Death or Alive part 19

Death or Alive part 19
priyanka hawlader

সূর্য তার নরম সোনালি আঙুল দিয়ে ছড়িয়ে আছে আকাশে তবে সেই আলোর তাপ পাহাড় এর ভিতরে পৌছায় না।শুধু তার আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরের মেঝেতে আলতোভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে। চারদিকে এক নির্জন অথচ মায়াময় সকাল। পাখিদের কিচিরমিচির, দূরের গাছের পাতায় শিশিরের ঝিকিমিকি—সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন নতুন জীবনের গান গাইছে। অথচ এই সুন্দর সকালের মাঝেও অর্ষার হৃদয়জুড়ে ঘন এক অন্ধকার।
সে জানালার পাশে নিজের ছোট্ট রকিং চেয়ারে বসে আছে, দু’হাত নিজের কোলের ওপর রাখা, চোখ দুটি স্থির বাইরের দিগন্তে। এই সকালের সৌন্দর্য তার অন্তর্জগতকে ছুঁতে পারছে না। কারণ, তার ভিতরে চলছে এক তীব্র ঝড়।
নিজের মনে ভাবছে,

“কি হয়ে গেল আমার সাথে? আমার তো স্বপ্ন ছিল একদম অন্যরকম… নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে ভালোবাসা থাকবে এমন কাউকে নিয়ে… অথচ আমার জীবন তো এক রূপকথার বদলে হয়ে গেল এক অদ্ভুত জাদুর দুঃস্বপ্ন। এক জিন… হ্যাঁ, আমি এক জিনকে বিয়ে করেছি! এটা কি কখনো সম্ভব ছিল ভাবা?
তার চোখ ধীরে ধীরে ছলছল করে ওঠে, কিন্তু সে কাদে না, সে আরও ভাবে,
“বিয়ে তো হয়ে গেল। সবকিছুর সীমারেখা পার করে এখন তো সে আমার স্বামী… আমি কি মেনে নেব এই সম্পর্কটাকে? আমি কি সত্যিই তাকে ভালোবাসি? আমার অনুভূতিগুলো কেন এত এলোমেলো লাগছে? কখনো মনে হয় আমি তার দিকে টানছি, আবার কখনো মনে হয় না সে আমার কেউ না।
সে চোখ বন্ধ করে একদৃষ্টিতে মনে করতে চেষ্টা করে ওয়াজফানের সেই কথাগুলো—
একবার যদি কোনো মেয়েকে আমি আমার ভাবি তবে , সে চিরকাল আমার। এখন থেকে আমি তোমার স্বামী আমার পুরো অধিকার আছে তোমার উপর।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই কথাগুলোই যেন এখন বারবার অর্ষার অন্তরে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সে মনে মনে বলে ওঠে,
“ওয়াজফান তো ঠিকই বলেছে… আমরা মুসলিম মেয়েরা একবার বিয়ে হলে সেই সম্পর্কটাকেই মানি, যেটাই হোক না কেন। আমি কি তাহলে সত্যিই তার স্ত্রী হয়ে উঠব? আমি কি তাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারি?”
তার বুকের মাঝে গভীর একটা দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বিয়ের বন্ধন, সামাজিক দায়বদ্ধতা, আত্মসম্মান আর আবেগ—সব কিছু মিলেমিশে এখন অর্ষার হৃদয় এক অদৃশ্য ভারে নুয়ে পড়ছে।
একদিকে ভয়, অন্যদিকে অজানা এক মুগ্ধতা… আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক দিশেহারা অর্ষা।
ভাবনার মাঝে,

হঠাৎ করেই এক অদ্ভুত ব্যথা টের পেল সে—পেটের নিচে ধীরে ধীরে জ্বালা করে ওঠা চিনচিনে যন্ত্রণা। প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারেনি, তবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সব স্পষ্ট হয়ে যায়। তার দেহের অভ্যন্তর থেকে যে সংকেত আসছিল তা ছিল পুরনো, পরিচিত এক বাস্তবতার—হ্যাঁ, এটা তার পতি মাসের ব্যথা। আগের মাসে অনিয়মের কারণে তা হয়নি, তাই এবার যন্ত্রণা যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে।
অর্ষার মন ছটফট করতে লাগল। এখন সে কী করবে? এখানে তো কেউ তার মত না, কেউ বুঝবে না এই শারীরিক বাস্তবতা। এই রাজ্যে কেউ নেই যাকে নির্দ্বিধায় বলা যায়—না কোনো বন্ধু, না কোনো স্নেহভাজন।
একজন ছিল ইসাবেলা কিন্তু সেও তো রাজ্যে নেই এখন।

ব্যথা ক্রমশ বেড়ে চলছিল। সে ধীরে ধীরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল, শরীরটা কুঁচকে আসছিল যন্ত্রণায়। এমন সময় ঘরের পাশ দিয়ে এক দাসী যাচ্ছিল, অর্ষা কষ্টে গলা তুলে ডাকল তাকে।
– “শোনো… আমার… আমার পিরিয়ড হয়েছে… তুমি কি একটু ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?”
কথাগুলো বলে সে চোখ মুছল, যন্ত্রণার মাঝে একটুখানি আশার আলো খুঁজছিল মেয়েটি। কিন্তু দাসী তার দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মনে হল, সে যেন একেবারেই কিছু বোঝেনি।
আর বোঝার কথাও না। এ রাজ্যে সবাই তো জিন আর পরী—এদের শরীরে মানবীর মত ঋতুচক্র চলে না, এদের জীবনে নেই সে রকম কোনো বাস্তবতা। দাসী এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে যায়, যেন কোনো অপারগতা বোঝাতে না পেরে মুখ লুকোতে চায়।

আর অর্ষা?
সে একা পড়ে থাকে ঐ বিশাল শূন্য বিছানায়, দুই হাঁটু ভাঁজ করে বুকের দিকে টেনে নিয়ে পেট চেপে ধরে। মুখে চাপা কান্নার শব্দ, চোখে অবিরত জল। যন্ত্রণা শুধু শরীরের না, মানসিক এক ঘোর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল সে। এত এত জাঁকজমকের মাঝে, এত অলৌকিক শক্তির মধ্যে, একজন সাধারণ মানবী হয়ে তার এই নিঃসঙ্গতা যেন আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছিল।
চোখের কোনায় জল, বুকের গভীরে চাপা আর্তনাদ—অর্ষা শুধু মনে মনে বলে,
আমি কাকে বলব? এই রাজ্যে কেউ কি আছো, যে একটু আমাকে বুঝবে?”
ঘরের এক কোণে রাখা জলপাত্রের পাশে সেই অদ্ভুত নীরবতা—যেন রাজ্যের সব শব্দ, সব আলো নিঃশব্দে দেখে যাচ্ছে তার এই একাকী লড়াই।

অর্ষার রুম থেকে বের হওয়ার পরে দাসী ওয়াজফান এর রুমের সামনে দিয়ে নিচে যাচ্ছিল।
তাকে যেতে দেখে, দূরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ওয়াজফানের চোখ চেপে বসে। ঠোঁটের কোণে টান, চোখে রহস্যের ছায়া—কিন্তু তার চেয়েও বেশি, এক অদ্ভুত উদ্বেগ। সে দাসী কে ডাক দেয়,
“এই যে… শোনো। যাও অর্ষার কক্ষে। গিয়ে বলো—বাদশা ডাকছেন তাকে।”
ওয়াজফানের নির্দেশে দাসী নিচু মাথায় সম্মান জানিয়ে বলে ওঠে, “বাদশা, আমি সেখান থেকেই আসছি। তিনি… পেট চেপে কাঁদছিলেন। আমাকে কিছু আনতে বলেছিলেন, কিন্তু আমি কিছুই বুঝিনি। তাই অন্যদের ডাকতে যাচ্ছিলাম…”

‘কাঁদছে’—এই একটিমাত্র শব্দ যেন বজ্রাঘাতের মতো নেমে আসে ওয়াজফানের ওপর। তার হৃদয়ের গভীরে যেন কোথাও কেঁপে ওঠে অব্যক্ত যন্ত্রণা, আগুন জ্বলে ওঠে চোখে। মুহূর্তের একটুও দেরি না করে সামনে এগিয়ে যায় সে, রাজসিক অথচ ব্যাকুল ভঙ্গিতে।
হাঁটার শব্দে যেন কেঁপে ওঠে করিডোরের বাতাস। দাসী কিছু বলার সুযোগ পায় না, শুধু শুনতে পায় ওয়াজফানের একমাত্র নির্দেশ—
“তুমি যাও। আমি দেখছি কি হয়েছে,

এই বাক্যেই লুকিয়ে থাকে হাজারো আবেগ, অধিকার, আর এক দহনকাতর ভালোবাসার গোপন আগুন।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে অর্ষার কক্ষে প্রবেশ করল। ঘরের আবছা আলোয় তার চোখে ধরা পড়ল বিছানায় শুয়ে থাকা মেয়েটির কাঁপতে থাকা শরীর। ফর্সা মুখটা যেন লাল হয়ে উঠেছে কান্নায়, দুই হাতে পেট চেপে ধরে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছে সে। চোখে অশ্রু, ঠোঁটে নিঃশব্দ আর্তনাদ।
ওয়াজফান মুহূর্তেই ছুটে গেল অর্ষার পাশে। গম্ভীর মুখে ঝুঁকে পড়ে আলতো করে তার মাথাটা নিজের কোলের কাছে তুলে ধরল। তারপর দু’হাত দিয়ে গালে জমে থাকা অশ্রু মুছে দিতে দিতে গভীর এক স্নেহমাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
কি হয়েছে জান? কাঁদছ কেন?

ওয়াজফান-এর ছোঁয়ায় অর্ষা যেন একটু চমকে উঠল। চোখ তুলে তাকাতেই লজ্জায় গালটা লাল হয়ে উঠল তার। সে কিছুটা শরীর সরিয়ে নিতে চাইল, তবে পেটের যন্ত্রণা তাকে আর ততটুকুও নড়তে দিল না। ব্যথায় মুখটা তীব্র কষ্টে কুঁচকে উঠল। পেটের ওপর হাত রাখতেই সেই ব্যথা যেন দ্বিগুণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত দেহে।
ওয়াজফান তার অবস্থা দেখে আরো কাছে চলে এল। গভীর উদ্বেগে বলল,
পেটে ব্যথা? জান, তুমি চিন্তা করো না… আমি আছি, আমি ঠিক করে দিচ্ছি এখনই।
বলেই সে ডান হাতটা অর্ষার পেটে নিয়ে যেতে চাইলে, তার আঙুল থেকে হালকা সোনালী আভা জ্বলজ্বল করতে লাগল—এক রহস্যময় জাদু শক্তির প্রস্তুতি।

কিন্তু ঠিক তখনই, অর্ষা হঠাৎ ভয় আর কষ্টে মিশে যাওয়া এক চিৎকারে বলে উঠল,
না! করবেন না! এটা… এটা সাধারণ ব্যথা না। প্লিজ… আপনি কিছু করবেন না।”
ওয়াজফান স্তব্ধ হয়ে গেল। হাতটা থেমে গেল মাঝপথেই। তার সোনালী আলো নিভে গেল। তার চোখে ধরা পড়ল এক গভীর উদ্বেগ, এক অসহায়তা।
এরপর ওয়াজফান ভ্রু কুঁচকে অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলে,
কি বলছো তুমি? ব্যথা আবার সাধারণ আর অসাধারণ হয় নাকি?
তার কণ্ঠে বিরক্তি আর অধৈর্যতা, যেন এই ‘ব্যথা’ বিষয়টা তার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে।
আচ্ছা চলো,— হঠাৎই সিদ্ধান্ত নেয় সে — তোমাকে এখনই রাজ বৈদ্যের কাছে নিয়ে যাই।
একটুও সময় নষ্ট না করে, কোনো অনুমতির তোয়াক্কা না করে ওয়াজফান একঝটকায় অর্ষাকে কোলে তুলে নেয়।
অর্ষা হতবাক। কিন্তু হঠাৎই—

ওয়াজফানের হাত ছুঁয়ে যায় অর্ষার পায়ের নিচে…
আর সেই মুহূর্তেই তার আঙুলে রক্ত লেগে যায়।
গা শিউরে ওঠা এক ধাক্কায় সে থমকে দাঁড়ায়।
তার চোখ ছানাবড়া। রক্তমাখা আঙুলের দিকে তাকিয়ে ক্রমেই তার দৃষ্টিতে ছায়া নামে—
“এই রক্ত কেন?” – গর্জে ওঠে সে।
চোখ লাল। নিঃশ্বাস গরম।

আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে ওয়াজফান দরজার দিকে পা বাড়ায়।
তার চোখে এখন আর কৌতূহল নেই, আছে ভয়ানক এক উন্মত্ততা।
সে বেরিয়ে যাবে। নিয়ে যাবে অর্ষাকে। যেভাবেই হোক।
কিন্তু ঠিক তখনই…
“প্লিজ! প্লিজ থামুন!” — হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে অর্ষা।
ভয়ের সুর কণ্ঠে।
“আমি বলছি… আমি বলছি কি হয়েছে… প্লিজ… কোথাও যাবেন না…”
অর্ষার চোখে জল। তার ঠোঁট কাঁপছে।
সেই নিরীহ, নিঃসঙ্গ কণ্ঠস্বরটা যেন এক তীব্র আকুতি হয়ে বাতাসে ভেসে ওঠে।
ওয়াজফান থেমে যায়।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে… অর্ষা মুখে তাকায়।
অর্ষা একটু কাঁপা কাঁপা হাতে ওয়াজফানের জামার আঁচল ধরে।
ধীরে কাছে গিয়ে মুখটা একটু সামনে এনে, কানের কাছে মুখ নত করে ফিসফিসিয়ে বলে—
“এই ব্যাথাটা… পেটে ব্যাথা… এটা মেয়েদের হয়…”
ওয়াজফান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। অর্ষার কথা শুনছে।
প্রতিটি মাসেই হয়… এটা মানুষ মেয়েদের হয়…
তার কণ্ঠটা নরম, যেন একটু শুদ্ধতা মেশানো লজ্জা।
আর এটা কেন হয়, সেটা বুঝবে… এটা শরীরের একটা নিয়ম… আর এটা কাউকে বলা যায় না…
তার চোখে সেই কথার গভীরতা।
আমি তাই বলিনি কিছু, কারণ এটা বলা যায় না…

আবেগে গলা ভারী হয়ে আসে।
এই সময় মেয়েদের কিছু দরকার হয়… গরম জল… আরামদায়ক কাপড়… নেপকিন একটু ঘুম… নরম খাবার… আর শান্তি…
তার চোখ নামানো, কণ্ঠ স্বচ্ছ লজ্জায় আচ্ছন্ন।
এক মুহূর্ত নীরবতা।
ওয়াজফান ধীরে পেছনে ফিরে তাকায়।
তার চোখে যেন প্রথমবার কোনো কিছুর উপলব্ধি জন্ম নেয়।
সে তাকিয়ে থাকে অর্ষার দিকে… আর কিছু না বলে…
এরপর ধীরে ধীরে তাকে বিছানায় শুইয়ে দেয় আর বলে তুমি থাকো আমি আসছি এখুনি এরপর সে চলে যায় নিজের রুমে সেখানে গিয়ে গুগল সব জেনে নেয় আর এরপর সেই অনুযায়ী সব আনিয়ে নেয়।
এরপর আবার ফিরে আসে অর্ষার রুমে,
তারপর এক হাত দিয়ে অর্ষাকে আবারো কোলে তুলে নেয়—
ধীরে ধীরে, যেন অর্ষা কাঁচের পুতুল।
কোনো কথা বলে না—

শুধু হাঁটতে থাকে ওয়াশরুমের দিকে।
দরজার সামনে এসে থেমে যায়।
তারপর তার হাতে সবকিছু তুলে দিয়ে বলে—
“তুমি চেঞ্জ করে এসো… আমি বাইরে আছি।”
তার কণ্ঠে নেই কোনো আদেশ, নেই কোনো ব্যঙ্গ।
শুধু এক অদ্ভুত কোমলতা।
অর্ষা মাথা নত করে কিছু বলে না।
সে ধীরে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।
ওয়াজফান ফিরে আসে ঘরে।
তার চোখ পড়ে বিছানার দিকে।
সাদা চাদরে রক্তের দাগ।
দাগ নয় যেন—একটি চরম সংকেত।
যা তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে ভেতর থেকে।
একটুও সময় নষ্ট না করে—

নিজের হাতেই সে সেই চাদরটা তুলে নেয়।
আঁচলে রক্ত লেগে যায়, তবু থামে না।
কোনো দাসীকে ডাকে না, কারো সাহায্য নেয় না।
নিজেই হাঁটু গেড়ে বসে—
নিজের হাতে একটা নতুন বিছানার চাদর বিছিয়ে দেয় বিছানায়।
ঝাঁঝালো রাজসিক সুগন্ধি, মোলায়েম তুলার চাদর।
ঘরভর্তি নিরবতা…
আর মনে মনে যেন কেউ বলে ওঠে—
“কি আজব!”

“যে বাদশার জুতা পড়ানোর জন্য দশজন দাসী সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে—সে আজ নিজে বিছানার চাদর বদলাচ্ছে!”
রাজসিংহাসনের মতো জীবনে
আজ প্রথমবার
একজন মেয়ে
তার অহংকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়ে গেছে।
ওয়াশরুমের দরজা খুলে যায় ধীরে…
অর্ষা বেরিয়ে আসে নরম কাপড় পড়া,
চোখে এখনও অস্বস্তি…
পায়ে হালকা কাঁপুনি।
সে ঠিকঠাক হাঁটতে পারছে না।
আর সেই মুহূর্তেই—
ওয়াজফান আবার কাছে এসে দাঁড়ায়।
কোনো কিছু না বলে,

সে আবারো অর্ষাকে কোলে তুলে নেয়…
যেন এটা এখন তার স্বাভাবিক দায়িত্ব।
ধীরে ধীরে এনে বিছানায় বসায়।
তার চোখে কোনো বিরক্তি নেই,
আছে অদ্ভুত এক নরমতা।
তারপর পাশে রাখা কাপ থেকে একটি ওষুধ নিয়ে আসে,
নরম কণ্ঠে বলে—
“এটা খাও, ব্যথা একটু কমবে।”
অর্ষা মুখ তুলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।
তার চোখে দ্বিধা, মুখে অল্প অসহায়তা।
তবু সে ওষুধ খেয়ে নেয়।
ওয়াজফান ধীরে ওকে শুইয়ে দেয় বিছানায়।
চাদর টেনে দেয় কোমর অবধি।
আর হাত রাখে কপালে।

কিন্তু—
পেটের ব্যথা কমছে না।
অর্ষা কুঁকড়ে যাচ্ছে,
পেট চেপে এপাশ-ওপাশ করছে।
তার কণ্ঠে শব্দ নেই,
তবু যন্ত্রণার ছায়া ছড়িয়ে আছে তার মুখজুড়ে।
ওয়াজফান বসে থাকে কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তার চোখ ধীরে ধীরে গাঢ় হয়, গভীর হয়…
হঠাৎ সে একটু নত হয়।
আর তার ঠোঁট…
ধীরে ধীরে
ডুবিয়ে দেয় অর্ষার ঠোঁটের ভাজে।
তীব্র, গভীর, সম্মোহনী এক চুমু।
অর্ষা প্রথমে চমকে ওঠে…
তবু ধীরে ধীরে তার শরীর ঢিলেঢালা হয়ে আসে…
তাকে ছুঁয়ে যায় এক ধরনের অন্য মনোযোগ।
ঠিক সেই ফাঁকে—

ওয়াজফান তার চোখ বন্ধ করে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করে মনে মনে,তার ঠোঁট এখনো অর্ষার ঠোঁটের ভাজে ডুবানো।
তার হাত এগিয়ে যায় অর্ষার পেটের দিকে…
ধীরে রাখে সেখানে…
তার হাত থেকে বের হয় এক হালকা উজ্জ্বল আলো,
উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে অর্ষার ভেতর…
এক মায়াবী শক্তি…
এক ধরণের জাদু।
অর্ষার দম বন্ধ হয়ে আসছিল কিছুক্ষণ আগে,
কিন্তু এখন…
ধীরে ধীরে তার শরীর শান্ত হতে থাকে।
ব্যথা যেন গলে যাচ্ছে সেই স্পর্শে।
চোখের কোণে জল—
কিন্তু এবার সেটা যন্ত্রণার না, স্বস্তির।
সে ধীরে চোখ বন্ধ করে নেয়।
ওয়াজফান এবার তার ঠোঁট ছেড়ে দেয়।

অর্ষা যখন একটু শান্ত হয়ে আসে, তখন ওয়াজফান ধীরে ধীরে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
তার চোখে একধরনের স্থিরতা।
সে পাশ ফিরে অর্ষার দিকে তাকিয়ে,
চুপচাপ এক মুহূর্ত—
তারপর নরম কণ্ঠে বলে,
“এবার আমার কাছে আয়।”
অর্ষা কিছু বলার আগেই,
ওয়াজফান তার কোমরে হাত রেখে
ধীরে টেনে নেয় তাকে নিজের বুকের ওপর।
অর্ষা চমকে ওঠে।
কিন্তু প্রতিবাদ করে না।
তার মাথাটা এখন ওয়াজফানের শক্ত, উষ্ণ বুকে।
ওয়াজফানের হাত ওঠে তার চুলে…
ধীরে ধীরে বুলিয়ে দিতে থাকে।
তার গলায় এক শীতল অথচ আশ্বাসময় কণ্ঠ—
“এবার দেখবে ব্যথা পুরোপুরি চলে যাবে।”
অর্ষা চোখ তুলে চুপচাপ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একটানা…

ওয়াজফান চোখ বন্ধ করে আছে।
তবু তার চেহারায় এক অপার্থিব আকর্ষণ।
কপালের রেখা, গালের গঠন, পাতলা ঠোঁটের রেখা—
সব মিলিয়ে যেন কোন ভিনজগতের শিল্পকর্ম।
একটা জিন হয়েও এত সুদর্শন!
অর্ষা মনে মনে ভাবে।
এমন একটা মানুষ… না, জিন…
যে আমার পেটব্যথা দূর করতে মরিয়া হয়ে যায়,
নিজের হাতে বিছানা গুছিয়ে দেয়,
আমাকে আগলে রাখে এমন করে…
এই লোকের প্রেমে না পড়ে পারা যাবে?
অর্ষা হারিয়ে যায় সেই মুখের প্রতিটি ভাঁজে।
ভাবনার ঠিক তখনই—

ওয়াজফানের ঠোঁট নাড়তে শুরু করে।
চোখ এখনো বন্ধ, তবুও কথা ঠিকঠাক এসে পড়ে—
“আমাকে দেখার সময় অনেক পাবে, লিটল মনস্টার,
আমি তো এখন পুরোপুরি তোমার…
শুধু আমাকেই না,
আমার আরো অনেক কিছু দেখার সুযোগ পাবে।
তবে এখন ঘুমাও।
সেই কণ্ঠে এক অদ্ভুত কৌতুক, এক ধরণের অধিকার।
অর্ষার মুখ তেতে ওঠে লজ্জায়।
সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে নেয় সে।
মনে মনে নিজেই নিজেকে বলে—
“উফফ… অসভ্য লোক!
সবসময় বাজে কথা থাকে মুখে…”
তবু তার ঠোঁটের কোণে
একটা অজান্ত হাসি খেলে যায়।
হয়তো সে নিজেও বুঝতে পারছে,

এই লোকটার অসভ্যতাই আজ তাকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ অনুভব করাচ্ছে।
অর্ষা ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে যায় এই দৃশ্যটা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে কোন এক ছায়া।
প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা একটানা ঘুমিয়ে ছিল অর্ষা।
সেই দীর্ঘ যন্ত্রণার পর শরীরটা কিছুটা হালকা, মনটা কিছুটা স্থির।
ধীরে ধীরে তার চোখ খুলে যায়…
একটা নরম আলো চুঁইয়ে পড়ছে পর্দার ফাঁক গলে।
আর তখনই সে টের পায়—
সে এখনো ওয়াজফানের বুকেই শুয়ে আছে।
হতভম্ব হয়ে ওঠে অর্ষা।
তবে পরক্ষণেই দৃষ্টি পড়ে ওয়াজফানের চোখে।
ওয়াজফান এক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে—
চোখে ঘুম নেই, ক্লান্তিও নেই…

শুধু নিঃশব্দ চাওয়া।
অর্ষা চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়।
কিন্তু ওয়াজফান ধীরে তার কপালে একটা গভীর চুমু খায়।
“ঘুম কেমন হলো?”
তার কণ্ঠে ভোরের মতো নরমতা।
“ব্যথা কি এখনো আছে?”
অর্ষা ধীরে ধীরে উঠে বসে, চুলগুলো একটু ঠিক করে নেয়,
তার কণ্ঠও ঘুম জড়ানো –
“না… নেই এখন।”
ওয়াজফান মাথায় হাত রাখে,
ধীরে বুলিয়ে দিয়ে বলে—
“ভালো। এখন তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো…
আমি দাসীকে বলছি,
খাবার দিয়ে যাবে।”
তার কণ্ঠে এখন দায়িত্ব,

তার দৃষ্টিতে একধরনের স্বাভাবিক অধিকার।
অর্ষা চুপচাপ মাথা নাড়ায়।
হয়তো কিছু বলার ছিল…
কিন্তু সে কিছু না বলেই ধীরে বিছানা থেকে উঠে পড়ে।
ওয়াজফান তখনও তাকিয়ে থাকে তার দিকে,
চোখে সেই একই প্রশ্নহীন বন্ধন—
যেটা অর্ষা না চাইলেও অনুভব করে।
দিনভর অর্ষার ঘরে ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে আছে ওয়াজফান।
তার উপস্থিতি—নিঃশব্দে রাজসভার চেয়েও ভারী।
আলতো করে ওষুধ দেওয়া, সময়মতো পানি এগিয়ে ধরা, কখনো চুপ করে বসে থাকা…
ওয়াজফানের প্রতিটি আচরণে অদ্ভুত এক যত্ন, কিন্তু তার ভেতর লুকিয়ে আছে জ্বলন্ত আগুন।
অর্ষা অনেকবার অনুরোধ করেছে, মুখে বিরক্তি চাপিয়ে—

“আমি এখন একদম ঠিক আছি।
আপনি নিজের রুমে যান… কেউ দেখলে কি ভাববে!”
ওয়াজফান চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ।
তারপর ধীরে মুখ তোলে।
চোখে অন্ধকার মেঘ জমে।
“এই সাম্রাজ্য আমার,”
— তার কণ্ঠ হিম, চোখ আগুন।
“এই প্রাসাদ, এই দেয়াল, এই বাতাস—সব আমার শাসনে চলে।
এখানে কে কি ভাববে, সেটা ঠিক করার একমাত্র অধিকার আমার।
আমার অনুমতি ছাড়া কেউ কিছু ভাবার সাহসও করবে না।”
সে একটু থামে।
তার ঠোঁটে হালকা বাঁকা হাসি,

কিন্তু সেই হাসির নিচে ভয়াবহ বিষ।
“আর তোকে নিয়ে কিছু ভাবার সাহস—
যদি কেউ মনে আনে,
তাহলে তার কলিজাটা ছিঁড়ে হাতে তুলে নেব আমি।”
অর্ষা তাকিয়ে থাকে চুপ করে,
ঠিক তখনই ওয়াজফান ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে।
তার চোখ ঠান্ডা, কিন্তু ভেতরে জ্বলছে দাবানল।
এক পা… দু’পা…
তারপর হঠাৎ এক ঝটকায়—

অর্ষাকে টেনে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে।
এতটা জোরে, যেন তাকে শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলবে।
অর্ষা গা ছোঁড়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তার শক্তি না আছে, না সাহস।
ওয়াজফান তখন কানের কাছে ঠান্ডা ভয়ানক কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে—
“আর কখনো…
আর কোনোদিন…
আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা মুখে আনবি না,
বা এই ছোট্ট মাথায় ভাবিসও না…
না হলে…”
তার হাত উঠে আসে অর্ষার মুখে…
আঙুল দিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে ধীরে বলে—

“তোর ভাবার জন্য মাথাটা… আর বলার জন্য ঠোঁটটা…
দুটোই আর থাকবে না।
বোঝা গেছিস?”
অর্ষা শিউরে ওঠে।
তার চোখে জল আসতে চায়…
তবুও সে কেমন চুপ,
তবে ভয় পেয়ে নয় কারণ সে কখনো ভয় পায় না,
ভালোবাসায়— তার অনুভূতি গুলো সব আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে এই লোকটাকে ভালবাসতে বাধ্য করছে ধীরে ধীরে।
ওয়াজফান তখনও শক্ত করে ধরে আছে তাকে,

Death or Alive part 18

একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে—
তুই এখন শুধু আমার। তুই ভাবিস না, তুই অনুভব করিস—
তোর সবকিছু এখন আমার ছায়ার নিচে… চিরদিনের জন্য।

Death or Alive part 19 (2)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here