অন্য আর কি হবে আমার তো শুধু রাগ হচ্ছে কারণ ওই নির্লজ্জ চরিত্রহীন ব্যক্তি আমার ছুয়েছে।
সে একটা মেয়েকে ঠকিয়েছে এটাই আমার অদ্ভুত লাগার কারণ আর কিছুই না।
এদিকে এলিনা অনায়াসে বলে চলে,
— “আমি এখানে এসেছি দুটো কারণে। প্রথমটা, তোমার সাথে দেখা করতে। আর দ্বিতীয় কারণটা…”
এলিনা কথাটা সম্পূর্ণ করার আগে একটা দাসী এসে বলে,
— “প্রিন্সেস এলিনা আপনাকে ডাকছেন। সবাই ভোজন কক্ষে উপস্থিত, শুধুমাত্র আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
এলিনার পাশে তখন দাঁড়িয়ে ছিল তার পার্সোনাল দাসী মালালা।
মালালা যেন কেনো এক অদৃশ্য আগুনে জ্বলছিল। অর্ষার দিকে তাকিয়ে তার মনে মনে সন্দেহ,
“এই মানব কন্যা আবার না আমাদের বাদশাকে কেড়ে নিয়ে প্রিন্সেসের জীবনটাই উল্টে দেয়!”
হঠাৎ এলিনা নিজেই বলে উঠল,
— “চলো, সবাই ভোজন কক্ষে চলি।”
অর্ষা কিছুটা সংকোচে বলল,
— “আচ্ছা… আপনারা যান। আমি বরং আমার কক্ষে যাই।”
তখনই এলিনা তার হাত ধরে নরম কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
— “না, এখন তুমি আমাদের সাথে যাবে। আমরা সবাই একসাথে ভোজন করব।”
এরপর এলিনা অর্ষার হাত ধরে টেনে নিয়ে ভোজন কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। কক্ষে ঢুকতেই দেখা যায়, সবাই ইতিমধ্যে নিজ নিজ জায়গায় বসে গেছে। রাজকীয় আলোয় ঝলমল সেই বিশাল ভোজন কক্ষ যেন নীরব এক প্রতীক্ষার আবহে দাঁড়িয়ে।
ওয়াজফান বসে আছে তার নির্দিষ্ট চেয়ারে।
অর্ষা তার দিকে এক ঝলক তাকাতেই, ওয়াজফানের দৃষ্টিও গিয়ে পড়ে তার চোখে।
দু’জনের চোখ মিলিত হয়—কিন্তু সেই চোখে আজ আর আগের সেই ভীতি বা লজ্জা নেই।
অর্ষার চোখে এখন শুধু রাগ আর চাপা ক্ষোভ।
তাদের দৃষ্টি যেন এক নিরব যুদ্ধ।
অর্ষা তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নেয়।
ওয়াজফান মুহূর্তেই ভেতরে প্রশ্ন জাগায়,
“এর আবার কী হলো? এমন ব্যবহার কেন?”
ঠিক তখনই এলিনা ওয়াজফানের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসে, তারপর অর্ষাকে উদ্দেশ করে বলে,
— “তুমি এসো, আজ আমরা একসাথে খাব।”
অর্ষা নিজের রাগ নিজের ভেতরে চেপে রেখে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গিয়ে এক পাশে বসে পড়ে।
এরপর খাবার পরিবেশন শুরু হয়, ভোজন পর্ব চলতে থাকে।
কিন্তু পুরো সময়জুড়ে অর্ষা একবারের জন্যও ওয়াজফানের দিকে তাকায় না।
ওয়াজফান বারবার তাকায়, চুপিচুপি তার প্রতিক্রিয়া খোঁজে।
তবু অর্ষা নিরব, কঠিন। তার চোখে কোনো দৃষ্টি নেই, কেবল অনাহুত এক দূরত্ব।
আজকের অর্ষা যেন ওয়াজফানের কাছে একদম অচেনা এ কয়েক দিনে সেইটা তো বুঝে গেছে এই মেয়েকে কিভাবে জব্দ করতে হয় কিভাবে তার ঝগড়ুটে পেনা ছুটাতে হয় আর কদিনে যেন সে আরও বেশি আকর্ষণ কি করছে কিন্তু আজ এক অন্যরকম আরসা কে দেখছে সে।
সে ভেবেছিলো অর্ষার ঠোঁটের মতো করে তারপরও শরীরটাও নিজের অধিকার বসিয়ে জিতে নেবে আর হয়তো সেখানেই তার আকর্ষণ শেষ হয়ে যাবে কিন্তু না অর্ষার শরীরে প্রতি শুধু না তার হাসি কথা বলা রাগলে রাগি চোখ চুলের ঘ্রান সবকিছুর প্রতি কেমন যেন তার আকর্ষণ দিনে দিনে বাড়ছে আর এইটার কারণ সে নিজেও বুঝছে উঠতে পারে না।
সেভাবে একবার কি তাকে নিজের করে পাওয়া হয়ে গেলে এই আকর্ষণ কেটে যাবে হয়তো এইমাত্র শোন এইজন্য কিন্তু পৃথিবীতে এত মেয়ে আছে কারো প্রতি আমার এই আকর্ষণ কেন আসে না। নাকি এই মেয়ে কোন জাদু জানে সত্যি।
ভোজন শেষ হতেই যে যার মতো করে উঠে নিজ নিজ কাজে চলে যায়।
অর্ষাও ধীরে ধীরে নিচের কক্ষের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ গম্ভীর কণ্ঠে তাকে ডেকে ওঠে—
— “অর্ষা।”
অর্ষা পিছন ফিরে তাকায়।
দেখে, দাঁড়িয়ে আছে জ্যাইম। চোখে একটা স্থিরতা, মুখে যেন কিছু বলার প্রস্তুতি।
সে ধীরে এসে অর্ষার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
— “এলিনাকে দেখে নিশ্চয়ই বুঝে গেছো… সে আমাদের দা-এর বউ হবে। ছোটবেলা থেকেই ও ওয়াজফানকে ভালোবাসে। তাদের এনগেজমেন্টও হয়ে গেছে।”
একটু থেমে, জ্যাইম গভীর চোখে অর্ষার দিকে তাকিয়ে আবার বলে,
— “আশা করি আমি কী বলতে চাইছি, সেটা তুমি ঠিকঠাক বুঝে গেছো।
কারণ আমার মতে তুমি একজন অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে।”
তার কথাগুলো ছিল নরম, কিন্তু ভেতরে ছিল সুস্পষ্ট এক ইঙ্গিত—
একটা নিরব হুমকি, কিংবা একটা সতর্ক সংকেত।
জ্যাইমের কথাগুলো শোনার পর অর্ষা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর মাথা উঁচু করে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে—
— “আমাকে এসব বলার দরকার নেই, জ্যাইম। আমি জানি কোথায়, কতটুকু, কী করতে হয়।”
তার চোখে ছিল আত্মবিশ্বাসের এক শীতল দীপ্তি। কোনো উত্তেজনা ছিল না, ছিল কেবল সংযত রাগ আর নিজের আত্মমর্যাদা।
তাদের কথার মাঝখানেই হঠাৎ সেখানে এসে উপস্থিত হয় এলিনা।
সে এগিয়ে এসে জ্যাইমের পাশে দাঁড়ায়। মুখে হালকা হাসি, কিন্তু চোখে যেন এক অনুচ্চারিত কষ্টের রেখা।
— “কি রে জ্যাইম, এত গল্প করছিস কার সঙ্গে? আমাকে তো ডাকেই না আর। এখন বুঝি তুই নতুন বন্ধু পেয়ে গেছিস! আমি কিন্তু তোর ছোটবেলার বন্ধু—এটা ভুলিস না।
বন্ধু পেয়ে গেছিস ঠিক আছে, আমাকেও মনে রাখিস, প্লিজ।”
তার কণ্ঠে মিশে ছিল অভিমান আর একরাশ মিষ্টি অভিপ্রায়।
জ্যাইম এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হালকা হাসল, তারপর নিচু স্বরে বলল—
— “তোমাকে তো চাইলেও ভুলানো যায় না, এলিনা। তুমি আমার ছোটবেলার সঙ্গী, আমার সবকিছু জানার একজন। তোমার জায়গা কেউ নিতে পারবে না।”
তার কণ্ঠে ছিল আন্তরিকতা, কিন্তু অর্ষা যেন সেখানে আরেকটি ভিন্ন স্তরের কিছু অনুভব করল—এক ধরনের গোপন দ্বন্দ্ব বা টানাপোড়েন।
এরপর জ্যাইম একটু থেমে মুচকি হেসে বলে ওঠে,
— “তুমি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, এলিনা। তোমাকে কি ভুলানো যায়?”
এলিনা কিছু না বলে মাথা নিচু করে হালকা হাসল,
তাদের কথোপকথনের মাঝেই হঠাৎ সেখানকার পরিবেশ খানিক থমকে যায়।
ওয়াজফান এসে উপস্থিত হয়।
তার আগমন যেন মুহূর্তেই নীরবতা নামিয়ে আনে চারপাশে।
তাকে দেখেই এলিনা উজ্জ্বল মুখে এগিয়ে গিয়ে একহাতে তার বাহু জড়িয়ে ধরে বলে—
— “চলো, আমায় একটু এগিয়ে দিয়ে এসো না। আমার এখন ফেরার সময় হয়ে গেছে।”
এই দৃশ্যটা যেন উপস্থিত একজনের মনে গভীর কিছু নাড়া দিয়ে গেল।
মনে হলো, কোথায় যেন কিছু একটা ছটফট করছে, অথচ ধরা দিচ্ছে না।
বারবার এমন হচ্ছে কেন? কেন এমন অনুভব? সে বুঝে উঠতে পারছে না।
ওয়াজফান নিজের চিরচেনা গম্ভীরতা বজায় রেখে ছোট্ট করে বলে,
— “চলো।”
তারপর তারা একসঙ্গে সামনে দিকে পা বাড়ায়।
কিন্তু কয়েক কদম যাওয়ার পর হঠাৎ ওয়াজফান থেমে পেছনে ঘুরে তাকায়—
তার চোখ সরাসরি খোঁজে অর্ষাকে।
সে দেখে, অর্ষা এখনও তার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না।
কোনো চোখের যোগাযোগ নেই, কোনো ভাষাহীন অভিমানের চিহ্নও নয়।
কিন্তু… জ্যাইমের সাথে ঠিকই সে হাসিমুখে কথা বলছে।
তার ঠোঁটে হালকা হাসি, কথাগুলোও স্বাভাবিক।
এই দৃশ্যটা ওয়াজফানের মনে অজানা এক ঈর্ষার স্রোত বইয়ে দেয়।
একধরনের খচখচে ক্ষোভ যেন বুকের গভীরে নেমে আসে।
কিন্তু সে নিজেই বুঝে উঠতে পারে না—
এই রাগের কারণটা কী? কেন এতটা অস্বস্তি? কেন এতটা খোঁচা লাগছে ভিতরে ভিতরে?
চোখ সরিয়ে নিয়ে ওয়াজফান চলে যায় এলিনাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য,
কিন্তু তার মনের ভেতর তখনো চলছিল এক অস্থির, অজানা দ্বন্দ্বের যুদ্ধ।
এখানে আসার পর থেকেই অর্ষা মানুষের জগতের পরিচিত পোশাকের জগৎ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে।
এ রাজ্যে নেই জিন্স, টপ, সালওয়ার-কামিজ বা চেনা কোনো পোশাকের ছায়া।
ইসাবেলা—যে এই রাজ্যের প্রাসাদে তার সবচেয়ে আপনজনের মতো হয়ে উঠেছে—প্রতিদিনই তার জন্য বেছে দেয় রাজকীয় লম্বা গাউন, হালকা অথচ অভিজাত কাপড়ের নকশা করা পোশাক।
আজও অর্ষা পড়েছে ঠিক তেমনই একটি লম্বা গাউন।
তবে আজকের পোশাকটি অন্যরকম—
এর গলার কাটটা একটু বড়, একটু নিচু।
একটু ঝুঁকলেই বুকের খাঁচা দৃশ্যমান হয়, এবং গলার কাছ থেকে কপালের নিচ পর্যন্ত ছায়ার মতো পড়ে থাকা কাপড় হালকাভাবে দুলে ওঠে।
জ্যাইমের সঙ্গে কথোপকথন শেষে অর্ষা ধীরে ধীরে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
তবে সেদিন তার চলার গতি যেন একটু ভারসাম্যহীন ছিল, অথবা পোশাকের ভারেই কী যেন এক টান তৈরি হয় পায়ের কাছে।
হঠাৎই পা হড়কে পড়ে যেতে নিতে সে সামনের দিকে ঢলে পড়ে।
কিন্তু ঠিক তখনই—
জ্যাইম ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এসে তাকে ধরে ফেলে।
এক হাতে কোমর, আরেক হাতে সামনের অংশে তাকে সামলাতে গিয়ে তার হাত আচমকাই পড়ে অর্ষার বুকে।
পোশাকের ঢিলেঢালা গলা সামান্য নেমে গিয়ে সেই মুহূর্তে অর্ষার বুকের খাঁচা স্পষ্ট হয়ে দেখা যায়।
মুহূর্তটা ছিল খুব ক্ষণিকের, কিন্তু ভেতরে যেন সময়টা থমকে দাঁড়ায়।
অর্ষার চোখ বিস্ফারিত, তার মুখে বিস্ময় আর অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট।
জ্যাইমও হতভম্ব, কিন্তু পরক্ষণেই নিজের হাত সরিয়ে নেয়, মুখ নিচু করে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকে।
অর্ষা ধীরে নিজেকে সামলে নেয়, পোশাক ঠিক করে নেয়।
তার ভেতরে তখন অজানা এক অস্থিরতা, এক অনুভূতির ভার।
ঠিক সেই মুহূর্তেই—
যখন অর্ষা জ্যাইমের বাহুতে থমকে দাঁড়িয়ে, চোখে বিস্ময় আর লজ্জার অস্থির ছাপ—
ঠিক তখনই দূর থেকে এসে দাঁড়ায় একজন।
আর সেই একজন ছিল ওয়াজফান।
প্রাসাদের করিডোরের ছায়া মাড়িয়ে সে থেমে দাঁড়ায় সেই দৃশ্যের সামনে।
তার চোখে পড়ে, অর্ষার ঢিলে গলার পোশাক কিছুটা সরে গিয়ে বুকের অংশটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে,
আর জ্যাইমের হাত… স্পর্শ করছে সেই জায়গাটা।
চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কয়েকজন পুরুষ জ্বীনও চুপি চুপি তাকিয়ে ছিল ঠিক সেই দিকেই।
এই দৃশ্যটাই যেন ওয়াজফানের ভেতরের সমস্ত সংযমকে মুহূর্তে ভেঙে চুরমার করে দেয়।
তার চোখের লাল মণিগুলো হঠাৎ জ্বলতে জ্বলতে সোনালী রঙে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে—
ঝলসে ওঠে এক ভয়ানক রূপে।
সেই চোখ যেন আগুনের শিখা ছুঁড়ে দিচ্ছে চারদিকে।
মুখ ফাটিয়ে সে এক গর্জনে ফেটে পড়ে—
এক হুংকার, যা যেন পুরো প্রাসাদ কাঁপিয়ে দেয়।
ওয়াজফান যেন মুহূর্তেই রূপ নেয় আগ্নেয় এক অগ্নিদেবতার।
কোনো কিছু বলার বা বোঝার সুযোগ না দিয়ে সে সোজা এগিয়ে আসে অর্ষার দিকে।
তার চোখে ছিল দাউদাউ আগুন, চোয়াল শক্ত, নিঃশ্বাস প্রলয়ের মতো ভারী।
সে অর্ষার হাত এক ঝাঁকুনিতে ধরে ফেলে।
অর্ষা কিছু বোঝার আগেই সে টেনে নিতে থাকে তাকে করিডোর ধরে উপরের দিকের ঘরের দিকে।
চারপাশের সবাই হতচকিত, কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।
ওয়াজফান কারও কথা শোনার অবকাশ রাখে না।
তার হাতে ধরা অর্ষা যন্ত্রণায় মুখটা সামান্য কুঁচকে ফেললেও কিছু বলতে পারে না,
কারণ সে স্পষ্ট বুঝে গেছে—এই মুহূর্তে ওয়াজফান ঠিক সেই রূপে আছে,
যেখানে সে কেবল ছিঁড়ে ফেলার মতো ক্ষিপ্র, হিংস্র ও নিয়ন্ত্রণহীন।
উপরের ঘরে পৌঁছেই ওয়াজফান সজোরে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।
ধপ করে সেই দরজার শব্দ পুরো প্রাসাদে গর্জে ওঠে।
ঘরের ভেতরে পড়ে থাকে শুধু নিস্তব্ধতা, এক অস্থির নিঃশ্বাসের ভার, আর অর্ষার বুক ধুকপুক শব্দে কাঁপতে থাকা নিঃসঙ্গতা।
এই আতঙ্ক, অধিকার আর আগুনের সংমিশ্রণ
দরজাটা বন্ধ হতেই ঘরের ভেতর ভারী নীরবতা নেমে আসে।
ওয়াজফানের চোখে তখনো আগুন, শ্বাসজুড়ে জ্বালা।
সে একটুও সময় নষ্ট না করে অর্ষাকে সামনে টেনে এনে দাঁড় করায়।
তারপর হঠাৎ—
চপাৎ!
এক ভয়ঙ্কর থাপ্পড় এসে পড়ে অর্ষার গালে।
ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে যায় যে, অর্ষা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথা কেঁপে ওঠে।
চোখে জল এসে পড়ে না, তবু ভিতরের শক এত গভীর যে সে কিছুক্ষণ বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আজ তার চোখে এমনিও ছিল অভিমান, ক্ষোভ আর বিষণ্নতা—
আর সেই ক্ষোভ যেন মুহূর্তেই দ্বিগুণ হয়ে ওঠে।
সে কিছু বলতে যাবে, হালকা কাঁপতে থাকা ঠোঁট খুলে কথা শুরু করতে চায়—
ঠিক তখনই…
আরেকটি চড়—এবার আরও জোরে, আরও হিংস্র।
অর্ষা সোজা ছিটকে পড়ে মাটিতে।
ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরতে থাকে, রক্ত লাল হয়ে মুছে দেয় তার নরম ঠোঁটের কোণাগুলি।
চোখে অন্ধকার নামতে থাকে।
মাথাটা ঘুরে যায়।
মাটির ঠাণ্ডা ছোঁয়ায় তার হৃদয়ে এক ধরণের অসহায়তা ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু এখানেই থেমে থাকে না সেই ক্রোধ।
ওয়াজফান আবারও জ্বলে ওঠে।
সে নিচু হয়ে অর্ষাকে মাটি থেকে তুলে নেয়—
তার গলা চেপে ধরে, এতটাই জোরে যে অর্ষার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
চোখে রক্তিম জ্বালা, মুখে বিকৃত ক্রোধ নিয়ে সে গর্জে ওঠে—
— “অনেক শক্ত নিজেকে, তাই না? বিলিয়ে দিচ্ছিস শরীর?
দেখাতে চাস না পরপুরুষকে নিজের এই শরীরটা?
অনেক মজা হয় তো নিজের বুক দেখিয়ে সবাইকে তাকাতে দেখলে?”
তার কণ্ঠে ছিল শুধু হিংস্রতা নয়,
ছিল একরাশ পুঞ্জিভূত ঈর্ষা, দগ্ধ অভিমান,
আর নিজের ভিতরের অদ্ভুত আকর্ষণকে বোঝাতে না পারার এক ভয়ংকর অভিমানী ঘৃণা।
অর্ষা তখনো অসাড়, নিঃশ্বাসের জন্য হাঁপাচ্ছে,
আর চোখে জমা হচ্ছে না বলা হাজারো প্রশ্ন, ঘৃণা আর আত্মসম্মানের রক্তাক্ত টুকরো।
এই ভয়াবহ, বিস্ফোরণময় মুহূর্তে…
ঘরের দেয়ালের মতো নিস্তব্ধ হয়ে
ঘরের বাতাসটা ভারী হয়ে উঠেছে।
ওয়াজফানের চোখে এখন আগুনের লাল আভা। ওর মুখের চোয়াল শক্ত, নাকের পাখা ফুলে উঠেছে রাগে আর অধিকার বোধে।
যেন কোন ক্ষুধার্ত বাঘ তার শিকারের চারপাশে ঘুরছে।
সে গর্জে উঠে বলতে থাকে পর পুরুষের ছোঁয়া নিতে তোর এত ভালো লাগে?”
তার কণ্ঠটা গম্ভীর, নিচু, কিন্তু যেন বিষ ছড়িয়ে দেয় বাতাসে।
অর্ষার বলেই বুকের কাছে তার শক্ত বাহু দিয়ে অর্ষার জামা চেপে ধরে।
চোখের সামনে চোখ। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস লড়ছে।
ওয়াজফান মুখটা কাছে এনে ফিসফিস করে বলে
তুই চাস তোর দুনিয়ায় ফিরতে ? ঠিক আছে। আমি তোকে ফিরিয়ে দেব। শুধু একটা রাত… একটা মাত্র রাত আমায় দে।”
“আজ রাতটা আমায় দিবি, অর্ষা… তাহলে কাল তোকে তোর দুনিয়ায় ফিরিয়ে দিয়ে আসবো। তুই মুক্ত… শুধু এই এক রাতের বিনিময়ে।”
তার ঠোঁটের কোণে হাসি, কিন্তু সেটা প্রেমের নয়—নোংরা মালিকানার, বিকৃত কামনার।
এই অবধি সব সহ্য করেছিল অর্ষা।
শরীরের ঘায়ে ক্ষত হয়েছিল, মনে অপমানের আগুন জ্বলছিল, চোখের নিচে অঘুম জেগে ছিল।
কিন্তু এই কথা… এই প্রস্তাব?
এ যেন তার অস্তিত্বের উপর বিষ ঢেলে দেওয়া।
তার শরীরটা এক মুহূর্তে কেঁপে ওঠে, কিন্তু সেটা ভয়ের নয়, বিদ্রোহের।
চোখের তারায় আগুন জ্বলে ওঠে।
সে ধীরে ধীরে ওয়াজফানের দিকে তাকায়।
চোখে ভয় নেই, আছে জ্বলে ওঠা এক দাহ—ঘৃণার দাহ।
তার কণ্ঠ শুকনো, গলার স্বর ফাটছে রাগে, কিন্তু শব্দগুলো ধারালো ছুরির মতো— এরপর একটা শব্দ
ঠাসসসস
আকাশ ফেটে গর্জে ওঠে যেন অর্ষার থাপ্পড়ের শব্দে।
তার সারা রাগ, অপমান, ঘৃণা—সব মিলিয়ে ওই এক থাপ্পড়ে যেন সে তার অস্তিত্বকে রক্ষা করল।
এরপর অর্ষার গর্জন আকাশ কাঁপিয়ে বলে ওঠে—
কি ভাবেন আপনি নিজেকে? হবেন আপনি এই রাজ্যের বাদশা,
কিন্তু আমার চোখে আপনি কিছুই না…
কিছুই না।”
তার কণ্ঠে বজ্রের ঝড়, আগুনের দাহ। প্রতিটি শব্দ যেন ছুরি হয়ে বিঁধে যায় ওয়াজফানের বুক চিরে।
“আপনার সাহস কী করে হলো এমন একটা নোংরা প্রস্তাব আমাকে দিতে?
আমি আপনার মতো না। আমি শরীর নই, আমি মানুষ।
আপনি নিজে তো একজন নির্লজ্জ, লম্পট, চরিত্রহীন ব্যক্তি!
আমাকে কি নিজের মত মনে করেন?”
ওয়াজফান নড়ে না।
তার চোখে এবার জ্বলছে অপমান, বিস্ময়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি—পরাজয়ের শীতলতা।
অর্ষা এগিয়ে আসে এক পা, বুক উঁচিয়ে, ঠোঁট কাঁপছে রাগে।
“নিজে তো ফিয়ান্সে থাকা সত্ত্বেও দিনের পর দিন একটা পর নারীকে ছুঁয়ে যান—
কারণে অকারণে, সুযোগ পেলেই আমার ঠোঁটে হামলে পড়েন!
আপনি কি জানেন লজ্জা কাকে বলে?”
তার দুচোখে এখন ঘৃণার জলোচ্ছ্বাস। গলার স্বর খানখান হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু থেমে নেই সে।
বিয়ে করেছেন একজনকে, আর ভোগ করতে চান আরেকজনকে?
এই আপনিই? রাজ্যের আদর্শ?
নাহ! আপনি শুধুই এক ঘৃণ্য লোভী পুরুষ।
শরীরের জন্য একটা মেয়েকে এভাবে আটকে রেখেছেন।
অর্ষার গর্জন থেমে যায়।
ঘরটিতে নেমে আসে এক মুহূর্তের নিঃশব্দ ধ্বনি।
তবে সেই নীরবতা ছিল না শান্তির, বরং এক আগ্নেয়গিরির অস্থির প্রতীক্ষা।
ওয়াজফানের চোখ দুটো জ্বলে ওঠে।
সে যেন আর নিজের মধ্যে নেই, তার ভিতরের পশুটি যেন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।
চোখের তারায় আগুন, মুখের রেখায় ঘৃণা আর লাঞ্ছনার প্রতিচ্ছবি।
হঠাৎই—
সে দপ করে অর্ষার হাতটা চেপে ধরে।
আচমকা, অর্ষা বুঝে ওঠার আগেই তার বাহুটা পেছনে ঘুরিয়ে দেয় ভয়ংকর এক মোচড়ে।
“আআআআআআআআ!”
একটানা আর্তনাদ করে ওঠে অর্ষা।
একটা বিকট শব্দ—হাড় ভাঙার কড়মড় শব্দ, ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
তারপরেই ব্যথার তীব্রতায় জ্ঞান প্রায় হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা।
অর্ষার কণ্ঠ ফেটে যায় যন্ত্রণায়, সে এত জোরে চিৎকার করে যে প্রাসাদের দেয়াল কেঁপে ওঠে।
ওয়াজফান সেই চিৎকারে স্থির হয়ে যায়।
সেই মুহূর্তে…
সেই চিৎকার যেন তাকে কাঁপিয়ে দেয় ভিতর থেকে।
হঠাৎ যেন একটা আয়না ভেঙে পড়ে তার সামনে।
এই মেয়েটি তো কখনো এমন করে চিৎকার করে না।
সে বুঝে যায় হাতের করুন অবস্থা করে ফেলেছে সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে।
সে হাতটা ছেড়ে দেয়।
অর্ষা ধপ করে মাটিতে পড়ে যায়।
সে কাঁপছে, কাতরাচ্ছে, বাম হাতটা বুকের কাছে চেপে ধরে ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে।
চোখে জল, মুখে ফ্যাকাশে ছায়া—সে যেন হাহাকার করছে নিজের অস্তিত্বের জন্য।
ওয়াজফান দাঁড়িয়ে থাকে, নিঃশ্বাস বন্ধ।
তার বুকের ভিতরে যেন কেউ ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে।
তার ভেতরটা এক অজানা যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে উঠছে।
সে চায়…
চায় গিয়ে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরতে, হাতটা ধরে বলতে, “আমি দুঃখিত…”
কিন্তু সে পারে না।
তার ভিতরের দানব অস্তিত্ব তাকে এটা করতে দেয় না।
তবে সে চুপ করে দাঁড়িয়েও থাকতে পারে না।
সে ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়।
বাইরে এসে নিঃশ্বাস নেয়—ভেতরটা যেন আগুনে দগ্ধ হচ্ছে।
তার ঠোঁট ফাটছে, চোখ লাল, কিন্তু এখনও ঠোঁট শক্ত করে চেপে রেখেছে সে।
তারপর রাজ্যের প্রধান চিকিৎসককে আদেশ দেয়,
“তাকে দেখে যাও… এখনই।”
চিকিৎসক কিছু না বুঝে দৌড়ে যায় অর্ষার ঘরের দিকে।
ওয়াজফান দাঁড়িয়ে থাকে সিঁড়ির কিনারায়, একা।
তার মনে শুধু বাজছে অর্ষার সেই আর্তনাদ—
“আআআআআআআ!”
সেই চিৎকার এখন তার বুকের ভিতর প্রতিধ্বনি তুলছে।
যেন নিজের হাতেই নিজেকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে।
আর ঘরের ভিতর—
একটি ভাঙা মেয়ে পড়ে আছে মাটিতে।
ভাঙা হাত, ভাঙা বিশ্বাস, ভাঙা শরীর—তবু ভিতরে জ্বলছে তার অস্তিত্বের আগুন।
চিকিৎসক অর্ষা হাতটা দেখে বুঝে যায় এটা ভেঙে গেছে যে কোন মত একটা ব্যান্ডেজ করে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে অর্ষা ঘুম পাড়িয়ে এরপর চলে যায়।
নিচে গিয়ে ওয়াজফান কে বলে যায় মেয়েটার হাতটা বাজে বাজে ভেঙে গেছে আর এটা প্রশিক্ষণ ডাক্তার ঠিক করতে পারবে তার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে বা আপনার কাছে তো জাদু শক্তি আছে সব ব্যথা সাড়ানোর আপনি চাইলে নিজেই ঠিক করে দিতে পারেন এতটুকু বলে মাথা নিচু করে চলে যায়।
রাতের আকাশে চাঁদ লুকানো। প্রাসাদের চারদিক নিস্তব্ধ, যেন সমস্ত কিছুর নিঃশ্বাস থেমে আছে।
অর্ষা গভীর ঘুমে।
চিকিৎসকের দেওয়া ঘুমের ইনজেকশনে এখনো তার শরীর অবচেতন, চেতনার স্তরে কেবল হালকা স্বপ্নের ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
কিন্তু হঠাৎ…
এক অজানা অনুভব তাকে ঘুমের গাঢ়তা থেকে টেনে তুলতে শুরু করে।
কারও দৃষ্টি।
কারও নিঃশ্বাস খুব কাছ থেকে এসে মিশছে তার গালের পাশে।
একটা ছায়া তার মুখের উপর ঝুঁকে আছে।
নরম নিঃশ্বাসের গতি তার চুলে লেগে গেছে।
ধীরে ধীরে চোখ মেলে অর্ষা।
চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে প্রথমে সে কেবল আবছা কিছু দেখতে পায়।
তখনো ঘুমের প্রভাব পুরোপুরি কাটেনি।
তবে এক ঝলকে যেটুকু দেখে—তা তার শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে তোলে।
ওয়াজফান।
তার মুখটা খুব কাছে।
চোখে একধরনের অভিভূত মুগ্ধতা।
যেন কোনো অজানা আবেগ তাকে ঘুমন্ত অর্ষার দিকে টেনে এনেছে।
তার দৃষ্টিতে হিংস্রতা নেই।
বরং গভীর কিছু—অব্যক্ত আকর্ষণ, অথবা কিছু অন্য রকম।
অর্ষা দম ফেলে। ভয় আর বিস্ময়ের মাঝে হঠাৎ তার চোখে দুপুরের স্মৃতি ভেসে ওঠে।
সে নিজের হাতটা নাড়ায়।
কিন্তু…
ব্যথা নেই।
সে আবার নাড়ায়।
না, সত্যিই কোনও ব্যথা নেই।
যে হাত দুপুরে ভেঙে গিয়েছিল বলে মনে হয়েছিল, এখন সে একেবারে স্বাভাবিক।
কোনো ফোলা নেই, ব্যথার ছিটেফোঁটা নেই। যেন কিছুই ঘটেনি।
কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?
তার এই বিভ্রান্তির মাঝেই, হঠাৎ…
ওয়াজফান দু’হাত বাড়িয়ে অর্ষার দুই গালে আলতোভাবে ছুঁয়ে দেয়।
তার কণ্ঠটা নিচু, নরম, কিন্তু অসহ্যভাবে তীক্ষ্ণ—
“আমি জানি না আমার অনুভবের উৎস কোথা থেকে আসে…
এটা কি শুধুই আকর্ষণ? নাকি কিছু বেশি?
আমি সত্যিই জানি না, কিন্তু আমি জানি—
আমি তোমায় চাই।
একদিনের জন্য হলেও চাই।
হয়তো তখন আমার ভিতরের এই যন্ত্রণা একটু কমবে…”
তার ঠোঁটে কষ্ট, চোখে তৃষ্ণা—
কিন্তু এই অনুভবটা যতই আবেগময় হোক, অর্ষার হৃদয়ে তা শুধুই বিষ।
সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে।
তার চোখ জ্বলছে, নিঃশ্বাস ঘন।
তার মুখে সাহস আর ক্ষোভ একসঙ্গে ফুটে ওঠে।
সে সরে যায় ওয়াজফানের ছোঁয়া থেকে,
আর তীব্র, রুদ্ধ কণ্ঠে বলে—
“আজকের পর আপনি যদি আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টাও করেন…
তাহলে আমি শপথ করছি—নিজেকে শেষ করে দেব।”
ওয়াজফান থমকে যায়।
অর্ষা কাঁপতে কাঁপতে বলে যেতে থাকে—
“রোজ রোজ আপনার এই স্পর্শে আমি তিলে তিলে মারা যাচ্ছি।
আর না!
আমি পুরোটা শেষ করব একবারে…
আপনার লোভের খেলায় আমি আমার প্রাণ দিয়ে অবসান ঘটাব।”
এক মুহূর্তে যেন ঘরের বাতাস জমে যায়।
ওয়াজফান দাঁড়িয়ে থাকে পাথরের মতো।
তার চোখে বিস্ময়, যন্ত্রণা।
এমন কথা সে আশা করেনি।
একসময় যে মেয়েটাকে নিজের হাতে মারতে চেয়েছিল ,যাকে যন্ত্রনা দেওয়ার জন্য এখানে তুলে নিয়ে এসেছে,
যাকে আঘাত করতে চেয়েছিল…
আজ সেই মেয়েটার মুখে মৃত্যুর শপথ শুনে যেন তার নিজের বুক চিরে কিছু একটাকে ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে।
কিছু বলতে গিয়েও সে চুপ করে যায়।
তার চোখে এক মুহূর্তের তীব্র যন্ত্রণা ছায়া ফেলে।
Death or Alive part 15
তারপরে সে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।
একটা ভাঙা শব্দে দরজাটা খুলে…
ওয়াজফান বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
আর অর্ষা?
সে পড়ে থাকে বিছানার কোণে।
নিজের বুকে হাত রেখে, চোখের কোণে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
ভেতরে জ্বলছে আত্মসম্মানের বিষাদ-নিঃশ্বাস।
তবু সে আজ নিজেকে হারায়নি।
