শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫৭+৫৮

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫৭+৫৮
Nabila Ishq

মাইক্রো-র ভেতরে এয়ারকন্ডিশনার আছে। তবে তা বন্ধ। কেন? কারণ তন্ময়ের প্রিয়তমা প্রকৃতির উত্তপ্ত হাওয়া উপভোগ করবে। পুতুলের মতন আঁখিদুটি দ্বারা চেয়ে যখন বলল, ‘ভাইয়া, উইন্ডোজ গুলো খোলা থাকুক?’ তখন মাহিন উত্তাপে গলগল করে ঘামছে। ক্ষ্যাপা সূর্যকিরণের তাপে অচৈতন্য হওয়া বাকি। তবুও অরুর আবদারটুকুর মুখে শক্তপোক্ত এক না বলতে বড্ড নারাজ। সে রুস্তমের সঙ্গে চোখাচোখি করে।

দু’বন্ধু অনিচ্ছাকৃত রোবটের ন্যায় মাথা দোলায়। সহমত! ওদের নাস্তানাবুদ হতে দেখে তন্ময় ইষৎ পৈশাচিক আনন্দ পায়। অন্যত্র অরু আত্মহারা। সমর্থন পেয়ে। উচ্ছ্বাস বদনে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগে ব্যাকুল সে। মাইক্রো-তে মোট ছয়টা উইন্ডো। প্রদীপ্ত সূর্যের তাকে মস্তক গলে যাবার উপক্রম। প্রত্যেকটি উইন্ডো খোলা। অরুর পার্শ্ববর্তী উইন্ডোতে সূর্যের উত্তপ্ত কিরণ পড়ছে। ঠিক ওর মুখমণ্ডলের ওপরও। এই দৃশ্য কিয়ৎক্ষণ অবলোকন করে তন্ময়। ওর ফরসা মুখটা রক্তিম হয়ে যাচ্ছে। ভরাট গাল দুটো লালিত। মুহূর্তেই অরুর হাত টেনে একান্ত কাছে আনে। এহেন আকস্মিক কাণ্ডে অরু হকচকিয়ে যায়। ধাতস্থ হয়ে মাথা তুলে চায়। দৃষ্টিতে প্রশ্ন। অতঃপর কৈফিয়ত না পেয়ে প্রশ্ন করে বসে,
‘কী হলো?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অরুর প্রশ্নের প্রত্যুত্তর করে রুস্তম। তার পুরুষালি কণ্ঠখানা কৌতুককর শোনায়, ‘তোমার সুন্দর মুখটায় সূর্যিমামা বসেছে। এটা তোমার পার্সোনাল বড়ো ভাইয়া মানতে চাচ্ছে না। যদি তোমার বেবি স্কিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়? তাহলে তো…’
তন্ময় রুক্ষমূর্তি রূপ ধারণ করে ফেলেছে। বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো গম্ভীর। ললাটে চারটে নিষ্ঠুর ভাঁজ পড়েছে। ওষ্ঠদ্বয় একে ওপরের সঙ্গে প্রগাঢ়ভাবে লেপ্টে। সন্তর্পণে হাতের তালুর মুঠোয় রাখা ইয়ারপিস দুটো– পুনরায় অরুর কানে নির্বিকার চিত্তে ঢুকাল তন্ময়। একেকটি বন্ধুর মুখশ্রী পানে সূক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে শেষমেশ সতর্ক কণ্ঠে গর্জিয়ে ওঠল,

‘ওর সামনে ফালতু কথা না। শুধরে থাক। ওয়ার্নিং দিচ্ছি।’
মাহিন যেন কৌতুক শোনে। ক্রুর রবে হাসে। আমোদেই ভ্রু নাচিয়ে শুধায়,
‘না শুধরালে কী করবি? শাহজাহান তন্ময় চাচা ঠিক কী করবে জানতে আগ্রহী বড্ড!’
রিয়ান ড্রাইভিং-এ মনোযোগী স্বত্বা হয়েও সুরে সুর মেলায়,
‘বল, বল —কী করবি? আমি তো এক্সাইটেড। অরুর মতন। আমাদের স্মল বেইবি এই ট্যুর নিয়ে এক্সাইটেড এবং আমিও।’
তন্ময়ের চোয়াল শক্ত হয়। চাপাস্বরে ধমকানো সুরে বলে, ‘লাথি খাইস না। বলছি না এসবে ডাকবি না ওকে?’
রিয়ান অসহায় ভঙ্গিমায় আওড়ায়, ‘এমন বাচ্চা মেয়েকে কী বলে ডাকব?’
তন্ময়ের নির্বিকার প্রত্যুত্তর, ‘ভাবি।’

‘ইশ! এই সম্বোধনে ডাকতে লজ্জা লাগে। ওই বাচ্চা মুখটা কী আমাদের ভাবির কাতারে পড়ে?’
মাহিন মাথা দোলায় ক্রমান্বয়ে। তন্ময় অতিষ্ঠ এবং হতাশ। এইমুহূর্তে তার অনুশোচনা হচ্ছে। ওদের সাথে অরুকে সঙ্গে নিয়ে ট্যুর দেয়াটা নির্বুদ্ধিতা বৈ কিছু নয়। তন্ময়ের ভোঁতা পুরুষোচিত মুখাবয়ব দেখে রুস্তম মুখ টিপে হাসছে। তন্ময়ের পার্শ্ববর্তী আসনে বসা নির্বোধ, নির্ভেজাল, অবিদিত অরুকে দেখে বলে,
‘অরুর কানে ইয়ারপিস দিছিস কেন? বেচারি লেফটআউট ফিল করবে। ইয়ারপিস খোল।’
তন্ময় দাঁতে দাঁত পিষে। ভ্রু দুটো নাচিয়ে কাঠকাঠ গলায় প্রত্যুত্তর করে, ‘করুক। তোর ভাবতে হবে না। আমার বউকে নিয়ে আমাকেই ভাবতে দে।’

রিয়ান, মাহিন আর রুস্তম দৈত্যের ন্যায় হেসে ওঠে। ওদের হাসির তোপে পড়ে অসহ্য শুহানি।
অতিষ্ঠ ওদের কর্মকাণ্ডতে। চোখ রাঙিয়ে তাকায় রিয়ানের দিক। ওর উদ্দেশ্যেই শাসানো গলায় বলে,
‘ওফ, থাম তোরা। ঘুম ধরছে। সারারাত ট্যুর প্ল্যানিং-এর চক্করে ঘুম হয়নি। এখন ঘুমাব, ঘুমাতে দে। আল্লাহ্’র দোহাই লাগে।’
শুহানির এইকথাতে, মুখ দ্বারা রিয়ান আর একটি শব্দ বের করার স্পর্ধা দেখায় না। নীরব রয়। এতে অসন্তোষ মাহিন। ওষ্ঠদ্বয় ফুলিয়ে রাখে। একজন বউকে ভয় পায়, অন্যজন বউকে অন্তঃকরণের পিঞ্জরে বন্দি করে রাখে। এদের মধ্যে সিঙ্গেল সে লেফটআউট এবং বিষণ্ণ। অসাধারণ নীরবতায় তন্ময় সন্তুষ্ট অনুভব করে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে। অরুর কান থেকে ইয়ারপিস খোলে। ওর মাথাটা একান্ত কাঁধে চেপে আদেশ ছুঁড়ে,

‘কবুতরের মত ছটফটানো বন্ধ কর। চোখ বুজে ঘুমা। লম্বা জার্নি।’
ট্যুর নিয়ে প্রবল উৎসাহিত অরু গতরাত ঘুমুতে পারেনি। নিদ্রার ‘ন’ টুকু আসেনি সারারাত। নিশাচর প্রাণী প্যাঁচার মত সজাগ ছিল ভোরের আগ পর্যন্ত। চোখ দুটি ছোটো-ছোটো হয়ে আছে। ইষৎ রক্তিমও বটে। তন্ময়ের কথায় অনুভব হয় নির্ঘুম চোখদুটোর তন্দ্রা প্রয়োজন। প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিতে বেশ আমোদেই তন্ময়ের কাঁধে মাথা রেখে, হাত জড়িয়ে চোখ বুজল। এই দৃশ্যে ফ্যাচফ্যাচ করে হাসে। তন্ময় চোখ রাঙাতেই ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলে।

নীলসাদাটে গগনের বুক ছিঁড়ে ওড়া স্বাধীন পাখিদের মতন শহুরে সড়কপথ পিষে ছুটছে মাইক্রো-টি। মাইক্রো অনুসরণ করছে নীড় বিহীন ইষৎ সংখ্যক পাখিদল। কার ক্ষমতা কতটুকু তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে যেন। রিয়ান দু’ঘন্টাখানেকের মত ড্রাইভ করেছে। এইমুহূর্তে সরু এক সড়কের নৈকট্যে মাইক্রো থামাল। এর বেশি ড্রাইভ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। গতরাত তার পর্যাপ্ত ঘুম হয়নি। ট্যুর সম্পর্কিত রচনার প্রণালী সাজানোয় ব্যগ্র ছিল। ড্রাইভিং-এর আসন ছেড়ে বেরোল বিদ্যুৎ গতিতে। এযাত্রায় পরিষ্কার এবং ম্লান কণ্ঠে ঘোষণা দেবার ভঙ্গিতে জানাল,
‘এখন ড্রাইভ করবে —আমাদের চাচা ওরফে মাহিন মজুমদার। কড়ো তালি হোক।’

সূর্যিমামার উত্তপ্ততা মৃদু হয়ে এসেছে। বাতাবরণের মিষ্টি স্পর্শ শীতল। ড্রাইভিং-এর পার্শ্ববর্তী সিটে মাহিন তন্দ্রার তোপে দুলছিল। সিটে মাথাটা এলিয়ে ছিল কোনাকুনি ভাবে। আকস্মিক কড়ো তালির ধ্বনিতে হকচকিয়ে ওঠল। কাঁচা তন্দ্রার রেশ তখনো কাটেনি। ইষৎ রক্তিম চক্ষুযুগল পিটপিট করে চেয়েছে কেবল। মুখাবয়ব পরাকাষ্ঠা গম্ভীর। নিশ্ছিদ্র এক প্রলয়কারী দৃষ্টি তাঁক করেছে রিয়ানের পানে। যেন দৃষ্টি দিয়েই ধনুক বাণ ছুঁড়ে এফোঁড়ওফোঁড় করছে রিয়ানের জ্যান্ত হৃৎপিণ্ড। রিয়ানের এতে হেলদোল হলো না। সে উত্তেজনাহীন এক নির্বিকার। অরুর গভীর তন্দ্রা ছুটেছে। তন্ময় অসন্তোষ। রিয়ান এহেন আমোদেই ফের উচ্চকণ্ঠে বলল,

‘কীরে— বেরিয়ে ড্রাইভ কর।’
মাহিন প্রগাঢ় নিদ্রায় দুলুদুলু করছে। পাপড়িযুগল জোরপূর্বক বুজে আসছে। রিয়ানের কথা কানে নেয় না। পুনরায় সিটে মাথা এলিয়ে জানায়,
‘আমার দ্বারা হবে না। ঘুমের তোপে গাড়ি কোথাও মেরে দেব।’
রুস্তম নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। শুহানির কানে ইয়ারবাডস ঢোকানো। দুজনই এই কোলাহলপূর্ণ ব্যাপারে নির্বোধ। তন্ময় ওদের বিরক্ত চোখে কিয়ৎক্ষণ দেখে। বেরিয়ে আসে দরজা খুলে। অরুকেও হাতের ইশারায় বেরুতে বলে। অরু ত্বরিত বেরোয় তন্ময়ের পেছন-পেছন। তন্ময় ড্রাইভিং-য়ে বসতে-বসতে মাহিনের উদ্দেশ্যে বলে,
‘পেছনে গিয়ে ঘুমা।’

যেন এই বাক্য শোনবার প্রত্যাশায় ছিল মাহিন। বিলম্ব না করে উৎফুল্ল বদনে বেরিয়ে এলো। ইতোমধ্যে রিয়ান অবসাদগ্রস্ত ভঙ্গিতে মাইক্রো-র পেছনের আসনে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়েছে। মাহিনও ওর শরীরে চরণ ফেলে আধশোয়া ভাবে চোখজোড়া বুজে নিয়েছে। সকলেই আপাতত সু’গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। অরু ড্রাইভিং-য়ের পাশে বসেছে। তন্ময় গাড়ি রি-স্টার্ট করেছে। ইতোমধ্যে তারা ঢাকার শহুরে পথঘাট হতে বহুদূর। মফস্বলের নৈকট্যে। সবুজে রঙানো নৈসর্গিক সৌন্দর্যে এক অপরূপ অর্পিত। দূরদূরান্তের যেথায় দৃষ্টি যায় শুধুমাত্র গাছেদের সমাহার। আঁধারছন্নতায় পড়া চাঁদের আলোয় এই যেন এক টুকরো স্বর্গ…

সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত সিলেট—পৌঁছাতে-পৌঁছাতে রাত এগারোটা ত্রিশ। তখন মানুষ্যদের যাতায়াত দ্বিপ্রহরের তুলনায় কম। নিস্পন্দ চতুর্দিক। মাইক্রো কোথাও থামে না।
সোজা বাগানবাড়ির উদ্দেশ্যে ছোটে। সবাই বিধ্বস্ত, ক্লান্ত। পৌঁছেই ভোজন সেরে নিজেদের গদিতে আয়েশ করে ঘুমুবে। সর্বপথ তন্ময় ড্রাইভ করে। অরু এই ঘুমায় আবার এই সজাগ। সজাগ থাকলে মুখ বন্ধ হয় না। ক্রমাগত চলে। তোতাপাখির ন্যায় যতসব বেহিসেব প্রশ্ন করতেই থাকে। পেছনে আধবসা মাহিন এবং রিয়ান বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা সবসময় ভেবেছে অরু কম কথা বলে। শান্ত-স্থির। অথচ স্বচক্ষে এই দৃশ্যে দুজন ভাষাহীন। অবশ্য ইব্রাহিম সেবার মজার সুরে বলেছিল,

‘অরুকে এখনো চিনিস নাই। ও অসহ্য রকমের চঞ্চল। একবার মিশে গেলে চিনবি।’
তবে বিশ্বাস করতে অপারগ তারা। দুজনই নিজ চোখেতে সেবার দেখেছিল অরুকে। নিশ্চেষ্ট ভঙ্গিতে বসেছিল। আজও দ্বিপ্রহরে পুতুলের মত নিশ্চুপ। মুখে রা নেই। অথচ সাঁঝের সময় থেকে যেন পৃথক অরুকে আবিষ্কার করল। শুহানি বেশ উপভোগ করেছে এই চঞ্চল অরুকে। ও যা-যা প্রশ্ন করছে তন্ময় প্রত্যুত্তর না করলেও সে নিয়মকরে করছে। এতে বেশ ভাব জমেছে দুজনের। হরেক রকমের বিষয়ে চর্চা হচ্ছে। মাইক্রো ইতোমধ্যে মৌলভীবাজার পৌঁছেছে। ঠিক পশ্চিমের কোলাহলধ্বনি হতে সুদূরে স্থাপিত রুস্তমদের বাগানবাড়ি।

এযাত্রায় বাগানবাড়ির দোরগোড়া ছুঁয়েছে তাদের মাইক্রো। পুরাতন আমলের বাড়িটি সুউচ্চ প্রাচীর এবং গাছপালা দ্বারা আবৃত। প্রাচীন ছাঁদের প্রাচীর ঘেঁষে অর্পিত একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। গাছের শাখা বিস্তৃত। বাতাবরণে দুলছে ঝুলন্ত লতাপাতা। দারোয়ান ইয়াসিন মোল্লা দ্বার খুলে দিয়েছে। কেয়ার টেকার বাবু মিঁয়া ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে তাদের অপেক্ষায়। গাড়ির ধ্বনি শোনে অন্দর হতে বেরিয়েছে ইব্রাহিম, সৈয়দ এবং এলিজা, ঐশী। ইব্রাহিম আর সৈয়দ গতকালই সিলেট পৌঁছেছিল। এলিজা, ঐশী আজই সাঁঝের সময়ে এসে পৌঁছেছে। দুজন প্লেনে করে এসেছে। মাহিন বেরিয়েই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঝাঁকাতে লাগল। দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে যেন। শুহানি বেরিয়েই এলিজা, ঐশীর আলিঙ্গনে মত্ত। রিয়ান বেরুল ঘুমকাতুরে চোখে। অরু চেয়ে তন্ময়ের পানে। তন্ময় বেরোচ্ছে না বলে সেও বসে। তন্ময় গাড়ি পার্ক করতে উত্তরদিকে ড্রাইভ করছে। ওখানে একটি গাড়ি ইতোমধ্যে পার্ক করা। গাড়িটার পাশেই মাইক্রো পার্ক করল তন্ময়। আপন সিটবেল্ট খুলে অরুর সিটবেল্ট খুলতে কোমর বাঁকিয়ে, হাত বাঁড়াল।
শুধাল,

‘টায়ার্ড?’
অরু গর্দান নাড়াল ক্রমান্বয়ে। বলল, ‘আপনি সেই কখন থেকে ড্রাইভ করেছেন। নিশ্চয়ই খুব ব্যথা করছে কোমর?’
তন্ময়ের মলিন মুখাবয়ব জুড়ে দুষ্টুমির ভিড় জমাল। যা সে অনায়াসে লুকিয়ে ফেলল। গম্ভীরতা বিরাজমান। দু’জনের মুখশ্রী এইমুহূর্তে ঘনিষ্ঠতায়। সিটবেল্ট খুলে তন্ময় ডান ভ্রু তুলে বলে,
‘হুঁ। মালিশ করে দিবি?’
অরু মাথা দুলাল। মুখ বাড়িয়ে আকস্মিক তন্ময়ের গালে ওষ্ঠদ্বয় ছোঁয়াল। মৃদু গলায় প্রত্যুত্তরে বলল, ‘দেব।’
তন্ময় কিয়ৎক্ষণ আশ্চর্য হয়। এবার সত্যিই আগ্রহী…. উত্তেজিত। উৎকণ্ঠিত সে অপেক্ষারত। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হওয়া যন্ত্রণা ওর মোলায়েম হাতের স্পর্শ পেতে ব্যগ্র।

কৃষ্ণচূড়া গাছটির মাথার ওপর ঠিক আসমানের বুকপকেটে জ্যোৎস্নাময়ী একটি চাঁদ বসেছে। চাঁদ জুড়ে আলোকবিন্দুর মতো জাজ্বল্যমান নক্ষত্রের নিবাস। ঝরঝরে হাওয়ার স্পর্শে দুলছে কৃষ্ণচূড়া গাছটি। এই বাগানবাড়িটি বেশ বিস্তৃত;খোলামেলা। দর্শন মাত্রই প্রশান্তি অনুভব হয় নয়নে। হৃদয়ের সব অবসাদ উড়োচিঠি বনে যায়। উঠোন খানা পরিপূর্ণ রূপে কৃষ্ণচূড়া ফুল দ্বারা আচ্ছাদিত। হাওয়ার স্পর্শে সেসব দিকভ্রান্ত, উৎকণ্ঠিত। একেকটি ফুলের ওপর পা ফেলতে দ্বিধাগ্রস্ত মন। ধীর গতিতে পদক্ষেপ ফেলতে হচ্ছে প্রাঙ্গণে। কৃষ্ণচূড়া গাছটির অদূরেই কয়েকটি চেয়ার পেতে দিয়েছেন বাবু মিঁয়া। তন্ময় বসেছে একটিতে, ঊরুর ওপর পা তুলে।

পাশেই রিয়ান বসেছে মেরুদণ্ড এলিয়ে। শান্ত হাওয়ার স্পর্শে আমোদিত সবাই। আরামকরে হেলেদুলে বসেছে একেকজন। ইতোমধ্যে সংগৃহীত খাবারদাবার গরম করা হচ্ছে। খেয়েদেয়ে এক গভীর ঘুমে ঝাঁপানো হবে। এটিই তাদের গ্লানি দূর করার একটিমাত্র মাধ্যম। ঘুমকাতুরে মাহিন অবচেতন হবে-হবে ভাব। রিয়ানও বেশ তটস্থ। অন্যত্রে ইব্রাহিম অত্যন্ত চাঙ্গা। আজ সারারাত গল্পে মশগুল থাকতে পারবে। সারাদিনব্যাপি ঘুমিয়ে কেটেছে বলে কথা। সৈয়দের আঙুলের ভাঁজে একটি সিগারেট। ধরাতে গিয়েও ধরানো হচ্ছে না। অরুর বিদ্যমানতা তাকে নিষেধাত্মকের সম্মুখে ফেলেছে। বাঁদিকের আসনে বসা তন্ময়ও সতর্কবাণীময় সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়েছে দু’বার। উপায়ন্তর না পেয়ে সিগারেট বক্সে ভরে ফেলল। পকেটে ঢুকিয়ে নিলো আলগোছে। ভোঁতা মুখে বন্ধুর মুখশ্রী পানে চেয়ে তেরছাভাবে প্রশ্নাত্মক কণ্ঠে বলল,

‘রেখেছি। ইউ হ্যাপি, ব্রো?’
তন্ময়ের হাতে লেবু শরবত। কাচের গ্লাসে। ঠান্ডা। আইসকিউব দেয়া। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই দিয়ে গিয়েছেন বাবু মিঁয়া। ভদ্রলোক উল্লাসেই আছেন। অতিথি আপ্যায়নকারী আত্মভাব তার। একত্রে এতগুলো বন্ধুবান্ধব দেখে তিনি আপ্লুত। যেন নিজের শৈশব দেখছেন। গদগদ গলায় ক্ষণেক্ষণে এসে এঁকেবেঁকে প্রশ্ন করছেন, সবার পছন্দ-অপছন্দের। সেই মোতাবেক খাবার তালিকাকৃত করবেন। খাতা-কলমও তার হাতে ছিল। এইমুহূর্তে তন্ময়ের দৃষ্টি অদূরে। ঠিক সামনে। অরুর দিক। অরু কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে। শুহানির সঙ্গে। হাসছে, চাঁদের ছবি ক্যাপচার করছে। পাশাপাশি এলিজা, ঐশীও দাঁড়িয়ে। রমণীদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠেছে। তন্ময় নিজের প্রগাঢ় চাহনি ফিরিয়ে আনে। সৈয়দের চোখে চেয়ে প্রশ্নের প্রত্যুত্তর করে,

‘ইয়েস, মাইন্ডব্লোয়িং। প্লিজ, বিহেভ ইওরসেল্ফ!’
রিয়ান উচ্চকণ্ঠে হেসে ওঠে। ভোঁতা মুখের একনিষ্ঠ মালিক– সৈয়দের পুরুষালি কাঁধ চাপড়ে সতর্ক করার তাগিদাতে বলে,
‘মামা, সাবধান। বি সুপার কেয়ারফুল ফ্রম আওর তন্ময় চাচা। সে খাঁটি বউ পাগল। কোন ল্যাভেলের বউ পাগল সচক্ষে না দেখলে বুঝবি না। পুরাই প্রটেক্টিভ। আমি অরুকে বেবি ডাকছি দেখে, পারছিল না আমায় জিন্দা ক বর দিতে। চোখের চাহনি দিয়ে ভস্ম করতেছিল।’

তন্ময়ের ভ্রুদ্বয়ের মধ্যস্থানে গুটি কয়েক ভাঁজ পড়ে। ডান ভ্রু তুলে সে। চাপা স্বরে ধমকের সুরে বলে,
‘আমার বউকে আমিই এখনো বেবি ডাকিনি। শালা, তুই ডাকার সাহস পাস কই?’
এবার সৈয়দও ফিক করে হেসে ফেলে। রুস্তম দানবের মতন উচ্চকণ্ঠে হাসছে। তালে তাল মিলিয়ে হাসছে বাকিরাও। যেন পৃথিবীর অন্যতম কৌতুক শুনেছে। রিয়ান দু’হাত তুলে ফেলে সারেন্ডার হওয়ার ভঙ্গিমায়। ত্বরিত নিজের ভুলত্রুটি স্বীকার করে ফেলে,

‘অনেক বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি। মাফ করে দেন জনাব। আমি কাল থেকে বেবি ডাকব। আজ রাতে তো তুই এভাবেও কয়েকশত বার জান, মাই বেবি, সোনামণি—ডাকতে থাকবি।’
রুস্তমের টনক নড়ে। উদগ্রীব হয় দৃষ্টি। কণ্ঠে উৎসুক ভাব,
‘এই আজ কী তাহলে তন্ময়ের মধুচন্দ্রিমা হতে যাচ্ছে?’

তন্ময় নির্বিকার ভঙ্গিতে শরবত খাচ্ছিল। পরোয়া করছিল না একটি বাক্যেরও। শেষমুহুর্ততে আকস্মিক এহেন বাক্য কানে প্রবেশেই, পিলে চমকে ওঠে। শিহরণ বয়ে যায় মেরুদণ্ড বেয়ে। হৃদয়ে উথালপাতাল বেগতিক ঢেউয়ের জোয়ার। এবেলায় খুকখুক করে কেশে ওঠে। ঢোক গিলতেই—শরবত মস্তকে ওঠে আসে। নিজেকে ধাতস্থ করে সম্মুখে চায়। কাশির ধ্বনি শুনে অরু বিচলিত চোখে ইতোমধ্যে চেয়ে আছে। আপাতত তন্ময়ের দিকেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। তন্ময় শক্তপোক্ত দৃষ্টিতে চোখ রাঙায় বন্ধুদের। দাঁতে দাঁত চেপে নিচুস্বরে আওড়ায়,

‘শাট ইওর ডার্টি মাউথ।’
ভেঙাল ইব্রাহিম, ‘তুমি করলে ডার্টি না, আমরা বললেই ডার্টি।’
এবারে আর তন্ময়ের সতর্কতার বাণী ছুঁড়তে হয়নি। অরু কাছাকাছি আসতেই সবাই নীরব, স্থির—নিবৃত্ত বড্ড। মুখে মিঠাইয়ের মতন মিষ্টি স্মিত হাসি। অরু এসে বিহ্বল কণ্ঠে শুধায়,
‘কী হয়েছে? আপনি কাশছিলেন!’
তন্ময় মুখ খোলার সুযোগটুকু পেলো না। রুস্তম সুর তুলে প্রত্যুত্তরে বলল, ‘এই কাশি আসল কাশি নয়, মামণি। এই কাশির এক ভিন্ন অর্থ আছে।’
অরু বড়ো অস্থির হয়, ‘কাশির আবার অর্থ হয়?’
মাহিন অকপটে বলে, ‘আছে।’
‘কী অর্থ?’ অরুর ব্যাকুল প্রশ্ন।
তন্ময় চূড়ান্ত হতাশ। অনুরাগশূন্য মুখাবয়ব। অসহ্য চোখে চেয়ে। রুস্তম মাথা দুলিয়ে বলে, ‘অর্থ হচ্ছে, তন্ময় তোমায় মিস করছে।’

অরু আশ্চর্য হয়। কাশির যে এমন তাৎপর্য রয়েছে সে জানতো না। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি তন্ময়ের ওপর পড়ে। তন্ময় এবারে ওঠে দাঁড়ায়। রুস্তমকে বাঁকাচোখেতে দেখে বলে,
‘জ্যোতিষী স্টিল সিঙ্গেল। স্যাড!’ বলে আর দাঁড়াল না। অবুঝ অরুর কাঁধ ধরে বাড়ির অন্দরে ঢুকে গেল। রুস্তম আহত চোখে চেয়ে। তার দুর্বল যায়গাতে প্রহার করেছে। গার্লফ্রেন্ড নেই বলে এভাবে কটাক্ষ করবে? ইব্রাহিম হেসে ওঠে। স্লোথ গলায় শুধায়,
‘আমি বলেছিলাম না? বিশ্বাস হলো তবে?’
মাহিন যেন এখনো বিশ্বাস করতে অপারগ,

‘ভাই, তন্ময়ের সেই ধৈর্য আছে। গাড়িতে অরু তোতাপাখির মতন বলেই যাচ্ছিল, বলেই যাচ্ছিল। আর তন্ময় স্থির ভঙ্গিতে শুনছিল। আবার সাবলীলভাবে জবাবও দিচ্ছিল। যেন এমনটা নিত্যদিন হয়।’
শুহানি এসে দাঁড়িয়েছে সবেমাত্র। এইকথা শুনেই চটে যায়,
‘এতে এতটা আশ্চর্য হওয়ার তো কিছু নেই।
তন্ময় বরাবরই অরুর সবকিছুতেই ধৈর্যবান। ওরা
দুজন– মেইড ফর ইচ আদার। একজন বাঁচাল। অন্যজন পারতে একটি শব্দ উচ্চারণ করে না। অপজাইট এট্রাক্টস দ্য মোস্ট। আবারো প্রমাণিত।’
এসময় বাবু মিঁয়া ত্বরান্বিত পায়ে ছুটে এসেছেন। জানিয়েছেন খাবারদাবার গরম হয়েছে। যেকোনো সময় পরিবেশন করতে পারবে। এতে সবাই হৈচৈ করে ওঠল। ততক্ষণাৎ বাড়ির ভেতর রওনা হলো। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেয়া দরকার। পেটে ইঁদুর হাঁটছে।

উত্তরদিকের ঘরটি তন্ময় নিয়েছে। ঘরের পূর্বত্রে বারান্দার মতন আছে। সাথে প্রশস্ত একটি জানালা। লাগোয়া ওয়াশরুম। প্রকৃতপক্ষে অরুর পছন্দের ঘর এটি। ধীর গতিতে টুকটুক করে ঘুরে বেরিয়েছে পছন্দমত রুমের খোঁজে। পেতেই সে সন্তোষ বিড়াল। আরাম করে নরম গদিতে বসে আপাতত। পা দুটো নাচিয়ে ভেতরে চোখ ঘুরাচ্ছে। সাদা বাল্বের আলোতে চমৎকার লাগছে সবকিছু। বেশ সুশৃঙ্খলভাবে গোছানো। তন্ময় তাদের ল্যাগেজ দুটো প্রাচীর ঘেঁষে রাখল। উর্ধ্বদিকে তাকে অনুদ্ধত দেখালেও —হৃদয়ের ভেতরে সে আলোড়িত। বন্ধুদের তখনকার কথাটি এখনো কানে বেজে চলেছে। অপরদিক অরুর উদগ্রীব দৃষ্টি তাকে উত্তেজিত করছে। আপন সত্ত্বাকে নিয়ন্ত্রণ করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসময় রিয়ানের আহ্বান শোনা গেল দ্রুত বেরুনোর,

‘রোমান্স পড়ে করিস। সারারাত বাকি আছে। অরুকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আয়। খাব। ক্ষুদায় মা রা যাচ্ছি, লিট্রেলি!’
অরুর সহাস্য চঞ্চল মুখটি ধুপ করে নিভে এলো। দৃশ্যমান রূপে রক্তিম হলো গাল দুটো। কাঁপল ঠোঁটজোড়া। চোখজোড়ার পাপড়িদ্বয় ক্রমান্বয়ে পলক ফেলছে। তন্ময় নিজেকে নির্বিকার রাখার প্রচেষ্টারত গলায় বলল,
‘যা –ফ্রেশ হয়ে আয়।’

অরু যেন আদেশের অপেক্ষাতেই ছিল। ততক্ষণাৎ ওঠে দাঁড়াল। নিজের ল্যাগেজ খুলল ব্যস্ত হাতে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে ওয়াশরুম ঢুকল। ওয়াশরুমের দরজা লাগতেই, বড়ো করে শ্বাস টেনে ফেলল তন্ময়। শার্টের চারটে বোতাম খুলল ঝটপট। অত্যধিক গরম লাগছে। ঘেমে ওঠেছে ললাট। এত গরম লাগার কারণ কী? আর হার্টবিট তিনশো পঞ্চান্ন ডিগ্রীতে চলছে কেন? ধুকপুক.. ধুকপুক.. ধুকপুক। বক্ষস্থলে হাত চেপে বিছানায় বসল। নিরাশ্রয় দৃষ্টি ওয়াশরুমের দরজায়। এরপূর্বেও তো তারা একই কক্ষে থেকেছে। আজ প্রথম তো নয়! দৃষ্টি ফেলল দেয়াল ঘড়িতে। বারোটা বিশ। রাত হয়েছে বেশ। তন্ময় ফোন বের করল পকেট হতে। সাইলেন্ট করা ছিল। মোট নয়টি মিসড এসে রয়েছে। পাঁচটা মোস্তফা সাহেবের।

চারটা আনোয়ার সাহেবের। তন্ময় আপন পিতাকেই কল ব্যাক করল সর্বপ্রথম। ভদ্রলোক যেন ফোন হাতেই বসেছিলেন। এক রিং হতেই ধরেছেন। কণ্ঠে গমগমে ভাব। প্রশ্নপত্র যেন তার হাতেই ছিল। একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে চলেছেন। তন্ময় আজ পিতার বাধ্যগত পুত্র। সাধারণ, সাবলীল গলায় প্রত্যুত্তর করছে। পিতার সঙ্গে কথা শেষ করে, চাচা নামক শ্বশুরকে কল করল। আনোয়ার সাহেবের কণ্ঠ তন্দ্রাচ্ছন্ন। ভদ্রলোক ঘুমুচ্ছিলেন। তন্ময় দু’চার বাক্যের কথা শেষ করে কল কাটল। ফোন বিছানায় ফেলে ওঠে দাঁড়াল। ল্যাগেজ থেকে ট্রাউজার, টি-শার্ট বের করে নিলো। অরুর তদ্রূপ সময় লাগেনি। মেয়েটা পাঁচ মিনিটের মাথায় বেরিয়ে এসেছে। জামাকাপড় বদলেছে। পরেছে কটনের পাতলা ফতুয়া সাথে বিস্তৃত প্লাজো। হাতে স্কার্ফ। জড়সড়ো পদচারণ ফেলে এগিয়ে আসছে। অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে; সামান্য লাজুকও বটে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাচ্ছে না। বরং চতুর্দিক ওর মনোবৃত্তি।

কাচের ডাইনিং টেবিল জুড়ে এরমধ্যে সকলে সমাগত। উৎকণ্ঠিত ভঙ্গিতে বসে তন্ময়-অরুর জন্য। ওরা দুজন আসতেই খাওয়াদাওয়ার পর্ব শুরু। কয়েকরকমের তরকারির বন্দোবস্ত করা হয়েছে ঝরঝরে সাদা ভাতের সাথে। ইত্যবসরে রয়েছে বড়ো ইলিশ মাছের ভাঁজা। অরুর ভাঁজা ইলিশ পছন্দের। তন্ময় সেটিই আগে তুলে দিলো ওর পাতে। এই দৃশ্যে ঐশী, এলিজা মূক। দুজনই শুনেছে, তবে শোনা এবং দেখার মধ্যে আসমান সমান পৃথকতা। এলিজা তো বলেই বসল,
‘আমাদের তন্ময় হাজবেন্ড ম্যাটারিয়াল। অরু ভাগ্যবতী!’
শুহানি নিজের একাগ্রতা প্রকাশে গর্দান দোলাল।
ঐশী আমোদেই শুধাল,

‘আমরা ঠিক বলছি তো, অরু?’
অরুর উদ্ধত প্রত্যুত্তর শুনতে তন্ময়ও আনমনেই মুখিয়ে। উর্ধ্বভাগে দেখানো, পরোয়ানাবিহীন খেতে থাকা তার কান দুটো উদগ্রীব। অরুর জবাবটি বেশ সময় নিয়ে এলো। মুখচোরা ভাব কণ্ঠে,
‘হুঁ। আমিও তাই মানি।’

অতি সাধারণ প্রত্যুত্তরটি– তন্ময়ের হৃদয়ে উত্তাল সমুদ্রঝড় সৃষ্টি করল। ভালো লাগায় দুলে ওঠল। ঠোঁটের কোণেতে ভিড় জমাল সূক্ষ্ণ হাসির রেখা। খাওয়ার পরের সময়টুকুতে বন্ধুদের মধ্যে আলাপ চলল জম্পেশ। তন্ময় প্রয়োজনে দু’চার বাক্য বলছে। ভোজন শেষ হয়েছে একে-একে সবার। শুহানি পূর্বেই ছুটেছে ঘুমুতে। চোখে শর্ষেফুল দেখছে সে। রিয়ানও আর রইল না। এলিজা, ঐশী একসাথে ঘুমোবে। নিজেদের রুমে চলে গিয়েছে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে রুস্তম, মাহিন এবং ইব্রাহিম। তিনজনের মুখাবয়ব সুবিধার নয়। অরু তন্ময়ের পাশেই দাঁড়িয়ে। চারজনের চাওয়াচাওয়ি অবলোকন করছে অবুঝ দৃষ্টিতে। রুস্তম চোখ টিপে দুষ্টু হাসল। তন্ময় তা দেখেও যেন দেখল না। নির্বিকার। তন্ময়ের কানের কাছটায় বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলে চলে যাচ্ছে মাহিন। তার পেছন-পেছন বাকি দুটোও চলে গেল। অরু শুধাল,
‘ভাইয়া, কী বললেন?’
প্রশ্নটি সন্তর্পণে এড়িয়ে গেল তন্ময়। অরুর হাতটি মুঠোভরতি নিজেদের ঘরের দিক হাঁটা ধরল।

বারান্দার দরজা খোলা। সিলিং ফ্যান ছাড়া। পাখাদুটো ঘুরছে অনবরত। কাঠের জানালা খানা মেলে আছে। মৃদু হাওয়া ভেসে ভেতরে প্রবেশ করছে। শীতল করে তুলেছে রুম। আকাশের চাঁদটি কালো মেঘেতে ডুবেছে। আবির্ভাব ঘটেছে গুমোট, প্রাকৃতিক পরিমন্ডলের। তন্ময় বিছানায় বসেছিল। কী করবে বুঝে পাচ্ছিল না! নিজেকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখতে ল্যাপটপ বের করেছে। ব্যস্ততা দেখাচ্ছে কাজে। অরু বাবু মিয়াঁর থেকে সরষের তেল এনেছে। কাচের বাটি হাতে তার। এসে দাঁড়িয়েছে তন্ময়ের কাছটায়। তন্ময় আকস্মিক চোখ তুলে চাইল। ওর হাতে তেল দেখে আশ্চর্য হলো। টনক নড়ল। মনে পড়ল তখনকার বিষয়টা। ওর এখনো মনে রেখেছে? অরু বেশ চিন্তিত,
‘ল্যাপটপ নিয়ে বসলেন যে? আজ এসব করার কী দরকার? বলেছিলেন পিঠ, কোমর ব্যথা করছে। মালিশ করে দিই।’

তন্ময় একপল চাইল অরুর মুখপানে। বেশ বাধ্যভাবেই ল্যাপটপ সরিয়ে রাখল। টি-শার্ট একটানে খুলে ফেলল। পেটানো দেহ দৃশ্যমান। মাংসপেশি গুলো ফুলেফেঁপে আছে। পেটের দিকটায় সিক্সপ্যাক। অরুর দু’গাল রক্তিম হচ্ছে। ছন্নছাড়া দৃষ্টি। তন্ময় শুলো পেটে ভর দিয়ে। অরু অন্যপাশ দিয়ে বিছানায় ওঠেছে। দু হাঁটু ভাঁজ করে বসেছে পাশেই। দু’হাতে তেল নিয়ে হাত দুটো রাব করল কিয়ৎক্ষণ। উষ্ণ ভাব আসতেই, হাত দুটো ছোঁয়াল তন্ময়ের শিরদাঁড়ায়। স্পর্শে যেন ইলেক্ট্রিক্যাল পাওয়ার স্থাপিত করা। ছুঁতেই তন্ময় বড়ো করে শ্বাস নিলো। তার এখন আর মালিশ নিতে ইচ্ছে করছে না। বরংচ মালিশ দিতে ইচ্ছে করছে। তন্ময় কপাল চাপড়ে ধরল। তখনো অরু ধীর গতিতে মালিশ করছে সর্বপিঠ। বাহিরে থেকে ধ্বনি ভেসে আসছে।

কর্ণগোচর হচ্ছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ধ্বনির। অরু বেশ শক্তি প্রয়োগ করছে। হাতের তালু দুটো টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে। ব্যথাও হচ্ছে কবজিতে। তবে থামল না। এবারে ঝুঁকে কাঁধের দিকটায়ও মালিশ করছিল। কাঁধটা শক্ত। বেশ কসরত করতে হচ্ছিল। কোমল হাত দুটো অনবরত মালিশে ব্যস্ত। অরু ধ্যানমগ্নতায় আবদ্ধ। আকস্মিক তার চোখের সামনিটায় আকাশপাতাল নড়ে ওঠল যেন। বুঝে ওঠবার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করল তন্ময়ের বুকের নিচে। অপ্রত্যাশিত ভাবে– শোয়া। তন্ময় ঠিক তার ওপরে। উদোম দেহে। গভীর চোখে চেয়ে। তার হাত অরুর মাথার কাছটায়। মুখটা অতি কাছে। নাকে নাক স্পর্শ করছে। অরুর বড়ো বড়ো চোখদুটো শক্তভাবে বুজে গিয়েছে। তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁটজোড়া।

তৈলাক্ত হাত দুটোয় আপন হাত ডুবাল তন্ময়। দুর্বোধ্য হাসল। হাত দুটোকে তেলে মাখিয়ে অরুর পাতলা নরম তুলতুলে কোমল ছুঁয়ে দিলো মালিশ করার তাগিদে। অরু চমকে চোখ মেলে চাইল। মুহূর্তেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবিষ্ট হলো। তন্ময় ততক্ষণাৎ মুখ নামিয়ে অরুর কোমল, গোলাপি ঠোঁটে মিশে গেল। যেন এটিই একমাত্র রাস্তা পালানোর। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। তীব্র ধ্বনি চতুর্দিক হতে শ্রবণ হচ্ছে। ভেসে বেড়াচ্ছে বৃষ্টির জল। বারান্দা, জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। ভিজেয়েছে ফ্লোর। এযাত্রায় তন্ময় আপন সত্ত্বাকে থামাল। টেনেহিঁচড়ে চেতনা ফেরাল যেন। অরুর ঠোঁটজোড়া ছাড়ল। নিগূঢ়ভাবে অবলোকন করল সুশ্রী মুখ খানা। পাশেই শুয়ে —অরুর কম্পিত দেহ দু’হাতে আগলে নিলো বক্ষপিঞ্জরে। চুলের উর্ধ্বভাগে চুমু বসিয়ে, মাথা বুলিয়ে আওড়াল,

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫৫+৫৬

‘ঘুমা…’
অরু শান্ত হয়েছে। হৃদয়ে উথাল গতিবেগ কমে এসেছে। কম্পমান হাত দুটো তন্ময়ের কোমর জড়িয়ে নিয়েছে। কান উঁচু করে বৃষ্টির ধ্বনি শুনে বলে,
‘বৃষ্টি হচ্ছে।’
‘হুঁ।’

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫৯+৬০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here