Death or Alive part 19 (2)

Death or Alive part 19 (2)
priyanka hawlader

করিডোরটা যেন আজ একটু বেশিই নীরব। দেয়ালের ওপরে টাঙানো পুরনো ঝাড়বাতিগুলোর ম্লান আলোয় অর্ষার ছায়া দীর্ঘ হয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গীহীন পদচিহ্ন। পাথরের মেঝেতে তার নরম পায়ের আঘাতগুলো নিঃশব্দ হলেও, বুকের ভিতর যে গুমোট এক ভাব—তা যেন পুরো পথটাকেই ভারী করে তুলেছে।
হাতে ধরা ছিল না কোনো নির্দেশপত্র, মুখেও ছিল না কোনো প্রয়োজনীয় বার্তা। শুধু কয়েক মুহূর্ত আগে একটি দাসী এসে নিঃসাড়ে জানিয়ে গিয়েছিল—”বাদশাহ ওয়াজফান আপনাকে ডেকেছেন। এখনই।”

এই “এখনই” শব্দটার মধ্যে অর্ষা যেন একটা চাপা তাড়া, একটা দমবন্ধ করা আদেশের গন্ধ পায়। সে জানে, ওয়াজফান কখনোই তুচ্ছ কারণে কাউকে ডাকে না—কিন্তু তার ক্ষেত্রে সবকিছুই ব্যতিক্রম। তুচ্ছতাকে মহার্ঘ্য করে তোলাই তো সেই পুরুষটির অদ্ভুত খেলা। তার মন যেন সদা প্রস্তুত কাউকে অপমান করতে, কারো চোখে অযাচিত ভয় ঢুকিয়ে দিতে, কিংবা… নিঃশব্দে কাছে টেনে নিয়ে নিজের অন্ধকারে ডুবিয়ে দিতে।
অর্ষার মনে পড়ে গেল কিছু পুরনো দৃশ্য—ওয়াজফানের চঞ্চল চোখ, দুঃসহ স্পর্শ, বেপরোয়া বাক্য, আর কখনো কখনো অযাচিত কোমলতা, যা আরও বিভ্রান্তিকর। সে জানে না আজ কী অপেক্ষা করছে—নতুন কোনো আদেশ,না কি নিঃশব্দ কোনো দাহ? হয়তো আজও তাকে কোনো দৃষ্টিপূর্ব পরিকল্পনার মোহজালে ফেলে দেবে এই বাদশাহ নামক লোক।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হাঁটতে হাঁটতে, সে একবার থেমে যায় এক জানালার পাশে। বাইরে চাঁদের আলো ধুয়ে নিচ্ছে প্রাসাদের অঙ্গন। এক ফালি বাতাস তার কপালের চুলগুলো আলতোভাবে সরিয়ে দেয়, ঠিক যেমন করে কোনো সময় ওয়াজফানের আঙুলগুলো হঠাৎ ছুঁয়ে যায় তার মুখ।
সে চোখ বন্ধ করে কিছু মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নেয়, বুকের ভেতর জমে থাকা ভয়টা একটু প্রশমিত করার আশায়। তারপর আবার ধীরে ধীরে পা বাড়ায়—ঠিক ওয়াজফানের কক্ষের দিকে। প্রতিটি পা যেন অনিশ্চয়তার দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।
এভাবেই করিডোর পেরিয়ে, অন্ধকার আর নীরবতার মাঝখানে, এক তরুণী এগিয়ে চলে সেই পুরুষের দিকে—যার ডাক সবসময় একটি ধাঁধা, একটি ভয়, আর কখনো কখনো… একটি অদ্ভুত আকর্ষণ।
অর্ষা থমকে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। চোখের পলকে কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করে। তার বুকের ধুকপুকানি যেন চারপাশে শুনতে পাচ্ছে কেউ। নক করবে কি করবে না—সেই দ্বিধায় হাতটা একটু বাড়ায়, আবার থেমে যায়।
ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ করেই দরজার কপাট খোলে—একটা শক্তিশালী হাত অর্ষার কব্জি চেপে ধরে তাকে টেনে নিয়ে যায় ঘরের ভিতরে।

— “আঁ…! আপনি…!”
অর্ষা চমকে ওঠে, চোখ বড় হয়ে যায়। বিস্ময়ে ঠোঁট কাঁপে তার।
ওয়াজফান কোনো কথা না বলে দরজাটা পিছন থেকে বন্ধ করে দেয়। ঘরের আলো নরম, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিতে তীব্রতা।
— “এইভাবে টানলেন কেন? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম,” অর্ষা গলা কাঁপিয়ে বলে ওঠে।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে। চোখে যেন আগুন, ঠোঁটে একধরনের জেদ।
— “তুমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন? কতক্ষণ ধরে? আমি ডাকছিলাম, তবুও তুমি আসো না। কেন, অর্ষা? আমি না তোমার স্বামী? আমাকে এভাবে অবহেলা করো কেন?”
আমি… আমি ভাবছিলাম… আপনার মন ভালো নেই হয়তো। দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু আপনি তো ডাকেনও এমনভাবে, যেন আমি দাসী! আর সত্যি দাসী পার্সোনালদাসী এটাই তো সবাই জানে।
ওয়াজফান এক ধাক্কায় তার খুব কাছে এসে দাঁড়ায়।

সবাই জানে শুধু কিছুদিনের জন্য তুমি দাসী না তুমি আমার স্ত্রী। আর খুব জলদি এটা সবাই জানবে।
তোমার মনে কী চলে, সেটা জানি না। তবে এটুকু জানি—তুমি আমার। আর আমার স্ত্রীকে আমাকে বারবার ডেকে আনতে হবে—এটা আমি সহ্য করতে পারি না। তুমি নিজে থেকে এলে না কেন?
অর্ষা চোখ নামিয়ে ফেলে। একদিকে ভয়, অন্যদিকে ক্ষোভ। তার ঠোঁট দুটো কাঁপে।
এরপর বলে – আপনার যেটা মনে চায় সেটাই বলেন আপনি। কখনও ভালোবেসে ডাকেন না। কখনো বলেছেন ভালোবাসেন আপনি আমার বলেন নি কখনো। সব সময় রাগ দেখান। অপমান করেন। তাহলে কেন আসব আমি ?
ওয়াজফান হঠাৎ হাত বাড়িয়ে তার গাল ছুঁয়ে বলে

— “তোমার এই ঠোঁট যখন জবাব দেয়, আমার সহ্য হয় না। একদিন এই ঠোঁট শুধু আমার নামেই কাঁপবে, বুঝলে?
অর্ষা এক ধাক্কায় পেছনে সরে যায়।
— “আপনার এসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না। আপনি শুধু নিজের ইচ্ছা বোঝেন, কারো অনুভব বোঝেন না।
ওয়াজফান এবার থেমে যায় কিছুক্ষণ। চোখ সরিয়ে জানালার দিকে তাকায়।
— “তোমার অনুভব জানার ইচ্ছা আমারও আছে, কিন্তু তুমি কি কখনো আমার ভেতরের আগুনটা দেখেছো?
অর্ষা মনে মনে বলে—

— “দেখেছি। সেই আগুনেই তো আমার মন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে দিনদিন।
কিন্তু মুখ ফুটে তা বলে না।
ঘরে এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা। কেবল দুইটা শ্বাসের শব্দ—একটা দ্রুত, একটা ভারী।
এরপর অর্ষা বলে আমি যাই এবার,
বলে অর্ষা পেছন ফিরে দরজার দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ একটা শক্ত হাত তার কনুই ধরে টেনে ধরে রাখল। থমকে দাঁড়ায় সে।

— “কোথায় যাচ্ছেন, মানব কন্যা?”
ওয়াজফানের কণ্ঠে ছিল ধীর অথচ গভীর এক ব্যঙ্গ। অর্ষা চোখ নামিয়ে নিলেও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে।
— “ছাড়ুন আমাকে। আমি যেতে চাই। আপনার ডাকে এসেছিলাম, এখন আবার চলে যাচ্ছি,” — শান্ত অথচ কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল সে।
কিন্তু ওয়াজফান হাত ছাড়াল না। বরং ধীরে ধীরে তাকে নিজের দিকে ঘোরাল।
— “এত অভিমান কিসের, বলো তো? কেন পালাতে থাকো আমার কাছ থেকে? আমি কি শত্রু? না কি এমন কিছু করেছি, যা এক রাজা তার রানির সঙ্গে করে না?
তার চোখদুটো জ্বলছিল আগুনের মত। অর্ষা নীরবে দাঁড়িয়ে রইল, কিছু না বলে, শুধু তার চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল।
ওয়াজফান এগিয়ে এসে এক ধাক্কায় অর্ষাকে নিজের কোলে বসিয়ে নিল। অর্ষা হতভম্ব হয়ে উঠে পড়তে চাইলে, সে শক্তভাবে ধরে রাখল তাকে।

— “আপনাকে তো আমার কাছেই থাকতে হবে, সারাজীবনের জন্য। আমি ভালোবাসি বা না বাসি , তাতে আপনার কিছু আসে যায় না। আপনি থাকবেন এই ভয়ংকর বাদশার বুকেই — এটাই আপনার নিয়তি।”
তার কণ্ঠে ছিল নিঃসঙ্গতা, ছিল অধিকারবোধ, আর ছিল এক ধরণের উন্মাদনা।
— “অনেক অভিযোগ করেছো, অনেক অভিমানও করেছো,” — ওয়াজফান বলল ধীরে ধীরে, চোখ নামিয়ে অর্ষার ঠোঁটের কাছে, — এবার একটু আদর করো না তোমার স্বামীকে?”
তারপর বিনা অনুমতিতে সে মুখ নামিয়ে আনল অর্ষার গালের কাছে। অর্ষা চোখ বড় বড় করে তাকালেও কিছু বলতে পারল না।
ওয়াজফান অর্ষার গালে চুমু খেল।

— “সব জানো, শুধু এটা জানো না — আমি পাগলের মতো তোমাকে চেয়েছি, মানব কন্যা,” — সে ফিসফিস করে বলল, কপালের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে।
তার কণ্ঠ, তার স্পর্শ, তার দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল, যা অর্ষাকে এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাসহীন করে দিল। সে বুঝতে পারছিল না—এটা ভালোবাসা, না এক ধরণের বন্দিত্ব।
এরপর ওয়াজফান তার গালে ঠোঁট রেখে বলল—
তুমি পালাতে পারো না, রানী। কারণ তুমিই আমার আর আমি… আমি তোমার অন্ধকার নিয়তি।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে অর্ষার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“তোমার ঐ দুটো এত ছোট কেন, লিটল মনস্টার?
তোমার সব কিছু তোমার মতোই… এতো লিটল লিটল।
তবে আমার ছোঁয়া পেলে আর কিছু ছোট থাকবে না…
If I touch it, it will grow bigger…
অর্ষা প্রথমে কিছুই বোঝে না। তাঁর ঠোঁট কেঁপে ওঠে, চেহারায় একরাশ বিভ্রান্তি।
“কি বলছেন আপনি?” — মুখে সে কিছু বলার আগেই, হঠাৎ বুঝতে পারে ওয়াজফানের দৃষ্টি তার বুকের উপর আটকে আছে।
চোখ-মুখ মুহূর্তেই লাল হয়ে ওঠে অর্ষার।
তার মনটা ছটফট করে ওঠে লজ্জায়, কিন্তু একইসঙ্গে একরকম অচেনা শিহরণে।
সে কোল থেকে উঠে দ্রুত বেরিয়ে যেতে চায়।
কিন্তু হঠাৎই ওয়াজফানের বাহু দুটো তার কোমরের নিচ দিয়ে গলে আসে, পেটের কাছে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।

“এভাবে পালিয়ে যেও না… আমার লিটল মনস্টার…”
তার গলার স্বরে ছিল ভয়, অধিকার আর গভীর আকর্ষণের মিশেল।
অর্ষা থমকে যায়। পুরো মুখটা আগুনের মতো জ্বলছে লজ্জায়। কিন্তু হাত-পা যেন অসাড় হয়ে গেছে।
সে পালিয়ে যেতে পারে না।
শুধু শুনতে পায় নিজের বুকের ভেতর হৃদস্পন্দনের আওয়াজ—অস্বস্তিকর, তবুও অদ্ভুতভাবে চেনা।
ওয়াজফান এবার ধীরে ধীরে হাত দুটো অর্ষার জামার নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে নেয়। তার আঙুলগুলো থেমে যায় অর্ষার উন্মুক্ত পেটে।

হালকা ঠাণ্ডা স্পর্শে কেঁপে ওঠে অর্ষার শরীর।
সে যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়।
ওয়াজফান ওর কান বরাবর মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে—
“কি হলো? এভাবে কাঁপছো কেন, লিটল মনস্টার?
আমি তো এখনো কিছু করেইনি…
তুমি চাইলে…”
ওর কথাটা শেষ হওয়ার আগেই, অর্ষা তীব্র লজ্জা আর অস্বস্তিতে ঘুরে দাঁড়ায়,
দু’হাতে ওয়াজফানের ঠোঁট চেপে ধরে।

— “প্লিজ… আর কিছু বলবেন না। প্লিজ…”
ওয়াজফান একটু থেমে তার চোখে চোখ রাখে।
তার চোখে ছিল দুষ্টুমি, তীব্র আকর্ষণ… আর অদ্ভুত রকম কোমলতা।
সে হেসে বলে,
“ঠিক আছে, বলবো না।
তবে একটা শর্ত আছে…
তুমি যদি নিজের ইচ্ছায় আবার আমার কোলে এসে বসো,
আমার মাথাটা নিজের বুকে টেনে জড়িয়ে ধরো…
তাহলে আমি কথা দিচ্ছি—একদম চুপ থাকবো।
ভালো বাচ্চার মতো, একটাও শব্দ করবো না।
এই বলে সে আবার নিজের আঙুলগুলো ধীরে ধীরে অর্ষার পেটে স্লাইড করতে থাকে,
শুধু ত্বক ছুঁয়ে ছুঁয়ে হালকা ছোঁয়ার এক আবেশ তৈরি করে।

অর্ষা বুঝে যায়, সে কিছু না করলে ওয়াজফান যা ইচ্ছা তাই করবে।
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, সে বুঝতে পারে—এমনটা করতে সে একদমই অস্বস্তিতে নেই।
বরং তার বুকের মধ্যে যেন এক রকম শান্তি খেলা করছে।
সে ধীরে ধীরে ঘুরে ওয়াজফানের দিকে ফিরে আসে।
তার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই আবার কোলে বসে পড়ে। দু পা দুইদিকে দিয়ে ওয়াজফানের পায়ের উপর ভালো করে বসে।
দু’হাত বাড়িয়ে ওয়াজফানকে নিজের বুকে টেনে নেয়,
আর চুপচাপ জড়িয়ে ধরে।
ওয়াজফান সত্যি সত্যি চুপ হয়ে যায়।
সে শুধু চোখ বন্ধ করে অনুভব করে,
অর্ষার বুকের ভেতর কেমন এক নরম, উষ্ণ আশ্রয় আছে—
যা হয়তো তার বাকি জীবনেও সে আর কোথাও পাবে না।

অর্ষা এখনো ওয়াজফানের কোলে বসে আছে। তার বুকের গভীরে অদ্ভুত এক শান্তি, যেন আশ্রয় পেয়েছে।
কিন্তু সেই প্রশান্তির মাঝেই হঠাৎ মনে পড়ে—ক্যালিয়ন।
তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই রহস্যময় চোখ, শক্ত বুক, তার কথা…
আর ওয়াজফানের সাথে তার ভয়ানক সংঘর্ষ।
সে নিচু গলায় বলে ফেলে,

— “আপনার সাথে ক্যালিয়নের এমন ঝামেলা কেন? ও আপনাকে চিনে… আপনিও ওকে…?
কথাটুকু শেষ হতে না হতেই যেন বজ্রপাত।
ওয়াজফান হঠাৎ করে অর্ষাকে নিজের কোল থেকে ধাক্কা মেরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পাশের সোফায়।
অর্ষা ধপাস করে পড়ে যায়, কিছু বোঝার আগেই ওয়াজফান ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপরে।
চোয়াল শক্ত করে ধরে, এত জোরে, যেন মুহূর্তেই ভেঙে দেবে।
তার চোখ জ্বলছে।

না, সেটাকে চোখ বলা যায় না—ওটা যেন রক্ত লাল আগুন!
চোখ দিয়ে তাকানো নয়, ও যেন গিলে খাওয়ার জন্য তাকাচ্ছে।
— “কার নাম মুখে এনেছিস তুই আবার?”
ওর গলায় বিষ, আগুন আর উন্মত্ততা।
— “তোরে কতবার বলছি, ঐ জানোয়ারটার নাম আমি তোর মুখে শুনতে চাই না!
শুধু মুখে না… তোর মনে, তোর মস্তিষ্কেও ওর কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারবে না!
তুই কি ওকে ভালোবাসতি, বল!”
অর্ষা দমবন্ধ হয়ে আসা গলায় ফিসফিস করে কাঁপতে কাঁপতে বলে—

— “না… না… আমি ওকে কখনো ভালোবাসিনি… শুধু একটু পছন্দ…”
কথা শেষ করার আগেই ওয়াজফান তার ঠোঁট আঁকড়ে ধরে,
ভীষণ রকম তীব্রতায় চেপে ধরে তার ঠোঁট।
এক মুহূর্তের জন্য চারপাশ থেমে যায়।
তারপর হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে,
— “কি করতি তুই ওর সাথে, বল!”
অর্ষা আবার ফিসফিস করে, চোখ ভিজে ওঠে—
— “না… প…”
ওর “না” কথাটুকু মুখে আসতে না আসতেই ওয়াজফান আরও হিংস্র হয়ে ওঠে।
এবার সে অর্ষার গলায় ঠোঁট রাখে, এবং…

রুঢ়ভাবে কামড়ে ধরে।
অর্ষা কেঁপে ওঠে। ভয়, লজ্জা, আর অজানা এক অনুভূতিতে সে জমে যায়।
ওয়াজফান কিছুক্ষণ পর থেমে যায়।
তার চোখের পাগলামি একটু প্রশমিত।
সে নিচু গলায় ফিসফিস করে বলে,
— “এবার বল… কি করতি?”
অর্ষা এবার কিছু বলে না।
শুধু চোখ বন্ধ করে মাথা দু’পাশে নাড়ে।
না… সে কিছু বলতে চায় না।
ওয়াজফান এবার একটু নিচু হয়ে ওর কানে ফিসফিস করে, ঠোঁটে হিংস্র এক বাঁকা হাসি—
— “That’s my girl.”

তার গলায় গর্ব, দানবীয় মালিকানা আর অদ্ভুত রকম ভালোবাসা মিশে আছে।
ওয়াজফানের রুম থেকে বেরিয়ে অর্ষা নিজের কক্ষে যাওয়ার জন্য করিডোর ধরে এগোতে থাকে।
শরীরটায় ক্লান্তি, মুখে লজ্জা আর চোখে একধরনের থমকে থাকা নীরবতা।
পা টেনে টেনে এগিয়ে যেতে গিয়েই…
হঠাৎ
তার সামনে হুট করে এসে দাঁড়ায় কেউ একজন।
তীক্ষ্ণ ভঙ্গিতে, দমবন্ধ করে দেওয়া এক উপস্থিতি।
অর্ষা থমকে দাঁড়ায়। কিছুটা ঘাবড়ে যায়।
চোখ তুলে তাকাতেই চিনে ফেলে মুখটা—জ্যাইম।
অনেকদিন পর।
যুদ্ধ শেষ করে অবশেষে ফিরে এসেছে সে।

সেই চেনা মুখ, কিন্তু এবার যেন আরও দৃঢ়, আরও কঠিন, চোখের গভীরে যুদ্ধের ছাপ।
জ্যাইমকে দেখে অর্ষার মুখে ফুটে ওঠে একরাশ নরম হাসি।
চোখে আনন্দ, বিস্ময় আর একধরনের স্বস্তি।
জ্যাইম… তুমি ফিরে এসেছো…
কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।
জ্যাইমের চোখে ছিল না কোনো উষ্ণতা।
তার কণ্ঠে উঠে আসে কর্কশ এক প্রশ্ন,
কঠিন, যেন ভিতর থেকে রাগে ফুটছে সে।
তুমি না এখান থেকে চলে গিয়েছিলে?
তবে কেন আবার এখানে ফিরলে?
কি মতলব তোমার, অর্ষা?

কেন আবার এসেছো এই বাড়িতে?”
অর্ষা কিছুক্ষনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যায়।
হাসিটা এক ঝলকে মিলিয়ে যায় তার মুখ থেকে।
তার চোখে বিস্ময়, ঠোঁট কেঁপে ওঠে।
অর্ষা এবার কিছুটা রূঢ় ভঙ্গিতে জ্যাইমের কথার উত্তর দেয়।
আমি নিজে থেকে এখানে আসিনি, জ্যাইম।
তোমার দা ভাই আমাকে এখানে তুলে নিয়ে এসেছে।
তুমি তাকেই যেয়ে জিজ্ঞেস করো, সে আমাকে এখানে কেন তুলে এনেছে আর কি কারণে…
কি মতলব তার।

তোমার প্রশ্নের উত্তর সেই তোমাকে ভালোভাবে দিতে পারবে।
কারণ আমি এখানে তার ইচ্ছেতে এসেছি, নিজের ইচ্ছেতে না।”
জ্যাইম চোখ কুঁচকে তাকায়।
ওয়েট!
তুমি দার রুম থেকে বের হলে কেন?
তুমি তার রুমে কী করছিলে?”
অর্ষা বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
আমি নিজে থেকে তোমার দার রুমে যাইনি।
সে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছে—
তার কাজ করানোর জন্য।

জ্যাইম এবার ক্ষোভ চেপে রাখতে পারে না। কণ্ঠ কিছুটা কাঁপে।
সব সময় ডাকলেই কি যেতে হয়?
তোমার নিজের কি কোনো self respect নেই?
সে দিনরাত যখন ইচ্ছা—তোমাকে ডাকে,
তোমাকে তখনই দৌড়ে যেতে হয়?
ভুলে যেও না, সে একজন জীন হলেও সে কিন্তু পুরুষ।
তাই যেকোনো সময়, তার যা ইচ্ছে, তোমার সাথে সেটা করতে পারে।
অর্ষার চোখে এবার স্পষ্ট বিদ্রূপ আর রাগ।
If your kindly information,
সে আমাকে এখানে এজন্যই রেখেছে।

সো এটা আমাকে না বলে,
তোমার দা’কে যেয়ে বলো।
শুধু শুধু আমার দিকে আঙুল তুলছো কেন?
সে কেন একটা মেয়েকে দিনরাত ২৪ ঘন্টা খাটায়—
সেটা তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো।
আমার কাছে কেন এসেছো?
তোমার প্রশ্নের উত্তর সেই দেবে তোমাকে খুব ভালো করে।
জ্যাইম এবার চোখ ঠাণ্ডা করে সংকুচিত করে বলে,
দা-এর দাসী রূপে আছো তুমি,
তাই তোমাকে ওই পর্যন্তই যেন থাকতে দেখি।
Don’t cross your limit,
নয়তো খুব খারাপ হবে।

আর খারাপটা ঠিক কী হবে—
তা এখন বুঝতে পারবে না তুমি।
হুমকির মতো ঠান্ডা স্বরে কথাগুলো বলে জ্যাইম অর্ষার দিকে একটা শেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘুরে যায়।
তার পায়ের আওয়াজ করিডোর জুড়ে প্রতিধ্বনি তোলে—ঠান্ডা, বিষাক্ত, রাগে ঝলসানো।
অর্ষা ও এবার ধীরু পায়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটা শুরু করে। মনে একরাশ অস্থিরতা—কেন এমন ব্যবহার করল জ্যাইম? আগে তো সে এমন ছিল না। বন্ধুর মতো ছিল, হাস্যোজ্জ্বল, আপন। আজ হঠাৎ এতটা রুঢ়, যেন অপরিচিত এক মানুষ!
হঠাৎ কী এমন ঘটল? এটা কি শুধু তার দা-য়ের প্রতি অতিরিক্ত পজেসিভনেস? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো গভীর কারণ—যা সে এখনো বুঝতে পারছে না?
ভাবনার ভারে ভারাক্রান্ত অর্ষা নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে।
দরজাটা বন্ধ হওয়ার শব্দ যেন পুরো দিনের ক্লান্তির সমাপ্তি টানে।

নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে হঠাৎই অর্ষার নিঃশ্বাস কেমন যেন ভারী হয়ে ওঠে। স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝের দোলাচলে ঘুমন্ত চোখ দুটো ধীরে ধীরে খুলে যায় তার। বুকের ওপর অদ্ভুত এক চাপ… যেন কেউ একটানা ওর বুক জুড়ে শুয়ে আছে।
চোখ দুটো পুরো খুলতেই থমকে যায় সে।
ওর বুকের ওপর মাথা রেখে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে ওয়াজফান। ঘন চুলের লটগুলো বিছানায় ছড়িয়ে, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসে তার শরীর নড়ছে ধীরে ধীরে। অর্ষার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। ধুকপুক করে ওঠে বুকের ভেতর।
কয়েক মুহূর্ত নিস্পন্দ হয়ে থাকে সে। এরপর হঠাৎ এক ঝটকায় উঠে বসে পড়ে।

— “এই! আপনি এখানে… কী করছেন এত রাতে? নিজের রুম না রেখে আমার রুমে… কেন এসেছেন?”
কণ্ঠস্বর কাঁপছে। বিস্ময়, আতঙ্ক, আর অস্পষ্ট এক দ্বিধা একসাথে জড়িয়ে আছে সেখানে।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে চোখ মেলে। চোখদুটো এখনো ঘুমে ঝাপসা, কিন্তু তাতে যে গভীরতা, তাতে ঠাণ্ডা হয়ে যায় অর্ষার শরীর।
ওয়াজফান শান্ত কণ্ঠে, কিন্তু তার চোখের তীব্রতা কাটার মতো ধারালো, উত্তর দিল,

— “আমি আমার বউয়ের রুমে আছি। তুমি কে বলার আমি কোথায় থাকবো? আমার ঘুম আসছে না, আর তোমার শরীরের ঘ্রাণ ছাড়া আমার ঘুম আসে না। এখন তোমার ঘ্রাণ নিয়ে ঘুমাবো।
তারপর ঠোঁট আরেকটু ঝুঁকে এল অর্ষার কানের কাছে। নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল,
— “চুপচাপ ঘুমাও, আল্লাহর কসম, আমি কিন্তু এখন যদি অন্য কিছু করা শুরু করি তাহলে তুমি পালানোরও সুযোগ পাবে না।”
অর্ষার বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড যেন লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে আসছে। গলা অবরুদ্ধ হয়ে এসেছে ভয়ে, কিন্তু সে চিৎকার করতেও সাহস পাচ্ছে না। এই মুহূর্তে ওর সামনে যে মানুষটা, সে একটুও স্বাভাবিক নয়—তাকে রোখার শক্তি অর্ষার নেই। তাই নিঃশব্দে, নিঃসাড়ে শুয়ে থাকে সে। চোখ বন্ধ করে, নিঃশ্বাস চেপে রাখে যেন তার অস্তিত্বও টের না পায় ওয়াজফান।

ওয়াজফান আবার ধীরে ধীরে মাথা রেখে দেয় তার বুকের ওপর। গভীর ঘুম নয়, বরং গভীর এক অধিকারবোধে—অবাধ্যতার কোনো জায়গা নেই, পালাবার কোনো রাস্তা নেই।
রাতটা যেন থমকে যায়—আর এই থমকে যাওয়া মুহূর্তেই।
কিছুক্ষণ পর অর্ষা টের পায়—ধীরে ধীরে তার জামার ফিতে আলগা করছে ওয়াজফান। হঠাৎ সে কেঁপে উঠে, ভয় পেয়ে তার হাত আঁকড়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,
– কি… করছেন আপনি?
ওয়াজফান থেমে যায়, ঠান্ডা গলায় বলে,
– কিছু না। এখন কিছু করার মুডে নেই। তাই তুমি মুড অন করো না—তাহলে বাধ্য হবো।
তার কণ্ঠে কোনো উত্তেজনা নেই, বরং একধরনের শীতল দাবি।
– জামাটা সরাচ্ছি শুধু… কারণ আমি তোমার শরীরের ঘ্রাণ খুঁজে পাচ্ছি না। জামার গন্ধে ঢাকা পড়েছ তুমি। আমি… শুধু তোমার ঘ্রাণ চাই।

বলেই সে পোশাকটি তুলে সেটার মধ্যে মুখ ডুকিয়ে নিয়ে নিজের মুখ ডুবিয়ে দেয় অর্ষার বুকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়ে থাকে, যেন গভীর নিঃশ্বাসে শুষে নিচ্ছে কোনো হারিয়ে যাওয়া অনুভূতি। নাকটা ঘষে নেয় কয়েকবার তার বুকে।
তারপর মৃদু ফিসফিস করে বলে,
– এবার পাচ্ছি… তোমার আসল গন্ধ। এটাই দরকার ছিলো।

Death or Alive part 19

অর্ষা নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে, ভয়ে, লজ্জায়, না কি অন্য কিছুর টানে সে নিজেই জানে না। ওয়াজফান ধীরে ধীরে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যেন শান্ত করতে চায় তাকে।
– ঘুমাও… লিটল মনস্টার। না হলে আমি নিজেকে আটকাতে পারবো না।
অর্ষা ও এবার চুপচাপ চোখ বন্ধ করে নেয়।

Death or Alive part 20

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here