Death or Alive part 40
priyanka hawlader
অর্ষার ঠোঁট থেকে ভেসে আসা – “I love you, Keliyon…” – যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিল।
ওয়াজফানের বুকের ভেতর এতদিন ধরে চাপা পড়ে থাকা লাভা মুহূর্তেই ফেটে বের হলো। শান্ত, নিয়ন্ত্রিত ওয়াজফান আর রইল না।
সে হঠাৎ প্রচণ্ড শক্তিতে অর্ষাকে নিজের উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
বিছানা থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ল অর্ষা—ধপাস শব্দে।
তার হাত তো আগেই শক্ত করে পিছনে বাঁধা ছিল, ফলে আঘাতটা যেন দ্বিগুণ ব্যথা হয়ে ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে।
মুহূর্তের মধ্যে তার কণ্ঠ থেকে দমবন্ধ করা একটা গোঙানি বেরিয়ে এলো।
মাটিতে পড়ে কুঁকড়ে উঠল অর্ষা, ব্যথায় নিঃশ্বাস ছিঁড়ে আসছে তার।
ওয়াজ ফান বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। শেষের আগুনের মতো রাগে কাঁপছে তার সারা শরীর, বেগে বেগে শ্বাস নিচ্ছে, ঘাম ঝরছে অবিরাম। নিজের গায়ে থাকা সাদা টি-শার্টটা হঠাৎ টেনে ছিঁড়ে দূরে ছুঁড়ে মারল—যেন সেই কাপড়টাও এখন তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।
এরপর ঝড়ের মতো এগিয়ে গিয়ে অর্ষার চুলের মুঠি ধরে তাকে টেনে তোলে। ঠিক পরের মুহূর্তেই এক প্রচণ্ড থাপ্পড় মারে—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
থাপ্পড়ের জোর এতটাই ছিল যে অর্ষা আবার ছিটকে পড়ে যায় মাটিতে।
আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে তার ঠোঁটের কোনা ফেটে যায়, গরম রক্ত গড়িয়ে নামে।
ওয়াজ ফান দাঁত চেপে, রাগে গর্জে ওঠে—
“F***!!
তুই কি বললি? তোর সাহস হলো এমন একটা মুহূর্তে পরপুরুষের নাম নিয়ে ভালোবাসার কথা জানানো?! Bloody b****!!”**whore**
ওয়াজফানের আঘাত আর বিষাক্ত কথাগুলো যেন অর্ষার বুকে ফিরে গেঁথে যাচ্ছিল। সে ডুকরে কেঁদে ওঠে—কান্নার শব্দ ভরে যায় চারপাশ।
ওয়াজফান আবার ঝাঁপিয়ে গিয়ে তার চুলের মুঠি ধরে মাটি থেকে টেনে তোলে। চোখ রক্তবর্ণ হয়ে আছে তার।
– “এই! তুই কী করে অন্য পুরুষের কথা ভাবতে পারিস এই মুহূর্তে? তুই কি অন্য পুরুষের সাথে শুয়েছিস? তুই কি সত্যিই ক্যালিওনের সাথে…”
কথা শেষ করতে পারল না সে। বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল—এমন জঘন্য প্রশ্ন নিজের মুখে উচ্চারণ করতেও যেন ঘৃণা লাগছিল।
পরের মুহূর্তেই এক প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে অর্ষাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। অর্ষা ছিটকে গিয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ল—কপাল ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।
কিন্তু তবুও ওয়াজফানের রাগ কমল না। যেন সে আজ নিজের ভেতরকে চেনাই ভুলে গেছে। এতদিন সে নিজেকে কন্ট্রোল করেছে, অর্ষার জেদ, রাগ, খামখেয়ালি সব মেনে নিয়েছে। কিন্তু আজ… এত ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে অর্ষা অন্য পুরুষের নাম উচ্চারণ করেছে, ভালোবাসার কথা বলেছে ক্যালিওনকে।
এটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব।
পাশে থাকা বেল্টটা তুলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে।
প্রচণ্ড আঘাত করতে লাগল অর্ষার উপর।
অর্ষা চিৎকার করে কেঁদে উঠল—
– “না! মারবেন না! আমি কী এমন করেছি? আমাকে কেন মারছেন? দোহাই লাগে, আমাকে ছেড়ে দিন! আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে… অনেক ব্যথা পাচ্ছি আমি…”
আজকের অর্ষা আর আগের সেই জেদি, সাহসী অর্ষা নেই।
সে এখন ভেঙে পড়েছে, ভয় পায় ছোট ছোট বিষয়েও।
আঘাতে, ভয়ে, আর অপমানের ভারে কুঁকড়ে যাওয়া এক অর্ষা—যে শুধু মুক্তি চাইছে।
তবে ওয়াজফান আজ এতটাই রাগে আছে—মনে হচ্ছে তার শরীর আসল রূপে ফিরে আসছে।
তার চামড়া লাল হয়ে উঠছে, বুক দপদপ করছে, আর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে।
চোখের মণি জ্বলন্ত লাভার মতো লাল—এমন লাগছে যেন সে কিছু ধরলেই তা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
হঠাৎ ওয়াজফান হাতে ধরা বেল্টটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অর্ষার হাত ধরে তাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করল।
কিন্তু তার ছোঁয়া পড়তেই অর্ষা কুঁকড়ে উঠল,এমন মনে হচ্ছে ওয়াচ পান পেট ধরা জায়গাটা যেন পুড়ে যাচ্ছে, সে হাত ছুটাতে চাইলো , কিন্তু তার দুই হাত পিছনে বাধা তাই সে কিছুই করতে পারল না,
মরিয়া হয়ে চিৎকার করতে লাগল—
– “ছাড়ুন! আমাকে ছেড়ে দিন!”
ওয়াজফানের চোখ ততক্ষণে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। সে ঝট করে এক টুকরো কাপড় অর্ষার মুখে গুঁজে দিল, যেন তার চিৎকার আর বাইরে না যায়।
তারপর ফিসফিসে, শীতল অথচ আতঙ্কজাগানো কণ্ঠে বলল—
– “আজ তোমার জন্য ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে… এত ভয়ংকর যে তোমার ভিতরের আর্তনাদ বাতাসকেও কাঁপিয়ে তুলবে।”
কথা শেষ করে সে অর্ষাকে ছুঁড়ে মারল বিছানায়।
অর্ষা আছড়ে পড়ল, ভয়ে আর আতঙ্কে তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠল।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে তার উপর ঝুঁকে এলো।
তার নিঃশ্বাস গরম, চোখে পাগলামির আগুন—
– “Let me take you on a tour of hell… tonight.”
এরপর ওয়াজফান ধীরে ধীরে অর্ষার গলা বরাবর ঠোঁট ছোঁয়ালো।
তার গরম স্পর্শে অর্ষার শরীর কেঁপে উঠল—যেন সেই জায়গাটা মুহূর্তেই আগুনে জ্বলে উঠেছে।
অর্ষা চিৎকার করে উঠতে চাইলো, কিন্তু মুখে গুঁজে রাখা কাপড় তার আর্তনাদকে আটকে দিল।
ফলে তার মুখ থেকে শুধু গুমরে ওঠা গোঙানি বের হতে লাগল—যা ঘর কাঁপিয়ে তুলল।
তার চোখ থেকে এবার অঝরে জল গড়িয়ে পড়ছে।
কিন্তু ওয়াজফানের চোখে যেন কোনো দয়া নেই।
আজ সে ঠিক করেছে—কোনো কিছুতেই অর্ষাকে ছেড়ে দেবে না।
ওয়াজফানের ঠোঁট ছোঁয়া জায়গাটাতে অর্ষা এখনও জ্বালা টের পাচ্ছিল।
তবে হঠাৎ সে আরও গভীরে ঝুঁকে গেল পুড়ে যাওয়া জায়গায় কামড়ে ধরল নিজের দাত দিয়ে —অর্ষা টের পেল ব্যথার হিংস্র শিহরণ সারা গলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
তবে তার আর্তনাদ আজ যেন রাজ খান দেখছেই না।
তারপর ধীরে ধীরে ওয়াজফান নামতে থাকল—গলা থেকে বুক, বুক থেকে পেট… প্রতিটি জায়গায় অর্ষা প্রথমে ঠোঁটের আগুনে পোড়া শিহরণ টের পায়, আর পরক্ষণেই এক অসহ্য যন্ত্রণার দাগ।
মুহূর্তেই রক্তাক্ত হয়ে গেল তার পুরো শরীর।
অর্ষার চোখ দিয়ে ঝরতে লাগল অঝোর জল।
তার গুমরে ওঠা কান্না ঘর ভরিয়ে দিলেও—ওয়াজফান যেন পাগল হয়ে গেছে।
সে থামছে না।
আজ অর্ষাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে তবেই তার দহন নিভবে।
অর্ষার হাত দুটো এতক্ষণ শক্ত করে বাঁধা থাকার কারণে —ব্যথায় তার শিরা-উপশিরা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে।
সে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছিল, শরীর কাঁপছিল অবিরাম।
হঠাৎ ওয়াজফান এক ঝটকায় তাকে উল্টে ঘুরিয়ে দিল।
অর্ষার নিঃশ্বাস থমকে গেল, কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওয়াজফান তার এক পা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে এক মুহূর্ত সময় না দিয়ে এক ঝটকা তার ভিতরে প্রবেশ করে।
এবার অর্ষার আর্তনাদ যেন আকাশছোঁয়া অর্ষার চোখ থেকে নতুন করে জল গড়িয়ে পড়ল।
সে ছটফট করতে চাইলো, কিন্তু বাঁধা হাত-পায়ে সেই শক্তি আর রইল না।
ওয়াজফানের বুক ওঠানামা করছিল রাগে আর উন্মত্ততায়—সে এতটা রাফ হয়
যেন এখন সে পুরো পৃথিবীকে ভুলে গিয়ে শুধু অর্ষাকে নিয়েই নিজের আসল রূপ দেখাবে।
অর্ষার মনে হচ্ছিল—তার ভেতরটা যেন আগুনে জ্বলছে।
পেটের গভীর থেকে এক অসহনীয় যন্ত্রণা উঠে আসছে, যা তাকে ভেতর থেকে ছিঁড়ে ফেলছে।
তার এই প্রথম ব্লিডিং শুরু হয়ে গেল তার রক্তে মেখে কেন ওয়াজফান আর পুরো বিছানা।
একটু পর তার নিঃশ্বাস কেঁপে উঠল, চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে গেল।
শরীরের দুর্বলতা আর অসহ্য যন্ত্রণার চাপে যেন তার চারপাশের সবকিছু কালো হয়ে আসতে লাগল।
সে মনে মনে একটাই কথা বলে উঠলো আমাকে ছেড়ে দিন কায়াস্থ সাহেব আমি আর পারছি না।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অর্ষার শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো—
সে জ্ঞান হারিয়ে অন্ধকারে তলিয়ে গেল।
সে কথাগুলো মনে মনে বললেও যেন ওয়াজফান এর কান পর্যন্ত পৌঁছে গেল সে এবার হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল
ছেড়ে দিল অর্ষাকে।
তার রাগ এমনি শান্ত হয়ে গেল হটাৎ অর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল সে অজ্ঞান হয়ে আছে এবার যেন তার মধ্যে এক অনুশোচনা কাজ করল সে অর্ষার সব বাঁধন খুলে দিল এরপর নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল তাকে।
অর্ষাকে বিছানায় সোজা করে শুইয়ে দিয়ে, তার বুকের বা পাশে নিজের মাথা রাখলো। গা ঘেঁষে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ফিসফিস করে বলল—
“তোর এই পাজরে শুধু আমার অধিকার…
তুই শুধু আমারি, আমার একার। আমার তাকদিরে তোর নাম লেখা থাকুক বা না থাকুক,তবুও তুই শুধুই আমার। তোর গায়ে শুধু আমার ছাপ, তোর প্রাণে শুধু আমার নিশ্বাস।
তোর প্রতিটা নিঃশ্বাসে আমার অধিকার, প্রতিটা মুহূর্তে আমার অধিকার, তোর প্রতিটা কথায় আমার অধিকার।
তোর শরীরের প্রতিটি রন্ধে আমি নিজের নিঃশ্বাস গেঁথে দিয়েছি, তোর শিরা-উপশিরায় আমি নিজের অস্তিত্ব মিশিয়ে দিয়েছি।
এবার দেখি, তুই কেমন করে আমায় ভুলে যাস! ভুলতে গেলেও তোর স্মৃতির অন্ধকারে শুধু আমি থাকব, শুধু আমারই ছায়া।কারণ সেখানেও শুধু আমার অধিকার।
তুই আমার মানে শুধু আমার—সেখানে অন্য কারো ছায়া আমি কখনো সহ্য করব না।”
কিছুক্ষণ পর ওয়াজফান নিজেই অর্ষাকে ফ্রেশ করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দেয়। তারপর সাবধানে তাকে বিছানায় শুইয়ে নরম কম্বলের ভেতর ঢেকে রাখে, যেন তার চারপাশে কোনো কষ্ট ছুঁয়েও না যায়।
এরপর রাজ বৈদ্যকে খবর পাঠানো হলো। অল্প সময়ের মধ্যেই রাজ বৈদ্য এসে অর্ষাকে পরীক্ষা করে বলল,
“বাদশা, উনার অবস্থা বেশ গুরুতর। আমি ওষুধ দিয়ে গেলাম, তবে কখন জ্ঞান ফিরবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।”
কথাগুলো বলে রাজ বৈদ্য বিদায় নিল।
ওয়াজফান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার মনে হলো, হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্ষা চোখ খুলবে—প্রতিবারই তো এমনটা হয়েছে। তাই সে তেমন দুশ্চিন্তা না করে অর্ষার কপালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে গেল।
ওয়াজফান স্তম্ভাকৃত—এক পা সামনেই, অন্য পা হালকা পিছন, এক হাত কাত হয়ে সামনে রেখেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো ভদ্র এক কণ্ঠ—
“ভিতরে আসবো, দা।”
ওয়াজফান ঘুরেও না দেখে জানিয়ে দিলেন, কণ্ঠে সামান্য শান্তি—
“হ্যা, আসো।”
ধীরে ধীরে পা ফেলতে ফেলতে ভিতরে ঢুকল ড্যানিয়েল। চোখে সামান্য অনুশোচনা মিশিয়ে ছোট্ট কণ্ঠে বলল—
“আপনি আমাকে দেখছেন?”
ওয়াজফান তার দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে কড়া একটা আদেশ মিশানো সুরে বললেন—
“তুমি জানো, আমি কেন তোমাদের মেনে নিয়েছি? এটা তোমার শেষ সুযোগ । আমার দেওয়া এটা শেষ সতর্কবার্তা। জীবনে কখনোই যদি একবারও আমি আমার বোনের চোখে তোমার জন্য এক বিন্দু পরিমান পানি দেখতে পাই, তাহলে এই পৃথিবীর টিকে থাকা দিনই তোমার শেষ হয়ে যাবে। তুমি যে ভুল করেছো তা আমি একবার ক্ষমা করলাম; দ্বিতীয়বারের জন্য আমার কাছে কোনো আশা রাখিও না—কারণ আমি কখনো কাউকে ক্ষমা করতে শিখিনি।”
কথাগুলো যেন ঠাণ্ডা আগুনের মতো ড্যানিয়েলের কানে ভাঙে; রাজসভা থেমে আছে, মুহূর্তটা নিঃসহ।
ওয়াজফানের কথার শেষ হতেই ড্যানিয়েলের কণ্ঠ ধীর কণা হয়ে উঠল—
“জীবনে কখনো আমি ইসাবেলাকে কষ্ট দেওয়ার বা তার চোখে পানি আসার সুযোগ দেব না । আর যদি এমন দিন আসে, তাহলে আমাকে মেরে নিজের হাত নষ্ট করে কষ্ট পেও না—আমি নিজের জীবন দিয়ে দেব। আমি ইসাবলাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি, দা। ওর খুশির জন্য আমি সব করতে রাজি—এমনকি নিজের জীবন দেয়া হলেও। আপনি আমার জীবনে যে খুশিটা আজ দিয়েছেন, তার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। এই দেনা আমি হয়তো কোনোদিন শোধ করতে পারব না।”
ড্যানিয়েলের সেই কথাগুলো ওয়াজফানের মনে একটা সান্ত্বনা জাগাল—বহু ভাব ফুটে উঠল তার মনে, তবে মুখে রাখলেন গম্ভীরতা। অল্প এক ইশারায় তার অনুমোদন জানালেন।
তারপর ড্যানিয়েল চুপচাপ সেখান থেকে সরিয়ে নিল পদচারণা, নিঃশব্দে চলে গেল।
ওয়াজফান ড্যানিয়েল চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ এক গভীর চিন্তায় ডুবে পড়ল—কেন সে তাদের মেনে নিল? কেন এমন সহজে রাজি হল? প্রশ্নগুলো বারবার মনে ভাঙছিল।
দৃশ্যপট হঠাৎ করে ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে গেল—
কালই যে খবরটায় রাজপ্রাসাদ উদ্দাম হয়ে উঠেছিল, ইসাবেলা মা হতে চলেছে—সেই খুশির মুহূর্তগুলো ওয়াজফানের মুখে প্রকাশ পায়নি, তবু ভেতরে গোপন এক তৃপ্তি জেগে উঠেছিল। সবাই যখন রুম ছেড়ে চলে গেল, তখন ওয়াজফান একা হয়ে প্রায় বেরোতে বসেছিল। হঠাৎ দরজার ফিসফিসনায় সে শুনল—ইসাবেলার কণ্ঠ, কেঁপে ওঠা গলায়: “আমি এই বাচ্চা রাখব না।” সেই শব্দটুকুই ওয়াজফানের কানে লেগে থাকল।
সেই মুহূর্তে সে ছুটে এসে দাঁড়িয়েছিল না—স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত কথাকেই সে ভাঙতে চায়নি। তাই নীরবে সেখান থেকে সরে গিয়েছিল। তখনও সে বুঝেছিল তাদের মধ্যে শান্তি নেই, ভাঙন আছে।
তবে ভালোবেসে বিয়ে করার পরও এই ভাঙ্গন কিসের সেটাই তার জানার ছিল।
কিছুক্ষণ পর ওয়াজফান ড্যানিয়েলকে আলাদা কক্ষে ডেকে আনে। দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকতেই ড্যানিয়েল আর কিছু লুকায় না—শুরু থেকেই যা ছিল সব খুলে বলে ফেলে। কথা শেষ হতেই ওয়াজফানের চোখে আগুন ঝলসে উঠে। মুহূর্তের মধ্যে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে ড্যানিয়েলের উপর।
ড্যানিয়েল স্থির হয়ে দাঁড়ায়—হতভম্ব, মুখে অনুশোচনার ছাপ। ওয়াজফানের চোটানো থাপ্পড় আর মুষ্টির ধাক্কা কানে লাগে; প্রতিটি আঘাত যেন তার অতীত অপরাধের জন্য প্রায়শ্চিত। সে চিৎকার করে না—শব্দ বমি করে না—প্রতিটা আঘাত নীরবভাবে হজম করে, যেন নিজের করা ভুলের স্বীকারোক্তি হিসেবে কষ্ট নিতে চাইছে।
ওয়াজফান কণ্ঠে হুংকার—গজগজে ক্রোধ, চোখ সাদা লাল হয়ে ওঠে—বলছে,
— “তোর সাহস কী করে হলো? আমার বোনের সঙ্গে এভাবে আচরণ করতে! ওই নেকড়ে ক্যালিয়নের জন্য তুই আমার বোনের সঙ্গে নাটক করেছিলিস? তোর কি প্রাণের মায়া নেই? তুই জানতিস না যে ও কার বোন—ওয়াজফান কায়াস্থের বোন? সেই সত্য জানার পরও তুই এত সাহস দেখিয়েছিস?”
তিনি কথাগুলো কড়া, থেমে থেমে উচ্চারণ করেন, আর প্রতিটি বাক্যের সঙ্গে ড্যানিয়েলের উপর একটিও আঘাত কমে না। ড্যানিয়েল নিজের অপরাধের অঙ্গীকারে মাথা নত করে আছে; তার শরীর কেঁপে উঠছে—but সে কোনো প্রতিরোধ দেখায় না।
ওয়াজফান মার বন্ধ করে না, না বলে রাখে—প্রতিটি হাতে থাকা ক্রোধ যেন মুহূর্তে বিষাক্ত হয়ে সারারাত ব্যথা হিসেবে মিশে যায়। কক্ষটি তখন এক নিঃসঙ্গ আহাজারির সঙ্গী, যেখানে এক পুরনো বিশ্বাসঘাতকতা আর অপরাধেরাই কথা বলছে।
ওয়াজফানের বেজিং সাহসী মুষ্টি নেমে আসার পর ড্যানিয়েল আর ঠিক থাকতে পারে না—সে মাটিতে ঢলে পড়ে, গলায় কাঁধি কাঁধি শ্বাস। ওয়াজফান আর সেখানে না থেকে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল তবে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই কণ্ঠে কড়া, হালকা না হওয়া হুঁশিয়ারি দিল—
“আজকের পর তোর আর আমার বোনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আমি তোদের সব সম্পর্ক নষ্ট করে দিব। তোকে আমার বোন থেকে এতদূরে ছুড়ে দেব—তোর যেন ইসাবেলার ছায়াও ছুঁতে না পারে। আমার বোনের জীবন থেকে তোর অস্তিত্ব মুছে ফেলব!”
ওয়াজফানের কথাগুলো ড্যানিয়েলের বুক কেটে ঢুকল — সে জানে ওয়াজফান কথা বলতে জানলে, কাজেও ধারাবাহিক। ভয়ের এক নতুন তরঙ্গ তার ভেতরে জাগল। হুঁশিয়ার কণ্ঠ আর কঠিন চোখ—সবকিছু একসঙ্গে চাপ দিল।
ড্যানিয়েল নির্ঘুম কণ্ঠে উঠে দাঁড়াতে চাইল, তবু পায় সামলে না পেরে; সে ওয়াজফানের পায়ে জড়িয়ে পড়ল, থরথর করে কেঁদে কেঁদে আহাজারি শুরু করল—
“দা… দোহাই দিচ্ছি, এমন করবেন না। আমি স্বীকার করছি — আমি ভুল করেছি। এটা এক মুহূর্তের ভুল ছিল, কিন্তু তারপর থেকেই আমি শুধু ভালোবেসেছি। আপনার বোনকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। আমি—আমি ওকে অনেক বেশি ভালোবাসি। আপনি আমাকে ক্ষমা করলে, আমি ভালো হয়ে যাবো, ঠিক করে দেবো সব কিছু। যদি ক্ষমা না করেন, তাহলে… ইচ্ছে থাকলে, আপনি আমাকে মেরে দিয়ে যান—তখন আমার জন্য ইসাবেলার থেকে দূরে থাকা সহজ হবে। দয়া করে, আমার এই এক অনুরোধটা মেনেই নিন।”
তার কন্ঠ কেঁপে উঠে, চোখ ভেজা; প্রতিটি শব্দে অনুযোগ, অনুশোচনা আর একরাশ বিনম্রতা নেই। ওয়াজফানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অনুরোধ যেন ঘরে ভেসে ওঠা শেষ চিৎকার।
ড্যানিয়েলের সমস্ত অনুনয়-প্রার্থনা শুনে, ওয়াজফানের মন কিছুটা নরম হয়ে যায়। সে অনুভব করে ড্যানিয়েল সত্যিই তার বোন ইসাবেলাকে কতটা ভালোবাসে। প্রথমে ভুল করলেও, এই গভীর ভালোবাসা ও দৃঢ় অনুভূতি এতদিনে তার চোখে পড়েছে। তাই আর কোনো কথার প্রয়োজন অনুভব করে না; সে শুধুমাত্র দাস-দাসীদের নির্দেশ দেয় সবাইকে রাজসভায় আনতে। এরপর নিজেই ধীর পা নিয়ে চলে যায়, রাজসভা প্রস্তুতির জন্য।
বর্তমানে,,,,
দাঁড়িয়ে সেই সব ভাবনা মনে করছে—সে চায় তার বোন খুশি থাকুক। সেই দিন সে যা কিছু মেনে নিয়েছিল, সবকিছুই এই কারণেই—যেন ইসাবেলা এবং তার পেটের সন্তান কোনো কষ্টে বা ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। শান্তি ও সতর্কতার সঙ্গে ওয়াজফান নিশ্চিত হয়, যে তার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল, অন্তত তার বোনের সুখের জন্য।
আয়রাকের শক্ত মুঠোয় ধরা ছিল ইয়ানার নরম হাত। দু’জন পাশাপাশি হেঁটে চলেছে নিঃশব্দ রাস্তায়, যেদিকে গন্তব্য—কাজী অফিস। রোদের আলো ফাঁকফোকর গলে এসে পড়ছে তাদের উপর, যেন প্রকৃতি নিজেও সাক্ষী হতে চাইছে এক অদ্ভুত মিলনের।
কাজী অফিসের সামনে এসে আচমকাই ইয়ানা থমকে দাঁড়াল। তার পা যেন আর এগোতে চায় না। আয়রাক অবাক হয়ে ইয়ানার দিকে তাকাল, তার চোখে উদ্বিগ্ন দৃষ্টি। কোমল অথচ চিন্তিত কণ্ঠে সে বলল—
—“কি হলো, দাঁড়িয়ে পড়লে যে?”
ইয়ানা ধীরে ধীরে আয়রাকের চোখের দিকে তাকাল। কণ্ঠে বিস্ময়, যেন মনের গভীর থেকে উঠে আসা এক আকুতি—
—“চলুন না… আমার মা-বাবাকে জানিয়ে বিয়ে করি।”
কথাগুলো শুনে আয়রাক কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে রইল। তারপর শান্ত অথচ গম্ভীর স্বরে জবাব দিল—
—“দেখো ইয়ানা, আমি একজন জিন। আর একজন জিনের সঙ্গে একজন মানব কন্যার বিয়ে… এ সমাজ কোনোদিনও মেনে নেবে না। তোমার মা-বাবাকে জানালে তারা আমাদের বিয়েটা কখনোই গ্রহণ করবে না। বরং তখন উল্টো ঝামেলা তৈরি হবে। তাই এখনই বিষয়টা তোমার মা-বাবাকে জানানো ঠিক হবে না। আপাতত গোপন রাখাই ভালো।”
আয়রাকের কথাগুলো হাওয়ায় ভেসে এসে ইয়ানার অন্তরে আঘাত করল। কিছুক্ষণ সে স্থির দাঁড়িয়ে রইল, মনে হলো দ্বিধার দোলাচলে হারিয়ে গেছে। তবু ভেতরে ভেতরে ভাবল—
—“হয়তো আয়রাক ঠিকই বলছে…”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আর কোনো কথা বলল না। আবার নিঃশব্দে আয়রাকের হাতটা শক্ত করে ধরল। এবার আর থামল না। দু’জন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কাজী অফিসের ভেতরে, এক অদ্ভুত ভবিষ্যতের দিকে।
কাজী অফিসের ভেতরে ঢুকতেই দু’জন সোজা কাজী সাহেবের সামনের চেয়ারগুলোতে বসে পড়ল। কক্ষটায় কাগজপত্রের গন্ধ, ধূতির ফোঁটা আর পুরনো সময়েরওয়াজ নীরবে ভাসছে। কিন্তু ঠিক কাজী সাহেবকে দেখার মুহূর্তেই আয়রাক ভ্যাবাচে খেয়ে গেল তার চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে উঠলো সে মনে মনে বলে উঠল:
“শালার—আবারও সেই একই কাজীরই বেটা। বাদশাহর বিয়েটা কে এই বেটা নষ্ট করেছে; এখন যদি আমার বিয়ের বারোটা বাজায়, তাহলে ওকে আমি মেরেই ফেলবো।”
কথাগুলো আয়রাকের মনেই গুড়গুড়ে আগুন জ্বালিয়ে দিল—কিন্তু কাজী সাহেবের দিকে তাকালে দেখা গেল, কাজী সাহেবের আয়রাক কে নিয়ে চিন্তা নেই। কারণ আগেরবার, যখন কাজী সাহেব কে এখানে ছেড়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন আয়রাক কাজীর স্মৃতিগুলো মুছে ফেলেছিল—তাই আজ কাজী সাহেবের স্মৃতিতে আয়রাক শুধু অচেনা এক ব্যক্তি মাত্র।
আয়রাক মনে মনে আবারো বলে উঠলো,
“এখন কি করবো? এখান থেকে চলে যাবো নাকি? যদি এই বেটা আবার ইয়ানার সামনে ওই সব কান্ড শুরু করে, তাহলে তো আমি লজ্জায় পড়ে যাব। তখন কি করবো আমি?
না না… এখন তো এখান থেকে যাওয়া যাবে না। তাহলে ইয়ানা আমাকে হাজার প্রশ্ন করবে—কেন চলে যাচ্ছি। যাই হোক, যে কাজ করতে এসেছি, তা এখানেই করে ফেলি।”
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা, কিছু মুহূর্তে চুপচাপ ভাবের ভার। তারপর ধীরে আয়রাক উচ্চস্বরে বলল—
“বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।”
কাজী সাহেবও বিয়ের পড়ানো শুরু করে।
ইয়ানা মাথা নিচু করে লজ্জা অনুভব করছে, কিন্তু চোখে-চোখে বোঝা যায়—তার মনটা কিছুটা ভারাক্রান্ত। হয়তো সে ভাবছে যদি আজ তার মা-বাবা পাশে থাকতেন, তাহলে এই মুহূর্ত আরও আনন্দের হতো। তবু আল্লাহ যা করে, সবসময় বান্দার ভালোই করে—এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে এবং মনকে ধীরে ধীরে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে।
বিয়ে পড়াতে পড়াতেই হঠাৎ বাতাসে ভেসে এলো এক অচেনা দুর্গন্ধ। শব্দ কোনো নেই, অথচ দুর্গন্ধ তাই পুরো কক্ষে উপস্থিত। আয়রাক মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারল—কারণটা ঠিক কোথায়।
কিন্তু, ইয়ানা চোখ বড় বড় করে চমকে ঘুরে তাকাল আয়রাকের দিকে। চোখের দৃষ্টি এমন—যেন দোষীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে।
পাশেই বসা আয়রাক সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় পড়ে গেল। স্পষ্টই বুঝতে পারছে,সে ইয়ানা ভেবেছে এই দুর্গন্ধ ছেড়েছে সে-ই!
আয়রাক তড়িঘড়ি মাথা দুদিকে ঝাঁকিয়ে হাত নাড়তে লাগল, যেন প্রাণপণ বোঝাতে চাইছে—
—”না, এটা আমি করিনি!”
তার অস্থির ভঙ্গিতে পরিস্থিতি আরো বিব্রতকর হয়ে উঠল। আর ঠিক তখনই আয়রাক ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে দিল, চোখে একধরনের রাগী বিদ্যুৎ খেলে গেল। সেই দৃষ্টি সোজা গিয়ে গেঁথে উঠল কাজী সাহেবের গায়ে।
মুহূর্তেই পরিবেশে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। যেন সবাই শ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে—আয়রাক এখন কী করে!
তবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আয়রাকের চুপচাপ, কষ্টমিশ্রিত ভঙ্গি এবং মনস্তত্ত্বের ছাপ পড়ে গেল তার মনে।
অবশেষে সে মাথা নিচু করে চুপচাপ নিজের কাজ চালিয়ে গেল—বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা চলতেই থাকল।
তবে বিয়ে সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই হঠাৎ বাতাসে ভেসে এলো সেই দুর্গন্ধ আবারও—এইবার বজ্রপাতের মতো একটি শব্দের সঙ্গে। আয়রাক রেগে যায়; চোখে আগুন, মুখে কঠোর ভাব। সে কাজী সাহেবের দিকে তাকিয়ে ফুঁসে ফুঁসে বলে উঠল,
“কাজীর বাচ্চা, তুই আবারও এইসব শুরু করছোস!”
হঠাৎ করে হাত নাড়াতে নাড়াতে কাজী বলে ওঠে,
“আল্লাহ কি কসম, হামনে নেহি পাদা! হামনে নেহি পাদা!”
ইয়ানা কিছুটা লজ্জায় পড়ে যায়—এমন কান্ড দেখে, চোখের সামনে যেন লাল রঙের লজ্জার ঢেউ ভেসে ওঠে। তবে মুচকি মুচকি হাসে সে এরকম কান্ড দেখে।
আর আয়রাক কাজী কে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বলে,
“তোর মিছে কথা বলছিস। আরেকবার যদি এরকমটা করিস, তাহলে ডিরেক্ট… বাকিটা বুঝে নে। আমি এত সুন্দর মুহূর্তে নিজের রাগটা প্রকাশ করতে চাই না, তাই তোকে কিছু না বলেই ছেড়ে দিচ্ছি।”
কাজী সাহেবও আয়রাকের দৃঢ় থ্রেড শুনে কেঁপে ওঠে—মনে ভয়, শরীরে অনিশ্চয়তা। তাই এবার নিজের আবেগ সামলে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ করে, কেবল কবুলের পালা বাকি থাকে।
প্রথমে ইয়ানা নীরবে “কবুল” বলে—কিন্তু কিছুটা আবেগে ভরা, চোখে চোখে বাবা-মায়ের স্মৃতি ভেসে ওঠে। তারপর আয়রাক আর দেরি না করে দ্রুত “কবুল” বলে ফেলল।
সব শেষ হতেই তারা দ্রুত কক্ষে বেরিয়ে পড়ল, পেছনে রেখেছিল এক ঝড়ের মতো উত্তেজনা আর এক শান্তির ঝলক, যা কেবল তাদের হৃদয়ে আবদ্ধ রইল।
বিয়ে শেষ করে তারা যখন রাজপ্রাসাদের ফটকে এসে পৌঁছাল, চারপাশ যেন অন্যরকম এক আভা ছড়িয়ে দিল। রাজকীয় সোনালি দরজার সামনে সারি সারি মশাল জ্বলছে, আলোয় ঝিকমিক করছে লাল গালিচা। মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্ত যেন তাদের জন্যই রচিত হয়েছে।
আগেই ওয়াজফান হুকুম দিয়ে রেখেছিল—রাজপ্রাসাদ আজ সাজানো থাকবে নবদম্পতির বরণে। তাই আয়রাক ও ইয়ানার প্রাসাদে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই অভ্যর্থনার ঢোল বেজে উঠল। চারদিকে ফুল ছড়ানো হলো, সুগন্ধি ধূপে ভরে গেল চারপাশ। রাজকর্মচারীরা বিনম্রভাবে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল, আর দরজার দুপাশ থেকে ঝরল রঙিন ফুলের পাপড়ি।
তাদের জন্য রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরে আগে থেকেই প্রস্তুত করা হয়েছিল এক অপরূপ কক্ষ—সোনালী ঝাড়বাতি, মখমলের পর্দা, কারুকার্যময় খাট, আর সুবাসিত গোলাপফুলে ভরা। যেন সেই কক্ষ অপেক্ষা করছিল কেবল তাদের জন্য।
ওয়াজফানের নির্দেশ অনুসারে তাদের কক্ষে পৌঁছে দেওয়া হলো। নিঃশব্দে দরজা বন্ধ হতেই মুহূর্তটি আরও ব্যক্তিগত ও রহস্যময় হয়ে উঠল। রাজপ্রাসাদের গম্ভীর দেয়ালের ভেতর এবার শুরু হতে চলল এক নতুন অধ্যায়—তাদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম পর্ব।
রাজপ্রাসাদের সেই সাজানো কক্ষে প্রবেশ করতেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এক স্বপ্নিল আবহ। সোনালী ঝাড়বাতির আলোয় ঝলমল করছে পুরো কক্ষ, সুগন্ধি ধূপের সাথে গোলাপের মিষ্টি ঘ্রাণ মিশে তৈরি করেছে অন্যরকম এক জাদুময় পরিবেশ। মখমলের লাল বিছানায় চারপাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে গোলাপের পাপড়ি, জানালার পর্দা দিয়ে ভেসে আসছে মৃদু হাওয়া—যেন পুরো প্রাসাদ আজ তাদের ভালোবাসার সাক্ষী।
কক্ষে প্রবেশ করেই আয়রাক ইয়ানাকে বলে ফ্রেশ হয়ে নিতে। আসার সময় শপিং মলে গিয়ে তার সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রই তার পছন্দমতো কিনে দিয়েছে আয়রাক।
সেই প্যাকেট থেকেই একটি তুলে নিয়ে ইয়ানা চলে যায় গোসলে।
আয়রাক তখন চুপচাপ বসে তার অপেক্ষা করে।
কিছুক্ষণ পরই ইয়ানা বেরিয়ে আসে—লাল রঙের হট নাইটি গায়ে, যেটা হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে আর নিচের অংশ ফাঁকা।সাদা ধবধবে পা দুটো বেরিয়ে আছে।
এভাবে ইয়ানাকে দেখে আয়রাক অবাক হয়ে ডোগ গিলে ফেলে। তার মনে হলো—আজ তো ইয়ানা তাকে মেরে ফেলারই ফন্দি এঁটেছে।
ইয়ানাও বুঝতে পারলো আয়রাকের চোখ এখন তার দিকেই নিবদ্ধ। কিন্তু কোনো পাত্তা না দিয়ে সে সোজা হেঁটে চলে গেল বারান্দায়।
আয়রাকও নিজেকে সামলে নিয়ে গোসলে চলে গেল।
তবে কিছুক্ষণ পর গোসল সেরে বেরিয়ে এসে আয়রাক লক্ষ্য করলো—ইয়ানা এখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
সে ধীরে ধীরে সেখানে এগিয়ে গেল। গিয়ে দেখলো, ইয়ানার হাতে কিছু একটা আছে, সে সেটা খাচ্ছে।
আয়রাক সামনে গিয়ে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো
“এটা কি খাচ্ছ তুমি?”
ইয়ানা ঘুরে তাকিয়ে মিষ্টি ভঙ্গিতে উত্তর দিল—
“ট্যাবস চকলেট… আমি শপিং মল থেকে নিয়ে এসেছিলাম। আপনিও চাইলে ট্রাই করে দেখতে পারেন।”
কথাটা শুনলেও আয়রাকের দৃষ্টি স্থির হয়ে ছিল অন্য জায়গায়—ইয়ানার ঠোঁটে। সেখানে সামান্য চকলেট লেগে আছে।
আয়রাক ধীরে ফিসফিস করে বললো—
“হ্যাঁ… অবশ্যই ট্রাই করবো।”
বলেই সে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। হঠাৎ করেই ঝুঁকে পড়ে ইয়ানার ঠোঁটের উপর নিজের ঠোঁট বসিয়ে দিলো, আর শুষে নিলো লেগে থাকা চকলেটের সবটুকু স্বাদ…
একটু পর ইয়ানা আয়রাক এর গলা পেচিয়ে ধরে তার সঙ্গে তাল মেলাতে থাকল।
এরপর আয়রাক ধীরে ধীরে ইয়ানার ঠোঁট ছেড়ে গলার দিকে নামতে চাইলে ইয়ানা হঠাৎ করেই পিছিয়ে যায়।
আয়রাক অবাক হয়ে প্রশ্ন করে—
“কি হলো? দূরে যাচ্ছ কেন?”
কিন্তু ইয়ানার ঠোঁটে তখন দুষ্টু একটা হাসি খেলে যায়। সে আঙুল তুলে নিচের দিকে ইশারা করে দেয়, আর মিষ্টি ভঙ্গিতে বলে—
“যদি আজ সারারাত ওখানে কাটাতে পারি… তবে আপনি যা চান, তাই পাবেন।”
আয়রাক নিচে তাকাতেই বুঝলো—ওটা ফুলের বাগান। মনে পড়লো, এটা ওয়াজফান অর্ষার জন্যই তৈরি করেছিল। আর এই জায়গায় কোনো প্রহরীর প্রবেশ ওয়াজফান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে রেখেছে। কারণ অর্ষা প্রায়ই এখানে সময় কাটায়। তাই এখানে শুধু নারী দাসীরাই থাকে, পুরুষদের জন্য কড়া নিষেধ। তবে মাঝে মাঝে আয়রাককেই ওয়াজফান বলতো পাহারা দিতে।
আয়রাক একবার তাকালো ইয়ানার দিকে—এই পোশাকে সে মোটেও চায় না অন্য কেউ তার স্ত্রীকে দেখুক। মেয়ে হোক কিংবা দাসী—তার কাছে কিছুই যায় আসে না। দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো—
“আচ্ছা, দাঁড়াও… আমি আসছি।”
এরপর সে বাইরে গিয়ে সরাসরি ওয়াজফানের কাছ থেকে অনুমতি নিলো এবং আজ রাতের জন্য ফুলের বাগানের দিকে কোনো প্রহরী বা দাসীর প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো।
সবকিছু ঠিক করে ফিরে এসে আয়রাক নরম ভঙ্গিতে ইয়ানার হাত ধরলো। আর তাকে নিয়ে ধীরে ধীরে নামলো সেই ফুলেল বাগানে, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে রাত্রির নীরবতা আর গোপন আবেশ…
বাগানে আসতেই ইয়ানা যেন হঠাৎ আরও চঞ্চল হয়ে উঠলো। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, ফুলের মাঝখানে ঢুকে পড়ছে, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখছে রঙিন পাপড়িগুলো। আর আয়রাক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে—তার চোখে যেন এক স্বপ্নিল পরী নেচে বেড়াচ্ছে চাঁদের আলোয়।
ছোট্ট ড্রেসে ডাকা শরীর, চাঁদের আলোর ঝিলিকে ইয়ানাকে যেন আরও মোহনীয়, আরও অসহ্যরকম সুন্দর লাগছে।
ঠিক সেই সময় হঠাৎ করেই নামলো বৃষ্টি। ঝুমঝুম ফোঁটার ভিজে যাওয়ায় ইয়ানার শরীর কেঁপে উঠলো, কাপড় লেপ্টে গেল তার গায়ের সঙ্গে। প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি স্পর্শকাতরতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
আয়রাক আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। চোখে দহনময় তৃষ্ণা, শরীরে উত্তাল ঝড়। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সে হঠাৎই ইয়ানাকে সোজা কোলে তুলে নিলো।
ঝরঝরে বৃষ্টির ভেতরেই তার ঠোঁট ছুঁয়ে গেল ইয়ানার ঠোঁটে—অবিরাম, উন্মাদ কিস। ইয়ানার দু’পা আয়রাকের কোমরে জড়িয়ে গেল, দুই হাত শক্ত করে তার গলা জড়িয়ে ধরলো।
বৃষ্টির শব্দ, ফুলের গন্ধ আর রাতের নিস্তব্ধতায়—তারা দুজন যেন হারিয়ে গেল এক উন্মাদের মতো চুম্বনে, যেখানে কেবল ভালোবাসা আর আকাঙ্ক্ষাই ছিল শাসনকর্তা।
দুজনে যেন পাগল হয়ে উঠল গভীর চুম্বনে একজন অন্য জনকে ছাড়তে চাইছে না।
এরপর আয়রাক নিরবচ্ছিন্নভাবে ইয়ানার ঠোঁটে চুম্বন করতে করতে তাকে বুকে আঁকড়ে ধরে বৃষ্টিভেজা ঘাসের ওপর বসে পড়ে। মুহূর্তেই তার দৃষ্টি আরও গভীর হয়ে উঠলো।
ধীরে ধীরে সে ইয়ানাকে শুইয়ে দিলো মাটিতে, চারপাশে ভেজা ফুল আর বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে যেন এক স্বপ্নরাজ্য তৈরি হলো।
Death or Alive part 39
আয়রাক হাত বাড়িয়ে খুলে ফেলে ইয়ানার সমস্ত পোশাক, ইয়ানাও আয়রাক এর পড়নের পোশাক খুলে ফেলে।
আর তারপর আয়রাক সম্পূর্ণ ডুবে গেল ইয়ানার মাঝে—
যেখানে আর কোনো আলাদা সত্তা রইলো না, শুধু দু’জনার আবেগ, উন্মাদনা আর সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
 
