Death or Alive part 34
priyanka hawlader
আকাশ যেন হাহাকার করে কেঁদে চলেছে। চারদিক ঘন অন্ধকারে ঢাকা, দূরে পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টির ধারা নেমে আসছে—প্রকৃতি এক অদ্ভুত ভয়ংকর সৌন্দর্যে ভরে উঠেছে। বৃষ্টির ফোঁটা টিনের ছাদে পড়ছে টুপটাপ শব্দে, আর সেই শব্দ যেন ক্যালিয়নের ভেতরের অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
সে ঘরের ভেতর এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। প্রতিটা ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর—সব জায়গা খুঁজে ফেলেছে। কিন্তু কোথাও তার রেড ওয়াইন নেই।
ক্যালিয়নের বুকের ভেতর হঠাৎই এক অদ্ভুত আতঙ্ক জন্ম নিল। চোখে-মুখে ভয়ের ছায়া ফুটে উঠল।
মনের ভেতর ভয়ঙ্কর এক চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল—
“না… না, এমনটা কখনো হবে না। সে আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না। সে আমাকে ভালোবাসে, সে আমার। অনেক সাধনার পর আমি তাকে পেয়েছি। এবার আর আমি তাকে হারাতে পারব না… না, পারব না!”
ক্যালিয়নের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। সে ঘরের ভেতর দৌড়াচ্ছে, একেকটা দরজা খুলে খুঁজছে, প্রতিটা কোনে তাকাচ্ছে। কণ্ঠ ভেঙে যাচ্ছে আতঙ্কে, তবুও সে ডাকতে থাকে—
—“রেড ওয়াইন! …রেড ওয়াইন!! তুমি কোথায়?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রকৃতির সেই ভয়ংকর সৌন্দর্য, ঝুম বৃষ্টি, আর ক্যালিয়নের তীব্র আতঙ্ক মিশে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করল কটেজজুড়ে—যেন ভালোবাসার সঙ্গে ভয়ও বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে।
খুঁজতে খুঁজতে ক্যালিয়ন শেষমেশ কটেজের বাইরে বেরোল। বৃষ্টির শব্দ যেন পুরো জঙ্গলের বুক কাঁপিয়ে তুলছে। তার চোখ হঠাৎই থেমে গেল—ফুলের বাগানের এক কোণে দাঁড়িয়ে ভিজছে রেড ওয়াইন। সাদা পোশাক ভিজে শরীরে লেগে আছে, চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।
এক মুহূর্তের জন্য বুকের ভেতর জমে থাকা ভয় যেন গলে গেল। ক্যালিয়নের ঠোঁটে ফুটে উঠল শান্তির হাসি। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে। হৃদয়ের ভেতর যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি বেজে উঠছে—ভালোবাসা, মোহ, আর এক অচেনা নেশা।
ক্যালিয়ন নিজের কালো জ্যাকেট খুলে নিল, আলতো করে রেড ওয়াইনের মাথার উপর ধরে দিল। জ্যাকেটের ভেতরে এখন তারা দুজন—কেবল সে আর তার রেড ওয়াইন।
মেয়েটি এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিল, বৃষ্টিকে যেন উপভোগ করছিল নীরবতায়। কিন্তু হঠাৎই অনুভব করল, তার গায়ে আর পানি পড়ছে না। ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল। সামনে ক্যালিয়ন—ভেজা চুল থেকে পানি ঝরছে, কিন্তু তার চোখ শুধু তাকিয়ে আছে রেড ওয়াইনের দিকে।
তাদের মাথা একই জ্যাকেটের নিচে, দুজন একেবারে কাছে চলে এলো। দূরত্ব এতটাই কমে গেল যে নিঃশ্বাসের উষ্ণতা মিশে যাচ্ছে একে অপরের সঙ্গে। ক্যালিয়নের চোখে ভেসে উঠল নেশার ছোঁয়া। ধীরে ধীরে সে ঝুঁকে এল, রেড ওয়াইনের ঠোঁটের দিকে এগিয়ে গেল।
কিন্তু… ঠিক সেই মুহূর্তে মেয়েটির বুকের ভেতর কেঁপে উঠল এক অদ্ভুত অনুভূতি। যেন কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না। শরীরের ভেতর দোলা দিল অপরিচিত এক ভয়। সে তড়িঘড়ি করে সরে গেল ক্যালিয়নের কাছ থেকে।
রেড ওয়াইনকে এভাবে দূরে সরে যেতে দেখে ক্যালিয়নেরও হুঁশ ফিরল। তার বুক ভেঙে গেল, তবু সে নিজেকে সামলে নিল। গভীর শ্বাস নিয়ে পিছনে ফিরল।
“আমি তাকে চাই… তবে এভাবে নয়। আমি আমার রেড ওয়াইনকে কষ্ট দিয়ে নয়…”
কোনো কথা না বলে ক্যালিয়ন দ্রুত ভেতরে ফিরে গেল। পেছনে দাঁড়িয়ে রেড ওয়াইন ভিজতে থাকল বৃষ্টিতে, আর কটেজের ভেতরে অন্ধকারের মতো নীরব হয়ে গেল ক্যালিয়নের হৃদয়।
সারা রাত একবারও রুমে ফেরেনি ড্যানিয়েল।
ফিরেনি বললে পুরোটা সত্যি হবে না—
সে এসেছিল, দরজায় বহুবার কড়া নেড়েছিল।
কিন্তু ইসাবেলা একবারও সেই দরজা খোলেনি।
ড্যানিয়েল চাইলে সহজেই নিজের শক্তি খাটিয়ে দরজাটা ভেঙে ফেলতে পারতো।
তবুও সে তা করেনি।
কারণ সে চেয়েছিল, ইসাবেলাকে বিরক্ত না করতে।
তাই সে নিরবে ফিরে গেছে।
রাত কেটে নতুন ভোর আসে।
তবুও ঝামেলা শেষ হয়নি—
সকালের আলোয়ও দরজা খোলে না ইসাবেলা,
ড্যানিয়েল দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে, এবার রাগ চেপে বসে তার মাথায়।
কাল দুপুর থেকে ইসাবেলা কিছু খায়নি,
রাতভরও না খেয়ে থেকেছে।
রাতে সে কিছু বলেনি, চুপ ছিল।
কিন্তু এখন রাগ হচ্ছে—
কেন এতক্ষণ না খেয়ে থাকা?
অবশেষে, আর দেরি না করে—
সে নিজের শক্তি দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলে।
ভেতরে ঢুকে দেখতে পায়,
ইসাবেলা চুপচাপ খাটের ওপর বসে আছে।
ড্যানিয়েল ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় তার দিকে…
ইসাবেলা চোখ তুলে একবারও তাকায় না।
চুপচাপ সেভাবেই বসে আছে, যেন রুমে আর কেউ নেই—
এমন ভঙ্গিতে, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে।
ড্যানিয়েল আস্তে স্বরে বলে ওঠে—
“ইসাবেলা… চলো, খেতে চলো।”
কোনো সাড়া নেই।
ইসাবেলা যেন শুনতেই পাচ্ছে না,
নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
ড্যানিয়েল আবার বলে—
“চলো, যাবে না? কাল থেকে কিছুই খাওনি…
চলো, খেতে চলো।”
তবুও ইসাবেলা নীরব।
একটুও নড়ে না, যেন তার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না সেই ডাক।
অবশেষে ড্যানিয়েল এগিয়ে এসে আস্তে করে তার হাত ধরে বলে—
“চলো…”
তখনই ইসাবেলা ঝটকা মেরে হাত ছেড়ে দেয়।
দূরে সরে গিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে—
“আমি খাব না!
আমার জন্য আপনার দরদ দেখাতে হবে না।
আপনি চলে যান এখান থেকে।
আমি খাব না বলেছি তো… খাব না!”
ঘর ভরে ওঠে তার কণ্ঠের প্রতিবাদে।
ড্যানিয়েল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ এই মেয়ের এত জেদ কোত্থেকে হল।
ড্যানিয়েল এবার রেগে যায়।
রাগে দাসীদের ডেকে আদেশ করে খাবার নিয়ে আসার জন্য।
দাসীরা তার কথামতো দ্রুত খাবার নিয়ে আসে।
ড্যানিয়েল নিজের হাতে খাবার তুলে নেয়,
ইসাবেলার মুখের সামনে বাড়িয়ে ধরে।
কিন্তু ইসাবেলা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে—
“আমি খাবো না বলেছি না? মানে আমি খাবো না।”
ড্যানিয়েলের চোখে রাগের ঝড় নামে—
“তোমার মতামত কে জানতে চেয়েছে?
আমি বলেছি তোমাকে খেতে হবে মানে তোমাকে খেতেই হবে।”
সে আবারও খাবার ইসাবেলার মুখের সামনে ধরে।
কিন্তু ইসাবেলা এবারও মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
তখনই ড্যানিয়েল ক্ষোভে তার চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে,
মুখ ঘুরিয়ে জোর করে খাবার পুরে দেয়।
ইসাবেলা চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে চেষ্টা করে খাবারটা ফেলে দিতে।
ড্যানিয়েল গর্জে ওঠে—
“যদি এই খাবারটা মুখ থেকে ফেলতে চাও,
তবে মনে রেখো—আরও ভয়ংকর শাস্তি পেতে হবে।
ভাবছো না খেয়ে থাকতে পারবে?
কখনোই না। আমি চাইলে খারাপ রূপ দেখাতে পারি,
তবে সেটা আমাকে বাধ্য করো না।
চুপচাপ খেয়ে নাও।
ড্যানিয়েলের হুমকিতে ইসাবেলায় এবার একটু ভয় পায় তাই না চাইতেও ইসাবেলা গিলে ফেলে খাবারটা।
তার কণ্ঠে তিক্ততা ঝরে—
কি আর খারাপ করা বাকি রেখেছেন আমার সাথে?
এখন তো শুধু এই জীবনটাই আছে।
এটাও নিয়ে নিন… পুরোপুরি শেষ করে দিন আমায়।
এটা ছাড়া আর পারবেনই বা কী?
ড্যানিয়েল ঠান্ডা অথচ ভয়ংকর স্বরে উত্তর দেয়—
“তুমি ভালো করেই জানো আমি কী করতে পারি আর কী না।
তাই আমার রাগ বাড়িও না।
বলছি—খাবারটা চুপচাপ খেয়ে নাও।”
ইসাবেলা মানতে চায় না।
অবশেষে বাধ্য হয় ড্যানিয়েলের জোরে খেতে।
খাওয়া শেষ হলে রুম থেকে বেরোনোর আগে
ড্যানিয়েল ফিরে তাকিয়ে কঠিন কণ্ঠে বলে ওঠে—
“চাইলে তুমি পাগলামো করতে পারো…
কিন্তু এটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও,
না খেয়ে তুমি এখানে থাকতে পারবে না।
তুমি যেহেতু এখানে আছো—তাহলে আমার নিয়ম মেনে,
আমার কথামতোই তোমার জীবন যাপন করতে হবে।”
ইসাবেলা কিছু বলতে যাচ্ছিল,
কিন্তু তার আগেই ড্যানিয়েল রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
নিজের রুমে রকিং চেয়ারে বসেই দুল ছিল ওয়াজফান তার মনে একটাই ভাবনা তার সেই লিটল মন্সটার কে হারিয়ে যাওয়ার দিনটা নিয়ে,
ওয়াজফান চোখ বন্ধ করতেই তার সামনে ভেসে উঠল সেই দিনের বিভীষিকাময় দৃশ্য। রাজপ্রাসাদে
সেদিন অন্য এক রাজ্যের গুপ্তচর ঢুকে গিয়েছিল আর তাই আয়রাক তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল তবে সে রাজপ্রাসাদে এসে সবটা সামলে নিয়ে,
কাজ শেষ করে সে রওনা হয়েছিল মধুপুর গড় গ্রামের উদ্দেশ্যে।
গ্রামে পৌঁছেই অর্ষার বাড়ির সামনের দৃশ্য যেন তাকে অজানা অশুভ শিহরণে আচ্ছন্ন করে দিল। চারদিকে কোলাহল, মানুষের আর্তচিৎকার, কেউ বলছে—“সব শেষ হয়ে গেল… পরিবার শেষ হয়ে গেল…” এই কথাগুলো যেন শূন্য আকাশে প্রতিধ্বনির মতো বাজতে থাকল ওয়াজফানের কানে।
সে আর স্থির থাকতে পারল না। পাগলের মতো ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল। আর তখনই—
তার চোখের সামনে ধরা দিল এক মহাদুঃস্বপ্ন।
অর্ষার বাড়ি দাউদাউ করে জ্বলছে আগুনে। শিখাগুলো আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে, চারপাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে ক্রুদ্ধ গর্জনে।
ওয়াজফান থমকে দাঁড়িয়ে রইল। তার বুকের ভেতরে যেন হৃৎপিণ্ড থেমে গেল। চোখের সামনে এই দৃশ্যকে নিজের বিশ্বাসে আর মানাতে পারল না সে।
তার সমগ্র সত্তা কেঁপে উঠল, আর নিঃশ্বাস যেন বুকের ভেতরেই কোথাও আটকে গেল।
এক মুহূর্ত পর ওয়াজফান পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল দাউদাউ করা আগুনের ভেতর।
তার লিটল মনস্টারকে বাঁচানোর তাড়নায় সে ভুলে গেল সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য—
সে একজন জিন হলেও আগুনই তার সবচেয়ে বড় শত্রু।
নিজের আগুন দিয়ে সে দুনিয়াকে পুড়িয়ে দিতে পারবে, কিন্তু প্রকৃতির আগুনের কাছে জিনেরা দুর্বল। সাধারণ কোনো জিন হলে এতক্ষণে আগুনের তাপে ছাই হয়ে যেত। কিন্তু ওয়াজফান জিনদের বাদশাহ—তাই মৃত্যুর আগুন তাকে নিতে পারল না, তবুও তার শরীরের অনেকাংশ দগ্ধ হয়ে ছাইয়ের মতো পুড়ে যাচ্ছিল।
যন্ত্রণা ছিল ভয়ংকর, তবুও মুখে কোনো শব্দ বের হলো না।
কারণ বুকের ভেতরের যন্ত্রণা, প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা, সেই দাহের চেয়েও হাজার গুণ বেশি ভয়ংকর ছিল।
ভেতরে ঢুকে সে উন্মাদের মতো ঘর থেকে ঘর খুঁজতে লাগল।
আর তখনই তার চোখ পড়ল—
মেঝেতে পড়ে আছে তিনটি নিথর দেহ।
দুইটি দেহ অর্ষার বাবা-মায়ের, আরেকটি ছোট শরীর—অর্ষার ভাই।
সবকিছু আগুনে নিঃশেষ, তবুও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তাদের পরিচয়।
ওয়াজফানের বুকটা হাহাকারে ভরে উঠল।
কিন্তু তবুও তার চোখ অর্ষাকে খুঁজছিল…
প্রাণপণে খুঁজল প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ছায়া।
কিন্তু কোথাও অর্ষা নেই।
সেই মুহূর্তে তার মনে ক্ষীণ আশার আলো জ্বলে উঠল—
“না, আমার লিটল মনস্টার বেঁচে আছে। এখানে নেই মানে বাইরে কোথাও আছে।”
সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে বেরিয়ে এল।
তার শরীর পুড়ে যাচ্ছে, দগ্ধ মাংস থেকে ভয়ংকর যন্ত্রণা ছড়াচ্ছে, কিন্তু সে যেন কিছুই টের পাচ্ছে না।
সে তার যাদুশক্তি দিয়ে আয়রাককে নিজের কাছে ডেকে পাঠাল।
ভয়ংকর লাল চোখে তাকিয়ে কেবল বলল—
“পুরো জঙ্গল চষে ফেলো। —আমার লিটল মনস্টারকে খুঁজে বের করো। এখনই।”
আয়রাক বিন্দুমাত্র দেরি করল না।
তারাও ছুটল চারদিক জুড়ে, উন্মাদের মতো।
ওয়াজফান নিজেও প্রতিটি গাছের ফাঁক, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি মাটির নিচে খুঁজে বেড়াল…
শুধু একটাই আশা নিয়ে—
“আমার লিটল মনস্টার… কোথাও না কোথাও, তুমি আছো।”
পুরো জঙ্গল খুঁজেও অর্ষার কোনো চিহ্ন পেল না ওয়াজফান।
মাথার দুশ্চিন্তা আগুন হয়ে জ্বলে উঠল তার ভেতরে।
শেষমেশ সে নিজের জাদুশক্তি ব্যবহার করল—
হাতে তৈরি করল আগুনের এক গোলক, সেই গোলক থেকেই দেখতে শুরু করল, কয়েক ঘণ্টা আগে আসলে কী ঘটেছিল অর্ষার ঘরে।
গোলকের ভেতরে ভেসে উঠল বিভীষিকার ছবি।
অর্ষা তখন সবে ঘুমিয়েছে। শরীর ব্যথায় ভাঙা, তবুও শান্ত ঘুম।
কিন্তু আচমকাই বাইরে অদ্ভুত এক শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে টলতে টলতে দরজার বাইরে আসতেই—
তার চোখে পড়ে বিভৎস দৃশ্য।
মেঝেতে নিথর পড়ে আছে তার বাবা ও মা।
তাদের নিথর দেহ থেকে টলটল করে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত।
আঘাতের চিহ্নে বোঝা যাচ্ছিল— ধারালো ছুরির নির্মম খেলা।
অর্ষার বুকটা আতকে উঠল।
গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো হাহাকারের চিৎকার।
আর সেই চিৎকারের দিকেই ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল সে দানব—
সেই জিন, ওয়াজফান যার হাত কেটে দিয়েছিল।সেদিন অর্ষার সঙ্গে কথা বলার অপরাধে।
এবার সে এসেছে প্রতিশোধের জন্য।
এক হাতে ধারালো ছুরি দিয়ে ধরে আছে ফারাজ এর গোলার কাছে —অর্ষার ভাই।
অর্ষার চিৎকারে তার গলা কেঁপে উঠল,
—“আপনি কেন… কেন মারলেন ওনাদের? কী চাই আপনার? দয়া করে, আমার ভাইকে ছেড়ে দিন।”
দানবীয় হাসি ঝরিয়ে জিনটি উত্তর দিল,
—“আমার চাই তুই। তোর শরীরটা, তোর রক্তটা, তোর প্রতিটা নিঃশ্বাস আমার চাই। বল, আমাকে দিবি কি দিবি না?”
অর্ষা কাঁপতে কাঁপতে মাথা নাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
—“না! আমি মরে গেলেও নিজেকে তোর মতো পিশাচের হাতে তুলে দেব না। ওকে ছেড়ে দে!
আর নয় তো ওয়াজফান জানলে তোকে ভয়ংকর মৃত্যু দিবে।
কিন্তু সেই দানব বাঁকা হেসে ছুরি চালিয়ে দিল ফারাজের গলায়।
এক মুহূর্তে ভাইয়ের নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
অর্ষা ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
কাঁদতে কাঁদতে ডেকে উঠল,
—“বাবা… মা… ভাই… তোমরা ফিরো… আমাকে ছেড়ে যেও না…”
ঠিক তখনই দানব তার চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টানে মাটিতে ফেলে দিল।
দাঁত বের করে বিষাক্ত হাসি হেসে বলল,
তুই আমাকে ওয়াজফান এর ভয় দেখাস নে মেরে দিলাম তোর পরিবার এবার তোর পালা দেখি তোর ওয়াজফান আমার কোন বালটা ছিড়তে পারে।
—“এবার তোকে আর কেউ বাঁচাতে আসবে না। এবার সবকিছুই দিবি আমাকে—তোর শরীর, তোর আত্মা, তোর জীবন।”
সঙ্গে সঙ্গে জিনটা তার জামার বুক ছিঁড়ে ফেলল।
অর্ষার বুক কেঁপে উঠল আতঙ্কে।
সে বুঝে গেল—
এখানে থাকলে শুধু জীবন নয়, ইজ্জতও যাবে।
আর সে এই মুখ নিয়ে ওয়াজফানের সামনে কোনোদিন দাঁড়াতে পারবে না।
হঠাৎ, সাহস জোগাড় করে পাশে পড়ে থাকা ভারী কাঠটা হাতে তুলে নিল।
সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করল জিনের মাথায়।
দানব কেঁপে উঠল, কিছুক্ষণের জন্য দিশেহারা হয়ে গেল। যদি ওই আঘাত তার জন্য কিছুই না তবে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।
অবস্থার সুযোগ নিয়ে অর্ষা উঠে দৌড় দিল জঙ্গলের দিকে।
তার পেছনে পেছনে হো হো করে হেসে ছুটতে লাগল সেই জিন,
—“তুই ভুলে যাচ্ছিস, তুই মানুষ আর আমি জিন। যত দূরেই দৌড়াস না কেন, আমার থেকে পালাতে পারবি না।
তবুও দৌড়া… দৌড়া… তোকে তাড়া করতে আমার বড়ই মজা লাগছে।
অন্ধকার জঙ্গলে দৌড়াচ্ছে অর্ষা…
আর তার পিছুপিছু নরকীয় হাসি নিয়ে ছুটে আসছে সেই দানব।
দৌড়াতে দৌড়াতে অর্ষা পৌঁছে গেল জঙ্গলের শেষ প্রান্তে।
তার সামনে হা-হা করে ফুঁসে উঠছে গভীর এক খাদ।
খাদের নিচে গর্জন করে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি ঝরনা,
পানি এমন বেগে নামছে যেন অজস্র রক্তধারা ছুটে চলেছে মৃত্যুর দিকে।
অর্ষা থমকে দাঁড়াল।
শ্বাসকষ্টে বুক উঠানামা করছে দ্রুত,
কিন্তু তার সামনে যে দৃশ্য—
তা যেন মৃত্যুর চেয়েও ভীতিকর।
পেছনে—দাঁড়িয়ে আছে সেই দানবীয় জিন।
চোখে তার শিকারীর উন্মাদ আলো।
সামনে—খাদ, যেখানে ঝাঁপ দিলে নিশ্চিত মৃত্যু।
একপাশে মৃত্যুর ছোবল, অন্যপাশে লাঞ্ছনার অভিশাপ।
মুহূর্তেই অর্ষার মনে এলো এক ভয়ংকর উপলব্ধি।
এই দানবের হাতে মরার চেয়ে
নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দেওয়া ঢের ভালো।
কিন্তু বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল অন্য এক যন্ত্রণায়—
“শেষবার… শুধু শেষবার যদি কায়াস্থ সাহেবকে দেখতে পারতাম… তার বুকের ওপর মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে পারতাম… তবে আফসোস থাকত না।”
চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু।
কিন্তু সময় নেই।
এক মুহূর্তের মধ্যেই সে সিদ্ধান্ত নিল।
শ্বাস টেনে বুক শক্ত করে চোখ বন্ধ করল,
আর দেরি না করে ঝাঁপ দিল পাহাড়ি খাদের গভীরে।
অপ্রস্তুত হয়ে গেল সেই জিন।
স্তম্ভিত চোখে দেখল তার শিকার নিজের হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল মৃত্যুর দিকে।
সে চিৎকার করে দৌড় দিল,
হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল অর্ষাকে—
কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
অর্ষার দেহ বাতাস কেটে নিচে নেমে যাচ্ছিল দ্রুত।
নিচে অপেক্ষায় ছিল গর্জন করা পানির স্রোত,
আর তার বুক ভরে উঠছিল এক অদ্ভুত মুক্তির হাহাকারে।
অন্যদিকে দাঁড়িয়ে থাকা জিন—
হতভম্ব হয়ে শুধু তাকিয়ে রইল।
যেন এ দৃশ্যের জন্য তার প্রস্তুতি ছিল না।
খাদের কিনারায় ছড়িয়ে রইল শুধু অর্ষার ঝাঁপ দেওয়ার প্রতিধ্বনি—
যা মিলিয়ে গেল ঝরনার গর্জনের ভেতর।
তবে নিচে পড়তে পড়তেই অর্ষার মনে হলো—
সে যেন নিজের ভেতরেই লিখে যাচ্ছে এক চিঠি,
এক অদৃশ্য চিঠি, যার প্রাপক শুধু একজন—
তার কায়াস্থ সাহেব, তার প্রাণের ওয়াজফান।
কিন্তু এই চিঠি কোনদিনই হয়তো পৌঁছাবে না তার কাছে।
এ কেবলই থেকে যাবে বাতাসে,
তার শেষ নিঃশ্বাসের সাথে মিলেমিশে।
“প্রিয় কায়াস্থ সাহেব,
পারলে আমায় ক্ষমা করবেন।
আমি পারলাম না আপনার পাশে থেকে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে যেতে,
পারলাম না আজীবন আপনার হাত ধরে হাঁটতে।
নিয়তির নিষ্ঠুর খেলায় আমাদের ভালোবাসা আজ এখানে এসে থেমে গেল।
হয়তো আমাদের পথচলার কেবল এইটুকুই ছিল,
হয়তো পূর্ণতারও একটা সীমা থাকে।
আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছিল,
কিন্তু ভাগ্য সেই পূর্ণতাকে এভাবে ছিন্ন করে দিল।
জানি, আমার মৃত্যুর পর আপনার পৃথিবী ফাঁকা হয়ে যাবে।
আপনার নিঃশ্বাসে আর আলো থাকবে না।
তবুও শেষ অনুরোধ—
নিজেকে একেবারে ভেঙে দেবেন না।
ভেবে নেবেন, আমি উপরে আছি,
আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিঃশ্বাস দেখছি স্রষ্টার কাছ থেকে।
আমি জানি, আমার কষ্টের সাথে সাথে আপনিও জ্বলে-পুড়ে যাবেন।
হাজার চেষ্টাতেও হয়তো শান্ত হবেন না।
কিন্তু চেষ্টা করবেন বেঁচে থাকতে,
চেষ্টা করবেন খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করতে।
ভালো থাকার ভান করবেন অন্তত।
আমি চলে যাচ্ছি—
তবে সাথে নিয়ে যাচ্ছি আপনার হৃদয় আপনার ভালোবাসা।
আপনার বুকের ভেতরে আমার জন্য যে অগ্নিঝরা যন্ত্রণা জমে উঠবে,
সে কষ্ট থেকে বেরোতে হয়তো আপনি পারবেন না।
তবুও চাইবেন, চেষ্টা করবেন বাঁচতে।
আর যদি পারেন…
আপনাকে একা করে দিয়ে চলে যাওয়ার অপরাধে এই স্বার্থপর, বেইমান আপনার মানব কন্যাটিকে, একদিন মাফ করে দেবেন।
ইতি,
আপনার আসক্তি,
আপনার লাড্ডু,
আপনার লিটল মনস্টার।”
চিঠি শেষ হলো।
চোখ থেকে ঝরে পড়ল অশ্রুবিন্দু।
শেষবারের মতো বুকটা ভারী করে দিয়ে অর্ষার দেহ আছড়ে পড়ল পানির গর্জন ধ্বনির মাঝে।
স্রোতের দাপটে ধীরে ধীরে সে ভেসে যেতে লাগল—
চিরতরে অদৃশ্যের পথে।
জিনটি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পাহাড়চূড়ায়।
তার চোখ যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না—
একজন মানুষ, একটি মেয়ে,
নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে!
নিচে ঝরনার গর্জন—
ফেনিল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে অর্ষার শরীর,
আর তার কানের দুলটাও যেন পানির ঢেউকে সাথে নিয়ে
অদৃশ্যের পথে বিলীন হয়ে গেল।
জিনটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে এক মুহূর্তের জন্য।
কিন্তু পরক্ষণেই সে বাস্তবে ফিরে আসে—
“এখন আর কিছুই করার নেই ।
“এমন উচ্চতা থেকে পড়ে কোনো মানুষ বেঁচে থাকে না—
এটাই স্বাভাবিক।”
তারপর আর কোনো শব্দ না করে,
আর কোনো চিহ্ন না রেখে
ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে সে।
অদৃশ্য গন্তব্যের দিকে—
যেন কিছুই ঘটেনি,
যেন এ পৃথিবী থেকে আরেকটি প্রাণ হারিয়ে যাওয়া
তার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়।
অর্ষা ধীরে ধীরে স্রোতের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিল,
কোথাও এক বিন্দু আলো পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছিল না।
ঠিক সেই মুহূর্তেই ওয়াজফানের হাতে ধরা আগুনের বলটা
হঠাৎই কালো হয়ে ওঠে।
দৃশ্য যেন আঁধারে ঢেকে যায়,
আর কিছুই তার চোখে ধরা দেয় না।
ওয়াজফানের বুক ধকধক করে উঠল।
শক্তি প্রয়োগ করল বারবার,
কিন্তু বলের ভেতরে কিছুই দেখা গেল না।
শুধু অন্ধকার, শুধু শূন্যতা।
সে আর স্থির থাকতে পারল না।
গর্জে উঠল,
আয়রাককে আদেশ করল—
জঙ্গলে পুরো চারদিক তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখো,
এক মুহূর্তও দেরি করবে না।
আমার লিটল মনস্টারকে খুঁজে বের করো!”
আয়রাক সম্মতি জানিয়ে উধাও হয়ে গেল জঙ্গলের দিকে।
কিন্তু ওয়াজফান আর দাঁড়িয়ে রইল না।
পাগলের মতো ছুটে গিয়ে ঝাঁপ দিল পাহাড় থেকে
সেই গর্জনরত পানির স্রোতে।
সে খুঁজে ফিরল প্রতিটি কোণ,
গভীর থেকে গভীরতর আঁধার—
তার নিশ্বাস শেষ হয়ে আসছিল,
তবুও খোঁজা থামাল না।
কিন্তু কোথাও নেই অর্ষা।
কোথাও নেই তার নিঃশ্বাসের ছায়াটুকুও।
ভয়ংকর অস্থিরতা গ্রাস করল ওয়াজফানকে।
সে উঠে এল পানির বুক চিরে।
আবার শক্তি প্রয়োগ করল হাতে ধরা বলের উপর।
কিন্তু না—
সেটা এখনও কালো,
অন্ধকারের গভীর শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই দেখাচ্ছে না।
রাগে, যন্ত্রণায় গর্জে উঠল ওয়াজফান।
ছুড়ে ফেলে দিল সেই বলটাকে শূন্যে,
পাহাড়ের বুক জুড়ে প্রতিধ্বনি হল তার হুংকার।
এরপর আবার ঝাঁপ দিল সে।
আবার খুঁজল,
প্রত্যেকটা অচেনা কোনায়,
প্রত্যেকটা পানির গহ্বরে।
কিন্তু—
না, নেই অর্ষা।
কোনো নাম, কোনো গন্ধ, কোনো চিহ্নও নেই।
সে এবার উঠে আসে,
অস্থিরতা তার শরীর জুড়ে রক্তের মতো দপদপ করে জ্বলতে থাকে।
তার চোখ লাল, বুক হাহাকার—
যেন পুরো পৃথিবীকে ভস্ম করে ফেলবে এক মুহূর্তে।
সে উপরে উঠতেই দেখতে পেল—
আয়রাক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
অস্থির কণ্ঠে ওয়াজফান জিজ্ঞেস করে উঠল—
“কি হয়েছে আয়রাক? লিটল মনস্টারকে কি কোনো জায়গায় খুঁজে পেয়েছিস? কি হয়েছে, বল না!”
আয়রাক কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল।
তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল—
“না বাদশা… রানীর কোনো খোঁজ পাইনি।
তবে আশেপাশের মানুষ বলাবলি করছিল—
ঝরনার নিচের ওই পানির তলদেশে নাকি অনেক কুমিরের বাস।
তাই আমার কি মনে হয় জানেন… এতক্ষণ যাবৎ যেহেতু রানীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না…
মনে হয় হয়তো তাকে কোনো কুমির…..
আয়রাক আর বাকিটা বলার সুযোগ পেল না।
তার আগেই ওয়াজফান বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে তার গলা চেপে ধরল।
“চুপ!
আমার লিটল মনস্টার কোথাও যেতে পারে না!
ওর কিছু হয়নি—ও মরতে পারে না!
তুই কিভাবে ভাবলি যে ও মারা গেছে?
ও একদম ঠিক আছে… ও আমার কাছে ফিরেই আসবে—দেখিস!”
ধীরে ধীরে ওয়াজফান আয়রাকের গলা ছেড়ে দিল।
আয়রাক হাঁপাতে হাঁপাতে কাশতে শুরু করল।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ে।
তার চোখে জলন্ত কিছু—তবে সেটা পানি নয়, স্পষ্ট বোঝা যায়।
তার মাথা যেন কিছুটা নিচু হয়ে যায়, এবং ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে অদ্ভুত কিছু কথা—
“আয়… আয়রাক… আমার লিটল মনস্টারকে আমার কাছে ফিরিয়ে দে।
আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।
তুই আমার কাছে যেকোনো মূল্যে… আমার লাড্ডুকে ফিরিয়ে এনে দে।
আর যদি ওকে এনে দিতে না পারিস,
তাহলে আমার এই শেষ নিঃশ্বাসটুকুও কেড়ে নে?
আমি চাই না এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে।
দেখ… আমার লাড্ডু আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে,
দেখ… ও আমাকে রেখে যাচ্ছে।
এরকম নিশ্বাসের সঙ্গে আমি বেচে থাকতে চাই না।
এই নিঃশ্বাস নিয়ে তুই আমাকে মেরে দে।
আমি আদেশ করছি, আয়রাক… আমার সব আদেশ পালন তো তুই করিস।
আর তাই মেরে দে আমায়… আমি চাই, আমার লিটল মনস্টারের কবরে…
একই সাথে দুজনকে দাফন করে দেওয়া হোক—
আমাকে, আমার লিটল মনস্টারের কবরে রেখে দিয়ে আয় দেখ ওকে ছাড়া আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাই তুই আমার এই শ্বাস টুকুই কেরে নে না, তাহলেই তো থাকবেনা আর কোন কষ্ট।
কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
আগুনে পুরো দগ্ধ শরীর,
তার ওপর আবার সেই ক্ষত…
পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া অর্ষাকে না পাওয়ার চিন্তা, এই সব কষ্ট…
অবশেষে তার শরীর আর সহ্য করতে পারে না।
জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে।
এই প্রথম সেই সব ভয়ংকর জিনের বাদশা ও ক্যান হারালো যাকে কেউ হাজার আঘাত হাজার বার কষ্ট দিয়েও কখনো এক চুলও ভাঙতে পারেনি। কখনো তাকে তার ভয়ংকর হিংস্রতা থেকে এক চুলও নড়াতে পারেনি সেই ভয়ংকর বাদশা আজকে আর হারালে একটা সামান্য মানব কন্যার জন্য। যেই মানব কন্যাকে একদিন সে সহ্য করতে পারত না।
কথাগুলো মনে মনে ভাবছিল আয়রাক আর ওয়াজফানকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল পারস্য রাজ্যের দিকে।
বারান্দার কাঠের রেল ধরে দাঁড়িয়ে ক্যালিয়ন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। রাতের আকাশে মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছে ঝুম বৃষ্টির পর। তার মনে এক অদ্ভুত উত্তাপ, এক অস্থিরতা—মনের গভীর কোনো হিসেব মিলাচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে সে ভাবছে, কিছুক্ষণ আগে যা ঘটেছিল, যা করতে যাচ্ছিল। মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে অগোছালো চিন্তার ঝলক আর মনে অনুশোচনা।
সে জানে, সে অর্ষাকে ভালোবাসে। শুধু ভালোবাসে না—সম্মান করে, যত্ন করে। আর কখনো তাকে অসম্মান করতে চাইবে না। এই দুই মাস ধরে সে কোনো ভয়ঙ্কর স্পর্শ করেনি, কোনো অসঙ্গত আচরণ করেনি। সে জানে, তার ভালোবাসাকে অপবিত্র হতে দেবে না। সে চায়, বিয়ে করে, তারপর নিজেকে রেড ওয়াইনের কাছে ছুঁয়ে দেখতে।
ক্যালিয়ন নিঃশ্বাস নিয়েই বিড়বিড় করে বলে—
—“অর্ষা অসুস্থ… তাই বিয়েটা করতে পারছিনা। তবে এবার আর দেরি নয়। রাত যেন আর না হয়। খুব জলদি, তাকে কিছু একটা বুঝিয়ে বিয়েতে রাজি করাতে হবে।
তার মনে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—অর্ষা যদিও জানে সে তার স্বামী, তবে সত্যিই তা হয়নি। এই মিথ্যাটা যদি লুকাতে হয়, তবে আমাকে যেভাবেই হোক এটাকে সত্যি করতে হবে।
“অনেক সাধনার পরে আমি আমার রেড ওয়াইনকে নিজের কাছে পেয়েছি। যাই হোক, আমি ওকে হারাতে পারব না। এবার অন্তত আমি তাকে পুরোপুরি নিজের কাছে ধরে রাখবো… সারা জীবনের জন্য।”
তার চোখে determination আর আবেগের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। বারান্দার ঠান্ডা বাতাসে কেবল তার নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে। হঠাৎই মনে হয়—যে স্বপ্নের জন্য এতদিন লড়াই করেছিল, সেই স্বপ্ন আজ হাতের নাগালে। আর এবার আর কোনো দূরত্ব তাকে বিরক্ত করতে পারবে না।
বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ক্যালিয়নের মন শান্ত, কিন্তু উত্তেজনা ভরা। তার চোখে ঝলমল করছে এক অদৃশ্য প্রতিজ্ঞা—যে প্রতিজ্ঞা, যে ভালোবাসা, আর যেটা কোনো শক্তিই ভেঙে দিতে পারবে না।
তার ভাবনার মাঝেই পাশে এসে দাঁড়ায় অর্ষা।
আস্তে করে বলে ওঠে,
“আমি জানি তুমি কি ভাবছো। আসলে তখন আমি ইচ্ছে করে দূরে সরে যাইনি।
আমিতো জানি, তুমি আমার স্বামী।
আমার উপর পুরো অধিকার তোমার আছে।
আমাকে ছোঁয়ার অধিকার… ভালোবাসার অধিকার…
তবুও কেন যেন তখন ওই জিনিসটায় আমার মনে কিছু একটা হচ্ছিল,
সেই জন্যই আমি দূরে সরে গিয়েছিলাম।
তুমি রাগ করো না আমার উপর।
আসলে, আমি যখন থেকে একটু একটু করে সবটা মনে করতে পারছিলাম,
তখন থেকে তো তুমি আমার স্মৃতিতে আছো।
আর কোনো কিছুই তো আমার মনে নেই।
প্রথমে আমি ভাবতাম, তুমি আমার কেউ নও…
কিন্তু যখন থেকে আমার স্মৃতি ফিরে এসেছে,
সেই স্মৃতিতে শুধু তুমি আর আমি—আমাদের ভালোবাসার সব স্মৃতি আছে।
তবুও কেন আজ আমি এরকম করলাম, আমি জানি না।”
ক্যালিয়ন এবার অর্ষাকে টেনে জড়িয়ে ধরে,
“আরো পাগলি… আমিতো জানি আমার রেড ওয়াইন অসুস্থ ছিল, তাই কিছুই মনে করিনি।
আর আমি রাগ করিনি, বরং ভালো হয়েছে।
তুমি আমাকে কোনো ভুল করার থেকে আটকে দিয়েছো।
তবে আমি একটা জিনিস ভেবেছি…
আমি ভাবছি, চলো আমরা আবার বিয়ে করি।
আমাদের বিয়ের স্মৃতি তোমার মনে নেই, তাই আমরা আবার বিয়ে করি।
তাহলে আর তোমার এমন কোনো সমস্যা হবে না,
আর তুমি আমার কাছে আসতে আমার ছোঁয়ায়।
বিয়ের কথাটা শুনে হঠাৎ অর্ষার মনটা খারাপ করলো কেন যেন, মনে মনে ভাবলো—ও তো আমার ভালোবাসা, আমার স্বামী…
তাহলে কেন মনটা এমন যন্ত্রণা দিচ্ছে?
কিন্তু মুখে হেসে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ… চলো, আমরা আবার বিয়ে করবো। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, ক্যালিয়ন।”
ক্যালিয়ন মুচকি হেসে, আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“I love you, my love.”
অর্ষা হাসি নিয়ে ফিসফিস করে উত্তর দিলো,
“I love you too.”
নিকারো রাজ্যের যেন অস্থিরতা নেমে এসেছে।
চারদিকে কোলাহল,
সবাই ছুটোছুটি করছে।
দাসীদের মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে—
“ইসাবেলা পালিয়েছে!
এখন কী করবো?
ড্যানিয়েল স্যার জানতে পারলে তো খবর আছে!”
আসলে ড্যানিয়েল একটু জরুরি কাজে
রাজ্য থেকে বাইরে গিয়েছিলেন।
আর সেই সুযোগেই
সৎ ব্যবহার করে ইসাবেলা
রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
একজন দাস ড্যানিয়েল কে জানাতে —
ইসাবেলা রাজ্য ছেড়ে পালিয়েছে।”
খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে,
ড্যানিয়েলের মুখে রাগ থাকার কথা ছিল,
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে
রাগের বিন্দুমাত্র ফুটে ওঠে না।
বরং তার ঠোঁটে জমে ওঠে
একটি শীতল, ভয়ংকর হাসি।
মনে মনে সে বলে ওঠে—
Death or Alive part 33
**“তুমি কি ভেবেছ, ইসাবেলা…
তুমি আমার কাছ থেকে পালিয়ে মুক্তি পেয়ে যাবে?
না, সেটা কখনোই হবে না।
আমার এই জাল থেকে মুক্তি নেই তোমার জন্য।
বরং এখন থেকে তুমি আরও ভয়ংকর শাস্তি ভোগ করবে—
শুধু এই পালানোর সাহস করার জন্য।
তুমি কখনোই পালাতে পারবে না।
তোমাকে আজীবন আমার হয়েই থাকতে হবে,
আমার জান হয়ে, আমার হয়ে।
Get ready to take my punishment,
baby girl.
