প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩৫
সাইয়্যারা খান
আজ বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও পৌষ যেতে পারছে না। সোজা ভাবে তৌসিফ বলেছে তার জন্য সারপ্রাইজ আছে। কি এমন আছে যা চমকে দিবে পৌষকে, ভাবতেই পৌষের মাথা গরম হচ্ছে। এভাবে অর্ধেক বলা কথায় বেশ বিরক্ত ও। সকালে উঠে গোসল করেই একদম তৈরী হয়ে আছে পৌষ। তৌসিফ উঠেই দৌড়াতে গিয়েছে। তায়েফা উঠেছে সেই ফজরের সময়। সেই থেকে তৌসিফকে না দেখে পৌষকে বার কয়েক জিজ্ঞেসও করেছে। পৌষ শুধু ছোট করে জানিয়েছে, জগিং এ গিয়েছে। এ-র চাইতে বেশি পৌষ জানেও না। নাস্তার টেবিল গোছাতে গোছাতেই তৌসিফ হাজির হয়েছে। তায়েফা এগিয়ে গিয়ে ভাইকে ধমকালো। তৌসিফ ঘর্মাক্ত শরীরে বোনের হাতে চুমু খেয়ে শুধু বললো,
“চিন্তা করো না আপা। ঠিক আছি আমি।”
“এখন চিন্তা করি না। এতদিন করতাম৷ তোর চিন্তা করার মানুষ আছে এখন।”
তৌসিফ এক ভ্রুঁ উঁচু করতেই তায়েফা হেসে ফেললো। হাসিমুখেই বললো,
“চিন্তায় মেয়েটার মুখ শুকিয়ে আছে।”
“চিন্তায় মুখ শুকানোর মেয়ে তো পৌষরাত না আপা। নিশ্চিত অন্য কিছু হয়েছে।”
তায়েফা খানিকটা অবাক হলো। এতক্ষণ যাবৎ ভেবে আসছে পৌষ বুঝি তৌসিফের অপেক্ষা করছিলো তাই ওমন মুখটায় রাগ রাগ ভাব ছিলো কিন্তু এখন ভাইয়ের কথা শুনে কিছুটা চিন্তিত হলো। মেয়েটা সকাল থেকে এমন রেগে আছে কেন? তায়েফা এগিয়ে এসে পৌষের হাতে হাতে টেবিল সাজাতে নিলেই পৌষ বাঁধ সাধলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আপা আমি করে নিব। আপনি বসুন।”
তায়েফা ওর গালে হাত রাখলো। পৌষ একটু চুপ করে গেলো। তায়েফা গালে আদর দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে সোনা? মন খারাপ কেন?”
“মন খারাপ না তো আপা।”
কথাটা বললো মুখে হাসি রেখে। তায়েফা ওর হাত থেকে হাত নামিয়ে নিজের হাতের মাঝে পৌষের হাতটা নিতেই পৌষ হেসে ফেললো শব্দ করে। বললো,
“সকাল থেকে রাগ হচ্ছিলো আপা কিন্তু এখন আপনার এত চিন্তা দেখে রাগ পড়ে গেলো।”
“এভাবে হাসবি বুঝলি? এই ফ্ল্যাটে হাসিঠাট্টা হয় না অনেক বছর।”
পৌষের মুখটা আগের মতোই রইলো। তৌসিফ এসে বসা মাত্রই তায়েফা বললো,
“সামনের সপ্তাহে চলে যাব তুসু। তোর দুলাভাই অপেক্ষা করছে।”
তৌসিফের খাওয়ার হাত থেমে গেলো। আপার দিকে পূর্ণদৃষ্টি দিয়ে থমথমে স্বরে বললো,
“সবে মাত্র দুই মাস হলো আপা। এখনই চলে যাবে? দুলাভাইকে আসতে বলো।”
“আসবে। ঐ দিকের কাজ গুছিয়ে আসবে বলেছে। আপনি এসেছিলাম তোর সংসার দেখতে। আমি দেখেছি। এই বাংলাদেশে এক তোর জন্য চিন্তা হতো যা এখন নেই৷ তোর জন্য একান্ত কেউ আছে ভাবতেই আমি শান্তি পাই সোনা।”
“যেতে দিচ্ছি না আমি আপা।”
“ভাইয়ের সংসারে আর কত থাকব?”
কথাটা বলেই হাসলো তায়েফা তবে তৌসিফ হাসলো না৷ পৌষ ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। তৌসিফ বোনের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বললো,
“তোমাকে কেউ কিছু বলেছে? ভাইয়ের সংসার আবার কি আপা?”
“আহ্হা, রেগে যাচ্ছিস তুসু। আমার সংসার আছে না ওখানে? তোর দুলাভাইকে নিয়ে শিঘ্রই চলে আসব।”
“মাস শেষ হতে দুই দিন। তুমি আমাকে এখন বলছো?”
“আরে বাবা, তুই এমন করলে কিভাবে যাব আমি?”
তৌসিফ চুপচাপ খেতে লাগলো। পৌষ নিজের রাগ আপাতত তুলে রাখলো৷ পরে নাহয় সময় নিয়ে রাগ দেখাবে। আপা চলে যাওয়ার শোকে তৌসিফ যেভাবে গড়গড় করছে, না জানি ব্যাটা পৌষকেই উল্টো রাগ দেখিয়ে ফেলে। তায়েফা খাওয়া শেষ করেই বললো,
“তুই কাজ গুছিয়ে পৌষকে নিয়ে আমেরিকা আসবি। তোর দুলাভাই টিকেট কেটে রাখবে বলেছে।”
বলেই পৌষের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর পাসপোর্ট আছে সোনা?”
পৌষ মাথা নাড়লো। পাসপোর্ট তো দূর ঐ জন্মনিবন্ধন আর এনআইডি বাদে কিছুই নেই তার। তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“আমি করে দিব।”
“খুব ভালো কথা। তারাতাড়ি করে ফেলিস। তোদের হানিমুন ওখানেই ব্যবস্থা করে দিবে তোর দুলাভাই।”
এতটুকু শুনেই তৌসিফ বাঁকা চোখে তাকালো পৌষের পানে। পৌষের দৃষ্টি সরল। তৌসিফ সেই দৃষ্টি দেখেই চোখ ফিরালো। কপাল গুনে বউ তার। হানিমুনের কথায় অন্য মেয়ে হলে নিশ্চিত লজ্জা পেতো অথচ দেখ তার বউকে, কিভাবে জামাই এর দিকে তাকিয়ে আছে কুটুরমুটুর করে। আসলেই তার পৌষটা ভিন্ন। একটু অন্যরকমের ভিন্ন। এতটাই ভিন্ন যে জামাই রেখে ভাসুরকে পছন্দ করে তা আবার জোর গলায় ঢোল পিটিয়েও বলে।
তৌসিফ বাইরে গেলো ঘন্টা খানিক হবে। পৌষ এদিকে ভীষণ রেগে আছে। তাকে আজ ভার্সিটি যেতে দিলো না তৌসিফ। সরাসরি মুখের উপর না করেছে। পৌষ জোর খাটাতেই শান্ত স্বরে বলেছে,
“সারপ্রাইজ আছে হানি।”
“ঐ হানির সারপ্রাইজের খেতাপুড়ি আমি৷ *লছাল আমার ভালো লাগে না৷ বাইরে যাব।”
তৌসিফ চোখ বড় করে ছোটখাট ধমক দেয়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“গালিগালাজ করবে না।”
“একশত বার করব।”
“স্বামীর মুখে তর্ক করা ভালো না তোতাপাখি।”
“অ-স্বামী আপনি আমার। পড়াশোনা বন্ধ করতে চাইছেন।”
তৌসিফ এগিয়ে এসে ওর চিরায়ত চুমু খায় সেই থুতনিতে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
“সু-স্বামী আমি তোমার।”
“মামাতো ভাই আপনি। সেই হিসেবে কি হবে, মামাতো স্বামী?”
“ছিঃ খুব বাজে শোনালো পৌষরাত।”
বলেই সরে যায় তৌসিফ। পৌষও রেগে কথা বলে না। সেই থেকে রাগে রাগে এই দুপুর হলো তবুও তৌসিফ এলো না।
দরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই পৌষ হেসে তাকালো। বললো,
“আপা, নক করতে হবে না৷”
তায়েফা ভেতরে ঢুকে। বিছানায় পৌষ ওকে বসতে জায়গা দেয়। তায়েফা বসতেই পৌষ জিজ্ঞেস করে,
“কিছু লাগবে আপা?”
“তোর সাথে কথা ছিলো একটু।”
“এভাবে বলছেন কেন আপা? বলুন।”
তায়েফা পৌষের হাত দুটো ধরে। কণ্ঠে তার কাঁপন স্পষ্ট টের পায় পৌষ। তায়েফা খুব আশা নিয়ে বলতে লাগে,
“আমরা তো এতিম পৌষ। আমি, আমার তুসু সহ আমরা সবকটা ভাইবোন। মা নেই বাবা নেই৷ আমাদের জীবন সবাই যেভাবে দেখে ওভাবে পাড় হয় নি। রাজনীতি করা এক পরিবার আমাদের। চাচাদের সাথে মিলেমিশে বিশাল বড় একটা সংসার ছিলো। আমাদের উঠান ভর্তি মানুষ থাকতো। রোজ ডেকচিতে রান্না হতো। এলাকার মহিলারা বিকেল হতেই আসর জমাতো। চাচি আম্মা কি করলো জানিস, টিভি একটা বাইরে লাগিয়ে দিলো। সম্রাট ভাইজান টিভি এনেছিলো। লোকজন সেই কি খুশি৷ বাড়িঘর হৈ-হুল্লোড়ে মশগুল থাকতো। এতগুলো ভাই-বোন আমরা। কতবড় পরিবার।
সুখের যেমন অভাব ছিলো না তেমনই শত্রুরও অভাব ছিলো না কিন্তু আমরা খুব খুশি ছিলাম। আব্বু, চাচা অবশেষে সম্রাট ভাইজান, আমাদের নাম-ডাক খুব জোড়ালো ভাবে বেড়ে গেলো। সেই একান্নবর্তী পরিবারটা হঠাৎ করে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো পৌষরাত। তুই সৎ হতে পারিস কিন্তু আমাদেরই তো তাই বলছি। আমার তুসু খুব আম্মু ভক্ত ছিলো। আব্বুর খুব কাছের ছিলো। আব্বুর মৃত্যুর সময় ছোট তিশা খুব কাঁদছিলো হাসপাতালে। তুসু তখন আসতে পারে নি। তুহিন আসতে পারে নি। তুরাগ লুকিয়ে আসতো, চলে যেতো। আমরা অসহায় হয়ে গেলাম। এত এত পুরুষ অথচ চোখে নারী বাদে কেউ নেই। আমিও স্বার্থপর হয়ে গেলাম বোধহয়। সেদিন হাসপাতালের করিডোরে তিশা চিৎকার করে কাঁদছিলো আর অভিযোগ করছিলো আব্বুর মৃত্যুর জন্য ভাইয়েরা দায়ী।
তুসু আর তুহিন একটু বেশি দায়ী। তাদের রাজনৈতিক ঐ লুকোচুরিতে আব্বু লুকিয়ে গেলো। হারিয়ে গেলো। তৌসিফ সেদিন থেকে চুপ করে গিয়েছিলো। আম্মু ছিলো বলে হয়তো সামলে উঠলো কিন্তু আম্মুর প্রস্থান ও মেনে নিতে পারে নি পৌষ। একদম ভেঙে গিয়েছে। ও মানুষ পছন্দ করে। খুব পছন্দ করে। পরিবারটা ভাঙ্গুক তা ও চায় নি কিন্তু ছেলেরা বিয়ের পর সিদ্ধান্ত একা নিতে পারে না। ভাইরাও পারে নি। সবাই আলাদা হলো। সবাই ঘর, সংসার পেলেও একা পড়ে গেলো তুসু। কত বললাম রাজনীতি ছেড়ে দে। চলে আয় আমার কাছে। শুনলো না। মানলোই না।”
এতটুকু বলে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো তায়েফা। পৌষ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“এত টাকা থাকলে রাজনীতি কেন করে আপা?”
তায়েফা এহেন প্রশ্নে হেসে ফেললো। বললো,
“রাজনীতি ওরা টাকার জন্য করে না৷ বংশীয় ব্যাপার-স্যাপার। তুসু দলের হয়ে কোন পদ আজও গ্রহণ করে নি। নিঃস্বার্থ কাজ করছে। হয়তো মনের তুষ্টি।”
তায়েফা এবারে পৌষের হাত দুটো আরেকটু চেপে ধরলো। কণ্ঠে ভীষণ আকুলতা এনে বললো,
“তুই ওকে আগলে রাখিস সোনা৷ তুই বাদে আর কেউ নেই ওকে দেখার। ওর খুব সংসার পছন্দ। তুই ওকে একটা ভরা সংসার উপহার দিস বাচ্চা। আমি জানি খুব অ-আবদার এটা কিন্তু করতে বাধ্য হচ্ছি। তোর শশুর, শাশুড়ী নেই পৌষ। তুই আমার তুসুটাকে নিজের মতো ভালোবাসিস। আমি অনুরোধ করছি সোনা, তুই বাচ্চা নিয়ে নে। পড়াশোনার চিন্তা করিস না। তোর বাচ্চা আমি নিজে এসে পেলেপুষে দিব। আমার তুসুকে একটা আগের মতো ঘর ফিরিয়ে দে সোনা। ও কিছু বলে না কিন্তু আমি বুঝি, জানি ও কি চায়। মুখ ফুটে বলবে কি না জানি না কিন্তু এতটুকু জানি ওর কাছে তুই ভালো থাকবি। হাজার যাই হোক, তোকে খারাপ রাখবে না৷”
পৌষ তায়েফার কথা শুনেই গেলো। দ্বিরুক্তি করলো না কিছুতেই কিন্তু আবার সহমতও পোষণ করলো না। চুপচাপ শুনে গেলো এক বোনের আহাজারি।
আজ আদিত্যকে নিয়ে বিকেলে বাগান বাড়ীতে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু তৌসিফ থাকায় পৌষ বের হতে পারছে না। এই লোক এই সময়ে বাড়ীতে থাকে না। আজ কি হলো কে জানে, ঘর ছাড়ছে না। তৌসিফ বিরক্ত হয়ে গেলো এক প্রকার। এভাবে ঘরবন্দী হয়ে কোনকালেই ছিলো না সে। সারাজীবন দৌড়াদৌড়ির উপর কেটেছে। তৌসিফ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বউয়ের ছটফট দেখছে। মাঝেমধ্যে মুচকি মুচকি হাসছে৷ হাসলে তার চিকন, পাতলা ঠোঁটটা সামান্য কাঁপে। বিষয়টা আজ খেয়াল করলো পৌষ। টিকতে না পেরে বারান্দায় যেতেই তৌসিফ ডেকে বললো,
“সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে পৌষরাত। বারান্দা বন্ধ করে দাও।”
পৌষ একটু থেমে গেলো যেন। সন্ধ্যা হতেই বারান্দা বন্ধের এই নিয়ম অথচ পৌষ তো পুরো বাগান বাড়ীর ভেতরে ঢুকার পরিকল্পনা করছে। বেল বাজতেই পৌষের বুকটা সামান্য ধ্বক করে উঠে। আদিত্য এলো নাকি তাকে ডাকতে? যদি তৌসিফ দেখে ফেলে তাহলে কি করবে? পৌষ মনে মনে মিথ্যা সাজাতে ব্যস্ত তখনই বেল বাজে পুণরায়। কোন বুয়া বা মিনু খুললেই আগে তৌসিফকে জানাবে তাই দৌড়ে এলো পৌষ। মিনু দরজার নব ঘুরানোর আগে পৌষ নবটা ধরে ফেললো। তারাতাড়ি করে বললো,
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩৪
“তুমি যাও। আমি দেখছি।”
মিনু একটু অবাক হলো অবশ্য। ও চলে যেতেই পৌষ দরজা খুললো। খুলে সম্মুখে তাকিয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ভেতর থেকে তৌসিফ ডাকছে কিন্তু তা কানে আসছে না পৌষের। ও তো ব্যস্ত সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অস্তিত্বে নিজেকে খুঁজতে।
