ডার্কসাইড পর্ব ২৭
জাবিন ফোরকান
কায়সার এম্পায়ার।
অফিস ভবনের নিচের বেজমেন্টের পাতাল কক্ষে বসে আছেন বাদশাহ কায়সার।তার ঠিক ডান পাশে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ। নিভুনিভু দৃষ্টি তার আবদ্ধ সম্মুখে রাখা কফিনের দিকে। গার্ডরা আশেপাশে অবস্থান করছে, সকলেরই নতমুখ।শুধুমাত্র মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা একজন কফিনের উল্টোপাশে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে কাপছে।আতঙ্ক এবং দুশ্চিন্তায়। বাদশাহর সুস্থির শীতল দৃষ্টি শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়ার মতনই প্রবল।
ইশারা করতেই কফিনটি কাছে টেনে আনা হলো, বাদশাহ একটুখানি ঝুঁকলেন। তার বিশ্বস্ত মাহিনের নিথর দে*হ হিমায়িত।সম্পূর্ণ শরীর ধারণ করেছে ফ্যাকাশে বর্ণ,জিহ্বা বেরিয়ে রয়েছে,দৃষ্টিও আধ উন্মুক্ত।দেখতে ভীষণ বী*ভৎস লাগছে।তার চাইতেও বিভীষিকাময় ব্যাপার তার বুকের উপর ধা*রালো অ*স্ত্র দিয়ে খোদাই করা হয়েছে একটি ইংরেজী অক্ষর।
“ এ ( A ) ”
অক্ষরটির চারিপাশে র*ক্ত জমাট বেঁধে কালচে হয়ে রয়েছে।দৃশ্যটিতে দৃষ্টিপাত ঘটালেই শরীরের রোমকূপজুড়ে শীতল শিহরণ খেলে যায়।এ যেন অশরীরীদের কার্যক্ষেত্র।নিজের দৃষ্টি সরিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে আনলেন বাদশাহ।ক্রোধ, আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা, ভীতি, সংশয়ের মিশ্রিত এক বিস্বাদ অনুভূতি অনুভব করছেন তিনি।মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা লোকটি কম্পিত কন্ঠে বলতে থাকলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– আমি কিছুই জানিনা কিভাবে কি হয়েছে।আমাকে তো এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে পাঠালেন মাহিন ভাই, এরপর ফিরে আসার সময় দেখি মেয়েটা দাঁড়িয়ে দেয়ালের পাশে।কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইট দিয়ে…
বলে সমাপ্তও করতে পারলোনা সে। বাদশাহর নীরব ইশারায় দুইজন অগ্রসর হলো,পি*স্ত*ল ঠেকিয়ে কাছ থেকে গু*লি ছুঁড়লো। সাইলেন্সারে শব্দ হলো মৃদু, ছিটকে উঠলো ম*গজ! মৃ*ত্যুর হাহাকার তুলে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো সদ্য প্রাণহারানো শরীর।কেউ কোনোপ্রকার টু শব্দটিও উচ্চারণ করলোনা। বাদশাহর দৃষ্টি তখনো কফিনে, মাহিনের গলায় বাঁধা বোও বাঁধনটি দৃষ্টি কেড়েছে তার। দারুণ এক উপহার পাঠানো হয়েছে তাকে কি*লিং মেশিনের তরফ থেকে।
দীর্ঘ এক মুহূর্তের নীরবতা।অবশেষে দীর্ঘশ্বাসের ধ্বনি কর্ণগোচর হলো সকলের।বাদশাহ হাতের তালুতে মুখের অর্ধাংশ ঢেকে নিলেন।বিড়বিড় করলেন,
– দ্যা গার্ল ইয বিইং প্রোটেক্টেড বায় আসমান।
– জ্বি।
মৃদু কন্ঠে জবাব সারলো আকাশ।এক নজর সদ্যমৃ*ত দেহের দিকে চেয়ে পুনরায় যুক্ত করলো,
– জটিল এক নিরাপত্তার দেয়াল তুলে দেয়া আছে।নাম্বার ট্র্যাক করাও সম্ভব নয়।নির্দিষ্ট এরিয়ার ভেতরে প্রবেশ করলেই সিগন্যাল হারিয়ে যাচ্ছে।অবস্থান ট্রেস করতে ব্যর্থ আমাদের সাইবার এক্সপার্ট টিম।নতুন কোনো সফটওয়্যারের ফায়দা ব্যবহার করা হচ্ছে নিজেদের যোগাযোগ মাধ্যম ফাঁস হওয়ার হাত থেকে রক্ষায়।
শুনে গেলেন বাদশাহ।এমন পারদর্শীভাবে নিজেকে লোকাতে সক্ষম ওই একটিমাত্র বান্দাই।ঘুরেফিরে সবকিছুই তার অস্তিত্বকে নির্দেশ করছে।ঘটেছে এক নবউত্থান।বাদশাহ উঠলেন, আসন এড়িয়ে পায়চারি আরম্ভ করলেন কফিনের পাশে। কেউই কিছু উচ্চারণ করার সাহস করছেনা,একমাত্র আকাশ ব্যতীত।কথা বলতে তার অনুমতির প্রয়োজন নেই।
– ২১ শে সেপ্টেম্বরের আয়োজন ক্যান্সেল করা হয়েছে।আমাদের হাতে আর কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই।
– ফাঁদ পেতে মেশিনকে ধরা সম্ভব নয়।
বহুদিন বাদে বাদশাহর কন্ঠে এক পরাবাস্তব অনুভূতির উপস্থিতি টের পাওয়া গেলো।স্থির তাকিয়ে থাকলো আকাশ, প্রভুর এমন বাক্যের অর্থ হয়ত তার কোনো ভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।তার দিকে ঘুরে বাদশাহ বিড়বিড় করলেন,
– আসমানের শেষ টার্গেট এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।নিশ্চয়ই খুব শীঘ্রই তার মৃ*ত্যু পরোয়ানা জারি হবে।
সহসাই সবটা উপলব্ধি করলো আকাশ।কোনদিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে এবং পরিকল্পনা কেমন হবে তাকে বুঝিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই।মৃদু হাসি নিয়ে বাদশাহ জানালেন,
– অনেক হয়েছে এই ইদুর বিড়াল দৌড়। ফাঁদ পেতে ধরা সম্ভব না হলে তার ফাঁদেই তাকে আবদ্ধ করতে হবে।
নিজের দাড়িতে হাত বুলিয়ে চললেন বাদশাহ কায়সার।তার ব্যবসায়িক প্রতিপত্তি বেহাত হতে শুরু করেছে,টেন্ডার হারানোর খবর ইতোমধ্যে মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে।এবার তাই এসপার নয়ত ওসপার।
যে মেশিনকে তিনি নিজ হাতে তৈরি করেছেন সেই তার সাম্রাজ্যের বিনাশকরূপে আবির্ভূত হবে কোনোদিন কল্পনা করেছিলেন বাদশাহ?নাহ, কোনোদিনও না। এ লড়াই বর্তমানে শুধু প্রতিশোধের নয়,এ লড়াই অমোঘ অস্তিত্বের লড়াই।জিতবে একজনই, অপরজন হারাবে সবকিছু, নিঃস্বতার কলঙ্ক গ্রাস করবে তাকে অচিরেই।
মারবেল ভবন।
বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গিয়েছে।অশুভ সেপ্টেম্বর মাস বিদায় নিয়েছে ভবনের মানুষগুলোর জীবন থেকে। অক্টোবরের মৃদু শীতের আবহ ধীরে ধীরে আপন হিমের চাদর বিছাতে আরম্ভ করেছে প্রকৃতিজুড়ে।দিন হয়ে এসেছে ছোট, আঁধারের রাত্রি দীর্ঘ।বছরের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ানো সভ্যতা ব্যাস্ত সর্বোচ্চটুকু আদায় করে নিতে।
গত দুইদিন ধরে ভীষণ ব্যাস্ত আসমান। ব্যাস্ত বলতে তার মুখদর্শনের সুযোগটুকুও হয়নি রোযার।কারণ?সে বাড়িতেই ফেরেনি।কোথায় আছে,কি করছে সেই সম্পর্কে বিশেষ কোনো ধারণা কারোর নেই।নিহাদও নিজের তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিয়েছে। মারবেলে তার শেষ সপ্তাহ।তারপর বিদায় নেবে সে, পাড়ি জমাবে আপন ঠিকানায়।বিলাল রেমান পর্যন্ত নিজের আপন জগতে ডুবে রয়েছেন।খুব ভোরে বেরিয়ে যান,ফিরে আসেন গভীর রাতে।মাঝে মাঝে তাকে সঙ্গ দেয় চারুলতা।কোম্পানির কোনো কাজে ব্যাস্ত সময় পার করছেন।কে বি গ্রুপের অর্থনৈতিক ভিত্তি গুঁড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা সম্পর্কে রোযার কোনো ধারণা নেই।তবুও তার আশেপাশের মানুষগুলো আচার আচরণে সে আন্দাজ করতে সক্ষম।
এক অঘোষিত যু*দ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে শীঘ্রই।
কেউই বাসায় নেই।না নিহাদ,না আসমান, না বিলাল রেমান।সম্পূর্ণ একলা রোযা।অবহেলায় প্রস্তুতকৃত একটি রুটি আর ডিমভাজা দিয়ে ক্ষুধা মিটিয়ে চারুলতার কাছ থেকে ধার করে আনা ল্যাপটপ নিয়ে বসলো সে।দাদুর চলে যাওয়ার পর থেকে মানসিকভাবে এতটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে যে নিজের জীবনে মনোযোগ দেয়ার কোনো ইচ্ছা হয়নি।কিন্তু বাস্তবতা ভালোই উপলব্ধি করতে পারছে।জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না।যতদিন না সৃষ্টিকর্তা নিজ ইচ্ছায় তাকে নিজের কাছে টেনে নেন,ততদিন পর্যন্ত এই ইহকালের জীবনবোঝা তাকে বইতে হবে।
বিছানায় পা গুটিয়ে বসে ল্যাপটপে প্রুফ রিডিং শেষে ই মেইলে ফাইল অ্যাটাচ করে অফিসের ঠিকানায় সেন্ড করে দিলো।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপ ভাঁজ করে দুহাতে মুখ ঢাকলো।সেপ্টেম্বর মাসে আগের লিখা একটা গল্প দিয়ে চালিয়ে দিয়েছে, এটা দ্বিতীয়টি।গতদিন থেকে নিজের মস্তিষ্ককে জাগতিক যন্ত্রণা থেকে দূরে রাখতে ভেবে ভেবে লিখেছে।কে জানে, ফিডব্যাক কেমন আসে? ফাউন্টেন পেনের সম্পাদক জ্যাক হেনরি অবশ্য তার দাদুর প্রয়াণের খবরে বিরতি নিতে বলেছিলেন।কিন্তু রোযা নিজের চাকরির প্রথম পর্যায়েই গাফিলতির অভিযোগের সুযোগ দিতে চায়নি কর্তৃপক্ষকে।তাই যেমন করেই হোক নিজের কাজটাকে অন্তত ঠিক রেখেছে, এবং রাখবে এমনটাই ইচ্ছা তার।
বিছানায় একা একা বসে ভাবলো রোযা।কি তার জীবনের উদ্দেশ্য?আগে তো দাদুর জন্য বেঁচে থাকা হয়েছে,লড়াই হয়েছে।নিজেকে চুক্তিতেও আবদ্ধ করা হয়েছে।কিন্তু এই চুক্তির আদও কি কোনো প্রয়োজন রয়েছে?কি হবে নিজেকে রক্ষা করে?জীবনের ভয় তো তার আর নেই!তবুও অবাধ্য এ হৃদয় কিছুতেই মানতে চায়না।চুক্তির সমাপ্তির কথা মাথায় আসলেই সমস্ত শরীর কেমন অবাধ্য প্রতিক্রিয়া করতে শুরু করে।যদিও সত্যি নয়,পাতানো,তবুও এখানে একটি পরিবার পেয়েছে সে।একজন বাবা, একজন বোন, একজন ভাই এবং একজন…. কি বলা যায় তাকে?সঙ্গী?রক্ষক?নাকি ধ্বংসক?এমন একটি মানুষের প্রতি রোযা এক সমুদ্র সমান দুর্বলতা অনুভব করবে সেটা কোনোদিন ভাবতেও পারেনি।এতদিন নিজের অনুভূতিগুলোকে স্রেফ প্রয়োজন বলে চালিয়ে দিয়েছে নিজের কাছে।কিন্তু অন্তরের কাছে কি মিথ্যা বলা যায়? হৃদয়মাঝে প্রস্ফুটিত নব্য অনুভূতির কলিটি ধীরে ধীরে পাঁপড়ি মেলে পুষ্পের আকৃতি ধারণ করতে শুরু করেছে।কিভাবে রুখবে এই বেহায়া মনকে?
আসমান এবং তার রহস্যেঘেরা অস্তিত্ব।কোনো এককালে এই রহস্যমানবও ভালোবেসেছিল এক ভাগ্যবতীকে।নিজের সবটুকু উজাড় করে আগলে নিয়েছিল হৃদয়রাণীকে।তাদের বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে, সন্তান হয়েছে, হয়েছে একটি পরিবারও।কিছু না থাকা থেকে হুট করে পেয়ে যাওয়া,এবং পাওয়ার পর আবার সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া… অতি মাত্রায় নিষ্ঠুর!অসহ্য এক যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি।রোযার তুলনায় ভালো আর কেই বা জানবে প্রতিনিয়ত এমন অনুভূতি বুকে পুষে বেঁচে থাকার গ্লানি?
মৃদু পদশব্দে রোযার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটলো।মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই চারুলতাকে রুমে প্রবেশ করতে দেখল।ঘুমের পোশাক পরে একেবারে তৈরি সে। বর্তমানে রোযার সঙ্গে থাকার প্রয়োজন যদিও নেই, কিন্তু আজ বাসা খালি বলে রোযাই তাকে আসতে বলেছে।হৃদয়ের ঠিকঠিকানা নেই। একা একা ভাবতে ভাবতে যদি কখনো আবার উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে?
বিছানায় উঠে মুহূর্তেই নিজের পাশে শুয়ে পড়লো চারুলতা।মেয়েটাকে ক্লান্ত লাগছে।ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করেছে আজ সারাদিন।তাই রোযাও বিশেষ কিছু না বলে লাইট অফ করে শুলো।কিন্ত ধুকধুকে হৃদযন্ত্র জানান দিচ্ছে যে আজ রাতে খুব সহজে ঘুম নামক বস্তু তার নয়নে আগমন করবেনা।দীর্ঘ মুহূর্তজুড়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই মুখ খুললো রোযা।
– আসমান এবং চিত্রলেখার মেয়ে ছিলো।
সবেমাত্র বুজে আসা চারুর চোখ চট করে খুলে গেলো।কিছুটা বিস্ময় নিয়ে সে মাথা ঘুরিয়ে চাইলো রোযার দিকে।এই পর্যায় পর্যন্ত বর্ণনা সে করেনি।তাহলে মেয়েটা কিভাবে জানলো তাই ভাবছে।রোযা পাশ ফিরল,মাথার নিচে হাত দিয়ে দৃষ্টি মেলালো চারুর সাথে।একদম সুস্থির তার মুখবয়ব।
– চারুলতা…. আমি উপন্যাসের অন্তিম পাতা পর্যন্ত পৌঁছতে চাই।এখনি সেই সময়।
সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি গেলো চারুর।একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো তার বুক থেকে।মৃদু কন্ঠে শুধালো,
– তুমি সত্যিই প্রস্তুত?
এক মুহুর্ত ভাবলো রোযা।
– না,মোটেও প্রস্তুত নই।
অবাক হয়ে চারুলতা তার দিকে তাকাতেই রোযা যুক্ত করলো,
– কিন্তু আমি সেই অতীতের মোকাবেলা করতে চাই।জানতে চাই,বুঝতে চাই।সবকিছুর সাক্ষী হতে চাই।
একটি ঢোক গিললো চারুলতা।তার দৃষ্টি ফিরে গেলো সিলিংয়ে।মিনিটখানেক পর তার কণ্ঠে ধ্বনিত হতে আরম্ভ করলো,
– আপু আর আসমানের বিয়ের পর….
স্মৃতির পাতা উল্টে অতিবাহিত হয়েছে দেড় বছর। চারশতাধিক দিন সময় নামক জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় বদলেছে ব্যাপক কিছু।একসময় অচিন্তনীয় বিষয়বস্তুও আজ বাস্তবতা হয়ে ধরা দিয়েছে এই ধরিত্রীর বুকে বসবাসরত কিছু কিছু মানুষের জীবনে।মানবজীবন আসলেই বড্ড বিচিত্র,নাটকের চাইতেও নাটকীয়।তাইতো কবি সাহিত্যিকগণ সেই অমোঘ বাস্তবতার নিরিখে সাজান নিজেদের কবিতার পংক্তি, নাটকের দৃশ্য, কিংবা উপন্যাসের কাহিনী।বাস্তবতা নাটক চলচ্চিত্র নয়,কিন্তু তা এই মানবজীবনের মোড়ে মোড়ে ঘটিত গল্পসমূহ থেকেই অনুপ্রাণিত।
ইতালির উত্তর প্রান্তের একটি গ্রাম মানারোলা।জগৎবিখ্যাত চিংকু তেরে রিজিয়নের মোট পাঁচটি গ্রামের মধ্যে অন্যতম এই গ্রামটি পর্যটক মাত্রই আকর্ষণের বিষয়বস্তু।সমুদ্রের পাশেই পর্বতের ন্যায় টিলার উপর সজ্জিত রং বেরংয়ের বাড়িঘর।যার দেয়ালে দেয়ালে জড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস।জনজীবন এখানে বড়ই প্রশান্তিকর।স্নিগ্ধ আবহাওয়ার নৈঃশব্দ্য,তার সঙ্গে কফির স্বাদ উপভোগ করতে করতে সূত্রপাত ঘটে দিনের।দিবাকর পশ্চিমে ঢলতে ঢলতে বৃদ্ধি পায় পর্যটকদের আনাগোনা।
স্থানীয়রা ধরনা দেয় বাজারগুলোতে,প্রয়োজনীয় সতেজ সবজি সংগ্রহ করতে।সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ঝলমলে বাতিতে সজ্জিত হয়ে উঠে অলিগলিতে মোড়ানো সড়কগুলো।ছেলেমেয়ের দল ছুটে বেড়ায় হেসে খেলে।প্রাচীন সুরে বেজে উঠে বাঁশুরি, নিজেদের মন প্রাণ তাতে বিলিয়ে আনন্দে মেতে উঠে বাসিন্দাগণ।
দিবাকর পশ্চিম প্রান্তে উঁকি দিচ্ছে।জানান দেয়া নিজের অস্ত যাওয়ার সময়ের। লাইব্রেরীর অভ্যন্তরে তাকের মাঝে থরে থরে সাজানো পুস্তকগুলোর মোটা মলাটে সেই সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে চলেছে।বায়ুতে পুরোনো কাগজের অদ্ভুতুড়ে সুঘ্রাণ, নীরবতার মাঝে শুধুমাত্র পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টানোর শব্দ।কেউ বা আবার বই থেকে নিজের ল্যাপটপে টুকে নিচ্ছে প্রয়োজনীয় অংশ,কি বোর্ডের কী চাপার মৃদু ধ্বনি কারো জন্য বিরক্তিকর হলেও ঠিক আপত্তিকর নয়।প্রতিদিনের মতোই নিজের প্রয়োজনীয় বইটি সংগ্রহ করে এগিয়ে এলো মেয়েটি। লাইব্রেরিয়ানের ডেস্কের নিকট এসে নিজের কার্ড দিয়ে ব্রেসলস্ পরিহিত দাঁত দেখিয়ে হাসলো।
– প্রেন্দো কুয়েস্তো লিব্রো অজি। [ আজ এই বইটি নিচ্ছি ]
– বেনে। [ ঠিক আছে ]
পাল্টা উত্তর এলো ইটালিয়ানে।যদিও মানুষটি এদেশীয় নয়,তবুও ভাষার টানে বোঝা দায়।ধবধবে বর্ণের ত্বকে সকলের মাঝে তাকে কিছুটা আলাদাভাবেই চোখে পড়ে, এই কয় মাসের আনাগোনায় পরিচিত হওয়া হয়েছে অনেকটাই।
– কমেস্তা আন্দালদোলা জোরনাতা? [ দিন কেমন যাচ্ছে?]
– গ্রান্দে! [ চমৎকার ]
জবাব দিয়ে আসমান বইটি সুন্দর করে কাগজে মুড়িয়ে মেয়েটিকে দিলো।রেজিস্টার বুকে টুকে নিলো তার লাইব্রেরী কার্ড নম্বর এবং আজকের তারিখ।বইয়ের প্যাকেট নিয়ে মেয়েটি দ্বিতীয় দফায় উজ্জ্বল হেসে বললো,
– চি ভেদিয়ামো আল ফেস্তিবাল? [ উৎসবে দেখা হচ্ছে তাহলে ]
– চি ভেদিয়ামোলি। [ দেখা হচ্ছে ]
– বুওনোসিয়েরা। [ শুভ সন্ধ্যা ]
হাত নেড়ে মেয়েটি বিদায় নিলো।পাল্টা হেসে হাত দেখালো আসমানও।
সন্ধ্যা হওয়ার আগে আগেই লাইব্রেরীর শিফট শেষ করে বেরিয়ে পড়লো আসমান।সমুদ্র থেকে প্রবাহিত হয়ে আসা বিশুদ্ধ নোনা বায়ুতে বুক ভরে মুক্তির প্রশ্বাস টেনে এগোলো।রাস্তা ধরে চললো বাজারের দিকে।ক্রমেই ভিড় বাড়ছে।পর্যটকদের আনাগোনায় পরিপূর্ণ সড়ক থেকে দোকানপাট পর্যন্ত।তবে এই ভিড় খুব একটা খারাপ লাগছেনা আসমানের।বরং এই জীবনে সে ক্রমশই অভ্যস্থ হয়ে পড়ছে।
কখনো কি ভেবেছিল সেও জীবনে কোনোদিন স্বাধীনতা লাভ করবে?এই পৃথিবীতে সবকিছু থেকেও এতদিন তার কিছুই ছিলোনা।পরাবাস্তব এক শৃংখলে আবদ্ধ আপন সত্তাকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে যে অস্তিত্ব,তার প্রতি আসমানের কৃতজ্ঞতা কিংবা ভালোবাসার কোনো শেষ নেই।অমানিশায় ডুবে ছিল সে।তারপর হঠাৎ একদিন এক দীপ্তিময় হাতের ছোঁয়ায় তার সাদাকালো বর্ণহীন জীবনে চড়েছে রঙের ছটা। তারই পরিণয় আসমানের বর্তমান জীবন।যে জীবনে আবেগ,অনুভূতি,ভালোবাসা, মায়া,স্বপ্ন, সুখের কোনো শেষ নেই।
বাজারে এসে দরদাম করে কিছু সতেজ সবজি এবং ক্র্যাব কিনলো।তারপর ধরলো বাড়ীর পথ।ক্রমশ পাহাড় বেয়ে ওঠার মতন সড়ক, দুইপাশে রঙিন বাড়ি।বারান্দায় বারান্দায় ঝুলছে টব, কেউ কেউ আবার শখ করে লণ্ঠন ধরিয়েছে। দাওয়াত বসে আকাশ দেখছে কেউ, কেউবা সান্ধ্যকালীন পানীয় পান করতে করতে আরামকেদারায় আসিন।আসমান পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে প্রতিবেশীদের দুই একজন হাত নাড়লো তার উদ্দেশ্যে। ইটালিয়ানে সম্ভাষণ বিনিময় করে শেষ প্রান্তের নীল রঙের বাড়িটার কাছে পৌঁছল সে।করাঘাত এড়িয়ে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো।
আরামদায়ক এবং উষ্ম বাড়ির ভেতরের কক্ষে ঢুকতেই কিচেন থেকে উঁকি দিলো চিত্রলেখা। ঠোঁটজুড়ে তার বিস্তৃত হাসির রেখা।
– ওয়েলকাম হোম, মাই ব্রোকেন হার্ট।
সম্বোধনে হাসলো আসমান।এগিয়ে গিয়ে কাউন্টারের উপর হাতের ব্যাগ রেখে দিলো। সিংকে ধুয়ে নিতে লাগলো নিজের হাত।পিছন থেকে তার বাইরের পোশাক খুলে নিয়ে ঝুলিয়ে রাখলো চিত্র,তার উভয় বাহুতে জড়িয়ে ধরলো নিজের স্বামীকে। কাঁধে চুমু ছুঁইয়ে বিড়বিড় করলো,
– কেমন গেলো দিন আপনার,মিস্টার?
উল্টো ঘুরল আসমান,নিজের বাহুতে চিত্রকে কাছে টেনে ফিসফিস কন্ঠে জানালো,
– এমনিতে ঠিকঠাক।কিন্তু তোমাকে ছাড়া একাকিত্বে মোড়ানো।
– উফ্ বাবা, এত রোম্যান্টিক কথাবার্তা কবে থেকে শিখলেন মিস্টার ব্রোকেন হার্ট? এত মিষ্টতা আমার সইছেনা, ডায়াবেটিস হয়ে যাবে।
– হুম, লাইব্রেরীর উপন্যাসের কিছু লাইন চুরি করে নিজের কল্পনা মিশ্রিত করে তৈরি করছি।সমস্যা এতই কি তাতে?
– অবশ্যই নয়…. আমি এমন মিষ্টতা চাই, আরও চাই।
আসমানের কাঁধে হাত জড়িয়ে কাছাকাছি এলো চিত্র।তাকালো নয়নপানে।উভয়ের দৃষ্টিই এক, কামনা গভীর কিছু।ঝুঁকে এলো আসমান,চিত্রের মুখ আলতোভাবে স্পর্শ করে তার কোমল ওষ্ঠে ছোঁয়ালো নিজের অধর। সেকেন্ডখানেকের কোমলতা রূপ নিলো নিগূঢ়তায়। বুজে এলো চোখের পাতা।আসমানের চুলে জড়িয়ে গেলো চিত্রর আঙুল।
– ওয়া…. উওয়াআ!
তীক্ষ্ণ ক্রন্দনধ্বনিতে ভালোবাসা বিনিময়ের মুহূর্তে ছেদ পড়লো।নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খিলখিল করে হাসলো চিত্র।
– তোমার নবাবজাদী বড্ড পজেজিভ।
মৃদু শব্দ করে হাসলো আসমান, দ্রুতগতিতে চিত্রর কপালে চুমু এঁকে ছুটলো ভেতরের রুমে।ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বাজারের প্যাকেট থেকে জিনিসপত্র বের করতে লাগলো চিত্র।কিছুক্ষণ পরেই ক্রন্দনধ্বনি থমকে গেলো,ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আসমান, তার কোলে ফুটফুটে এক ছোট্টদেহী শিশুকন্যা।
– আহ আমার মেঘ সোনা, পাপাকে মিস করেছ তুমি হুম?
সোফায় বসে কন্যা মেঘের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে উঠলো আসমান।ছয় মাস বয়সী মেঘ নিজের পিতার আঙুল চেপে ধরে স্ববিস্ময়ে চেয়ে আছে।কিছুক্ষণ হলো মাত্র ঘুম থেকে জেগেছে সে। সারা বাড়িকে জানান দেয়া দরকার ছিল যে মহারানীর ঘুম ভেঙেছে, রাজ্যপাট চালাতে প্রস্তুত সে।আসমান প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টিতে একমনে নিজের ছোট্ট অংশটার দিকে তাকিয়ে রইলো।সেও একদিন পিতৃত্বের স্বাদ লাভ করবে, এমন অকল্পনীয় চিন্তা তার জীবনে চিত্রলেখা আসার পূর্বে কোনোদিন আসেনি।
কিচেন থেকে স্বামী এবং সন্তানের খুনসুঁটি মাখানো দৃশ্যের দিকে চেয়ে রইলো চিত্র।নিজের হৃদয়ে এমন এক আবেগ অনুভব করলো যা পৃথিবীর কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।এত সুখ তার জীবন, এত শান্তি!সৃষ্টিকর্তা আদতেই পরম দয়ালু।তাই আসমানের মতন একজন মানুষকে তার ভালোবাসা, তার স্বামী হিসাবে প্রেরণ করেছেন। আশীর্বাদস্বরুপ এই ভালবাসার সম্পর্কের মাঝে আগমন ঘটেছে মেঘের। সম্পূর্ণ নাম চিত্রিতা রেমান মেঘ।আসমান এবং চিত্রলেখা;উভয়ের একটি করে অংশ নিজের মাঝে ধারণ করে বেড়ে উঠছে মেঘ।
আজও মেঘের জন্মের দিনটার কথা খুব মনে পড়ে চিত্রর।গর্ভাবস্থায় শেষ কয়েক মাস সে বিলাল রেমান আর চারুর সাথে রোম শহরে কাটিয়েছে।যেদিন হাসপাতালে তার ডেলিভারি ডেট ছিলো, সেদিন ঘন কালো মেঘপুঞ্জে আচ্ছাদিত হয়েছিল সমস্ত আকাশ।পরবর্তীতে চারুলতার কাছে শুনেছে,সে অপারেশন থিয়েটারে থাকাকালীন আসমান এতটাই আতঙ্কিত ছিল যে ডাক্তার কিংবা নার্স কাউকে দেখলেই ছুটে যাচ্ছিল,থরথর করে কাপছিল তার শরীর।আর মেঘকে প্রথমবার কোলে নেয়ার পর…. অনুভূতিহীন মেশিনও মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে কেঁদেছিল, অনেকক্ষণ।আসমানের নয়নে শুধুমাত্র একটিবারই চোখের জল খেয়াল করেছিল চিত্র,তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার সময়ে।তারও যে আবেগ রয়েছে, সেও যে কষ্টে কিংবা খুশিতে কাদতে পারে তা সকলের নিকট প্রমাণিত হয়েছিল মেঘের জন্মের দিন।
মেঘ বলতে রীতিমত অজ্ঞান আসমান।চিত্র আগেই খেয়াল করেছিল, বাচ্চাদের প্রতি একপ্রকার ভিন্ন টান রয়েছে মানুষটার। চিত্রর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যারা বাচ্চাদের ভালোবাসতে জানে,তারা আর যাই হোক অন্তত মানুষ হিসাবে খারাপ হয়না।আসমানের প্রতি দূর্বলতা তার তাতে আরও গভীর হয়।নিজের সন্তান পৃথিবীতে আসতে চলেছে জেনে ছেলেটির অভিব্যক্তি এতটাই প্রফুল্ল হয়ে উঠেছিল যে সবকিছু ভুলে গেলেও চিত্র কোনোদিন সেই মুহূর্তটি ভুলবেনা।
জন্মের পর মায়ের থেকে অধিক নিজের বাবার প্রতি আসক্ত হয়েছে মেঘ।চিত্র গর্ভবতী থাকাকালীন সকল সাংসারিক কাজ থেকে আরম্ভ করে যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর কাজ আসমান করতো, চিত্রকে সামান্যতম কষ্টও করতে দিতে রাজী ছিল না সে।রান্নায় চিত্রকেও টেক্কা দেয়ার ক্ষমতার উৎপত্তি তার সেখান থেকেই।মেঘ আসার পর তাকেও দেখভালের দায়িত্ব সে পালন করে আসছে সমানতালে।প্রয়োজন বলে নয়,তার ভালো লাগে নিজের পরিবারের যত্ন নিতে।অদ্ভুত সম্মোহনী ক্ষমতা রয়েছে আসমানের।নিজের স্নেহ এবং ভালোবাসার চাদরে সে সর্বদা মুড়িয়ে রাখে মেয়েকে,রক্ষা করে চলে সমগ্র অশুভ জগতের হাত থেকে।স্ত্রী সন্তানের ছোট্ট এই পরিবারটি তার জন্য পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গীয় নীড়।
সোফায় আসমান এবং মেঘ খেলতে খেলতে মেঘের দুধ তৈরী করে এগোলো চিত্র।আসমানের হাতে ফিডার তুলে দিতেই সে মেঘকে কোলে বসিয়ে বিড়বিড় করলো,
– মামণি, আ করো তো…এই দেখো…তোমার সুন্দরী মায়ের তৈরী সুস্বাদু খাবার তৈরি। না খেলে আমার দিকে জুতো ছুঁড়ে আসতে পারে,তুমি নিশ্চয়ই চাও না তোমার পাপা ব্যথা পাক, হুম?
হেসে আসমানের মাথায় চাটি লাগালো চিত্র, পাল্টা হেসে মেয়েতে মনোযোগ দিলো আদর্শ পিতা।
চিত্র ঘরের কাজ গুছিয়ে নিয়ে রাতের খাবার তৈরি করতে করতে মেঘকে নিজের কাছেই রাখলো আসমান।একটা সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে নিজের রাজকন্যাকে তার ক্রিবে শুইয়ে কপালে ভালোবাসার চুমু একে দিলো।
নিজের হাতে থাকা অ্যালকোহলের গ্লাস সজোরে মেঝেতে ছুড়ে ফেললো নাবিল।ভেঙে চুরমার হয়ে ঝরঝর করে কাচের টুকরো ছড়িয়ে পড়লো এদিক সেদিক।তাতে আশেপাশে উপস্থিত লোকগুলো ভড়কে গেলেও বিপরীত প্রান্তের আসনে বসা রাফা নির্বিকার।আপনমনে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে নিজের হুইস্কিতে।দৃষ্টিতে ধোঁয়াশা অনুভূতি।
– আবারো ফেইল? কি খাস কি তোরা?সামান্য একটা মন্ত্রীর চেলাকে টপকাতে পারিস না?
হাঁটু মুড়ে বসে আছে দুইজন মানুষ। ভয়ে কাপছে থরথর করে।নাবিল নিজের কোমরে দুহাত জড়িয়ে চিৎকার জারি রাখলো।
– শালার কত বড়ো সাহস!আমাকে নগণ্য মনে করে!একটামাত্র কাজ, সেটা করলে নাকি ভীষন ক্ষতি হয়ে যাবে,আমি নাকি অশিক্ষিত।আবার হু*মকিও দেয়!ওটাকে…
রাফার সুরুৎ করে চুমুক দেয়ার শব্দে বিরক্ত হয়ে নাবিল টেবিলে লাথি হাকালো।মাথা চেপে ধরে বলতে থাকলো,
– সবগুলা অকর্মার ঢেঁকি। আসমান থাকলে এক ঘণ্টায় ওই নিমকহারাম ফিনিশ হয়ে যেতো!
দৃশ্যমানভাবে কম্পিত হয়ে উঠল রাফার শরীর।তবুও নিজেকে নির্বিকার দেখানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা তার।বিড়বিড় করলো,
– যেটা নেই সেটা নিয়ে ভেবে লাভ কি?চলে গিয়েছে, বেঈমানি করে।
– ওই আসমান শালা আরেক ফকিন্নি। কত্ত বড় গাদ্দার!যার খেয়ে যার পড়ে বড়ো হয়েছে,তাকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তার সংসার পাতানো?সে নাকি আর এসব করবে না,মগের মুল্লুক?পবিত্র পানিতে গোসল করলেই কি আর অতীত মুছে যায় শালা?শুধুমাত্র বাবার জন্য….নাহলে ওটাকে ধরে…
– কিছুই করতে পারতিনা ব্রো।তুই আঙুল তোলার আগে ও তোর ধ*র থেকে মাথা বিচ্ছি*ন্ন করে দিত।
কটমট করে রাফার দিকে তাকালো নাবিল।তার বর্তমানে এই বার্বি ডলটাকেই আছাড় দিতে ইচ্ছা হচ্ছে।কিন্তু কিছুই বললোনা।এই মেয়ের মাথার তার ছিড়া,মানসিক সমস্যা আছে,অদ্ভুতুড়ে সমস্যা। তা সবার জানা।নিজের লোকদের দিকে তাকালো নাবিল, আদেশ ছুড়লো,
– তোদের দ্বারা হবে না।নিহাদকে ফোন দে।
– নিহাদ ভাই স্যারের নির্দেশে অলরেডি একটা মিশনে আছে,পাকিস্তানে।
– ফা*ক!
অশ্রাব্য শব্দ উচ্চারণ করে হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো নিহাদ।তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো রাফা। মস্তিষ্কজুড়ে বর্তমানে একটিই চিন্তা বইছে তার।উহু…একজনের চিন্তা।কতদিন দেখে না ওই শুভ্র মায়াবী মুখখানা!
দিবাকর নিজের রশ্মি বিলিয়ে নব্য দিনের সূচনা ঘোষণা করতেই মিটমিট করে নিদ্রাপুরী থেকে ধরিত্রীতে পদার্পণ করলো আসমান। আরমোড়া ভেঙে তাকালো পাশে।তার স্নিগ্ধ ভালোবাসা চিত্রলেখা প্রতিদিনের মতনই স্বপ্নের জগতে বিচরণ করছে। সুদর্শনার মুখখানা সোনালী আভায় প্রজ্জ্বলিত রত্নের ন্যায় চমক প্রদর্শন করছে।মিষ্টি হেসে ঝুকলো আসমান, স্ত্রীর অধরে ছোঁয়ালো নিজ অধরের আলতো স্পর্শ, তারপর সরে গেলো।উঠে বসে পাশের ক্রিবের দিকে তাকালো।নয়নের মণি মেঘ বিলীন আপন জগতে।তার ললাটেও স্নেহ বুলিয়ে বিছানা ছাড়লো আসমান।
আজকে হলিডে, লাইব্রেরী বন্ধ থাকবে।দুপুরের পর থেকে উৎসবে মেতে উঠবে সমস্ত মানোলোয়া। তারই প্রস্তুতি চলমান।ফ্রেশ হয়ে কিচেনে চলে এলো আসমান।গতকাল মেঘ তাদের অনেক জ্বালিয়েছে, থেকে থেকে কেঁদে উঠেছে রাতে।তাতে ক্লান্ত চিত্র সাধারণত আসমানের আগেই ঘুম থেকে উঠলেও আজ উঠতে পারেনি।ঘুমাক একটু,বিশ্রাম দরকার মা এবং মেয়ে উভয়ের।ভেবে নাস্তার জন্য পাউরুটি টোস্ট এবং ডিমপোচের ব্যবস্থা করতে থাকলো আসমান।দক্ষ হয়ে আসা হাতে পোচ তুলে প্লেটে সাজিয়ে ফলগুলো বের করতেই ভাইব্রেট করে উঠলো কাউন্টারের উপর রাখা তার ফোন।তুলে নিলো, স্ক্রিনে বাংলাদেশী নাম্বার দেখে তার ভ্রু কুঁচকে এলো।তবুও রিসিভ করলো,নিজে থেকে কোনো কথাই বললোনা।
– ভালো আছো?
– হুম।আছি।
আগে শুধু “ হুম ”উত্তর পাওয়া যেতো,এখন অতিরিক্ত শব্দ উত্তরে যুক্ত করছে,উন্নতি—ভাবলো ওপাশের মানুষটি।
– মেয়ে হয়েছে শুনলাম।কি নাম রেখেছ?
– মেঘ।
– বাহ্,সুন্দর নাম।
– কেনো ফোন করেছেন?
এক মুহুর্ত নীরবতা।তারপর জবাব এলো।
– কে বি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিরাট আয়োজন করা হয়েছে। জানো নিশ্চয়ই।
– না জানিনা।দেশের খবর খুব একটা রাখা হয়না।
– ওহ।তাহলে জানিয়ে দিলাম।
– আচ্ছা।
– তোমার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এসো।ভাবলাম দাওয়াত তোমারও প্রাপ্য।
– আপনি দাওয়াত দিতে ফোন করেননি।
আবারো নীরবতা,এবার দীর্ঘ সময়ের।অতঃপর নিশ্বাসের শব্দ।
– হ্যাঁ,সবসময়ের মতোই ঠিক ধরেছ।বুদ্ধিতে চির ধরেনি জেনে খুশি হলাম।
– আমি আর ওইসব কাজ করবোনা বলেছি।
– তোমাকে কিছুই করতে হবেনা।শুধু একবার দেখা করো।কিছু পরামর্শ দেবে, বাস।
প্রতিবাদ করতে যেয়েও থমকে গেলো আসমান।
– প্লীজ, কথা দিচ্ছি এই শেষবার।এতদিনের কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে হলেও অন্তত তোমার সহযোগিতা কামনা করছি।
– ঠিক আছে।আমি আসবো।
– আহ,খুশি হলাম।স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে এসো,অন্তত একবার মুখদর্শন পর্যন্ত না দেয়ার মতন পাষাণ হবে না আশা করি।
– হুম,চিত্র চাইলে হবে।রাখছি।
নিজের ফোন কেটে কাউন্টারে রেখে দিলো।তার উৎফুল্ল মনটা হঠাৎ করেই বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। চিত্রলেখাকে বিয়ের সময় বাদশাহ কায়সারকে একপ্রকার হুম*কিই দিয়েছিল সে, রেমান পরিবারের যদি কোনো ক্ষতি হয় সে চুপ বসে থাকবেনা।তাকে সত্যিই ঘাটায়নি বাদশাহ।সেই পরিণতি পাল্টে পুনরায় অতীতের মুখোমুখি হওয়া।নিজের বর্তমানের পবিত্রতা রক্ষা করা সম্ভব হবে কি?
ডার্কসাইড পর্ব ২৬
অবশ্যই হবে,কেন হবেনা? চিত্রকে সে কথা দিয়েছে।তাছাড়া সে আর একা নয়।তারও একটা ছোট্ট সুখের পরিবার রয়েছে। ভাবতেই আসমানের ঠোঁটজুড়ে মৃদু হাসির ধারা ছড়িয়ে পড়লো।
তখনো সে আন্দাজ করেনি তার ভাগ্যের মোড় কতটা নাটকীয় রূপ ধারণ করতে পারে।
