Death or Alive last part 

Death or Alive last part 
priyanka hawlader

সন্ধ্যা নেমে এসেছে; চারিদিকে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে—আর সেই অন্ধকার ইসাবেলার জীবনে বেড়ে উঠেছে। ড্যানিয়েল এর নিঠুর দেহটা সামনে বসে, পাগলের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছে ইসাবেলা; বারবার তাকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে বলছে—

“প্লিজ উঠুন, ড্যানিয়েল, প্লিজ! আপনি আমাকে এভাবে একা ছেড়ে চলে যেতে পারেন না। আমি তো আপনাকে ভালোবাসি, খুব বেশি ভালোবাসি; কিন্তু আপনি তো আমাকে সেটা বলবার সুযোগটুকুও দিলেন না—তার আগেই চলে গেলেন এই পৃথিবী ছেড়ে। আপনার ভুলের জন্য আমি তো আপনাকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি, তবু আপনি কেন বলবার সুযোগই দিলেন না—আমি তো আপনাকে ভালোবাসি, নিজের হৃদয়ের স্পন্দন থেকে।
এই শুনুন না—আপনি আমাকে এভাবে একা ফেলে কোথাও যেতে পারবেন না। আপনি চলে গেলে—আমার কী হবে? আমাদের বেবিটির কী হবে? ও তো বাবা হারিয়ে ফেলবে। প্লিজ, ওর জন্য হলেও ফিরে আসুন—না, অন্তত একবার। প্লিজ, শুনুন আমাকে, শুনেন না?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ইসাবেলার আর্তনাদ যেন চারপাশের বাতাসকেও ভারী করে দিল—শূন্যতায় কেঁদে কেঁদে শব্দগুলো ঘুরে ফিরে ফিরে এসে তার নিজের কানে গেঁথে লাগল। সে আর নিজেকে ধরতে পারেনি; বুকটা চেঁচিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শক্তি ঝরে পড়লো। ধীরে ধীরে হাঁটু ভেঙে মাটির ওপর লুটিয়ে পড়ল, কাঁদা চেহারা মাটিতে মিশে গেল, চোখের পাতা নেমে গেল—আর অল্পক্ষণের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে অচেতন অবস্থায় ঢলে পড়লো।
এতক্ষণে সমস্ত খবর পৌঁছে গিয়েছিল ওয়াজফানের কানে। সে ছুটে আসে, কিন্তু এসে দেখে তখন আর কিছু করার নেই। দৃশ্যটা তার চোখের সামনে—মাটিতে অচেতন ইসাবেলা, আর তার কোলের ওপর নিথর ড্যানিয়েলের দেহ। মুহূর্তেই ওয়াজফান থমকে যায়, বুকের ভেতরটা যেন হাহাকার করে ওঠে।

সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ইসাবেলার অচেতন দেহটা নিজের বাহুতে তুলে নেয়, চোখে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা খেলে যায়। ঠাণ্ডা গলায় কিন্তু কঠিন আদেশের সুরে আয়রাককে বলে—
“ড্যানিয়েলের দেহটা তুলে নাও।”
এরপর কোনোরকম কথা না বাড়িয়ে, নিস্তব্ধ ভারী পরিবেশে তারা রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়, বাতাসে যেন মৃত্যুর শীতলতা ভেসে বেড়াতে থাকে।

দু দিন পর,,,,
দুই দিন কেটে গেল, কিন্তু ইসাবেলার সঙ্গে করে শান্তি এখনও ফিরল না। ড্যানিয়েলকে হারানোর পর থেকে সে যেন অচলাবস্থা—কথা নেই, হাসি নেই। সারাবেলা তার চেতনায় ড্যানিয়েলের ছবিই ভাসে; মাঝেমাঝে অচেতনভাবে পেটে হাত বুলাতে বুলাতেই সে তার ছোট্ট বেবির সঙ্গে নীরব কথাবার্তা করে।
ড্যানিয়েলের স্মৃতি যখন গভীর ভাবে তার কাছে আছড়ে পড়ে, তখনই সে কেঁদে কেঁদে পাগলের মতো বেহাল হয়ে যায়—খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হয় না; অর্ষা ও ওয়াজফান যতটা সম্ভব জোর করে খাবার খাওয়ান, তবু দু’টি রাত কেটে যাওয়াটাই যেন এক অপূরণীয় চেষ্টা। এই টানাপোড়েন শরীরকে ভেঙে দিয়েছে—প্রতিটি নিঃশ্বাসে ক্লান্তি, প্রতিটি সন্ধ্যায় ক্ষুধার পিছু টলাটানি।

তবুও ইসাবেলা নিজের উপর কড়া বলেছে—ড্যানিয়েলের শেষ চাওয়া পূরণ করতে হবে। বাচ্চাটার জন্যই যদি না হয়, নিজের জন্য নয়—ও নিজেকে কটোর করে রাখার চেষ্টা করে, যেন কোনোভাবে ভাঙা অংশগুলো সংযোজিত থাকা যায়। কিন্তু যখন শ্রান্ত স্মৃতির আনাগোনা আঘাত করে, তখন হাজার অনুশ্রমই অকার্যকর—মনটা আটকে পড়ে, কষ্ট ছাড়া আর কিছুই মেলে না।
ইসাবেলা উঠেই রুম থেকে নিচে নামার চেষ্টা করল। একটু বেখেয়ালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎই পা হোঁচট খায়, সঙ্গে সঙ্গে এসে গিয়ে সিড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে রক্তক্ষরণ শুরু হল; ব্যথায় সে চিৎকার করে ওঠে। চিৎকারের শব্দে সিঁড়ির সামনে মুহূর্তেই জমে গেল রাজ্যের সবাই — ওয়াজফান, অর্শা, দাসীরা, সকলেই ছুটে এল।

কিন্তু সেই দৃশ্য দেখে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই; মুহূর্ত কয়েকেক পেরোতে লাগল—কী হয়েছে, এটা কিভাবে হলো, বোঝার বাইরে। ইসাবেলা মেঝেতে পেট ধরে কাতরাচ্ছে; ওর ব্যথা দেখে অর্ষার দুচোখে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ে। পাশেই দাড়িয়ে থাকা ওয়াজফান—বোনের এমন কষ্টে দেখতে পেয়ে প্রথমে নিশ্চুপ, তারপর এক মুহূর্তও না দেরি করে ছুটে এসে ইসাবেলাকে কোলে তুলে নিতে চাইলো
ভাঙা কণ্ঠে সে বলল,

কিছু হবে না তোর — আমি তোর কিছুই হতে দেব না। তোর ভাই তোর পাশে আছে তো দেখে নিস আমি তোকে কিছু হতে দেবে না। ঠিক বাঁচিয়ে নেব আমি তোকে ভয় পাস না ভাই আছে তো তোর ভাই আছে তোর পাশে। ভয় পাস না কিচ্ছু হবে না তোর শান্ত পিচ্চি হতে দেবো না দেখে নিস আমি ঠিক সুস্থ করে তুলবো তোকে।
অন্যদিকে অর্ষা অঝোরে কাঁদছে; ঘরটা একেবারে আবেগে ভেসে উঠল।
ইসাবেলা বুঝতে পারে এভাবে মাটিতে পড়াতেই তার মিসক্যারিস হয়ে গিয়েছে পেটে প্রচন্ড ব্যথা করছে তবুও সে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে
তাই সে ওয়াজফান কে নিজেকে তুলতে না দিয়ে তার হাত ধরে তারপর ধীরে ধীরে বলে ওঠে,

প্লিজ দা আমার একটা কথা শোন। অন্তত আমার শেষ চাওয়া হিসেবে, দেখ ড্যানিেয়ল এর শেষ চাওয়া ছিল আমি যেন ওর বেবিটা কে আজীবন আগলে রাখি নিজের কাছে। আমি তো সেটা পারলাম না পারলাম ওর শেষ স্মৃতিটাকে নিজের কাছে আগলে রাখতে পারলাম না ওর শেষ কথার মর্যাদাকে রাখতে। তাহলে এই জীবন থেকেই বার কি করার আমি নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়েছি আর এখন যার জন্য আমি বেঁচে থাকতাম ভালোবাসার চিহ্ন সে তো এখন আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেল এখন আর আমার বেঁচে থাকার কোন মানেই হয় না এই জীবন থাকার চেয়ে ভালো মরে গিয়ে শান্তির ঘুম ঘুমানো। তাই প্লিজ তুই আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করিস না। দা আমার অনুরোধ তোর কাছে প্লিজ আমাকে এরকম মৃত্যুর পথে ছেড়ে দে আমি খুশি খুশি এইটাই গ্রহণ করতে চাই প্লিজ আমাকে বাঁচিয়ে তুলিস না আমি চাইনা বাঁচতে।
ওয়াজফান ইসাবেলাকে ধমকি দিয়ে বলে,

কি বলছিস তুই এসব পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই ভুল করেও যদি আরেকবার মৃত্যুর নাম নিজের মুখে আনিস আমি কিন্তু তোকে খুব বকবো খুব রাগ করবো তোর উপর কিচ্ছু হবে না তোর ঠিক হয়ে যাবি তু দেখে নিস। আর তোর বেবিটা ওর কিছু হবে না দেখিস আল্লাহ ওকে ঠিকই বাঁচিয়ে দেবে তবুও তুই এসব পাগলামো কথা বলিস না। আর এখন কথা বলার সময় নেই জলদি যেতে হবে, নয়তো তোকে বাঁচাতে মুশকিল হয়ে পড়বে।
ইসাবেলা কাঁপতে কাঁপতে ওয়াজফানের হাত ধরে চেয়ে দেখে ওয়াজফান এর দিকে—আর অনুরোধ করে ফিসফিস করে বলল,

“প্লিজ, দা… প্লিজ আমার কথাটা শোন। দেখ, ড্যানিয়েল আমাকে রেখে চলে গেছে; এখন এই বেবিটাও আমাকে রেখে চলে যাবে—আমি আর এই দুনিয়ায় বেঁচে কী করব? যদি বেঁচে থাকলেও, আমি তো নিজের জীবনই নিজেই নিয়ে নেব। আমি বাঁচতেও চাই না। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাতেই মরে যাওয়া যদি ভালো হয়, তাহলে প্লিজ—তুমি আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করো না। আমি মরে গেলেই তো আমার সন্তান আমার স্বামীর কাছে যাবো। প্লিজ, দা’, শান্তিতে আমাকে একটু মরতে ছেড়ে দাও; আমি শান্তি পেতে চাই। শান্তিতে মৃত্যু গ্রহণ করতে চাই। ”
ওয়াজফান থমকে দাঁড়ায়—মুখ খুলতে চাইলেও ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। সে চুপ করে ইসাবেলার দেহটাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ষা বারবার ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে বলছে,
“প্লিজ, ওকে বাঁচান—নিয়ে যান, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান। প্লিজ, ওয়াজফান, ইসাবেলার কথা শুনুনেন না ।”
কিন্তু ওই মুহূর্তে যেন ওয়াজফান কিছুই শুনতে পারে না; —সবাই স্তব্ধ। তার সামনে শুধু ইসাবেলার মায়ামাখা মুখটার

ইসাবেলা ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে তার শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ে। হাতটা ঢলে যায়; হৃদস্পন্দন থেমে আসে। তার চোখ দুটো বড় হয়ে, যেন শেষবারের জন্যও ওয়াজফানের দিকে তাকিয়ে আছে—এক মুহূর্তে সবকিছু থমকে যায়। ওয়াজফানের কণ্ঠে কোনো শব্দ বেরোয় না; সে কেবল নীরবে হাত বাড়ায় এবং ইসাবেলার ভেজা হয়ে থাকা, খুলে থাকা চোখ দুটো ভ্রমে ভ্রমে নামিয়ে এনে ম্লান পলকগুলো আলতো করে বন্ধ করে দেয়।
ঘরটা ভরে ওঠে সেই নিঃশব্দ শূন্যতায়—মানুষের শ্বাসচাপ কমে আসে; কেউ কাঁদছে, কেউ চিৎকার করছে না। শুধু ওয়াজফানের চেপে থাকা কষ্ট আর ইসাবেলার নিঃশব্দ বিদায়—সেই দুইটি জিনিসই এখন স্থির হয়ে যায়। ওয়াজফান হা হা কার করে বলে তুই সার্থপর হলি বোন আমাকে ছেড়ে চলে গেলি আামার কথা না তুই ভাবলি না জ্যাইম।
যা তোরা তোদের কে ও আমার লাগবে না।

কেটে গেছে কয়েক মাস,,,,,
পারস্য রাজ্যে সব কিছু আগের মতো নেই আছে তবে আছে শুধু অর্ষা আর ওয়াজফান এর ভালোবাসার মূহুর্তগুলো আগের মতোই।
আয়রাক ইয়ানা তারাও নিজের মতো দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে কারণ এখানের কোন খবর ওয়াজফান তাদের দেয় নি।
অর্ষার স্মৃতির পর্দাটা যেন কেউ ইচ্ছে করে ছিঁড়ে, আবার কিছুটা সেলাই করে দিয়েছে—যেখানে বাকি দুনিয়াটা সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢেকে গেছে। মা, বাবা, রক্তের সম্পর্ক, শৈশবের হাসি-কান্না, ভাইবোনের ছায়া—সবকিছু যেন চিরতরে মুছে গেছে তার ভেতর থেকে।

তবে এই শূন্যতার মধ্যে একমাত্র যে মুখটা রয়ে গেছে, যে নামটা আঁকড়ে ধরে আছে তার ভেতরের প্রতিটি সুতোর মধ্যে—সে হলো ওয়াজফান।
পারস্যের রাজ্য আর ওয়াজফানের স্মৃতিগুলোই এখন তার একমাত্র জীবন, একমাত্র দুনিয়া। বাকি পৃথিবী তার কাছে নেই, নেই কোনো সম্পর্ক, নেই কোনো অতীত। অন্ধকারে মোড়ানো স্মৃতির ভাণ্ডারে কেবল ওয়াজফানের ছায়াই যেন অমর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
অর্ষার চোখে এখন ওয়াজফানই শুরু, ওয়াজফানই শেষ। তার প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি ভাবনা, প্রতিটি স্বপ্নে জায়গা করে নিয়েছে শুধু এই এক মানুষ। যেন পৃথিবীর আলো-অন্ধকার সবটুকুই ঘুরপাক খাচ্ছে ওয়াজফান নামের চারপাশে।
ওয়াজফানও এই সত্যটা বোঝে—যতই অর্ষার স্মৃতি ভাঙাচোরা হোক না কেন, তার লিটল মনস্টারের এখনকার পৃথিবী কেবল সে নিজেই। আর এই ভাবনাই তাকে একদিকে শান্তি দেয়।

অর্ষা খাটে বসে গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল। ঠিক তখনই গোসলখানা থেকে বের হলো ওয়াজ ফান। সারা গায়ে ভেজা পানির ফোঁটা, বুকের কাছে জমে থাকা বিন্দুগুলো টুকটুক করে নিচে পড়ছে। ভেজা চুল চোখ পর্যন্ত নেমে এসেছে, সেখান থেকেও একেক ফোঁটা গড়িয়ে নামছে। সেই দৃশ্য যেন অর্ষার মনে অদ্ভুত এক নেশার ঝড় তুললো। ওয়াজফান এর লাল মনির চোখ দুটো আরও অস্বস্তিকরভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
অর্ষা অনিচ্ছায় এক ঢোক গিলে নিলো, তারপর হঠাৎ চোখ সরিয়ে নিলো তার দিক থেকে। কিন্তু ওয়াজ ফান ততক্ষণে সব লক্ষ্য করেছে। ঠোঁটে হালকা দুষ্টু হাসি এনে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। একটা ট্রাউজার পরে এসে খাটের সামনে বসে টাওয়ালটা অর্ষার দিকে বাড়িয়ে দিলো।

– “এত লুকিয়ে দেখার কী হলো, লিটল মনস্টার?” গলায় খেলাচ্ছলে ভরা স্বর। “পুরোটাই তো তোমার। একদম সামনে এসেও দেখতে পারো না? এবার আমাকে মুছে দাও… চাইলে ছুঁয়েও দেখতে পারো।”
কথাগুলো শুনে অর্ষার মুখমণ্ডল লাল হয়ে উঠলো। লজ্জায় কাঁপতে থাকা আঙুলে টাওয়ালটা চোখ নামিয়ে নিয়ে নিলো। ধীরে ধীরে ওয়াজ ফানের চুল মুছতে শুরু করলো সে, কিন্তু সাহস করে একবারও তাকাতে পারলো না তার চোখের দিকে।
ওয়াজফান অর্ষাকে টেনে তুলে কোলে নিলো, তার হাতে থাকা ভেজা টাওয়ালটা ছুঁড়ে দিল একপাশে। চোখে যেন একধরনের ভয়ঙ্কর জেদ—অর্ষার মুখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

—”আমার দিকে তাকাও… এত লজ্জা কেন? আমাদের মাঝে কি আর কোনো কিছু বাকি আছে যা লুকাতে হবে? তোমার মধ্যে এমনকি আর বাকি আছে যা আড়ালে লুকাতে চাও।
ওর কণ্ঠে এক অদ্ভুত শীতলতা, যেন দম বন্ধ করা অন্ধকার ঘনিয়ে আসে চারপাশে।
এমন বাঁধনহারা কথায় অর্ষার গাল লাল হয়ে উঠল, বুকের ভেতর কেঁপে উঠল অজানা স্রোতে। সে আর চোখ তুলতে পারল না, মুখ লুকিয়ে রাখল ওয়াজফানের বুকের ভাঁজে। তার নিঃশ্বাস যেন কাঁপা-কাঁপা হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ সে সেভাবেই রইল—নীরবতা আর অস্বস্তি মিলেমিশে এক অদ্ভুত ভারী আবহ তৈরি করল।
হঠাৎই একটা প্রশ্ন তার মাথায় কাঁটার মতো বিঁধল। বুকের ভেতর সাহস জোগাড় করে ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালো ওয়াজফানের দিকে। চোখ দুটো ভয় আর আশায় কাঁপছিল। তারপর গলা জড়িয়ে ধরে খুব আস্তে, প্রায় কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করল,

—”আপনি… আমাকে ভালোবাসেন?”
এক মুহূর্ত নীরবতা। অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে আছে। ওয়াজফান স্থির চোখে তাকিয়ে রইল, তারপর ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
—”না। বাসি না।”
শব্দগুলো ছুরি হয়ে বিঁধল অর্ষার হৃদয়ে। এতদিন সে ভেবেছিল হয়তো কোনো একদিন এই লোকটা বলবে—“ভালোবাসি।” কিন্তু এত কিছু পার হয়ে আসার পরও, এই নিষ্ঠুর অস্বীকার!
অর্ষা মুখ ফুলিয়ে ওয়াজফানের হাত আলগা করতে যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু ওয়াজফান আঙুল গেঁথে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল — এমনভাবে যেন ওর ছাড়া পৃথিবীটা ছিন্ন হয়ে যাবে। চুলের কানে অল্প আঘাত দিলেও ও রিলিজ দিল না; কণ্ঠে মর্মর করে জিজ্ঞেস করল,

—”কী হয়েছে? কোথায় যাচ্ছ?”
অর্ষা চোখ মিটমিট করে একটু অভিমান করে বলল, “ছাড়ুন আমাকে, ধরবেন না। আপনি আমাকে ভালোবাসেন না, তাহলে কেন ধরে আছেন?”
ওয়াজফানের ঠোঁটে একটা মুচকি হাসি নেমে এলো — তার চোখে কোনো উষ্ণতা নেই; সেখানে আছে এক ধরণের ঠান্ডা নিশ্চিততা, এক অদ্ভুত দখলের অদেখা মানচিত্র। সে ধীরে ধীরে কাপুরুষের মতো নয়, বরং কোনো সিদ্ধান্তগ্রস্ত শিকারীর মতো কানে কানে বলল,

—”এটা তোমার কাছে নতুন ব্যাপার না? তুমি যতবারই এই প্রশ্ন করো, আমি ততবারই বলেছি — আমি তোমাকে ভালোবাসি না। কারণ তুমি আমার ‘ভালোবাসা’ নও। তুমি আমার ‘আসক্তি’।
অর্ষা পুলকিত হয়ে কাঁধ আঁচড়াল—এই শব্দটা তার কানে কেমন বিষম লেগে গেল। ওয়াজফান থামল না, কণ্ঠটা নিষ্ঠুর হয়ে নামল,
—”ভালোবাসা মানে ত্যাগ। ভালোবাসলে হয়তো তুমি আমার হওয়া বা না হওয়া ঠিক করে দিতেই পারো। কিন্তু আসক্তি অন্য রকম। এটা বুকের ভেতরে একটা জমাট পাথর, একটা কাটা ক্ষত — যেখানে তুমি আছো, আর ফিরবার কোনো দ্বার নেই। আমি তোমাকে কখনো যেতে দেব না। আসক্তি কখনো ভালোবাসা হয় না; আসক্তি হয় দখল, হয় বাবদ একরকম অধিকার। তুমি আমার কাছে—তুমি আমার ভালোবাসার চেয়েও বেশি। তোমাকে হারাতে হলে আমাকে সবকিছু হারাতে হবে, এবং আমি হারাবো না।”

শব্দগুলো হাওয়ার মতো নরম ছিল না; তারা ছিল ধারালো কাচ। অর্ষার বুকের ভেতরটা হাবুডুবু খেতে লাগল।
ওয়াজফান তার চোয়ালে হাত রেখে নিচুস্বরে বলল, “কারণ তুমি আমার আসক্তি, আর আসক্তি কখনো রিলিজ চায় না। এটা জেলখানার তালা; তুমি কি জানো—এই তালা খুলে দিলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। আমি তোমাকে চিরকালই রাখতে চাই, ভেতর থেকে টেনে—অন্তর থেকে ধরে। তোমাকে প্রাপ্য না বোধ করলেই চলে যাব, কিন্তু আমি চলে যাব না।”
ওয়াজফান ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক কোমলতা মুড়িয়ে দিল—কণ্ঠে যেন কোনো প্রতিশ্রুতি আর কোন অশ্রাব্য কৌতুক মিশে আছে। তার চোখে অন্ধকারের এক অবচেতন আগুন জ্বলে উঠল যখন সে বলল,

—”তুমি মানুষ আর আমি জিন। আমি জানি তোমাদের আয়ু আমার থেকে অনেক কম। তবে এক কথা মনে রেখো—আমি তখনই তোমাকে ছাড়ব না যখন তুমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। আমি সেদিনই নিজের শ্বাসও থামিয়ে দেব—তোমার সঙ্গে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। তোমাকে ওপারেও একা থাকতে দেবো না।আর এ কারণেই আমি আমার নিঃশ্বাসটা তোমার নামে লিখে দিয়েছিলাম।
এরপর আরেকটু ফিসফিস করে বলে,
main ye dil pe likh chuka hoon,,,
tu mera hai tu mera hai…….

এই কথাগুলো অর্ষার কানে পড়তেই কোনো অদ্ভুত শান্তি তার বুকে নেমে এলো—কেমন এক ধরনের নিঃশব্দ আশ্বাস, যা ভয়কে মলিন করে দেয়। সে যেন এক বিন্দুতে থেমে গেল, ওয়াজফানের গলা থেকে ঝরে পড়া প্রতিজ্ঞাটা নিজের ভিতরে জুড়ে নিল। স্বাভাবিকভাবেই ভয়ের সঙ্গে মিশে থাকা প্রেমও এক সাথে বড় হতে লাগল—এক রকম আত্মাহুতি-সংক্রান্ত সমঝোতা।
অর্ষা ফিরে ঝুঁকে ধরল, কাঁধে মাথা দিয়ে বলল, “আমি জানি আপনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন। তবে আমার ইচ্ছা—একবার আপনার মুখে শুনতে চাই—আপনি বলুন, আপনি আমাকে ভালোবাসেন। প্লিজ, একবার শুধু।”
ওয়াজফানের মুখে এক ক্ষণ হালকা হাসি খেলল; চোখে ফিরলো সেই দূরের গভীরতা। ওর কণ্ঠে, যেন সারা রাতের একটি দিনলিপি লুকানো, আঘাত করা প্রতিজ্ঞা—

—”আচ্ছা। ঠিক আছে, বলব। কিন্তু এখন নয়। রাতের কোনো এক সময়ে—যখন তুমি নিজেকে পুরোটা আমার কাছে ভিজিয়ে দেবে, তখন আমি বলব। আজ রাতে বলবো সারা রাত বলবো তুমি যা শুনতে চাও রেডি থেকো, My queen.”
শব্দটা বলে সে নিজেই খানিকটা হেসে উঠল — সেই হাসি রোমান্টিক ছিল না, বরং এক ধরণের অধিকারী স্বীকারোক্তি। অর্ষা কোল থেকে উঠে, বুকে একটা হালকা তপ্ত ধাক্কা নিয়ে পায়ে হেঁটে গেল; পিছন দিকে তাকিয়েও না, মোরা-চোখে শুধু দেখল ওয়াজফান আরেকবার মৃদু হাসছে।

ক্যালিয়ন এখন নিকারো রাজ্যের রাজসভায়, সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে—তার চোখে এমন এক আভা, যেন কোনো মহাযুদ্ধের ঘোষণাই করতে চলেছে।
সে রাজ্যের সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে জোরে চিৎকার করে উঠল,
“এই কয়েক মাসের ট্রেনিং শেষে—অবশেষে সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।”
সকলের কণ্ঠাবলাই হয়ে উঠল—“জি, লর্ড ক্যালিওন!”
ক্যালিওনের মুখে তৃপ্তির এক কড়া হাসি ছেয়ে গেল। সে বলল,

“অবশেষে আমাদের অপেক্ষার ঘড়ি শেষ হলো—এ দিনটাই আমি বহুদিন ধরে প্রত্যাশা করেছি। ওই—ওয়াজফান… এর অনেক কিছুই সহ্য করেছি আমি; আর সহ্য করব না। সে আমার রেড ওয়াইনকে আমার কাছে থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল; আমার ছোট ভাইয়ের মতো ড্যানিয়েলকেও সে মেরে ফেলে—আমি তা মেনে নেব না। আমি ভেবেছিলাম হয়ত সে ইসাবেলা ও ড্যানিয়েল এর সম্পর্কটা কোনোভাবে মেনে নেওয়ার ভান করেছিল ,কারণ ওয়াজফান বোধ হয় ড্যানিয়েলকে খুন করে হয়ত তার বোনকে নিজের কাছেই আটকে রাখবে—কিন্তু সে এতটাই নির্মম যে নিজের বোনকেও ছাড়লোনা। জীবনে ভালোবাসা বলে তার কাছে কিছুই ছিল না; সবই স্বার্থ—ফুরিয়ে গেলে ওদের স্থান শুধু মৃত্যু। আমি আর আমার রেড ওয়াইনকে এমন নিষ্ঠুর লোকের হাতে রাখতে পারব না।”

তার কণ্ঠে উত্তেজনা বাড়ল—“আজ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি: ওই ওয়াজফান এর কাছ থেকে আমার রেড ওয়াইন কে ছিনিয়ে নিয়ে আসব; এতদিনের কষ্ট, সব প্রতিশোধ নেব—যেকোনো মূল্যেই হক না কেনো।”
এই ঘোষণা করে ক্যালিওন তার সিপাহীদের নিয়ে রওনা দিল পারস্য রাজ্যের দিকে—যুদ্ধের উদ্দেশ্যে।
রাতের অন্ধকারে পারস্য রাজ্যে প্রবেশ করে ক্যালিয়ন। ঠিক এই মুহূর্তটাই ছিল অপরিহার্য—রাজ্যের সকলে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আর এই ঘুমই হবে তাদের জীবনের শেষ ঘুম। এই ঘুমের মধ্য দিয়েই তাদের প্রাণ ছিনিয়ে নিয়ে, তার রেড ওয়াইনকে ফেরত আনা ক্যালিয়নের কাছে সহজ হয়ে যাবে। এই ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে সে সবাইকে নিয়ে রাজ্যের ভেতরে প্রবেশ করে।

রাজ্যের সবকিছু নিঃশব্দ, গভীর ঘুমে নিমগ্ন। ক্যালিয়ন এবং তার সিপাহীরা খুব সাবধানে এক এক করে ঘুমন্ত জ্বীনদের জীবন কেড়ে নেয়। ধীরে ধীরে রাজ্যের প্রায় সব জ্বীন আক্রমণে নিহত হয়, তাদের নিথর দেহ মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। তবে এই নির্মম দৃশ্য যেন এক জ্বীনকেও ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। হঠাৎ করেই চোখ খুলে যায়, আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্যালিয়ন ও তার সিপাহীদের নৃশংসতা—সবকিছু দেখে সে প্রচণ্ড ভয়ে কাঁপতে থাকে।
সঙ্গে সঙ্গে জোরে চেঁচাতে থাকে, “বাদশা! বাদশা! কোথায় আপনি প্লিজ বাঁচান আমাদের—তার চেঁচানো শব্দে রাজ্যের সবাই, এমনকি ওয়াজফানও ঘুম থেকে জাগে। অর্ষারও ঘুম ভেঙে যায়, আর এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই রাজ্য বেহাল ও অস্থির হয়ে পড়ে।

ওয়াজফানের ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই সে বুঝতে পারে রাজ্যে হামলা হয়েছে — আর এই হামলার উদ্দেশ্য ও ঘটনার কারণও বুঝতে তার এক মিনিটও লাগেনি। তাই সে সঙ্গে সঙ্গে অর্ষাকে রুমে বন্দী করে গেট আটকে দিয়ে দ্রুত নিচে নামে। তার চোখে জ্বলন্ত লাভা রাগে কচ কচ করছি সে তার জুয়েল হাত দুটো সে এমন কায়দায় আসছি মনে হচ্ছে এক দৃষ্টিতেই যেন সকলকে শেষ করে দিবে সে একাই।
আর এরপর শুরু হয় দুই রাজ্যের মধ্যে ভয়াবহ লড়াই।

এই যুদ্ধে নিকারো রাজ্যের সিপাহীদের মধ্যেই অনেকেই প্রাণ হারায়; তবে পারস্য রাজ্যের সিপাহীরা আগেই ক্ষতবিক্ষত ছিল—তারা এই রাজ্যের বহু জ্বীনকে হারিয়ে ফেলেছিল, আর যারা বেঁচে ছিল, তারা এবার নিকারো রাজ্যের সিপাহীদের সঙ্গে লড়াই চালাতে পারছে না। তাদের মধ্যে অল্প কিছু বেঁচে থাকা লোক তবুও সবাই যুদ্ধ করে চলেছে। ওয়াজফান এবার নিজের আসল রূপ ধারণ করে তার মাথা দিয়ে বড় বড় শিং বের হয়ে আসে একটাও দেখতে ভয়ংকর হয়ে যায় আর সে যার আসল রূপ নিয়েই এবার একাই—হাজার জনকে মারার জন্য যথেষ্ট —আর সে একাই নিকারো রাজ্যের বহু সিপাহীদের জান কেড়ে নেয় দেখতে এই দৃশ্যটাকে ভয়ানক মনে হয়।
তবে যখন নিকারো রাজ্যের সকলকে মারা শেষ তখন ওয়াজফান আবার নিজের মানুষরূপে ফিরে আসে ক্যালিয়নের সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটা বাঁকা হাসির সাথে বলে ওঠে,

তোকে মারার জন্য তো আমার এই রুপি যথেষ্ট তোকে তো আমি একহাতেই মেরে ফেলতে পারব তোকে মারাটা আমার কাছে কোন ব্যাপারই না এটা আমার এক হাতের কাজ মাত্র।
আর এরপরই ক্যালিয়ন আর ওয়াজফান এর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়।
আর এতক্ষন অর্ষাও বুঝে গেল নিচে কী হচ্ছে—তার হৃদয় দৌড়ে ওঠে। সে বারবার বর্ষছে, মুক্তির জন্য তাড়া করছে; বেরোবার একটাই তাগাদা ঘিরে রেখেছে তাকে। কখনো সে গেটের সঙ্গে দাঁত ঘষে, কখনো চেয়ার তুলে গেটে আঘাত করে; জমে থাকা সব শক্তি খরচ করে সে ছুটছে ছুটছে—তবু গেট যেন অচেতন, খুলতেই চায় না। অস্থিরতা ক্রমশ বেড়ে যায়; চিৎকারে কণ্ঠ ভেঙে পড়ে, বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে করতে তার সাথে আর কিছুই করা নেই—এটাই এখন তার একমাত্র কাজ।

লাশের এক বিশাল বন্যা বয়ে গেছে পারস্য রাজ্যে—প্রতিটি কোণে মৃতদেহ ছড়িয়ে, রাজ্যের সিপাহীদের নিথর দেহ মেঝেতে পড়ে আছে; নীরবতার মাঝে রক্তের গন্ধ মিশে আছে বাতাসে। ওয়াজফানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ক্যালিয়ন ও এবার আর পেরে উঠছে না ওয়াজফান এর তরোয়ালের আঘাতে এতক্ষণে ক্যালিয়ন অনেকটাই আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে।

তবে হঠাৎই যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে ক্যালিয়নের মুখে এক বাঁকা হাসি ফুটে উঠে—সে ভেবেছিল হয়তো পরাজয় অনিবার্য, কিন্তু হঠাৎ জেতার কোনো পথ খুঁজে পেয়েছে। ওর মনে পড়ে ওয়াজফানের সেই কথা—কটেজের যে দিন অর্ষা ওয়াজফানের উপর ছুরি চালাতে গিয়েছিল, ওয়াজফান বলেছিল, “শুধু তার পাজরে মারলেই তার মৃত্যু, বাকি হাজার আঘাত কিছুই করতে পারবে না তার।” ক্যালিওন তখন সেই কথাটাই পেছনে থেকে শুনেছিল—আর আজ সে বিশ্বাস করল, সেই কথার কারণেই সে নিজের জয় লেখে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
ওয়াজফান এক মুহূর্তের জন্য স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে অন্যদিকে তাকায়, ক্যালিয়ন আর একটু অপেক্ষা করে না—ততক্ষণে সে নিজের তরোয়াল চালিয়ে দেয়, ওয়াজফানের বুকের মাঝে।
তবে হ্যাঁ—তরোয়ালটা ওয়াজফানের বুকে ঢোকার আগেই হঠাৎ অর্ষা ছুটে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে যায় প্রতিরক্ষা হয়ে। এক মুহূর্তে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়—ক্যালিয়নের চালানো ধারালো তরোয়াল সোজা বিভেদ করে ঢুকে যায় অর্ষার বুকের ভেতরে।

অনেকক্ষণ যাবত অর্ষা অবিরাম চেষ্টা করেছিল—কখনো কখনো চেয়ার দিয়ে আঘাত করে অবশেষে দরজাটা ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয় সে। কিন্তু তখন যুদ্ধ ছিল শেষ পর্যায়ে। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা লাশের মাঝেই সে দেখতে পায়—ক্যালিয়নের তরোয়াল সোজা লক্ষ্য করছে ওয়াজফানকে। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে অর্ষা দৌড়ে এসে নিজের প্রিয় কায়াস্থ সাহেবকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার সামনে।
অর্ষা সঙ্গে সঙ্গেই লুটিয়ে পড়ল ওয়াজফানের কোলে। ক্যালিয়নের হাতে তখনো রক্তমাখা সেই তরোয়াল—সে বুঝতেই পারল না, আসলে কি হলো! কেন হলো! তার উদ্দেশ্য তো ওয়াজফানকে আঘাত করা, তাকে শেষ করে দেওয়া, কিন্তু অর্ষা হঠাৎ মাঝখানে এসে দাঁড়াবে—এমনটা তার কল্পনাতেও ছিল না। অবাক বিস্ময়ে, হতবুদ্ধির মতো ক্যালিয়ন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

অন্যদিকে অর্ষা ওয়াজফানের কোলে লুটিয়ে পড়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। কথা বলার, বিদায় জানানোর, কিংবা শেষ কোনো আকুতি করার সুযোগ পর্যন্ত সে পেল না। যেন এক মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে গেল—ওয়াজফানের বুকে ভেঙে পড়ল তার সমস্ত ভালোবাসা, সমস্ত জীবন।
ওয়াজফান শুধু তাকে জড়িয়ে ধরে রইল — অবাক, স্তব্ধ। কয়েক মুহূর্তেই কী হল তা মাথায় হচ্ছে না। কীভাবে তার লিটল মনস্টার হুট করে তার কোলে এসে শুয়ে পড়ল আর এখন নিথর—এই ভাবনাটা বিশ্বাস করতে পারছে না সে। ধীরে ধীরে সে অর্ষার মৃতদেহটাকে জোরে আলতো করে ঝাঁকায়, কণ্ঠ কম্পমান হয়ে বলতে থাকে—

“এই লিটল মনস্টার… এভাবে কেন শুয়ে আছিস? ওঠো না… তাকা আমার দিকে … এভাবে কেন পড়ে আছিস?”
তার হাত কাঁপছে, নড়েচড়ে উঠছে না—ভেতরের সব কিছু যেন বেরিয়ে গেছে। সে আবার গলা ভেঙে চেঁচিয়ে উঠে, “আমার লাড্ডু! ওঠো না, মজা কেন করছো আমার সাথে? উঠে যা—আমার দিকে তাকাও—দেখো আমি ভয় পাচ্ছি এই প্রথম ওয়াজফান কায়াস্থ ও ভয় পাচ্ছে, আমাকে ভয় দেখিও না, আমার সাথে কথা বলো—ওঠো না, প্লিজ—ওঠো!”

শূন্যতা আর ধীর নিঃশ্বাস—ওই ক্ষণগুলো যেন কেটে না যাবে। ওয়াজফান তীব্র আর্তনাদ করে চারদিকে ডাক দেয়—প্রহরী ! ডাক্তার! কেউ তো আসো!”—কণ্ঠে ভয়, ক্রন্দন ও বেদনা একসঙ্গে গোঁজ। সে অর্ষাকে জোরে ঝাপটিয়ে কাঁধে টেকিয়ে নিল, আর তার চোখে অচেনা আতঙ্ক — হারানোর ভয়, অপরাধবোধ ও নিঃশব্দ অনুনয় মিলেমিশে ধরা দিল।
ওয়াজফান আর্তনাদ করে চিৎকার করে ওঠে। কণ্ঠে ভাঙা সুর—কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,
“উঠো না, পাখি—প্লিজ উঠো! আমার পাঁজর—আমাকে ছেড়ে যাস না এভাবে! দেখ, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে… ওঠো না, জান, আমার লাড্ডু—ওঠো না!”
তার কণ্ঠে এক ধাক্কা, একটা নিষ্প্রাণ অনুনয়—তিনি জোরে জোরে বলে,

“আমি তোকে বলিনি কি—আমি তোকে ভালোবাসি? হ্যাঁ, আমি তোকে ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি—এক আকাশ সমান ভালোবাসি তোকে। তুই তো এটা শুনতে চেয়েছিলে না—দেখ তো, আজ আমি চিৎকার করে বলছি—আমি বলছি, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, আমার লিটল মনস্টার। এবার তো উঠে যাও—আমাকে শুনো তো।
কিন্তু অর্ষার নিথর দেহ চুপচাপ পড়ে আছে—মৃতদেহ তো আর কথা বলে না। ওয়াজফানের আর্তনাদে পুরো আকাশ যেন শূন্য হয়ে আসে; সে অর্ষার কপালে কণ্ঠ জোরে ঢেলে বলতেই অনন্ত নিস্তব্ধতা ফিরে আসে—ছেঁড়া কণ্ঠে রয়ে যায় শুধু এক রাগ আর এক অপরিণত আবৃত্তি, আর তার চোখে গলা বন্ধ করে ঢলে পড়া অশ্রুর ধারা।

এতক্ষণ পেছনে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল ক্যালিয়ন তার এতক্ষণ যাবৎ এসব টা দেখে খারাপ লাগছিল অনুশোচনা বোধ করছিল সে এবার হুট করেই যেন তার মাথায় খেলে যায় এক অজানা খেয়াল সে ওয়াজফান কে উদ্দেশ্য করে বলে, দেখেছিস ওয়াজ পান আমি আমার রেড ওয়াইনকে তোর হতে দিলাম না। ঠিক তোর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলাম সে তোর তো হলো না তবে দেখে নিস আমার হবে আমি ওকে পাইনি তো কি হয়েছে আমি ও ওপারে পারি জমাবো আমার রেড ওয়াইনের সাথে আর সেখানেই আমরা থাকবো একসাথে।

তুই আর চাইলেও আমার রেড ওয়াইন কে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবি না আমি আমার রেড ওয়াইনকে তোর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছি চিরতরে। কথাটা বলেই ক্যালিওন আর এক মুহূর্ত দেরি না করে নিজের হাতে থাকার তরোয়ালটা দিয়ে নিজের বুকেই চালিয়ে দেয় আর সঙ্গে সঙ্গেই তার নিঠুর দেহটা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। তবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে তার মুখ থেকে বের হয়ে আসে, আমি তোমায় এই দুনিয়ায় পাইনি তো কি হয়েছে তা নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই পরপারে তুমি শুধু আমারই থাকবে আজীবন আমি তোমাকে নিজের করে নিয়ে যাচ্ছি নিজের সাথে আমার রেড ওয়াইন। কথাটা বলেই সে নিজের শেষ নিঃশ্বাসটুকু ত্যাগ করে।

তবে চারপাশে কি হচ্ছে—এসবের কিছুই যেন ওয়াজফানের কানে ঢুকছে না। সে আর্তনাদ করে, নিজের লিটল মনস্টারকে জড়িয়ে ধরে। এবার অর্ষাকে বুকে আরও জোরে টেনে ধরে, কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“এ জন্মে আমি তোমাকে নিজের করে পেয়েছিলাম তো ঠিকই তবে তোমাকে নিজের করে রাখা হলো না আজীবন ভালবাসি বলা হলো না, তুমি তো আমাকে সেটা বলার সুযোগটাই দিলে না। তবে আমি কথা দিচ্ছি। পরের জন্মে যদি আমাদের আবারও দেখা হয় তখন আমি তোমাকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখে দেবো নিজের কাছে আজীবন।
পরের জন্মে দেখা হলে আমি তোমার পিছু কিছুতেই ছাড়বো না আমার বুকের পাঁজর আমার লিটল মনস্টার আমার লাড্ডু।

এগুলো বলে সে অর্ষার কপালে একটা চুমু দেয়। ওয়াজফানের গালে এখনো অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তারপর ধীরে অর্ষার নিথর দেহটা মাটিতে নামায়। পাশে থাকা তরোয়ালটা তুলে নেয়, অর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোকে বলেছিলাম না—এই নিঃশ্বাসটা আমি তোর নামে লিখে রেখেছি। যেদিন তুই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে, সেদিন এই নিশ্বাসটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর আজ—সেই দিনটা এসে গেল, তোর সঙ্গে তোর নামে লেখা নিঃশ্বাসটাও নিয়ে যা।
বলেই সে তরোয়ালটি বুকে বা পাশে চালিয়ে দেয়। ওয়াজফান আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না; সে ঝুঁকে পড়ে মাটিতে। অর্ষা বুকের মধ্যে থুবড়ে পড়ে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে—এবং সেই মৃত্যুতে লঘু এক হাসি দেখা যায় তার ঠোঁটের কোনে।

১হাজার বছর পর……..
১০০০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে—পারস্য রাজ্য এখন আর আগের মত নেই; যেন এই রাজ্যের নিজের জানটাও হারিয়ে ফেলেছে ওয়াজ ফান-এর মৃত্যুর সাথে সাথে। পারস্য রাজ্যের রাজসভার ওপরে, ঠিক মাঝ বরাবরে টাঙানো আছে অর্ষা ও ওয়াজফান-এর একটি বড় ছবি। আর তার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আয়রাক। তার যৌবনত্ত এখনো একটুও বদলায়নি, তবে শোকে—শোকে যেন তার দেহটা ভেঙে পড়েছে; চেহারায় দেখা যায় সেই শোকের ছাপ।
তার মনে জেগে ওঠে অনুশোচনার বোধ—সে ওয়াজফান-এর ছবিটির দিকে তাকিয়ে নিম্নকণ্ঠে বলে ওঠে, সেই দিন যদি রাজ্যে আমি থাকতাম, তাহলে বাদশা—আপনাকে আমি কখনো মরতে দিতাম না; আর রানী —কে বাঁচিয়ে নিতাম। আমি থাকলে হয়তো এত সবকিছুই ঘটতো না। কেন যে সেই দিন আমি রাজ্য থেকে বেইরে ছিলাম? আর সেই দিনটার জন্যই আজও পর্যন্ত আমি অনুতপ্ত।”

হঠাৎই পেছন থেকে ভেসে ওঠে একটি কণ্ঠ— “বাবা।”
আয়রাক এক মুহূর্তে পেছনে তাকায়; দেখতে পায় তার ছেলে ইয়ানকে। ইয়ান, বাবার এমন হাল দেখে, জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি আজও মাকে ভুলতে পারোনি? আজও কি মার স্মৃতি তোমাকে আঁকড়ে ধরে রাখে, বাবা?”
আয়রাক ধূপ করেই মাটিতে বসে পড়ে; হাটুরে বসে ইয়ানের সামনে এসে। ছেলের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে,

“আজও তোর মা—স্মৃতি আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। তবে সে তোকে এই দুনিয়ায় নিয়ে এসে নিজে পারি জমিয়ে ছে পারো পারি। আর তোকে আমার কাছে রেখে গিয়েছে—আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে। আর নিজে চলে গিয়েছিল এক অজানা জগতে; আমি তার সঙ্গে করে যেতে পারিনি। কারণ এখন আমার ছোট্ট দুনিয়া—তুই, আমার বাবা। আর আমি চাই না, তোর মা যেভাবে আমাকে একা রেখে গিয়েছিল, আমি তোকেও এমনভাবে একা ছেড়ে চলে যাই। তাই তো তোর জন্য আজও আমি টিকে রয়েছি।”

Death or Alive part 41

এরপর আবারো আয়রাক ইয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে আলতো চুমু দিয়ে আবারও বলে, “জানিস বাবা—ভালোবাসা না, খুব নিষ্ঠুর একটা জিনিস। কতগুলো ভালোবাসাই পূর্ণতায় পৌঁছায়নি। জ্যাইম ভালোবেসে ছিল এলিনাকে—তবে সে তাকে পায়নি; বরং উপহার হিসেবে মৃত্যু গ্রহণ করতে হলো তাকে, এলিনাও ভালোবেসে ছিল বাদশাহ কে—সে ও তাকে পায়নি। ড্যানিয়েল ভালোবেসেছিল ইসাবেলাকে, ইসাবেলাও তাকে ভালোবেসেছিল; কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস—সেই পূর্ণতা কেউও অর্জন করতে পারল না। বাদশা ও রানীর ভালোবাসা সবার থেকে আলাদা ছিল, তবু নিয়তি তাদের একসাথে থাকতে দিলো না—আজীবন। আর আমি—আমি তো তোর মাকে ভালোবেসেছিলাম; তবে আমি তাকে পেয়েও হারিয়েছি। সে আমার জীবন থেকে চলে তো গিয়েছে তবে —আজীবন তার এই শূন্যতা কখনো পূর্ণ হবে না; এ মন আজীবন রয়ে যাবে সেই শূন্যতায়।”

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here