শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫৩+৫৪

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫৩+৫৪
Nabila Ishq

অরু এসছে গুণে-গুণে তিন মিনিট পর। দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। হাতে শরবতের গ্লাস। তন্ময় তখনো ল্যাপটপ স্ক্রিনেতেই নজর রেখে। মাথা তুলে তাকায় না। তবে অনুভব করতে পারছে, না চেয়েও। অরু তার চেয়ারটির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সজোরে শরবতের গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখেছে। এতে শরবতের জল উপচে বেরোয় ছিটেফোঁটা হয়ে। তন্ময় এবারে চোখ উঠিয়ে চায়। ভ্রু তুলতেই অরু গমগমে গলায় শুধায়,

‘আপনি কী চোখ গরম করে চাইছেন?’
তন্ময় সাবলীল ভাবেই বলে, ‘তোর কি তাই মনে হচ্ছে?’
অরু জবাব দেয় না। শুধু থমথমে মুখে চেয়ে রয়। তার নয়নযুগল চিৎকার করে জানান দিচ্ছে তারা অভিমানে জর্জরিত। দুটো কারণে তার অভিমান জমেছে। প্রথমত তাকে না বলেই, না জানিয়েই –চলে গিয়েছিল। আর দ্বিতীয়ত তখন তাকে নিয়ে ওভাবে রঙ্গতামাশা করেছে। তন্ময় প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তখনো চেয়ে জবাবের আশায়। জবাব না দিয়ে অরু আশ্চর্যজনক এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। চট করে তন্ময়ের কোলে বসে পড়ে। দিন-দুপুরে এহেন কাণ্ডে শুধু হতবাক নয় – তন্ময় কিংকর্তব্যবিমূঢ়! অরুর হাত দুটো আমোদে তার গলা জড়িয়ে ধরেছে। রিনরিনে মিনমিনে মেয়েলি কণ্ঠজুড়ে অভিমান,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আমাকে সকালে ডাকেননি কেন?’
তন্ময় দরজার দিক তাকায়। দরজাটা পরিপূর্ণ ভাবে খোলা। এই দিন-দুপুর বেলাতে যেকেউ যখনতখন চলে আসবে। এসে তাদের এই অবস্থায় দেখে ফেললে এক বিশ্রী পরিস্থিতি দাঁড়াবে। তা কী আর বুঝবে এই অবুঝ মেয়ে? কাণ্ডজ্ঞানহীন অপদার্থ একটা। সে ত্বরিত স্বরে তাড়া দেবার ভঙ্গিতে বলে,
‘ওঠ আগে। ওখানে বোস। তারপর বলছি।’

অরু যেন শোনেও শোনেনি। তার লাজুক মুখাবয়ব জুড়ে সরলতা। যেন এই দুনিয়ার কিচ্ছুটি সে বোঝে না; শোনে না। তন্ময় পূর্বেই আন্দাজ করে নিয়েছিল –তার গতকালকের আগবাড়ানোর পরিণাম কী হবে, মাশুল কী দাঁড়াবে! তারপরও স্বেচ্ছায় এই মসিবত সে বড়ো আমোদেই কাঁধে এনেছে। অবশ্য মসিবত হলেও উপভোগ তো করছে! তন্ময় ঢোক গিলে অবলীলায়। মুখে এক বললেও তার পুরুষালি বেহায়াপনায় সুউচ্চ হাত দুটো ইতোমধ্যে অরুর পাতলা কোমর খানা জড়িয়ে নিয়েছে। মুখে সে পুনরায় বলে অসহায় গলায়,

‘কেউ চলে আসবে।’
অরু আজ বড়ো নির্ভীক। সে আরেকটু নিবিড়ভাবে বসে। দৃঢ় হাতে জড়িয়ে ধরে। তন্ময়ের চোয়াল শক্ত হয়। চোখদুটো অশান্ত ভঙ্গিতে সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়। অরুর প্রাণোচ্ছল কণ্ঠে গদগদ ভাব,
‘দীপ্ত বাবার সঙ্গে বেরিয়েছে। শাবিহা আপু অয়ন ভাইয়ার সাথে প্রেম করছে। রুবি আপু বাগানে। বড়ো মা, চাচি– মা সব্বাই রান্নাঘরে। দুপুরের আয়োজন করছে। বড়ো চাচ্চু গাড়ি পরিষ্কার করাচ্ছে দারোয়ান চাচাকে দিয়ে। আপাতত কেউই আসবে না।’

তন্ময়ের গলাটা শুঁকিয়ে চৌচির। মরুভূমির মতন খাঁখাঁ করছে। অনুভূতির জোয়ারে ভেতরটা আন্দোলন করছে। ধকধক করে চলেছে। ইচ্ছে তো করছে অরুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গভীর চুম্বনে লিপ্ত হতে। তবে সব ইচ্ছেদের কী পূর্ণতা দিতে হয়? বাড়িতে আজ সবাই উপস্থিত। কেউ দেখে ফেললে বড্ড লজ্জাজনক ব্যাপারস্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। অরু এযাত্রায় মুখ বাড়িয়ে চুমু বসাল তন্ময়ের চাপদাড়ির ওপর। তন্ময় চোখ বন্ধ করে ফেলে। সে কেন পারছে না অরুকে জোরপূর্বক সরাতে? কেন ওর বাচ্চামিতে আস্কারা দিয়ে চলেছে? ‘ওয়েক আপ, তন্ময়! ইট’স ডেঞ্জারাস।’ নিজেকে নিজে সাবধান করেও লাভের লাভ কিছু হলো না। তার কণ্ঠে মিনতির আভাস,

‘নিচে যা। আমি আসছি।’
অরু এযাত্রাতেও নিরুত্তর তার মিনতির নিকট। সে উল্টো নিজের মতন বলে ওঠে,
‘আজকের ওয়েদার অধিদপ্তর কি জানাচ্ছে জানেন?’
তন্ময় নিরুপায়, ‘কী?’
‘আজ প্রেমের বৃষ্টি হবে। বিকেল বেলায়।’
অরু ঠিক কীসের বরশী ফেলছে তন্ময় বুঝে ওঠেনি। অবুঝ জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে শুধায়,
‘প্রেমের বৃষ্টি?’
‘হুঁ। যেই বৃষ্টিতে আপনি আমায় ঘুরতে নিয়ে যাবেন, ওটাই প্রেমের বৃষ্টি।’
তন্ময় ওর লজিক শুনে আশ্চর্য না হয়ে পারে না। পৃথিবীর সব অদ্ভুত যুক্তি ওর কাছে থাকে। সে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে ভ্রু তুলে,

‘কখন বলেছি ঘুরতে নেব? আমার তো মনে পড়ছে না।’
অরুকে বেশ নিরীহ দেখাল, ‘আপনি তো জানেন আমি বৃষ্টি কত্ত ভালোবাসি। তাই না?’
‘হুঁ।’
‘আজ ঘুরতে নিয়ে যাবেন না?’
তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিরক্তির হাবভাবের ভঙ্গিমা ধরে ওকে আগাগোড়া দেখল। চোখ রাঙানো ছুঁতোতে বলল,
‘নেব। ওঠ।’
অরু উঠল না। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে রেখেছে। যেন এখনো কিছু বলার আছে। তন্ময় নিবিড়ভাবে ওই গোলাপি ওষ্ঠদ্বয় দেখে আওড়াল,
‘কী বলবি?’

অরুকে ভীষণ লজ্জিত দেখাল। পাপড়িযুগল সমানে পলক ফেলছে। ঠোঁট দুটো নিষ্ঠুরভাবে দাঁতে পিষছে। সময় নিয়ে নিচুস্বরে ফিসফিসানির সুরে কোনোরকমে বলে,
‘আ– আমরা কবে থেকে একসাথে থাকব?’
তন্ময়ের কান দুটো ঝাঁঝাঁ করে উঠল। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ইলেক্ট্রিক শক লাগল যেন। দৃষ্টি প্রখর হলো। গেল, গেল— গেল। তার দেহে থাকা বিন্দুমাত্র হতভাগা ধৈর্য উবে গেল। মুহূর্তেই অরুর কোমরে থাকা তার দুটো হাত দৃঢ়তর হলো। খামচে ধরল সেথায়। চোখের পলকে মুখ বাড়িয়ে অরুর ওষ্ঠদ্বয়ে শক্তপোক্ত কামড় বসাল। দাঁতে দাঁত পিষে শাসানো গলায় বলে উঠল,

‘এক্ষণ তুই এখান থেকে রফাদফা না হলে– তোর কপালে দুঃখ আছে।’
অরু আতঙ্কে দু’হাতে মুখ চেপে ধরেছে। নয়নযুগল ততক্ষণাৎ আর্দ্র হয়ে এসেছে ব্যথায়। ভীত সে তক্ষুনি লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তন্ময়কে দ্রুত গতিতে উঠতে দেখেই এক দৌড় লাগাল। এক দৌড়ে বেরিয়ে গেছে রুম থেকে। তন্ময় উপলব্ধি করল তার শরীর গরম। মনে হচ্ছে, আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। দাউদাউ করে জ্বলছে। সে জানালা বন্ধ করে দিলো। বারান্দার দরজা লাগাল। মূল দরজা লাগিয়ে এসি ছাড়ল। কী সাংঘাতিক পেকেছে এই মেয়ে! তন্ময়কে দমবন্ধ করে না মে রে শান্ত হবে না। ওকে শায়েস্তা না করলেই না!
সেলফোনটা বাজছে। তন্ময় এগিয়ে হাতে নিতেই দেখে, রিয়ানের কল। রিসিভ করে কানে ধরতেই– রিয়ান বড়ো চমৎকৃত গলায় ডেকে ওঠে,

‘দোস্ত!’
ফোনটা তক্ষুনি কানের কাছ থেকে ছিটকে সরিয়ে আনে তন্ময়। রাগ সংবরণ করে গম্ভীর গলায় শুধায়,
‘কী?’
রিয়ান ওপাশে চিৎকার করে বলে, ‘মামা তো সেই ক্ষ্যাপা! কথাবার্তা আগামু নাকি কাটমু?’
মাহিনের কণ্ঠ ভেসে এলো তখনই, ‘কেটে দে। ওর বউয়ের রাগ আমাগো ওপর ঝেড়ে দেবে।’
কলটা ঝটপট কেটে গেল। তন্ময় ছুঁড়ে মারল ফোনটা বিছানায়। সব ফাজিল তার গলায় ঝুলেছে। টি-শার্ট খুলতে খুলতে সে ওয়াশরুমের দিক হাঁটা ধরল। তার এখন গোসল নেয়াই উত্তম। মাথা ঠাণ্ডা হওয়া প্রয়োজন।

ঘরের ভেতর অরু মাস্ক পরে ঘুরছে। এই নিয়ে বাড়ির সকলের অভিযোগ। অভিযোগটি তন্ময়ের ঘরেতেও চলে এসেছে। এনেছে দীপ্ত। সে বিচিত্র ভঙ্গিতেই নাকমুখ কুঁচকে বলে,
‘ভাইয়া, দেখেছ অরুপির কাণ্ড? সে বাসায় মাস্ক পরে ঘুরছে। হাও ফানি!’

দীপ্তর কাছে যা মজার লাগছে; তা তন্ময়ের কাছে মোটেও লাগছে না। এই মেয়ে তার মানইজ্জত ধুলোয় মিশিয়েই ছাড়বে। কেন মাস্ক পরে ঘুরতে হবে? ঘন্টাখানেক ঘরে থাক। ফোলা ভাবটা নাহয় খানিক কমে যেতো। অবশ্য তন্ময়েরও দোষ। কী দরকার ছিলো কামড় দেবার? সে অশান্ত ভাবে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পেছনে দীপ্তও ছোটোছোটো পায়তাকে অনুসরণ করছে। সিঁড়িপথ ধরতেই দেখল অরুর পেছনে রুবি দৌড়াচ্ছে। মাস্ক খুলবে বলে। তন্ময়ের হার্ট ব্লক খায়। সে উচ্চকণ্ঠে ধমকাবে, পূর্বেই যা ঘটার ঘটে গেছে। রুবি মাস্ক খুলে অরুর মুখ নিবিড়ভাবে দেখছে। লিভিংরুমে তখন স্বয়ং তার পিতা শাহ্জাহান মোস্তফা বসে। বড়ো বিনয়ী, উৎসুক এবং চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করছে,

‘কী হয়েছে, মামণি? কোনো সমস্যা?’
তন্ময়ের ইচ্ছে করছে উদাস গলায় বলতে,
‘তোমার মামণিকে আমি শাহ্জাহান তন্ময় কামড়ে দিয়েছি। এখন আমার কী করবে করো!’

খাবার টেবিলে সবাই বসে। খাওয়াদাওয়ার পর্বটি বেশ আনন্দের সহিত চলছে বলে মনে হচ্ছে। দেয়াল ঘড়িতে তখনো দুটো বাজতে বারো মিনিট। বজ্রপাতের ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টি হবে শীঘ্রই।
খাওয়াদাওয়ার ফাঁকফোকরে মিটিমিটি হাসছে শাবিহা, রুবি– আকাশ। ওদের এহেন রঙ্গতামাশার সম্মুখে অরু লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখলেও; তন্ময় বড়ো সাবলীল ভঙ্গিতেই আছে। যেন ওদের হাসাহাসি তাদের দুজনকে ঘিরে না। নিজের মতন খেতে ব্যস্ত। এমনকি আহামরি পাত্তা দিচ্ছে না নিজের পিতা মহাশয় —শাহজাহান মোস্তফাকেও। মোস্তফা সাহেবের মুখমণ্ডলের অবস্থা বেশ একটা সুখকর নয়। গুরুগম্ভীর তার মুখশ্রীর হাবভাব। তেরছাভাবে ছেলেকে পরখ করে নিচ্ছেন ক্ষণেক্ষণে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির প্রভাবটুকু তন্ময় অনুভব করেও; অবুঝের ভাণ ধরে আছে। সংকোচনীয় ব্যাপারটি ঘটে গেছে তো গেছে। এখন আর কী করার? নিজের বউকে চুমুটুকুর বদলে কামড় নাহয় খেয়েছে। তাতে কী এমন হয়েছে? তার বউকে সে চুমু খাবে নাকি কামড়– তারও কি কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি? একফাঁকে বাঁকাচোখেতে একবার অরুকেও দেখে নিয়েছে। অপদার্থটা মাথা নুইয়ে হাঁসফাঁস করছে। এত লজ্জাই যদি পাবে তাহলে নেমেছিল কেন নিচে? কে জোর করেছে ওকে? ড্যাংড্যাং করে সেধেপড়ে লজ্জা মাথায় নিলে এখানে তার কী করার? ওর মাথার ভেতরে আসলে কিছুই নেই। গাধা একটা!

খাওয়া শেষে তন্ময় যেতে নিয়েও আরেকটিবার ফিরে চায়। অরু এখনো বলদের মতন খাবার প্লেটে নিয়ে বসে আছে। দু-লোকমা কোনোরকমে হয়তোবা মুখে তুলেছিল। বাদবাকি খাবারগুলো মনোযোগ সহকারে আঙুল দিয়ে বুনছে। আশ্চর্য! খেয়েদেয়ে ঘরে যাবে– তা না করে ঠোঁট কাঁটা মুখ নিয়ে আমোদে বসে থাকার মানে আছে?বতন্ময় একপ্রকার বাধ্য হয়েই ধমকে ওঠে,
‘এভাবে খাবার নিয়ে বসে আছিস কেন? খেয়েদেয়ে ওঠ!’

অরু চমকে ওঠে। মুহূর্তেই চোখ তুলে চায়। দৃষ্টিতে দৃষ্টির মিলন ঘটে সেকেন্ডের। পরমুহূর্তেই মুখ বাঁকিয়ে সে নিজের খাবার বুনতে শুরু করে পূর্বের ন্যায়। অনাগ্রহী তন্ময়ের আদেশ শুনতে। তন্ময় আর একমুহূর্ত দাঁড়ায় না। ত্বরান্বিত পদচারণে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে আসে। সুযোগ পেলেই দেখা যাবে তার ঘাড় ধরে বসেছে মোস্তফা সাহেব। তার সম্মুখীন না হওয়াই উত্তম। রুমে ফিরে আধপড়া ফর্মটা পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখনই নামল ঝুম বৃষ্টি। তার ইজি চেয়ারটা বারান্দার ঠিক কাছেতেই। সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বৃষ্টির উদাসীনতা– বিশালতা। উদার হাওয়াতে বসে ভেসে ভেতরে প্রবেশ করছে বৃষ্টির জল। বারান্দার ফ্লোর ভিজিয়ে দিয়েছে ইতোমধ্যে। গ্রিলে ঝুলানো ছোটো-ছোটো ফুলের টবগুলোতে থাকা কয়েকধরণের ফুলেরা ভিজছে, দুলছে–হাসছে।

তন্ময়ের মনে পড়ল অরুর সকালের কথাগুলো। ঘুরতে যেতে চেয়েছিল মেয়েটা! অনেকদিন ধরেই ওকে নিয়ে বেরোনো হচ্ছে না। অরুর ভার্সিটিতে গিয়ে একদিন ওকে পিক করা প্রয়োজন। বিষয়টা খুব পছন্দ করে ও। বিশেষ করে তন্ময় একান্তভাবে গিয়ে ওকে পিক করবে, এই বিষয়টা খুব এঞ্জয় করে। তন্ময় বুঝে সবই। সেবার হঠাৎ করেই দুপুরের দিক সে অরুর ভার্সিটিতে পৌঁছেছিল। ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে তাকে দেখতে পেতেই কী খুশিই না হয়েছিলো মেয়েটা! পাশে দাঁড়ানো বন্ধুবান্ধব গুলো কেউই যেন তখন আর ওর চোখের দৃষ্টিতে নেই। শুধুই তন্ময় বসবাস করছিল ওই মণি দুটোতে। সেই হাস্যজ্জ্বল মুখটার কথা ভাবলে এখনো আনন্দে জোয়ার বয় তার হৃদয়ে। অথচ কাজের চাপে আজকাল সময় দিতে পারছে না।

ভেবেই তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দেয়াল ঘড়িতে দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় একটিবার। এখনো আসছে না যে! বৃষ্টি নেমেছে মিনিট পাঁচেক হলো বলে। ও কী দেখেনি? তন্ময় গুণে-গুণে আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করল। তবুও অরুর দেখা পাওয়া গেল না। অবশেষে সে নিজেই উঠে দাঁড়াল। নিশ্চয়ই অভিমান ধরে বসে আছে। ও অভিমান ছাড়া আর কী-বা পারে করতে! ওয়ালেট, ফোন —গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। অরুর রুমের দরজা খোলা। ভেতরে কেউই নেই। তন্ময় সিঁড়ি ভেঙে নিচতলায় নেমে আসে। ড্রয়িংরুমে বসে মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব এবং ওহী সাহেব। সাপ-লুডু খেলছেন তিন ভাই।

চা খাচ্ছেন আর সাথে আলাপ জুড়েছেন ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড নিয়ে। অরুকে কোথাও দেখা গেল না। তন্ময় ভ্রুদ্বয় কুঁচকে দীপ্তকে ডাকল গলা তুলে। দীপ্ত রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো। মুখে তখনো ঠাঁসা মিটবল। জবেদা বেগম আজ মিটবল বানাচ্ছেন। তার হাতের সবই কমবেশ সুস্বাদু হয়। তার হাতে বানানো এই মিটবলও অসাধারণ হয়েছে খেতে। দীপ্তই সর্বপ্রথম খেয়ে টেস্ট করছিল রান্নাঘরের বেসিনের ওপর বসে। তন্ময় অরুর সম্পর্কে শুধাতেই দীপ্ত হাত উঠিয়ে ওপরে দেখায়। শাবিহার রুমের দিকটায়। তন্ময় পুনরায় সিঁড়ি ধরে ওপরে ওঠে আসে। শাবিহার রুমের কাছাকাছি গিয়েই তার পা’জোড়া থেমে আসে। রুবি দুষ্টুমির সুরে রঙ্গ করে বলছে,

‘কীরে—চুপ আছিস কেন, বল, বল! আমাদের খুলে বল হয়েছে কী! আমরা যা ভাবছি তাই বুঝি? তন্ময় ভাইকে দেখে কিন্তু রোমান্টিক বলে মনে হয় না। ভাই তোকে ধরে চড়িয়ে পড়াচ্ছে এতটুকুতেই আমার চিন্তাভাবনা সীমাবদ্ধ। এরথেকে বেশি ভাবা সম্ভব হচ্ছে না।’
হাসাহাসির একটি ঝড় বইল রুবির বাক্যগুলো শেষ হতেই। সেখানে আকাশের কণ্ঠের হাসির ধ্বনিও মিশ্রিত। তন্ময়ের কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। সে পদচারণ ফেলে এগুব তখনই অরুর অসন্তুষ্ট গলার স্বর শোনা গেল। বড্ড বিরক্তি মিশে তার বচনের ভঙ্গিতে,
‘তোমরা কী কখনো পড়নি —‘ডু নট জাজ আ বুক বায় ইট’স কভার?’ আমার তন্ময় ভাই কেমন তা আমি জানলেই হবে। তোমাদের তো জানার প্রয়োজন নেই।’

শাবিহা সহমত পোষণ করল ততক্ষণাৎ, ‘সহমত। আমি ভাবির সঙ্গে একমত।’
এবারো হাসল সকলে। অরুকে ভাবি ডাকাটা যেন অন্যতম হাস্যকর ব্যাপারস্যাপার। এইযে রুবি হাসতে হাসতেই বলে ফেলল, ‘ভাবি-টা আমাদের খুব ছোটো হয়ে গেল।’
অরুর কণ্ঠজুড়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ, ‘তোমরা ভীষণ খারাপ আর দুমুখো। তোমরা দুর্বলকে পিষে মারো আর শক্তিশালীকে ভয় করো। যাও না —গিয়ে তন্ময় ভাইয়ের সামনে রঙ্গতামাশা করো। দেখি তোমাদের কত সাহস।’
আকাশ হেসে রসিকতার সুরে বলল, ‘কীরে অরু! এখনো তন্ময় ভাই বলছিস? তোর কী আর ভাই হয়?’
‘কেন হবে না?’

তন্ময় এবারে দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়াল। দরজাটা সটানভাবে খোলাই ছিলো। তাকে দেখেই পিনপতন নীরবতা বইল সেকেন্ডের জন্য। শাবিহা ত্বরিত পেছনে ঘুরে ইতোমধ্যে টেবিল গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রুবি মাথানিচু করে বাথরুমে ঢুকে গিয়েছে। ধমক সে খেতে চায় না। আকাশ ফোন টিপছে বিছানায় বসে। মুখে তখনো তার দুষ্টু হাসি। অরু সবগুলো দু’মুখোদের কর্মকাণ্ড দেখে ভেংচি কাটে। কতবড় দুমুখো সাপ সবগুলো। এখন তন্ময়ের সামনে কেন ওসব দুষ্টু কথাবার্তা বলতে পারে না? ভালো সাজবার মানে কী? তন্ময় সরু চোখে দেখছে অরুর ভোঁতা মুখটা। ও অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁই। যেন তন্ময় না ডাকলে এক’পা নড়বে না। তন্ময় অসহায় কণ্ঠে ডাকে,
‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয়।’

অরু এবারে মাথা তুলে চায়। মুখ বাঁকায়। তবে কথা শোনে। হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। সিঁড়ি বেয়ে আগেই নেমে যাচ্ছে। আনোয়ার সাহেব মেয়ের তাড়াহুড়ো দেখেই গলা তুলে সাবধান করলেন। ওহী সাহেব শুধালেন,
‘বাইরে বৃষ্টি, মামণি! কই যাচ্ছো তুমি?’
তিন ভাইয়ের প্রশ্নবোধক দৃষ্টিই আপাতত অরুর পানে। তন্ময়ও পিছু পিছু নেমে এসেছে। অরুর হয়ে জবাব সেই দেয়,
‘একটু বেরোচ্ছি ওকে নিয়ে।’
আনোয়ার সাহেবকে দারুণ খুশি দেখাল, ‘তাই বুঝি! বেরিয়ে পড়ো তাহলে। ঘুরেফিরে বৃষ্টিবিলাস করে এসো। তবে বৃষ্টিতে ভেজো না যেন!’

মোস্তফা সাহেব মুখে কিছু বললেন না। শক্ত, দৃঢ় চোখে শুধু ছেলের পানে চেয়ে। পিতা-পুত্রের দৃষ্টির মিলন ঘটল। একজনের সূক্ষ্ম দৃষ্টি আর অন্যজনের সাবলীল। এযাত্রায় তন্ময় ডান ভ্রু তুলে নাচাল। যেন অবলিত প্রশ্নবোধক ‘কী’ উচ্চারণ করছে সে। মোস্তফা সাহেব মুখ ফিরিয়ে নিলেন। থমথমে গলায় বললেন,
‘তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’
তন্ময় হাসে। মুখে বলে, ‘জি।’

আঁধারছন্ন ঝুম বৃষ্টি। বাতাসের তোড়জোড়ে কঠিন প্রভাব বিস্তর করছে। সড়কপথে মানুষজন নেই। গাড়িঘোড়া হাতেগোনা কিছু বায়-পাস করছে তাদের। গাড়ির স্পিড মাঝামাঝিতে। অরু জানালার কাঁচ অর্ধেক নামিয়েছে। অত্যন্ত ধারালো, প্রখর বৃষ্টির সম্মুখে সম্পূর্ণ নামানো যাচ্ছে না। সুযোগ পেতেই বৃষ্টি পোঁটলাপুটলি বেঁধে তার কোলে বাসা বাঁধতে উদ্যত। তন্ময় আড়চোখে দোটানায় ভোগা অরুকেই দেখছিল। এযাত্রায় মুখ খুলল সে,
‘কাঁচ নামাতেই হবে কেন? ভেতর থেকে কি দেখা যাচ্ছে না?’
অরুর কণ্ঠজুড়ে আশ্চর্যতা, ‘এক বিষয় হলো নাকি? বৃষ্টি ছুঁয়ে, সরাসরি না দেখে কি উপভোগ করা যায়?’
‘না যাওয়ার তো কারণ দেখছি না।’

অরুর ক্ষোভযুক্ত নয়নযুগল সূক্ষ্মভাবে তন্ময়কে পরখ করে নিচ্ছে, ‘আপনি চাচ্ছেন আমি যেন রেগে বাসায় চলে যেতে চাই। তাহলে আর আমায় ঘুরতে নিতে হবে না। আপনি বেঁচে যাবেন।’
তন্ময়ের চোখমুখ জুড়ে প্রাণোচ্ছল হাসি ফুটে ওঠে, ‘পণ্ডিত কোথাকার।’
অরুর ঝগড়াটে কণ্ঠ আসমান চড়ে বসে,
‘আমি কি ভুল কিছু বলছি? তাহলে অস্বীকার করুন! বলুন মুখে।’
তন্ময় দৃষ্টি রাস্তাতেই রাখে। ঠোঁট জুড়ে চওড়া হাসি, ‘অস্বীকার করছি না। তুই বাসায় যেতে চাইলে বেঁচে যাব।’
অরু চমকাল। বিমূঢ় হলো দৃষ্টি। ছোটো-ছোটো ছলছল অভিমানী চোখে চেয়েই রইল তন্ময়ের মুখপানে। ভোঁতা হয়ে থাকা আদুরে মুখটা দেখে– নিজের হাতটা আর সামলে রাখতে পারল না তন্ময়। ডান হাতে স্টিয়ারিং সামলে বাম হাতটা বাড়িয়ে অরুর গাল দুটো চেপে ধরল,

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫১+৫২

‘কী? দিয়ে আসি বাসায়?’
‘আমি চাচ্চুকে বিচার দিব।’
তন্ময় সামান্য ভয় পাবার ভাণ ধরে জানাল, ‘ওহ্, ভীষণ ভয় পেয়েছি। এখন তো বাধ্যহয়ে তোকে নিয়ে ঘুরতেই হবে।’
অরুর ঠুনকো অভিমান এবং ভোঁতা মুখ, দুটোর একটাও বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব পেলো না। বৃষ্টি যেন সব অভিমান গুলো মুছে দিলো। ঠিক সড়কপথটির মতন। পরিষ্কার, ঝকঝকে।

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫৫+৫৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here