ডার্কসাইড পর্ব ৩৭

ডার্কসাইড পর্ব ৩৭
জাবিন ফোরকান

রেমান পরিবারের বাসভবন,মেঘতীর।
বিস্তৃত হলঘরের সোফায় বসে ফাইল ঘাটছে আসমান।একবার মাত্র চোখ বুলিয়েই একটির পর একটি ছুঁড়ে ফেলছে টি টেবিলের উপর। অপরপ্রান্তে বসে কফির মগে চুমুক দিতে থাকা চারুলতা চেয়ে চেয়ে দেখছে তার কাজকর্ম।বিরক্তির আস্ফালন খচিত তার সুদর্শনা চেহারাজুড়ে।প্রায় সতেরটি ফাইল ঘেঁটে মাত্র তিনটি নির্বাচন করলো আসমান।আনমনে ঠেলে দিলো চারুর উদ্দেশ্যে।
– কি আশ্চর্য্য!কতবার বলেছি যে এক্ষুণি বিয়ে করতে আমি ইচ্ছুক নই?আমার সময় প্রয়োজন ভাইয়া।
নির্বিকার দৃষ্টি সিলিংয়ের উদ্দেশ্যে আপতিত করে আসমান উভয় বাহু ভাঁজ করে রাখলো বুকের উপর।বিড়বিড় করলো,

– বাবার ইচ্ছা।
ভ্রু কুঁচকে অত্যন্ত অনীহা নিয়ে চারুলতা ফাইল তিনটি তুললো।অনিচ্ছা সত্ত্বেও উল্টেপাল্টে দেখলো।আসমান সবথেকে ভালো পাত্রদেরই নির্বাচন করেছে।দুইজন ব্যবসায়ী,এবং একজন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর।তাদের প্রোফাইল অভিজাত এবং চারুলতার সঙ্গে মানানসই।
– ডেট করে দেখ,কাকে ভালো লাগে।
একবার দেখেই সবগুলো পুনরায় টেবিলে রেখে দিয়ে চারুলতা জানালো,
– কাউকেই না।
ভ্রু কুঁচকে তাকালো আসমান।তার দৃষ্টিমাঝে নির্দ্বিধায় দৃষ্টিপাত ঘটিয়ে চারুলতা বললো,
– এদের কেউই তো তুই নস।
শক্ত হয়ে এলো আসমানের দৃষ্টি, নয়নজুড়ে অব্যক্ত এক প্রতিফলন।
– তোর মুখ থেকে যেন আর কোনোদিন এই কথা না শুনি চারু।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল প্রবাহ খেলে গেলো চারুলতার।কপালে হাত ঠেকালো সে।আসমানকে নিয়ে তার হৃদয়ে কোনো আশা নেই।যতটুকু ছিল তা সেদিনই চাপা দিয়েছে যেদিন অনুধাবন করেছে পুরুষটি তার বোনের স্বামী।নিজের প্রাণের চাইতেও প্রিয় বোনের জীবনে কোনোপ্রকার অশান্তির সৃষ্টি করতে চায়নি সে।নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সম্পূর্ণ।কিন্তু চিত্রলেখার চলে যাওয়ার পর,আসমান যখন সম্পূর্ণ একলা হয়ে পড়েছিল,নিজের আপন প্রতিশোধের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছিল;তখন না চাইতেও দুর্বলতা জেগেছিল অন্তরে। অমানিশাকে কাছে পেতে দুর্বার হয়ে উঠেছিল হৃদয়,বেহায়া আবেদনও জানিয়েছিল সে অজান্তে।তদুপরি টলেনি হিমালয়।

“ তোর মাঝে আমি চিত্রলেখাকে দেখি চারু।বিষয়টা আবেগীয় নয়,অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক!”
জবাব দিয়েছিল আসমান এটুকুই।দ্বিতীয়বার অনুভূতি নিয়ে তার মুখোমুখি হওয়ার দুঃসাহস চারুলতা করেনি।তাছাড়া তারা বর্তমানে ভাইবোন,বিলাল রেমান আসমানকে দত্তক নিয়েছেন আপন সন্তান হিসাবে।ভাইবোনের মাঝে এমন সম্পর্ক?অত্যন্ত কদর্য।নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে চারুলতার আসমানের প্রতি টান ফিকে হয়ে এসেছে।তাদের জীবনে রোযার আবির্ভাব ঘটার পর অনুভূতিতে আরো বিস্তর ভাটা পড়েছে।প্রথম প্রথম কষ্ট পেয়েছিল প্রচুর,অভিমান হয়েছিল আসমানের উপর,তাকে নির্বাচন না করে ভিন্ন কাউকে গ্রহণ করায়।কিন্তু যত দিন পেরিয়েছে তত বুঝদার হয়েছে।

আসমানের মতন পরাশক্তিকে সামলানোর ক্ষমতা তার নেই।একটিমাত্র মানুষের ছিল, চিত্রলেখা।এবং বর্তমানে?হয়ত….রোযা!
– আমি বিয়ে করবো না।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অতঃপর কঠোর কন্ঠে জানালো চারুলতা।আসমান নির্বিকারভাবে বসমান।প্রতি উত্তর করলোনা কোনো।অগত্যা কফি নিঃশেষ করে উঠলো চারু,
– আমাকে যেন এই বিষয়ে জোর করা না হয়।
– বাবাকে বলিস।
উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিলেও থমকে পড়লো চারুলতা।হনহন করে আসমানের নিকটে এগোলো,
– বাবার ইচ্ছার এতই মূল্য তোর কাছে?তাহলে সে যে চাইলো তুই রোযাকে বিয়ে কর,সেই ইচ্ছা কেনো পূরণ করছিস না ভাইয়া?

বুক থেকে ঝুলে পড়লো আসমানের উভয় হাত, মুষ্টিবদ্ধ হলো কোলের মাঝে।নিঃশব্দ রইলো,দৃষ্টি সরিয়ে কোনোপ্রকার শব্দ উচ্চারণ করলোনা।
– আমি জানি।আমাকে নতুন করে শেখাতে হবেনা।রোযা তোকে পছন্দ করে, আর তুই ওকে তোর জীবনে জায়গা দিলে সে অবশ্যই আসবে।আমাকে নাহয় দূরে ঠেলে রাখিস,কিন্তু রোযা কি দোষ করেছে?
এবারেও নীরবতা। চারুলতা তাতে খানিক তেঁতে কিছুটা উচ্চশব্দেই বলে ফেললো,
– বৈরাগী দেবদাস হয়ে কাটাবি সারাজীবন?
– হ্যাঁ।

প্রশান্ত জবাবে হতচকিত হয়ে চারুর অধরে অধর চাপলো।যদিও আসমান শান্ত রয়েছে,তবুও তার সম্পূর্ণ অবয়বজুড়ে অদ্ভুতুড়ে এক অশরীরী প্রভাব নজরে পড়ছে যেন।সতর্কবাণী। পিশাচকে ঘাটানো উচিত হবেনা।তার সঙ্গে কোনোপ্রকার তর্কে লিপ্ত হওয়ার আগ্রহবোধ না করে আসমান সোফা থেকে উঠে কিচেনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো,উদ্দেশ্য ঠান্ডা এক বোতল ফলের রস।এই শীতেও শীতল পানীয় পানে তার কোনো অনীহা নেই। চারুলতা শুধু দূর থেকে চেয়ে দেখলো তার কার্যক্রম।পরক্ষণে দৃষ্টি নামিয়ে ধপ করে বসলো সোফায়।মাথায় চাপলো তর্জনী।
– আসমান ভাই!

অতর্কিত কণ্ঠটি তাকে বিহ্বল করে তুললো।ঝট করে ঘুরে তাকাতেই বিশাল প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে লক্ষ্য করা গেলো নিহাদকে।ভীষণ হন্তদন্ত হয়ে আসছে।শীতের মাঝেও ঘেমে গিয়েছে,তাতে কপালে চুলের গুচ্ছ লেপ্টে রয়েছে। গ্রীবাদেশে আভার প্রতিফলন ঘটিয়ে কয়েক ফোঁটা চিকচিক করছে।কিন্তু সেই সৌন্দর্য্য অবলোকনের অবকাশ নেই।ভীষণ চিন্তিত সে,ভ্রুজোড়া তীব্রভাবে কুচকে আছে, নয়নজুড়ে এক শীতল আতঙ্ক।
– কি হয়েছে?
আসমানের আগে চারুলতাকে দেখতে পেলো নিহাদ।দ্রুত এগোলো।হাঁপাচ্ছে খানিক।
– রোযা কোথায় জানো?
– মানে?কি বলছ কি?আমি কিভাবে জানবো?ওর সাথে তোমার বেশি কথা হয়।
– হয়।কিন্তু বাসায় নেই।ভাবলাম কোথাও গিয়েছে কিনা। ফোন বন্ধ।অথচ আমাকে কল করেছিল, বাইকে থাকায় ধরতে পারিনি। পরে বাসায় গিয়ে দেখলাম তালা,নিচতলার স্টুডেন্ট জানালো এখনো ফেরেনি।কেমন অদ্ভুত লাগছে বিষয়টা।

চারুলতা তড়িৎ গতিতে নিজের ফোন বের করলো।বান্ধবী ফারিয়ার নাম্বার ডায়াল করলো।ততক্ষণে কিচেন থেকে আসমান চলে এলো,নিহাদের সকল কথাই সে শুনেছে।কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন করলোনা। চারুলতা কথা শেষ করে ফিরেই বললো,
– ফারিয়া জানালো এক কলিগের বার্থডে পার্টি ছিল, কিন্তু সেটা শেষ করে ৮ টার দিকেই সবাই যার যার বাসায় চলে গিয়েছে।
ঘড়ির কাঁটা বর্তমানে সাড়ে দশটার ঘরে।আসমানের দৃষ্টিতে কিঞ্চিৎ চিন্তা প্রদর্শিত হলো।নিহাদ আনমনে বললো,
– আমার কেমন যেন লাগছে।মনে হচ্ছে কোথাও যেন একটা কিন্তু রয়ে গিয়েছে। পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছেনা টাইপ ব্যাপার।কি যেন একটা অসঙ্গতি….

– কল দাও।
– হ্যাঁ?
– রোযার ফোনে।আরেকবার কল দাও।
আসমানের বক্তব্যে নিহাদ তাই করলো।পুনরায় ডায়াল করলো রোযার নাম্বার।কিন্তু সংযোগই ঘটলোনা।যান্ত্রিক রমণী জানালো,
– দুঃখিত।এই নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
– ও কি আসলেই ঠিক আছে?
চারুলতা আনমনে বিড়বিড় করতেই আসমান অনুভব করলো তার শরীরজুড়ে হিমশীতল এক তরঙ্গ খেলে গিয়েছে।ঠিক কিসের এমন অনুভূতি তা অনুধাবনের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ত্যাগ করে দ্রুত নিজের ফোন বের করলো।বহুদিন বাদে নিজে থেকে নাম্বারটিতে কল করলো।ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রথমবারের মতন বলে উঠলো,

– আসাদ উদ্দিন?
– কি*লিং মেশিন!কি সৌভাগ্য!প্রথমবার তুমি নিজে থেকে কথা বললে।বলো,নতুন কি তথ্য দিয়ে তোমায় সাহায্য করতে পারি?
কিঞ্চিৎ ইতস্তত করলো আসমান।তারপর সব দ্বিধা ঝেড়ে শুধালো,
– রোযার কোনো খবর আছে আপনার কাছে?
এক মুহুর্ত নীরবতা।
– না।ওই একবারই এসেছিলো আমার দুয়ারে।যোগাযোগ হয়নি।
– ও কোথায় আছে এই মুহূর্তে সেই খবর পেতে কত সময় লাগবে?
– কমপক্ষে তিনদিন।আমি একদমই হাতছাড়া।তোমার কন্ঠে বুঝতে পারছি এই মেয়ে গায়েব হয়ে গিয়েছে কোথাও।সবকিছু বিশ্লেষণ করে সঠিক তথ্য জানাতে সময় প্রয়োজন হবে।

– সময় নেই।
আবারো এক দীর্ঘ নীরবতা।তারপর প্রশ্ন,
– তুমি কিছু সন্দেহ করছো?
– করছি।
– ঠিক আছে।দুই মিনিট সময় দাও।
এটুকু বলতেই লাইন কেটে গেলো।আসমান স্থির তাকিয়ে রইলো স্ক্রিনে।নিহাদ এবং চারুলতা উভয়ে উৎসাহী হয়ে চেয়ে আছে।কিন্তু কোনো উত্তর না করে চুপচাপ সোফায় বসলো আসমান।দৃষ্টি গেলো ঘড়ির দিকে।সাড়ে দশটা পেরিয়ে পঁয়তাল্লিশের ঘরে কাটা।নিজের মাঝে দুশ্চিন্তা অনুভব করলো আসমান।মেয়েটা গেলো কোথায়?আদতেই গিয়েছে নাকি?নিজের চুলে আঙুল চালালো।জোর দিয়ে চেপে ধরলো কেশরাশি আপন হাতের মাঝে।রোযার উপর নজর রাখা দরকার ছিলো।কে বি গ্রুপের পতনের কারণে বিষয়টি হেলাফেলা করে বিরাট ভুল করে ফেলেছে আসমান।ভেবেছিল প্রয়োজন হবেনা।মেয়েটির সঙ্গে কোনোপ্রকার সম্পর্ক না রাখলে কেউই তাকে খেলার গুটি বানাবেনা।কিন্তু ভাগ্যের পরিকল্পনা সর্বদাই ভিন্ন কিছু ছিল আসমানের জীবনে।

চিত্রলেখাকে রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে সে।তবে এবার কি রোযাকেও…..
না!
অন্তরাত্মা চেঁচিয়ে উঠলো তীব্রভাবে। ধুমধুমার স্পন্দনে কাপলো হৃদযন্ত্র।নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রক্রিয়ায় অস্বস্তি হচ্ছে।এক টানে মাস্ক খুলে ফেললো।আবিষ্কার করলো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসেও দরদর করে ঘামছে।
– আসমান ভাই,তুমি ঠিক আছো?
নিহাদের চিন্তিত প্রশ্নে আসমান মাথা নাড়তে চাইলেও পারলোনা।তার সমস্ত অস্তিত্ব বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে।প্রতিবাদের জোয়ার তুলে জানাচ্ছে আসমান ভয় পেয়েছে! রোযাকে হারিয়ে ফেলার ভয়!
—কাপুরুষ আসমান!এবারেও ব্যর্থ হলি রক্ষকের ভূমিকায়। দূরে ঠেলে দিলেই সবকিছুর সমাধান হয়না।আগলে রাখতে জানতে হয়,বেঈমান!
ঢোক গিললো আসমান,অস্বস্তি জেঁকে বসেছে তার বক্ষে।অবস্থা বেগতিক দেখে চারু ছুটলো,দ্রুত এক গ্লাস পানি আনলো।কিন্তু আসমান ঠেলে সরিয়ে দিলো, পান করলোনা।

– খারাপ লাগছে?ডাক্তারকে ফোন করবো?
– তুমি আংকেলকে জানাও চারুলতা।
জীবনে প্রথম সঠিকভাবে নিহাদ তার সম্পূর্ণ নামটি উচ্চারণ করেছে তা খেয়াল করবার অনুভূতি অবশিষ্ট নেই চারুর মাঝে।দ্রুত বিলাল রেমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিস্তারিত জানাতে থাকলো সবকিছু।তিনি কোম্পানিতে রয়েছেন এই মুহূর্তে।
আসমানের ফোন ভাইব্রেট করে উঠতেই তীর্থের কাকের ন্যায় অপেক্ষারত পাথরমানব অতি দ্রুত তা কানে চাপলো।
– কামরুল গ্যাংয়ের নাম শুনেছ?
– হুম।
– গতকাল আমার কাছ থেকে বিদেশী মালের ডেলিভারি নিয়েছে।কোনো জরুরী মিশনে আছে।বেশিকিছু জানা সম্ভব হয়নি,একটা মেয়ে তুলে নেয়ার কেইস সম্ভবত।
অধরে অধর চেপে ধরলো আসমান।নিয়ন্ত্রণ করলো নিজেকে।
– কামরুল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চ্যালা।উঠাবসা,মিশন মন্ত্রী সাহেবের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী!
আসমানের স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো এক অন্তিম দৃশ্য এবং তার অভিসম্পাত,

“ তুই যেই হস না কেনো, একদম কিন্তু শেষ জাইনা রাখিস!আমার মায় খাদ্যমন্ত্রী,আর বাপ… ”
“ নিজের শনি নিজে ডাইকা আনিস না।স্বরাষ্টমন্ত্রী কিন্তু আমার দুঃসম্পর্কের খালু লাগে!”
রায়হান?
বিদ্যুৎ খেলে গেলো যেন আসমানের শরীরে।ইচ্ছা হলো ফোনটি আছাড় দিয়ে ক্রোধ নিবারণ করতে।কিন্তু সেই বাসনা নিয়ন্ত্রণে আনলো ধাতব দেহে শক্তভাবে আঙুল চেপে।
– থ্যাংক ইউ।
এটুকুই।ফোন কেটে অতি দ্রুত উঠলো।কাউকে কোনোপ্রকার কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো নিজের ঘরে।নিহাদ এবং চারুলতা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি ব্যতিত আর কিছুই করতে সক্ষম হলোনা।

মিনিট পনেরোর মাথায় আসমানের দেখা মিললো।দুশ্চিন্তায় পায়চারি করতে থাকা নিহাদ তার অবয়ব লক্ষ্য করে থ হয়ে গেলো।পুরোদস্তুর তৈরী সে।সাদা শার্ট এবং কালো ক্রপসুটে আবৃত সর্বাঙ্গ। ভারী জুতোর সোলের শব্দ প্রতিধ্বনি তুলছে দেয়ালে দেয়ালে।রাত এগারোটার সময় তার এমন প্রস্তুত মনোভাব লক্ষ্য করে চারুলতা প্রশ্ন ছুড়লো,
– বাবা আসছে।তুই কোথায় যাচ্ছিস?
– স্বরাষ্ট্র দপ্তরে।
হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকল চারু,সম্পূর্ণ জমে গিয়েছে সে।কিছুতেই যেন আসমানের উত্তর বিশ্বাস হচ্ছেনা তার।এক মন্ত্রীর দপ্তরে?এই রাত্রিতে?এই ছেলে কি উন্মাদ হয়ে গেলো?
থামলোনা আসমান।হেঁটে চললো দুর্বার ঘূর্ণিঝড় হয়ে।বিনা বাক্যে তাকে অনুসরণ করলো নিহাদ।প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই এই অমানিশার দুয়ারে।পুনরায় যেন এক ধ্বংসকাব্য রচনা করতে চলেছে আজ। তারই এক বিধ্বংসী পূর্বপ্রস্তুতি।

স্রোতধ্বনি ঠেকছে কর্ণগুহরে। ধীরগতিতে যেন বালুচরে আছড়ে পড়ছে প্রবাহ।মৃদু দুলুনি তার মিলিয়েছে ঊর্মির তরঙ্গের সনে। বায়ুমালা বইছে ফিসফিসে সুরে,এক অনবদ্য সঙ্গীতের স্বরলিপি রচনা করে।যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।অদ্ভুত এক আকর্ষণ শ্রবনাঙ্গজুড়ে।বহুক্ষণ রইলো এই আসক্তিময় আবেশ।অতঃপর নেত্রপল্লব মেললো।ক্রমশ ঝাপসা হতে স্পষ্টতর হয়ে এলো দৃষ্টি।
মাটিতে লুটিয়ে রয়েছে রোযা।ঠিক মাটি নয়, ধাতব মেঝে।বরফের মতোন শীতলতায় ছেয়ে রয়েছে সম্পূর্ণ স্থান। হিম টুকরোয় পরিণত হয়েছে যেন শরীর।কয়েক মুহূর্তের জন্য যথার্থ চালু হলোনা মস্তিষ্ক।শুধুই অবোধ অনুভব।অতঃপর ধীরে ধীরে উপলব্ধি হলো পরিস্থিতি।

নদীতে ভাসমান এক লঞ্চের ছাদে নেতিয়ে রয়েছে রোযা।তার ঠিক সামনেই অদূরে চারিপাশে গোল হয়ে বসে আপনমনে তাস খেলে চলেছে গাট্টাগোট্টা ধরনের কিছু লোক।নিষিদ্ধ তরলের কটু গন্ধের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে আশেপাশের দুর্গন্ধযুক্ত বায়ু।ঘন কালো গগনের ছায়াতল থেকে ভেসে আসছে লঞ্চের সাইরেনের আওয়াজ।বুড়িগঙ্গার ঘাট?আপনমনে ধারণা করে নিলো রোযা।
– ওই ওই,মাইয়ার হুশ আইসে মনে হয়।
– কামরুল ভাইরে খবর দে।

দুইজন লোক উঠে হড়বড় করে নিচতলায় নেমে যেতেই রোযা নড়েচড়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠলো।তার হ্যান্ডব্যাগটি খানিক দূরেই রয়েছে,নাগালের মাঝে।মাথায় কি চিন্তা খেললো জানেনা।সেটি কাছে টেনে নিহাদের দেয়া টিজারটি পরিধানের কামিজের আড়ালে লুকিয়ে ফেললো।প্রচণ্ড শীতে থরথর কাপছে তার সর্বাঙ্গ। নাক বেয়ে ঢুকছে হিমশীতল বায়ু, সম্পূর্ণ শ্বাসনালী কেমন অবশ হয়ে পড়েছে।র*ক্ত জমাট বেঁধে যেন পাথরে পরিণত হয়েছে অঙ্গজুড়ে।
কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে এলো কয়েকজন লোক।যাদের দলপতি বিশালদেহী এক কুস্তিগীরের মতন দেখতে পুরুষ।সম্পূর্ণ কালো পোশাকে আঁধারের মাঝে রীতিমত মিশে গিয়েছে যেন।শ্যামলা বর্ণের চেহারায় ঝুলছে এক কুটিল প্রভাব।অধরের কোণে জ্বলজ্বল করছে ফুঁকতে থাকা সিগারেট। রোযার সম্পূর্ণ শরীরজুড়ে দৃষ্টি বুলিয়ে এনে তীর্যক হাসলো,সিগারেট ঠোঁটে ধরেই বিড়বিড় করলো,

– ওহ, পুতুল তাহলে নাচার জন্য তৈরি?
– আপনারা কারা?আমাকে কেনো তুলে এনেছেন?কি চাই আমার কাছে?
জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে কামরুল নামক দলপতি ধীরগতিতে এগোলো রোযার উদ্দেশ্যে।যেন শিকারী এগোচ্ছে শিকারকে লক্ষ্য করে, অভিব্যক্তিতে লোভনীয় অনুভব।হাতের ভরে পিছিয়ে যেতে থাকলো রোযা,অজান্তেই।একটা সময় ধাক্কা খেলো শীতল ধাতুর চিমনিতে, পেছানোর জায়গা অবশিষ্ট নেই।কামরুল তার সন্নিকটে এসে থামলো। হাঁটু মুড়ে বসে মুখ থেকে সিগারেট সরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো।ইচ্ছাকৃতভাবেই,যেন তা রোযাকে অস্বস্তি দেয়। খুকখুক করে কেশে উঠলো রোযা,চোখ খিচে মুখ নামিয়ে নিলো।কিন্তু পারলোনা। ধা*রালো নখরযুক্ত আঙুল তার চিবুকে ঠেকলো,এতটা জোরের সঙ্গে যে কোমল ত্বকে তা আচ*ড়ের দাগ ফেললো। জ্বলুনিতে ভ্রু কুচকে রোযা তাকালো কামরুলের দিকে।

– চাই তো তোমার সোয়ামীকে পাখি!কিন্তু তুমিও মন্দ না,ভালোই টসটসে। সোয়ামীকে সবটাই ঢাইলা দিছ নাকি পবিত্রতা কিছু বাকি আছে?
– সংযতভাবে কথা বলুন মিস্টার!
কাষ্ঠহাসি হাসলো কামরুল।রোযার মুখের কাছে ঝুঁকে এলো।এই বুঝি ছুঁয়ে দেবে!কিন্তু দিলোনা।বরং তার গালে আঙুল বুলিয়ে যেতে যেতে বললো,
– সংযত?তাও এই কামরুল?শোনো পাখি, তুমি মনে হয় বুঝতে পারতেছোনা কি পরিস্থিতিতে আছো তুমি।তোমার কোনো ডিমান্ড করার অধিকার নাই বুঝলা?শুধু আমাদের ডিমান্ড ফুলফিল করবা।তাইলেই মুক্তি পাবা।
রোযার সামনে দুপায়ে বসলো কামরুল।তারপর সিগারেট দূরে ছুঁড়ে অন্তিম ধোঁয়া পরিত্যাগ করে দুহাতের আঙুলগুলো একত্রিত করে মটকালো কিছুক্ষণ।আড়মোড়া ভাঙার অঙ্গভঙ্গি করে ডাক ছুড়লো,

– ওই মনা যন্ত্রপাতি নিয়া আয় দেখি!
একজন লোক হাজীর হলো সহসাই। সাঁড়াশির মতন দেখতে একটি সিলভার ধাতুতে তৈরি যন্ত্র তুলে কয়েকবার চাপ দিয়ে দেখালো কামরুল,
– বুঝলা পাখি?এইটায় কিন্তু অনেক ব্যাথা।তোমারে ভাল্লাগছে।ব্যথা দিতে চাইনা।তাই বলতেসি,যা জিজ্ঞেস করব সুন্দর মতন বলবা।ওকে?
একটি শক্ত ঢোক গিললো রোযা।সাঁড়াশি থেকে দৃষ্টি সরাতেই পারছেনা হাজার চাওয়া সত্ত্বেও।কি হতে যাচ্ছে তার সঙ্গে?

– এইবার বলো দেখি,তোমার সোয়ামীর পুরা নাম কি?সে কি করে?কোথায় থাকে?তার দুর্বলতা কি কি?তোমারে ছাড়লো কেনো?তার কাছ পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছানো যায়?বলো বলো,শরম কইরো না।
আসমানের সম্পর্কে জানতে চায়?আবার এটাও জানে বর্তমানে তাদের মাঝে কোনো বন্ধন নেই।ব্যাপারটা কি হলো? এরা কি ভাবছে আসমান আদতেই নীলাদ্রি রেমান নীল? বিলাল রেমানের ছেলে?তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে?এমন কিছু? রেমান গ্রুপের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী কি এরা?
উত্তর যাই হোক, এরা আসমানের শত্রু এটুকু নিশ্চিত।তাই এদের কাছে প্রিয়তমর কোনোপ্রকার তথ্য প্রদানের অর্থই হয়না। দাঁতে দাঁত চেপে রোযা জবাব দিলো,

– আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছিনা।আমার কোনো স্বামী নেই।আমি অবিবাহিতা।
হাসলো কামরুল।নিদারুণ শব্দ তুলে।আশেপাশে ঘিরে দাঁড়ানো লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– মারেম্মা!পাখি দেখি আবার নাটকও জানে!
– আমি নাটক করছিনা।আপনারা ভুল মানুষকে পাকড়াও করেছেন।
– ওমা,এত বড় ভুল কিভাবে করলো কামরুলের লোক?চিন্তার বিষয় তো!
নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে বলতে রোযার বাম হাত মুঠোয় নিয়ে তর্জনী আঙুলে সাঁ*ড়াশি চা*পলো কামরুল।তার কালচে শুষ্ক ঠোঁটে যথারীতি হাসির রেখা।
– খুব মজা না….পাখি?

রোযার সমস্ত শরীরে যন্ত্রণা তরঙ্গ ছড়িয়ে আ*ঙুল সাঁ*ড়াশিতে অতি জোরে চা*পলো কামরুল,তাতে চা*মড়া ছিঁ*ড়ে র*ক্তপা*ত ঘটলো, হা*ড়ে পড়লো প্রচণ্ড চাপ। না চাইতেও বেদনায় কুকড়ে গেলো রোযা, যন্ত্রনাবোধক ধ্বনি নির্গত হলো কন্ঠ থেকে।ঠিকরে এলো অশ্রু।তবুও দাঁতে ঠোঁ*ট কামড়ে সহ্য করে গেলো সে।
কামরুল ছাড়লো তার আঙ্গুল,পাক্কা এক মিনিট পর।ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।আঙুল না বা*কায় রোযা ধারণা করলো হাড় ভা*ঙেনি,যদিও বাহ্যিক অবস্থা মর্মা*ন্তিক।
– এইবার বলো।তোমার স্বামী….উপস…এক্স স্বামীরে কিভাবে বাগে আনা যায়?শুনছি আড়ালে আড়ালেই থাকে।তাইলে আমাদের রায়হান ভাইয়ের সাথে শত্রুতামি ছিল কিসের?
হাসলো রোযা।এই অবস্থায়ও তার অধরে হাসির উৎপত্তি লক্ষ্য করে কামরুলের ভ্রু কুঁচকে এলো।

– বাগে আনবেন?তাও অমানিশাকে?ওই দানব এক ঘূর্ণিঝড়,যাকে আবদ্ধ করার চেষ্টা করলেই ধ্বং*স অবধারিত। বায়ুঝড়কে কি আর আবদ্ধ করা যায়?
রোযার দৃষ্টির উদগীরণ সহ্য হলোনা।এক ঝটকায় তার ঘাড় চে*পে ধরে পিছনের চিমনির সঙ্গে সজো*রে ঠু*কলো কামরুল।একবার….দুইবার…তিনবার!রোযার মা*থা ফে*টে র*ক্ত বেয়ে ভিজিয়ে ফেললো কাপড়।
– অতিরিক্ত তেজ শরীরে পাখি,দেখি এই তেজের মতন র*ক্ত আছে কতটুকু!
রোযার সম্পূর্ণ পৃথিবী যেন তার সম্মুখে বনবন করে ঘুরতে আরম্ভ করলো।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইকবাল আহসান আজ কিছুটা উৎফুল্ল রয়েছেন।বিরাট এক ব্যবসায়ীর কাস্টমসের মালামালের নিরাপত্তা অজুহাত ব্যবহার করে বেশ বড় রকমের একটি অংকের ডিল সম্পাদন করেছে তার সেক্রেটারি। ডিল?উহুম। খাঁটি ভাষায় বলা যায় ঘুষ।ব্যবসায়ী বর্তমানে তার অফিসের ঠিক বিপরীত প্রান্তের চেয়ারটিতে বসে আছে। আগামীকালই বিদেশে যাবে,খুব দামী তার সময়।তাই এমন রাতেই এই মিটিংটা রাখা হয়েছে দপ্তরে।তাছাড়া কর্মচারীদের দেখানো দরকার। মন্ত্রীমশাই কতটা কর্মচঞ্চল!

– চিন্তা করবেন না।সরকারি বাহিনীর ব্যাপারটা আমি মাথায় রাখবো।আপনার মাল আটকাবে না।
– ধন্যবাদ।আসলেই বড় বিপদে পরে গিয়েছিলাম এই মালামাল নিয়ে।
এক ঝলক হাসি উপহার দিয়ে ইকবাল সাহেব নিজের চেয়ারে হেলান দিলেন।কন্ঠ পরিষ্কার করে প্রস্তুতি নিলেন এক মহান ভাষণ প্রদানের।যা রাজনৈতিক বিভিন্ন জনসভায় প্রায়শই দিতে হয় তাকে।মিথ্যার জালে নিপুণভাবে বোনা একেকটি ভাষণ শুনলে হয়ত ইবলিশও লজ্জাবোধ করবে!
তবে আজ আর ভাষণ প্রদানের সুযোগ হলোনা।মধ্যবয়স্ক সেক্রেটারি একপ্রকার হড়বড় করেই বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়ল অফিসে।তাতে ত্যাক্ত হয়ে কিছু উত্তপ্ত বাক্য ছুড়তে উদ্যত হচ্ছিলেন,কিন্তু সহকারীর বাক্যে তার আত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় হলো এক লহমায়।

– আসছে…
– কে আসছে?
– ও…
– ধুরু মিয়া!রাত বিরাতে মশকরা করো?কে আসছে জিজ্ঞেস করছি। যেই আসুক না কেনো বিদায় করো, এখন দেখা করার সময় নেই।
– কি*লিং মেশিন…!
জমে গেলেন ইকবাল।সম্পূর্ণ।নিজের শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করলেন না কয়েক মুহূর্ত।অপলক চেয়ে থাকলেন।
– ক…কে?
সেক্রেটারি বলার সুযোগ পেলোনা।প্রচণ্ড গুঞ্জন কানে এলো।এক ঝটকায় অফিসের দরজা খুললো।এতটা জোরে যে তা ঠাস করে দেয়ালে গোত্তা খেল।এক লাফে স্থান থেকে সরে পড়লো সেক্রেটারি।অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো সাদা শার্ট এবং কালো ক্রপ স্যুট পরিহিত….

আসমান!
ওই নিগূঢ় কৃষ্ণগহ্বরে দৃষ্টিপাত করে ইকবাল সাহেবের কিছুই উপলব্ধিতে বাকি থাকলোনা।তার দুয়ারে আজ হানা দিয়েছে স্বয়ং মৃ*ত্যুদূত!
সামান্যতম সময় ক্ষেপন করলোনা আসমান।ভেতরে ঢুকে দ্রুত পদক্ষেপে মন্ত্রীর টেবিলের কাছে এলো।ঝুঁকে এক ঝটকায় শক্তিশালী মুঠোতে আঁকড়ে ধরলো মন্ত্রী সাহেবের কলার!টেনে তুললো গদি থেকে। ধারালো দৃষ্টি মেলালো আঁখিতে।

সকল স্মৃতি যেন অন্তরে উদঘাটিত হলো,পুরোনো ছবির অ্যালবামের মতন।কে বি গ্রুপের হাত জেঁকে বসেছিল সরকারের উপর।আসল ক্ষমতাবান দেশচালক যেন তারাই।সুযোগ নিতে পিছপা হয়নি সরকারও।বিভিন্ন ছাড় এবং সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে অসংখ্যবার ব্যবহার করেছে কে বি গ্রুপের হাতিয়ার, আপন রাজনৈতিক কিংবা কূটনৈতিক শত্রু ধ্বং*সে।তাকেই এইসব কার্যক্রমের প্রধান দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল।তাই এই বান্দার সম্পর্কে তার ধারণার কোনো শেষ নেই।

স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অফিসে আজ কর্মচারীগণ স্তব্ধ।বিপরীত প্রান্তের চেয়ারে বসে মাত্রই ঘু*ষ প্রদান করে কাজ আদায় করতে আসা ব্যক্তিটিও একদম লেপ্টে গিয়েছে আতঙ্কে।উপস্থিত নিরাপত্তা সদস্যগণ আপন আপন অ*স্ত্র উদ্যত করে আছে ঠিকই,কিন্তু থরথর করে কাপছে তাদের সর্বাঙ্গ।এ কোন মহাপ্লাবন এলো তাদের চৌকাঠে?
স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোটের কলার চেপে ধরেছে!ঠিক কতটুকু ক্ষমতার প্রয়োজন হয় বিনা বাক্যে এহেন গুরু*তর কাজটি সম্পাদনের দুঃসাহস করতে?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছেন মন্ত্রী,তার বয়সের ছাপ পড়া চেহারায় এক আতঙ্কের অভিব্যক্তি খচিত।অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়েছেন ওই নিগূঢ় কৃষ্ণগহ্বর নয়নপানে।সম্পূর্ণ শরীর যেন তার স্থবির হয়ে পড়েছে। মৃ*ত্যুদূতের মুঠোয় তিনি বন্দী সম্পূর্ণ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এগোতে চাইলে কাপা কাপা হাত তুলে তাদের থামতে ইশারা করলেন ইকবাল সাহেব।দুরুদুরু বক্ষে মোকাবেলা করলেন দানবের।ক্রোধান্বিত হয়েছে,অধিক আগ্রাসনে কেয়ামতে পরিণত করবার কোনো প্রয়োজন নেই।
ঝুঁকলো আসমান,অসহনীয় দৃষ্টিপাত করে সর্বাঙ্গে শিহরণ খেলানো বজ্রকন্ঠে মন্ত্রীকে শুধালো,
– তথ্য নাকি মৃ*ত্যু?কোনটি নির্বাচন করতে ইচ্ছুক?
বাকরুদ্ধ সকলে।

– অমানিশা নির্দয়, সুযোগবিহীন।তবুও আপনাকে দিচ্ছে।বিন্দুমাত্র অপব্যবহার,এই ক্ষমতার আসনের ধ্বংস!
টেবিল ঘুরে এলো আসমান,এক পা তুলে ধপাস করে রাখলো ক্ষমতাবান গদিতে।শিহরিত হয়ে উঠল প্রত্যেকটি সত্তা।তবুও যেন সম্মোহিত আকর্ষণীয় দৃশ্যপটে।এক নজর আপন গদি এবং তারপর মেশিনের অবয়বে তাকালেন ইকবাল সাহেব।প্রশ্বাস টেনে হৃদযন্ত্র নিয়ন্ত্রণের অবাধ্য প্রচেষ্টা করলেন।
– তুমি কি চাও?
অতি বিহ্বল কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মন্ত্রী, ঘামের ফোঁটা চুইয়ে নামছে তার ললাট থেকে গ্রীবায়। নিশ্বাসরুদ্ধ করে চেয়ে আছেন অমানিশার পানে। পরাশক্তিধর ওই কন্ঠ গভীর আবেদনে আদেশ করলো,
– চাঁদ তার জ্যোৎস্না ব্যতীত অসম্পূর্ণ,আমার জ্যোৎস্নাকে চাই।
জ্যোৎস্না?অনুধাবনে তেমন কিছুই বাকি রইলোনা তার।কাঠের পুতুলের মতন বলতে থাকলেন,

– আমি কিছুই জানিনা।আমার বউয়ের চাচাতো বোন জোবায়দা আর্জি জানিয়েছিল,কামরুলকে কাজ দিয়েছি।এরপর যা করার ওরাই করেছে।
– কামরুল কোথায়?
– জোবায়দা জানবে।
কলার ছাড়লো আসমান।যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন ইকবাল সাহেব।শরীর ছেড়ে এলো, এলিয়ে পড়তে চাইলেন।কিন্তু গদিতে পাথর মানব অতি অবহেলায় পা তুলে রাখায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকাই শ্রেয় মনে হলো।আসমান কি যেন ভাবলো,অতঃপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে জানতে চাইলো,
– এখন খাদ্যমন্ত্রীর বাড়িতে যাওয়ার মতন কষ্টও আমাকেই করতে হবে?
লাফিয়ে উঠলেন ইকবাল সাহেব।

– না না না….এই নসিব… দ্রুত… জোবায়দাকে খবর পাঠাও,ইমিডিয়েটলি আসতে বলো এখানে!
সেক্রেটারি কোনোমতে মাথা নেড়েই ছুট দিলো।আসমান দ্রুত মাথা দোলালো,
– উহুম।প্রচুর সময় নষ্ট হবে।আমার সময় নেই।
– কি…কিন্তু…
– আপনি কামরুলকে ফোন দিন। জিজ্ঞেস করুন কোথায় আছে।
– আমি….
সামান্য দৃষ্টিপাতই যথেষ্ট ছিল।দ্রুত পকেট থেকে আইফোনখানা বের করে নাম্বার ডায়াল করলেন মন্ত্রীসাহেব।উপস্থিত অন্যান্যরা তার অবয়বে নিষ্পলক চেয়ে ভাবতে থাকলো একটি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিভাবে কারো গোলাম হতে পারে!কেউ অনুধাবন পর্যন্ত করতে সক্ষম হলোনা যে এই দৃশ্যপটে মনিবের চাইতেও গোলাম অধিক প্রভাবশালী।

অপরদিকে বাইক নিয়ে দপ্তরের বাইরে অপেক্ষারত নিহাদ।চাইলেও আসমান তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি।সব কি ঠিক আছে?বাইরের নিরাপত্তা সদস্যরা তার দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে।এদিকে আবার রোযার উধাও হওয়ার চিন্তা।উফ! হুট করেই মাথায় এলো।রোযার বাড়িতে যাওয়ার সময় একটি গাড়িকে পাশ কাটিয়েছিল সে।ওই তল্লাটে কয়েকবার যাওয়া হয়েছে তার,কে বি গ্রুপের প্রভাব থাকাকালীন রোযার উপর নজরদারি রেখেছে।কিন্তু এমন গাড়ি প্রত্যক্ষ করেনি।মধ্যবিত্ত কিংবা তার থেকে সামান্য উপরের শ্রেণীতে জীবনযাপন করা মানুষগুলো গাড়ি ব্যবহার করবে না স্বাভাবিক। ক্যাবের প্রচলনও কম।তবে কি….?

নিজেকে প্রচণ্ড ব্যর্থ অনুভূত হলো নিহাদের।একটিবার যদি জানালার কাছে ঝুঁকে দেখতো! রাগে দুঃখে বাইকের উপর ঘু*ষি হাকালো।ধাতুতে গ্লাভস থাকা সত্ত্বেও ব্যথা লাগলো,তবুও।কিভাবে পারলো সে এতটা অবহেলা করতে?পদশব্দ শুনে আপন জগত থেকে বেরিয়ে নিহাদ দেখলো দপ্তর থেকে বেরিয়েছে আসমান। হাতে একটি ছোট্ট কাগজের টুকরো।যেটা দ্রুতই প্যান্টের পকেটে চালান করলো। হেঁটে এলো নিজের পোর্শের কাছে।
– কিছু জানতে পেরেছ?

নিহাদের প্রশ্নে একনজর তাকিয়ে আসমান জানালো,
– বুড়িগঙ্গার পরিত্যক্ত ঘাট,ঠিক যেখানে রায়হানকে শে*ষ করেছি!
আর কোনো বাক্য খরচ না করে দ্রুতই গাড়িতে চড়ে বসলো আসমান।নিজের মাথায় হেলমেট চড়ালো নিহাদ।ইঞ্জিনের গর্জন তুললো তার বাইক।তাতে চাপা পড়লো নীরব ঘা*তক পোর্শের হুংকার।
– প্লীজ বেঁচে থেকে ফুলটুশী,আমরা আসছি!
আপনমনে বিড়বিড় করে নিহাদ ছুটলো,অত্যধিক গতিতে।তারপরও আসমানের গাড়িকে টেক্কা দিতে সক্ষম হলোনা।দুর্নিবার বায়ুঝড় তুলে সেটি ছুটে চলেছে নগরের সড়কপথ বেয়ে। ব্যাস্ততম স্থানেও থামবার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে না।একের পর এক ওভারটেক করে যাচ্ছে।বনবন করে ঘুরছে স্টিয়ারিং, ছাপিয়ে যাচ্ছে সকল সীমারেখা। নয়নজুড়ে এক গভীর অভিব্যক্তি,অসামান্য আক্রোশ।সিগন্যাল পর্যন্ত কেটে ছুটে গেলো,ঝিমিয়ে পড়া ট্রাফিক পুলিশ শুধুমাত্র এক ঝলক বিদ্যুৎ দেখতে পেলো যেন,এরপরই শূন্যতা।বায়ুর ঝাপটা মেখে দিয়ে গিয়েছে তার শরীরে।

লঞ্চের ছাদে সম্পূর্ণ র*ক্তা*ক্ত অবস্থায় পড়ে আছে রোযার শরীরখানি। দূর থেকে দেখলে মানুষ হিসাবে গণ্য হবেনা।মাথা,কব্জি,হাতের আঙ্গুল,পায়ের আঙুল, কোনোকিছুই বাদ যায়নি ক্ষ*ত বিক্ষ*ত হওয়া থেকে।খুব ক্ষীণভাবে উঠানামা করে চলেছে তার বুক।এখনো প্রাণ রয়েছে বক্ষপিঞ্জরে বন্দী হয়ে।আরেকটু আ*ঘা*ত, হয়ত তাহলেই নিঃশেষ হবে সবকিছু।তবুও মুখ খোলেনি রো*যা। চ*ড় থাপ্প*ড়ে অধর ফে*টেছে, নির্গত করা সম্ভব হয়নি একটিমাত্র শব্দও।এক রমণী এতটা দৃঢ়চিত্তের অধিকারী হতে পারে তা রোযাকে না দেখলে এর আগে উপলব্ধি করতে সক্ষম হতোনা কামরুল।ঘেমে নেয়ে একাকার হওয়া শরীরের শার্ট খানার বোতাম খুলে তীব্র দৃষ্টিতে রোযার দিকে চেয়ে সে বিড়বিড় করলো,

– খুব কঠিন মন না তোমার?
– ভেঙেছি গড়েছি বহুবার নিজেকে,আর ভাঙার আতঙ্ক হয়না চিত্তে।
অত্যন্ত ক্ষীণ শোনালো কন্ঠস্বরটি।তবুও কামরুলের শরীরে জ্বালা ধরে গেলো যেন।
– মাইয়ামানুষের চিত্ত অবশ্যই নড়ে পাখি…. কখন নড়ে জানো?
বাঁকা হেসে নিজের লোকদের ইশারা করলো কামরুল। ক্ষুধার্ত জ*ন্তুদের মতন তারা ঘিরে ফেললো রোযাকে।আধ জাগরণেও বুঝতে সময় লাগলোনা কি হতে যাচ্ছে।এক টানে তার কামিজের অংশ ছিঁ*ড়ে ফেলা হলো।উন্মুক্ত হয়ে পড়ল উদর।নিঃশ্বাস অবরুদ্ধ করে ফেললো রোযা।

না! কিছুতেই না!ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সে প্রাণ থাকতে হতে দেবেনা!হয়ত আসমান তার পরোয়া করেনা,কিন্তু এই ঘটনার পর সে যেভাবে ভাঙবে, সেই ভাঙন সৃষ্টির অন্তিম দিন পর্যন্ত পূরণ হবেনা!
প্রথমজন ঝুঁকে আসতেই খোদার নাম নিয়ে কোমরে গুঁজে নেয়া টিজারটি তুললো রোযা। ক্ষ*তবিক্ষ*ত আঙুলে তা হলো প্রচণ্ড কষ্টসাধ্য।তবুও।একবার কালেমা পড়ে নিলো নিজের অজান্তেই,অতঃপর অতর্কিতে সেটা চে*পে ধরলো একজনের ঘা*ড়ে।বিদ্যু*তের ঝ*টকায় এক মুহূর্তে কেঁপে কেঁপে মেঝেতে লুটিয়ে গেলো সে।বাকিরা অবাক হয়ে গেলো।সুযোগটি নিলো রোযা।সকল বেদনা উপেক্ষা করে উঠলো,চড়াও হলো দ্বিতীয়জনের উপর।দুই আঙ্গুল একত্রিত করে ঠুস*লো চো*খের ভি*তর! গগনবিদারী আর্তনাদ!লুণ্ঠিত হলো অপরজন মেঝেতে। ছুটতে গিয়েও পায়ের পাতার আ*ঘা*তে হোঁচট খেলো রোযা, বারংবার।তবুও ভ্রুক্ষেপ নেই।তার উদ্দেশ্য লঞ্চের রেলিং।জানে,চাইলেও এই অবস্থায় পলায়ন করতে পারবেনা।একটিমাত্র উপায়….

আ*ত্মাহুতি!
পৌঁছেও গেলো,কিন্তু সম্ভব হলোনা বিসর্জন।দুইজনের বলিষ্ঠ হাত তাকে টেনে হিঁচড়ে আনলো,চেপে ধরলো মেঝেতে।এগিয়ে এলো কামরুল,জোর ঝটকায় লা*থি হাঁ*কালো উদরে।
– পাখি সোনা বইলাও লাভ নাই।একটা বে***!
টিজারটি সহসাই তার মুখ বরাবর ছুড়*লো রোযা।হতচকিত হয়ে গেলো সকলে।সুযোগ বুঝে হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো,কিন্তু যাত্রা থামলো চিমনিতেই।তার মাথা চেপে পুনরায় বারকয়েক ঠো*কা হলো,সমস্ত শক্তি যেন বেরিয়ে গেলো শরীর থেকে। আর সম্ভব নয়।তবুও মানতে নারাজ অন্তর।দুর্বল হাতেই ঠেলতে থাকলো কামরুলকে।দুইজন এগিয়ে এলো, চেপে ধরলো রোযার উভয় বাহু।একজন ঘাড়ে এবং অপরজন পিঠে মুখ বসাতে গেলো।ঠিক তখনি…
থপ!থপ!

মৃদু ধ্বনিও রাত্রির আবহে শোনালো প্রকম্পনের ন্যায়। রোযার উভয় পাশ থেকে লোকগুলো এলিয়ে গেলো ধাতব মেঝেতে।উষ্ণ র*ক্তে পরিপূর্ণ হলো অঙ্গন।ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকালো রোযা,সে তখনও আবদ্ধ কামরুলের হাতে।
নিহাদ।হাতের রিভ*লভার থেকে তার ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে তখনো।টকটকে দৃষ্টিতে চেয়ে আছে,যেন তাণ্ডবলীলা আরম্ভ করবে এক্ষুনি।চেয়ে থাকল রোযা একদৃষ্টে।

ভারী পদক্ষেপের শব্দ শোনা গেলো।ধাতব সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চের ছাদে উঠে আসছে কেউ।রোযা নিহাদের উপর থেকে দৃষ্টি হটিয়ে তাকালো,প্রথমে কিছুই টের পেলোনা।অতঃপর আঁধারের চাদর সরিয়ে সম্মুখে এলো অমানিশা।
উভয়ের দৃষ্টি মিলিত হলো।থমকে পড়লো পাথরমানব, নিজের জায়গায়। রোযার ভগ্নপ্রায় অবয়বে নিগূঢ় দৃষ্টি বোলালো।ওই দৃষ্টির মাঝে এক ঘূর্ণিপাকের উদ্ভব ঘটলো।যে ঘূর্ণির প্রলয়ে অবনমিত হবে ধরিত্রীও।কিন্তু ঘূর্ণিপাক একলা নয়,তার সঙ্গে রয়েছে অনুভূতির জোয়ার।টলটলে সমুদ্রের অশ্রু যেন,একটি মাত্র ফোঁটা ডান নয়ন বেয়ে নেমে গেলো কপোল থেকে মাস্কে।

ডার্কসাইড পর্ব ৩৬

দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা রোযা। শূণ্য অনুভূত হচ্ছে তার।হাঁটু ভেঙে মেঝেতেই বসে পড়লো।বিলীন হলো ওই দৃষ্টির মাঝে।কি আছে ঐ দৃষ্টিজুড়ে?
আফসোস এবং অপরাধবোধ।
তাদের সঙ্গী অশরীরী অধিপতি নরকরাজ।
মুষ্টিবদ্ধ হলো চাঁদের হাত,এতটা জোরের সহিত যে তার আঙুলের ফাঁক গলে টপটপ ধারায় হতে থাকলো রক্তিম প্রবাহ বিসর্জন।

ডার্কসাইড পর্ব ৩৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here