Death or Alive part 38

Death or Alive part 38
priyanka hawlader

সকালটা রাজ্যের আকাশে ভেসে উঠেছে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা নিয়ে। সূর্যের আলো সোনালি আভা ছড়ালেও, বাতাসে যেন জমে আছে এক অজানা শূন্যতা।
কাল যে রাজ্যে এখনো প্রাণের স্রোত বয়ে যেত, সেখানে আজ ছড়িয়ে আছে এক মৃত্যুসংবাদ।
জ্যাইম-এর মৃত্যু।
খবরটা আর শুধু পারস্য রাজ্যের ভেতর সীমাবদ্ধ নেই। দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশের সব রাজ্যে। সীমানা পেরিয়ে গিয়েছে কানাকানি, লোকেদের ভীত কণ্ঠে ভেসে বেড়াচ্ছে সেই শোক সংবাদ।
ড্যানিয়েলের কানে গিয়েছে এই সংবাদ।
তবে আশ্চর্যের বিষয়, যে পরীটার সাথে এই মৃত্যুর গভীর সম্পর্ক—সে এখনো কিছুই জানে না।
কারণ…

সে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে এক চিলতে রুমের অন্ধকার কোনায়।
দিন হোক বা রাত—সে আর বাইরের পৃথিবীর মুখোমুখি হয় না। রাজ্যের ভেতরের বা বাইরের কোনো খবরই তার কানে পৌঁছায় না।
তাই জ্যাইম-এর মৃত্যুসংবাদ এখনো ইসাবেলার কাছে পৌঁছেনি।
এক ভয়ঙ্কর সত্যি, যা দেরি হোক, অবশেষে তার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াবেই।
আর সেই সত্যির সঙ্গে তার মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তই হয়তো বদলে দেবে সবকিছু।
জ্যাইম-এর মৃত্যুসংবাদটি কানে আসতেই ড্যানিয়েল যেন উন্মত্ত হয়ে ছুটে গেল ইসাবেলার কাছে। হৃদয়জুড়ে তীব্র এক অস্থিরতা—এই খবরটা কিভাবে বলবে, খবরটা জানার পর ইসাবেলার অবস্থা কী হবে, সে কি সামলাতে পারবে? নাকি আরও ভেঙে পড়বে? এই ভাবনাগুলো তার মনে ঢেউ তুললেও, বুকের ভেতর থেকে সাহস সঞ্চয় করে সে এগিয়ে চলল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিজের রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল—
এক কোণায় নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে ইসাবেলা। মাথা নিচু, চোখে এক অদৃশ্য শূন্যতা। যেন পৃথিবীর সব রঙ হারিয়ে ফেলেছে সে।
ইসাবেলাকে দেখেই ড্যানিয়েলের বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল। তার পা যেন ভারী হয়ে এল, তবুও ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে।
ইসাবেলা মুখ ফিরিয়ে বসে আছে অন্যদিকে। ড্যানিয়েলের আগমন বুঝতে পারলেও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার।
ড্যানিয়েল কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে তারপর সাহস সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে তার পাশে গিয়ে বসল।
আলতো করে হাত রাখল ইসাবেলার মাথায়। নরম কণ্ঠে, প্রায় ফিসফিস করে বলল—
— “তোমার ভাই… জ্যাইম… আর এই দুনিয়াতে নেই। সে… সে নিজেই নিজের জীবন শেষ করেছে। আত্মহত্যা করেছে সে। ”

কথাগুলো যেন বজ্রপাত হয়ে আঘাত করল ইসাবেলার অন্তরে।
তার নিঃশ্বাস থমকে গেল, চোখ বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। মনে হলো—সে যেন কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে, কোনো ভয়াবহ বিভ্রমে আটকে পড়েছে।
কিন্তু না… এ দুঃস্বপ্নটাই সত্যি।
ইসাবেলা স্থবির হয়ে রইল, কোনো শব্দ বেরোল না তার ঠোঁট থেকে। একেবারে নিস্তব্ধ, অনড়।
তার এই নিস্তব্ধতা দেখে ড্যানিয়েলের বুক কেঁপে উঠল। ভয় পেয়ে গেল সে—এই নীরব ঝড়ের পর ইসাবেলার ভেতরে কী বিস্ফোরণ হতে চলেছে, তা সে কল্পনাও করতে পারছে না।

ড্যানিয়েল ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে ইসাবেলার কাঁপতে থাকা আঙুলের উপর নিজের উষ্ণ হাত রাখল। এক মুহূর্তের জন্য ইসাবেলা চেষ্টা করল নিজেকে সামলাতে, চোখের ভেজা নদী আটকাতে। কিন্তু পারল না। ভেতরে জমে থাকা হাজারো বেদনা, অভিমান আর না বলা কথাগুলো হঠাৎই বাঁধ ভেঙে দিল। সে ভেঙে পড়ল।
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ ঘর ভরিয়ে তুলল। ইসাবেলা অসহায় শিশুর মতো ড্যানিয়েলের বুকে মুখ গুঁজে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। তার দমবন্ধ করা কান্না ড্যানিয়েলের বুক ভিজিয়ে দিচ্ছিল, বুকের ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলছিল।
ড্যানিয়েল কোনো কথা বলল না। শুধু নিঃশব্দে তাকে জড়িয়ে ধরে রাখল, যেন নিজের বাহুতে একটা ভেঙে পড়া পৃথিবী আগলে রেখেছে। তার বুকের উষ্ণতা, হাতের শক্ত আগল আর নিশ্চুপ আশ্বাসে ইসাবেলার ভাঙাচোরা হৃদয়টা একটু একটু করে শান্ত হতে লাগল।

সেই মুহূর্তে তাদের মাঝের রাগ, অভিমান, দূরত্ব—সবকিছু যেন মিলিয়ে গেল। ভুলে গেল তারা অতীতের আঁধার, ভুলে গেল তিক্ততা। মনে হলো, এ এক নতুন ভোরের শুরু, যেখানে কেবল দুজনেই আছে—শুধু ইসাবেলা আর ড্যানিয়েল।
ড্যানিয়েলের কানে কেবল শোনা যাচ্ছিল ইসাবেলার কান্নার শব্দ। আর ইসাবেলা অনুভব করছিল, ড্যানিয়েলের বুকের ভেতরে এক নীরব প্রতিজ্ঞা—

“যাই হোক না কেনো তোমাকে আর কখনো ভেঙে পড়তে দেব না আমি।”
ধীরে ধীরে কান্না সামলে নিয়ে ইসাবেলা ড্যানিয়েলের বুক থেকে মাথা তুলল। চোখে তখনো জল চিকচিক করছে, কণ্ঠ কাঁপছে ভয় আর দ্বিধায়। অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে সে মৃদু স্বরে বলল—
—“আমি যেতে চাই আমার ভাইয়ের কাছে… আমার রাজ্যে… অন্তত শেষবারের মতো। প্লিজ, আমাকে নিয়ে চলুন না। সামান্য কিছুক্ষণ হলেও… আমি আমার রাজ্যে থাকতে চাই। তারপর চাইলে আমি আবারও আপনার সঙ্গে ফিরে আসব এই রাজ্যে। প্লিজ, নিয়ে চলুন না।”

ড্যানিয়েল কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ইসাবেলা ভেবেছিল, এবারও হয়তো কঠিন মুখে সে না বলে দেবে। আগেও তো তাই করেছে। বাবার মৃত্যুর সময়ও ইসাবেলা আবদার করেছিল, কিন্তু ড্যানিয়েল কোনোভাবেই রাজি হয়নি। বলেছিল, “সেখানে গেলে ওয়াজফান আমাদের মানবে না, উল্টো অপমান করে ফিরিয়ে দেবে।” সেই অভিমানে ইসাবেলা নিজের বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে পর্যন্ত যেতে পারেনি।
কিন্তু এবার যেন অন্য ড্যানিয়েল। এক অচেনা শান্ত স্বরে সে হঠাৎ বলল—
—“ঠিক আছে, চলো। দেরি না করে এখনই রওনা হবো তোমার রাজ্যের উদ্দেশ্যে।”

কথাটা শুনে ইসাবেলা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। চোখ বড় বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না—একটা কথায় রাজি হয়ে গেল ড্যানিয়েল! সে তো ভেবেছিল অনেক অনুনয়-বিনয় করতে হবে, হয়তো আবারও প্রত্যাখ্যান করবে তাকে। কিন্তু না, এবার যেন নিজের সমস্ত আপত্তি ভুলে গিয়েছে সে।
তবে এসব ভাবনার সময় এখন নয়। বুক ভরে এক অদ্ভুত স্বস্তি অনুভব করল ইসাবেলা। দীর্ঘদিনের জমে থাকা তৃষ্ণা যেন এক মুহূর্তে মিটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল সে। আর ড্যানিয়েলের হাত ধরে রওনা হল নিজের রাজ্যের উদ্দেশ্যে—
যেখানে অপেক্ষা করছে অজানা এক মুখোমুখি, অচেনা এক পরিণতি।

ড্যানিয়েল ও ইসাবেলা পারস্য রাজ্যে পৌঁছাবার আগেই এই খবর পৌঁছে গিয়েছে ওয়াজফান এর কান অব্দি।
এ খবর পাওয়া মাত্রই রেগে উঠে ওয়াজফান তার চোখ আগুনের মত দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে হুট করেই মুক্তিবদ্ধ হয়ে যায় তার হাত জোড়া ।
সে দ্রুত ছুটে আসে সদর দরজার সামনে।
ইসাবেলা ও ড্যানিয়েল আসলেই জানো, সে সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দেবে—এই ভাবনা নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে ওয়াজফান।
কিছুক্ষণ পরেই মেন গেটের সামনেই এসে দাঁড়ায় ড্যানিয়েল ওই ইসাবেলা ।
ইসাবেলা নিজের ভাইকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য এগিয়ে যায়।
আর তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে—

“দা ভাই… তুই!”
তবে ইসাবেলা জড়িয়ে ধরার আগেই ওয়াজফান নিজের জায়গা থেকে দূরে সরে যায়। তার কণ্ঠে নেমে আসে কঠোরতা, যেন বরফ শীতল ঝড়—
**“এই পৃথিবীতে আমার কোনো বোন নেই আর তাই আমি অন্য কোন ব্যক্তির মুখে ‘দা ভাই’ নাম ডাকটাও শুনতে চাই না। হ্যাঁ, আমার একটা বোন ছিল… তবে সে অনেক আগেই আমার কাছে মারা গিয়েছে। আর তাই এখন আর আমি চাই না আমার রাজ্যের আশেপাশেও কোনো শত্রু দলের নেকড়ে স্ত্রীকে দেখতে।
তাই এখান থেকে নিজেদের সম্মানের সাথে ফিরে যা। নয়তো আমার খারাপ রূপ দেখতে বাধ্য হবে। আমি কোনো নেকড়ে স্ত্রীর সাথে নিজের ভালো রূপটাকে দেখাতেও পারবো না। যদি তোমরা এখান থেকে ফিরে না যাও, তবে আমার নিম্নতম খারাপ রূপ দেখাতে হলে—আমি সেটাও দেখাবো।
তাই আমার খারাপ রূপ দেখতে না চাইলে এক্ষুনি, আর এক মুহূর্ত দেরি না করে, আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা।”**

কথাগুলো যেন ছুরির ফলার মতো সোজা এসে বিদ্ধ করে ইসাবেলার বুক।
সে কি তবে তা হলে নিজের দুই ভাইকে হারিয়ে ফেলেছে—এই ভয়ঙ্কর ভাবনা হঠাৎই তার মাথায় ঘুরে বেড়াতে থাকে।
তবুও, ভাঙার ভয়কে পেছনে ফেলে ইসাবেলা অনন্ত চেষ্টা করে যায়—ওয়াজফানের চোখে নিজের প্রমাণ রাখার জন্য। সাহসের জোয়ারে বুক ভরে, নিঃশ্বাস নিয়েই সে ধীরে ধীরে বলে—

“দা ভাই, তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। প্লিজ, দয়া করে ভুল বুঝিস না আমায়। প্লিজ, আমি যা ভুল করেছি, তার জন্য ক্ষমা করে দে আমায় সকল ভুলেরই তো ক্ষমা হয়। তুই আমাকে একটিবারের জন্য ক্ষমা করে দে না। আমি নিজে ভুলের জন্য অনুতপ্ত। প্লিজ, তুই আমাকে ফিরিয়ে দিস না এখান থেকে। প্লিজ, দা ভাই, আমাকে জ্যাইম-এর মৃতদেহ রাখার স্থানে একটিবার যেতে দে। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, আমি দূর থেকে শুধু স্থানটাকে একটিবার দেখব। একটি বার জ্যাইম এর রুমে গিয়ে একটু ঘুরে দেখব, তারপর আবার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যাব নিজের রাজ্যে। দা ভাই, অত্যন্ত এটুকু সুযোগ তো তুই আমাকে দে। দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে দিস না।”
ওয়াজফান মানে না। এবার তার রাগের চরম লেভেলটা আরও বেড়ে যায়।
ওয়াজফান হুংকার ছেড়ে বলে ওঠে—

**“আমি বলেছি না, আমি অন্য কারো মুখে ‘দা ভাই’ ডাক শুনতে চাই না। আর হ্যাঁ, কেউ অনুতপ্ত বোধ করুক বা না করুক, আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। ভুল যেহেতু করে ফেলেছিস তবে তার শাস্তি তোকে আজীবন পেতে হবে।
এরপর সে কিছুক্ষণ থেমে একটা বাঁকা হাসির সাথে আবারপ বলে উঠে,
ও আচ্ছা, এখন বুঝি তোর মনে পড়ছে নিজের রাজ্যের কথা। কেন, যখন আমি ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলাম, তখন তুই নেকড়ে দলের শত্রুদের সাথে হাত মিশিয়ে আমাকে ওখান থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে, তাই না? তখন তোর তো মনে পড়ে নি তোর বাবার কথা, ভাইয়েদের কথা? এখন একেবারে দরদ উতলে পড়েছে নাকি? আর না হয় হবে হয়তো এই শত্রু দলের লোকেরা তোকে এখন ধোকা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে? এজন্য তোর নিজের রাজ্যের কথা মনে পড়ছে।

যাইহোক, কোন নেকড়ের স্ত্রী সাথে কী হচ্ছে—এসব কিছু জানা আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই। শুধু এতোটুকু ভালো করে শুনে রাখ—আমার বোন অনেক আগেই মারা গিয়েছে। আর তাই আমি এখন কোন নেকড়ে স্ত্রীর মুখে ‘দা ভাই’ ডাক শুনতে চাই না।
তুই তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলি, না? এখন তোর ভালোবাসা কোথায় গেল? জানালা দিয়ে পালিয়েছে নাকি, যে তুই ছুটে এখানে এসেছিস? কি হয়েছে? এখন তোর স্বামী কি তোকে ছেড়ে দিতে চাইছে নাকি? এখন তোর এই রাজ্যের কথা মনে পড়ছে? কই বাবা তো মারা গিয়েছিল, তাই না? তখন তো তোর বাবার কথা মনে পড়ল না। তখন তো প্রয়োজন বোধ করলিও না—বাবাকে শেষবার দেখতে আসার জন্য।
তবে এখন কেন জ্যাইম-এর জন্য তোর দরদ উতলে পড়ছে? এটা কি শুধু জ্যাইমকে একবার দেখতে চাওয়া, নাকি কোন শত্রু বিষাক্ত বাহানা দিয়ে তুই আমার রাজ্যে ঢুকতে চাইছিস? তাই না? আর এরপর রাজ্যকে ধ্বংস করার সন্ধি ফাটবি তুই তো শত্রু দলের লোকেদের সাথে আগেই মিশে গিয়েছিস, আর এখন তাদের মতোই কাজ করছিস হয়তো তাই হবে।

কথাগুলো শুনে ইসাবেলা স্তব্ধ হয়ে যায়। সে যেন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে—বু‌ঝতে পারছে না, যে তাকে ছোটবেলা থেকে আগলে রেখেছে, কতটা ভালোবাসতো, সে আজ এতটা কঠোর হতে পারছে কেন? সে কি ও জানে না ইসাবেলা কখনোই নিজের ‘দা ভাই’-এর ক্ষতি করবে না?
এই কথাগুলো যেন তার বুকে তীরের মতো আঘাত হানে। ইসাবেলা নিশ্চুপ হয়ে গেলেও, এবার ড্যানিয়েল আর চুপ থাকতে পারে না। সে নিজের স্ত্রীর উপরে এসব অপবাদ মেনে নিতে পারছে না। গম্ভীরভাবে, স্থির কণ্ঠে, সে এবার ওয়াজফানকে থামানোর চেষ্টা করে এবং বলেঃ

“দেখুন, আপনি…”
তবে ড্যানিয়েলকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, ওয়াজফান এক হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেঃ
**“আমি চাই না কোন শত্রু দলের নেকড়ের সাথে কথা বলে নিজের মুখ নষ্ট করতে, কারণ আমি পক্ষের সাথে মুখে কথা বলার চাইতে তাদের শরীরে তরোয়াল চালাতে বেশি ভালোবাসি । আমি এতক্ষণ শান্ত ছিলাম, তাই তোমাদের সঙ্গে ভালো ভাবে কথা বলেছি, আর নয় তো, আমি যদি রেগে যেতাম, তাহলে দেখা যেত—এতক্ষণ এখানে লাশের বন্যা বয়ে যেত।

আমি শান্ত আছি, আমাকে শান্তই থাকতে দাও। আর নয় তো, আমি এক মুহূর্ত না ভেবে তোমাদের উপর তলোয়ার চালিয়ে দিতে পারি। আমি শেষবারের মতো ভালই ভালই বলছি—চলে যাও আমার রাজ্য থেকে। এখান থেকে চলে যাও, আর কখনো যেন আমি তোমাদের ছায়াও আমার রাজ্যের আশেপাশেও না দেখি। আর নয়তো খুব খারাপ হবে।
আর হ্যাঁ, যদি এরপরও তোমাদের মুখে বলতে হয় এখান থেকে যাওয়ার কথা , তবে আমি আর মুখে নয়, ডিরেক্ট দুটো লাশের বন্যা বইয়ে দেবো এখানে। আর তারপর সেই লাস্ট দুটোকে রেখে আসবে তোমাদের রাজ্যে। তাই এখন তোমরাই ভালো জানো—তোমরা সুস্থভাবে এখান থেকে চলে যাবে নাকি, আমি তোমাদের লাশ বানিয়ে পাঠাবো এখান থেকে।”**

কথাগুলো ইসাবেলার বুক ভেদ করে আঘাত হানল, ঠিক যেন তার বউকে কেউ বারবার তলোয়ার দিয়ে আঘাত করছে।
ইসাবেলা ধুপ করে মাটিতে বসে পড়ল, চোখ ভেজা হয়ে কেঁদে উঠল। তার কান্না যেন তার সমস্ত ভয়, হতাশা ও বেদনা একসাথে বের করে দিচ্ছে।
ড্যানিয়েল ইসাবেলাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে, আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। কোনো শব্দও বাড়াল না, শুধু শান্তভাবে এগিয়ে গেল। ইসাবেলার সামনে বসে, নিজের দুই হাত ইসাবেলাকে ঘিরে ধরে, ধীরে ধীরে তাকে মাটির কোলে থেকে তুলে দাঁড় করাল।

তারপর, একসাথে পা বাড়িয়ে, তারা ধীরে ধীরে নিজের রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা হতে শুরু করলো।
তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো একটি কণ্ঠ—
“আরে ইসাবেলা তুই এতদিন পর এখানে এসেছিস? আর তুই আমার সাথে দেখা না করেই এখান থেকে চলে যাচ্ছিস!”
কণ্ঠের তীব্রতা যেন সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করল। ইসাবেলা হঠাৎ ঘুরে তাকাল, আর সেই সঙ্গে ওয়াজফানও দূর থেকে ছুটে আসতে দেখল অর্ষাকে।

অর্ষা, দ্রুতগতিতে এগিয়ে এসে, জড়িয়ে ধরল ইসাবেলাকে। চোখে চোখ রেখেই বলল,
“কেমন আছিস তুই? কোথায় ছিলে এতদিন? জানিস, অনেক দিন যাবত তোকে দেখি না, আমি খুব মিস করছিলাম। আর তুই কিরকম সই রে—এখানেই এসে, আর আামর সাথে দেখা না করেই চলে যাচ্ছিস? কিভাবে পারলি তুই আমার সাথে দেখা না করে চলে যেতে? তোর কি একটু আমার কথা মনে পড়ে না?”
ইসাবেলার বুক ধক ধক করতে লাগল, চোখ ভরে এল আবেগ, আর চারপাশের বাতাস যেন এই আবেগকে আরও তীব্র করে তুলল।

ইসাবেলা অর্ষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কণ্ঠে কেঁপে ওঠা ভাব, চোখে মিশ্রিত অনুভূতি—
“মনে পড়ে তো? খুব বেশি মনে পড়ে। আমার, তোমাকে ভাবি, তোমার কথা, এই রাজ্যের কথা—সবই খুব বেশি মনে পড়ে। এই রাজ্যের সকলকে আমি খুব বেশি মিস করি। তবে আমার মনে রাখাতে তার কিছু আসে যায় না। আমি তো এখন হাজার চাইও আর, এই রাজ্যে ফিরে আসতে পারবো না। আর, আমাকে দা ভাই মেনেও নেবি না। আমি যে ভুল করেছি, তারপর আর কখনো সে আমাকে মেনে নেবে না। থাক, তাই বাধ্য হয়ে চলে যেতে হচ্ছে, আমাকে এই রাজ্য ছেড়ে।”

ইসাবেলার কথাগুলো শুনে অর্ষা হঠাৎ ওয়াজফানের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। চোখে চোখ রেখে, কণ্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে বলল—
“ক্যালিয়ন, তুমি কেন এরকমটা করছো? কেন ইসাবেলাকে এ রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছো? তুমি কি জানো না ও আমার সই? তবে তুমি কেন ওকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছো? ইসাবেলাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিও না, প্লিজ। ও খুব ভালো মেয়ে, আমি ওকে খুব পছন্দ করি। প্লিজ, ক্যালিয়ন, ওকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিও না।”
অর্ষাকে এরকম দেখে ওয়াজফান বেশ অবাক হয়ে গেল। তবে কি তার লিটল মনস্টারের ইসাবেলার কথা মনে আছে? তবে কি এখন ইসাবেলার একমাত্র পথ, যে কিনা তার লাড্ডুকে তার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবে। তবে কি ইসাবেলার মাধ্যমেই ধীরে ধীরে তার লিটল মনস্টার আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারবে—এই ভাবনাগুলোই যেন ওয়াজফানের মাথায় নাড়া দিয়ে ওঠে। ওর মধ্যে চলতে থাকা রাগ ও আগুন সবটা শান্ত হয়ে যায়।
যদি এখন ইসাবেলার মাধ্যমেই লিটল মনস্টার নিজের স্মৃতি ফিরে পেতে পারে—এটা ভেবেই ওয়াজফান এবার কিছুটা শান্তভাবে ঘোষণা করল:

“এই রাজ্যের মহারানী যখন চেয়েছে যে তুই এই রাজ্যেই থাক, তবে আমি শুধু তার অনুরোধেই তোমাদের এই রাজ্যে থাকার অনুমতি দিচ্ছি। তোমরা এই রাজ্যে থাকতে পারো, শুধুমাত্র এ রাজ্যের মহারানীর চেয়েছে বলে। তবে হ্যাঁ, আমি স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছি, কোন নেকড়ে স্ত্রী এই রাজ্যে থাকাকালীনও যেন আমাকে ‘দা ভাই’ বলে না ডাকে। আমি শুধু তাকে থাকতে দিচ্ছি আমার মহারানীর আদেশ পালন করার জন্য। তাই তোমরা যেন এখানে মহারানীর গেস্ট হিসেবেই থাকবে। এর চেয়ে বেশি আর কিছু নয়।”
কথাগুলো বলেছি অর্ষাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।

ইসাবেলা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সত্যিই অবাক হয়ে সবকিছু দেখছিল। মনে মনে ভাবছিল—অর্ষা কেন তার দা কে ক্যালিয়ন বলে ডাকছে? ব্যাপারটা তার মাথায় একেবারেই ঢুকছিল না। তবে এখন ওয়াজফানের বলা কথাগুলোই তার কানে বারবার বাজছিল। ওয়াজফান তাকে এখানে থাকার অনুমতি দিয়েছে—হোক না সেটা শুধু ভাবির জন্য। তবুও ধীরে ধীরে যদি সে এখানে থাকে, তবে একদিন না একদিন তার দা এর মন গলবেই। এই ভেবেই ইসাবেলার বুকের মধ্যে এক ধরনের শান্তি নেমে এল। আপাতত অর্ষা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, সেটা পরে জানবে।
সে ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হঠাৎ পেছন থেকে ড্যানিয়েল তার হাত টেনে ধরল।

— “কোথায় যাচ্ছ?”
ইসাবেলা বিস্মিত চোখে তাকাল,
— “কেন? ভেতরে। চলো।”
ড্যানিয়েলের চোখে স্পষ্ট বিরক্তি ও দৃঢ়তা,
— “তোমার ভাই তোমাকে বোন হিসেবে মেনে নেয়নি, শুধু তার বউয়ের কথায় এখানে দয়া করে থাকতে দিয়েছে। আর তুমি তাও এখানে থাকতে চাও? না, ইসাবেলা। তুমি এক্ষুনি আমার সঙ্গে আমার রাজ্যে ফিরে যাবে। এখানে থাকার কোন দরকার নেই।”
ইসাবেলা করুণ চোখে ড্যানিয়েলের দিকে তাকাল। তার ঠোঁট কাঁপছিল, গলায় কান্না জমে ছিল। ধীরে ধীরে অনুরোধের সুরে বলল—

— “প্লিজ ড্যানিয়েল… এমন করবেন না। একদিন ভাই ঠিকই আমাকে মেনে নেবে। আপনি শুধু আমাকে এখানে থাকার সুযোগ দিন। আমি কথা দিচ্ছি, আমি কোথাও পালাবো না… আমি সারাজীবন আপনার সঙ্গেই থাকব। আপনি চাইলে এখনই রাজ্যে ফিরে যেতে পারেন… কিন্তু আমাকে কিছুদিন এখানে থাকার সুযোগ দিন। প্লিজ…
আর যদি আমাকে এখানে একা রেখে না যেতে চান তাহলে আমার সঙ্গে এখানেই থাকুন, ড্যানিয়েল…”
কথাগুলো বলতে বলতে সে ভেঙে পড়ল। কান্নায় ভিজে যাচ্ছিল তার মুখ, চোখদুটো লাল হয়ে উঠল।
ড্যানিয়েল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হৃদয়ের গভীরে নরম স্রোত বয়ে গেল। ইসাবেলা তো সত্যিই এতদিন ভীষণ কষ্ট করেছে—নিজের পরিবার থেকে দূরে থেকে, একা একা লড়াই করে। আজ সে যদি তার ছোট্ট একটা ইচ্ছা পূরণ করতে চায়, তবে কেন না করবে?

নিজের ভেতরের দ্বিধা গিলে নিয়ে ড্যানিয়েল গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল সম্মতির ভঙ্গিতে।
— “আচ্ছা ইসাবেলা… থাকো। আজ না হয় আমি-ও তোমার সঙ্গে এখানেই থাকলাম। যদি এতে তোমার মন শান্তি পায়। তবে মনে রেখো… এর পরেও তুমি আমারই থাকবে, আমার রাজ্যেই ফিরে আসবে।”
ইসাবেলার মুখ ভিজে গেল স্বস্তির অশ্রুতে। সে নিঃশব্দে ড্যানিয়েলের বুকের সঙ্গে মুখ লুকিয়ে রাখল।
ইসাবেলা মনে মনে ভাবছিল— “ড্যানিয়েলকে আমি যতটা খারাপ ভেবেছিলাম, ড্যানিয়েল আসলে ততটা খারাপ নয়। আজ সকাল থেকে সে আমার জন্য কত কিছুই না করল। দা-এর এত কঠিন কথাও চুপচাপ সহ্য করল… আর এখন আমাকে এখানে থাকতে দিতেও রাজি হয়ে গেল। তবে কি সত্যিই ড্যানিয়েল আমাকে ভালোবাসে? তবে কি সেদিন সে শুধু একটা ভুলই করেছিল…?”

এইসব ভাবতে ভাবতেই তারা ভিতরের দিকে এগিয়ে গেল।
ভেতরে ঢুকেই ইসাবেলার চোখ পড়ল জ্যাইম-এর ছবির ওপর। ছবিটা দেখামাত্রই বুক ভেঙে কান্না বেরিয়ে এলো তার। দমে দমে কাঁদতে লাগল সে।
ড্যানিয়েল নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে ইসাবেলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, তার চোখের অশ্রু বুকের ভেতর লুকিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগল।
ঠিক তখনই রাজপ্রাসাদের দাসীরা এসে তাদের কাছে মাথা নত করল। নীরবে এগিয়ে এসে ইশারায় পথ দেখাল, যাতে তারা থাকার ঘরে যেতে পারে। ধীরে ধীরে দাসীদের সঙ্গে তারা চলে গেল নির্ধারিত কক্ষে থাকার জন্য।
কক্ষে প্রবেশ করতেই ড্যানিয়েল সোজা চলে গেল গোসলখানার দিকে, হাত-মুখে পানি দিতে।
এই সুযোগে ইসাবেলা নীরবে পাশে দাঁড়ানো এক দাসীকে ডেকে নিল। ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করল—

— “বল তো, অর্ষা কেন আমার দা-কে ক্যালিয়ন বলে ডাকছে? এভাবে কেন আচরণ করছে?”
দাসী কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল গত কয়েক মাসে কী কী ঘটেছে।
প্রতিটি শব্দ যেন ইসাবেলার বুক ভেদ করে যাচ্ছিল। দাসীর মুখ থেকে শোনা ঘটনাগুলো শুনে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগে ড্যানিয়েলের জন্য তার মনে যে সামান্য জায়গা তৈরি হচ্ছিল, তা মুহূর্তেই গলে গেল।
“তাহলে এতোদিনে… ক্যালিয়ন এমন সব করেছে! আর ড্যানিয়েল কি জানে না? না… নিশ্চয়ই জানে। বরং… হয়তো ক্যালিয়নকে এসব করতে সাহায্য করেছে। তাহলে…”

এই ভেবে ইসাবেলার বুক আবারো ঘৃণায় ভরে উঠল।
ঠিক তখনই ড্যানিয়েল গোসলখানা থেকে বেরিয়ে এসে তাকে দেখে বলল—
— “এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন, ইসাবেলা? চলো, তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও।”
বলে সে এগিয়ে এসে তার হাত ধরতে গেল।
কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে ইসাবেলা হাতটা ছাড়িয়ে নিল। কণ্ঠে রাগ, চোখে বিদ্বেষ—
— “বলেছি না! আমাকে ছোবেন না। আমাদের সম্পর্কের কিছুই ঠিক হয়নি। ভেবেন না আমি আপনার সঙ্গে কিছুটা ভালোভাবে কথা বলেছি বলে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। না! আমি আপনাকে ভালোবাসি না… আমি এখনো শুধু ঘৃণা করি আপনাকে। শুধুই ঘৃণা!”
বলে ইসাবেলা দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
ড্যানিয়েল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে।
ইসাবেলার বলা কথাগুলো যেন বিষাক্ত তীরের মতো তার বুকে গেঁথে যাচ্ছিল, আর সেই যন্ত্রণায় তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছিল।

এভাবে কেটে যায় কিছুদিন।
ইসাবেলার সংস্পর্শে এসে অর্ষা ধীরে ধীরে আগের তুলনায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে। আগের মতো আর সারাক্ষণ “ক্যালিয়ন, ক্যালিয়ন” বলে ওঠে না। যদিও মাঝেমধ্যে বলে ফেলে, তবুও ইসাবেলা তখন তাকে বোঝায়—এটা কী, ওটা কী, কোনটা ক্যালিয়ন নয়, কোনটা আসল। যেন প্রতিদিনই অর্ষা নতুন করে পৃথিবীটা চিনতে শিখছে ইসাবেলার হাত ধরে।
সবকিছু যেন নতুন করে শুরু হচ্ছে। তবে থেমে আছে শুধু একটি সম্পর্ক—ড্যানিয়েল আর ইসাবেলার। যেখানে এখনো কোনো কিছুই বদলায়নি।

ওয়াজফান ব্যস্ত থাকে অর্ষাকে নিয়ে—রাজ্য দেখা, সময় দেওয়া, তার যত্ন নেওয়া। ইসাবেলা আর ড্যানিয়েলের সঙ্গে সে একটিও কথা বলে না। রাজ্যে তাদের অতিথি হিসেবে জায়গা দিয়েছে, অতিথি আপ্যায়নে কোনো খামতি রাখেনি, কিন্তু তাদের প্রতি কোনো আগ্রহও দেখায় না।
তবুও একটি বিষয় ওয়াজফানের চোখ এড়ায়নি।
সে লক্ষ্য করেছে—ড্যানিয়েল সত্যিই ইসাবেলাকে ভালোবাসে। এ কয়দিনে সেটা স্পষ্ট বোঝা গেছে। ড্যানিয়েল কখনো তাকে অবহেলা করে না, কখনো দূরে সরিয়ে রাখে না। বরং প্রতিটি মুহূর্তে যত্ন, স্নেহ, ভালোবাসা দিয়েই ঘিরে রাখে।
কিন্তু ইসাবেলার দিকটা ভিন্ন। সে সবসময়ই ড্যানিয়েলের প্রতি দূরত্ব বজায় রাখে, অচেনা অচেনা আচরণ করে।
ওয়াজফান এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। তার কাছে এখন শুধু একটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—তার লিটল মনস্টার, অর্ষা।

যদি ইসাবেলার উপস্থিতিতে অর্ষা সুস্থ হয়ে ওঠে, তবে সে সন্তুষ্ট। কিন্তু একবার অর্ষা পুরোপুরি আগের মতো হয়ে গেলে, তখন আর কোনো কারণ থাকবে না ইসাবেলা আর ড্যানিয়েলকে রাজ্যে রাখার।
এইসব চিন্তা মাথায় ঘুরছিল ওয়াজফানের। করিডরের লম্বা নিস্তব্ধতা ভেঙে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছিল। রাজপ্রাসাদের বিশাল অন্দরমহল, চারদিকে শুধু পাথরের দেয়ালে মশালের ক্ষীণ আলো, আর পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনির মতো ফিরে আসছিল।
হঠাৎই তার দৃষ্টি আটকে গেল পাশের একটি অন্ধকার কক্ষে।
দরজার ভেতর থেকে যেন চাপা কোনো আওয়াজ ভেসে আসছিল।
কৌতূহলী হয়ে থেমে দাঁড়াল ওয়াজফান।
“কে হতে পারে?” — মনে প্রশ্ন জাগল তার।

এ রুমে তো সাধারণত কেউ থাকে না। এক পা, দুই পা… সাবধানে ভেতরে প্রবেশ করল সে। ঘরের ভেতরটা প্রায় আঁধারে ঢাকা। মশালের আলোও সেখানে পৌঁছায়নি, কেবল সামান্য ক্ষীণ আলোয় দেখা গেল—
মাটিতে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে আয়রাক।
ওয়াজফানের চোখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠল।
আয়রাক—তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষী, সবসময় কঠিন ও অটল, যাকে কখনো ভাঙতে দেখেনি সে… আজ তাকে এভাবে ভাঙা অবস্থায় দেখে এক অজানা অস্বস্তি ছুঁয়ে গেল মনের ভেতর।
কেন এভাবে? কী এমন ঘটেছে?
ওয়াজফান এগিয়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল।
ওয়াজফান খানিকটা গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন—

—“কি হয়েছে? এভাবে এখানে বসে আছো কেন?”
তার কণ্ঠ শোনামাত্রই আয়রাক তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে উত্তর দিল,
—“না বাদশা, তেমন কিছু হয়নি… এমনি বসে আছি।”
ওয়াজফানের চোখে তখন রাগের ঝলক। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বললেন,
—“তুমি ভুলে গেছো আমি কে! আমি হলাম ওয়াজফান কায়স্থ। আমার সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যে বলে আমাকে এড়িয়ে যাবে—আর আমি বুঝব না? এটা তুমি ভাবলে কি করে?”
আয়রাক এবার আরও নিচু করে ফেলল মাথা। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। শান্ত অথচ আঘাতভরা গলায় সে বলতে শুরু করল,

—“আপনি ঠিকই বলেছিলেন, বাদশা… মানুষ জাতি ভালো নয়। মানুষই সবচেয়ে বহুরূপী প্রাণী। মানুষ শুধু ঠকাতে জানে।”
ওয়াজফান আয়রাকের কথা শুনে কিছুতেই অর্থ বুঝতে পারল না। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। আয়রাক তখন যেন বুকের ভেতরে জমে থাকা সবকিছু একসাথে উজাড় করে দিতে শুরু করল—
—“বাদশা… আপনি তো আমাকে প্রতি মাসেই বাংলাদেশে পাঠাতেন মহারানীর খোঁজ নিতে, তার ভার্সিটির খবর জানার জন্য। সেখানে গিয়ে আমি সবসময় তার বন্ধু ইয়ানার সঙ্গে দেখা করতাম। কখন যে ইয়ানাকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিল, আমি নিজেও জানি না। এরপর আর শুধু দায়িত্বের জন্য নয়, নিজের ইচ্ছাতেই প্রতিবার ছুটে যেতাম সেখানে… কেবল ইয়ানার জন্য।

কিন্তু মহারানী যখন রাজ্যে ফিরে এলেন, তখন আপনি আর আমাকে সেখানে যেতে বলেননি। তবুও আমি যেতাম… শুধু ইয়েনাকে এক ঝলক দেখার জন্য। আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম, বাদশা। অজান্তেই, অকারণেই—তবু সত্যি বলছি, আমি তাকে ভীষণ ভালোবেসেছিলাম।
কালও গিয়েছিলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু… আমি তাকে দেখলাম অন্য এক পুরুষের বুকে জড়িয়ে আছে। আমার ভালোবাসা, আমার অনুভূতি—সে কোনোদিনই বুঝতে পারেনি। আমি প্রতিবার তার কাছে ফিরে ফিরে যেতাম, অথচ সে কি একবারও ভাবল না কেন? নাকি সে বুঝেও ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে উপেক্ষা করল?
হয়তো… সে জানে আমি জ্বীন। আর সেই কারণেই কি আমাকে এভাবে অবহেলা করল? বাদশা, আমার হৃদয়টা কেন এমন করে ভেঙে দিল সে…!”
আয়রাক হঠাৎই ভেঙে পড়া কণ্ঠে বলে উঠল—

—“একতরফা ভালোবাসা কি এতটাই কঠিন, বাদশা? সে কি আমার হতে পারত না? সে মানুষ হয়েছে তো কী হয়েছে—মহারানীও তো এই রাজ্যে মানুষ হয়েও আপনাকে ভালোবেসেছে। তবে কেন ইয়ানা আমাকে ভালোবাসতে পারল না?”
ওয়াজফান গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল—
—“একটা কথা মনে রাখবে, আয়রাক। ভালোবাসা কখনো একতরফা হয় না। যাকে ভালোবাসো তাকে ছিনিয়ে নিতে শিখতে হয়। না হলে ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ বলে নাটক করার কোনো মানে নেই।

ভালোবাসা বলতে কিছু হয় না—সবটাই আসক্তি। আর এই আসক্তি যদি সত্যিই তীব্র হয়, তবে যার প্রতি আসক্ত, তাকে তুমি পুরো পৃথিবীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসবে। যদি সেই ক্ষমতা তোমার থাকে, তাহলেই ভালোবেসো। আর যদি না থাকে, তবে চার দেয়ালের ভেতরে বসে কান্নাকাটি করা, নিজেকে করুণ প্রমাণ করার কোনো মানে নেই।
দেখো আমাকে। আমি আমার লিটল মনস্টার—আমার অর্ষাকে পুরো পৃথিবীর কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছি। সে আমাকে ভালো না বাসলেও আমার কাছেই তাকে থাকতে হতো, সারা জীবন আমার বন্দী হয়েই থাকবে… আমার হয়েই থাকবে।”

এই কথাগুলো শেষ করে ওয়াজফান আর একবারও পেছনে না তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
আয়রাক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওয়াজফানের পদচারণার শব্দ যত দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, ততই তার বুকের ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। যেন বুকের ভেতরে অদ্ভুত আগুন জ্বলে উঠল। তার হৃদয় যেন কাঁপতে লাগল—ভেতর থেকে একটা শক্তি উঠে আসছে, যা আগে কখনো অনুভব করেনি।
ওয়াজফান যা বলেছিল—যাকে ভালোবাসো তাকে ছিনিয়ে নিতে হবে, আর ক্ষমতা থাকলে তাকে নিজের কাছে আনতে হবে—সেই কথাগুলো এখন তার মনে নতুন প্রেরণা যোগ করছিল। আর সে বুঝতে পারল, আর চুপচাপ বসে থাকা নয়।

“না,” নিজের ভেতরে বলল আয়রাক, “আমি আর অপেক্ষা করব না। আমি বসে থেকে কিছু পাব না। আমার ভালোবাসা চাই ঠিকই চাই, আর যেভাবেই হোক, আমি তা পেতে চাই।”
ওয়াজফানের সেই তীব্র, কিন্তু স্পষ্ট নির্দেশনা—যার মধ্যে অসীম দৃঢ়তা আর সাহস ছিল—এবার আয়রাককে নিজের প্রিয়জনের দিকে এগিয়ে যেতে প্ররোচিত করল। সে বুঝল, তাকে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, নিজের ভালোবাসার জন্য লড়াই করতে হবে, আর আর কেউ তার জন্য লড়বে না।

Death or Alive part 37

আয়রাক ধীরে ধীরে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। তার চোখে আগুন, ভেতরে সাহস, এবং হৃদয়ে এক অদম্য ইচ্ছা—যা বলছে, সে আর বসে থাকবে না, চুপচাপ নয়, এবার নিজেই নিজের ভালোবাসাকে আনবে।

Death or Alive part 39

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here