তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৯
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
“হবো না রিল্যাক্স। আমার রাগের দাম এই দুই পয়সা? জড়িয়ে ধরে শুধু একটা চুমু?”
তাজদার হতচকিত! এমন কথা শাইনার মুখে সচরাচর শোনা যায় না। সে খুব সাবধানে কথা বলে। শব্দ উচ্চারণ সতর্কতা অবলম্বন করে।
সে অবাক না হয়ে পারছে না।
শাইনা তাকে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত কয়েক পা পিছিয়ে গিয়েছে। দেয়ালের দিকে মুখ করে দূরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে সে। রাগে চোখদুটো দগদগে লাল।
তাজদার অবাক হয়ে শাইনার দিকে তাকাল। সংযত, শান্ত স্বভাবের শাইনা এভাবে কথা বলছে, এমন উন্মুক্ত আবেগ দেখাচ্ছে এটা অবিশ্বাস্য!
তাজদার সাবধানে পা বাড়াতে বাড়াতে নরম সুরে বলল, “আচ্ছা শান্ত হও। এভাবে বললে বাড়ির মানুষ কেউ শুনতে পাবে।”
শাইনা আরও কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে প্রায় কঠোরভাবে জবাব দিল, “শুনুক।”
তাজদারের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। “এইসব বাচ্চামি মমতাজ। তোমাকে মানাচ্ছে না।”
শাইনার কণ্ঠস্বর এবার সামান্য হলেও খাদে নামল।
“না মানাক। আপনি দাদুকে কি কি বলেছেন সব শুনেছি আমি।”
তাজদার এগিয়ে এল। “মুখে যা বললাম তা তো শুনতে পাবেই। মনের কথা তো শুনতে পাওনা। এসো একটু জড়িয়ে ধরো ভালো করে। মনের কথা শোনো। কেন আমি ওরকম বলেছি তার পেছনের কারণটা তো জানতে হবে তোমাকে।”
শাইনা কোনো কথা শুনবে না। সে পালঙ্কের পেছনে গিয়ে এমনভাবে দাঁড়াল যে তাজদার তাকে আর দেখতে পারছে না। তার মাথায় একটি কথাই ঘুরছে। তার ইমোশন ফেইক। সে আর কোনো ইমোশন দেখাবে না। একদম না।
তাজদার কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর একরাশ হতাশা ঝরে পড়ল তার কণ্ঠে, “তুমি আসবে না তাই তো?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অন্য পাশ থেকে শীতল উত্তর এলো, “জীবনেও না।”
তাজদার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছ?”
শাইনা সুযোগ পেয়েই ফুঁসে উঠল।
“আপনি যে যখন তখন আমাকে ব্লেম করেন তার বেলা?”
তাজদারও এবার একটু কঠিন হলো।
“তুমি যে আমার কাছে থাকতে চাওনা এই সত্যিটা বলে ভুল করেছি আমি?”
“আমি থাকতে চাই না?”
তাজদারের অভিযোগ তীক্ষ্ণ।
“পাঁচ মাস ভিডিও কলে দেখে দিন কাটিয়ে দিয়েছ। তুমি দিব্যি ভালো ছিলে। ছিলে না?”
“হ্যাঁ, সব আমারই দোষ।”
“আবারও কথা ঘোরাচ্ছ। আমি কি জিগ্যেস করেছি?”
“হ্যাঁ, ভালো ছিলাম। বেশ ছিলাম। তো?”
“দাদুকে ওটাই বলছিলাম। যে পাঁচ মাস আমাকে ছেড়ে আরামসে থাকতে পারে, সে পাঁচ বছরও থাকতে পারবে।”
“বসে বসে কাঁদতে বলছেন? কাঁদিনি তারপরও এসে হাসছিলেন এই বলে কাঁদতে কাঁদতে সিদ্দিক বাড়ি বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছি। বেশ করেছি কাঁদিনি।”
শেষ আঘাতটা হানল তাজদার।
“তুমি কত পাষাণ! অথচ বলে বেড়াও আমিই বেশি পাষাণ।”
কথাটা বলার সাথে সাথে দুই পক্ষ নীরব। ঘরের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে ডাক আর ঘড়ির কাঁটার মৃদু টিক্ টিক্ শব্দ ছাড়া কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। শাইনার চোখে জল জমছে। সে আবারও তা মুছে ফেলছে। তার চোখের পানি আরেক বেহায়া।
তাজদার শান্তভাবে বলল,”আচ্ছা বাদ দাও। কেউ কারো জন্য কষ্ট পেয়ে লাভ নেই। ওইসব বাদ। মানুষ ছাড়া মানুষ মরে না। একটু কষ্ট হবে। তোমাকে যখন তখন মনে পড়বে। চাইলেই তোমাকে দেখবো না সামনে থেকে। একটু মজা করি, ওসব করতে পারবো না। হাত বাড়ালেই তোমাকে ছুঁতে পারি। এইসব আর পারবো না। এটুকুই। বাদ দাও। আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ হাসিখুশি থাকো। সামনে এসো।”
শাইনা এল না। তাজদার বলল,”আচ্ছা এসো না। আমিই বেরিয়ে যাচ্ছি। তুমি ঘুমিয়ে পড়লে তখন আসবো।”
বলতে বলতে সে বেরিয়ে গেল। শাইনা উঁকি দিয়ে তার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো।
তাজদার যখন পুনরায় ঘরে ফিরল তখন অনেক রাত। বাইরে শীতের ঠান্ডা হাওয়া বইছে তাই তার গায়ে একটা বাদামী রঙের চাদর জড়ানো। সে আলতো করে দরজাটা ভেজিয়ে দিল।
ঘরে প্রবেশ করে দেখল বিছানায় শাইনা নেই। ডিমলাইটের মৃদু আলো অস্পষ্ট কিছু ছায়া তৈরি করেছে ঘরজুড়ে।
তাজদার চোখ কুঁচকে কিছু একটা ভাবল। ডিমলাইটের আলোয় ভুল দেখছে? ও আবার কোথায় যাবে? সে হাত বাড়িয়ে মূল সুইচ বোর্ডের দিকে যেতেই দেয়ালের ঠিক পাশে শাইনাকে দেখল।
শাইনা সেখানে দাঁড়িয়ে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। সেই দৃষ্টিতে স্পষ্ট অভিযোগ। চেহারায় এখনও রাগের রেশ লেগে আছে। কিছুক্ষণ আগের ঝগড়ার উত্তাপ এখনও তার চোখে-মুখে জমাট বেঁধে আছে।
সবচেয়ে অবাক হওয়ার মতো বিষয়। তার পরনে সেই শাড়িটা! যেটা তাজদার তাকে উপহার দিয়েছিল। অন্ধকারে আবছা হয়েও শাড়িটার জমকালো লাল রং আর সোনালী কাজ তাজদারের চোখ এড়ালো না।
শাইনা নড়ল না। শুধু রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
তাজদার চাদরটা একপাশে রাখতে গিয়েও থামল। কথা না বলে এখন এগিয়ে যাওয়া মানে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করা। সে বলল,”তুমি এখনো ঘুমোওনি কেন?”
শাইনা পাল্টা প্রশ্ন করলো,”কে যেন আমি ঘুমোনোর পর আসবে বলেছিল?”
তাজদার ঠোঁটের কাছে হাত রেখে হাসি আড়াল করলো। শাইনা তা বুঝতে পেরে তার দিকে জোরে একটা শপিং ব্যাগ ছুঁড়ে মেরে সেখান থেকে যেতে যেতে বলল,”চুড়িগুলো আমার হাতে হচ্ছে না। এত ছোট সাইজের চুড়ি আমার হাতে হয় না। আমি বড়ো মানুষ। দেখে মনে হচ্ছে বাচ্চাদের জন্য চুড়ি এনেছে।”
তাজদার শপিং ব্যাগটা খপ করে ধরে ফেললো। তারপর শাইনার দিকে চেয়ে বলল,
“আমি বললাম চুড়ি দিতে। ওরা দিল। এখন তোমার হাতে না হলে আমার দোষ?”
“অবশ্যই আপনার দোষ। আপনি আপনার বউয়ের হাতের সাইজ জানবেন না?”
“মারাত্মক ভুল হয়ে গিয়েছে।”
তাজদার বাকিটা বলার আগে শাইনা বলল,”মাফ নেই। সবকিছুর মাফ হয় না।”
“তুমি বড়ো মানুষ। বড়ো মানুষরা ছোটোমানুষকে মাফ করে দেয় জানতাম।”
“ছোটমানুষকে মাফ করে। যে ছোটোমানুষ সাজার চেষ্টা করে তাকে নয়।”
শাইনাকে আবারও আগের মতো জেদি হিসেবে ফিরে পেয়ে তাজদারের আনন্দ হচ্ছে। আবার চিন্তাও হচ্ছে কিভাবে একে শান্ত করানো যাবে।
শাইনা বিছানাটা এলোমেলো করে ফেলেছিল ব্লাউজ খুঁজতে খুঁজতে। কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে সেগুলো গোছগাছ করতে করতে বলল,
“বাইরে আমার জন্য গিয়েছে নাকি নিজেকে সময় দিতে?”
তাজদার বাধ্য স্বামীর মতো উত্তর দিল,
“কুকুর তাড়াতে। বেশি ডাকাডাকি করছিল।”
শাইনা তার দিকে ফিরে তাকালো।
“আপনার জবাব কে চেয়েছে?”
তাজদার শব্দ করে হেসে ফেললো। শাইনা তেড়ে এসে বলল,”আবার হাসছেনও? আমাকে বিপাকে ফেলে আপনার তো খুব আনন্দ হচ্ছে। গোটা গোটা পাঁচ মাস! যে সময়টায় মেয়েরা স্বামীর কাছে যত্ন খুঁজে সেই সময়টা আপনি হাসপাতালে কাটিয়েছেন। যখন দেখলেন ওখানে আমি নেই তখন…
“আমি তোমাকে..
শাইনা বাঁধা দিয়ে বলল,”আগে আমার কথা শেষ করতে দিন। যখন ওখানে আমাকে দেখতে পেলেন না তখন আপনার ভীষণ রাগ হলো। কিন্তু আপনি সেটা কাউকে দেখালেন না। এমনকি ভিডিওকলে আমার সাথে কথা বলার সময়ও না। কারণ আপনি জানেন আমার শাস্তি হলো পাঁচ মাস আমি এখানে পড়ে থাকবো আর আপনি ঢাকায়।”
“আমি কিন্তু.
“আমার কথা শেষ হোক আগে।”
তাজদার পেছনে হাত ভাঁজ করে গলা হালকা কাত করে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,”আচ্ছা তুমি বলো।”
শাইনা রাগ সামলে নিয়ে বলল,”আপনার মনে হয়েছে আমি ইচ্ছে করে ওখানে যাইনি। তাই নিজ থেকে একবারও আমাকে যেতে বলেননি। আপনার নীরবতা দেখে আপনার পরিবারও ভেবে নিয়েছে আপনি চান না আমি ঢাকায় যাই।”
তাজদার গম্ভীর হয়ে গাল চুল্কাতে চুল্কাতে বলল,”ভয়ানক ষড়যন্ত্র দেখছি।”
শাইনা রাগে দুঃখে তার গায়ের চাদর খামচে ধরে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। মজা করছে এখনো তার সাথে? সে এখানে একটা কথাও মিথ্যে বলেছে? সবকিছুর দোষ তার? সামনে তার ডেলিভারি। বাঁচা মরা আল্লাহর হাতে। এমন একটা সময়ে সে চাইবে না তার সন্তানের বাবা তার পাশে থাকুক? এরা তাকে কি মনে করেছে? নিজেদের সব ভাবনা তার উপর চাপিয়ে দিয়ে যে যার সিদ্ধান্ত নেয়। তার কথা কে ভেবেছে ঠান্ডা মাথায়? রাগে তার মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। এবার রাগগুলো জল হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো গাল বেয়ে। রাগ যদিও একফোঁটা কমেনি।
তাজদারকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে চোখ মুছতে মুছতে বিছানার দিকে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখুনি তাজদার তাকে পেছন থেকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চেপে একটা চুমু খেয়ে বলল,”এনাফ! অনেক রাগরাগি হয়েছে আজকের জন্য। অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে। এসো।”
বলতে বলতে সে শাইনাকে তার গায়ের চাদরটার মধ্যে আড়াল করে নিয়ে সামনে ফিরিয়ে নিল। শক্ত করে জড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,”এমন শীতে একটা সোয়েটার অন্তত গায়ে দিতে হয় মমতাজ।”
“দেব না। আমার একটু শীত করছে না।”
তার মুখের উপর তপ্ত শ্বাস ছেড়ে তাজদার বলল,”আচ্ছা? তাহলে আমি যাকে জড়িয়ে ধরেছি তার শরীর কাঁপছে সেটা ভুল?”
“আমি মোটেও কাঁপছি না মিস্টার তাজদার সিদ্দিকী।”
তাজদার তার মুখের উপর ঝুঁকে কপালে চুমু খেতে খেতে বলল,”আচ্ছা! আমি ছুঁয়েছি বলে হয়তো কাঁপছো।”
শাইনা বলল,”মোটেও না।”
তাজদার তার ডান গালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,”আমি আদর করলাম তাই হয়তো।”
শাইনা শক্তপোক্ত আবরণ একটু একটু সরছে। সে কম্পিত গলায় বলল,”একদম না।”
তাজদার সিদ্দিকী তার বাম গালে মুখ ডুবিয়ে চুম্বন করে বলল,”আমি তোমাকে ছুঁবো, আর তুমি কাঁপবে না তা কখনো হয়?”
শাইনা ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,”বললাম তো কাঁপছিনা।”
“তুমি যে কাঁপছো না তার প্রমাণ কি? আমার কাছে প্রমাণ আছে যে তুমি কাঁপছো।”
বলতে বলতে সে শাইনার কানে একটা চুমু খেল। শাইনার শরীরটা এবার দুলে উঠলো। সাথে সাথে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,”আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনার সাথে অভ্যস্ত হতে চাই না।”
“কেন অভ্যস্ত হতে চাও না?”
“নতুন করে কোনো কষ্ট পেতে চাই না।”
“তুমি বলতে চাইছো আমি যা ছুঁই সব দুঃখ হয়ে যায়?”
“আপনি আমাকে দুঃখ ছাড়া কি দিয়েছেন?”
“তুমি এত অভিযোগ রাখলে আমার কিন্তু যাওয়া হবে না।”
“অভিযোগের এখনো দেখেছেন কি?”
“থাক, আর দেখতেও চাই না। আমাকে যেতেই হবে। উপায় নেই।”
শাইনা তার কলার জাপ্টে ধরে তাজদারকে নিজের দিকে টেনে এনে বলল,”তাহলে এইসব আলগা পিরিত দেখাবেন না। এইসব ভুলতে না পারলে ভুগতে হবে।”
“ভুগতে ভুগতে ভুলে যাবে।”
শাইনা অদ্ভুতভাবে ক্ষীণ শব্দে একটা চিৎকার করে প্রতিবাদ করে উঠলো। তাজদার তার গায়ে চাদরটা ভালো করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”এইসব রীতিমতো অত্যাচার। তুমি শাড়ি পরেছ, আমি মন ভরে দেখবো। কিন্তু তা না। তুমি করছো ঝগড়া?”
“আমি ঝগড়া করছি?”
“না আমিই ঝগড়া করছি। তুমি কখনো ঝগড়া করতে পারো?”
“খোঁচা মারছেন!”
“আরেহ না। কে বললো খোঁচা মারছি?”
“আপনি মশকরা করছেন? এইমুহূর্তেও তামাশা করছেন।”
“তুমি কাঁদছো আর আমি তামাশা করবো বলে তোমার মনে হয়?”
“হয়। কারণ আপনি আমাকে কাঁদতে দেখলে সুখ পান।”
“পরের মতো কথা।”
“আপন কখন ভেবেছেন, নিজের কখন ভেবেছেন?”
“সবসময়। তোমাকে লাল শাড়িতে দেখার পর থেকেই নিজের নিজের লাগে। আজ একদম লাল টমেটো লাগছে। চলো, নুপুরটার একটা বিহিত করি। যাওয়ার আগে কিছু মহৎ কাজ না করলে চলে?”
“দরকার নেই।”
“খুব দরকার। চলো চলো। আচ্ছা একটু কোলেটোলে তুলি।”
“একদম না।”
তাজদার তাকে কোলে তুলে নিল। শাইনা তার গলা জাপটে জড়িয়ে ধরে রেখে বলল,”আমাকে কোলে নিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছেন?”
“তোমাকে কোলে নিলাম কে বললো? নিলাম জুনিয়রকে। ওর জন্মের সময় আমি থাকবো না। তাই এখন এভাবে নিয়ে নিলাম। ক্লিয়ার?”
শাইনার রাগ আরও বাড়িয়ে দিল সে। মনে মনে হাসলো ভীষণ। শাইনাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে শপিং ব্যাগ থেকে নুপুরটা বের করে তার সামনে বসলো। শাইনা বলল,”এইসব আপনি ইচ্ছে করে করছেন তাই না?”
তাজদার তার দিকে তাকালো। কিন্তু কোনো জবাব দিল না। পায়ে হাত দিতেই শাইনা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। তাজদার তার পা টেনে এনে নুপুরটা পরিয়ে দিতে লাগলো। শাইনা তার মুখের দিকে চেয়ে বলল,”বোবা হয়ে গেলেন কেন?”
তাজদার এবার ভাবলো আর কোনো কথা বলবে না। কথার পিঠে কথা বাড়বে। তাকে শান্ত করাতে হলে তার চুপ থাকাটা জরুরি। এইসময় অনেক রকম মুড সুয়িং হয় মেয়েদের। সে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। বলল,”কিছুক্ষণ পর সকাল হয়ে যাবে।”
“শীতের রাত অনেক বড়ো।”
“ঘুমাও।”
শাইনা ধমকে বলল,”আপনি ঘুমান।”
“ওকে।”
শাইনা বিছানায় বসে প্রলাপ বকতে লাগলো। তারপর কিছুক্ষণ পরপর তাজদারের দিকে তাকাতে লাগলো। এই মানুষ কি চায় নিজেও জানেনা। সারাদিন তার সাথে সবার সাথে রাগ দেখালো চলে যেতে হবে বলে এখন আবার এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন উনি কখনোই রাগ দেখাননি। সব রাগ সে দেখিয়েছে।
সে আবারও চোখ মুছলো। আবারও দরজার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পর আবারও তাজদার সিদ্দিকীর দিকে। শেষমেশ আর না পেরে বলল,
“কাল সকালেই আমি বাড়িতে চলে যাব। আর আসবো না। দুইদিন পর ঘরটা তো এমনিতেই খালি হবে।”
তাজদার চোখ খুলছেনা দেখে শাইনা তার দিকে চেয়ে রইলো। তাজদার সিদ্দিকী নিজ থেকে তাকে কষ্ট না দিলে তার এত কষ্ট পাওয়ার কথা ছিল না। অথচ যখন সত্যিই কষ্ট দিয়েছিল তখন সে এতটা ব্যথা অনুভব করেনি। তখন তো তার মনে হয়নি তাজদার সিদ্দিকী কষ্ট না দিলেও, তার কষ্ট হবে। তাজদার চোখ খুলতেই দুজনেই চোখাচোখি! সে পেটে চেপে হেসে উঠলো।
শাইনা করুণ সুরে কেঁদে উঠে আবারও সাথে সাথে তা গিলে ফেলে বলল,”আপনি আমাকে কাঁদিয়ে মজা পান।”
তাজদার তাকে টেনে এনে জড়িয়ে ধরলো। তারপর তার গালের এপাশে ওপাশে নিজের খসখসে গালে চেপে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলল,”তুমি বুঝবে না। এই কান্না আমার অর্জন। তুমি আগে কাঁদতে আমি কষ্ট দিতাম বলে। এখন কাঁদছো আমার জন্য কষ্ট হচ্ছে বলে। শাইনা মমতাজ আমি তোমাকে নিজের করেই ফেললাম। দেখলে?”
শাইনার ঠোঁটের কাছে তার কানটা ছিল। কানে ঠোঁটের স্পর্শ খুব গাঢ়ভাবে লাগছিল ঠিক ভালোবেসে রাখা স্পর্শের মতোই।
তাজদারের স্যুটকেস গোছানো হচ্ছে। শাইনা এককোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছে। তাজদার খুব মনোযোগ দিয়ে জরুরি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে।
শাহিদা বেগম সকাল সকাল ভাপা পিঠা আর খেজুরের রস পাঠিয়েছে। তাজদার বলেছে বেলা হলে খাবে। গরম ভাপা পিঠা শাইনার পছন্দ তাই সে গরম গরম খেয়ে নিয়েছে। তাজদারের পছন্দ ঠান্ডা ভাপা পিঠা। শাইনা বুঝলো না এটা কেমন পছন্দ? অবশ্য এই প্রশ্নটা সে করেনি।
রওশনআরা কিছুক্ষণ পর পর এসে জিগ্যেস করছেন, এটা ওটা দেবেন কিনা।
তাজদার শান্তভাবে উত্তর দিচ্ছে। তিতলিও ঘুরঘুর করছে ঘরের আশেপাশে। সকালে সে একটা কান্ড ঘটিয়ে বসেছে। ভাপা পিঠার মাঝখানে যতটুকুতে মিঠা আছে ততটুকু খেয়ে বাকিগুলো তৌসিফের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। তাই তৌসিফের মার খেয়েছে। বড়ো ভাইয়ের সাথে বেয়াদবির ফল তৌসিফ তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে।
তাসনুভাও ভাপা পিঠা খেয়েছে। খাওয়ার পর বলেছে, এটা কোনো খাবারের পর্যায়েই পড়েনা।
সে আজ খুব চিন্তিত। কাল এয়ারপোর্টে তাকে নিয়ে যাবে না বলেছে ছোটো ভাইয়া। কিন্তু সে যাবেই। এইদিকে সে গেলে তিতলিও বায়না করছে সেও যাবে। ও যেতে পারলে সে যেতে পারবে না কেন এই ধরণের ফালতু লজিক দেখাচ্ছে। তিতলি আজকাল খুব বেয়াদব হয়েছে। আগে এমন ছিল না। শাইনার সাথে মিশে মিশে এমন হয়েছে। এখন কথায় কথায় বিয়ে বিয়ে করে। কি কারণে মেয়েরা বিয়ে বিয়ে করে এটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে তাসনুভা খুব বাজে একটা কারণ খুঁজে পেয়েছে। তারপর তিতলির উপর অসম্ভব রাগ হয়েছে। বিয়ের কি বোঝে ও? ও জানে মেয়েদের বিয়ে পরবর্তী জীবন কেমন হয়? তিতলি এখনো ফ্যান্টাসির জগতে বসবাস করছে। সময়মতো মার পড়লে ঠিক হয়ে যাবে।
স্যুটকেস গোছগাছ শেষ করে তাজদার শাইনার দিকে তাকিয়ে,”ওই ছবিটা আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
দেয়ালের টাঙিয়ে রাখা ছবিটা দেখিয়ে দিল সে। বউ সাজে শাইনা মমতাজ আর বর সাজে তাজদার সিদ্দিকী। শাইনা বলল,”ছবি দিয়ে কি করবেন?”
“রুমে রাখবো।”
“নিচ্ছি।”
শাইনা আস্তে করে বলল,”হু।”
তাজদার ছবিটা নিয়ে এসে প্যাক করতে লাগলো। শাইনা বলল,”ছবি দিয়ে মানুষ আরও অনেক কিছুই করে।”
“হ্যাঁ জাদু করে।”
শাইনা হঠাৎই শব্দ করে হাসলো তার কথার ধরণে।
“আপনিও জাদু করবেন?”
“হু।”
“কীসের জন্য?”
“যাতে ভুলে না যাও।”
“আপনাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব বলছেন?”
“তোমার দ্বারা অসম্ভব কিছু আছে?”
“আপনি আবারও আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছেন। অথচ কাল রাতে বলেছেন যাওয়ার আগে আর কোনো রাগারাগি হবে না।”
“তোমার জন্য এইমুহূর্তে রাগ করা ফরজ। করো ইচ্ছেমতো।”
“রাগ করতে বলছেন আমাকে। কিন্তু রাগ আপনার কথায় প্রকাশ পাচ্ছে।”
“রাগ হবে না? তুমি অকারণে হাসছো কেন?”
“আপনি কাল রাতে আমাকে কাঁদতে দেখে হেসেছেন তাই।”
“তুমি মানুষ হওনি।”
শাইনা হেঁটে এসে তার শার্ট খামচে ধরে কাছে টেনে নাকে নাক ঠেকিয়ে বলল,”আপনাকে রাগ করলে কিন্তু মন্দ লাগে না। ছোটবেলায় ঘৃণা লাগতো। এখন হাসি পায়।”
তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৮
“হাসি পায়?”
শাইনা হাসিমুখে বলল,”মানে আপনি বাচ্চাদের মতোই রাগ করেন তাই আর কি।”
“সব রাগ গোসসার অবসান ঘটিয়ে আমি গেলাম। তুমি হাসতে থাকো।”
শাইনা হাসতে লাগলো। হাসির আড়ালে যত্ন করে সে যে কি লুকিয়ে রাখলো তা তাজদার সিদ্দিকী টেরই পেল না। একেবারে পায়নি তা ভুল। পেয়েছে। ওইটুকু। যতটুকু গতরাতে চোখের পানিতে লেখা ছিল। চোখের পানি কতটুকু মনের ব্যাথা প্রকাশ করে?
