ডার্কসাইড পর্ব ৪০
জাবিন ফোরকান
অভূতপূর্ব স্মরণীয় দিনটির সমাপ্তি ঘটেছে।নগরে নেমেছে রাত্রি।হিমশীতল বায়ু প্রভাব বিস্তার ঘটিয়েছে প্রকৃতিজুড়ে।স্থানে স্থানে কুয়াশার দৌরাত্ম্য। কাচের আবরণে লেপ্টে তা পরিণত হয়ে চলেছে শিশিরফোঁটায়।রাত্রির আঁধার চিরে গগনে উদিত হয়েছে একফালি চাঁদ।ঔজ্জ্বল্য তার চোখ ধাঁধানো।শীতলতার ধোঁয়াশা ভেদ করে ধরিত্রীকে স্নিগ্ধতায় সিক্ত করছে সে আপন জ্যোৎস্নায়।
মেঘতীর।
বিস্তৃত কক্ষটির বিছানায় চুপটি করে বসে আছে রোযা।হৃদস্পন্দন তার হার মানিয়েছে তেজস্বী অশ্বকেও। লাজ খচিত দৃষ্টিতে আনমনে চারিপাশে দৃষ্টিপাত করে চলেছে।এখন পর্যন্ত তার বিশ্বাস হয়ে উঠছেনা সে বিবাহিত!নিজের চাঁদকে আপনরূপে লাভ করেছে।ভাগ্য এতটা সহনশীল কবে থেকে হলো তার প্রতি?পুনরায় রেমান পরিবারের বাসভবনে ঠাঁই হয়েছে তার।তবে এবার কোনোপ্রকার আশ্রিতা হিসাবে নয়,এ তার অধিকার!আজ থেকে এই বাড়িটি তার নিজেরও।ভাবতেই কেমন শিরশিরে তরঙ্গ খেলে গেলো হৃদয়জুড়ে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আশেপাশে তাকালো।এক বনেদী এবং আধুনিক বৈশিষ্টের মিশেল স্থাপত্যজুড়ে।শুভ্রতার ছোঁয়া দেয়ালে দেয়ালে,যার প্রান্তে টেরাকোটা সম্বলিত কারুকার্য খচিত।একদম মাঝখানে বিছানা, পেন্টহাউজের কিছু আসবাব এখানে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে স্থানবদল এবং নতুনত্বের কারণে সবকিছুই প্রথম দেখছে এমন অনুভূত হচ্ছে।চেনার মাঝে শুধু কালো টেডি বিয়ার,যেটি সবথেকে উপরের তাকে অতি যত্নে কৃত্রিম ফুলের আশেপাশে সজ্জিত তা পর্যবেক্ষণ করলো রোযা।কক্ষটির একপাশে বিস্তৃত বারান্দা সংযুক্ত,একটি স্বচ্ছ স্লাইড ডোর দিয়ে পৃথক করা। বারান্দা অত্যন্ত সুন্দর,মেঝেতে বিছানো কার্পেট, যাতে বালিশ কুশনের কমতি নেই।চাইলেই কম্বল নিয়ে রাত কাটানো সম্ভব অনায়াসে।
তবে রোযার মূল আকর্ষণের বিষয়বস্তু বর্তমানে বিছানায় সাজসজ্জা।সম্পূর্ণ কালো চাঁদরের উপর রজনীগন্ধা ছড়িয়ে একটি হৃদয় চিহ্ন আঁকা হয়েছে। বেডসাইড টেবিলে তাজা টিউলিপ ভাসছে।পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও স্থানে স্থানে সুঘ্রাণ সম্বলিত মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত।যার সুবাসে সম্পুর্ণ কক্ষ পরিপূর্ণ।আনমনে ঢোক গিলে তা লক্ষ্য করলো রোযার দৃষ্টি,যেন মাত্রই অনুধাবন করেছে যে আজ তার বাসর রাত!
বিয়ের প্রথম রাত।কতই না স্বপ্ন বোনা থাকে প্রত্যেক রমণীর জীবনে এই বিশেষ রাত্রিকে ঘিরে!কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্য রোযার তেমন কোনো বাসনা নেই।কোনোদিন ভাবার সুযোগ হয়নি।জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করেই অতিবাহিত হয়েছে তার যুগ,যখন কারো অনুভূতিতে জড়ানোর পালা এলো,তখন দোলাচলে দ্বিধাদ্বন্দ্বে চুরমার হলো অন্তর বারংবার।ভয় হতো এই হৃদয়ে, অমানিশাকে ঘিরে স্বপ্ন বোনার ভয়!কল্পনাও করেনি কোনোদিন তার ভাগ্য তাকে এই পর্যায়ে টেনে এনে দাঁড় করাবে,সবটা যেন বাস্তব হয়েও পরাবাস্তব।অপার্থিব হয়েও রূপকথার ন্যায় চমৎকার!
উঠলো রোযা।কক্ষের ডিজিট্যাল ক্লক জানাচ্ছে সময় রাত এগারোটা বেজে বিশ মিনিট।
আনমনে সে হেঁটে গেলো তাকের কাছে,তাকিয়ে রইলো রক্ষিত টেডি বিয়ারটির উদ্দেশ্যে।আসমানের অংশ!কেমন ছিল সে দেখতে?নিশ্চয়ই পিতা মাতার মতোই অভূতপূর্ব?রোযা যদি চায় আসমান কি তাকে দেখতে দেবে?মেঘকে একটিবার অবলোকন করা সম্ভব হবে কি?আপনমনে একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত করলো রোযা।অজান্তেই তার ডান হাতটি ঠেকলো নিজের উদরে, মৃদু হাসি নিয়ে ভাবলো, কোনোদিন কি আসমানকে ছোট্ট একটি আসমান উপহার দেয়ার সৌভাগ্য হবে তার?
খুট করে দরজা খোলার শব্দে ঘুরে তাকালো রোযা।ভেতরে প্রবেশ করতে দেখলো আসমানকে।স্যুট খুলে ফেলেছে, বাহুতে ঝুলছে তা।ইন করা শার্টও বেরিয়ে এসেছে বেল্টের বাইরে।এক হাতে কলার ঢিলে করতে করতে এগিয়েই রোযাকে লক্ষ্য করে থমকে গেলো, স্থবির হয়ে পড়লো সম্পূর্ণ।নিকষ আঁধার দৃষ্টিতে সামান্য বিস্ময় দেখা দিলো,যেন রোযার উপস্থিতির কথা বেমালুম ভুলে বসেছে সে!অনুধাবন করে মৃদু হাসলো রোযা,নিঃশব্দে।তাতে একটি ঢোক গিলে অতি দ্রুত দৃষ্টি হটিয়ে কন্ঠ পরিষ্কার করলো আসমান।
– এহেম…তুম…তুমি এখনো ঘুমাওনি?
– ঘুমাবো?এই রাত ঘুমানোর রাত বুঝি?
মেশিনের মাঝে বিবৃতবোধ লক্ষ্য করে মস্তিষ্কে দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো রোযার।তার কৌতুকে কাজ হলো বৈকি!প্রথমবারের মতন আসমানকে লজ্জাবোধ অনুভব করতে দেখা গেলো যেন।অস্বস্তিতে ভুগছে।ক্রমেই নিজের কলার টানাটানি করে চলেছে।কি যেন ভাবলো কয়েক মুহূর্ত।তারপর অতর্কিতে চাইলো রোযার উদ্দেশ্যে।তাকের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো রোযা হঠাৎ অমানিশার দৃষ্টির পরিবর্তন খেয়াল করে বরফে পরিণত হলো।হাতের স্যুটখানা বিছানায় ফেলে আসমান এগোলো, শার্টের উপরের বোতামজোড়া উন্মুক্ত করলো।তাতে তার শুভ্রতম ত্বকে উদ্ভাসিত তীক্ষ্ম হাড় প্রদর্শিত হলো।দুহাতে কাফ খুলে ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকলো রোযার পানে।অজান্তেই শক্ত একটি ঢোক কন্ঠনালী বেয়ে উদরে নেমে গেলো রোযার।অনুভব করতে পারছে,হৃদস্পন্দন তার বাঁধনহারা হয়েছে।
তার সন্নিকটে পৌঁছে ঝুঁকলো আসমান।কিঞ্চিৎ কম্পিত শরীরে সম্মোহিত চাহুনি রোযার,অমানিশার অবয়ব যেন লুটেছে তার সর্বস্ব।নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রক্রিয়া ক্রমেই অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। আরো একটু ঝুঁকে নিগূঢ় দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালো আসমান,উদ্ভ্রান্ত অস্থির সত্তায় আঙুল বাড়িয়ে তার মাস্কটি টেনে নামিয়ে নিলো রোযা।প্রানভরে অবলোকন করলো চাঁদের কলঙ্ক,অতি আপন তা।ইচ্ছা হলো ছুঁয়ে দেয়।কিন্তু মুহূর্তটি নষ্ট করতে ইচ্ছুক নয় সে।শুভ্রতার মুখাবয়বে বেহায়া দৃষ্টি বুলিয়ে সে থামলো পুষ্ট অধরে।ঢেউ খেলানো পত্রপল্লব যেন, সিক্ত শিশিরের প্রজ্জ্বলন রেখায়।নিশ্চয়ই অধিকার জন্মেছে এর স্বাদ আস্বাদনের।তথাপি নারীসুলভ লাজুকতা ত্যাগ করা সম্ভব হলোনা।অপেক্ষা শুধুমাত্র স্বামীর আগ্রহের। অধৈর্য্য দমিত হলো শাড়ীর আঁচলে জোরালোভাবে আঙুল চেপে।
– ক্যান আই….
আসমানের মৃদু আর্দ্র কন্ঠস্বর হৃদয়ে মোহ জাগ্রত করলো। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বুজে এলো নয়ন।এক মুহুর্ত ওষ্ঠে ওষ্ঠ চেপে তা উন্মুক্ত করল রোযা,কিঞ্চিৎ ফাঁক হলো হৃদয়রাজের আমন্ত্রণে।প্রতিটি রোমকূপজুড়ে যেন সুখের প্রস্রবণ ঘটে চলেছে।এক মহা অগ্নুৎপাতের প্রস্তুতি অনুভূতিদের।আসমানের ত্বকের উষ্মতার ছোঁয়া লাগলো কপোলে,এরপরই মৃদু একটি ঘড়ঘড় শব্দ।ঝট করে দৃষ্টি মেলে রোযা লক্ষ্য করলো তার বাম পাশের টেবিলের ড্রয়ারটি খুলেছে আসমান,সেখান থেকে একটি ছোট বইয়ের মতন দেখতে জিনিস বের করে এক লহমায় নিজের উষ্ণতা কেড়ে সরে দাঁড়ালো। দৃষ্টিজুড়ে তার কৌতূহল,ওই পুষ্ট অধরে সামান্য তীর্যক কৌতুকরেখা।
– এভাবে পাখির চঞ্চুর মতন ঠোঁট উঁচু করে রেখেছ কেনো?
মুহুর্তের উত্তেজনায় কখন যে রমণী অধর প্রস্তুত করেছে চুম্বনের উদ্দেশ্যে, খেয়ালই হয়নি!টকটকে রক্তিম লালিমা ছেয়ে গেলো রোযার সম্পূর্ণ মুখে, ঠোঁটের উপর হাত চেপে প্রসারিত দৃষ্টিতে দেখলো আসমানকে।মনে হলো যেন আপনমনে মিটিমিটি হাসছে অমানিশা!
অনুভূতি গুঁড়িয়ে পারদর্শী আসমান ফিরে এসেছে নিজের সহজাত বৈশিষ্ট্যে। আরো একবার ঘটিয়েছে অচিন্তনীয় বিষয়বস্তু।শুধুমাত্র রোযা একাই তাহলে কামনা করছিল!ক্রোধ এবং লজ্জার মিশ্রিত অনুভূতি অনুভব করে রোযা এক ধাক্কায় আসমানকে সরালো সামনে থেকে,
– ইডিয়ট!
– হাহা…তুমি কি আকাশকুসুম কল্পনা করছিলে রোযা?
– ঘোড়ার আন্ডা!
গজগজ করতে করতে পরিধানের শাড়ীতে ঝংকার তুলে রোযা বিছানার কাছে এলো,আসমানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে উল্টো দাঁড়ালো।রিরি করে কাপছে তার শরীর।এই ছেলে তার সকল আশায় নর্দমার পানি ফেলে দিলো!সেই বা এত বোকা হলো কিভাবে?কপাল চাপড়ালো নিজের,এই মেশিনের ফাঁদে কিছুতেই পড়া যাবেনা।একদম চালু মাল এই পাবলিক!
ক্রোধ দর্শন করাতেই যেন একে একে নিজের অলংকার খুলে সশব্দে বেডসাইড টেবিলে রাখতে লাগলো রোযা।ধারেকাছে থাকা মোমবাতিগুলোও তার ফুয়ে নিভতে বাধ্য হলো।চেয়ে চেয়ে দেখলো আসমান।সদ্য হাতে তুলে নেয়া চেকবইটি টেবিলের উপর রেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।কি যেন ভাবলো মুহূর্ত কয়েক।অতঃপর নিজেকে প্রস্তুত করে ঘুরলো উল্টো।ধীরে ধীরে হেঁটে উপস্থিত হলো স্ত্রীর নিকট।নিজের চোলির পিন খুলতে ব্যস্ত রোযা তার উপস্থিতি অনুভব করলেও ফিরে তাকালো না।দেয়ালে সংযুক্ত আয়নাশৈলীর মাঝে আপন প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করতে করতে কাজ সারছে সে।
– গুড নাইট বলার প্রয়োজন নেই।তুমি ঘুমাতে পারো, আর হ্যাঁ,চিন্তা নেই।আমি সোফায় ঘুমাবো!
নববধূর অভিমান ঝরে পড়লো প্রত্যেকটি বাক্যে।তাতে মুষ্টিবদ্ধ হলো আসমানের দুহাত।ভুল করে ফেলেছে সে। দাঁতে অধর কামড়ে ধরে কয়েক সেকেন্ড চিন্তায় ক্ষেপণের পর অবশেষে দূরত্ব মেটালো।রোযার পিছনে দাঁড়িয়ে তার অবয়বে স্পর্শ করলো আপন বলিষ্ঠ শরীর। নেকলেসে হাত দেয়া রোযা স্থবির হলো, প্রতিচ্ছবিতে আসমানের মাঝে ভিন্ন এক গভীরতর আস্ফালন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।তার নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে অমানিশার ডান হাতটি উঠে এলো রোযার গ্রীবায়, লম্বাটে আঙুলে পেঁচিয়ে ধরলো নেকলসের অংশ।একটিমাত্র টান,কিঞ্চিৎ হিসিয়ে উঠল রোযা। নেকলেসটির বেপরোয়া পতন ঘটলো মেঝেতে।
– আস….মান…
উচ্চারণে শিরশির করে উঠলো সর্বাঙ্গ।অনুভূতির শীতলতা বইলো শিরা উপশিরাজুড়ে।আসমানের আঙুলগুলো পেঁচিয়ে গেলো রোযার গ্রীবায়, আলতোভাবে বুলিয়ে চলেছে আঁকিবুঁকি।শুধুমাত্র স্পর্শও যে এতটা গভীরতা ধারণ করতে সক্ষম তা অনুধাবন সম্ভব হয়নি রোযার পক্ষে। আনমনে বুজে এলো দৃষ্টি, কুঁচকে এলো ভ্রু,অনুভবে মনোযোগী সমস্ত অস্তিত্ব।নিজের মাঝে আসমান যেন মিশিয়ে ফেলল তাকে।গলাধঃকরণ ঘটালো সম্পূর্ণ। কোমরজুড়ে শক্তিশালী হাতের উপস্থিতি,অপরদিকে গ্রীবার অংশজুড়ে নিগূঢ় স্পর্শ।রোযার সর্বাঙ্গ থেকে থেকে কাপতে লাগলো অজানা সন্নিকটতার আশংকায়।আসমানের শীতল আঙুল উঠলো তার চিবুকে, অতঃপর নমিত হলো,কানের লতি ছুঁয়ে নেমে এলো কাঁধে। শাড়ির আঁচলের অন্তরালে প্রবেশ করলো ইঞ্চিকয়েক,ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দৃষ্টি মেললো রোযা।
আসমান নিজের আপন দুনিয়ায়ই রয়েছে। প্রতিচ্ছবিতে তার দৃষ্টিজুড়ে ঠিক মোহ নেই,বরং যান্ত্রিকতা! ঘন ভ্রুজোড়া কেন্দ্রীভূত হয়েছে মনোযোগে, যেন স্নেহের ছোঁয়া নয়,বরং পরীক্ষার অংক কষছে হিসাব করে।সকল অনুভূতি যেন বিদায় নিলো রোযার।বাস্তবতার চাঁদর আচ্ছাদিত করলো অন্তর। নিয়ন্ত্রণহারা আসমানের হাত তার কোমরের আচ্ছাদন সরিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে চাইলো ত্বক ছুঁয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে।অভাবনীয় কম্পন রোযার দৃষ্টি এড়ালোনা।স্থির কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
– আসমান?
কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।একই যান্ত্রিকতায় লিপ্ত মেশিন।যেন ব্যাটারি ভরে চালু করে দেয়া হয়েছে।জ্বালানি নিঃশেষ না হওয়া অবধি নিজের কর্মসাধন করে যাবে সে।এবার দৃঢ়তা আনলো কন্ঠে রোযা।
– চাঁদ?থামো।প্রয়োজন নেই।
অতর্কিতে থমকালো আসমান, আয়নাশৈলীতে চাইলো।ভারী নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে উঠানামা করছে বক্ষ, হাঁপাচ্ছে বিনা কারণেই,দৃষ্টি সম্পূর্ণ উদ্ভ্রান্ত।জ্বলজ্বল করে উঠলো কৃষ্ণগহ্বর,অব্যক্ত অনুভূতিতে।তারপরই মুখ গুজলো রোযার কাঁধে।উভয় বাহু জড়িয়ে গেলো তার অঙ্গে,আবেগীয় আলিঙ্গনে।সামান্য সিক্ততা অনুভূত হলো রোযার আপন কাঁধে,এরপরই অনুশোচনা ভেসে এলো,
– সরি!
বিস্তৃত অধরে হাত বাড়িয়ে আসমানের গাল ছুঁয়ে দিলো রোযা, চুলে এলোমেলো স্নেহ বুলিয়ে মৃদু কন্ঠে জানালো,
– ইটস ওকে। ইটস টোটালি ফাইন।
আসমানকে ধাতস্থ হতে সময় দিলো রোযা।তারপর আলিঙ্গন ভেঙে তাকে ধীরে ধীরে বিছানায় বসালো।মাথা নত করে রইলো অমানিশা,সামনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মুখ তুলে তাকালো।
– চাঁদ।সব ঠিক আছে।আমি ঠিক আছি।কোনো সমস্যা নেই।কষ্ট পেওনা প্লীজ।
অত্যন্ত আদুরে শোনালো রোযার কন্ঠস্বর।দুহাতে আসমানের মুখ স্পর্শ করে নিজের দিকে ঘোরালো, দৃষ্টি মেলালো আঁধারমেলায়।
– আমি দুঃখিত।তোমাকে সুখ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়।খুবই নিষ্ঠুর আমি,অনুভূতির উদগীরণ বড়ই অসাধ্য।
মৃদু হাসি ধরে রেখে শুনে গেলো রোযা।তারপর মাথা নাড়লো,
– একদমই নয় আসমান,একদমই নয়।আমি বুঝতে পারছি,তোমার অন্তরে এখনো ভয় রয়ে গিয়েছে।নতুনকে গ্রহণে সময় লাগবে বৈকি।আমি একটুও অভিমান করিনি বিশ্বাস করো।
তবুও বিষাদে পূর্ণ আসমানের চিত্ত। রোযা আরেকটু এগোলো।কপালে কপাল স্পর্শ করে জানালো,
– সময় নাও প্রিয়।আমি অপেক্ষা করবো।তোমাকে সম্পূর্ণভাবে আপন করে পাবার অপেক্ষা যদি সারাজীবনেও না মেটে তবুও খেদ নেই,আমি জানি তুমি আমার পাশে আছো।তোমার উপস্থিতি,তোমার আলিঙ্গন,তোমার কন্ঠস্বর,তোমার চাহুনি যথেষ্ট।
– দুঃখিত….
– উহুম।দুঃখিত হয়োনা।নিজেকে সময় দাও।তোমার হৃদয় যা চাইবে তাই করো।আমি তো আছিই তোমার সঙ্গে,থাকবো,কখনো ছেড়ে যাবো না কথা দিচ্ছি।
– চিত্রলেখার কথা ভীষণ মনে পড়ছে।মনে হচ্ছে যেন আমি বিশ্বাসঘাতকতা….
– হুশ!
আসমানের অধরে তর্জনী চাপলো রোযা।নির্বাক দৃষ্টিতে আপন উৎসাহ মিশিয়ে বললো,
– তুমি বিশ্বাসঘাতক নও।তোমার প্রেম অমর।তাইতো তোমার এমন সুতীব্র অনুশোচনার অনুভূতি।
চেয়ে থাকল আসমান,একদৃষ্টে।রোযা তার কাঁধে হাত ছুঁয়ে কোমল হাসিতে উচ্চারণ করলো,
– জোরপূর্বক মিলন চাইনা চাঁদ।না নিজের প্রতি,না তোমার প্রতি।ভাগ্য যখন একসূত্রে আমাদের গেঁথেছেই, তখন অনুভূতিও জন্ম নেবে, আপন মহিমায়।শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা তাইতো? ধৈর্য্যধারণ করেছি সারাটা জীবন,আরেকটু করতে ক্ষতি কি? একটুখানি হাসো,তোমাকে হতাশ দেখতে ভালো লাগেনা।
অবশেষে দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে সামান্য হাসি ফোটালো আসমান।
– এইতো!
– ধন্যবাদ।
– হাহা….এবার বলো তো।তুমি ওই ড্রয়ার থেকে কি বের করছিলে?
প্রসঙ্গ পাল্টাতে আগ্রহী রোযা।আসমানকে অবসাদগ্রস্ত দেখতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা হচ্ছেনা।মাথা হেলিয়ে টেবিলের দিকে চেয়ে আসমান জানালো,
– চেকবই,নিয়ে আসো।
রোযা বাধ্য হয়ে উঠল,চেকবই এবং তার সাথে থাকা কলমটি নিয়ে এসে আসমানের হাতে দিলো।কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– এটা দিয়ে কি হবে?
– তোমার দেনমোহরের টাকা।
চেকবইয়ের পাতায় কলম ছুঁইয়ে বিড়বিড় করলো আসমান।রোযা ভ্রু তুলে সন্দিহান প্রশ্ন ছুড়লো,
– এত দ্রুত পর করে দিতে চাও?
– দেনমোহরের সঙ্গে পর করে দেয়ার কি সম্পর্ক?আমি যতদূর জানি স্ত্রীর কাছে তা অতি সত্তর পরিশোধ করে দেয়াই উত্তম।
– এত জানলে কবে থেকে?
আসমান রোযার দিকে ফিরলো।
– দেনমোহর একজন স্ত্রীর অধিকার রোযা।
তবুও কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়ে তাকিয়ে থাকল নববধূ।আসমান ডান হাতে তার চিবুক স্পর্শ করে নমনীয় কন্ঠে প্রকাশ করলো,
– আমি চাই তুমি স্বাধীন থাকো।ছোট বড় কারণে যেন সবসময় আমার কাছে ছুটে আসতে না হয়।তোমার ইচ্ছা হয়েছে এটা করবে,করে ফেলো।ইচ্ছা হয়েছে সেটা কিনবে, কিনে ফেলো।আপন স্বপ্ন পূরণ করার সম্পূর্ণ অধিকার তোমার রয়েছে,তার জন্য কারো মুখাপেক্ষী হওয়ার দরকার নেই,আমারও নয়!
আসমানের বক্তব্যে যেন সম্মোহিত হয়ে পড়ল রোযা।এই বান্দা এভাবে ভেবেছে সে কল্পনা করেনি।সত্যিকার অর্থে বিয়ের পর তার চাকরি করা সম্ভব নয়,ক্যাফে লো ফাইয়ের দায়িত্ব ছাড়তে হবে,টিউশনি অসম্ভব।ফাউন্টেন পেন অবশ্য চালিয়ে যাওয়া যাবে।কিন্তু তাতে কতটুকুই বা প্রয়োজন মিটবে?বিয়ে উপলক্ষ্যে সকল জমা খরচ হয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারটা এখনো বাকি।রোযার যে বৈশিষ্ট্য তাতে কখনোই মুখ ফুটে কারো কাছে চাইতে পারবেনা।বিষয়টা কি আসমান আগেই ধারণা করেছে?উপলব্ধি হতেই আবেগ পরিপূর্ণ হলো অস্তিত্বে।
– বিশ লাখ দিচ্ছি,চেক টা রেখে দিও।বাকিটা যখন প্রয়োজন মনে করবে চাইবে।
চেকে সাইন সম্পন্ন করে সেটা রোযার দিকে এগিয়ে দিলো আসমান,গ্রহণ করে হাসলো রমণী।
– থ্যাংক ইউ!আজ থেকে তুমি আমার প্রদীপের জ্বীন।
– তুমি কি তবে আলাদিন?
– যদি চাও তবে হতে পারি তোমার জেসমিন।
হাসলো আসমান,মৃদু কলরল তুলে।পংক্তি পংক্তি খেলাটা দারুন লেগেছে তার।রোযা বিছানা ছেড়ে উঠলো।চেকটি সযত্নে ড্রয়ারে নিজের হ্যান্ডব্যাগে রেখে ফিরে এলো।খোলা চুলে খোঁপা তুলে বললো,
– তুমি তাহলে এখন বিশ্রাম নাও। আমি বিছানা গুছিয়ে দিচ্ছি।
সত্যি সত্যি ফুল সরানোর কাজে লেগে পড়লো রোযা।একপ্রান্তে বসে হাহাকার অনুভব করলো আসমান তা পর্যবেক্ষণ করে। অতি বিশেষ এই রাত্রির তবে এমন সমাপ্তি ঘটবে?কোনো আরম্বড়তা নেই।নেই কোনোপ্রকার সুখস্মৃতি স্মরণে রাখার মতন।ব্যাপারটা কি উচিৎ হলো?নিজেকে বড্ড শূণ্য অনুভূত হচ্ছে তার।আপন অস্তিত্বকে ভৎসর্ণা করবার ইচ্ছা জাগছে।
– আসমান?
হঠাৎ ডাকে ঘুরে তাকিয়ে আসমান খেয়াল করলো তাকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে রোযা।একটি হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে একপাশে স্ট্যান্ডে ঠেকানো কালো বর্ণের গিটারটিকের।মুগ্ধতা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সে।
– তুমি গান গাইতে পারো?
– সামান্য।
– আমাকে একটা গান শোনাবে?
নিস্তব্ধতা।অতঃপর ধ্বনিত হলো,
– চিত্র ছাড়া কাউকে কোনোদিন শোনাইনি।ভালো লাগেনা।
– ওহ আচ্ছা।
কন্ঠে স্পষ্টত মিশ্রিত বিষাদটুকু আসমান উপলব্ধি করতে বেগ পেলোনা। রোযা তাকে জোর করলোনা কোনোপ্রকার।বিছানার কাছে ফিরে এলো।একপাশে বসলো।দীর্ঘ এক মুহুর্ত নৈঃশব্দ্য।তারপর অতর্কিতে উঠলো আসমান। গিটারখানা বাগরে ফিরে এলো বিছানায়।বিস্মিত হয়ে থাকা রোযার উদ্দেশ্যে এক নজর চেয়ে টিউনিংয়ে মনোযোগ দিলো।
– অনেকদিন গাইনি। মন্দ হলে আমার দোষ নেই।
চেয়ে রইলো রোযা,বিনা কারণেই তার আঁখি ছলছলে হলো। অধরে প্রস্ফুটিত হলো মনকাড়া এক হাসির পুষ্পধারা।বিছানায় উঠে বসে আসমানের মুখোমুখি হলো।অত্যন্ত আগ্রহ এবং অনুভূতিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো হৃদয়েশ্বরকে। আঙুলগুলো তার বয়ে চলেছে গিটারের ফ্রেডবোর্ডে,মুহূর্তেই সম্পূর্ণ গুমোট কক্ষ ভাসিয়ে তুললো সুরের মূর্ছনা।শীতল এক বায়ুর ঝাপটা খেলে গেলো অভ্যন্তরের সম্পূর্ণ বিষাদ মুছে।তার সঙ্গে ওই শ্রুতিমধুর কন্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হলো আপন আলোড়নে,
~সেদিন ভোরে
বুকের গভীরে শুনেছি জমে থাকা নীল বেদনারা ডাকে
এই শহরে
ইটের পাহাড়ে ছিল না কেউ যে দেওয়ার প্রেরণা
যন্ত্রে বাঁধা মন ছিল ক্লান্ত অসহায়
অর্থে কেনা সুখ ম্রিয়মাণ দুঃখের ছায়ায়~
হারিয়েছে রোযা অমানিশার তরে।তার মুগ্ধ দৃষ্টিতে মিলেছে আসমানের দৃষ্টি,না বলা সকল কথারা যেন তার কণ্ঠের সুর হয়ে ঝরে পড়ছে রোযার হৃদগহীনে।
~আজকে শুনি আনন্দধ্বনি
পৃথিবী ভরেছে সুখে বেঁচে থাকার মায়ায়
শূণ্য আশার জীবন্ত ভাষায়
অদূরে দেখেছি প্রাণের মোহনা~
বিলীন হলো দুটি অস্তিত্ব একে অপরের মাঝে।নিগূঢ় কণ্ঠের জাদুতে,অনুভূতির মিশ্রণে হারালো তারা একে অপরকে।পরোয়া করলোনা রাত্রির,পরোয়া করলোনা নৈঃশব্দ্যর।গুনগুনিয়ে নিজেও কন্ঠ মেলালো রোযা, আসমানের অধর বিস্তৃত হলো তাতে,নিকটে সরে ঝুঁকে সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে চললো,
~আর নয় সময় উদ্দেশ্যহীন মিছিলে
তুমি সেই পূর্ণতা আমার অনুভবে
আর নয় আঁধার, তুমি স্বপ্নে ডেকে নিলে
ভরে মন অন্তহীন রঙিন এক উৎসবে~
একটা সময় ম্রিয়মাণ হয়ে এলো সুর,তবুও থমকালোনা গুঞ্জণ।গুনগুন কন্ঠে সঙ্গীতের আবহ ধরে রেখে আসমান প্যান্টের পকেটে হাত ভরলো,ছোট্ট একটি মখমলি বাক্স বের করে রোযার হাতটি টেনে নিলো।বাকরুদ্ধ হয়ে প্রসারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রোযা।তার বাম হাতের মধ্যমায় সযত্নে একটি আংটি পরিয়ে দিলো আসমান,যেন তাদের পবিত্র বন্ধনের সাক্ষী। অশ্রুজল ঠেকানো কষ্টসাধ্য হলো দীপ্তির,নিজ অধরে তুলে ধরে আলতোভাবে ছোঁয়ালো অমানিশা,
– পূর্ণতা…..
– আনন্দ…..
ডার্কসাইড পর্ব ৩৯
তিরতির করে কাপলো রোযা,অনুভূতির গাঢ়ত্তে।তার মুখ স্পর্শ করে নিকটে টানলো আসমান,ললাটে স্পর্শ করলো আপন অধর।দীর্ঘ মুহূর্তজুড়ে ঘটলো সকল অব্যক্ত অনুভূতিমালার বিনিময়।অতঃপর এক অমোঘ আলিঙ্গন,বিছানায় লুটায়িত হলো উভয় অস্তিত্ব।আসমানের প্রশস্ত ভরসার বক্ষে আশ্রয় নিলো রোযা।বারান্দা থেকে বয়ে আসা ঝিরঝিরে হিমশীতল বায়ুতে যত কম্পিত হলো,তত শক্তভাবে একে অপরকে নিজেদের মাঝে জড়িয়ে ধরলো।আর কোনো শব্দ উচ্চারণের প্রয়োজন নেই অনুভবের প্রকাশে।
এই রাত্রি ব্যর্থ নয় বরং পরিপূর্ণ,এক রূপকথার চাইতেও চমৎকার এই রাত্রির মায়াজাল,যা রচনা করেছে এক নব্য সূচনার……..
