Death or Alive part 28
priyanka hawlader
ইসাবেলার মন আজ অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে আছে। বহু দিনের অপেক্ষা, লুকিয়ে রাখা অনুভূতি, ভয় আর বাঁধা পেরিয়ে অবশেষে আজ তাদের ভালোবাসা পূর্ণতার পথে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে—কেশে আঙুল বুলিয়ে, ঠোঁটে হালকা রঙে প্রাণের স্পর্শ দিয়ে। হৃদয় যেন অধীর হয়ে আছে ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই, রাজপ্রাসাদের কঠোর নজরদারির ফাঁক গলে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে সে। রাতের বাতাসে ভেসে আসে ফুলের গন্ধ আর দূরে কোথাও বাজপাখির ডাক—মনে হয় প্রকৃতিও আজ তাদের সাক্ষাতের সাক্ষী হতে চলেছে।
অল্প দূরে, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল সেই নেকড়ে ছেলেটি—যার চোখে যেন হাজার বছরের আকুলতা। ইসাবেলাকে দেখা মাত্রই তার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে হাসি, যা অন্ধকারকেও উজ্জ্বল করে তোলে। এক বিন্দু দ্বিধা না করে ইসাবেলা এগিয়ে যায়, তার উষ্ণ হাতে নিজের হাত রেখে দেয়।
দুজনের হাতের মাঝে যেন এক নীরব শপথ বোনা হয়—যা ভাঙার সাধ্য কারও নেই। তারা ধীরে ধীরে পা বাড়ায় নিকারো রাজ্যের দিকে, যেখানে অপেক্ষা করছে নতুন এক গল্পের সূচনা…
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিকাড়ো রাজ্যের রাজপ্রাসাদ আজ শান্ত, আকাশের নীলিমা যেন রাজ্যের সাদা প্রাসাদের গায়ে মাখামাখি করছে। সেই প্রাসাদের এক দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন ক্যালিয়ন—রাজা, কিন্তু আজ তার চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। ঠোঁটে হালকা, আশ্বস্তকর হাসি, যা দূরের পাহাড়ের মতো দৃঢ় আর একই সাথে কোমল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বারান্দার দিকে এগিয়ে আসে ড্যানিয়ল। প্রথা মেনে ক্যালিয়নের অনুমতি নিয়ে সে ইসাবেলাকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ইসাবেলার চোখে কৌতূহল আর সামান্য স্নিগ্ধ লজ্জা—এ প্রথমবার সে এই রাজাকে সামনে দেখছে।
ড্যানিয়ল সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে বলে—
উনি নিকাড়ো রাজ্যের রাজা, লর্ড ক্যালিয়ন । আর লর্ড, উনি আমার গার্লফ্রেন্ড… খুব শিগগিরই আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি।”
ইসাবেলা মিষ্টি হাসি দিয়ে ক্যালিয়নের সামনে মাথা নোয়ায়, রাজাকে তার প্রাপ্য সম্মান জানায়।
ক্যালিয়নের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।
“বাহ! খুব সুন্দর জুটি তোমরা। একসাথে তোমাদের দারুণ মানিয়েছে। দোয়া করি, খুব শিগগিরই বিয়ে করো আর সুখে-শান্তিতে সংসার করো।”
কথাটা শুনে ইসাবেলার গালে হালকা লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে। ক্যালিয়ন মৃদু রসিকতা করে বলে—
“আমাদের রাজ্যের হবু বউ হয়ে গেলে, লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই কিন্তু।”
এরপর তিনি ড্যানিয়লের দিকে তাকিয়ে স্নেহভরে বলেন—
“অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসেছিস। আগে বিশ্রাম কর, আর ওকেও বিশ্রাম নিতে দে।”
ড্যানিয়ল সম্মতি জানিয়ে ইসাবেলাকে নিয়ে তার জন্য নির্ধারিত কক্ষে যায়, সেখানেই তাকে কিছুটা সময়ের জন্য বিশ্রাম করতে বলে। তারপর আবার ক্যালিয়নের কাছে ফিরে আসে, যেন আরও কিছু কথা বাকি আছে তাদের মধ্যে।
আজ ক্যালিয়নের চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি যেন মুছে যাওয়ার নামই নিচ্ছে না। দীর্ঘদিনের অপেক্ষা, পরিকল্পনা আর ধৈর্যের ফল আজ তার হাতে—মনভরা এক বিজয় অনুভূতি।
তার পিছনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে ড্যানিয়ল। পদচিহ্নের শব্দও যেন হারিয়ে গেছে এই নীরবতায়। ক্যালিয়ন ধীরে পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়, চোখে স্নিগ্ধ অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, আর সাবাসি ভরা কণ্ঠে বলে—
“গুড জব, ড্যানিয়ল! আমি জানতাম, এই কাজটা একমাত্র তুই-ই করতে পারবি। আর দেখ, তুই করেও দেখিয়েছিস। আমরা অবশেষে আমাদের বহু দিনের মিশনে সফল হয়েছি। আমার আনন্দ… তা তোকে ভাষায় বুঝিয়ে বলতে পারব না।”
তারপর সেই হাসি ধীরে ধীরে বদলে যায়, কণ্ঠ আরও গভীর, ঠান্ডা অথচ ধারালো হয়ে ওঠে—
“ওই জানোয়ারের বাচ্চা… আমার কাছ থেকে আমার হৃদয় কেড়ে নিয়েছিল। দেখ আজ… আমিও ওর কাছ থেকে ওর কলিজা কে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছি।”
এই কথাগুলো শোনার পর ড্যানিয়লের মুখে খুশির আভা থাকার কথা ছিল। কিন্তু সে দাঁড়িয়ে থাকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায়, চোখে অনিশ্চয়তার ছায়া। ঠোঁট কাঁপে, কিছু বলতে চায়… কিন্তু ক্যালিয়নের সামনে সাহস হারিয়ে ফেলে। বুকের ভেতরে যেন অজানা যন্ত্রণার ঢেউ আছড়ে পড়ে—সে কি তবে অজান্তেই ইসাবেলার মায়ায় জড়িয়ে পড়ছে?
বাতাসে যেন এক গোপন ঝড়ের ইঙ্গিত মিলছে…
সকালটা ছিল অদ্ভুত—আকাশে রোদ উঠেছে ঠিকই, কিন্তু জানালার ফাঁক গলে আসা আলোও যেন কোনো এক গোপন অন্ধকারে ঢাকা। ঘরে ভারী নীরবতা, কেবল দূরে কোথাও অচেনা এক পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।
এলিনা নিজের কক্ষে গভীর ঘুমে ডুবে ছিল, আর তার পাশেই নিঃশ্বাসের মৃদু ওঠানামা নিয়ে শুয়ে আছে জ্যাইম। হঠাৎ, ঘুমের আবরণ ধীরে ধীরে সরতে শুরু করে এলিনার চোখ থেকে। সে চোখ মেলে ধীরে উঠে বসে—মাথা এখনো কেমন যেন ঝিমঝিম করছে, মনে হচ্ছে শরীরটা ভারী হয়ে গেছে।
বিছানা ছাড়তে গিয়ে হঠাৎ কম্বলের ভেতরে নিজের দিকে তাকাতেই তার বুক ধক করে ওঠে। চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়—যেন এক মুহূর্তে হৃদয়ের স্পন্দন আটকে গেছে।
কাঁপা কাঁপা হাতে ধীরে ধীরে পাশে তাকায়… আর তখনই দেখতে পায় জ্যাইমকে—শান্ত ঘুমে আচ্ছন্ন, তবু যেন তার নীরব উপস্থিতি সবকিছু বলে দিচ্ছে।
পরের মুহূর্তেই এলিনা যেন এক আকাশ পরিমাণ চমকে ওঠে। গত রাতের ঘটনাগুলো বুঝতে তার আর কোনো শব্দ বা প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না। নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে আসে, চোখে আতঙ্কের ছায়া গাঢ় হয়।
চাদরটা শক্ত করে জড়িয়ে পুরো শরীর ঢেকে নেয় সে, যেন সেই কাপড়ই তার একমাত্র আশ্রয়। তারপর হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে দৌড়ে ঢুকে যায় ওয়াশরুমে।
দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় জ্যাইমের। সে চোখ মেলে তাকায়,
পাশের ফাঁকা জায়গাটায় হাত বুলিয়ে বুঝতে পারে—এলিনা আর সেখানে নেই। বিছানার চাদর এখনো উষ্ণ, তবু তার অনুপস্থিতি ঘরটাকে কেমন শূন্য করে তুলেছে।
মুহূর্তেই তার বুকের ভেতর অস্বস্তির ঢেউ আছড়ে পড়ে। মনে মনে ভয় পেয়ে যায়—আজ এলিনা চোখে চোখ রাখবে কি করে সে, কিভাবে বুঝাবে তাকে যে, গত রাতের ঘটনা… সে কি ভুলভাবে নেবে?
ভাবতে ভাবতে মনের ভেতর অদ্ভুত কাঁপন জাগে। “না… এলিনা নিজেই এসেছিল আমার কাছে… সে-ই জোর করেছিল…”—নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে জ্যাইম। কিন্তু এই যুক্তিগুলোও যেন তার নিজের কানে বিশ্বাসযোগ্য শোনায় না। মাথার ভেতর এক অদৃশ্য চাপ জমে ওঠে, যেন হাড়ভাঙা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে পুরো মগজে।
“আমি কি… খুব বড় ভুল করে ফেলেছি?”—প্রশ্নটা নিঃশব্দে ভেসে ওঠে তার মনে, আর সেই প্রশ্নের উত্তর যেন কোথাও নেই।
ধীরে ধীরে সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ভারী পায়ের শব্দে মেঝে কেঁপে ওঠে। নীরবে নিজের পোশাক গায়ে চাপায়, যেন প্রতিটি বোতাম লাগানোর সাথে সাথে নিজের ভেতরের অস্থিরতাকেও লুকিয়ে ফেলতে চাইছে।
কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুমের দরজা ধীরে ধীরে খুলে যায়। এলিনা বেরিয়ে আসে—মুখ দেখে বোঝাই যায়, সে অনেক কেঁদেছে। চোখ লাল, পাপড়ি ভিজে আছে অশ্রুর দাগে, আর ঠোঁট কাঁপছে অস্থিরতায়। তার মুখে একসাথে ক্ষোভ, আঘাত আর অসহায়তার ছাপ।
জ্যাইমের বুক হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে থাকে। সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে হাত বাড়ায় তাকে থামানোর জন্য।
“এলিনা, শোন… আমার কথাটা একবার শোন।”
কিন্তু এলিনা হাত তুলে ইশারা করে থামিয়ে দেয়। ঠান্ডা অথচ কাঁপা কণ্ঠে বলে—
“তুই… যা এখান থেকে।”
জ্যাইমের গলা ভারী হয়ে আসে।
“তুই যেমন ভাবছিস তেমন কিছু না আমি ইচ্ছে করে —”
হঠাৎই এলিনা তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়, চোখে দপদপে আগুন নিয়ে চিৎকার করে ওঠে—
“তোকে আমি যেতে বলেছি! এখনই… এখান থেকে বেরিয়ে যা! আমার রুম থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে যা! আমি এই মুহূর্তে তোর কোনো কথা শুনতে চাই না! যা বলছি!”
তার চিৎকারে জ্যাইম এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। মনে হয় যেন তার পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে।
কিন্তু এলিনার রাগ থামে না—সে পাশে রাখা গ্লাসটা হাতে তুলে নেয়, মুহূর্তেই সেটা ভেঙে ধারালো কাঁচের টুকরো হাতে ধরে জ্যাইমের দিকে তাকায়।
“বেরিয়ে যা! আমি বলছি তোকে… এখান থেকে বেরিয়ে যা!”—কণ্ঠে কাঁপন, কিন্তু চোখে অটল সিদ্ধান্ত।
এলিনার এই উত্তেজনা আর রাগের সামনে জ্যাইম আর কিছু বলতে পারে না। নিঃশব্দে, এক পা… দু পা পিছিয়ে যায়। তার চোখে অদ্ভুত এক দৃষ্টি—যেখানে অপরাধবোধ, বিস্ময় আর হতাশা মিলেমিশে আছে।
শেষমেশ দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায় সে, আর ঘরে রয়ে যায় কেবল এলিনার ভারী শ্বাস আর গাঢ় নীরবতা।
জ্যাইম দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে যেতেই এলিনা ধপ করে দরজাটা জোরে বন্ধ করে দেয়। কাঠের সাথে ধাক্কার শব্দ যেন পুরো ঘরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে।
পরের মুহূর্তেই সে পা ভেঙে বসে পড়ে মেঝেতে। দু’হাত মুখে চেপে ধরে হঠাৎ করেই ফেটে পড়ে অঝোর কান্নায়—কোনো শব্দ আটকে রাখার চেষ্টা নেই, বরং কণ্ঠ ভরে ওঠে বেদনাময় চিৎকারে। মনে হয়, যেন বুকের ভেতর জমে থাকা সমস্ত কষ্ট, ক্ষোভ আর অপমান একসাথে বেরিয়ে আসছে।
“আমি কী করে ফেলেছি…?”—নিজেকেই প্রশ্ন করে সে, কিন্তু কোনো উত্তর নেই। চোখের পানি থামে না, গাল বেয়ে ঝরতে থাকে, আর তার শরীর কাঁপতে থাকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে।
এদিকে, জ্যাইম ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। পেছনে ফেলে আসে সেই ভারী নীরবতা আর তীব্র কান্নার শব্দ। তার মুখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা—
সে জানে, এখন এলিনা উত্তেজিত, কষ্টে ভরা; এই মুহূর্তে কোনো কথা বললে তা শুধুই পরিস্থিতি আরও খারাপ করবে।
তাই সে নীরবে প্রাসাদ ছাড়ে, পা বাড়ায় নিজের রাজ্যের উদ্দেশ্যে। মনে মনে ভাবে—যখন এলিনা শান্ত হবে, তখন সে সবটা বুঝিয়ে বলবে… নিজের সত্যিটা শোনাবে।
তবে অন্তরের গভীরে এক শঙ্কা চুপচাপ বাসা বাঁধে—সেই মুহূর্ত কি সত্যিই আসবে?
ঘুম থেকে উঠেই আজ অর্ষা যেন এক অচেনা মানুষ।
চোখে ঠাণ্ডা শূন্যতা, ঠোঁটে একটুও হাসি নেই।
ওয়াজফান যতবার কথা বলার চেষ্টা করেছে—মৃদু স্বরে, রসিকতায়, এমনকি একটু খেপিয়ে—
অর্ষা কেবল নীরব থেকেছে,
নজর সরিয়ে নিয়েছে,
যেন তার অস্তিত্বটাই উপেক্ষা করছে।
সকালবেলায় ওয়াজফান তার কাছে এসে এক কাপ পানির সঙ্গে একটা ঔষধি ধরিয়ে দেয়—
শরীরের ব্যথা কমানোর জন্য।
অর্ষা চুপচাপ নিয়ে খেয়ে নেয়,
তবে চোখে কোনো কৃতজ্ঞতা বা স্নেহ নেই,
শুধু ঠাণ্ডা নিরাসক্তি।
তারপর বিছানা থেকে উঠে,
নিজের ব্যাগ খুলে,
আরো একটি ঔষধ বের করে খেয়ে নেয়—
সেটা গতকাল শপিংয়ের সময় কিনে এনেছিল।
ওয়াজফান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে,
জিন হওয়ায় মানুষের এই ধরনের ঔষধ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই।
কাল রাতে অর্ষা তাকে এই ঔষধের কাজ বুঝিয়ে বলেছিল—
“আমি চাই না এখন কোনো বেবি আসুক।
আগে আমরা বাবা-মায়ের কাছে যাব,
তাদের বলবো আমাদের বিয়ের কথা।
তারপর… আপনি চাইলে, আমিও আর আপত্তি করবো না।”
ওয়াজফান কোনো প্রতিবাদ করেনি,
কারণ সে তো ঠিক করে ফেলেছে—
খুব শিগগিরই অর্ষাকে নিয়ে যাবে তার বাবা-মায়ের কাছে।
এই কয়েকদিন…
তার নীরবতা আর শীতলতা মেনে নেওয়াই হয়তো ভালো।
ওয়াজফান সকাল থেকে কতবার চেষ্টা করেছে—
কথা বলতে, মজা করতে, চোখে চোখ রাখতে।
কিন্তু অর্ষা যেন দেয়ালে রূপ নিয়েছে।
একটাও শব্দ নয়, একটাও দৃষ্টি নয়—
শুধুই ঠাণ্ডা উপেক্ষা।
শেষমেশ ওয়াজফানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল।
মনের ভেতর গর্জে উঠলো—
“কি বেয়াদব মেয়ে!
সকাল থেকে আমায় ইগনোর করছে।
সে কি ভুলে গেছে আমি ইগনোর সহ্য করি না?
আমার সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলা,
আমায় চ্যালেঞ্জ করা, আর
ইগনোর করা আমার সহ্য হয়না।
না, এটা আমার সবচেয়ে অপছন্দের জিনিস।
নিজের মনে কষে বিড়বিড় করলো—
“তবুও এই বেয়াদব মেয়ে বারবার একই কাজ করে।
এবং তবুও আমি… কিছু বলতে পারি না।
ফাজিল একটা বউ পেয়েছি—
যেমন গেঁড়ে বসেছে আমার জীবনে,
তেমনই আমার ওপর এক অদ্ভুত দখল কায়েম করেছে।
ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে গর্দান ঘুরিয়ে ফেলতাম।
কিন্তু এই ফাজিল বউকে কিছু বললেই…
আমার বুকে চিনচিনে ব্যথা করে।
অসভ্য মেয়ে!
এরপর আবার মনে মনে বিড়বিড় করে—
আরো যা মানব কন্যাকে নিজের আসক্তি বানাতে,
এরা কোনোদিনও ভালো না। এজন্যই মানব জাতি দেখতে পারিনা আমি,
তুই তো ভালো হয়ে গেছিস,
ভালো ব্যবহার করছিস…
তাই সাহসটা একটু বেশি বেড়ে গেছে ওর।
নিজেকেই কিছুক্ষণ বকাঝকা করলো।
মাথা ঝাঁকিয়ে গভীর নিঃশ্বাস ফেললো।
তবুও…
মনে হলো এই নীরবতা ভাঙতেই হবে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে অর্ষার পাশে বসল।
তার হাত ধরতে চাইলো।
কিন্তু—
অর্ষা আবারো উঠে দাঁড়িয়ে,
একটি শব্দও না বলে
ঠাণ্ডা চোখে ইগনোর করে
হেঁটে চলে যেতে নিলো।
এবার সত্যিই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল ওয়াজফানের।
বজ্রের মতো হাত বাড়িয়ে অর্ষার কবজি চেপে ধরলো,
একটানে টেনে ছুড়ে ফেললো বিছানায়।
মুহূর্তের মধ্যেই নিজে উঠে গেল তার উপর—
চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে।
চোয়াল শক্ত করে, গর্জে উঠলো,
অর্ষার থুতনি শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
তোর সাহস হয় কী করে আমাকে ইগনোর করার?
তুই কি আমার আসল রূপ ভুলে গেছিস?
আমি আদর করি বলে মাথায় চড়ে বসবি?
বল—
এবার তোকে মেরে দিই!
মেরে দিলে তো আর ইগনোর করতে পারবি না!
এই fucking ignorance drama আমার সামনে করবিনা।
অর্ষা জানে…
এটা সেই মুহূর্ত, যখন ওয়াজফান আর মজা করছে না।
সকাল থেকে সে যতবার চেষ্টা করেছে কথা বলার,
ততবারই ইগনোর করেছে।
এবং সে ভালো করেই জানে—
তার কায়স্থ সাহেবের ধৈর্য বড়ই কম।
তাই রাগের আঁচে পুড়ে যাওয়ার আগে
অর্ষা ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসে…
চোখ নামিয়ে ফেলে, ঠোঁট সামান্য কেঁপে ওঠে—
আর প্রতিরোধের বদলে নিঃশব্দে স্থির হয়ে থাকে তার নিচে।
এরপর নরম, কেঁপে ওঠা গলায় বলল—
ইগনোর করবো না তো কি করব?
আপনি জানেন, কাল আপনি আমাকে কতটা ব্যথা দিয়েছেন?
আমি কত কেঁদেছি… তবুও আপনি আমাকে ছাড়েননি।
আমার শরীর এখনও ব্যথায় ভরা…
তবুও আপনি শুধু নিজের মতো ছিলেন।
তার কণ্ঠের অভিযোগে আর কষ্টে ভরা সুরে
ওয়াজফানের চোখের আগুন আস্তে আস্তে নিভে গেল।
সে ধীরে অর্ষার চোয়াল থেকে হাত সরিয়ে নিল,
তারপর মাথা নামিয়ে,
অর্ষার গলায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল—
যেন এই মুহূর্তে পৃথিবীর একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় সে।
এক লম্বা, গভীর নিঃশ্বাসে টেনে নিল তার গায়ের গন্ধ—
যেন তা পৃথিবীর সবচেয়ে বিরল ও মধুর সুগন্ধ,
যার কাছে যে কোনও ফুলের ঘ্রাণও হার মানবে।
তার নাক আলতো করে ঘষে যাচ্ছে অর্ষার ত্বকে,
প্রতিটি নিশ্বাসে যেন সে
শুধু তাকে নিজের ভেতরে বন্দি করে নিচ্ছে।
কিছুক্ষণ এভাবে অর্ষার ঘ্রাণে ডুবে থেকে,
ওয়াজফান ধীরে, প্রায় ফিসফিস করে বলে উঠল—
এতে আমি কিছু করতে পারবো না, জান…
আমি যতবার তোমার কাছে আসব,
যতবার নিজেকে তোমার মাঝে বিলিয়ে দিতে চাইব,
ততবার তোমার এই ব্যথাগুলো সহ্য করতেই হবে।
তুমি কাঁদবে—
তাতে আমার একফোঁটা সমস্যাও নেই।
কিন্তু শোন…
আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা
কখনও, একটুও, করবে না।
তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত মিশ্রণ—
অর্ধেক সতর্কতা, অর্ধেক মোহ।
তোমাকে কাছে পেলে,
তোমার নেশায় আমি এতটাই ডুবে যাই
যে নিজের উপর আমার আর কোনও কন্ট্রোল থাকে না।
গত এক হাজার বছরে
কোনও নারী আমাকে এমনভাবে
বাঁধতে পারেনি—
আর কেউ পারবেও না।
আগে কখনও এতটা সত্য,
এতটা নেশা কারো জন্য অনুভব করিনি…
কারো কাছে যাইনি আমি।
তুমি আমার জীবনের প্রথম আর শেষ নারী
যার নেশায় আমি এতটা আসক্ত।
ওয়াজফান আরও কাছে ঝুঁকে,
তার গলায় নিশ্বাস ছুঁইয়ে বলে গেল—
তোমার অন্য সব কষ্টে
আমার বুকে চিনচিন ব্যথা করে…
কিন্তু যখন তুমি আমার দেয়া ব্যথায়
জোরে জোরে কাঁদো…
তখন আমার ভিতরে
একটা আলাদা শান্তি জন্ম নেয়।
আমি তোমাকে সারাজীবন
এভাবেই কাঁদাবো…
My fucking little monster.
ওয়াজফানের কথাগুলো অর্ষার কানে পড়তেই তার মন জুড়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল।
একদম ভেতর থেকে, গভীর থেকে অনুভব করল—
এই পুরুষটা তাকে কতটা ভালোবাসে,
কতটা অন্তহীন ভালোবাসায় বন্দি করে রেখেছে তাকে।
এই হাজার বছরের ইতিহাসে,
যে ভয়ঙ্কর বাদশা হাজারো নারীর ওপর ক্ষমতা ও শাসন চালাতে পারে,
সে কখনো তার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারায়নি—
তবে…
শুধুমাত্র অর্ষার জন্যই সে উন্মাদ পাগলের মতো ভালোবাসে।
ভালোবাসা নয়, এক ধরনের বেদনাদায়ক আবেগ যা ছুঁয়ে যায় তার অন্তরার্জিত দিকগুলো।
অর্ষা সে ভালোবাসা বুঝতে পারল—
যা শুধু ভালোবাসা নয়, এক রকম উন্মাদের মত একঘেয়ে অভিমান।
মনে মনে ভাবল—
হোক না এত ভালোবাসার মাঝেও কিছু যন্ত্রণার গল্প।
তাতে কী?
সে আমাকে যতটা ভালোবাসে,
হয়তো ততটাই ভালোবাসতে পারে অন্য কেউ নয়।
মুচকি হেসে নিজেকে বোঝাল—
এই ভয়ঙ্কর বাদশার বুকে যেন আমার মৃত্যুও বরণীয়।
কিন্তু মুখে কিছু বলে না।
শুধু শান্ত হয়ে, শুদ্ধ হাত বাড়িয়ে
ওয়াজফানেকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো।
অর্ষার কোমল স্পর্শ পেয়ে ওয়াজফান বুঝতে পারল,
তার ছোট্ট লাড্ডুর রাগ ভেঙে গেছে।
তারই সঙ্গে সাথেই সে একটু আরও জোরে গলায় জড়িয়ে ধরে,
নাকটা গলার মাঝখানে চাপিয়ে,
আলতো করে ঠোঁট কামড়ে ধরে শুয়ে রইল।
অর্ষার এই ঘ্রাণে তার নিজের নিয়ন্ত্রণ ফের হারাতে বসেছে,
কিন্তু এবার সে একটু জোরে ঠোঁট কামড়ে নিজের ইচ্ছাকে থামালো।
কারণ জানে,
তার লিটল মনস্টার এখন বেশ ক্ষতবিক্ষত,
বিপদজনক অবস্থায় আছে।
কাল রাতের ঘটনার পর
যদি আজ আবার ওর ওপর চাপ সৃষ্টি করে,
অর্ষা আর তা সহ্য করতে পারবে না।
আর যাই হোক, নিজের লিটল মনস্টারের ক্ষতি করার সাহস ওর নেই।
তাই নিজেকে সামলে নিল,
চুপচাপ অর্ষাকে আঁকড়ে ধরে,
দুজনেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল—
মনের অদৃশ্য বাঁধনে বাধা হয়েই,
একটা শান্ত নিঃশ্বাসের মাঝে গা ভাসাল।
নিজের কক্ষে দাঁড়িয়ে ইসাবেলা জানালার পাশে, মনটা অদ্ভুতভাবে ভারাক্রান্ত। বাইরে থেকে আসা হালকা আলো জানালার ফাঁক দিয়ে তার গায়ের ওপর পড়ছে, যেন এক মৃদু আলোর ছোঁয়া তার বেদনাকে সামলানোর চেষ্টা করছে।
হঠাৎ পিছনের দরজা নীরবে খুলে যায়। ড্যানিয়েল প্রবেশ করে, চোখে গভীর উদ্বেগ।
ইসাবেলা দ্রুত ঘুরে তাকায়, আর স্নেহে ও নিরাপত্তায় ভরে ড্যানিয়েলকে জড়িয়ে ধরে।
ড্যানিয়েল ধীরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে একটু চিন্তার ছাপ নিয়ে বলে,
“কি হয়েছে? তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছে?”
ইসাবেলা মৃদু সুরে ফুঁ ফুঁ করে বলে,
আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, ড্যানিয়েল… তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো? আমি তোমার জন্য আমার দা, আমার পরিবার… সবাইকে ছেড়ে এসে তোমার সঙ্গে এসেছি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাদের জন্য, তবে আমি বুঝে গিয়েছি দা তোমাকে কখনো মেনে নিত না। তাই তোমার সঙ্গে চলে এসেছি। তুমি কখনো আমায় ছেড়ে যাবে না তো?”
ড্যানিয়েল আদুরে হাতে ইসাবেলার চুলের ভাজে এক স্পর্শ দিয়ে ছোট্ট করে একটা চুমু খায়। তারপর ধীরে ধীরে বলে,
আমিও তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি, পাগলি। তুমি কেন এমন কথা বলছো? আমি তোমার কোনো কষ্ট হতে দেবো না। তোমাকে একটুও ক্ষতি সহ্য করব না। সবসময় তোমাকে আগলে রাখবো, কথা দিলাম।
কিন্তু তার মনে অদৃশ্য একটা ঝড় উঠছে—
আমি তো তোমাকে আসলে অন্য উদ্দেশ্যে এনেছি, লর্ড ক্যালিয়নের কথা মাথায় রেখে ভালোবাসার নাটক করতেই এসেছিলাম। কিন্তু তোমাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি—এটা কখনো ভাবিনি। এখন আমি কী করবো? ক্যালিয়নের উদ্দেশ্যটা আমি কীভাবে পূরণ করব? তোমাকে কষ্ট দিতে পারব না।
তার হৃদয়ের গভীরে একটা ভয় জমে—
যদি তুমি একদিন আসল সত্যিটা জানতে পারো, তখন আমাকে কি এভাবেই ভালোবাসবে নাকি ঘৃণা করবে?
তোমার চোখে সে ঘৃণা কল্পনাতেও সহ্য করা যায় না। সেই ঘৃণার ভয়ে যেন তার বুক চিরে যেতে চায়। মনে প্রশ্নের ঝড় বয়ে যাচ্ছে, কষ্ট হয়ে বেঁধে যাচ্ছে তাকে।
অর্ষা বারান্দায় বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ভাবনায় ডুবে গেছে।
বিগত দুই দিনের স্মৃতিগুলো তার মনের পটে এক এক করে ভেসে উঠছে।
প্রথম দিন, যখন তারা এই ঘরে এসেছিল,
ওয়াজফান তাকে জিজ্ঞেস করেছিল—
তুমি কি রান্না করতে পারো?
আমি চাইনা এখানে কোনো দাসি আসুক,
আমাদের দুজনকে বিরক্ত করুক কেউ।
তাই তুমি যদি রান্না করতে পারো, তাহলে আর কাউকে ডাকব না।
আর না পারলে, ডাকতেই হবে।
অর্ষা লজ্জার চোখ মুচকে করে হোঁ বলেছিল,
হ্যাঁ, সে রান্না করতে পারে।
কিন্তু আসল কথা হলো, সারা জীবন সে শুধু পড়ালেখার খোরাক হয়েছে।
ডাক্তারি শিখতে ছুরিকাচি চালানো শিখেছে,
কিন্তু রান্নার র ও জানে না।
তবুও নিজেকে বড় দেখাতে,
হঠাৎ করেই রান্নার চেষ্টা করেছিল।
আর শেষমেষ আজেবাজে এক রান্না নিয়ে হাজির হয়েছিল সে।
অর্ষার আজেবাজে রান্না ওয়াজফানের সামনে রেখে সে একটু নার্ভাস চোখে তাকালো।
ওয়াজফান খাবারটি মুখে তুলতেই সঙ্গে সঙ্গে সেটি ফেলে দিল!
এত অখাদ্য খাবার জীবনেও খাইনি,সে
তার প্রাসাদে তো ভুলেও যদি খাবারে একটু এদিক ওদিক হত,
তাহলে সেটি ছুড়ে ফেলেত দাসীর মুখের উপর,
এরপর নতুন করে রান্না করতে হতো।
কিন্তু আজ ওয়াজফান বেশ সহিষ্ণু ছিল।
সে বেশি কিছু বলল না, শুধু ধীরে ধীরে বলল—
তুমি রান্না পারো না,
এটা বললেই তো হতো,
শুধু শুধু মিথ্যে বলার কী দরকার ছিল?
তারপর একটু থামল,
তার চোখে একটা অদ্ভুত মিশ্রণ দেখা গেল,
মজা আর আদর মিশিয়ে—
“আচ্ছা, দাঁড়াও, আমি কোনো দাসী ডাকছি।
বলে সে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ায়,
হঠাৎ করেই অর্ষার চোখ ভরে এলো অশ্রু,
কাঁদতে কাঁদতে কাঁধ কাঁপিয়ে বলে উঠল—
আমি কিছু পারি না।
আমি আপনাকে একটা ভালো রান্না করে খাওয়াতে পারলাম না।
আপনি আমাকে শুধু শুধুই বিয়ে করেছেন,
আমার দ্বারা কোনো কাজ হয় না।
একটা অখাদ্য খাবার রান্না করে নিয়ে এলাম শুধু।
ওয়াজফান তখনই আবার টেবিলে বসে পড়ল,
অর্ষার হাতের রান্না করা সব খাবার টুকটাক খেতে লাগল।
অর্ষা অবাক হয়ে হঠাৎ কান্না থামিয়ে দিলো।
সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
এরপর ওয়াজফান এর সামনে এসে বলল—
“কি করছেন? এসব অখাদ্য খাবার আপনার খেতে হবে না।
দাসীকে ডাকুন, ওরা ভালো রান্না করবে।
তখন ওয়াজফান অর্ষার হাতে হাত রেখে গম্ভীর গলায় বলল—
আমি আমার বউয়ের হাতের রান্না তৃপ্তি ভরে খেতে চাই।
আমাকে বিরক্ত করো না।
চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে থাকো।
অর্ষা একটু লজ্জা নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখে,
ওয়াজফান যেন সত্যিই প্রতিটি কামড়ে
আনন্দে ভরে উঠছে,
এমনভাবে তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে।
যখন অর্ষা তার নিজের রান্না করা খাবার খেতে চাইল,
ওয়াজফান কঠোর সুরে বলে উঠল—
“না, এটা পুরোটা আমার জন্য।
তুমি কিছু খাও না।”
তারপর নিজেই সেই খাবার ধীরে ধীরে সব খেয়ে শেষ করলো।
অর্ষার চোখ বড় হয়ে গেল, কিছু বলতে চাইছিল,
কিন্তু ওয়াজফান চুপচাপ বসে একে একে সব খাবার পেট পূর্ণ করে ফেলল।
এরপর নিজের খাওয়া শেষ করে ওয়াজফান অর্ষার জন্য বাইরে থেকে নতুন খাবার আনে।
এই দুই দিন ধরে,
অর্ষা যতই মনে মনে নিজেকে ছোট ভাবুক,
তার অখাদ্য রান্না ওয়াজফান তৃপ্তি ভরে খেতে থেকেছে।
অর্ষা একবার বলেছিল,
দাসী এনে দিতে,
কিন্তু ওয়াজফান তা মানেনি।
সে বলেছে,
আমার বউর হাতের রান্নাই আমার জন্য যথেষ্ট।
কথাগুলো ভেবে অর্ষার মুখে মুচকি হাসি ছড়িয়ে পড়ল।
তখনই ওয়াজফান নিঃশব্দে তার পাশে এসে বসল।
ধীরে ধীরে অর্ষার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে সাইডে রাখল।
তার হাত ধরে টেনে নিল নিজের কোলে,
নরম গলায় জিজ্ঞেস করল—
কি এত ভেবে মুচকি হাসছো, লাড্ডু?
তার গালটা টেনে একটু আদর করল।
অর্ষা কিছু বলতে পারল না,
শুধু ওয়াজফানের গলা জড়িয়ে ধরে গভীর এক শান্তি পেল।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে বলল,
আজ আমাদের ফিরতে হবে, সবকিছু গুছিয়ে নাও।
অর্ষা হাসিমুখে বলল,
যাক, আজ থেকে আর আপনাকে অখাদ্য খাবার খেতে হবে না।
এবার প্রাসাদে গিয়ে ভালো খাবার খাবেন।
ওয়াজফান চোখ ঝাপসা করে বলল,
কে বলেছে আমি অখাদ্য খাবার খেয়েছি?
এই দুইদিনের খাবারগুলো আমার এত ভালো লেগেছে,
যে এখন থেকে তুমি প্রতিদিন আমার জন্য রান্না করবে।
প্রাসাদেও আমি শুধু তোমার হাতের রান্নাই খাব।
অন্য কারো রান্না আমি খেতে চাই না,
আমার বউয়ের হাতের রান্নাই আমার আসল মজা।
অর্ষা কপালে পড়া চুলগুলো কানের পেছনে সরিয়ে দিতে দিতে কথাগুলো বলল সে।
অর্ষা ওয়াজফানের দিকে অবাক চোখে তাকাল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে সে নরম স্বরে তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল।
মনে মনে বলল—
আমি কি পারবো এই ভালোবাসাটা নিয়ে সারা জীবন
এই লোকটার বুকে থেকে যেতে?
বিছানায় পড়ে আছে এলিনার নিথর দেহ, যেন অচেতন শূন্যতার মাঝে হারিয়ে যাওয়া এক জীবনের অবশিষ্টাংশ। তার মুখ ছাই রঙা, সাদা—যে সাদাটে রঙটিতে আর কোনো রক্তরাশি নেই, কোনো জীবনের আঁচ নেই। চোখ বন্ধ, কিন্তু যেন তার নিঃশ্বাসের গতি থেমে গেছে চিরতরে। হাতের নখগুলো নিঃসঙ্গ নিঃসার ছায়ার মতো মেঝেতে আঁচড় ফেলে রেখেছে।
তার পাশে বসে আছে জ্যাইম, চোখের পলকে যেন স্থির হয়ে গেছে পৃথিবীর সব আলো। তার শরীর লোহার মতো অচল, কিন্তু মনে মনে তুফান বইছে। যেন তার হৃদয়ে এক একটি স্পন্দন কেটে গেছে, মনে হচ্ছে বুকের পাঁজর গুলো সব এক একটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। আর সামনে পড়ে থাকা নিথর দেহ নয়, হারানো জীবনের এক একটুকরো ছবি যেন তার চোখে ভেসে উঠছে। অশ্রু তার চোখ থেকে মুক্তি পেতে চায়, কিন্তু সে যেন তার অন্তরের যন্ত্রণাকে থামাতে চায় না।
ঘরের চারদিকে দাসীরা স্তম্ভিত, চোখে বিষাদের কালো ছায়া, মুখে অমোঘ শোক। প্রাসাদের মহল যেন মর্মর করছে গভীর দুঃখে। নিচের তলায় পড়ে আছে এরিনার বাবা—তার কান্না আর বুকের ভেতরের দংশন যেন পুরো প্রাসাদে রকমারি বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। মালালা, এই বেদনার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সেই নীরবতার মাঝে হঠাৎ দাসীদের মধ্যে একজন কণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠে, কঠোর ও অমোঘ—
এবার তো প্রিন্সেসকে নিতে হবে!
শব্দগুলো যেন এক নিমেষে যেন বরফের মতো ছুরির মতো ঘা দিয়ে আঘাত করল, জ্যাইমের বুকের মর্মে। তার মুখ থেকে বের হলো আচ্ছন্ন, দমবন্ধ করা চিৎকার—
কোথাও নিবে না ওকে! কোথাও না! ও আমার কাছে থাকবে! ও শুধু অভিমান করেছে, তাই এমন করছে। ও ছোটবেলার সেই অভ্যাসে, সবসময়ই অভিনয় করে আমার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে!
তার চোখ থেকে ঝরছে অশ্রু, কিন্তু তার কণ্ঠে আছে অবিচল বিশ্বাস আর নিষ্ঠুর এক আবেগ। ধীরে ধীরে সে এলিনার কাছে এগিয়ে যায়। কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“ওঠ, এলিনা, উঠ! না ওঠা ঠিক না। দেখ, তুই আমার সঙ্গে এমন করবি না! আমি ভুল স্বীকার করছি, আমার সব দোষ , তবে তুই আমাকে এত বড় শাস্তি দিতে পারিস না। উঠ, আমার কথা শুন, যা বলবি আমি সব শুনবো। যাকে বলবি, আমি তাকিয়ে এনে দেবো। দরকার হলে আমি দা এর কাছে পায়ে পড়ে যাব, আর ওকে তোকে এনে দেবো! তবুও তুই আমাকে ছেড়ে যেতে পারিস না!
তার কণ্ঠ আর শক্ত হতে থাকে, আর এক মুহূর্তে সে বোমার মতো বিস্ফোরিত হয়, চোখ লাল করে একরাশ আবোল-তাবোল মিশিয়ে চিৎকার করে,
Death or Alive part 27 (2)
“তুই তোকে! তুই কেন আমাকে এভাবে ছেড়ে যাচ্ছিস! আমার জীবন ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবিস কেন! আমি তোকে হারাতে পারবো না! উঠ, উঠ… আমার কথা শুন! ওঠো… ওঠো!”
তার আর্তনাদে যেন পুরো প্রাসাদ কেঁপে ওঠে। কান্নার সুরে ভাসে যে গভীর কষ্ট, তা যে কেউ শুনলে বুক কেঁপে উঠবে, প্রাণ স্তব্ধ হয়ে যাবে। অসহায়তার যে মিছিল, যে ব্যাথা সেই মুহূর্তে সমস্ত বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
এই আর্তনাদ যেন দম বন্ধ করে দেয়, সময় থমকে যায়।
 
