Death or Alive part 30
priyanka hawlader
কয়েকটা দিন কেটে গেছে।
কিন্তু সময়ের প্রবাহ যেন থেমে গেছে জ্যাইমের কাছে।
সূর্য উঠেছে, অস্ত গেছে, রাত্রি এসেছে আবার ভোর হয়েছে—
তবু সেই সময়ের কোনো স্রোত তার জীবনের ভেতর ঢুকতে পারেনি।
সে এখন নিজেকে বন্দী করে রেখেছে এক অন্ধকার কক্ষে।
কক্ষটির ভারী দরজা বাইরে থেকে বন্ধ নয়,
তবুও যেন কারো পক্ষে ভেতরে প্রবেশ করা অসম্ভব।
কারণ, ভেতরের অন্ধকারই সমস্ত কিছু গ্রাস করে নিয়েছে।
জানালার পর্দাগুলো সবসময় টানা,
আলো প্রবেশের সাহস পায় না সেই ঘরে।
দিন-রাতের কোনো পার্থক্য নেই সেখানে,
শুধু একটানা নিস্তব্ধতা আর অন্ধকারের দমবন্ধ পরিবেশ।
জ্যাইমের চারপাশে কেউ নেই,
তবুও সে যেন হাজার মানুষের ভিড়ের ভেতরে একা।
একসময়ের প্রাণবন্ত, জিনটা আজ নিস্তব্ধতার মাঝে ভেঙে পড়েছে।
এলিনার মৃত্যুর সেই নির্মম ছায়া তার ভেতর থেকে সমস্ত আলো কেড়ে নিয়েছে।
যার মৃত্যু তার পৃথিবীকে শূন্য করে দিয়েছে, সেই স্মৃতিই এখন তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরছে।
কোনো হাসি, কোনো সুর, কোনো জীবনের রঙ তার কাছে পৌঁছায় না।
সে কথা বলে না কারো সঙ্গে, বের হয় না বাইরে।
নিজেই নিজেকে আবদ্ধ করেছে এই অন্ধকার কারাগারে।
কখনো দেয়ালের কোণে চুপচাপ বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা,
কখনো চোখ তুলে তাকায় শূন্যতায়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
যেন সেখানে কারো মুখ ভেসে উঠবে,
যে আর কখনো ফিরবে না।
তার চোখে শুধু জমে আছে না বলা যন্ত্রণা,
দমিয়ে রাখা আর্তনাদ,
এক অজানা শূন্যতার ভার।
সে যেন নিজের ভেতর গড়ে তুলেছে আরেকটা জগৎ—
যেখানে নেই কোনো হাতছানি, নেই কোনো আলোর দিশা।
আছে কেবল অন্ধকারের বন্দীত্ব,
যা ধীরে ধীরে তাকে নিজের গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
আর আছে একরাশ যন্ত্রণা—
যা প্রতিটি শ্বাসের সাথে তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে।
এলিনা জানত, তার জীবনের সূর্য অস্তমিত হতে চলেছে।
শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে সে রেখে গিয়েছিল একখানা চিঠি—
একটি চিঠি, যেখানে লুকিয়ে আছে তার মৃত্যুর আসল কারণ,
তার হৃদয়ের না বলা বেদনা,
আর সেই মানুষটার উদ্দেশ্যে শেষ আর্তি—
জ্যাইম।
কিন্তু মৃত্যুর মুহূর্তে,
যখন তার নিথর দেহটা পড়ে রইল সবার সামনে,
শোকে ভেঙে পড়েছিল পুরো পরিবার,
চোখের জলে ভিজেছিল চারদিক।
তখন তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা ছিল সেই চিঠি।
কেউ খেয়াল করেনি—
কেউই না।
শুধু মালালা।
সবার অগোচরে, নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে
সে চিঠিটাকে আলগোছে বের করে নেয়,
নিজের কাছে লুকিয়ে রাখে।
কাগজটা যেন এক গোপন সত্যের ভার বহন করছিল,
যা তখনই সবার সামনে প্রকাশ পেলে
হয়তো পৃথিবী ভেঙে পড়ত।
দিন গড়ায়, সময় বয়ে যায়।
অবশেষে কাল—
মালালা সেই লুকানো চিঠিটা জ্যাইমের কাছে পৌঁছে দেয়।
নিঃশব্দ কণ্ঠে জানায়—
“এলিনা এই চিঠিটা তোমার জন্যই রেখে গিয়েছিল।”
আর আজ সেই চিঠি হাতে নিয়ে
জ্যাইম বসে আছে নিজের অন্ধকার রুমে, একাকী।
চোখেমুখে গভীর যন্ত্রণার ছাপ,
মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় ছায়াগুলো আরও ভারী হয়ে উঠছে।
চিঠিটা তার কাঁপা হাতে ধরা,
মনে হচ্ছে কাগজ নয়,
বরং এলিনার শেষ নিঃশ্বাস, শেষ আর্তনাদ, শেষ ভালোবাসার ছোঁয়া।
তার বুক ধুকপুক করছে অস্বাভাবিকভাবে।
সে জানে—
এই চিঠি খুললেই
তার সামনে উন্মোচিত হবে এক ভয়ঙ্কর সত্য,
যা হয়তো সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।
তবুও, অন্ধকারের নীরবতায়,
সে বসে আছে স্থির হয়ে—
চোখে জমে থাকা অশ্রু,
হাতে ধরা এলিনার শেষ উত্তরাধিকার।
জ্যাইম কিছুক্ষণ নিস্তব্ধে বসে থেকে চিঠিটা হাতে ধরে তারপর ধীরে ধীরে চিঠিটা পড়তে শুরু করে,
চিঠি
জ্যাইম,
যখন তুই এই চিঠিটা পড়বি, আমি তখন আর এই পৃথিবীতে থাকব না।
তবু লিখে যাচ্ছি শুধু তোর জন্য— যেন তুই নিজেকে অপরাধী না ভাবিস।
জ্যাইম, আমি তোর ভাইকে অশেষ ভালোবেসেছিলাম। তাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি বারবার, কিন্তু পারিনি। যতই নিজেকে সামলাতে চেয়েছি, প্রতিবারই হেরে গেছি নিজের কাছে। তাই আজ এই চরম সিদ্ধান্ত নিতে হলো। দয়া করে তুই আমাকে মাফ করে দিস।
কাল রাতের ঘটনাটা আমি এখনো পরিষ্কার মনে করতে পারি। সেখানে যা ঘটেছিল তার জন্য একটুও দোষ তোর নয়। সব দোষ আমার, শুধু আমার। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। তাই কখনোই ভাবিস না, আমি তোর কারণে জীবনটা শেষ করলাম। আসলে আমি নিজের কাছেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না।
আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস— নিঃশর্তে, নিঃশেষে। কিন্তু আমি তোকে কখনোই ভালোবাসিনি, ভালোবাসতেও পারিনি। কারণ আমার ভালোবাসা তো বহু আগেই অন্য কারো হাতে সমর্পণ করে ফেলেছিলাম— তোর ভাইয়ের হাতে। আর তাই তো, যতই চেষ্টা করি, তোর জন্য সেই অনুভূতিটুকু জন্ম নেয়নি।
জ্যাইম, তুই যেমন আমাকে ভালোবেসে পেলি না, আমিও তোর ভাইকে ভালোবেসে তাকে পাইনি। কারণ সে ভালোবাসত অন্য কাউকে— অর্ষাকে। আর অর্ষা-ও ভালোবাসে তাকে।
দেখ, ভালোবাসা কখনো কতটা নির্মম হতে পারে—
চারটি হৃদয়, অথচ মিলন হলো মাত্র দুটি। বাকি দুটি রয়ে গেল ভাঙা, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে।
আমার ভালোবাসা ছিল একতরফা, তাই তার মৃত্যু ঘটল— আমার নিজের হাতেই।
তোর ভালোবাসা-ও ছিল একতরফা, তাই তুই বেঁচে আছিস, যন্ত্রণায় পুড়ে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে ধুঁকে।
পারলে আমাদের ফটোটা ফেলে দিতে ভুল করিস না। কারণ স্মৃতির সাথে বেঁচে থাকাটা মৃত্যুর চেয়েও কষ্টকর— এটা আমি আমার জীবনের বিনিময়ে শিখে গেলাম।
একতরফা ভালোবাসা হলো এক নীরব আগুন— যা কাউকে ভস্ম করে দেয় ভেতর থেকে, অথচ তার ধোঁয়াও কারো চোখে পড়ে না। ভালোবাসা একসময় যে আলো দেখিয়েছিলো, সেই আলোই শেষে অন্ধকারে ঠেলে দেয়।
চিরদিনের জন্য,
এলিসা
চিঠির প্রতিটি অক্ষর যেন আগুনের মতো জ্যাইমের হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছিল।
শব্দগুলো পড়া মাত্রই তার চোখ ভিজে ওঠে, অশ্রু গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।
দু’চোখ ভাসিয়ে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
এক হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নিজের চুল,
অন্য হাতে এখনো চেপে রেখেছে এলিনার রেখে যাওয়া সেই শেষ চিঠি।
চোখের জল ভিজিয়ে দিচ্ছে কাগজটিকে,
যেন কাগজ নয়, এলিনার নিথর হাত—
শেষবারের মতো স্পর্শ করছে তাকে।
অসহনীয় বেদনা বুক চেপে ধরে।
কান্নার দমক দমাতে না পেরে একসময় তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে,
আর হঠাৎই আকাশভেদী চিৎকার ফেটে বেরিয়ে আসে তার বুক থেকে—
“এলিনা…! কেনো গেলে তুমি… কেনো আমায় ছেড়ে চলে গেলে এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে?
তুমি চলে গেলে, অথচ আমায় রেখে গেলে এই যন্ত্রণার মরুভূমিতে—
যেখানে প্রতিটি শ্বাস যেন বিষ, প্রতিটি দিন যেন মৃত্যুর শাস্তি।
তুমি কেনো এমন করলে আমার সাথে?
নিজে মুক্তি পেলে, কিন্তু আমায় শৃঙ্খলিত করে গেলে এক অন্তহীন কষ্টে।
তুমি না থাকলেও, তোমার রেখে যাওয়া এই স্মৃতি… এই যন্ত্রণা…
আমায় বাঁচতে দিচ্ছে না, মরতেও দিচ্ছে না।
আমি তো আটকে গিয়েছি মাঝপথে—
না বাঁচা, না মরা—
এক অসহ্য যন্ত্রণার গোলকধাঁধায়!”
তার চোখ লাল হয়ে ওঠে, গলায় হাহাকার জমে।
আরও উন্মত্ত হয়ে সে মাথা নাড়তে থাকে,
চুল মুঠো করে টেনে ধরে চিৎকার করে ওঠে—
“এলিনা…! যদি সত্যিই আমাকে শাস্তি দিতেই চাইতে,
তাহলে আমার জীবনটাই নিয়ে নিতে পারতে তোমার হাতে।
আমি হাসিমুখেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতাম।
কিন্তু এইভাবে প্রতিদিন আমাকে ভেতরে ভেতরে মেরে ফেলার যন্ত্রণা কেনো দিলে তুমি…?
বল তো, এ কেমন অভিশাপের মধ্যে ফেলে গেলে আমায় তুমি?”
তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয় অন্ধকার ঘরজুড়ে,
মোমবাতির আলো কেঁপে ওঠে,
আর জ্যাইম ভেঙে পড়ে নিজের যন্ত্রণার অগ্নিকুণ্ডে।
অসহ্য বেদনা তাকে গ্রাস করে,
সে আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে ওঠে—
মৃত্যুর মতো ভয়ঙ্কর,
ভালোবাসার মতো গভীর।
সেই দিনের ওয়াজফানের কঠোর ঘোষণার পর থেকে সমগ্র রাজ্যে কেউ আর ভুল করেও ইসাবেলা-র নাম উচ্চারণ করার সাহস পায়নি। তবে অর্ষা—তার মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা সেই প্রিয় বান্ধবীর স্মৃতি ভুলতে পারে না। বহুবার চেষ্টাও করেছে ওয়াজফানের কাছে ইসাবেলার পক্ষে কিছু কথা বলার। কিন্তু প্রতিবারই, নাম শুনলেই যেন দাউদাউ আগুনের শিখা লেলিহান হয়ে উঠত ওয়াজফানের চোখে।
ঠিক সেরকমই একদিন, অর্ষা সাহস করে বলেছিল—
ও তো কোনো খারাপ কিছু করেনি, শুধু নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। আপনিও তো একই কাজ করেছিলেন, তাই না? মানুষের সহ্য করতে না পাড়া সত্ত্বেও, আপনি আমায় বিয়ে করেছেন। তাহলে অর্ধেকটা হলেও ভেবে দেখুন, ইসাবেলা খুব খারাপ কিছু করেনি। চাইলে ইসাবেলা আর ড্যানিয়েলকে এ রাজ্যে রাখা যেতে পারে, তবে শর্ত হবে—তাদের আর শত্রু রাজ্যের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ থাকবে না। যদি সত্যিই ড্যানিয়েল ইসাবেলাকে ভালোবেসে থাকে, তাহলে সে সারাজীবন এ রাজ্যেই থেকে যাবে। দয়া করে বুঝতে চেষ্টা করুন, এভাবে আপনার বোনকে শাস্তি দেবেন না। ইসাবেলা অনেক মিষ্টি মেয়ে, হয়তো ভালোবাসার টানে ভুল করেছে, কিন্তু আপনাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। তাই কষ্ট না দিয়ে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করুন ওকে ওর ভালোবাসার মানুষটার সাথে।
অর্ষার প্রতিটি শব্দ যেন ধৈর্যের, বোঝানোর, আর মমতার সুরে মিশে ছিল।
কিন্তু ওয়াজফান মুহূর্তেই জ্বলে উঠল। তার চোখ লেলিহান আগুনের মতো দীপ্ত, কণ্ঠস্বর বজ্রের মতো গর্জন করে উঠল—
“আমি কতবার বলেছি, আমার সামনে কোনো নেকড়ে বউ নাম নেবে না! ভালোবাসা? ভালোবাসা মাই ফুট! যদি সত্যিই বোন হিসেবে আমার প্রতি ওর একটুও ভালোবাসা থাকতো, তাহলে নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে শত্রুর সঙ্গে হাত মেলাতো না। হ্যাঁ, একসময় ও ছিল আমার ছোট বোন… কিন্তু অনেক আগেই সে আমার কাছে মরে গেছে। আজ থেকে আমার সামনে তুমি আর কখনো ওর নাম উচ্চারণ করবে না। আমি শেষবারের মতো সতর্ক করছি তোমাকে, লিটল মনস্টার — ইসাবেলা আমার কেউ নয়, তাই আমি চাইনা তুমি আমার সামনে বারবার ওর নাম উচ্চারণ করে আমাকে রাগান্বিত করো!”
অর্ষা কেঁপে উঠেছিল, তবু ধীর কণ্ঠে বলেছিল—
“ওয়াজফান… রাগছেন কেন? আমি তো আপনাকে রাগানোর জন্য কিছু বলিনি।”
কিন্তু ওয়াজফান তার কথা শেষ হওয়ার আগেই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
সেই মুহূর্তে অর্ষা স্পষ্ট বুঝে গেল—ওয়াজফানের মনে ইসাবেলার নামের ওপরে এখন এক অটল পাহাড় জমে গেছে। এই পাহাড় আর কখনো ভাঙা সম্ভব নয়। তাই এরপর থেকে সে শপথ করল—রাজপ্রাসাদের ভেতর ওয়াজফানের সামনে আর কখনো উচ্চারণ করবে না সে ইসাবেলার নাম।
।
দিন যায়, রাত আসে, আবার ভোর নামে।
কিন্তু এই কয়েক দিনেও ইশবাবের চোখ একবারের জন্যও খোলেনি।
না কোনো শব্দ, না কোনো নড়াচড়া—
শীতল, নিথর দেহ পড়ে আছে সেই একই জায়গায়,
যেন সময় থেমে গেছে তার চারপাশে।
তার চারপাশে দিনগুলো ঘুরে ফিরে আসে,
সূর্য ওঠে, অস্ত যায়,
সবাই আসে , যায়,
কিন্তু ইশবাব—
সে যেন অন্য জগতে হারিয়ে গেছে,
যেখানে কারো হাতছানি পৌঁছায় না।
রাজ বৈদ প্রতিদিন নিঃশব্দে এসে তার শরীর পরীক্ষা করেন,
ঔষধ প্রয়োগ করেন, মন্ত্র পড়েন,
আশ্বাস দেন—
“হয়তো খুব শিগগিরই কোমা থেকে ফিরে আসবে তিনি।
আবার হয়তো… আর কোনোদিন ফিরবেন না।”
তার কণ্ঠের ভেতরে লুকিয়ে থাকে অজানা দ্বিধা,
এক অনিশ্চয়তা,
যা আশা আর ভয়ের মাঝখানে দুলতে থাকে।
কে জানে কোন দিকেই শেষমেশ হেলে পড়বে এই ভাগ্যের দাঁড়িপাল্লা?
তবে নিথর ইশবাব—
সে এখনো পড়ে আছে নিঃশ্বাসে টিকে থাকা এক জীবন নিয়ে,
এক নীরবতার গভীরে বন্দী।
বাইরে আলো ছড়ালেও, ভেতরে কেবল অন্ধকার ঘিরে থাকে।
সবার চোখে এক অদ্ভুত প্রতীক্ষা—
ফিরে আসবে কি না সে?
নাকি এভাবেই চিরতরে হারিয়ে যাবে অচেনা নিস্তব্ধতায়?
রাতের আকাশ যেন আজ অদ্ভুত রকমের দীপ্ত। তারার ঝলকানিতে যেন রাজ্যের প্রতিটি প্রাসাদ, প্রতিটি টাওয়ার ভেসে উঠছে অন্য এক অলৌকিক আভায়। আজ রাজ্যে বাইরে অন্য এক সভায় আয়োজিত হয়েছে এক রাজকীয় অনুষ্ঠান—যেখানে সমবেত হবে অসংখ্য জিন, প্রতিটি রাজ্যের মহামান্য অতিথিরা। সাধারণত ওয়াজফান তার কর্তব্য ও কাজের উদ্দেশ্যে যেখানেই যেতেন, একাই যেতেন। তার স্বভাবই ছিল নিঃসঙ্গ কিন্তু দুর্জয়।
কিন্তু আজকের রাত অন্য। তার মনে হয়েছে—তার লিটল মনস্টারকে সঙ্গে নেওয়া দরকার। হয়তো নিজের অদ্ভুত আসক্তি কিংবা গোপন আবেগই তাকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছে। তাই সে আগেভাগেই অর্ষাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন—“সুন্দর করে সাজবে, আজ তুমি আমার সঙ্গে যাবে।”
সময়ের পর্দা সরিয়ে যখন ওয়াজফান প্রবেশ করলেন নিজের কক্ষে, দৃশ্যটি তার চোখের সামনে এসে যেন তাকে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ করে দিল।
সেখানে বসে আছে তার লাড্ডু—কালো কর্নিশ সিল্কের গ্রাউন, যেটির গাঢ় আভা তার ফর্সা গায়ের রঙকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। গোল কালো চুল গুছিয়ে খোপা করে বাঁধা, খোপার ওপর শোভা পাচ্ছে ছোট্ট রূপালি তারার মুকুট। মুখে হালকা সাজ—চোখের কোণে মৃদু কাজল, ঠোঁটে শিশিরছোঁয়া আভা, আর পুরো চেহারায় এক সরল অথচ অমায়িক সৌন্দর্য।
সবচেয়ে বেশি যা ওয়াজফানের দৃষ্টি কেড়ে নিল—তা হলো তার সেই মিষ্টি হাসি। সরল অথচ কাঁপন ধরানো, যেন এই হাসিই ভেঙে দিতে পারে দানব সম্রাটের কঠোরতা।
ওয়াজফানের বুকের ভেতরে এক অস্থির ঝড় বয়ে গেল। মনে হলো—এই ছোট্ট লাড্ডুটাকে এখনই বুকে চেপে ধরে নিঃশেষে ভোগ করে নেয়। তার চোখ জ্বলজ্বল করছিল, তবু কঠিন চোয়াল চেপে নিজেকে শান্ত করল। না—আজ নয়।
অশান্ত মনকে স্থির করে তিনি এগিয়ে গেলেন, হাত বাড়ালেন অর্ষার দিকে। অর্ষা মাথা নিচু করে, তবে চোরা লজ্জার লাল আভা মুখে ফুটে উঠল।
“চলো, লিটল মনস্টার,” ওয়াজফানের কণ্ঠে বাজল সেই মিশ্রিত দৃঢ়তা আর মমতার সুর।
ওয়াজফান অর্ষা কে নিজের কোলে তুলে তারপর ডানা বের করে উঠতে শুরু করল।
তারপর, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে এসে পৌঁছালো তারা। রাতের আকাশের নিচে, রাজকীয় রথে পাশাপাশি বসল দু’জন। একদিকে দানবসম্রাটের গর্বিত কঠোরতা, অন্যদিকে ভীত-লজ্জায় আচ্ছন্ন অর্ষার কোমলতা।
সেই বিশাল আসরে উপস্থিত ছিল অগণিত মানুষ—
রাজকীয় অভিজাত, নানা প্রজাতির জিনেরা আর অদ্ভুত কিছু আশিক জিনের দলও।
ওয়াজফান সেদিন ভীষণ ব্যস্ত।
রাজকীয় অতিথিদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়,
একজনের পর একজনের সঙ্গে আলাপ,
কখনো আবার গম্ভীর আলোচনায় মগ্ন।
তবুও যত কাজই থাকুক, যত কথাই বলুক,
তার এক হাত যেন একেবারে শেকলের মতো শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিল অর্ষার হাত।
মুহূর্তের জন্যও তাকে নিজের পাশ থেকে আলাদা হতে দেয়নি।
অর্ষা ছিল তার ছায়ার মতো—
প্রতিটি পদক্ষেপে সাথে নিয়ে ঘুরছে,
যেন ভিড়ের মাঝেও তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় কাজ করছে ওয়াজফানের ভেতরে।
এই ব্যস্ততা, এই কোলাহলের মাঝেই—
কেউ একজন ওদের দিকে বহুক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিল।
সে ছিল আশিক জিনদের মধ্যকার এক জীন।
তার চোখের দৃষ্টি বারবার গিয়ে থেমেছিল অর্ষার ওপর। যেনো প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছে সে অর্ষা কে।
অবশেষে সাহস সঞ্চয় করে সে এগিয়ে এলো।
ওয়াজফানের সামনে এসে দাঁড়ালো সে,
চোখে কৃত্রিম ভদ্রতার আভাস,
হাতে এক অস্বাভাবিক ভঙ্গি।
সোজা অর্ষার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে
মিষ্টি হাসি ফোটাল ঠোঁটে—
যেন সৌজন্যের নামে স্পর্শ চাইছে।
কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই দৃশ্য পাল্টে গেল।
ওয়াজফান ঝড়ের বেগে জীনটির হাত চেপে ধরল একটা জোরে মোচড় দিয়ে ,
চোয়াল শক্ত করে, চোখ জ্বলজ্বল করছে আগুনের শিখার মতো।
ঠাণ্ডা অথচ রক্তহীম করা স্বরে বলল—
“ওর দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করবে তো সেই হাত আমি কেটে রেখে দেব আমি। যদি ওর দিকে ভুল করেও চোখ তুলে তাকাস তাহলে আমি শুধু তোর চোখ নয় তোর পুরো জীবনটাকেই কেড়ে নিবো।
তার কণ্ঠের কঠোরতা চারপাশের কোলাহল মুহূর্তেই স্তব্ধ করে দিল।
বাতাস যেন জমে গেল এক শীতল হুমকির ভারে।
অর্ষা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল,
আর আশিক জিনটি আতঙ্কে গিলে নিলো তার অহংকার।
এরপর ওয়াজফান ছেলেটার হাতটা ছিটকে ফেলে দিয়ে বলে,
আমার কথাটা যেনো মাথায় থাকে।
জীনটাও ওখান থেকে সরে যায়। আর ওয়াজফান আবার আগের মত নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ভিড়ের কোলাহল আর রাজসিক আলো ঝলমল পরিবেশের মাঝে অর্ষা হঠাৎই ওয়াজফানের জামার হাতা আলতো করে টেনে ধরল।
ওয়াজফান কিছুটা বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকায় তারপর ওয়াজফান কিছুটা নিচু হতেই অর্ষা তার কানের কাছে মুখ এনে আস্তে ফিসফিস করে বলল,
“আমি… ওয়াশরুমে যেতে চাই।”
ওয়াজফানের চোখে সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বশীলতার ছাপ ফুটে উঠল।
তার কণ্ঠে দৃঢ়তা মিশিয়ে বলল—
“ঠিক আছে, চলো। আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।”
কিন্তু অর্ষা মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে তার হাতটা ছাড়াতে লাগল।
তার চোখে একধরনের অস্বস্তি, ঠোঁটে চাপা এক হাসি।
মৃদু স্বরে বলল—
“না… আপনার যাওয়ার দরকার নেই। আপনি এখানে থাকুন, আপনার কাজ করুন। আমি একাই চলে যেতে পারবো।”
শব্দগুলো এত নিঃশব্দে উচ্চারিত হলো যে শুধু ওয়াজফানই শুনতে পেল।
কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা সঙ্কোচের আবেশে কথা শেষ করেই
অর্ষা হাত ছেড়ে পিছিয়ে গেল।
এক মুহূর্তের জন্য ওয়াজফানের চোখে ঝিলিক খেল—
সে যেন অর্ষাকে যেতে দিতে চায় না।
তার বুকের ভেতর অজানা এক অস্থিরতা কাজ করল,
কিন্তু পরিস্থিতির চাপে সে কিছু বলল না।
শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অর্ষার পিঠের দিকে,
যখন সে ভিড় ঠেলে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছিল।
অর্ষা একা হেঁটে যাচ্ছিল ওয়াশরুমের পথে,
কিন্তু তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন টের পাচ্ছিল
পেছনে থেকে ওয়াজফানের সেই জ্বলন্ত দৃষ্টির ভার।
ওয়াশরুম থেকে ফেরার পথে অর্ষা যখন নিঃশব্দে করিডোর পেরিয়ে আসছিল, হঠাৎই তার সামনে এসে দাঁড়াল সেই আশিক জিন ছেলেটি।
যে প্রথম অর্ষাকে চোখে পড়তেই নিজের মনে তাকে আঁকড়ে ধরেছিল, কিন্তু ওয়াজফান সবসময় পাশে থাকায় কখনো কথা বলার সুযোগ পায়নি। অবশেষে, ওয়াজফান না থাকায় সেই সুযোগটা এসে গেছে।
জিনটির ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি ফুটল।
চোখে ঝলকানো দুষ্টু উজ্জ্বলতা নিয়ে সে অর্ষার পথ আটকে নরম গলায় বলল—
“হ্যাই, কেমন আছেন আপনি?”
অর্ষা প্রথমে কিছুটা সঙ্কোচে পড়ল।
তার চোখে এক মুহূর্তের দ্বিধা খেলে গেল।
তবুও ভদ্রতা বজায় রেখে মিষ্টি এক হাসি এনে বলল—
“এইতো… ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
জিনটা গম্ভীর ভান করে মাথা নাড়ল, ঠোঁটের কোণে আরও চওড়া হাসি ফুটিয়ে বলল—
“ভালো আছি। আচ্ছা, আপনার মতো এত সুন্দর একটা মেয়ের নামটা কি জানতে পারি?”
অর্ষা এবার হালকা অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।
কিছুটা লজ্জা, কিছুটা অস্বস্তি মিশিয়ে ধীরে উত্তর দিল—
“আমার নাম অর্ষা সরদার।”
জিনটির চোখ যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
চওড়া হাসি দিয়ে বলল—
“Oh, nice! This is a beautiful name…”
অর্ষা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
কোনো জবাব দিল না।
শুধু ঠোঁটের কোণে হালকা, ভদ্র এক মৃদু হাসি ফুটিয়ে রাখল।
কিন্তু তার ভেতরে কোথাও যেন অজানা এক অস্বস্তির ছায়া নেমে এলো।
ওয়াজফানের শক্ত হাতটা ছেড়ে একা আসার সিদ্ধান্তটা হঠাৎই তাকে ভুল মনে হতে লাগল। তবুও নিজেকে ঘাবরাতে না দিয়ে মুখে টেনে রাখল মিষ্টি হাসি রেখা
মুহূর্তেই অর্ষার ঠোঁটের মিষ্টি হাসি জমে গেল ভয়ে।
তার কাপড়ে ছিটকে লাগল রক্তের গাঢ় ফোঁটা।
সামনে দাঁড়ানো সেই জিন ছেলেটি হঠাৎই ছিটকে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।
অর্ষা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল, শরীর কাঁপতে শুরু করল তার।
ধীরে ধীরে চোখ তুলতেই সে দেখল—
তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াজফান।
দৃষ্টিতে অগ্নিশিখার মতো দাউ দাউ জ্বালা, চোখ দুটো সোনালী বর্ণে দীপ্তিমান, মুখে ছড়িয়ে আছে রক্তের ছিটে আর ঠোঁটে খেলে যাচ্ছে এক অদ্ভুত বাঁকা হাসি।
তার এক হাতে ধরা রক্ত ঝরতে থাকা তরোয়াল, আর অন্য হাতে সেই ছেলেটার কাটা হাত ঝুলে আছে।
পুরো দৃশ্যটা যেন মৃত্যুর মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে ওয়াজফান।
অর্ষা বুঝল, ওয়াশরুম থেকে ফিরতে একটু দেরিই তার জীবনের ভয়ঙ্করতম মুহূর্ত ডেকে এনেছে।
কারণ ঠিক তখনই ওয়াজফান ছুটে এসেছিল তার খোঁজে।
আর চোখে পড়েছিল অর্ষা আর সেই জিন ছেলেটির ফিসফিস হাসি-ঠাট্টা।
সেই দৃশ্য যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিল—
ওয়াজফানের রাগ মুহূর্তেই মাথায় চড়ে বসে।
তরোয়ালের ঝলকেই ছেলেটার হাত কেটে ঝুলে থাকে ওয়াজফানের মুঠোয়।
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল জিনটি।
কিন্তু ওয়াজফান এর মনে কোন দয়া ছিল না ।
তার বুক থেকে রাগ যেন গর্জন করে বেরিয়ে এলো, শাপশাপান্ত করতে করতে বলল—
motherf******
“আমি বলেছিলাম না?
ওর দিকে তাকানোর সাহস করলেও আমি শুধু তোর চোখ নয়, তোর পুরো জীবন কেড়ে নেব।
আর তোর এত বড় সাহস, তুই আমার অর্ষার সাথে কথা বলতে এসেছিস!
আজ তোকে আমি এমন ভয়ংকর মৃত্যু দেব যে এরপর থেকে কেউ মিসেস ওয়াজফান কায়স্থের কাছে আসার সাহস করবে না।”
কথাগুলো রাগে-ফুসে ফেটে বের হচ্ছিল তার গলা থেকে।
প্রায় সৈনিকের মতো কায়দায় এগিয়ে যাচ্ছিল সে ছেলেটার দিকে, হাতে ঝলসানো তরোয়াল।
আর মাটিতে পড়ে থাকা ছেলেটি ভয়ে ভয়ে পেছাতে শুরু করল,
কিন্তু চোখে-মুখে লেখা ভয় তার মৃত্যুর ছায়াকেও আরও ঘন করে তুলছিল।
অর্ষা তখনো ভয়ে কাঁপছে। ওয়াজফানের চোখের আগুন দেখে সে হঠাৎই বুঝে যায়— আর এক মুহূর্ত দেরি করলে এই মেঝেতে আরেকটা প্রাণ ঝরে পড়বে। তাই এক দৌড়ে এগিয়ে এসে সে দাঁড়িয়ে যায় ওয়াজফানের সামনে, তার বুকের সামনে এক মানবঢাল হয়ে।
ওয়াজফান যেন হঠাৎ থমকে গেলেও, পরের মুহূর্তেই তার গর্জন বেরিয়ে আসে বজ্রপাতের মতো—
“আমার সামনে থেকে সর!”
তার সেই হুংকারে সারা অনুষ্ঠান ঘরটা কেঁপে ওঠে। অতিথিরা ছুটে আসে সে জায়গায়। কারো মুখে কথা নেই, কারো চোখে একমাত্র বিস্ময়— হঠাৎ কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য নেমে এলো তাদের চোখের সামনে, কেউ বোঝারও সুযোগ পাচ্ছে না।
যে জিন ছেলেটার হাত ওয়াজফানের তরোয়ালে পড়ে গিয়েছিল, তার বাবা-ও ছিলেন এই আসরে। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখ বিবর্ণ হয়ে যায় ছেলের রক্তাক্ত শরীর দেখে। যদিও সে বুঝতে পারছে না আসল ভুলটা কী ঘটেছে, তবু ওয়াজফানের রাগের পরিচয় সে জানে— আর জানে, এই রাগ কারও জীবনকে মুহূর্তে গ্রাস করে নিতে পারে।
তাই এক মুহূর্ত দেরি না করে লোকটা ছুটে এসে ঝপ করে পড়ে যায় ওয়াজফানের পায়ে।
চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে থাকে, কণ্ঠস্বর কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসে—
“বাদশা! আমি জানি না আমার ছেলে কোন অপরাধ করেছে। কিন্তু আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। সে যদি কিছু ভুল করে থাকে, আপনি শাস্তি দিন, আপনি যা চান তাই দিন, আমি মেনে নেব। কিন্তু দয়া করে তার প্রাণ কেড়ে নেবেন না। আমি ভিক্ষা চাইছি, তার প্রাণটা আমাকে ফিরিয়ে দিন।”
চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু লোকটার কান্না আর ছেলের কাতরানো শব্দ ভেসে আসছে।
ওয়াজফানের চোখে তখনো দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। তার তরোয়াল রক্ত ঝরিয়ে চলেছে, দৃষ্টি স্থির— যেন মুহূর্তেই সে শিরশ্ছেদ করে ফেলবে।
কিন্তু ঠিক তখনই অর্ষা ফিসফিস করে বলে ওঠে—
“প্লিজ, ওয়াজফান… ওনার কথা মেনে নিন। দয়া করে…”
অর্ষার এরকম কথায় ওয়াজফানের ভেতরের দানব যেন আরও উন্মত্ত হয়ে উঠল। তার চোখের সোনালী আভা ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠতে লাগল, যেন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা অগ্নিশিখা। পরক্ষণেই সে বজ্রগতিতে ছুটে গেল সেই তরুণ জিন ছেলেটির দিকে।
কিন্তু হঠাৎ ছেলেটির বাবা সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে আঁকড়ে ধরল। কাঁপতে থাকা কণ্ঠে, অশ্রুসিক্ত চোখে কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করতে লাগল—
“বাবা, দয়া করুন বাদশাহ… এবারের মতো অন্তত আমার ছেলের প্রাণটা ভিক্ষা দিন। আমি শপথ করে বলছি—ওকে নিয়ে বহুদূরে চলে যাব, আর কোনদিন আপনার সামনে ওর ছায়াও পড়বে না। প্লিজ বাদশাহ, একবার… শুধু একবার ওকে ক্ষমা করে দিন। আর কখনো ভুল করবে না আমার ছেলে। আপনিই তো তাকে মারবেন না, প্লিজ, প্লিজ।”
ওয়াজফান প্রথমে ছেলেটিকে লোকটার হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে চাইছিল, কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে গেল ছোটবেলার সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার কথা—যেদিন এই জিনটাই নিজের প্রাণ বাজি রেখে তার জীবন বাঁচিয়েছিল। স্মৃতি ঝলসে উঠতেই ওয়াজফানের পা যেন জমে গেল। সে এগোল না, তবুও তার দৃষ্টি ভরা আগুন নিভল না একটুও।
তার মনের ভেতরে অন্য এক আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল—কেন অর্ষা ওই ছেলেটার জন্য এভাবে প্রাণপণ হয়ে উঠল? কেন তার চোখে অন্য কারও প্রতি মায়া জেগে উঠল? দুদিনেই কী তার মনে অন্য কারও প্রতি ভালোলাগা জন্ম নিল? তবে কি সে ওয়াজফানকে ভুলে যাচ্ছে? এই ভাবনা যেন তার রাগকে আরও উসকে দিল প্রতিনিয়ত।
তবু সে ওই লোকটার ঋণ ভুলতে পারল না ওয়াজফান। গর্জে উঠল হুংকারে—
“তুমি একদিন আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলে, আজ সেই ঋণ শোধ করছি। তোমার ছেলের প্রাণ আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিলাম। নয়তো তুমি ভালো করেই জানো—ওকে রেহাই দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি যদি কিছু করতে চাই, তবে তা করেই ছাড়ি।”
লোকটা কৃতজ্ঞতার অশ্রু গড়িয়ে, আহত ছেলেকে বুকে জড়িয়ে দ্রুত সেখান থেকে সরে গেল।
কিন্তু ওয়াজফানের চোখ তখন লাল হয়ে জ্বলছে। এবার তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল অর্ষার দিকে। দাউ দাউ আগুন যেন তার চাহনিতে। লালচে মুখ, কপালের রগ ফুলে ওঠা—হঠাৎ সে অর্ষার হাত চেপে ধরল। অর্ষা কিছু বলার আগেই তাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল সরাসরি পারস্য রাজ্যে।
কোনো কথার সুযোগ না দিয়েই, জোর করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠিয়ে আনল তার রুমে। আর দরজা বন্ধ হতেই তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল মেঝেতে।
অর্ষা ব্যথায় কেঁপে উঠল, অথচ ওয়াজফানের দৃষ্টিতে তখনও আগুন জ্বলছে দাও দাও করে।
ওয়াজফান যেন এখানেই থেমে গেল না, হঠাৎ ঝড়ের মতো অর্ষাকে টেনে তোলে নিয়ে এলো সামনে। এক মুহূর্তের জন্য কোনো সতর্কতা না দিয়েই তার গালে সপাটে একটা থাপ্পড় মারল। আঘাতটা এত প্রবল ছিল যে অর্ষা ছিটকে গিয়ে আবার মাটিতে পড়ে গেল। তার ঠোঁটের কোণে ফেটে রক্ত ঝরে পড়ছে। গালে পাঁচ আঙুলের দাগ লাল হয়ে ফুটে উঠেছে, মাথার ভেতর যেন বজ্র নেমে এলো—সবকিছু ঝিমঝিম করছে।
অর্ষা ব্যথা আর অপমান গিলে ফেলে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ওয়াজফানের দিকে। ঠোঁট নড়ল না, কিন্তু চোখের ভেতরের কষ্ট আর ক্ষতবিক্ষত অভিমান যেন অগ্নি হয়ে জ্বলতে লাগল। তার নীরব দৃষ্টি প্রশ্ন করছিল—“আমি কী ভুল করেছিলাম?”
কিন্তু ওয়াজফানের চোখে যেন সেই দৃষ্টি কোনো অর্থ বহনই করল না। আজ সে এমন রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে যে, নিজের হিতাহিত জ্ঞানই হারিয়ে ফেলেছে।
সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল অর্ষার দিকে। চুলের মুঠি আঁকড়ে ধরে টেনে তুলল তাকে, আর বজ্রনাদে গর্জে উঠল—
“সাহস হলো তোর! অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলিস? মাত্র দুইদিনেই এত কথা জমেছে তোর মনে? আমার উপর মন ভরে গেছে ? নাকি শরীরে আগুন লেগেছে, তাই অন্য কারো কাছে ছুটে যাচ্ছিস?”
ওয়াজফানের চোখ যেন রক্তপিপাসু আগুনে জ্বলছে। তার কণ্ঠস্বর কাঁপিয়ে দিচ্ছে দেয়াল-ছাদ।
“বল, তোর শরীরের জ্বালা কি আমি মেটাতে পারি না। তাই অন্য কারো কাছে যাওয়া লাগে? এত জ্বালা ধরে গেছে তোর শরীরে?… আচ্ছা, আজ আমি নিজেই তোর সব জ্বালা নিভিয়ে দেব।”
অর্ষা থরথর করে কাঁপছিল, কিন্তু চোখের ভেতরের দৃষ্টি তখনও বলছিল—“এটা কি তার ওয়াজফান না শুধু এই রাজ্যের জিন বাদশা।
অর্ষা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওয়াজফানের দিকে। চোখে কষ্ট, অভিমান, প্রশ্ন—সবই জমাট বেঁধে আছে, কিন্তু ঠোঁটের কোণে কোনো শব্দ নেই। একটিও কথা সে বলল না।
অর্ষার এই নীরবতা যেন ওয়াজফানের রাগকে আরও উস্কে দিল। মুহূর্তেই তার চোখ আগুনের মতো জ্বলে উঠল। গর্জন করতে করতে সে আগুন রূপ ধারণ করল, আর হাতের বড় বড় ধারালো নখগুলো হঠাৎ বেড়িয়ে এলো। কোনো দ্বিধা না করে সেই নখ অর্ষার গলায় চালিয়ে দিল। গভীর ক্ষত না হলেও গলার চামড়া চিরে চিকন ধারার মতো রক্ত ঝরতে লাগল।
অর্ষা ব্যথায় মৃদু চিৎকার করে উঠল, চোখ কুঁচকে এলো, কিন্তু তবু মুখে কোনো শব্দ নেই। শুধু নিঃশব্দ অশ্রু টলমল করে গড়িয়ে পড়ছে। দৃষ্টি নিবদ্ধ ওয়াজফানের উপরই—সেই দৃষ্টি যেন প্রশ্ন করছে, “তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো? নাকি শুধু আমার দেহের প্রতি নেশাই তোমার সব? ভালোবাসলে কি এভাবে আঘাত করতে পারতে?”
তার বুকের ভেতর কাঁপতে থাকা প্রশ্নগুলো গলা ছুঁয়ে বের হতে চায়, কিন্তু ঠোঁট নড়ে না। শুধু চোখই বলে দিচ্ছে সব।
কিন্তু ওয়াজফান তার এই নীরবতাকে সহ্য করতে পারল না। তার আশা ছিল—অর্ষা কেঁদে ভেঙে পড়বে, বলবে—“আমি শুধু আপনাকেই ভালোবাসি, আমার মনে আর কেউ নেই।” অথচ এত আঘাত, এত ব্যথার পরও অর্ষা চুপ।
নিজের রাগে যেন নিজেরই শ্বাসরোধ হয়ে আসছিল ওয়াজফানের। সে বুঝল—এই মুহূর্তে যদি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকে, তবে হয়তো সত্যিই অর্ষাকে মেরে ফেলবে।
অবশেষে সে এক ধাক্কায় অর্ষাকে ফেলে দিল মেঝেতে। অর্ষা ধপ করে পড়ে গেল, কণ্ঠে ব্যথার গোঙানি আটকে গেল। ওয়াজফানের ধারালো নখ তার জামার পাশ ছিঁড়ে দিয়ে গায়ের মোলায়েম চামড়াতেও কেটে গেছে—রক্তের সূক্ষ্ম দাগ সেখানে স্পষ্ট।
এক মুহূর্ত অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। তারপর ওয়াজফান দরজা ভেঙে বেরিয়ে গেল রুম থেকে—পেছনে রয়ে গেল নিস্তব্ধ ঘরে অর্ষার শ্বাসরুদ্ধ ব্যথা, রক্তের গন্ধ আর এক নিঃশব্দ প্রশ্ন—“ভালোবাসা কি সত্যিই এটাই?”
ওয়াজফান বেরিয়ে যেতেই ঘরের নিস্তব্ধতায় হঠাৎ ভেঙে পড়ল অর্ষার কান্না। বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্ট যেন ঢেউ হয়ে বেরিয়ে এল। সে কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে বলতে লাগল—
“আপনি আমাকে ভালোবাসেননি কায়াস্থ সাহেব… আমি অকারণে আপনার মোহকে ভালোবাসা ভেবে নিয়েছিলাম। আপনি তো আমায় ভালোবাসেন না। ভালোবাসলে কেউ না জেনে এভাবে আঘাত করে না। আমি যে আপনাকে আমার পুরো মন, পুরো বিশ্বাস দিয়ে দিয়েছি… কিন্তু আপনি… আপনি তো কখনোই বলেননি মুখে যে আপনি আমায় ভালোবাসেন। আমিই বোকা ভেবে নিয়েছিলাম, আপনি আমায় ভালোবাসেন…”
কথাগুলো ভেঙে ভেঙে বেরোচ্ছিল তার ঠোঁট থেকে, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল লোনাজল। তার আর্তনাদ, তার চিৎকার যেন চার দেয়াল ভেদ করেও নিস্তব্ধ রাতকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল।
অবশেষে অশ্রুতে ভিজে যাওয়া গাল নিয়েই ক্লান্ত হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ল অর্ষা। বুকের ভেতর এখনো দগদগে ক্ষত, তবু কান্না ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল। আর্তনাদের পর শরীর ভেঙে পড়ল, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো…
চোখের কোণে শুকনো অশ্রু লেগেই সে গভীর দুঃখে, নিঃসঙ্গতায়, কষ্টের ভারে ডুবে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল—
যেন ঘুম নয়, এক অনন্ত অবসাদে ডুবে যাওয়া।
যেন তার ক্লান্ত শরীরটা এবার একটু শান্তি চায়।
কেটে যায় অনেকটা সময়,,,,,,,
ওয়াজফান একা দাঁড়িয়ে ছিল রাজপ্রাসাদের ছাদে। রাতের আকাশে তারা অনেকটাই মিলিয়ে গেছে, শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে চারপাশে। তার বুকের ভেতর তখনো রাগের জ্বালা, কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা নিভে আসছে।
পায়চারি করতে করতে হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় অর্ষার মুখ, তার চোখের সেই অভিমান, সেই কান্না… আর ঠিক তখনই যেন বজ্রাঘাতের মতো চমকে ওঠে সে।
“আমি কী করেছি…! আমি নিজেই আমার লিটল মনস্টারকে এভাবে আঘাত করলাম?”
নিজের বুক চাপড়াতে চাপড়াতে, দাঁত কিঁচিয়ে নিজেকেই গালি দিতে থাকে ওয়াজফান। তার চোখে এক ধরনের আতঙ্ক—নিজের উপরই ভীষণ ঘৃণা।
অবশেষে আর এক মুহূর্ত সহ্য করতে না পেরে ছুটে যায় অর্ষার কক্ষে।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই স্তব্ধ হয়ে যায়।
অর্ষা ঠিক সেভাবেই মেঝেতে পড়ে আছে, যেভাবে সে কিছুক্ষণ আগে ফেলে গিয়েছিল। ছোট্ট শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আছে, যেন যন্ত্রণার ভারে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে তার সামনে।
অর্ষার গালের পাঁচ আঙুলের লাল দাগ, ঠোঁটের কোণে শুকনো রক্ত, গলার চিকন রেখা বেয়ে নেমে আসা রক্তের দাগ—সবকিছুই যেন ছুরির মতো বিঁধতে থাকে তার হৃদয়ে।
তার কলিজায় ধুক করে ওঠে।
একটু আগে এই হাতেই, এই নখেই, সে এগুলো করে দিয়েছে—আর এখন সে দাঁড়িয়ে আছে সেই অপরাধের ভার নিয়ে।
রাগের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে, নিজের কলিজা
কেই সে এমন করে আঘাত দিয়েছে…
এখন তার নিজেরই বুক ভেঙে যাচ্ছে অপরাধবোধে, কষ্টে।
ওয়াজফান নিঃশব্দে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে অর্ষার পাশে—
চোখে অপরাধবোধের ছায়া, ঠোঁটে নিস্তব্ধতা, বুকের ভেতরে এক অজানা যন্ত্রণা।
ধীরে ধীরে ওয়াজফান অর্ষাকে আলতো করে তুলে নেয় নিজের কোলে। এতটুকু অসহায় শরীরটা তার বুকে যেন ভারী হয়ে আসে।
সে চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, তারপর নিজের জাদুশক্তি প্রয়োগ করে—মুহূর্তের মধ্যে অর্ষার গালের দাগ মিলিয়ে যায়, ঠোঁটের কোণের রক্ত শুকিয়ে যায়, গলার কাটা দাগটুকুও অদৃশ্য হয়ে যায়।
অর্ষা আবার আগের মতো শান্ত, নিস্পাপ হয়ে ওঠে, যেন কিছুই ঘটেনি।
ওয়াজফান কপালে আলতো চুমু খায়—চুমুর ভেতর অনুশোচনা, কষ্ট, আর অপরাধবোধের ভার লুকিয়ে আছে। এরপর তাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে, যেন নিজের বুকের সমস্ত যন্ত্রণা অর্ষার নিঃশ্বাসে মিশে গিয়ে হালকা হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ পরে আর থাকতে পারে না।
সে অর্ষাকে কোলে তুলে উড়ে যায় রাতের আকাশ পেরিয়ে, প্রাসাদের সীমানা ছাড়িয়ে, সোজা জঙ্গলের গভীরে।
মাঝখানে ঝরনার গর্জন শোনা যায়, সেই জলপ্রপাতের সামনে এক বিশাল পাথরের ওপর বসে পড়ে ওয়াজফান।
অর্ষা তখনো নিস্তেজ, শান্ত।
ওয়াজফান তাকে নিজের কোলে রেখে, মাথাটা বুকে চেপে ধরে।
তার চোখ রাগে জ্বলছে নিজের উপর রাগটা এখন।
সে শুধু চুপচাপ বসে থাকে, বুকের ভেতরে জমে থাকা কষ্টটুকু কমানোর মরিয়া চেষ্টা করে—
কিন্তু যতই অর্ষাকে আঁকড়ে ধরে, ততই বোঝে সে… এই মানুষটার প্রতি তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
হঠাৎই ঝরনার গর্জনমাখা শব্দে অর্ষার ঘুম ভেঙে যায়।
চোখ মেলে দেখতেই সে বুঝতে পারে, এক ঝরনার সামনে ওয়াজফানের বুকে জড়িয়ে সে বসে আছে।
কিছুক্ষণ আগের প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি আঘাত, প্রতিটি কথা যেন হুড়মুড়িয়ে তার মনে ফিরে আসে।
এক ঝটকায় ধাক্কা মেরে নিজেকে ওয়াজফানের থেকে সরিয়ে নেয় সে।
দূরে গিয়েও বুকের ভেতর শ্বাস কাঁপতে থাকে, চোখ ভিজে আসে।
ওয়াজফান নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে।
তার আচরণে স্পষ্ট বোঝা যায়, কেন অর্ষা এভাবে তাকে দূরে ঠেলে দিল।
তবুও সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, হাত বাড়িয়ে নরম কণ্ঠে বলতে চায়—
“শুনো… লিটল মনস্টার…”
কিন্তু তার বাক্য শেষ হবার আগেই অর্ষা চিৎকার করে ওঠে—
“আমি আপনার কোন কথাই শুনতে চাই না! আমার থেকে দূরে থাকুন। আমি আপনার সাথে থাকতে চাই না।
আপনি একটা দানব! আপনার ভেতরে দয়া নেই, মায়া নেই, ভালোবাসা বলতে কিছু নেই।
আমি ভুল করেছিলাম… একেবারেই ভুল করেছিলাম।”
এটা ভেবে কে আপনি আমায় ভালবাসেন।
কথাগুলো বলে অর্ষা উল্টোদিকে ঘুরে যায়, যেন ঝরনার গর্জনের সাথে মিলিয়ে হারিয়ে যেতে চায় দূর কোনো পথে।
তবে ঠিক তখনই ওয়াজফানের কণ্ঠ ভেসে আসে পেছন থেকে—
“থামো… পাজর।”
শব্দটা শুনে অর্ষা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
তার শ্বাস আটকে আসে।
শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে যেন অপরিচিত এক আলোড়ন বয়ে যায়…
ওয়াজফান পেছন থেকে দাঁড়িয়ে রুদ্ধকণ্ঠে, যেন বুক ফেটে যাচ্ছে তবু শক্ত করে শব্দগুলো ছুঁড়ে দেয়,
“চলে যাবি? আমার কে ছেড়ে চলে যাবি? আমি দানব, তাই তো? তোর পাশে থাকতে ভয় হয়?
আচ্ছা, ঠিক আছে… যা।
তবে যাওয়ার আগে একটুকু শিখিয়ে দিয়ে যা—আমি কিভাবে নিঃশ্বাস নেব তোকে ছাড়া?
যে নিশ্বাস আমি সেদিন তোর নামে লিখে দিয়েছিলাম, সেটাই তুই নিয়ে যাস।
ওটা তোর অধিকার।
ওটা আমি তোর নামে লিখে দিয়েছি।
তোকে ছাড়া সেই নিশ্বাস নেওয়া আমার পক্ষে আর কখনো সম্ভব নয়।”
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে ওয়াজফানের কণ্ঠ ভেঙে আসে, কিন্তু চোখের সোনালি আগুন নিভে যায় না।
তার দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে অসহায় হাহাকার।
সে যেন নিজের বুক চিরে কথা বলছে—যেন বুকের প্রতিটি কাঁপন অর্ষার নামেই লেখা।
অর্ষা শুনে কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতর হঠাৎ করেই কেমন টনটন করে ওঠে, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে।
কয়েক মুহূর্ত সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে—কানে ঝরনার শব্দ, বুকের ভেতর হৃদয়ের ধুকপুকানি, আর ওয়াজফানের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি মিলে এক অচেনা সুর বাজায়।
তারপর… ধীরে ধীরে সে ঘুরে দাঁড়ায়।
চোখে জল টলমল করছে, ঠোঁট কাঁপছে, অথচ চোখদুটোয় একরাশ অভিযোগের সঙ্গে মিশে আছে অদ্ভুত এক টান।
অর্ষা কে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে,
ওয়াজফান এক ঝটকায় নিজের কোমরের পাশ থেকে ঝকঝকে তরোয়াল বের করে আনে। ঝরনার আলোয় সেই তরোয়ালের ফলার উপর জোনাকির মতো ঝিলিক ছড়ায়। সে ধীরে ধীরে সেটা অর্ষার দিকে বাড়িয়ে দেয়। কণ্ঠ ভেঙে যায়, তবু চোখে আগুন জ্বলতে থাকে—
“এই নে… নিয়ে যা।
নিজের দেনমোহরের উসুল নিয়ে যা।
এই আমার নিঃশ্বাস—যেটা আমি তোকে দিয়েছিলাম, সেই নিশ্বাসটাই তোকে ফিরিয়ে দিচ্ছি।
নিয়ে যা।”
সে কাঁপা হাতে বাম পাশটা দেখিয়ে দেয়, যেখানে বুকের পাজর ভেতর থেকে ধুকপুক করছে।
“এই পাজরে চালাস।
আমি জানি না আমি কী করি, কেন করি। রাগ উঠলে আমি অন্ধ হয়ে যাই, হিতাহিত জ্ঞান হারাই।
কিন্তু এই পাজর… এটা আমার না, এটা তোর।
তুই চাইলে নিয়ে যা এটা, আমি আটকাবো না।
নিশ্বাসটা নিয়ে চলে যা, শান্তিতে বাঁচ।”
কথাগুলো বলেই ওয়াজফান স্তব্ধ হয়ে যায়। তার চোখে রক্তলাল স্রোতের সঙ্গে মিশে আছে অপরাধবোধ, অনুশোচনা আর নিঃস্বার্থ আত্মসমর্পণ।
অর্ষার চোখ ভিজে ওঠে। প্রতিটি শব্দ তার হৃদয়ে ছুরি হয়ে বিঁধছে, আবার একইসঙ্গে ভালোবাসার অদ্ভুত আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
ধীরে ধীরে সে এগিয়ে আসে, হাত বাড়িয়ে তরোয়ালটা নেয়। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে ওয়াজফানের চোখে—যেন তার হৃদয়ের সব কথা পড়তে চাইছে।
তারপর হঠাৎ—
তরোয়ালটা সে ছুড়ে ফেলে দেয় ঝরনার স্রোতে। ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে সেই লোহা হারিয়ে যায় পানির তলদেশে।
অর্ষা কেঁপে ওঠা গলায়, চোখে অঝোর জল নিয়ে ওয়াজফানকে জড়িয়ে ধরে। বুকের ভেতর মাথা ঠেসে ধরে বলে ওঠে—
“আমি কোথাও যাচ্ছি না… বুঝেছেন?
আমি আপনার সঙ্গেই থাকব, সবসময়।
যত কষ্টই দেন না কেন, যত রাগই করেন—আপনার ছাড়া আমি কিছু না। আপনি আমার দানব, কিন্তু সেই দানবই আমার আশ্রয়।”
ওয়াজফান স্তব্ধ হয়ে যায়। তার শরীর কেঁপে ওঠে, বুক ভিজে যায় অর্ষার অশ্রুতে। সে চোখ বন্ধ করে বুকের ভেতর সেই শব্দগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে—
“আমি আপনার সঙ্গেই থাকব সবসময়…”
ওয়াজফান অর্ষাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বসে পড়ল, যেনো সারা পৃথিবীর দৃষ্টি থেকে তাকে আড়াল করতে চায়। ঝরনার কলকল শব্দ, গাছের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া চাঁদের আলো—সবকিছু মিলেমিশে এক নিঃশব্দ অথচ গভীর মুহূর্ত তৈরি করে। দু’জনেই চোখ বন্ধ করে আছে, কোনো কথা নেই, শুধু বুকের ধ্বনি আর নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় একে অপরকে অনুভব করছে।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ওয়াজফান বুকের বা পাশটায় হালকা একটা ব্যথা টের পেল। ভ্রু কুঁচকে চোখ মেলে তাকাতেই দেখে অর্ষা চুপিচুপি তার কাপড়টা সরিয়ে দিয়ে সেই জায়গাটায় দাঁত বসিয়ে কামড়ে ধরেছে।
ওয়াজফান এক চিলতে মুচকি হেসে কণ্ঠ নরম করে বলল—
“কি করছো লাড্ডু?”
অর্ষা চোখ তুলে ভীষণ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল—
“একটু আগে আপনি আমায় আঘাত করেছিলেন, তাই শোধ নিচ্ছি। যাতে পরের বার রাগ করে হাত তোলার আগে মনে থাকে, আমিও আপনার শরীরে দাঁতের দাগ বসিয়ে দেব।”
এ বলে সে আরেকটু জোরে কামড়ে ধরল। হালকা রক্ত বের হয়ে ওয়াজফানের ত্বকে লালচে ছোপ ফেলে দিল।
কিন্তু ওয়াজফান ব্যথায় কুঁকড়ে গেল না। বরং হেসে উঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল অর্ষার।
“আরে আমার ইঁদুরের বাচ্চা, তোমার এই লিটল দাঁতের কামড়ে আমার কিছুই আসে যায় না। চাইলে আরো কামড়াতে পারো।”
ওয়াজফানের চোখে তখন ব্যথা নয়, এক অদ্ভুত প্রশান্তি। মনে হচ্ছিল, অর্ষার এই কামড় যেনো তার অপরাধের প্রতিটি দাগ মুছে দিয়ে নতুন করে তাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনছে।
হঠাৎ ওয়াজফানের চোখের রং পাল্টে গেল সেখানে এখন দেখা গেল কঠিন এক সতর্কতা। ধীরে ধীরে অর্ষার চিবুকটা আঙুল দিয়ে উপরে তুলল, চোখে চোখ রেখে গম্ভীর স্বরে বলল—
“কামড়াচ্ছো, ঠিক আছে… এটা আমি মেনে নিলাম। তবে আজ যেটা করতে চাইলে সেটা যেন আমি ভুলেও কখনো দ্বিতীয়বার না দেখি। এরকম জেদ আমার একেবারেই পছন্দ না। পরের বার যদি সাহস করে আবার আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা ভাবো—তবে হাত-পা কেটে নিয়ে নিজের কাছেই রেখে দেবো। তখন দেখে নিই, আমার থেকে দূরে গিয়ে কার কাছে এই জেদ দেখাও।”
Death or Alive part 29
সে আরও ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে যোগ করল—
“সাহস হলো কিভাবে, আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা ভেবেছো? তুমি কি জানো না, তুমি শ্বাসের মতো, নিশ্বাসের মতো—তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।”
ওয়াজফানের চোখ তখন যেন সোনালি আগুনে জ্বলছে, তবে সেই আগুন রাগের নয়—পাগল করা এক ভয় আর অধিকারবোধে ভরা। অর্ষা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল, যেনো তার বুক কেঁপে উঠল এই দানবসুলভ ভালোবাসার সামনে।
 
