Death or Alive part 26

Death or Alive part 26
priyanka hawlader

কিছুদিন পর,
ইসাবেলার জীবনে যেন নীরবে বয়ে যাচ্ছে এক অচেনা স্রোত।
গ্রামটাকে এখন সে প্রায় নিজের হাতের তালুর মতো চেনে—সবুজ ধানের ক্ষেত, সরু মেঠোপথ, নদীর ধারে ঝুলে থাকা শাখা, আর জঙ্গলের অন্ধকার গভীরতা—সবই তার আপন হয়ে গেছে।
কিন্তু এই পরিচয়ের পেছনে এক বড় কারণ আছে—সেই নেকড়ে ছেলেটি।
প্রথম দেখা হয়েছিল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে,

কিন্তু আজ, তার নাম মনে পড়তেই ইসাবেলার ঠোঁটে অজান্তেই লেগে যায় এক মৃদু হাসি।
সে এখন জানে—একটা নেকড়ে কেবল ভয়ঙ্কর নয়, কোমলও হতে পারে; বরং মানুষের চেয়েও বেশি আপন হয়ে যেতে পারে।
তাদের বন্ধুত্ব আর স্রেফ বন্ধুত্ব নেই—কথোপকথনের ভাঁজে, চাহনির গভীরে, এক অদৃশ্য সম্পর্কের সুতোর টান ক্রমে ঘন হয়ে উঠছে।
তবুও কেউই মুখে প্রেমের কথা বলে ফেলেনি—হয়তো ভয়, হয়তো সময় এখনো আসেনি।
এক রুদ্রস্নাত সকাল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আকাশে সূর্যের আলো ম্লান, বাতাসে কেমন এক শীতলতা।
জানালার পাশে বসে আছে ইসাবেলা—দূরে তাকিয়ে, অথচ মনে যেন অন্য কোনো জগতে ভাসছে।
বাইরে গাছের পাতায় বাতাস খেলে যাচ্ছে, আর তার খোলা চুলে লুকিয়ে ঢুকে পড়ছে সেই একই বাতাস, যেন আদরে জড়িয়ে ধরছে তাকে।
সে ভাবছে—প্রতিদিনের সেই সঙ্গ, সেই কথোপকথন, সেই অবলীলায় তার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হাসি… সবকিছু যেন বুকের ভেতরে এক উষ্ণ স্পন্দন তৈরি করছে।
কখনো তারা মেঠোপথ ধরে হাঁটেছে, কখনো নদীর ধারে বসে ঢেউ গুনেছে, আবার কখনো জঙ্গলের ভিতর হারিয়ে গিয়ে হঠাৎ হেসে উঠেছে।
তার চোখে চোখ রেখে ছেলেটি যখন কিছু বলে না, তখনও যেন হাজার কথা ভেসে আসে।
তবে ইসাবেলা সতর্ক।

এই সম্পর্কের কথা কেউ যেন না জানে—বিশেষ করে দা’ভাই বা ভাবি।
দাসী প্রায় ইসাবেলার সাথে বাহিরে যায় আবার কখন কখনো ইসাবেলা বাহানা দিয়ে তাকে বাসায় রেখেই চলে যায়। দাসী ছেলেটিকে চেনে, কিন্তু ইসাবেলা তাকে বলেছে—
“সে শুধু একজন মানুষ… আর আমার বন্ধু।”
তারপর দাসীর মুখ বন্ধ রাখতে গোপনে দিয়েছে অনেক গা ভর্তি সোনা, শর্ত দিয়ে—
“একটি কথাও যেন বাইরে না যায়।”

বাইরে তখনো বাতাস বয়ে যাচ্ছে, আকাশে ভাসছে সাদা মেঘ।
ইসাবেলা জানে না, এই বন্ধুত্বের স্রোত কোন দিকে যাবে—কিন্তু তার মনে আজকাল অদ্ভুত এক আলোড়ন, এক অজানা টান, যা ধীরে ধীরে তাকে সেই নেকড়ে ছেলেটির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
হুট করেই ইসাবেলার ঠোঁটে ফুটে উঠল একরাশ লাজুক হাসি।
চোখের কোণে যেন ভেসে উঠল একটি স্মৃতি—মিষ্টি, কোমল, আর অদ্ভুতভাবে উষ্ণ।
সেদিন পাহাড়ের চূড়ার একদম শেষ প্রান্তে গিয়েছিল তারা।
দাসীকে এক নিপুণ বাহানায় ঘরে রেখে, অবলম্বনে জঙ্গলের সরু পথ বেয়ে এগিয়েছিল সে—পাশে ছিল সেই নেকড়ে ছেলেটি।
আঁকাবাঁকা পথ, কখনো খাড়া উতরাই, কখনো পাথুরে ঢাল—সবকিছুর মাঝেও যেন আনন্দের ঢেউ বইছিল ইসাবেলার মনে।

হঠাৎই পায়ের পাতায় বিঁধে গেল একটি ছোট্ট কাঁটা।
ব্যথা সামান্য হলেও ইসাবেলার মুখে কষ্টের ছাপ ফুটে উঠল।
ছেলেটি সেটা দেখামাত্র থমকে দাঁড়াল, চোখে এল এক ধরনের উৎকণ্ঠা।
—“চলুন, বসুন,” বলল সে দৃঢ় কণ্ঠে।
এক নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে সাবধানে বের করল সেই কাঁটা।
পাশের জঙ্গল থেকে তোলা গাছের পাতা ও শিকড় মিশিয়ে তৈরি করল এক প্রাকৃতিক ওষুধ, আর সেটি আলতো করে লাগিয়ে দিল পায়ে।
তারপর যেন আর এক মুহূর্তও দেরি না করে—ইসাবেলাকে কোল তুলে নিল।
ইসাবেলা বারবার আপত্তি জানাল—

“না, আমি নিজেই হাঁটতে পারব…”
কিন্তু ছেলেটির চোখে তখন এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য।
যেন এই অচেনা পথে তাকে হাঁটতে দেওয়া মানেই বিপদ ডেকে আনা।
জঙ্গলের গভীরতার ভেতর দিয়ে যখন তারা যাচ্ছিল, বাতাসের শীতল স্পর্শ যেন প্রতিটি মুহূর্তে গল্প বুনছিল।
পায়ের ব্যথা কিছুটা কমে এলে ইসাবেলা নেমে দাঁড়াল, চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে শ্বাস নিল—পাহাড়ের মুক্ত বাতাস, পাখির ডাক, আর দূরের ঝর্ণার সুর যেন একসাথে মিশে যাচ্ছিল।
ছেলেটি শুধু তাকিয়ে থাকল—যেন তার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি অভিব্যক্তি নিজের ভেতরে ধরে রাখতে চাইছে।
বাতাসে দুলে দুলে ইসাবেলার চুল মুখের ওপর এসে পড়ছিল।
ছেলেটি আলতো করে সেই চুল সরিয়ে দিল—মনে হলো, তার হাসিমাখা মুখশ্রী দেখা যেন তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে জরুরি কাজ।

খাড়া উতরাই পথে নামতে গিয়ে ইসাবেলা হোঁচট খেল।
এক মুহূর্তেই ছেলেটির শক্ত হাত তাকে জড়িয়ে ধরল, পড়তে দিল না।
তার কণ্ঠে তখন হালকা রাগের সুর—
“তুমি কি জানো না, এখান থেকে পড়ে গেলে তোমাকে আমি জীবিত নয়, ভূত হিসেবেই দেখতে পাব? এজন্যই তো তোমাকে কোল থেকে নামাতে চাইছিলাম না। জানতাম, এই অচেনা পথে বারবার হোঁচট খাবে তুমি। কিন্তু তুমি আমার কোনো কথাই শোনো না।”

ইসাবেলা শুধু মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকাল।
সে জানত—এই যত্ন, এই আগলিয়ে রাখা কেবল বন্ধুত্বের মধ্যে আটকে নেই।
ছেলেটি আর কিছু বলল না, আবার কোলে তুলে নিল তাকে।
বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে ইসাবেলা অনুরোধ করল—
“ঘন জঙ্গলটা পার করে দিয়ে ফিরে যান।”
কিন্তু ছেলেটি তাকে বাড়ির একদম কাছাকাছি পৌঁছে দিল, আর নিজে আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল—যতক্ষণ না নিশ্চিত হলো যে সে নিরাপদে ঘরে ঢুকেছে।
জানালার পাশে বসে সেই দিনের কথা মনে পড়তেই ইসাবেলার মনে অদ্ভুত আলোড়ন জাগল।
সে বুঝতে পারল—এই অনুভূতি কেবল বন্ধুত্ব নয়।

এই অদ্ভুত যত্ন, নিঃশর্ত রক্ষা করার ইচ্ছে, সবসময় তার নিরাপত্তাকে প্রথমে রাখা—এসবের মানে অন্য কিছু।
আর সেই ভাবনা আসতেই ঠোঁটের কোণে আবারও ফুটে উঠল এক অনাবিল হাসি…
ইসাবেলার ঠোঁটে তখনো লেগে আছে সেই লাজুক হাসি।
চারপাশে কেউ নেই, তবুও মনে হয় যেন সে একা নয়।
কোথাও একজোড়া নীল চোখ, দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করছে।
চোখ দুটি যেন সবসময় তার চারপাশে অদৃশ্য এক বৃত্ত এঁকে রেখেছে—যেন বিপদের ছায়া ঢুকতে না পারে।
সে অনুভব করে, দিনের আলো হোক কিংবা রাতের গভীরতা—সে দৃষ্টি তার ওপর থেকে কখনো সরেনি।
রাতের নিস্তব্ধতায়, যখন চাঁদের আলো জানালা পেরিয়ে ঘরে ঢোকে, তখনও যেন মনে হয় কেউ তার দিকে চেয়ে আছে।

কোনো অজানা ভাষায়, কোনো না বলা কথায়, সেই চোখ দুটি তাকে পড়ছে—তাকে বুঝছে, তাকে মনে রাখছে।
ইসাবেলার এখন ভালো লাগে এই অদ্ভুত সঙ্গ।
সে উপভোগ করে প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দৃষ্টি।
ছেলেটার সাথে কাটানো সময় যেন তার জীবনের নতুন অধ্যায়—
যেখানে প্রতিদিন সে নতুন কিছু শিখছে, নতুন কিছু অনুভব করছে।
এই ক’দিনে, ছেলেটার মতো করে জীবনযাপন করতে করতে সে যেন ভুলে গেছে নিজের প্রকৃত পরিচয়—যে সে এক রাজকীয় পরী, এক উন্নত জীবনের অধিকারী।
তার রাজ্য, তার অভিজাত জীবন, সব যেন ঝাপসা হয়ে গেছে এই জঙ্গলের আলো-ছায়ায়, পাহাড়ের হাওয়ায়, আর ছেলেটার উপস্থিতিতে।

কখনো সে ভাবে—ফিরে গেলে হয়তো আর কখনো এই ছেলেটার সঙ্গে দেখা হবে না।
এমন মুহূর্তগুলো, যা এখন সে বুকে জমিয়ে রাখছে, হয়তো রাজ্যে ফিরে গেলে চিরতরে হারিয়ে যাবে।
তাই আজকাল সে রাজ্যে ফেরার কোনো পরিকল্পনা করে না।
ভাবছে—পরে দেখা যাবে, যাওয়া হবে কি না।
এই মুহূর্তে সে কেবল চাইছে নিজের এই ছোট্ট পৃথিবীটাকে উপভোগ করতে—
যেখানে প্রতিটি দিন যেন একেকটা গল্প, প্রতিটি সন্ধ্যা যেন একেকটা কবিতা, আর প্রতিটি দৃষ্টি বিনিময় যেন অদৃশ্য কোনো অঙ্গীকার।
নীল চোখ দুটি তখনও দূরে দাঁড়িয়ে, পাহারায়…
যেন নীরবে বলে দিচ্ছে—
“যতদিন তুমি এখানে আছো, তুমি নিরাপদ।

রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ যেন রূপোর থালা হয়ে ঝুলছে।
বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে চাঁদের দিকে চেয়ে ছিল অর্ষা।
চুপচাপ, ভাবনার গভীরে হারিয়ে যাওয়া সেই মুহূর্তে, পিছন থেকে এসে ওয়াজফান তাকে জড়িয়ে ধরল—
তার বুকের উষ্ণতা অর্ষার পিঠে মিশে গেল।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে মুখ গুঁজে দিল অর্ষার গলায়,
তারপর এক অদ্ভুত কোমলতায় হাত বাড়িয়ে জামার ভেতর দিয়ে রাখল পেটের ওপর।
সেই স্পর্শে যেন এক অচেনা শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
হাতটা ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে চাইলে, অর্ষা হঠাৎ থামিয়ে দিল।
তার আঙুলের বাঁধনে ধরা পড়ল ওয়াজফানের হাত।

— “কি করছেন?” কণ্ঠে বিস্ময় আর সামান্য কঠোরতা।
ওয়াজফান মৃদু, খানিক ভাঙা সুরে বলল,
— “আদর করছি, জান… আটকাচ্ছ কেন?”
অর্ষা এবার ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
— “না… আসবেন না কাছে। আপনি সেদিন যা করেছিলেন… আমার শরীরে এখনো তার ব্যথা রয়ে গেছে।”
ওয়াজফান হঠাৎই বাকা এক হাসি খেলিয়ে দিলো ঠোঁটের কোণে।
চোখের পলকে সে আরও কাছে ঝুঁকে এল, যেন শব্দের প্রতিটি ধ্বনি অর্ষার নিঃশ্বাসে গেঁথে দিতে চায়।
গভীর, কাঁপনধরা স্বরে বলল—
“তুমি জানো, তুমি আমার হাজার বছরের জমে থাকা পবিত্রতা ভেঙেছো… আমার হাজার বছরের ভাজিনিটি তুমি নষ্ট করেছো।”

তার চোখে একরাশ দুষ্টু শিখা জ্বলজ্বল করছিলো।
“এখন আমি চাই—প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে, আমার সবটুকু তোমাকে বিলিয়ে দিতে। সবটা… কেবল তোমাকে।”
অর্ষা অবাক, থরথর করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
ওয়াজফান এগিয়ে এলো আরেক পা, কণ্ঠ আরও নিচু, আরও গাঢ় হয়ে উঠলো—
“এখন তোমার আর পালাবার কোনো পথ নেই, লাড্ডু… কোনো পথই নেই।”
কথা শেষ হওয়ার আগেই তার শক্ত হাত এগিয়ে এল।
অপলক দৃষ্টিতে অর্ষার চোখ আটকে রেখে, একটানে তাকে নিজের কাছে টেনে নিলো।
মুহূর্তেই তাদের মাঝে থাকা সমস্ত ফাঁক মুছে গেল—
শুধু তীব্র নিঃশ্বাসের আদান-প্রদান আর বুকের ভেতর বেজে ওঠা উন্মত্ত হৃদস্পন্দন রয়ে গেলো।
ওয়াজফান আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না।
তার চোখে জ্বলছিলো দখলদারি তীব্রতা, আর ঠোঁটের কোণে বয়ে যাচ্ছিলো এক অদ্ভুত আকর্ষণ।
হঠাৎ সে অর্ষার ঠোঁট আঁকড়ে ধরলো—

না, শুধু ছোঁয়া নয়…
এ ছিলো দীর্ঘ, গভীর, অক্সিজেন কেড়ে নেওয়া এক চুম্বন,
যেন সে তার অস্তিত্বের প্রতিটি অংশে নিজের ছাপ রেখে যেতে চাইছে।
অর্ষার শ্বাস এলোমেলো হয়ে এলো, হাত কাঁপতে লাগলো…
কিন্তু ওয়াজফান থামলো না।
চুম্বনের ফাঁকে ফাঁকে সে ধীরে ধীরে মুখ সরিয়ে নিলো,

তার গলায় মুখ গুঁজে দিলো একদম ত্বকের ভেতর গলে যাওয়ার মতো উষ্ণতায়।
চোখ বন্ধ করেই সেখানে দাঁত বসিয়ে দিয়ে দিলো এক উগ্র লাভ বাইট—
যেন এক অদৃশ্য শিকল, যা বলে দিচ্ছে— তুমি আমার। শুধু আমার।
তারপর ধীর, ইচ্ছে করেই স্লো গতিতে, হাতটা অর্ষার জামার ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো।
উষ্ণ আঙুলের স্পর্শ কোমরের বাঁক ছুঁয়ে নিচের দিকে স্লাইড করতে থাকলো—
তার নিশ্বাস গাঢ় হয়ে উঠলো, ধীর ধীর স্পর্শে যেন শরীরের প্রতিটি স্নায়ু জেগে উঠছে।
তারপর…

ধীরে ধীরে, প্রায় পরিকল্পিত ভঙ্গিতে, জামার কাপড়টাকে উপরের দিকে তুলতে শুরু করলো—
চোখে এক অদ্ভুত উন্মাদ ঝিলিক, ঠোঁটে অর্ধেক হাসি।
আজ সে আবারো ডুব দিতে চায় অর্ষার মাঝে।
কিন্তু—
দরজায় হঠাৎ করেই নক পড়লো।
শব্দটা যেন বজ্রপাতের মতো ঘরের নীরবতায় আঘাত হানলো।
ওয়াজফান থমকে গেলো।

অর্ষার বুক দ্রুত উঠানামা করছে, চোখে ভয়ার্ত প্রশ্ন।
দরজার ওপার থেকে কারো উপস্থিতির অনুভূতি যেন বাতাসে জমে উঠলো—
দরজায় নক পড়তেই ওয়াজফান দাঁত চেপে বিরক্ত মুখে গজরে উঠলো—
“What the f*…** কে এসেছে এই সময়?
আমার মুডের পুরাই বারোটা বাজিয়ে দিলি… damn it!”
তার চোখে জ্বলছিলো আগুনের মতো রাগ।
“রোমান্সের সময় আমাকে বিরক্ত করিস… দাঁড়া, আজ দরজার ওপাশে যেই থাক না কেন, শালা তোর মাথা উড়িয়ে দেব!”

কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে সে ধীর কিন্তু প্রচণ্ড রাগমাখা পদক্ষেপে দরজার দিকে এগোল।
দরজা খুলে কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই পাশ থেকে আয়রাক মাথা নিচু করে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো—
“মার্জনা করবেন, বাদশা… এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
কিন্তু রাজসভায় গুরুতর এক ঝামেলা হয়েছে… আপনাকে এখনই যেতে হবে।”
ওয়াজফানের চোখের রাগ যেন ধীরে ধীরে নিভে এল, বদলে সেখানে এলো গম্ভীরতা।
এক মুহূর্তের নীরবতার পর সে গভীর গলায় বলল—
“ঠিক আছে… তুমি যাও, আমি আসছি।”
প্রহরী মাথা নত করে সরে গেল।

কক্ষের ভেতর নীরবতা ফিরে এলো, কিন্তু বাতাসে রয়ে গেল অর্ধসমাপ্ত এক উত্তেজনার ভারী গন্ধ।
দরজা বন্ধ করে ওয়াজফান এক গভীর নিশ্বাস ফেললো।
পদক্ষেপ ধীর করে সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
সেখানে… অন্ধকার রাতের আলো-ছায়ায় দাঁড়িয়ে অর্ষা—
এখনো কাঁপছে, বুকটা জোরে জোরে উঠানামা করছে,

নিঃশ্বাসগুলো ভারী, যেন প্রতিটা শ্বাসে ভয়ের সাথে মিশে আছে অদৃশ্য এক উষ্ণতা।
ওয়াজফান এগিয়ে এসে বিনা শব্দে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
তার বুকের ভেতর টেনে নিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে রাখলো—
যেন এই এক মুহূর্তেই সমস্ত অশান্তি মুছে দিতে চায়।
মৃদু কণ্ঠে, চুলের ভাঁজে মুখ গুঁজে বলে উঠলো—
“সরি, বেবি… আমার এখনই যেতে হবে।

তবে কাজ সেরে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব… তুমি অপেক্ষা করো আমার জন্য।”
অর্ষার ভেতরের কাঁপুনি যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো,
কিন্তু তার উত্তর শোনার আগেই ওয়াজফান মাথা তুলে ঠোঁটে এক জোরালো চুম্বন এঁকে দিলো—
যেন সেটা প্রতিশ্রুতি, অধিকার আর বিদায়ের মিশ্র সিলমোহর।
তারপর ধীরে ধীরে তাকে ছেড়ে দিয়ে, একবার গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
বারান্দা পেরিয়ে চলে গেলো অদৃশ্য রাতের অন্ধকারে…
রাজ সভার ঝামেলা মিটিয়ে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল।
প্রাসাদের করিডোরগুলো তখন নিস্তব্ধ, শুধু দূরে কোথাও মশালের আলো টিমটিম করছে।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে কক্ষে প্রবেশ করলো।

ভেতরে এসে দেখল—অর্ষা গভীর ঘুমে ডুবে আছে।
চাঁদের ফিকে আলো জানালা পেরিয়ে তার মুখে পড়েছে,
শান্ত, নিষ্পাপ, তবু যেন একটু ক্লান্ত।
ওয়াজফান কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো,
এক দৃষ্টি দিয়ে তার মুখের প্রতিটি রেখা, প্রতিটি শ্বাসের ওঠানামা মনে গেঁথে নিচ্ছিল।
তার ঠোঁটে এক হালকা হাসি খেলে গেলো।
মৃদু স্বরে ফিসফিস করে বলল—
“আজ আর তোমায় বিরক্ত করছি না, লিটল মনস্টার…
তবে কাল থেকে—তোমার আর কোনো ছাড় নেই।”
এ কথা বলে সে ধীরে ধীরে অর্ষার কাছে এগিয়ে গেলো।
সাবধানে বিছানায় উঠে তার শরীরের উষ্ণতায় মিশে গেল,
টি-শার্টের ভেতর দিয়ে নিজেকে আরও কাছে টেনে নিলো।
অবশেষে তার বুকে মাথা রেখে,
নিঃশব্দ রাতের শান্তিতে—নিজেও চোখ বুজে ঘুমিয়ে গেল।

বিকেলটা যেন সেদিন আলাদা রঙে রাঙানো।
আকাশের কিনারায় কমলা আর গোলাপি আলো একে অপরের সাথে মিশে গিয়ে তৈরি করেছে এক অপার্থিব দৃশ্য।
সূর্যের আলো ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসছে, হালকা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে শুকনো পাতার মিষ্টি খসখস শব্দ।
দূরে কোথাও পাখিরা ফিরতি পথ ধরেছে, আর চারপাশে এক ধরণের শান্ত, কোমল সুর বেজে চলেছে প্রকৃতির অদৃশ্য বাঁশিতে।
ইসাবেলা বসে আছে জানালার ধারে।

তার চোখে তখন বিকেলের আলো পড়েছে, যেন সূর্যের শেষ কিরণ এসে তার মুখে চুমু খেয়ে যাচ্ছে।
চুলগুলো হাওয়ায় উড়ে এসে বারবার তার গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে, সে মাঝে মাঝে হাত তুলে সরিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু বাতাস যেন দুষ্টুমি করে আবার ফিরিয়ে আনে।
হঠাৎ, সেই বাতাসের স্রোতে ভেসে আসে একখানা খাম।
মুগ্ধতা আর কৌতূহল মিলিয়ে ইসাবেলা হাত বাড়িয়ে সেটি তুলে নেয়।
খামের কাগজে এক অচেনা সুবাস—তবে লেখার হাতের ছাপ খুব চেনা।
তার হৃদয় এক লাফে যেন বোঝে, কে পাঠিয়েছে এটা।
ধীরে ধীরে খামটি খোলে ইসাবেলা।
ভেতরের কাগজে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা—
হেই কিউটি পাই,
কী ভাবছো এতক্ষণ?

আচ্ছা শোনো, কিছুক্ষণের মধ্যে আমার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী সুন্দর করে সেজে চলে আসো—তবে একা আসবে।
আজ তোমাকে একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাবো, নতুন কিছু শেখাবো।
জলদি চলে আসো, ওকে?
চিঠির শেষ লাইন পড়তেই ইসাবেলার চোখ যেন হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠল।
ঠোঁটে ফুটে উঠল একরাশ দুষ্টু-মিষ্টি হাসি, যেন তার ভেতরের ছোট্ট রাজকন্যা এক নিমিষে জেগে উঠেছে।
হৃদয়টা কেমন করে ধকধক করতে লাগল—অপেক্ষা, কৌতূহল আর আনন্দ মিশ্রিত এক অদ্ভুত অনুভূতি।
বিকেলের আকাশ তখন আরও গাঢ় হয়ে এসেছে, যেন সূর্যও অপেক্ষা করছে তার এই যাত্রার জন্য।
সে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না।

আয়নার সামনে গিয়ে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল, মনে হল আজ নিজেকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন পুরো বিকেলের আকাশও থমকে দাঁড়ায়।
চুলগুলো আলতো করে ঠিক করে নিল, পোশাকের ভাঁজ মসৃণ করল, আর চোখে লাগাল সামান্য উজ্জ্বলতা—যেন চোখদুটি অজানা গন্তব্যের গল্প বলে দেয়।
দাসী তখন ঘরে নেই।
কোথায় গেছে, সেটি জানার আগ্রহও নেই ইসাবেলার।
বরং এ-ই তো সেরা সুযোগ—কেউ আটকাবে না, কেউ জিজ্ঞেস করবে না।
সে নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল, যেন বাতাসকেও ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
জঙ্গলের সরু পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগল সে।

সূর্যের আলো পাতার ফাঁক দিয়ে এসে তার গায়ে পড়ছে, আর দূর থেকে ভেসে আসছে পাখিদের ডাক।
গভীর সবুজের ভেতর দিয়ে পা ফেলতে ফেলতে মনে হচ্ছিল এই পথটা যেন তাকে ধীরে ধীরে বাস্তব থেকে আলাদা করে নিয়ে যাচ্ছে এক রহস্যময় জগতে।
অবশেষে, এক গহীন বাঁক পেরিয়ে সে পৌঁছাল তার গন্তব্যে—
এক নিরিবিলি, যেন পৃথিবীর কোলাহল থেকে চুরি করে রাখা ছোট্ট স্বর্গ।
চারপাশে বুনো ফুলের রঙ, অদ্ভুত প্রশান্তি আর বাতাসে ভাসমান এক মিষ্টি গন্ধ।
যেন এই জায়গাটা শুধু তার জন্যই সাজানো, শুধু এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
হঠাৎ, নরম অথচ দৃঢ় দুটি হাত এসে ইসাবেলার চোখ দু’টি আলতো করে চেপে ধরল।
চেনা সেই উষ্ণ স্পর্শে তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক মৃদু, তৃপ্তির হাসি।
এক মুহূর্ত পরেই হাতগুলো ধীরে ধীরে চোখ থেকে সরে গেল।

ইসাবেলা চারপাশে তাকিয়ে অবাক—চারদিক শুনশান, কোথাও কাউকে দেখা যায় না।
মনে হল, যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে সেই মানুষটি।
কিন্তু ঠিক তখনই, পেছনে থেকে ভেসে এল হালকা শব্দ।
পিছন ফিরে তাকাতেই ইসাবেলার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল—
তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে সেই বহু চেনা মুখ।
হাতে এক তোড়া তাজা ফুল, সাজানো যেন হৃদয়ের গভীর থেকে তুলে আনা অনুভূতির রঙে।
আজ ছেলেটা যেন অন্য রকম—পরিপাটি, গম্ভীর অথচ চোখে দুষ্টু-মিষ্টি ঝিলিক।
মৃদু হাসি দিয়ে ছেলেটা বলল,

— “হুম… আমারা তো ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছি আজ মনে হচ্ছে, এই বন্ধুত্বটাকে একটা নতুন নাম দেওয়ার সময় এসেছে।
এতোদিনে কি আমি তোমার পূর্ণ বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি? নাকি এখনও অযোগ্য আছি?
আমি চাই, এই বিশ্বাস আর এই মিষ্টি পরীটাকে সারাজীবন পাশে রাখতে।
তুমি কি চাও, তোমার এই পাগল বন্ধুটা সারা জীবন তোমার সঙ্গী হোক?
তাহলে দেরি না করে আমার প্রোপোজালটা গ্রহণ করো…
So… I love you.”

ইসাবেলা কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল—চোখে বিস্ময়, ঠোঁটে অদ্ভুত কম্পন।
তারপর ধীরে ধীরে বলল,
— “I love you too. আমি আমার এই পাগল বন্ধুটার সাথ সারা জীবন কাটাতে চাই।
এরপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে।
ছেলেটা কৌতূহলী দৃষ্টিতে বলে উঠে,
— “কিন্তু যদি তোমার ভাই এই সম্পর্ক মেনে না নেয়?”
ইসাবেলা হেসে উত্তর দিল,

— “তাহলে আমি তোমার সাথে পালিয়ে যাবো… তোমার রাজ্যে। কিন্তু এখন আগে আমার সাথে চলো তো আমার ভাই এর কাছে আমার হাত চাইতে।
ছেলেটা চোখে মুগ্ধতা নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “তাহলে চলো, আর দেরি নয়… এখনই তোমার ভাইয়ের কাছে তোমার হাত চাইতে যাই।
না এখন না আমি আগে ভাইয়ার সাথে কথা বলি তারপর তোমাকে নিয়ে যাব।
আজই আমি ফিরে যাব আমার দুনিয়ায়। আর আমি সেখান থেকে তোমার সাথে যোগাযোগ করব।
এরপর, ইসাবেলা বাড়ি ফিরে এলো।
দাসীকে সঙ্গে নিয়ে অর্ষার বাবা-মায়ের কাছ থেকে স্নেহভরা বিদায় নিল।
নিজের রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময়, পথের এক বাঁকে তাদের সঙ্গে যোগ দিল সেই ছেলেটি—
যেন এই যাত্রা শুরু হলো এক নতুন গল্পের প্রথম অধ্যায় হয়ে।

সকালবেলা—জানালা দিয়ে আসা কোমল আলো ধীরে ধীরে কক্ষের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছে।
অর্ষার চোখ মেলে ধীরে ধীরে ঘুম কাটলো।
প্রথমেই টের পেলো—তার বুকের ঠিক ওপরেই এক উষ্ণ ভার।
চোখ নামিয়ে টি-শার্ট এর গলার ফাঁকের ভেতর দিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো—
ওয়াজফান, গভীর ঘুমে ডুবে, মুখটা নির্ভারভাবে তার বুকের কাছে গুঁজে রেখেছে।
তার লম্বা পাপড়ির নিচে ছায়া পড়েছে, ঠোঁটে হালকা নিঃশ্বাসের ছোঁয়া।
অর্ষার মুখে অজান্তেই মুচকি হাসি খেলে গেলো—
এই বাদশা, যার রূপে দুনিয়া কাঁপে,

তার কাছে এখন নিছক এক শান্ত, নির্ভার মানুষ হয়ে শুয়ে আছে।
ঠিক তখনই তার মাথায় এল এক দুষ্টু বুদ্ধি।
মনে মনে হাসি চেপে, খুব ধীরে হাত বাড়ালো—
আঙুলগুলো ওয়াজফানের চুলে আলতোভাবে চালিয়ে দিলো,
তারপর কানের কাছে হালকা স্পর্শ,
তারপর ঠোঁটের কিনারা ছুঁয়ে আবার সরে এলো।
অবশেষে হাতটা নামিয়ে তার গলার কাছে নরম ছোঁয়া দিয়ে কোমরে গিয়ে থামলো—
প্রতিটি স্পর্শে যেন নীরবে তাকে উস্কে দিতে চাইছে।
ওই নরম, দুষ্টু ছোঁয়াতেই ওয়াজফানের ঘুম ভেঙে গেল।
চোখ খুলেই বুঝে গেল—অর্ষা তাকে জ্বালাচ্ছে, না… সোজাসুজি বললে, সিডিউস করছে।
তার ঠোঁটে ধীরে ধীরে এক কুটিল হাসি ফুটে উঠলো।
এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে, সে হঠাৎই মাথা নামিয়ে অর্ষার বুকের খাঁজে টুপ করে এক চুমু খেয়ে দিলো।
অপ্রস্তুত অর্ষার হাত হঠাৎ থেমে গেল,

তার শরীর মুহূর্তে জমে উঠলো—
আর হৃদস্পন্দন যেন দ্বিগুণ হয়ে বেজে উঠলো।
ওয়াজফান তার এই অবস্থা দেখে মুচকি হেসে উঠে বসলো।
টি-শার্টের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে ঠোঁটে খেলা করা হাসি নিয়ে বললো—
“আমায় আর সিডিউস করার প্ল্যান ছিলো, তাই না?”
অর্ষা কিছু বলার আগেই, সে হালকা ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে ঠোঁটে টুপ করে আরেকটা চুমু খেলো।
তারপর দুষ্টুমি ভরা চোখে ফিসফিস করে বললো—
“চলো… হয়ে যাক এক গেম।”

কথা শেষ হওয়ার আগেই সে অর্ষার দিকে এগোতে শুরু করলো,
কিন্তু অর্ষা হঠাৎই উঠে বসে দুহাত দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে বললো—
“সরুন… আমার কাজ আছে!”
ওয়াজফান ভ্রু তুলে তাকালো, ঠোঁটে অর্ধেক হাসি—
যেন এই ছোট্ট বিদ্রোহটাও তার কাছে আরেকটা মজার খেলায় পরিণত হলো।
কথাটা বলে অর্ষা বিছানা থেকে নামতে উদ্যত হলো।
কিন্তু সে পা ফেলবার আগেই ওয়াজফান দ্রুত হাত বাড়িয়ে তার কব্জি চেপে ধরলো।
এক টানে তাকে আবার নিজের দিকে টেনে নিলো—
মুহূর্তেই অর্ষা গিয়ে পড়লো তার কোলের ওপর।
ওয়াজফান তাকে কোলে বসিয়ে,

ওয়াজফান পিছন থেকে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো,
ঠোঁটের কোণে সেই চেনা কুটিল হাসি।
মৃদু স্বরে বললো—
“আচ্ছা… এখন ছেড়ে দিচ্ছি।
কারণ কিছুক্ষণ পর আমাদের বের হতে হবে।
তাই, বেবি, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।”
অর্ষা তার বাহু থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো,
কিন্তু ওয়াজফান ইচ্ছে করেই কয়েক সেকেন্ড বেশি আঁকড়ে রাখলো—
যেন বলে দিচ্ছে, ছেড়ে দিচ্ছে ঠিকই, তবে পুরোপুরি নয়।
অর্ষা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

“আস্তে ধরুন… আর বলুন তো, আমরা কোথায় যাচ্ছি? হঠাৎ এমন কোথাও বের হচ্ছি কেন?”
ওয়াজফান ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে বলল,
“আমার কিছু কাজ আছে, তাই যাচ্ছি দুই দিনের জন্য।
আর তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি…
কোথায় যাবো সেটা তো পৌঁছালেই দেখতে পাবে।”
অর্ষা এবার কোলের ওপরেই ঘুরে বসল,
চোখে একরাশ কৌতূহল, তবু নামার কোনো তাড়া নেই।
তারপর নিজের হাত বাড়িয়ে ওয়াজফানের গলা জড়িয়ে ধরে মিষ্টি স্বরে বলল,
“যাবো ঠিক আছে… তবে আগে আপনি আমার সঙ্গে শপিংয়ে যাবেন।
আর আমার জন্য না—আপনার জন্য।

এই লম্বা পোশাকটা বদলে, আমি যা বলবো সেটা কিনবেন।”
ওয়াজফান ভ্রু তুলল, চোখে খুনসুটি মাখা প্রশ্ন—
“কেন? এই পোশাকে কী সমস্যা?”
অর্ষা হালকা হেসে বলল,
“সমস্যা কিছু নেই। তবুও আমি চাই… আমার ভালোবাসা আমার ইচ্ছেতে সাজুক।
আপনি না করবেন না, প্লিজ?”
ওয়াজফান তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল,
তারপর গভীর কণ্ঠে মেনে নিল,
“আচ্ছা… ঠিক আছে। যাওয়ার পথে শপিংয়ে যাবো।

এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
অর্ষা বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়েছে ঠিক তখনই,
দরজায় নীরবে এক দাসি এসে দাঁড়ালো।
শ্বাস সামলিয়ে সে খবর দিলো—
“প্রিন্সেস ইসাবেলা ফিরে এসেছেন… মানবের দুনিয়া থেকে।”
খবরটা শোনামাত্র অর্ষার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো, যেন অনেকদিনের প্রিয় বন্ধুর খবর পেয়েছে।
“সত্যি!?”—উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে বলে সে সাথে সাথেই বের হতে উদ্যত হলো,
যেন এখনই গিয়ে ইসাবেলাকে জড়িয়ে ধরবে।
কিন্তু ওয়াজফান হাত বাড়িয়ে তার পথ আটকালো।
গভীর, দৃঢ় কণ্ঠে বলল—

“আগে রেডি হয়ে নাও। যাওয়ার আগে দেখা করো।
না হলে আমাদের দেরি হয়ে যাবে।”
অর্ষা মুখ ভার করলো, কিন্তু কিছু বলল না।
শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল,
রেডি হওয়ার প্রস্তুতিতে মন দিলো।
তার ভেতরে ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেলেও,
ওয়াজফানের চোখে তখন এক অদ্ভুত স্থিরতা।
এরপর ,

সে ধীরে ধীরে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল—
পদক্ষেপ যেন হিসেব করে রাখা,
আর মুখে এক গোপন ভাবনার ছায়া।
ওয়াজফান সোজা ইসাবেলার কাছে যায়।
ওয়াজফানকে দেখে ইসাবেলা খুশিতে ছুটে গিয়ে দাদাভাইকে জড়িয়ে ধরল।
ওয়াজফানও এক মুহূর্তের জন্য বোনকে কাছে টেনে নিলো, তারপর হালকা বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল—
“এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে? কী ব্যাপার, ওখানে কোনো সমস্যা হয়েছিল নাকি?”
ইসাবেলা নম্র স্বরে উত্তর দিল—
“না, কোনো সমস্যা হয়নি। অনেকদিন তো ছিলাম সেখানে… তোমাদের কথা খুব মনে পড়ছিল, তাই চলে এলাম।”
ওয়াজফান তার মাথায় আলতো হাত রেখে মুচকি হেসে বলল—
“তা বল, মানবদুনিয়ায় কেমন কাটালি? মনের আশা পূর্ণ হলো তো?”
ইসাবেলা হেসে মাথা নাড়ল—

“খুব ভালো কাটিয়েছে, দাদাভাই। আমার আশা পূর্ণ হয়ে গেছে। আচ্ছা, তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল… জানো, একজন নেকড়ে—”
কিন্তু কথা শেষ করার আগেই “নেকড়ে” শব্দটা শুনে ওয়াজফানের চোখে এক ঝলক উত্তেজনা ছুটে গেল।
সে সাথে সাথেই ইসাবেলাকে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল—তার হাত-পায়ে কোথাও আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা।
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল—
“নেকড়ে? ওরা তোমাকে আঘাত করেছে? কোথায় আঘাত করেছে বল! কোন নেকড়ে করেছে? আমি এখনই তাকে শেষ করে দেব!”

ইসাবেলা ভাইয়ের এই রূপ দেখে শান্ত কণ্ঠে বলল—
“দাদাভাই, শান্ত হও। তুমি যা ভাবছ, তা কিছুই হয়নি। কোনো নেকড়ে আমাকে আঘাত করেনি। তুমি আমার কথা পুরো শোনোনি।”
কিছুটা থেমে, ভয় মাখা স্বরে আবার বলল—
“একটা নেকড়ে ছেলে…”
এই কথাটা শেষ হতে না হতেই ওয়াজফানের চোখ রাগে সোনালি হয়ে উঠল।
তার মুখ লাল, কণ্ঠে তীব্র কঠোরতা—

“এই নামটা তুমি কার কাছ থেকে শুনেছ জানি না, কিন্তু তোমার মুখে এই নাম আর কখনো শুনতে চাই না!
তুমি জানো না নেকড়েরা জিনেদের সবচেয়ে বড় শত্রু। এই রাজ্যে তাদের নিয়ে কথা বলাও নিষিদ্ধ। আমি ওদের চোখে সহ্য করতে পারি না। দ্বিতীয়বার আমার সামনে এই নাম উচ্চারণ করবে না!”
ভাইয়ের এমন রূপ দেখে ইসাবেলার বুক কেঁপে উঠল। সে ভয়ে মাথা নিচু করে নিলো।
ওয়াজফান সেই মাথায় আলতো হাত রেখে কণ্ঠ নরম করল—

Death or Alive part 25

“অনেক পথ পেরিয়ে এসেছ, বিশ্রাম করো। আমি আর তোমার ভাবি এক কাজে বের হবো, ফিরতে দুই দিন লাগবে। নিজের খেয়াল রেখো… আমি আসছি।”
কথাটা বলে ওয়াজফান রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
আর ইসাবেলা দাড়িয়ে থাকে নিজের জায়গায় স্তব্ধ হয়ে।

Death or Alive part 27

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here