শাহজাহান তন্ময় পর্ব ২৫+২৬

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ২৫+২৬
Nabila Ishq

মাথার ওপরে মেঘে ঢাকা বিদঘুটে আসমান হতে অঝোরে বর্ষণ নামছে। পাগলা ঝড়ো হাওয়ায় সর্বত্র আঁধারে এবং অপরিষ্কার। বাতাসের তোড়ে নৌকার বেগতিক অবস্থা! কেন্দ্রাংশ হারিয়ে প্রতিনিয়ত উলটোদিক অগ্রসর হচ্ছে নৌকা। যেকোনো সময়ে নদীতে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা আছে। ঘাট এখনো বহুদূর। এমতাবস্থায় মাঝি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে, নৌকা পাশেই কোথাও ভিড়ানোর প্রচেষ্টা করছে। বাম দিকে বাঁশবন বাগান। বাঁশবন পেরলে মেইনরোড। তন্ময় ব্যস্ত গলায় বলল,

‘চাচা। বামদিক নেওয়ার চেষ্টা করুন।’
তন্ময়ের সেলফোন বেজে চলেছে লাগাতার। ইতোমধ্যে ফোন ভিজে পকেটে পড়ে আছে। অরুকে একহাতে ধরে অন্যহাতে ফোন বের করে। শাবিহা, আকাশ, রুবি সবার কল। তন্ময় কল রিসিভ করে। তবে কথা শোনা যাচ্ছে না। নেটওয়ার্ক প্রব্লেম। কোনোরকম জানাল তারা ঠিক আছে। কল কেটে তাকাল শান্তশিষ্ট চুপচাপ বসে থাকা অরুর পানে। বৃষ্টিধারা পড়ছে ওর সর্বশরীরে। রেশমি কালো ঘন চুলগুলো কাঁধপিঠে পড়ে আছে। চুল থেকে ঝরছে সীমাহীন জল। সেই জল বেয়ে চলেছে টানা হরিণী চোখের পাপড়িতে, পাপড়ি থেকে নাক, গাল, গোলাপি ঠোঁট এবং অবশেষে গলা বেয়ে দু- কাঁধের মধ্যস্থান ধরে জামার ভেতরে চলে গেল। তন্ময় একদৃষ্টিতে ওই আবেদনময়ী সৌন্দর্যসৃষ্টি দেখল। চোখ ফিরিয়ে গলার স্বর নরম করে শুধাল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ভয় লাগছে?’
অরু পিটপিট নয়নে অদূরের জঙ্গলটা দেখে নিলো। ঢোক গিলল। দু’ঠোঁটের ভাঁজে বৃষ্টির জল নিয়ে বলল,
‘লাগছে না।’
আবহাওয়া খারাপের দিক। ঝড়ের মাত্রা বাড়ছে বলে। তন্ময় দেখল নৌকা বাঁশবনের দিকে চলে এসেছে। উঠে দাঁড়াল অরুর হাত ধরে। পেছন থেকে হাত ধরে ওকে আগে নৌকা থেকে নামাল। তারপর নিজে নামল। টাকা নৌকা ভাড়া নেওয়ার সময় দিয়ে দিয়েছিল। মাঝিকে বিদায় জানিয়ে অরুকে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর ধরে হাঁটা ধরল। বড়ো-বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা এতো গাছপালা ভেদ করে তাদের শরীর আগের মতো ছুঁতে পারছে না। তবে ঠাণ্ডাবোধ বেশি করছে। বাতাসের গতিপথ ও বেশি। শরীরের পশমগুলো শীতল অনুভূতিতে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
অরুকে দৃশ্যমান রূপে কাঁপতে দেখে তন্ময় দাঁড়িয়ে পড়ল। ওকে আগাগোড়া দেখে বলল,

‘ওড়নাটা জড়িয়ে নে।’
অরু কথা শুনল। গলা থেকে ওড়না সরিয়ে মেলে নিজের সর্বশরীরে জড়িয়ে নিলো। ফ্যালফ্যাল চোখে চারিপাশ দেখে মন্তব্য করল,
‘খুব নির্জন আশপাশ। কেমন গা ছমছম একটা ব্যাপার।’
‘রাত দশটার দিক এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে, এমন বাঁশবন নির্জন লাগবে না তো কী কোলাহলময় হবে?’
অরু ঠোঁট বাঁকাল, ‘আমিতো জাস্ট কমেন্ট করলাম।’
‘আমিতো জাস্ট রিপ্লাই করলাম।’

অরুর ভয়ার্ত মুখখানা চুপসে যায়। তন্ময় শব্দ করে হাসে। অরুর কাঁধ ধরে নিজের সাথে লেপ্টে শুধায় , ‘ভয় করছে? চোখ বন্ধ কর। আর একটু রাস্তা। মেইনরোড গেলে সিগনাল পাব। কল দিলে গাড়ি নিয়ে চলে আসবে।’
অরু চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে রাখে। বন্ধ চোখে তন্ময়ের ইশারায় চলে। পরমুহুর্তেই চোখ মেলে তাকায়। ভাবে, সে যেহেতু এতটা ভয় পাচ্ছে নিশ্চয়ই তন্ময়ও ভয় পাচ্ছে? এমনটা ভেবে ভীতিগ্রস্ত নয়নে চেয়ে রয়। তন্ময় ভ্রু উঁচু করে তাকালে বলে,

‘আমি চোখ বন্ধ করে থাকলে আপনি ভয় পাবেন।’
‘আমি ভয় পাব?’
‘হু।’
‘কেন ভয় পাব?’
‘আমি যে কারণে ভয় পাচ্ছি।’
‘তুই কী কারণে ভয় পাচ্ছিস?’
‘এখানে অন্ধকার। অনেক গাছপালা, জঙ্গলের মতো। কেউ নেই। আবার ঝড়বৃষ্টি।’
‘তো?’
‘ভুতপ্রেত থাকে তো এসব জায়গায়।’
‘তাতে কী?’
‘তাতে কী মানে? তারা মানুষের ওপর ভর করে।’
‘তাই নাকি। শুনেছিলাম ভুতপ্রেত সুন্দরী মেয়েদের বেশ পছন্দ করে। তাদেরকেই চোখে রাখে, তাদের ওপর ভর করে।’

অরুর বুকের ওঠানামার গতি বাড়ল। চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। দুহাতে শক্ত করে ধরল তন্ময়ের বলিষ্ঠ হাত। মিহি গলায় বলল,
‘আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন!’
তন্ময় গাঢ় দৃষ্টিতে ওর মুখখানা দেখে। নির্বিকার কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ভয় লাগছে?’
‘ভয় দেখিয়ে আবার এমন বলছেন কীভাবে!’
‘ভয় সারাব?’
অরু মাথা তুলে তাকায়, ‘বললেই ভয় সারানো যায়? এই জায়গা ভীষণ ভয়ানক। নর্মাল মানুষ ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক।’

‘তারমানে দাঁড়ায় আমি নর্মাল মানুষ নই? নিশ্চিত ভুতপ্রেত আমার ভেতর ঢুকেছে।’
এবার অরু থমকে পড়ে। সাংঘাতিক ভয়ে স্থির হয়ে আসে পা-জোড়া। ওসময় আসমান কেঁপে বজ্রপাত হতেই, চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠে। অমাবস্যা নামে আদুরে মুখখানায়। ভয়ে এইটুকুন হয়ে আছে গোলগাল মুখটা। তন্ময় পুনরায় জিজ্ঞাসু সুরে বলে,
‘ভয় সারাব?’
অরু তোতলানো গলায় শুধাল,
‘কী…কীভাবে!’
তন্ময় বড্ড আচমকা মাথা নামিয়ে আনে অরুর সমান। বৃষ্টির জলে ভিজতে থাকা রসালো কম্পিত ঠোঁট জোড়ায় শব্দ করে এক চুমু বসায়। এতটাই দ্রুত ঘটে গিয়ে শেষ হয় যে অরু হতবাক, বিস্মিত। ভেতর থেকে রুহ চলে গিয়েছে যেন! মূর্তির মতো অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে লোহার মতো দাঁড়িয়ে। তন্ময় নিচু হয়ে এক হাত ওর পিঠে রাখে এবং অন্যহাত গোড়ালির নিচে। টানটান ভঙ্গিতে পাঁজাকোলে তুলে ফেলে। বড়ো-বড়ো পায়ের ধাপে সামনে অগ্রসর হয়।
আড়ালে-আবডালে খেয়াল করে অরুর হতভম্ব নজর।

গাড়িটা এসে থামল মাত্র। তন্ময় দ্রুত অরুকে ঠেলে ভেতরে বসিয়ে দরজা লাগায়। নিজে ড্রাইভিং সিটের পাশে গিয়ে বসে। শাবিহা নিজের গায়ের ওড়না খুলে অরুকে পেঁচিয়ে নেয়। রুবি অরুর চুলগুলো মুছে দিচ্ছে। মেয়েটা শীতে কাঁপছে তবে জবান বন্ধ। কেমন হতভম্ব হয়ে আছে। তবে কারো সন্দেহ হলোনা কিছু। ও তো গিয়েছিল এভাবেই। একদম নিশ্চুপ হয়ে। দীপ্ত অরুর ঠান্ডা হাত দুটো চেপে বসে আছে।
আকাশ টি-শার্টের ওপর চ্যাক-শার্ট পরেছিল। ওপরের শার্ট খুলে তন্ময়ের দিক এগিয়ে দিল। তন্ময় সময় নিয়ে খুলল সাদা শার্ট খানা। দুহাতে ভেজা চুলগুলো কপাল থেকে উঠিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া শার্ট নিলো। আকাশ গাড়ি স্টার্ট করল। একটানে চলতে লাগল তীব্র বর্ষণময় রাস্তায়।
শাবিহা ধীর গলায় অরুকে ডাকল,

‘এই অরু! খারাপ লাগছে? ভীষণ ভয় পেয়েছিলি বুঝি?’
অরু মাথা তুলে তাকাল। তন্ময় লুকিং গ্লাসেই তাকিয়ে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হলো। অরু চোখ বড়ো করে বলল,
‘আপু, আমাকে একটা বড়ো করে চিমটি কাট। এক্ষুনি।’
শাবিহা বোকা অরুর মুখটা ভালোভাবে দেখে হাতে চিমটি কাটল। সামান্য ব্যথায় ‘উহু’ শব্দ করল মেয়েটা। বিড়বিড়িয়ে কীসব বলতে লাগল। শাবিহা ধাক্কা দিয়ে প্রশ্ন করল,
‘কিররে, কী হয়েছে?’
‘কি..কিছুনা। মাথা ভাড় লাগছে।’
‘নে কাঁধে মাথা পেতে ঘুমা। শীঘ্রই বাসায় ফিরব।’

অরু কাঁধে মাথা রেখে চুপ রইল। বাকিটা রাস্তা নীরবতায় গেল। তন্ময় ফোনটা টিস্যু দিয়ে মুছতে লাগল। আকাশের হুটহাট প্রশ্নে টুকটাক জবাব দিতে থাকল। ঘন্টাখানেক লাগল শাহজাহান বাড়ির সামনে আসতে। গাড়িটা আর ভেতরে ঢোকাল না। ইতোমধ্যে অরু ঘুমিয়ে ঢোল। কোনো হদিস নেই দিনদুনিয়ার। শাবিহা ডাকল অরুকে ধীর গলায়। অরু সময় নিয়ে জাগে। চোখ মেলে এদিক-ওদিক তাকাতেই তন্ময়কে দেখে, ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রয়। রুবি বলে,
‘তাড়াতাড়ি চল। তুই তো আজ জ্বর বাঁধাবি।’
অরু ধীরেসুস্থে বেরোতে-বেরোতে শাবিহা, রুবি ওরা দৌড়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। তন্ময় ছাতাটা মেলে অরুর মাথার ওপর ধরে। ধীর গলায় বলে,

‘যাচ্ছিস না কেন?’
অরু ঠোঁট নাড়ায়। কিছু একটা বলতে চায় যেমন। তবে বলা হয়না। তন্ময়ের ধরে রাখা ছাতার নিচে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। শাবিহা পুনরায় ফিরে আসে অরুকে নিতে। তবে দুজনকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আর এগোয় না। হেসে অগোচরে ফিরে যায়।
অরু কিছু একটা বলতে নেয়, ‘আপ..আপনি…’
‘আমি?’

অরু মাথা তুলে তাকায়। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে আচমকা এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। তন্ময় নির্নিমেষ চেয়ে রয় ওর যাওয়ার পথে। হৃদয় বলে ওঠে,
‘প্রিয়তমা আমার, প্রেয়সী আমার। দূরে না থেকে কাছে এসে দেখ। বুকে মাথা পেতে শোনো কী ধরনের অসুখ তুমি, কী নিদারুণ ব্যথিত সুখে আছি আমি!’

তীব্র বর্ষণ থেমেছে অনেকটা সময় হলো। মেঘেদের রাজ্য ছুটে কোথায় যেন পালাল। আঁধারে আসমানে ফকফকে সাদা অর্ধখণ্ডিত চাঁদখানা কেমন নিশ্চুপ, নিস্তব্ধতার গান গাইছে। হালকা-পাতলা শান্তস্থির বাতাস বইছে। জানালার গ্লাস দুপাশ দিয়ে মেলে রাখা। বাতাসের স্পর্শ আরামে ছুঁয়ে চলেছে। ধবধবে শুভ্র রঙের দেয়াল ঘড়ির ঘন্টার কাঁটা ঘুরছে দুটোয়। মিনিটের কাঁটা চারে আর সেকেন্ডের কাঁটা অনিমেষ ছুটছে। ১০৩° জ্বরে তন্ময় অচেতন হয়ে বিছানায় পড়ে। জবেদা বেগম ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে। হাতে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার। সেটি কপালের সামনে ধরে জ্বরের তাপমাত্রা জেনে নিলেন। ১০৩° জ্বর। চোখজোড়া মুহূর্তে লালচে হলো। ভেজা ভাঁজ করা রুমাল খানা কপালে ভালোভাবে জাপ্টে দিল। তন্ময় অস্পষ্ট গোঙাল। মাথা ভারী। সর্বশরীর আগুনের ন্যায় গরম। দেহের ওপর অদ্ভুত চাপ পড়ছে। চোখের ওপর বুঝি বড়ো পাথর রাখা? নাহলে মেলে তাকানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে কেন?

এতটা তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কারণ কী? বৃষ্টিতে খানিকক্ষণই তো ভিজেছিল মাত্র। এতটা জ্বর হওয়ার তো কথা নয়। নাকি প্রথম চুমুর ছোঁয়াতে এই রাজ্যের কঠিন জ্বর উঠেছে শরীরে? হয়তো। ওই আবেদনময়ী কেশ, টানা হরিণী চোখ, নেশাগ্রস্ত অধর তার ধৈর্যের পরীক্ষা নেয় প্রতিনিয়ত। দুএকবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে বসলে ক্ষতি কী? মস্তিষ্ক সচল হলো বুঝি। তন্ময় বহু প্রচেষ্টায় চোখ মেলে তাকাল।
জবেদা বেগম পাশেই বসেছে। নীরবে কাঁদছে। তার কান্নার কারণ বুঝল না তন্ময়। কোনোমতে গভীর, ভাঙা পুরুষালী গলায় শুধাল,

‘কাদছ কেন মা?’
জবেদা বেগম কান্নারত নয়নে, ঝাঁজাল গলায় বলেন,
‘কান্না করতে মন চাইল তাই কান্না করছি।’
তন্ময়ের সরু ফ্যাকাসে অধর ঘিরে ছুটল সাময়িক হাসির রেখা,
‘ঠিক আছি আমি। সামান্য জ্বর। রাতের মধ্যে সেরে যাবে।’
‘সামান্য জ্বর বলছিস? ১০৩° জ্বর। কী এমন করেছিস যে এতো জ্বর এসছে!’
তন্ময় আনমনা হলো। ভাবুক নয়ন জোড়া দেয়ালে সেঁটে। মস্তিষ্ক নেড়েচেড়ে উঠে জানাল, কিছু একটা তো সে করেছে। ওই করনীয় কাজটির সম্পর্কে তো আর মা’কে বলা যাবে না। জবেদা বেগম উঠলেন। বিড়বিড়িয়ে বলে গেলেন,

‘আদা রসের সাথে মধু মিশিয়ে আনছি। শুয়ে থাক।’
তন্ময় শুয়ে থাকল না। হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসল। জানালার পানে নজর রাখল মর্ধখণ্ডিত চাঁদটা মেপে দেখল অনিমেষ। জবেদা বেগম সময় নিলেন না। শীগ্রই কাঁচের গ্লাস হাতে ফিরে এলেন। আদার রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে এনেছেন। জ্বর-ঠান্ডা-কাশির জন্য উপকারী বেশ। তন্ময় অভ্যস্ত আদা-মধু খাওয়ায়। জ্বর তো আর তার কম হয়না! হলেই তো খেতে হয়। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে গ্লাস নিয়ে একটানে শেষ করল। গ্লাস ফিরিয়ে নিয়ে জবেদা বেগম নরম গলায় শুধালেন,

‘কিছু কী খেতে মন চাচ্ছে আব্বা?’
তন্ময় ইতস্ততভাবে চুপসে গেল। খেতে তো ইচ্ছে করছে। তবে খাবার নয়। সিগারেট। এটা তো আর মা’কে বলা যাবেনা। তাই মাথা নাড়ায়। মুখে বলে,
‘এখন ভালো লাগছে। রাত হয়েছে। শুয়ে পড়ো মা।’
‘তোকে রেখে শুয়ে পড়ব? তুই ঘুমা। দেখি, শুয়ে পড়।’
তন্ময় অগ্যত শোয়। চোখ বুঝে নেয়। জবেদা বেগম ঘরের বাতি নেভান। পাতলা কম্বলটা আরেকটু গভীর ভাবে ছেলের শরীরে মেলে দেন। দরজাটা ভিড়িয়ে লিভিংরুমে বসেন।

সূর্যের রশ্মি ভীড় জমিয়েছে বিছানার মাথায়। ঠিক তন্ময়ের মুখশ্রীর ওপর। ভ্রু-দ্বয়ের মধ্যিখানে ভাঁজ পড়েছে কিছু। ঘুমের ঘোরে বড়ো অসন্তোষ সে। পুরুষালী ডান হাতের কবজি বিরক্ত ভঙ্গিতে চোখের ওপর রাখল। দরজা খোলার সামান্য আওয়াজ এলো। জানালার গ্লাস লাগিয়ে, পর্দা আটকে দেওয়া হলো। মুহূর্তে আলোকিত রুমটি আঁধারে-আলোয় ডিম হয়ে এলো। ঘুমন্ত তন্ময়ের ভ্রু-দ্বয়ের ভাঁজ মিইয়ে গেল। সাথে ঘুম ও। নুপুরের রিনঝিন শব্দ ধ্বনির শ্রোত বইছে। কানে গানের ন্যায় বাজছে। নাকে ভেসে আসছে চেনাপরিচিত মেয়েলী সুঘ্রাণ।
তন্ময়ের ইচ্ছে করল চোখ মেলে চেয়ে, মায়াবী মুখটা সাতসকালে দেখতে। তবে ইচ্ছেদের সবসময় পূর্ণতা পেতে নেই। ইচ্ছের পূর্ণতা যদি এই ঘনিষ্ঠতা অদূরে ঠেলে দেয়, তাহলে ওই ইচ্ছের পূর্ণতা নাহওয়া শ্রেয়।

‘কেন করলেন ওমন! কেন কিছু বলেন না। আর কতকাল অপেক্ষায় থাকব।’
মিনমিনে গলার মেয়েলী স্বরে অভিমান লেপ্টে। কেমন ধীর, স্থির শোনাল। এভাবে অরুকে কথা বলতে শুনেনি তন্ময়। কথাটুকু শুনে মেরুদণ্ড বেয়ে হিমশীতল বয়ে গেল যেন। ধড়ফড়িয়ে উঠল ব্যাকুল হৃদয়। অশান্ত, অবিন্যস্ত হলো মস্তিষ্ক। এই কণ্ঠের গতি জানান দেয়, তার অরু আর বাচ্চা মেয়েটি নেই। সে বড়ো হয়েছে। বুঝতে শিখেছে। তন্ময় ভাবল চোখ মেলে চাইবে। ওসময় দরজা ঠেলে শাবিহা প্রবেশ করে। অরুকে বলে,

‘মা ডাকছে। শুনে আয়।’
অরু বেরিয়ে গেল। শাবিহা ভাইয়ের পাশে বসল। হাত বাড়িয়ে কপাল ছুঁয়ে মিহি কণ্ঠে ডাকল,
‘ভাই? ওঠো। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে নাও।’
তন্ময় হাত সরিয়ে চোখ মেলে তাকায়। বসে যাওয়া গলার স্বরে শুধায়,
‘কখন এলি?’
‘ঘন্টা হবে। উঠো, একসাথে ব্রেকফাস্ট করব।’
‘যা, আসছি।’
শাবিহা যেতেই তন্ময় উঠে দাঁড়ায়। এলোমেলো চুলগুলো কপাল থেকে তুলে পেছনে গুটিয়ে নেয়। ডান হাতের আঙুলের সাহায্যে চোখ ডোলে বাথরুম ঢোকে। গোসল নিয়ে বেরিয়ে দেখে দীপ্ত বসে চুপটি করে। তন্ময়কে দেখে লাফিয়ে দাঁড়ায়। ছুটে কাছে এসে বলে,
‘এখন কেমন লাগছে ভাইয়া?’
‘ভালো।’
‘ভালো হলেই ভালো। চাচ্চু সারারাত জেগে ছিলেন তোমার চিন্তায়।’

তন্ময় স্মিত হাসে। ভেজা চুল তোয়ালেতে মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চুলগুলো মুছে কাবার্ড থেকে টি-শার্ট বের করে। গায়ে জড়িয়ে নিতে নিয়ে আড়চোখে দেখে অরু ঢুকছে রুমে। মাথা নিচু করে এসে বিছানা গোছাতে ব্যস্ত। দীপ্ত কী ভেবে চলে গেল কে জানে! অরু কম্বল ভাঁজ করে, কোমর বেঁকিয়ে বিছানার চাদর ঝেড়ে দিলো। ঝাড়ুটা এনে মেঝে ঝাড়ু দিতে শুর করল। তন্ময় অবাক হলো না বটে। ও সবসময় তার কাজকর্ম জড়িত কাজ করতে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তা রুম গোছানো হোক কিংবা কাপড় কাঁচা। ওপাশটা ঝাড়ু দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, তন্ময়ের জায়গাটা ঝাড়ু দিবে বলে। তবে তন্ময় সরছে না। দাঁড়িয়ে চুল স্যাট করছে। অগোচরে আয়নায় অরুকে দেখছে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললে মেয়েটা চোরের মতো দৃষ্টি লুকিয়ে ফেলছে। চুমুটা বেশ কাবু করেছে ওকে! ভেবেই তন্ময় তাকাল ওই অধর পাবে। অরু নিচের অধরে দাঁত চেপে। তন্ময় দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। দুয়ারের দিক পা বাড়াল। অরুর পাশ দিয়ে যেতে নিয়ে থামল। অরু সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে তাকায়। তন্ময় থেমে থেমে বলে,

‘রোগী দেখতে এসছিস নাকি প্রেমিক? এতো সাজগোছ করার মানে কী!’
আতঙ্কে অরুর চোখজোড়া বড়ো হয়। হতভম্ব ভঙ্গিতে মুখ খুলে। বেশ সময় নিয়ে বলে,
‘কী! একটুমাত্র কাজল দিয়েছি। এখানে সাজগোছের কী দেখলেন তন্ময় ভাই?’
‘অনেক কিছু।’
অরু আরও কিছু বলতে চায়। পূর্বেই তন্ময় পা বাড়িয়ে বেরিয়ে আসে। ওর ধ্যানজ্ঞান ওই রাতের দৃশ্য থেকে সরাতে এরথেকে ভালো ব্যাপার হয়না। ঠিক অরুর ধ্যান সরেছে। ঝাড়ু দিতে দিতে আনমনে বকবক করতে থাকল,
‘কোথায় সাজগোছ করলাম। তন্ময় ভাই দেখি সাজগোছে এবিসিডি ও জানে না।’

সামনে ঈদুল আজহা। কোরবানির ঈদে শাহজাহান সাহেবরা গরু আনেন তিনটা। তিন ভাইয়ের তিনটা, একসাথে আনেন। ঠিক ঈদের সাতদিন পূর্বে। আজ বাদে আর নয়দিন বাকি ঈদের। মোস্তফা সাহেব চিন্তায় পড়লেন। ছেলে ছাড়া কোরবানি কীভাবে হবে! কোরবানিতে গরু আনা থেকে ধরে কাটা পর্যন্ত তার ছেলেই দেখাশোনা করে। তার ওপর স্ত্রী নারাজ! রোজার ঈদ গেল তার মাটি হয়ে। এবার কি কোরবানির ঈদ ও তেমন হবে? সম্পূর্ণ পরিবার ছাড়া কি ঈদের আনন্দ আছে? বড়ো ভাইকে চিন্তিত দেখে আনোয়ার সাহেব প্রশ্ন করলেন,

‘কী ভাবছেন ভাই?’
‘কিছুনা।’
‘ভাই! হাটে যাব যেদিন আগেই তন্ময়কে বলে রাখব।’
‘ও যাবে?’
‘কী বলেন ভাই! যাবে না আবার? ও জানে না আপনি কেমন? ও না গেলে যে আপনার ভাত হজম হবে না, ঠিক জানে। দেখবেন চলে এসেছে সময় মতো।’
মোস্তফা সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। সরু চোখে ছোটো ভাইকে আগাগোড়া দেখে নিলেন। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

সূর্যাস্ত হলো মাত্র। অফিস থেকে বেরোনোর ঘন্টাখানেক পূর্বে কল করল মাহিন। ধানমণ্ডির লেকের পাড়ে আছে সবগুলো। ওখানেই চলে আসতে তাকে। অফিস শেষ করে তন্ময় বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বেরোল। বাইকের গতি মাঝামাঝিতে। আবহাওয়া আজ শান্ত। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবন ক্ষীণ।
পৌঁছাতে সময় লাগল না। বাইক থেমেছে চেনাপরিচিত জায়গায়। অদূরে এদিক-ওদিক ছিটকে বসে তার বন্ধুবান্ধব। ভার্সিটির ক্লাসমেট কিছুও উপস্থিত। তাকে দেখেই হৈচৈ পড়ে গেল। তন্ময় তাদের কাছাকাছি আসতেই, মাহিন একটা সিগারেট হাতে ধরিয়ে দিলো। পাশে বসতেই মাহিন বলে ওঠে,

‘দোস্ত! রনিতা কী বলে দেখ! স্টিল শি’জ ক্রাশড ওন ইউ।’
তন্ময় মাথা তুলে তাকায়। রনিতা তার দিকেই চেয়ে।
ভদ্রতাসূচক মাথা নাড়ায় সে। দৃষ্টি সরিয়ে সিগারেট ধরায়। কথায়-কথায় আড্ডাবাজিতে সময় গিয়ে ঠেকে এগারোটা নয়ে। তন্ময় হাত ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ায়। বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে বাইকে চড়ে বেরিয়ে পড়ে।
মাত্রই লিভিংরুমে এসে বসেছে তন্ময়। জবেদা বেগম ছুটে এলেন। ছেলের হাতে ঠান্ডা পানির গ্লাস ধরিয়ে শুধালেন,

‘গরু আনতে যাবি না?’
‘যাব।’
‘কখন?’
‘যখন সময় হবে।’
‘বাবার মতো ত্যাড়া কথা শুধু।’
মুখ বেঁকিয়ে চলে গেলেন তিনি। তন্ময় সেলফোন তুলে স্ক্রিনে নজর বোলাল। অরু ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ওর সাজগোছ করা একটি ছবি দিয়ে। সুন্দর একটা কাজ করা কামিজ পরে, শুভ্র রঙের। চুল কার্ল করে। স্মোকি ম্যাট মেক-আপ করেছে। ছবির নিচে লেখা,

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ২৩+২৪

‘এটাকে বলে সাজগোছ।’
তন্ময়ের হাসি পেলো এবং সে হাসল ও। ছবিটি সেভ করে হোমস্ক্রিনে স্যাট করল। সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল।
‘মায়াবিনী এক যাকে দেখতে দেখতে সময় ফুরোয়, দেখার সাধ নয়।’

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ২৭+২৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here