Death or Alive part 29
priyanka hawlader
পারস্যের প্রাচীন আকাশ আজ অদ্ভুত রূপ ধারণ করেছে।
ভোর থেকেই এক অস্থিরতা ভাসছিল বাতাসে,
যেন মরুভূমির বুক চিরে উঠে আসছে এক অদৃশ্য ক্রোধ।
দমকা হাওয়ার তীব্রতা রাজপ্রাসাদের উঁচু মিনারগুলোকে কাঁপিয়ে তুলছে,
পাথরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে হাহাকার তুলছে বাতাস।
প্রাসাদের প্রতিটি কোণে ছুটোছুটি করছে দাসীরা,
প্রহরীরা অস্থির পায়ে গোপন ফিসফিস করছে—
তাদের চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক।
আজ যেন সকালের সূর্যও আলো দিতে ভয় পাচ্ছে এই ভূমিকে।
সকাল থেকে রাজপ্রাসাদের এক অদ্ভুত গুজব ছড়িয়ে পড়েছে—
বাদশাহ ওয়াজফানের অন্যতম প্রিয় বোন,
ইসাবেলা— তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কেউ জানে না, সে কোথায় গেছে, কার সাথে গেছে,
বা আদৌ কি সে নিজে থেকে কোথাও গিয়েছে,
নাকি তাকে নিয়ে গেছে কেউ।
সবাই চুপ, কারণ সত্যিটা মুখে আনার সাহস নেই কারো।
কারণ একবার এই খবর বাদশাহর কানে পৌঁছে গেলে,
প্রাসাদের দেয়াল হয়তো লাল রঙে রঙিন হবে।
প্রাসাদের উত্তর প্রান্তে,
সোনালি কারুকাজে মোড়া রাজ সবার মেঝেতে বসে আছেন ইসবাব—
ইসাবেলার বাবা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তাঁর মুখে দিনের পর দিন রাজ্যের গৌরবের গর্ব থাকলেও,
আজ সেই মুখে কেবল আতঙ্কের ছাপ।
তিনি মাথা হাতে ঠেকিয়ে বসে আছেন,
চোখের পাতা ভারী, কিন্তু ঘুমের কোনো ছোঁয়া নেই।
মনে পড়ছে সকালের কথা—
যখন তিনি মেয়েকে কোথাও খুঁজে পাননি,
তখন ভেবেছিলেন হয়তো কোনো বান্ধবীর বাড়ি গিয়েছে,
অথবা প্রাসাদের কোনো এক কোণে বসে আছে রাগ করে।
কিন্তু সূর্য অস্তমিত হওয়ার পরও
যখন ইসাবেলার কোন খোঁজ মেলেনি,
তখন তার বুকের ভেতর অদৃশ্য এক পাথর নেমে আসে।
বাইরে বাতাসের গর্জন যেন তার মনের আতঙ্ককে প্রতিধ্বনিত করছে।
এক অজানা ভয় তাকে আঁকড়ে ধরেছে—
কেমন ঘটনা ঘটেছে তার মেয়ের সাথে?
কারা তাকে নিয়ে গেছে?
আর যদি ওয়াজফান জানতে পারে…
তাহলে এই ঝড়টা কেবল আকাশেই নয়,
পুরো পারস্যের বুকে নেমে আসবে।
প্রাসাদের রাজ সভায় দাঁড়িয়ে আয়রাকের কপালে ঘাম জমেছে।
সকাল থেকে খোঁজ চলছে, কিন্তু ইসাবেলার কোনো চিহ্ন নেই।
মনের ভেতর একটা দোটানা—
বাদশাহকে খবরটা দেবে কি দেবে না?
সে জানে, একবার এই কথা ওয়াজফানের কানে গেলে
পুরো প্রাসাদ যেন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হবে।
অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিল—
এই খবর লুকিয়ে রাখা যাবে না।
পা বাড়াল বাইরে দিকে যাওয়ার জন্য।
কিন্তু হঠাৎ—
সদর দরজার বিশাল ব্রোঞ্জের ফটকে
এক দীর্ঘ, ছায়ার মতো অবয়ব দেখা দিল।
উঁচু, কঠিন চেহারার সেই মানুষ—
বাদশাহ ওয়াজফান, পাশে অর্ষা।
দু’জনের প্রবেশে যেন পুরো হলঘর এক নিমেষে নিশ্চুপ হয়ে গেল।
ওয়াজফান ঢুকতেই প্রথমেই চারপাশের মুখগুলো পড়ে নিলেন—
দাসীদের আতঙ্কিত চোখ, প্রহরীদের অস্থির পদক্ষেপ,
আর মেঝেতে বসে থাকা ইসবাব—
চোখে গভীর হতাশা ও ভয়ের ছাপ।
ওয়াজফানের সন্দেহ মুহূর্তেই দৃঢ় হলো।
কোনো বড় কিছু ঘটেছে,
আর সেটা তার অনুমান মতো সুখকর কিছু নয়।
তিনি ধীরে ধীরে ভেতরে পা বাড়ালেন,
চামড়ার বুটের শব্দ পাথরের মেঝেতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
তার কণ্ঠের গভীরতা পুরো হলঘর কাঁপিয়ে দিল—
কি হয়েছে এখানে, আয়রাক? সব বলো।
আয়রাকের বুকের ভেতর ধকধক শুরু হলো।
সে মাথা নিচু করে, গলায় ভয় মেশানো স্বর নিয়ে
পুরো ঘটনাটা খুলে বলল—
সকাল থেকে ইসাবেলার কোনো খোঁজ নেই,
সব খোঁজাখুঁজি ব্যর্থ হয়েছে।
শব্দগুলো শেষ হওয়া মাত্রই
ওয়াজফানের চোখে জ্বলে উঠল দাউ দাউ আগুন।
মুখের ধমনী ফুলে উঠেছে, শ্বাসের গতি ভারী।
রাগে যেন তার দেহ থেকে তাপ ছড়িয়ে পড়ছে,
যেন এক দণ্ডের মধ্যে প্রাসাদের বাতাসও ভারী হয়ে গেছে।
তার পিছনে দাঁড়ানো অর্ষা
তার চোখে ফুটে উঠেছে চিন্তার ছাপ ইসাবেলা শুধু তার ননদ না তার প্রিয় বন্ধু সে এভাবে কোথায় হারিয়ে গেলে সে ঠিক আছে তো ।
প্রাসাদের ভারী নীরবতা হঠাৎ চূর্ণ হয়ে গেল এক বজ্রনিনাদে।
এতগুলো দাস-দাসী, প্রহরী— তবু আমার ইসাবেলা কোথায় গেল, সেটা কেউ জানে না?”
ওয়াজফানের কণ্ঠে ছিল বজ্রপাতের গর্জন,
যা প্রাসাদের প্রাচীন দেয়াল কাঁপিয়ে তুলল।
তার চোখে আগুনের শিখা, ঠোঁট শক্তভাবে চেপে ধরা।
তিনি আরেক ধাপ এগিয়ে গর্জে উঠলেন—
যদি আমি ইসাবেলাকে খুঁজে না পাই… তবে আজ এই প্রাসাদে একটিও গর্দান অক্ষত থাকবে না। মনে রেখো— কাউকে আমি ছাড়ব না!
তার কথা শুনে দাস-দাসীদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল,
প্রহরীরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল,
কারো সাহস হলো না শ্বাস ফেলারও।
তারপর ধীরে ধীরে ওয়াজফান ডান হাত উঁচু করলেন।
আকাশে যেন অদৃশ্য শক্তির কম্পন ছড়িয়ে পড়ল।
চারপাশের বাতাস ঘন হয়ে এলো,
পাথরের মেঝেতে কাঁপন ধরল।
তার হাতের তালুর মাঝে
ঘূর্ণায়মান আগুনের এক বল জন্ম নিল—
আগুনের লেলিহান শিখায় নাচছিল রক্তিম আলো।
শক্তি এতটাই প্রবল, যেন সূর্যের এক খণ্ড অংশ তিনি হাতে ধরে আছেন।
আগুনের গোলক ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে উঠল।
তার ভেতরে ফুটে উঠল এক চিত্র—
এক চেনা রাজ্যের প্রাসাদদ্বার,
তার উপরে স্পষ্টভাবে খোদাই করা **”নিকরো রাজ্য”**র প্রতীক।
আর সেখানে…
একটা কক্ষে বসে আছে ইসাবেলা—
তাকে শক্ত হাতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক পুরুষ।
ওয়াজফানের চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল।
সেই মুখ— তিনি চেনেন।
ড্যানিয়েল।
তার শ্বাস ভারী হলো, কণ্ঠে বিষের মতো ঠাণ্ডা ক্রোধ
তাহলে… নিকরো রাজ্যই হবে আজ আমার শিকারক্ষেত্র।
আগুনের বল ধ্বংস হয়ে ছাইয়ের মতো ঝরে পড়ল,
কিন্তু প্রাসাদের ভেতর রয়ে গেল এক অদৃশ্য তাপ—
যেন ঝড়ের আগে মৃত্যুর নীরবতা।
ওয়াজফানের চোখে আগুনের শিখা জ্বলছে, কণ্ঠে গর্জন যেন যুদ্ধের ঢাক।
তিনি সিংহের মতো ছটফট করে দাঁড়িয়ে উঠলেন,
চারপাশের দাস-দাসী, প্রহরীরা আতঙ্কে মাথা নিচু করে রইল।
তৈরি হও সবাই! আজ নিকরো রাজ্যের শেষ দিন! ওই রাজ্যের মাটি লাল হয়ে যাবে রক্তে।
কেউ… হ্যাঁ, কেউই বাঁচতে পারবে না।
আর সেই ড্যানিয়েলের মাথা… আজ আমি নিজের প্রাসাদের প্রাঙ্গণে ফুটবল খেলব।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই
দূর থেকে পায়ের শব্দ, যেন বাতাস কেটে আসছে কেউ।
এক দাসী দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সামনে থামল।
মুখে আতঙ্ক, চোখে জল—
বাদশা… খবর… মেসোপটেমিয়া রাজ্যের প্রিন্সেস এলিনা… এলিনা সুইসাইড করেছেন!
শব্দগুলো যেন বজ্রাঘাত হয়ে আছড়ে পড়ল প্রাসাদের বুকে।
মুহূর্তেই নীরবতা নেমে এলো—
দাসীরা চোখ নামিয়ে ফেলল, প্রহরীদের মুখে অবিশ্বাসের ছাপ,
অর্ষা নিজের ঠোঁট চেপে ধরল।
ওয়াজফান অবাক হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন,
কিন্তু তাঁর পাশেই থাকা বৃদ্ধ সম্রাট—
তার চোখে কষ্টের ছায়া আরও গভীর হলো।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মনে মনে বললেন—
“এবার আমার ছোট ছেলেকে আমি কীভাবে বাঁচাবো?”
এতদিন ধরে তিনি শুধু লক্ষ্য করতেন—
যেদিন থেকে এলিনার বিয়ে ভেঙে গেছে ওয়াজফানের সঙ্গে,
তখন থেকেই তাঁর ছোট ছেলে…
হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছেন,
জ্যাইম — এর ব্যবহারে সে বুঝে গেছে,
পাগলের মতো ভালোবেসে এসেছে সেই মেয়েটিকে।
কিন্তু সে কখনও কাউকে বুঝতে দেয়নি,
ভালোবাসাটা লুকিয়ে রেখেছে বুকের গভীরে।
আজ সেই প্রিয় মেয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে
বৃদ্ধ সম্রাটের বুক হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল।
হাত দিয়ে বুকে চেপে ধরলেন তিনি—
শ্বাস ভারী হয়ে এলো, ঠোঁট কেঁপে উঠল,
চোখের সামনে সব ঝাপসা হতে লাগল।
তিনি দুলে উঠলেন, শরীর অসাড় হতে লাগল—
ঠিক তখনই তাঁর বড় ছেলে, ওয়াজফান,
বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে এসে
বাবার শরীর জড়িয়ে ধরে তাঁকে পড়ে যেতে দিলেন না।
প্রাসাদের ভেতর তখন কেবল শুনা যাচ্ছিল
ঝড়ের আগে এক ভয়ংকর নীরবতা…
যেন এই মৃত্যুর সংবাদ
রাজ্যের প্রতিটি হৃদয়ে অন্ধকার নামিয়ে এনেছে।
ওয়াজফান শক্ত হাতে বাবার অচেতন দেহটিকে আঁকড়ে ধরে
দ্রুত কক্ষের দিকে নিয়ে গেলেন।
তার চোখে তীব্র চিন্তা আর ক্রোধ—
কিন্তু ঠোঁট শক্ত করে বন্ধ, যেন কথা বেরোলেই বজ্রপাত নামবে।
রাজবৈদ্যের জন্য বার্তা পাঠানো হয়েছে আগেই।
মুহূর্তেই প্রাসাদের করিডোর দিয়ে রাজবৈদ্যের প্রবেশ—
সাদা পোশাক, কপালে ভাঁজ, হাতে চিকিৎসার থলি।
তিনি এগিয়ে এসে বৃদ্ধ বাদশাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন,
নাড়ি ছুঁয়ে দেখলেন, বুকের ওপর হাত রাখলেন, চোখের পাতা তুললেন।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—
“বাদশা, আপনার বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছেন।
তিনি এখন কোমায় আছেন।
কবে জ্ঞান ফিরবে… সেটি এখন বলা কঠিন।
কথাগুলো যেন কক্ষের ভেতর ভারী পাথরের মতো নেমে এলো।
বৈদ্য সামান্য মাথা নত করে সরে গেলেন,
পেছনে রইল শুধু নিস্তব্ধতা।
ওয়াজফানের শরীরে যেন আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে।
তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে,
হাতের মুঠো এতটাই শক্ত করে চেপে ধরেছে
যেন মুহূর্তেই ভেঙে ফেলবে সবকিছু।
আজকের দিনটা তার কাছে
শুধু বেদনা আর ক্রোধের সমুদ্র।
ইসাবেলার হারিয়ে যাওয়া,
এলিনার মৃত্যু,
এবং এখন বাবার কোমা—
সবকিছু যেন একসাথে ছিঁড়ে ফেলছে তার ভেতরটা।
পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অর্ষা—
তার চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে চুপিচুপি।
মনে মনে তার বুক ভেঙে যাচ্ছে এই ভেবে—
আমার কারণে কি এমনটা ঘটল?
এলিনা তো ভালো মেয়ে ছিল…
আমি কি তার মৃত্যুর কারণ হলাম?
যদি আমি না থাকতাম, তবে কি সে মরত না?”
চোখের জল থামাতে পারছে না অর্ষা,
আর সামনে দাঁড়ানো ওয়াজফানের ক্রোধ যেন
প্রাসাদের প্রতিটি দেয়াল কাঁপিয়ে দিচ্ছে—
ঠিক ঝড়ের আগের সেই ভয়ংকর নীরবতার মতো।
ওয়াজফানের বুকের ভেতর তখনো অগ্নিগিরির মতো ফুঁসছে ক্রোধ।
চোখে যেন রক্তিম আগুন, মুখে কঠোরতার ছাপ।
কিন্তু ঠিক তখনই তার দৃষ্টি পড়ল অর্ষার দিকে—
নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা,
চোখের কোণে ঝরে পড়া জলকণা,
যেন নিঃশব্দে হাজারো কথা বলছে।
এক মুহূর্তের জন্য ওয়াজফানের রাগ থেমে গেল,
তার চোখে গাঢ় গম্ভীরতা নেমে এলো।
সে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে আয়রাকের দিকে তাকাল—
তার কণ্ঠ গভীর, দৃঢ়, যেন বজ্রের শব্দে যুদ্ধের ডাক।
নিকারো রাজ্যে যুদ্ধের ঘোষণা পাঠাও—
বল আমরা আসছি।
কিন্তু তার আগে… আমি মেসোপটেমিয়া রাজ্যে যাব,
জ্যাইমকে দেখে আসব।
তারপরই ওই রাজ্যের ওপর ঝড় নামবে।
কথাগুলো শেষ করেই
সে অর্ষার হাত শক্ত করে ধরল,
যেন সেই স্পর্শে অর্ষাকে বোঝাতে চাইছে—
এই অন্ধকারের মাঝেও তুমি আমার সঙ্গী।
কোনো কথা না বলে
সে তাকে নিয়ে পা বাড়াল
নিজেদের কক্ষের দিকে,
যেখানে দরজার ওপারে অপেক্ষা করছে
আরও গোপন কথা, আরও গভীর পরিকল্পনা।
কক্ষে ঢুকেই ওয়াজফান থামল।
তার চোখ সরাসরি খুঁজে নিল অর্ষার—
ভেজা চোখ, কাঁপা ঠোঁট, নীরব অপরাধবোধে ডুবে থাকা এক মুখ।
সে ধীরে তাকে নিজের সামনে দাঁড়া করায়,
দুই হাত বাড়িয়ে আলতো করে মুছে দিল অর্ষার চোখের জল,
যেন প্রতিটি বিন্দু তার কাছে অমূল্য রত্ন।
এত মূল্যবান জিনিস এভাবে নষ্ট করছ কেন?
তার কণ্ঠে ছিল নরম সুর,
যেন গর্জন থেমে গিয়ে রয়ে গেছে শুধু মমতা।
এভাবে কেঁদে কি হবে?
যা হয়েছে, তাতে তোমার কোনো দোষ নেই।
নিজেকে কখনো দোষী ভেবো না।
সে আমাকে ভালোবাসতো,
কিন্তু আমি তাকে কখনোই বাসিনি।
আর এসবের ভেতরে তুমি তো ছিলেই না…
তুমি কেন নিজেকে দোষী ভাববে?”
কথাগুলো বলেই সে অর্ষাকে কাছে টেনে নিল—
তার বুকে লুকিয়ে দিল সমস্ত ভয় আর কষ্ট।
একটি চুমু রাখল কপালে,
যেন প্রতিশ্রুতি দিল,
যত ঝড়ই আসুক, আমি আছি।
তারপর ফিসফিস করে বলল,
আমি এখন বেরোবো… আমার ফিরতে সময় লাগবে আজ।
নিজের খেয়াল রেখো।
দরজার দিকে কয়েক পা বাড়িয়ে হঠাৎ থেমে গেল ওয়াজফান।
ঘুরে দাঁড়িয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল অর্ষার দিকে,
সেই দৃষ্টিতে ছিল এক অদ্ভুত ভয়,
যেন বুকের ভেতর আশঙ্কা দানা বাঁধছে,
কেউ তার কলিজায় হাত দিতে আসছে।
আমি না আসা পর্যন্ত… এক পা-ও বাইরে যাবে না।
অর্ষা নীরবে মাথা নাড়ল—
“হ্যাঁ”।
এরপর ওয়াজফান দরজার বাইরে পা রাখল।
সঙ্গে সঙ্গেই পাশে দাঁড়ানো এক দাসীকে কঠোর কণ্ঠে আদেশ দিল,
তোমাদের রানীর খেয়াল রাখবে।
ওর এক বিন্দু কষ্ট বা আঘাত হলে…
তোমার শরীরে থাকবে না তোমার নিজের গর্দান।
আদেশের শেষ শব্দটি যেন ঠান্ডা ইস্পাতের মতো বাতাসে কেঁপে উঠল।
তারপর আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে ওয়াজফান চলে গেল—
পেছনে রয়ে গেল নিস্তব্ধতা,
আর অর্ষার বুকের ভেতর ধুকপুক করা অজানা শঙ্কা।
মেসোপটেমিয়া রাজ্য
কালো পতাকা ঝুলছে প্রাসাদের চূড়ায়।
আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে, যেন রাজ্যের প্রতিটি নিশ্বাসে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কান্নার শব্দ—
কখনো চাপা, কখনো করুণ চিৎকারে ফেটে যাচ্ছে বাতাস।
ওয়াজফান দ্রুত পা চালিয়ে প্রাসাদের ভেতরে ঢোকে।
দরজার পাশে দাঁড়িয়েই দেখতে পায়—
জ্যাইম ভিড়ের মাঝে পাগলের মতো ছটফট করছে,
চোখ লাল, গলায় রক্তমাখা চিৎকার,
দু’হাতে শোকের শয্যাকে আঁকড়ে ধরে সে কাউকে এলিনার দেহের কাছে যেতে দিচ্ছে না।
কেউ কাছে আসবি না! কেউ ছুঁবি না ওকে!
জ্যাইমের কণ্ঠ যেন ছিন্নবিচ্ছিন্ন বেহালার তার—
রাগ, কষ্ট, অসহায়তা সব মিলিয়ে এক অমানবিক সুরে বাজছে।
ওয়াজফান দৌড়ে এসে তাকে জোরে জড়িয়ে ধরে,
বুকে টেনে আনে—
শান্ত হও জ্যাইম… আমি এসেছি।
জ্যাইম হঠাৎ থমকে তাকায়,
তারপর বুক ভেঙে কান্নায় ভাসে—
দা… তুই এসেছিস! দেখ না… ও আমার সাথে কথা বলছে না…
ওকে বল না উঠতে… আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না…
দেখ, তুইও তো এসেছিস—এবার তো ও ফিরতে পারে!
তুই বল না… তুই বল ওকে ফিরে আসতে…
আমি সব ঠিক করে দেব… আর কিছু চাইবো না… শুধু ওকে ফেরত দে…
তার কণ্ঠে এমন এক মরিয়া আর্তি ছিল,
যেন প্রতিটি শব্দে বুক থেকে ছিঁড়ে বেরোচ্ছে প্রাণ।
সে কাঁপতে কাঁপতে আবার বলে—
দা, তুই জানিস আমি ওকে ছাড়া শ্বাস নিতে পারি না…
ওকে ছাড়া আমার কিচ্ছু লাগবে না…
আমার রাজ্য, আমার জীবন… সব কিছু দিয়ে দেব…
শুধু ওকে ফিরিয়ে দে…
ওয়াজফান শক্ত করে ধরে রাখে ভাইকে—
কিন্তু সময় নির্মম,
চারিদিকে শোকাভিভূত জনতা এলিনার শেষ বিদায় জানাচ্ছে,
সাদা ফুলে ঢেকে যাচ্ছে তার নিথর দেহ,
আর প্রাসাদের প্রাচীর যেন নীরব হয়ে সবটা দেখছে,
যেমন নীরব থেকেছে নিয়তির নিষ্ঠুরতা।
জ্যাইমের আর্তনাদ ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে এক অস্পষ্ট শ্বাসে।
তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, ঠোঁট কাঁপে, তারপর—
নিঃশব্দে অজ্ঞান হয়ে যায় সে।
ওয়াজফান মুহূর্তের জন্য স্থির দাঁড়িয়ে থাকে,
চোখে, মুখের গাম্ভীর্য যেন তলোয়ারের মতো ধারালো।
সে নীরবে হাত বাড়িয়ে ভাইকে তুলে নেয়,
তার শরীরের ভার যেন হাড় ভেদ করে বুকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।
চারপাশের জনতা স্থির দৃষ্টিতে দেখছে বাদশাকে,
কেউ সাহস করছে না কাছে আসতে।
ওয়াজফান কোন কথা না বলে বেরিয়ে যায়—
পা ফেলার প্রতিটি শব্দে শোক আর ক্রোধের মিলিত সুর বাজছে।
প্রাসাদে ফিরে এসে সে জ্যাইমকে তার কক্ষে শুইয়ে দেয়,
তারপরে দরজা বন্ধ করে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
বাহিরে ঝড় বইছে,
ভেতরে তার চোখের পাতা ভেদ করে বেরোবার চেষ্টা করছে আগুনের শিখা।
অল্পক্ষণ পর, সিংহাসন কক্ষে প্রবেশ করে সে—
সব প্রহরী, দাস, সেনাপতি সামনে দাঁড়িয়ে।
তার কণ্ঠ যেন বজ্রপাতের মতো গর্জে ওঠে,
চলো… নিকারো রাজ্যের দিকে এগোনো যাক।
শব্দগুলোতে মৃত্যুর শীতল ঘোষণা।
এক মুহূর্তে প্রাসাদের নীরবতা ভেঙে যায়—
যুদ্ধের জন্য ঢাল-তলোয়ার ঝলসে ওঠে,
সেনাদের চোখে জ্বলে ওঠে প্রতিশোধের আগুন।
রাজপান নিজ হাতে পতাকা তুলে নেয়,
আর ওয়াজফান—
তার কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে চলে মৃত্যুর বার্তা নিয়ে নিকারোর দিকে।
নিকারো রাজ্যের বিশাল দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো ওয়াজফান। তার চোখে দাউ দাউ করে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন—যেন কারো এক চিলতে দৃষ্টি পেলেই তা ছাই করে দেবে। তার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত, কাঁধের পেশিগুলো শক্ত হয়ে আছে, মুঠোয় ধরা ক্রোধে কাঁপছে হাত।
দরজার প্রহরী সম্মান জানিয়ে সামনে এগিয়ে এলো। মাথা নত করে ভদ্র কণ্ঠে বলল—
“নিকারো রাজ্যে আপনাকে স্বাগতম, লর্ড ক্যালিয়ন আপনাকে ভিতরে আহ্বান করেছেন।”
কথাটা শুনে কিছুটা অবাক হলো সে।
মুখের গম্ভীরতা ও চোখের রাগের ঝিলিক চেপে রেখে, বুকের ভেতরের আগুনকে কোনোমতে বশে এনে, ওয়াজফান ভেতরে প্রবেশ করল।
রাজপ্রাসাদের হলঘরে ঢুকতেই দৃষ্টি পড়ল—সিংহাসনে অবিচল ভঙ্গিতে বসে আছে ক্যালিয়ন। তার চোখে সেই চিরচেনা অহংকার। আর তার পাশে দাঁড়ানো ইসাবেলা—যার মুখে এক ধরণের দৃঢ়তা, তবে চোখে অস্পষ্ট শঙ্কার ছাপ। আর… ঠিক তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ড্যানিয়েল।
ড্যানিয়েলকে দেখার মুহূর্তেই ওয়াজফানের রাগ তীব্রতায় বিস্ফোরিত হলো। তার মুঠো যেন নিজের ইচ্ছায় শক্ত হয়ে উঠল, দেহের প্রতিটি রন্ধ্রে প্রতিশোধের বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে আর নিজেকে থামাতে পারল না। কোমরের পাশ থেকে দ্রুততার সাথে অস্ত্র বের করল—তীক্ষ্ণ তরবারির ঝলক এক মুহূর্তে চোখ ধাঁধিয়ে দিল।
পদক্ষেপ দ্রুততর হয়ে উঠল—প্রতি ধাপে যেন মেঝে কেঁপে উঠছে। তার দৃষ্টি ড্যানিয়েলের উপর স্থির, সেই এক অগ্নিশিখা—আজ তার মাথা আর শরীর এক থাকবে না।
কিন্তু হঠাৎ…
ওয়াজফানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল ইসাবেলা।
তার চোখে এক অদম্য দৃঢ়তা, শরীর যেন ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ড্যানিয়েলের সামনে।
দুই হাতে ছড়িয়ে রেখেছে নিজের অবস্থান—যেন ঘোষণা করছে, “আমাকে পেরিয়ে যেতে হলে, প্রথমে আমার প্রাণ নিতে হবে।”
ওয়াজফানের পা থেমে গেল, কিন্তু তার বুকের ভেতরের জ্বলন্ত আগুন আরও তীব্র হয়ে উঠল। রাজপ্রাসাদের নিস্তব্ধতা ভেঙে কেবল শোনা যাচ্ছে ধুকপুক ধুকপুক হৃদস্পন্দন—যা যুদ্ধের আগের সতর্ক সংকেতের মতো।
ওয়াজফানের চোখে এবার ক্রোধ যেন রূপ নিল ঝড়ের। তরবারির ফলা আলোয় ঝলসে উঠল, কণ্ঠে বজ্রপাতের মতো গর্জন—
সামনে থেকে সরে যাও, ইসাবেলা! আজ আমি এই শয়তানকে শেষ করে দেব। ওর সাহস হলো কী করে আমার বোনের দিকে হাত বাড়ানোর!
ইসাবেলা থমকে দাঁড়ায়নি। তার বুকের ভেতর ধকধক করছে, কিন্তু চোখে ভয় নেই—বরং অদম্য প্রতিবাদ। কণ্ঠ যেন ধারালো অস্ত্রের মতো ছুটে গেল
দা ভাই… ওর কোনো দোষ নেই!
ওয়াজফান বিস্ময় আর রাগে চোখ বড় করে তাকায়,
কী বলছিস তুই?
ইসাবেলার গলা কেঁপে উঠলেও কথা থামেনি,
ও আমাকে এখানে জোর করে আনেনি… আমি নিজে এসেছি।
হলের বাতাস যেন এক মুহূর্তে জমে গেল। প্রহরীরা নিঃশ্বাস আটকে আছে, ড্যানিয়েলের মুখে বিস্ময়, আর ক্যালিয়নের ঠোঁটে অদ্ভুত এক অর্ধ-হাসি খেলে গেল।
ওয়াজফানের হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠল—রাগ, অবিশ্বাস আর আঘাতের ঢেউ যেন তার শিরায় শিরায় ছুটে যাচ্ছে।
ওয়াজফানের চোখে এবার ক্রোধ যেন আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল। সে হুংকার ছেড়ে গর্জে উঠল,
পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই, ইসাবেলা? নিজের মুখে কি বলছিস তা ঠিকমতো জানিস তো? এই পাগলামি করিস না! আমি জানি, ও তোকে ব্রেনওয়াশ করেছে, তাই তুই এসব বলছিস। না হলে তুই কেন এই শয়তানের হাত ধরে এখানে আসবি?”
ইসাবেলা এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়াল, তারপর স্থির কণ্ঠে বলল—
কেউ আমাকে ব্রেনওয়াশ করেনি, দা ভাই। আমি এখানে এসেছি কারণ… আমি ড্যানিয়েলকে ভালোবাসি। তাই আমি ওর সাথে এসেছি, আর আমি এই রাজ্যেই ওর সাথে থাকতে চাই… সারা জীবন।
ওয়াজফানের মুখের রঙ মুহূর্তে বদলে গেল—রাগ, অবিশ্বাস, আঘাত সব মিলেমিশে এক তীব্র ঝড় তৈরি হলো তার চোখে।
“তুই কি বলছিস এসব? তুই ভালোবাসিস সেই মানুষটাকে, যে তোর দা ভাইয়ের সবচেয়ে বড় শত্রু! যারা তোর ভাইয়ের অনেক ক্ষতি করেছে! তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস, ইসাবেলা? আমি আমার বোনকে এমন চিনিনি। আমার বোন অন্যরকম ছিল… কিন্তু তুই? তুই তাদের সাথে মিশে গিয়েছিস?”
তার কণ্ঠ আরও কর্কশ হয়ে উঠল—
“তুই এখানে থাকতে পারবি না। আমি তোকে থাকতে দেব না! তাই এসব পাগলামি বন্ধ করে চুপচাপ আমার সাথে রাজ্যে ফিরে চল। তুই ভালো করেই জানিস, আমি অতিরিক্ত রেগে গেলে এই রাজ্যে রক্তের বন্যা বইবে। তারপরও আমি তোকে এখান থেকে নিয়ে যাবই… যেকোনো মূল্যে।
এ কথা বলেই ওয়াজফান ঝট করে ইসাবেলার হাত চেপে ধরে টেনে নিতে উদ্যত হলো।
কিন্তু ইসাবেলার চোখে তখন অদম্য জেদ—সে মুহূর্তেই হাতটা ছিটকে ফেলল, যেন এক প্রাচীর ভেঙে দিয়েছে।
হলের নীরবতা আরও ঘন হয়ে এলো।
ইসাবেলার চোখে তখন আগুনের ঝিলিক, কণ্ঠে বিদ্রোহের ঝড়।
“তুমি এমন কেন করছো আমার সাথে, দা ভাই? আমারও তো নিজের মন আছে—নিজের ইচ্ছে আছে! আমি যা চাই, তাই করব, আর তুমি আমাকে থামানোর কেউ নোও। তুমিও তো ভালোবেসে এক মানবকন্যাকে বিয়ে করেছো, তাই না? তখন তো তোমার এত ঘৃণা, এত অহংকার কোথায় গেল? তুমি তো মানুষের ছোঁয়াতেও বিরক্তি পেতি, অথচ আজ সেই ‘তুচ্ছ’ মানবকেই বিয়ে করলল!
তুমি যখন নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেছো, তখন আমি কেন আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে পারব না? আমি ভালোবেসেছি ড্যানিয়েলকে—সে নেকড়ে হোক বা না হোক, আমার কাছে সে-ই আমার পৃথিবী। তুমি চাইলে মেনে নেও, না হলে এখান থেকে চলে যাও। আমি এখানে, এই রাজ্যে, আমার ভালোবাসার মানুষটার সাথে ভালো আছি। প্লিজ, আমাকে আমার মত থাকতে দেও, আর কোনো ঝামেলা করো না।”
তার প্রতিটি শব্দ যেন ছুরির মতো বিঁধছিল ওয়াজফানের বুকের ভেতর।
মুহূর্তে তার হাতে ধরা তরোয়ালটা ধুপ করে মেঝেতে পড়ে গেল।
সে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল ইসাবেলার মুখের দিকে—একসময় যে মুখে শুধু ভরসা আর শান্তি ছিল, আজ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক সাহসী, অবাধ্য নারী।
এ কি সত্যিই সেই ইসাবেলা, যে তার দাভাইর ছায়া ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারত না?
একটা নেকড়ে ছেলের জন্য সে আজ তার ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে এমন নির্মম কথা বলতে পারছে!
ওয়াজফান ধীরে ধীরে দু’পা পিছিয়ে গেল। চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা, মুখে পাথরের মতো শক্ত অভিব্যক্তি।
তারপর গম্ভীর, অথচ গভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করল—
“আজ থেকে আমার ইসাবেলা নামে কোনো বোন নেই। যাকে আমি চিনতাম, সে আজ আমার জন্য মৃত। এখন থেকে তার সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই।”
আর কোনো কথা না বলে, সে পিঠ ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেল রাজপ্রাসাদ থেকে।
পেছনে রইল নীরব এক রাজদরবার, আর ইসাবেলার বুকের ভেতরে ঝড়।
কথাগুলো শুনে ইসাবেলার চোখে ঝাপসা জল এসে ভরে গেল। বুকের ভেতরটা হঠাৎ করেই যেন ভারী হয়ে উঠল।
সে ধীরে ধীরে পিছিয়ে নিজের কক্ষে গিয়ে ধুপ করে মাটিতে বসে পড়লো।
চোখের কোণ বেয়ে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল মেঝেতে।
দৃষ্টি শূন্যে স্থির, অথচ মনে যেন বারবার ফিরে আসছে কয়েক ঘণ্টা আগের ঘটনা।
আজ, ওয়াজফান যখন নিকারো রাজ্যে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি পাঠিয়েছিল, ক্যালিয়ন নিজে এসেছিল ইসাবেলার কাছে।
তার মুখে ছিল অদ্ভুত শান্ত হাসি, কিন্তু চোখে লুকানো এক হিসাবি ধার।
সে নরম কণ্ঠে বলেছিল—
“তোমার ভাই আসছে তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ভেবে দেখো, তার সাথে গেলে হয়তো আবার তার রাজ্যে ফিরে যাবে, কিন্তু সেখানে গিয়ে তুমি কি তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে ফিরে পাবে? না, কখনোই না।
এখন বলো—তুমি কি করবে? যদি ফিরতে চাও, আমি নিজে তোমাকে তোমার ভাইয়ের হাতে তুলে দেব।”
ইসাবেলার চোখে তখন স্পষ্টতা ছিল, উত্তরও ছোট—
“আমি ড্যানিয়েলকে ছেড়ে কোথাও যাব না। তবে… দা ভাইকে কিভাবে আটকাবো, তা জানি না।”
ক্যালিয়নের ঠোঁটে শীতল এক হাসি ফুটে উঠল।
“তোমার ভাইকে আমি খুব ভালো করেই চিনি, ইসাবেলা। সে কাউকে তোয়াক্কা করে না। হাজারো বাধা পেরিয়ে, লাশের পাহাড় গড়ে হলেও সে তোমাকে নিয়ে যাবে।
কিন্তু তাকে আটকানোর উপায় আছে—মাত্র একটি উপায়।”
ইসাবেলা নিঃশব্দে জবাব দিল, “বলুন।”
ক্যালিয়নের কণ্ঠে এবার দৃঢ়তা—
“এখনই, এই মুহূর্তে, তুমি ড্যানিয়েলের সাথে বিয়ে করে নাও। নেকড়েদের নিয়ম অনুযায়ী একবার যদি বিয়ে হয়, তোমার ভাই চাইলেও তোমাকে আলাদা করতে পারবে না। কারণ তখন ড্যানিয়েল তোমার স্বামী হবে, আর তোমাদের বিচ্ছিন্ন করা তার পক্ষেও অসম্ভব।”
দ্বিধা না করে, ইসাবেলা সম্মতি দিল।
এরপর, নেকড়েদের প্রাচীন চুক্তি ও রীতি মেনে, সেই মুহূর্তেই তাদের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়।
ড্যানিয়েলের চোখে তখন আনন্দের দীপ্তি, আর ইসাবেলার মনে ছিল এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি—ভালোবাসা, ভয়, আর অনিশ্চয়তা।
ইসাবেলা ধীরে ধীরে কল্পনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এল।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস তার ঠোঁট ছুঁয়ে বেরিয়ে এল, যেন বুকের ভেতরের চাপা ব্যথা একটু হলেও বাইরে আসতে চাচ্ছে।
চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু ফোঁটাগুলো আর থামতে পারল না—
গাল বেয়ে একের পর এক নেমে এলো, উষ্ণতা মিশিয়ে রেখে গেল ত্বকের উপর।
রুমটা ছিল অর্ধেক আঁধারে ঢাকা, জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা আলোতে শুধু তার মুখের লবণাক্ত আভা ধরা পড়ছিল।
নিঃশব্দ ঘরে অশ্রু পড়ার মৃদু শব্দ যেন আরও গভীর করে তুলছিল সেই নিরবতা।
ঠিক সেই সময়—
দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল।
নিঃশব্দ পায়ের শব্দে ভেতরে প্রবেশ করল ড্যানিয়েল।
ইসাবেলা তাকে দেখে চমকে উঠল।
তাড়াহুড়ো করে চোখের পানি মুছে ফেলতে চাইল, যেন নিজের ভাঙা মনটাকে আড়াল করতে পারে।
কিন্তু ব্যর্থ হলো—
অশ্রু মুছলেও সেই লালচে চোখের দৃষ্টি তার ভেতরের কষ্ট ফাঁস করে দিল।
ড্যানিয়েল কিছু না বলে এগিয়ে এল।
তার মুখে কোনো বিস্ময় নেই, শুধু এক অদ্ভুত শান্তি আর গভীর মমতার ছাপ।
সে একেবারে কাছে এসে ইসাবেলার মুখের দিকে তাকাল—
দৃষ্টিতে যেন হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই।
ধীরে ধীরে সে হাত তুলল।
আঙুলের ডগায় আলতো করে ছুঁয়ে নিল ইসাবেলার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া সেই অশ্রু ফোঁটা।
যেন প্রতিটা ফোঁটার সঙ্গে মিশে থাকা কষ্টটুকুও নিজের ভেতরে টেনে নিচ্ছে।
দু’জনের মাঝে এক মুহূর্তের জন্য কোনো শব্দ নেই।
শুধু চোখের ভাষা, নীরবতার ভেতর লুকানো অনুভূতি, আর সেই ছোঁয়ার উষ্ণতা—
যা ইসাবেলার বুকের গভীরে অদ্ভুত এক ঝড় তুলে দিল। তারপর বলে,
তোমার দাভাই তোমাকে রেখে চলে গিয়েছে তো কি হয়েছে, আমি তো তোমার পাসে আছি।
একটা কথা সারা জীবন মনে রাখবে—আমি তোমার পাসে ছিলাম, আছি আর সারা জীবন থাকবো।
তুমি যেখানেই যাও না কেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে পড় না কেন, আমি তোমার সাথ কখনো ছাড়বো না।
আর হ্যাঁ, সেই ভালবাসার আমার দরকার নেই, যে ভালোবাসা মানুষটার চোখে আমার জন্য পানি আসবে, আমার জন্য কষ্ট পাবে।
যদি ভালোবাসা তোমাকে ভালোভাবে থাকতেই না দেয়, তাহলে আমার কাছে এর কোন মূল্য নেই।
আমি বলব, তুমি সেখানেই যাও যেখানে গেলে তুমি পুরোপুরি খুশি থাকবে।
কারণ তোমার চোখের পানি আমার সোহেল বাইরে। আমি সইতে পারি না তোমার কষ্ট।
ইসাবেলা মুখে মিষ্টি হাসি এনে বলে,
আমি আমার ভালোবাসার মানুষটার কাছেই আছি আর তার কাছে সারা জীবন সুখে থাকবো।
কথাটা বলে ইসাবেলা ড্যানিয়েলকে জড়িয়ে ধরে।
ড্যানিয়েল ইসাবেলাকে তার বুক থেকে উঠিয়ে দু’হাত দিয়ে তার গাল চেপে ধরে, ঠোঁটে লাগা মিষ্টি হাসিটা যেন উপভোগ করতে চাইছে।
সে তাই তার ঠোঁটে সমস্ত কষ্ট মুছে দেবে আজ।
ধীরে ধীরে ইসাবেলার ঠোঁটে চুমু খেতে নেয় ড্যানিয়েল।
ইসাবেলা লজ্জায় নিজের চোখ বন্ধ করে নেয়।
কিন্তু হঠাৎ ড্যানিয়েল থেমে যায়—
তার কিছু একটা মনে পড়ে যায়, তাই সেই ঝামেলাকে ছেড়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়।
ইসাবেলা এবার ধীরে ধীরে চোখ খুলে জিজ্ঞাসা ভান করে তাকায় ড্যানিয়েলের দিকে।
ড্যানিয়েল বলে,
আমার একটা জরুরী কাজ মনে পড়ে গেছে, আমাকে এখনই যেতে হবে।
কথাটা বলেই দ্রুত পদক্ষেপে রুম থেকে বের হয়ে যায় ড্যানিয়েল।
রুম থেকে বেরিয়ে ড্যানিয়েল দ্রুত পদক্ষেপে করিডোর পেরিয়ে সোজা চলে আসে ক্যালিয়নের কক্ষে।
ক্যালিয়ন যেন আজ উচ্ছ্বাসে ভরপুর—তার মুখে বিরল এক আনন্দের ঝলক, চোখে বিজয়ের আলো।
ড্যানিয়েল প্রবেশ করতেই ক্যালিয়ন উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে আসে।
এক মুহূর্তও দেরি না করে সে ড্যানিয়েলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
তার পিঠে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ওঠে—
“বাহ… সাহসিকতার জন্য তোকে অভিনন্দন, ড্যানিয়েল! তুই তোর লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়েছিস।
আমি জানতাম… এই কাজটা শুধু তুই-ই পারবি, আর তুই প্রমাণ করে দেখিয়েছিস।”
ক্যালিয়নের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি, যেন বহুদিনের পরিকল্পনার শেষ বাঁধা পেরিয়ে এসেছে সে।
তার চোখে ধূর্ত উজ্জ্বলতা, কণ্ঠে চাপা বিজয়ের সুর।
সে আরও ঝুঁকে এসে ধীরে, কিন্তু স্পষ্টভাবে বলে—
“এখন শুধু আমার আর একটা কাজ করে দে… তাহলেই সব শেষ হবে।
তুই যা করেছিস, সত্যিই ভালো করেছিস… কিন্তু এখন আরেকটা কর—
শুধু ইসাবেলাকে প্রেগনেন্ট করে দে, তারপর ওকে তার ভাইয়ের কাছে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আয়।”
কথাগুলো বলার পর ক্যালিয়নের মুখে এক অদ্ভুত নিষ্ঠুর হাসি ফুটে ওঠে,
যেন তার বিজয়ের মুকুটে শেষ রত্ন জুড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
ক্যালিয়নের মুখে তখনো সেই নিষ্ঠুর, তৃপ্তির হাসি লেগে আছে।
কিন্তু তার কথাগুলো ড্যানিয়েলের কানে পৌঁছাতেই যেন ভিতরে কিছু ভেঙে পড়ে।
হৃদয়ের গভীরে কোথাও ভারি পাথর চাপা পড়ে,
এক অদৃশ্য কষ্টের ঢেউ গলার কাছে এসে থমকে যায়।
এক মুহূর্ত নীরব থাকার পর, ড্যানিয়েলের চোখের দৃষ্টি কঠিন হয়ে ওঠে।
তার কণ্ঠে শোনা যায় দৃঢ়তার সুর—
“দুঃখিত… লর্ড ক্যালিয়ন, আমি আপনার এই আদেশ মান্য করতে পারবো না।
মাফ করবেন আমায়।
আমি… ইসাবেলাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
আর আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট পৌঁছে এমন কিছু কখনোই করতে পারবো না।”
শব্দগুলো ধীরে উচ্চারিত হলেও, তাতে ছিল অটল সংকল্পের ওজন।
ড্যানিয়েলের চোখে তখন ছিল এক অদম্য দীপ্তি—
যেন কোনো ঝড়, কোনো ষড়যন্ত্রই সেই ভালোবাসার দেয়াল ভেদ করতে পারবে না।
ক্যালিয়নের মুখের হাসি আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে শুরু করে,
আর বাতাসে ভেসে ওঠে এক অদ্ভুত নীরবতা…
ঘরজুড়ে নীরবতা, যেন প্রতিটি দেওয়াল কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যালিয়ন চেয়ার থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে রাগের আগুন, অথচ সেই আগুনের ভেতরে চাপা কোনো অস্থিরতা।
সে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল—
“কি বলছিস তুই, ড্যানিয়েল? এসব পাগলামি শোনাচ্ছিস কেন? তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস নাকি?”
শব্দগুলো ঘরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে, কিন্তু ড্যানিয়েল একটুও বিচলিত হয় না। সে দৃঢ় পদক্ষেপে ক্যালিয়নের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার ঠোঁটে তীক্ষ্ণ প্রতিউত্তরের আভাস নেই, কেবল এক শান্ত অথচ অটল সুর—
“হ্যাঁ… আমি পাগল হয়েছি।
ইসাবেলার ভালোবাসায় পাগল হয়েছি।
যেমন আপনি হয়েছিলেন অর্ষা ম্যাডামের ভালোবাসায়… তাই না, লর্ড ক্যালিয়ন?”
ক্যালিয়নের চোখে এক মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ের ছায়া নেমে আসে। যেন ড্যানিয়েলের এই সরাসরি আঘাত তার বুকের ভেতরে চাপা থাকা পুরনো ক্ষতটাকে টেনে বের করে এনেছে।
ড্যানিয়েল আবারও বলল, এবার তার কণ্ঠে এক ধরনের কোমল অথচ তীক্ষ্ণ সত্যের ধ্বনি—
“আপনি তো এখনো অর্ষা ম্যাডামকে ভালোবাসেন।
তাই আশা করি, আপনি বুঝবেন—
ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট পেতে দেখা ঠিক কেমন যন্ত্রণা দেয়।
আর নিজের হাতে তাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার যন্ত্রণা… সেই অনুভূতিটা আপনার অচেনা নয়।
তাই… দয়া করে… আমাকে আমার ভালোবাসার সাথে থাকতে দিন।
আমি তাকে আঘাত করব না, তার চোখে অশ্রু দেখতে চাই না।”
ঘরের বাতাস যেন হঠাৎ ভারী হয়ে যায়। বাইরে হাওয়ার শব্দও কেমন থেমে গেছে।
ক্যালিয়ন দাঁড়িয়ে থাকে, তার বুকের ভেতরে চলতে থাকে এক অদৃশ্য লড়াই—
রাগ আর বেদনার, কর্তৃত্ব আর সহানুভূতির।
তার দৃষ্টি ড্যানিয়েলের মুখে স্থির হয়।
সে দেখতে পায়, ওর চোখে কোনো ভয় নেই, কোনো দ্বিধা নেই—
শুধু আছে সত্যিকারের ভালোবাসার দৃঢ়তা।
একসময় ক্যালিয়নের ঠোঁট নড়ল, কিন্তু শব্দ বেরোল না।
সে জানে, ড্যানিয়েল যা বলছে, তার প্রতিটা কথায় অস্বীকার করার উপায় নেই।
হয়তো তার নিজের অতীতই আজ তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।
ড্যানিয়েল ধীরে ধীরে পেছন ঘুরল।
তার পদক্ষেপের শব্দ নীরব ঘরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
দরজার কাছে এসে এক মুহূর্ত থামল, কিন্তু ফিরে তাকাল না।
দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল,
আর তার সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ক্যালিয়নের কর্তৃত্বের কঠিন মুখোশও।
ক্যালিয়ন একা দাঁড়িয়ে রইল।
তার চোখের গভীরে দোটানার ছায়া আর মনখারাপের ভার মিশে আছে।
মনে পড়ছে অর্ষার মুখ, সেই অসমাপ্ত গল্প…
হয়তো ড্যানিয়েলের জন্য ইসাবেলাও সেই গল্পের মতো অসমাপ্ত হয়ে যাবে,
কিন্তু এবার সে কি সেই ভুলটা হতে দেবে?
কোনো উত্তর নেই।
শুধু নিস্তব্ধতা আর এক অদৃশ্য দ্বন্দ্ব ক্যালিয়নের বুকের ভেতর চেপে বসে আছে।
অর্ষা নিজের কক্ষে নিঃশব্দে বসে ছিল।
দরজার বাইরে হাওয়া ধীরে ধীরে বইছে, কিন্তু ভেতরে যেন নিস্তব্ধতার ভার জমে আছে।
তার চোখ জানালার বাইরে, অথচ মন কোথাও নেই—
সম্ভবত দিনভর ঘটে যাওয়া অস্থির ঘটনাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভেতর।
হঠাৎ, অজান্তেই তার কাঁধে এসে থামে এক জোড়া ঠান্ডা হাত।
শিরদাঁড়া বেয়ে কেঁপে ওঠে তার পুরো শরীর।
এই ছোঁয়া… চেনা, খুবই চেনা।
এমন স্পর্শে কথা বলার প্রয়োজন নেই—
কারণ এই ছোঁয়া একটাই মানুষের,
যে মানুষটা তার জীবনের সব ঝড়ের মাঝেও দাঁড়িয়ে থাকে তার পাশে।
অর্ষা কিছু বলে না।
শুধু স্থির হয়ে বসে থাকে, চোখের পাতা ধীরে নেমে আসে,
মনে হয় বুকের ভেতরের সব অস্থিরতা মিলিয়ে যাচ্ছে।
ওয়াজফানও কোনো কথা বলে না।
শুধু তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে—
তার বুকে যেন নিজের সমস্ত ক্লান্তি নামিয়ে রাখছে।
ওয়াজফান নিঃশব্দে বসে আছে।
তার বাহুতে জড়িয়ে ধরা অর্ষার ছোট্ট শরীর যেন তাকে ধরে রাখে, অথচ নিজেই যেন সবকিছুর ভার বোঝে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যেন সেই শ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছে তার ভেতরের একরাশ কষ্ট, এক মিলিয়ন অজানা অনুভূতি।
অর্ষা তার নিঃশব্দতার কারণ বুঝতে পারে, চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে—
“হুমম… আজ আমার খারুসমান টার কি হলো?
সাধারণত তো তার মুখে সব সময় রাগ ঝুলে থাকে।
আজ কেন এতটা শান্ত, এতটা চুপচাপ?”
ওয়াজফানের কণ্ঠে এক নরম, নিম্ম সুরে শব্দ ঝরে—
“আজ কাছ থেকে… আমার সবচেয়ে প্রিয়, আমার আদরের ছোট বোনটা হারিয়ে ফেললাম।”
অর্ষা কিছু বলে না।
শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যেন নিজের বুকের সঙ্গে তার দুঃখ মিলিয়ে নিচ্ছে।
কিছুক্ষণের নীরবতার পর, অর্ষা সাবধানে জিজ্ঞেস করে—
“ইসাবেলা… কি হয়েছে? ও কি আপনার সাথে ফিরে আসতে চাইনি?”
ওয়াজফান ধীরে ধীরে সব খুলে বলতে শুরু করে।
তার কণ্ঠে মিশে আছে দুঃখ, ব্যথা, এবং নিঃশব্দের একরাশ শূন্যতা।
অর্ষা নিশ্চুপ বসে থাকে।
শোনে, বোঝে, অনুভব করে—
ইসাবেলার দিকের অবস্থা, এবং ওয়াজফানের মনের গভীর কষ্ট।
কিন্তু কিছু করার নেই।
শুধু নীরবতার মধ্যে তাদের মধ্যে বিরামহীন অনুভূতির স্রোত বইতে থাকে।
অর্ষা এবার ওয়াজফানের মন ভালো করার চেষ্টা করল।
সে পেছনে ঘুরে তার দিকে তাকাল, মিষ্টি এক হাসি ফুটিয়ে বলল,
Death or Alive part 28
“চিন্তা করবেন না, আল্লাহ আবারো সব ঠিক করে দেবে, আগের মতো।”
এরপর অর্ষা আলতো করে ওয়াজফানের ঠোঁট স্পর্শ করল।
শুধুই একটি মুহূর্ত, কিন্তু যেখানে ভালোবাসা, আর দুজনের গভীর নিঃশ্বাস একসাথে মিশে গেল।
 
