প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব ৪৫+৪৬
Nabila Ishq
তন্ময়ের বন্ধুবান্ধব ধানমন্ডির আশেপাশেই আছে। আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। সবাই কাজ থেকে মুক্ত। সেই সুবাদে সকলে মিলে এক রেস্তোরাঁয় আড্ডা জমিয়েছে। আড্ডার মূল বিষয় হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জ কীভাবে যাবে, কই যাবে, কী খাবে, কীসব করবে, তার একটি তালিকা তৈরি করছে। তন্ময়কে এখানেই আসতে বললো মাহিন। ছেলেটার মন তল্লাশি করবে আজ সে। মুখোমুখি জিজ্ঞেস করবে নারায়ণগঞ্জ যেতে চায় নাকি! কোনোমতে যদি চোখমুখ পড়ে বুঝতে পারে যে তন্ময় যেতে চায়! তাহলে সে আসমান জমিন এক করে ফেলবে তবুও তন্ময়ের প্রেয়সী সহ তন্ময়কে নিয়েই ছাড়বে এই ট্রিপে। রিহান নাকমুখ কুঁচকে মাহিনের ভাবনায় বিভোর মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করছে। দু আঙুলের সাহায্যে চুটকি বাজালো চোখের সামনে। ভরাট কন্ঠে ডাকল, ‘এইযে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছোটো মাহিন মজুমদার দাদু! তন্ময় চাচা কী আসছে?’
মাহিন হতাশ গলায় বলল, ‘বিশিষ্ট ডিজাইনার সর্বোচ্চ ছোট্ট রিহান শিকদার কাকাকে জানাচ্ছি, তন্ময় প্রায় চলে এসেছে। সঙ্গে তার প্রানপ্রিয় প্রেয়সী ও আছে। তাই মুখে দয়া করিয়া লাগাম মারিবেন।’
‘লাগাম ছাড়া কখন হলাম,আশ্চর্য! আমার মতো ভদ্র মুখের অধিকারী দ্বিতীয় কেউ নেই। এইযে তুই ‘স্টেমিনা একদম নেই’ রোগে ভুগিস কই আমিতো বলতে যাইনা!’
সৈয়দ মাহিনের পাশে। সে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাথা দোলাল। মাহিন তাকে ইশারা করে বলল, ‘ও কী আমার বিছানায় এসেছিল? মানে ড্রাংক অবস্থায় মেয়েমানুষ মনে করে ওর সাথেই কিছু করেছিলাম নাকি! নাহলে জানল কীভাবে আমার স্টেমিনা নেই! ভাবার বিষয়।’
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
শুহানি উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে সে রিহানের বাহুতে পড়ে গেল৷ চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। থেমে নেই বাকিরাও। রিহান বিরক্ত হলো। নাকমুখ কুঁচকে ফেলল, ‘ইয়াক! শালা তুই ডাক্তার দেখা।’
ঠিকানা অনুযায়ী রেস্তোরাঁয় মাত্রই পৌঁছেছে গাড়ি।রসমালাই এবং মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার গুলো কিনে তবেই এসেছে। সেগুলো গাড়িতে রেখেই বেরোলো তন্ময়। অরুর ওড়না ফেঁসেছে সিটবেল্টে। খেয়াল করেনি। বেরোতে গিয়ে টান খেল। ফ্যাচ ফ্যাচ শব্দে ছিঁড়ে গেল অনেকখানি। বোকার মতো ছেঁড়া ওড়নায় নজর বোলালো। ইশ, কতখানি ছিঁড়েছে। ভাগ্যিস কোণঠাসা হয়ে ছিঁড়েছে। নাহলে তো বোঝা যেতো। ওড়না ধরে বেরোতে নিয়ে উঁচু জুতোর কারণে বা পা বেঁকিয়ে ফেললো। পড়তে নিয়েও গাড়ির দরজা ধরে নিজেকে সামলাল। পায়ের কোণা ছুলেছে কিছুটাও। তন্ময় সামনেই দাঁড়িয়ে। সে সাবলীল ভঙ্গিতে অগোছালো অরুকে দেখছে। এদিকে অরু কিছুটা বিরক্ত হলো বটে। নাকমুখ কুঁচকে বেরোলো। ওড়না পরিপাটি করলো। তন্ময়ের দু ভুরুর মাঝে ভাঁজ পড়েছে। সে প্রশ্ন করলো, ‘তোর থেকে তোর জুতো বড়ো। দেখি, জুতো খোল। এসব জুতা আর পড়বি না। আমি যেনো না দেখি।’
আতঙ্কে হাসফাস করে উঠলো অরু। মাথা দু’পাশে
দুলিয়ে তন্ময়ের অগোচরে হেঁটে সামনে অগ্রসর হলো। যার জন্য চুরি করে সে বলে চোর। এইযে এতো উঁচু জুতো ত তন্ময়ের জন্য পরে। মানানসই একটা ব্যাপার আছে না। লম্বা তন্ময়ের সামনে উঁচু জুতো না পরলে, একটুখানি দেখায় অরুকে। বলা যায়, দেখাই যায়না। এরজন্যই তো পরে সে।
অরুর বিভ্রান্ত চিন্তাভাবনা তন্ময় বুঝবে কীভাবে! সে অরুর কাঁধ চেপে ধরেছে। দুজন একসাথে এগোচ্ছে।
ভেতরে প্রবেশ করতেই সম্মুখীন হলো সকলের। হৈচৈ পড়ে গেল মুহুর্তেই। এটাসেটা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে তৎক্ষণাৎ। রিহান কথায় হেরে গিয়েছিল খানিক তবে সে পুনরায় শুরু হলো।এবার আর মাহিনের পিছু লাগেনি। তন্ময় আর সৈয়দের পিছু লেগেছে। হাস্যজ্বল পরিস্থিতি। অরুকে শুহানি এবং আশা’র মধ্যে বসিয়েছে তন্ময়। তারপর সে বসেছে মাহিনের পাশে। সাথে ইব্রাহিম আছে। রিহান ও পাশাপাশি। তাদের মধ্যে আলাদা আলোচনা। মাহিন কফিতে চুমুক বসিয়ে খুব স্বাভাবিক স্বরে শুধালো, ‘কি সমস্যা? যেতে কেন চাচ্ছিস না!’
তন্ময় নিশ্চুপ রইলো। দৃষ্টি কিছুটা দূরে বসা অরুর পানে। শুহানি কিছু একটা বলছে অরুকে। তাতে লজ্জায় চোখমুখ নুইয়ে রেখেছে অরু। তন্ময় বেশ কিছুক্ষন দেখল। চোখ সেখানে রেখেই বলল, ‘আজকাল আমি আর নিজের উপর কনফিডেন্ট নই।’
‘বিয়েটা তো হয়েছে। এখন কনফিডেন্ট না থাকলেও চলবে!’
‘তন্ময় চাচার যন্ত্রপাতি তাহলে ঠিকঠাক আছে।’
তন্ময় হাসলো। স্মিথ হাসি তার, ‘বাবা মানবে না। পারিবারিক ভাবে বিয়েটা হলে, তারপর নাহয়… ‘
‘এতকিছু বুঝি না। আমার বন্ধু যেতে চায় এটাই ইম্পর্ট্যান্ট। আর তুই যাবি সাথে তোর লেঞ্জাও।’
রিহান মুখ ভোঁতা করল, ‘তোর বাপের এতো মাথা ব্যথা কেলা?’
‘আমার বাবার কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে পরিবার। খুব যত্নে আগলে রেখেছেন। কোনো কারণে পরিবার ভেঙে যাবে সেটা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। তাই এতসব চিন্তা তার। আমাদের বিয়েটা ভবিষ্যতে হয়তো সমস্যা দাঁড় করাতে পারে, এটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অরু যেহেতু ছোটো তাই বাবার চিন্তা বেশি। তার মনে হয় আমাদের মতামত মিলবে না। বা বিয়েটা টিকবে না৷ আর যদি তেমন হয় পরিবার ভেঙে যাবে।’
মাহিন বিরক্ত হলো, ‘তোর বাপের এসব চিন্তাভাবনা নদীতে ডুবে আছে। অযথা চিন্তা যত্তসব। সে কী জানে না তুই কে? তুই তো ভেজা বিড়াল। মাছ সামনে রেখে ছুঁয়েও দেখোস না, লাগলে কাতরে মরে পড়ে থাকবি। কতটা ভালোবাসোছ তা তো আমরা জানি। নিজের চোখে দেখছি। এইসব সমস্যা কোনোকালেই হবে না, আমার কথা মিলিয়ে রাখ। আর অরু এখন যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক। এমনতো নয় ও তোকে পছন্দ করেনা৷ খুব পছন্দ করে। এইযে আমি খেয়াল করলাম মিনিটে শতবার তাকিয়েছে। তোকেই তো দেখছে ঘুরেফিরে।’
গম্ভীরমুখের তন্ময় শব্দ করে হাসলো। নিরব হাসি। স্বচ্ছ প্রানবন্ত। মাহিন বলল, ‘দোস্ত আমার কাছে ছুঁতো আছে। তুই শুধু ওয়েট কর। আমরা এবার সবাই মিলেই যাবো।’
রবিবার সন্ধ্যা সাতটা। মোস্তফা সাহেব লিভিং রুমে বসে আছেন। নিউজ দেখছেন সঙ্গে চা খাচ্ছেন। সাথে ওহী সাহেব, আনোয়ার সাহেবও রয়েছেন। এমতাবস্থায় বিনা আমন্ত্রণে হাজির তন্ময়ের বন্ধুবান্ধব। একসাথে ছয়জন। ছেলেমেয়ে মিলিয়ে এসেছে। হাতে নানান সরঞ্জাম। হাত ভর্তি খাবার এনেছে। সেগুলো উঠিয়ে দিয়েছে সামনে দাঁড়ানো জবেদা বেগমের হাতে। সেসময় তন্ময় বাসায় নেই। অফিসে সে। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন মোস্তফা সাহেব। ছেলের বন্ধুদের সে ভালোভাবেই চেনে। প্রায়শই কাজে অকাজে দেখা হয়েছে সকলের সাথেই। হঠাৎ তাদের আগমনে ভড়কে গেলেন কিছুটা। বসতে বললেন। মাহিন হাস্যজ্বল গলায় সালাম জানিয়েছে। চামড়া পাতলা রিহান ততক্ষণে ওহী এবং আনোয়ার সাহেবের মধ্যে চেপে বসেছে। গপ্পোবাজ সে এটাসেটা বলে আলোচনা শুরু করেছে। শান্ত বাড়িটি অশান্ত হয়ে উঠল মুহুর্তেই। চেঁচামেচির শব্দে বেরিয়ে এসেছে দীপ্ত, রুবি, শাবিহা এবং অরু। জবেদা বেগম অরু এবং রুবিকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে৷ ঝটপট খানাপিনা তৈরি করতে হবে। এভাবে শুকনো খাবার অলরেডি ট্রে করে নিয়ে এসেছেন।
সবাই আলোচনা করে এসেছে। আজ মুলত ট্রিপের কথা মাহিন বলবে। লজিক কথাবার্তায় সে এক্সপার্ট। বাকিগুলো ধাপ্পাবাজ একেকটা। তাই সময় পেয়েই মাহিন বলল, ‘চাচা পারমিশন নিতে এসেছি আপনার।’
মোস্তফা সাহেব হাসলেন, ‘কীসের জন্য? তোমাদের আবার পারমিশন লাগবে কীসে!’
‘নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছি। বন্ধুবান্ধব সকলে মিলে।’
‘তা তো বেশ। সাহায্য লাগলে বলো নির্দ্ধিধায়।’
‘চাচা সবকিছু স্যাট। আগামী বৃহস্পতিবার রাতে বেরোবো। লঞ্চ করে যাবো। লঞ্চ রিহানের বাবা দিচ্ছে। আর নারায়ণগঞ্জ আমার নানাবাড়ি। তো খানাপিনা, থাকা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। তিনদিনের ট্রিপ। আমরা চাচ্ছিলাম আপনারা সকলে যদি সামিল হোন, খুশি হব।’
মোস্তফা সাহেব উৎসুকভাবে হাসলেন, ‘বাচ্চাদের ট্রিপ। সেখানে আমরা মুরব্বি যেয়ে কী করবো! না বাবা! সম্ভব নয়। এভাবেও কাজের চাপ আছে।’
‘তাহলে বাচ্চাদের পাঠিয়ে দিন। মিলেমিশে যাই। আপনজন থাকলে ট্রিপ মজার হবে।’
‘পাঠানোর কী আছে? তন্ময় যেতে চাইলে যাবে!’
‘তন্ময় তো যাবেই। সাথে শাবিহা, রুবি আর অরু যদি যায়… ‘
মোস্তফা সাহেব থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। কিছু বলবেন পূর্বেই মাহিন পুনরায় বলল, ‘আর শাবিহার জন্য এই ট্রিপ খুব ভালো হবে। মনমেজাজ সতেজ হবে। ডিপ্রেশন কেটে যাবে অনেকাংশে। এসময় ঘুরাফেরা খুব কাজে দেয়।’
আনোয়ার সাহেব সহমত হলেন। ওহী সাহেব ও ভাবুক ভাবে মোস্তফা সাহেবের দিক তাকাল। মোস্তফা সাহেবেরও মাহিনের কথাগুলো ভালো লাগলো। শাবিহার জন্য ঘুরাফেরা এখন খুব দরকার। মাইন্ড ফ্রেশ হবে। হয়তো অয়নকে ভুলেও যাবে। মায়া কাটবে। কিন্তু অরু….মোস্তফা সাহেব দোটানায় পড়লেন। ওহী সাহেব বলল, ‘রুবির সামনে পরিক্ষা। ও তো যেতে পারবেনা। তবে তন্ময় তো যাচ্ছেই। শাবিহাকে দেখে রাখতে সঙ্গে অরুও যাক। তিনজন মিলে ঘুরেফিরে আসবে।’
খুব সাবধানে সিচুয়েশন হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল মাহিন। রিহান ও এদিকে সুরক্ষার বানি শোনাতে ব্যস্ত। মেয়েগুলো দিব্বি ভাব জমিয়েছে জবেদা বেগম, মুফতি বেগম এবং সুমিতা বেগমের সাথে। শাবিহাও ফাঁকে দু’এক কথা বলছে।
অবশেষে মোস্তফা সাহেব রাজি হলেন। বললেন, ‘যেতে চাইলে যাক। ঘুরে আসুক।’
ব্যস। অরু রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে উঠলো। জড়িয়ে ধরলো শাবিহাকে। জাপ্টে ধরে নিঃশব্দে চেঁচাচ্ছে। লাফালাফি থামাতে শাবিহা দু’হাতে অরুকে ধরে রেখেছে। মেয়েটা ব্যথা না পেয়ে বসে৷
অরুর কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে স্বর বেড়ে চলেছে। একসময় উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো। তার কান্নার শব্দে উতলা হয়ে সবাই বেরিয়ে এসেছেন। আনোয়ার সাহেব ছুটেছেন জুতো ছাড়া। অরু তখন ফ্লোরে বসে সমানে কাঁদছে। চোখ ফুলে কলাগাছ। তার সামনে তন্ময় দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে। হাতে কে’চি। পায়ের সামনে নানাজাতের উঁচু জুতোর সমাহার। সবগুলো জুতো আপাতত ছেঁড়া। এগুলো কেঁটে ফেলেছে তন্ময়। ফ্যাচ ফ্যাচ শব্দে সবগুলো কেঁটেছে। সেই জুতো জাপ্টে ধরেই কাঁদছে অরু। মোস্তফা সাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘কি হয়েছে?’
আনোয়ার সাহেব ও চিন্তিত সুরে শুধালেন, ‘হয়েছে কী?’
অরু রেগেমেগে উঠে দাঁড়ালো। অস্থির গলায় বিচার দিল, ‘আমার সব জুতো কেঁটে ফেলেছে। আমার জুতা…’
অরুর এমন করুণ কান্নায় মোস্তফা সাহেব রেগে গেলেন। চোখ রাঙিয়ে তাকালেন ছেলের পানে। এদিকে আনোয়ার সাহেব হাসলেন। মেয়েকে নিজের সাথে রেখে বললেন, ‘আরও সুন্দর জুতো কিনে দিব মা। থাক কাঁদে না।’
বাবার এমন কথায় অরুর কান্না দ্বিগুণ হলো। আশ্চর্য! কিনে দিবে মানে! এই লোককে কিছু বলছে না কেন! অরুর মনের আশা পূরন করলো মোস্তফা সাহেব। ধমকে উঠলেন ছেলেকে, ‘কেন করলে এমন!’
তন্ময় তখনো গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে অরুর দিক তাকিয়ে। এদিকে রুবি সহমত পোষণ করল, ‘চাচ্চু তন্ময় ভাইয়া ঠিক করেছে। এই মেয়ে এক আনা, জুতো পরে দু আনার। পায়ে ফোসকা পড়ে আছে কতশত। দেখ, ওর পায়ের অবস্থা! আমি কতবার করে বললাম এমন প্যান্সিল হিল পরিস না। এগুলো অনেক উঁচু। না কথাই শোনে না।’
সুমিতা বেগম বিরক্ত ভঙ্গিতে চলে যাবার জন্য পা বাড়ালেন। যাবার আগে রাগান্বিত কন্ঠে বলে গেলেন, ‘একদম ঠিক হয়েছে।মেয়েটা কোনো কথাই শোনে না।’
জবেদা বেগমের ছেলের কাজ পছন্দ হলো না। তিনি অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, ‘এরজন্য এমন করবে। মেয়েটা কতো কষ্ট পেলো। বুঝিয়ে বললেও ত হতো।’
মোস্তফা সাহেবও বিরক্ত, ‘তুমি কীসের বুঝদার হলে বলো ত! ছেলেমানুষী করে বিদায় তো এমন। বুঝলে কী আর এগুলো পড়বে!’
তন্ময় জবাব দিলো না। কেঁ’চি ফেলে চলে গেল। অরু বিছানার এক কোণে বসে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। তার কতগুলো টাকার জুতো। সবগুলো এভাবে নষ্ট করে দিল। ইশ, দানব’টা মলম পট্টি করে যে এমন করবে কে জানত! এইযে কিছুক্ষণ আগেই নিজ হাতে পায়ের গোড়ালি’তে মলম লাগিয়ে পট্টি করে দিল। অরু তখন ভালোবাসার সমুদ্রে ভাসছিল। সেখান থেকে টেনে হিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দিতে মানুষটার বুক কাঁপলো না। একটুও না।
জুতার বিষয় নিয়ে অরুর মন খারাপ রয়েই গেল। রাতের খাবার খেতে বসেও মনমরা হয়ে থাকল। মোস্তফা সাহেব বোঝালেন। জুতা নতুন অনেকগুলো কিনে দিবেন বললেন। তবুও কাজ হলো না। একসময় আলোচনা উঠলো ট্রিপের বিষয়টি নিয়ে। তন্ময় মাথা তুলে তাকালো। এই বিষয়ে সে একদম অজানা। তাকে না জানিয়েই এসেছে বান্দরগুলো তাহলে। তার বাবাকে মানিয়েও ফেলেছে। কীসব বলেছে কে জানে!
অরুর অভিমান রয়েই গেল। পরদিনও সে চুপচাপ বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করছে। তন্ময়ের কাছে ভুলবসতও ভিড়ছে না। তন্ময় কতবার ডেকেছে হিসেব নেই। শুনেও না শোনার ভাণ করে থাকলো। অরু এই লোকের সাথে কথাই বলবে না।
তন্ময় স্বভাবসুলভ গম্ভীর তবে ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। বলাবাহুল্য, এধরণের মানুষ খু’ন করেও শান্তশিষ্ট পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারদর্শী। তন্ময়ের স্বভাব অনেকটা একই। সে সচরাচর অশান্ত অথবা রেগে উঠে না। তার রাগান্বিত চেহারা দেখা দুঃসাধ্যের বাইরে। কিন্তু অরুর কারণে বেশ কয়েকবার তাকে রেগেমেগে অস্থির হতে হয়েছে। এর অবশ্যই যুক্তিযুক্ত করণ রয়েছে। তখন তন্ময় সতেরো বছরের যুবক। কিছুটা স্বাস্থ্যসম্মত এবং তরতাজায় ভরপুর। চেহারায় তেজ কন্ঠে গম্ভীরতা আনার প্রচেষ্টা! অরুর বয়স সবে সাত। হাঁটু সমান ফ্রোক পরে পায়ে নুপুর দিয়ে সম্পুর্ন বাড়ি দিব্বি নেচে-কুঁদে ঘুরেফিরে। এদিকসেদিক সবখানে তাকালেই শুধু সে। অরু যেন শাহজাহান বাড়ির একমাত্র সন্তান। তন্ময় স্কুল থেকে ফিরেছে মাত্রই। নিঃশব্দে কাঁধের ব্যাগ হাতে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চেঁচিয়ে উঠল। গলা ফাটানো চিৎকার। অস্থিরতা কন্ঠে স্পষ্ট।
কম্পিত হাত ফসকে ব্যাগ কখন যেন পড়ে গেল ফ্লোরে। পা জোড়াও থমকে গিয়েছে। সম্পুর্ন সেই যেমন পাথরে রুপান্তরিত হয়েছে। তার চোখের সামনে ফ্লোরে অরু র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় পড়ে। সাদা ফ্রোক লাল র’ক্তে মেখে। সম্পুর্ন শরীর র’ক্তে রাঙিয়ে। ফ্লোরে লম্বা লাল রক্তের লাইন এগোচ্ছে। থেমেছে তন্ময়ের থমকে থাকা পায়ের নিচে। এটা মোটেই কোনো সাধারণ দৃশ্য নয় মেনে নেবার মতো। অপরদিকে তন্ময়ের যুবক গম্ভীর স্বরের চেঁচানো শুনে, র’ক্তা’ক্ত অরু হুট করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। টানটান দাঁড়ানোর ভঙ্গি। চোখজোড়া বড়বড় বোয়াল মাছের ন্যায় হয়ে গেল মুহুর্তে। হাত থেকে পড়ে গেল লাল আলতার ডিব্বা।
ভীতিকর অবস্থা তার ছোট্ট চেহারার। মুলত সে ‘যেমন ইচ্ছে তেমন সাজো’ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য এক্টিং করছিল। এরজন্য সুমিতা বেগম ধমকে দিয়েছেন কয়েকবার। কিন্তু কে শুনে কার কথা! কোনো কথাই কানে নেয়নি। সে নিজের মতো পড়ে ছিলো ফ্লোরে। এসময় তন্ময় আসবে জানলে অরু কক্ষনো এমনটা করতো না। সেমুহুর্তে জবেদা বেগম ছুটে এসেছেন হন্তদন্ত ভঙ্গিতে। দেখলেন ছেলের এমন করুণ অবস্থা। আঁতকে উঠলেন। তন্ময় ঘেমেনেয়ে একাকার। কপালে বিন্দুবিন্দু ঘামের চিহ্ন। লম্বা নাক ঘামে চকচক করছে। পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে সে। চোখের পলক অবদি পড়ছে না। জবেদা বেগম ছেলের দিক ছুটলেন,’আব্বা অরু প্রেকটিস করতেছে। তুমি ভয় পাইছ!’
তন্ময় তখনো ধ্যান জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে যেন। চোখ ঘুরিয়ে তার মায়ের দিক তাকাল। তারপর অরুর দিক। ধীরে ধীরে চোখের সাদা অংশটুকু লাল শিরায় ছেয়ে গেল। অত্যন্ত রাগে রীতিমতো থরথর করে কাঁপছে। অরু আলগোছে পেছন দিকে পা ফেলে পিছিয়ে চলেছে। একসময় দৌড় লাগালো। আশেপাশে নজর দেবার সময় নেই। তার নেয়া একেকটা পায়ের ছাঁপ সাদা ফ্লোরে স্পষ্ট। তন্ময় সেই পায়ের ছাঁপ ফলো করে তেড়েমেরে এগোচ্ছে। জবেদা বেগম থামাতে চাইলেন কিন্তু সুমিতা বেগম দিলেন না। মেয়েটা এক নাম্বার বাদর। বাপ’চাচা কেউই কিছু বলেনা বলে, মাথায় চড়ে বসেছে। শিক্ষা পাক একটা। অন্যদিকে অরু লুকিয়েছে গুদামঘরে। অন্ধকার রুমে গুটিশুটি মেরে বসে। তন্ময় দরজা লাথি মেরে খুলে অরুকে ভাবার সময় দেয়নি। নরম তুলতুলে গালে শক্ত দুটো চড় মেরে বসেছে। টেনে ওয়াশরুম পাঠিয়েছে। সেই কী কান্না অরুর! সারারাত দিন কেঁদে কাটিয়েছে। তন্ময়ও স্বেচ্ছায় মন ভোলাতে যায়নি। বাধ্য হয়ে তিনদিন পর অবাধ্য অরুকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। পছন্দের জিনিস কিনে দিয়েছে। তবেই শান্ত হয়েছে মেয়েটা।
সেই অবাধ্য মেয়ে অরু এখন বড়ো হয়েছে। শুধু নামে তার বড়ো হওয়া। পরিবার কিংবা ভালোবাসার মানুষের সামনে সে, সেই ছোট্ট অরু রয়ে গেল। রাতে ভালোভাবে খেলো না। সকালেও খেতে আসেনি। জবেদা বেগম ডেকে গেলেন দুবার। অরু দরজা খোলেনি। সুমিতা বেগম চেঁচিয়েছেন, কাজ হলোনা। ডাইনিংয়ে কমবেশি সবাই চলে এসেছে। কিছুক্ষণের মাঝে তন্ময় এলো৷ অফিস যাবে। হাতে ব্যাগ। পরিপাটি সে টেবিলে নজর বোলালো। অরু নেই! শান্ত চেহারার ভুরু দু’য়ের মাঝে সূক্ষ্ম ভাজ পড়লো মুহুর্তে। ব্যাগ চেয়ারে রেখে জবেদা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল, ‘অরু কই?’
জবেদা বেগম হতাশ গলায় বললেন, ‘শুধু শুধু এমন করলি। মেয়েটার পেটে কিছুই পড়েনি কাল রাত থেকে।’
তন্ময়ের গম্ভীর স্বর এবার আরও গম্ভীরে পরিনত হলো, ‘ওকে আমি নারায়ণগঞ্জ নিব না। এমন অবাধ্য মেয়ে সাথে নেবার প্রশ্নই আসেনা।’
তন্ময়ের বলতে দেরি, পরপর দরজা খোলার শব্দ শুনতে দেরি হয়নি৷ অরু নাকমুখ কুঁচকে বেরিয়েছে। সকলের চোখের সামনে ডাইনিংয়ে এসে চেয়ার পেতে বসেছে। চুপচাপ মাথা নত করে খেতে লাগলো। এতক্ষণ যাবত মোস্তফা সাহেব গম্ভীরমুখে ছিলেন। আপাতত ঠোঁটে স্মিথ অদেখা হাসি ফুটে উঠতে চাইছে। তিনি ঠোঁট টেনে নিজেকে যথাসম্ভব ঠিকঠাক রেখেছেন। তবে আনোয়ার সাহেবের ঠোঁট জুড়ে অমায়িক হাসি বিচরণ করছে। সকলের এমন হাসার কারণ পেলো না অরু। বিরক্ত সে খানিক লজ্জায় পড়লো। আরে সে তো খেতে আসতে চায়নি। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ যেতে চায় বিদায় আসা। খেতে না চাওয়ার ছোট্ট বিষয় ধরে তন্ময় যদি সঙ্গে না নেয়, অরু তো এবার কষ্টে মরেই যাবে। এভাবেই জুতো হারাবার দুঃখে তার বক্ষে রয়েছে একরাশ বিষন্নতা। বিষন্নতা জমে পাহাড় বনে গিয়েছে। বিরক্তিকর অনুভূতি তার সর্বাঙ্গে বহমান। তন্ময়ের উপর অভিমান তার মনের আসমান ছুঁয়ে গেল। এতবড় অভিমান কী তন্ময় আদোও ভাঙতে পারবে? অরু যতই রাগ দেখিয়ে থাকুক। সে আশায় ছিল তন্ময় রাগ ভাঙাতে আসবে। কিন্তু আসলো না! শুধু ধমকের সুরে কয়েকবার ডেকেছে! ব্যস, হয়ে গেল?
অরু মিনমিন সুরে বলল, ‘আমাকে না নিলে আমি আর কখনোই কোথাও যাবো না আপনার সাথে।’
বুধবার রাত। ঘড়ির কাঁটা আটটা পঁয়তাল্লিশে। আজ ঠান্ডা আবহাওয়া। বাতাস ছেড়েছে। দখিনা বাতাস। কালো নিথর আকাশে গোলাকার চাঁদ। জ্বলজ্বল করছে। অরু বই হাতে বসে ছিল বারান্দায়। এমতাবস্থায় দীপ্তর চেঁচামেচির শব্দ। ‘অরু আপু’ বলে চিৎকার করে ছেলেটা যেমন এদিকটায় আসছে। অরু বই বন্ধ করলো। উঠে দাঁড়ালো। দীপ্ত দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তপ্ত ঘন নিশ্বাস ফেলছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার। স্বাস্থ্যসম্মত ছেলেটা এমন দৌড়ঝাঁপ করলে, অবস্থা এমন তো হবেই। অরুর কারণ জিজ্ঞেস করতে হলো না। দীপ্ত হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘তন্ময় ভাইয়া ডাকে।’
অরু ‘কি হয়েছে’ বলে দ্রুত পায়ে বেরোলো। একেকটা পায়ের ধাপ দ্রুততম গতিতে নেওয়া। ছুটে লিভিং রুমে এসেছে। তন্ময় দাঁড়িয়ে। সাথে বাড়ির বাকি সদস্যও। ফ্লোরে এক গাঁদা শপিং ব্যাগ রাখা।
রুবি ব্যাগে উঁকি মেরে দেখছে। সব জুতো। ফ্লাট জুতো, স্নিকার্স আর সামান্য উঁচু জুতো। শাবিহা হেসে নিজের জুতোর ব্যাগ নিয়ে চলে গিয়েছে। রুবি নিজের ব্যাগ থেকে জুতো বের করে পড়ে নিয়েছে।খটখট শব্দ তুলে রুমের দিক চলল। তন্ময় শপিং করলে কখনো একজনের জন্য। সবার জন্যই কমবেশ করে। জবেদা বেগম, সুমিতা বেগম এবং মুফতি বেগমের জন্যও জুতো আনএআনা হয়েছে। মুফতি বেগম মুখ ফুটে বললেন, ‘কি দরকার ছিলো। অরুর জন্যই আনতি শুধু।’
অরু ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে। সে মোটেও জুতো চায়না। তন্ময় এসে নরম সুরে কিছু কথা বললেই হতো। অরুর অভিমানের সমাপ্তি ঘটতো নিমিষেই। সে তো নরম তন্ময়ের জন্য খুব দুর্বল। একটু গলা নামিয়ে কথা বললেই, অরু আসমানে ভাসে।
দীপ্ত অরুর শপিং ব্যাগ গুলো অরুর রুমে নিচ্ছে। ওর হাতে পি’স্তল। এটা তন্ময় এনে দিয়েছে। দেখতে সম্পুর্ন রিয়াল। তবে গু’লি করলে পানি বেরোয়। এবং অনেক দূর পর্যন্ত স্যাট করা যায়। দীপ্ত খুব খুশী। খুশিতে সে বাকরুদ্ধ। তাই অনায়াসে অরুকে সাহায্য করছে।
অরু একটু অসন্তুষ্ট তবুও মুখ ঘুরিয়ে যেতে পারছেনা। তার তন্ময় ভাই এতকিছু এনেছে তারজন্য , আর সে চলে যাবে? উঁহু পারবে না। এতটাও কঠিন হৃদয়ের নয় অরু। তার মন নরম তুলতুলে। তাই চুপসে দাঁড়িয়ে রইলো। আশেপাশে কেউ নেই। তাদের দুজনের অস্তিত্ব শুধু। অরু স্পষ্ট তন্ময়ের পারফিউমের ঘ্রাণ নিতে পারছে। তীব্রভাবে নাকে ভাসছে। কি সুন্দর সুভাষ! তন্ময় দু’এক কদম ফেলে এগিয়ে আসলো। দুজনের মধ্যে খানিক দুরত্ব রেখে, খুব ধীর গলায় শুধালো, ‘অভিমান কমেনি? আর কী করতে হবে?’
সোজাসাপটা প্রশ্নের সম্মুখীনে, অরুর ব্যকুল হৃদয় মুহুর্তে শান্ত হয়ে গেল। প্রশান্তিতে চোখ বুজে এলো। ভালোলাগায় মন জুড়িয়ে গেল। ব্যস, এতটুকুই তো সে চেয়েছে। এমন সময় জবেদা বেগম রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘তন্ময় কফি খাবি? করবো?’
তন্ময় সমানতালে জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ।’
নত করে রাখা অরু গালে স্পর্শ অনুভব করলো। গরম হাতের স্পর্শ। গাল টেনে মাথা উঁচু করতে বাধ্য করেছে তন্ময়। অরু বাধ্য মেয়ের মতো তাকাল। তার মুখশ্রী আর অন্ধকার নয়। তন্ময় পুনরায় শুধালো, ‘কী!’
‘কিছু করতে হবেনা।’
‘আর মুখ গোমড়া করে থাকবি?’
‘না তো।’
‘কফিটা দিয়ে যা।’
সোফা থেকে ব্যাগ নিয়ে তন্ময় চলে গেল। অরু বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো। বুকের ভেতরে তোলপাড় চলছিল। বুকে হাত চেপে দৌড় লাগালো। সে তো জুতো দেখেনি।
শাবিহার এই ট্রিপে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। মুলত অরুর মুখের দিক তাকিয়ে যেতে হচ্ছে। অরু খুশিতে বাকবাকম বনে গিয়েছে। শাবিহা সাথে যাবে বিষয়টি নিয়ে সে খুব এক্সাইটেড। একটু পরপর এসে প্রশ্ন করছে,’যাবে তো? সত্যি যাবে তো?’ বাধ্যতামূলক ভাবে শাবিহা যাবে। তবে সে ফিজিক্যালি কিংবা মেন্টালি কোনোদিক দিয়েই ভালো নেই। অদ্ভুত যন্ত্রণায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। এসময় ট্রিপ মানসিক শান্তি দিবে বলে মনে হয়না। খুব অগোছালো ভঙ্গিতে ব্যাগে সরঞ্জাম গুঁছিয়ে নিয়েছে, যেসব কিছু প্রয়োজন। রুমে দীপ্ত আছে। বিছানার উপর বসে বইপুস্তক পড়ছে। ফাঁকেফাঁকে শাবিহাকে দেখে নিচ্ছে। কিছু বলবে বলবে ভেবেও বলছে না। ব্যাপারটা বুঝে শাবিহাই প্রশ্ন করলো, ‘কী বলবি?’
‘একা যাবে। আমাকে নিবে না?’
‘চল তাহলে।’
‘আমাকে যেতে দিবেনা বলেই, এমনটা বলছ তাই না! মা বলেছে এগুলো বড়দের ট্রিপ। ছোটদের যেতে নেই।’
‘তাহলে যাস না।’
দীপ্ত এই নিরামিষ শাবিহার সাথে কথা বলে ত্যক্ত। বইপুস্তক গুঁছিয়ে বেরিয়ে গেল। শাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসলো। হাতে ফোন নিল। আনমনে তাকিয়ে থাকলো ফোনের দিক। অয়নের বেশকিছু ছবি সেভ করা। শাবিহা কয়েকবার ডিলিট করতে যেও পারেনি। হাঁত কাঁপতে থাকে। অয়নের করা শেষ ম্যাসেজ ও চোখের সামনে। বুকের ভেতর কামড়ে উঠছে। সেই কী অদ্ভুত যন্ত্রণা! না শয়ে থাকা যায় আর না স্থির বসে থাকতে দেয়। সেলফোন সরিয়ে বারান্দার দিক পা বাড়ালো। জীবন থেকে যা চলে যাবার, তা নিয়ে না ভাবাই উত্তম। শাবিহা নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে আগের স্মৃতি ভুলে যাবার। অয়নকে ভুলে যাবার!
রাত অরু খুব কষ্টে কাটিয়েছে। উত্তেজনায় ঘুম আসতে চাচ্ছিল না। বহু চেষ্টার ফলে ঘুমোতে পেরেছে। আজ বৃহস্পতিবার। ধবধবে পরিষ্কার আকাশ। অরু সকল সকল উঠে ব্যাগ গোছাতে শুরু করেছে। এটাসেটার জন্য ছুটে চলেছে একেকদিকে। দুপুরের সময় মাহিনকে দেখা গেল। সঙ্গে ইব্রাহিম। লাঞ্চ করে একসাথে বেরোবে তারা। এরজন্য বেশ ভালো রান্না হয়েছে বাড়িতে। গিন্নীরা কমবেশি অনেক পদের আইটেম করেছেন। সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে।
খাওয়াদাওয়া শেষে রওনা হবার সময়। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে চারটায়। অরু তখনো ব্যস্ত ভঙ্গিতে তৈরি হচ্ছে। আজ কামিজ পড়েনি। চুরিদার পরেছে। কপালে ছোট কালো টিপ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। শাবিহা দাঁড়িয়ে। খুব সাধারণ ভাবে। কোনো সাজগোছ নেই। শুধু ড্রেসটাই পড়েছে। অরু এবিষয়ে কিছু বলবে পূর্বেই, শাবিহা তাড়া দিল, ‘ভাইয়া দাঁড়িয়ে। আয়।’
অরু কিছু বলতে পারল না৷ চুপচাপ এগিয়ে গেল। তন্ময় আর মাহিন কথা বলছে। অরুকে দেখেই মাহিন হাসলো। পরিষ্কার, সুন্দর মিষ্টি হাসি। তন্ময়ের কাঁধ চাপড়ে বলল, ‘জিতছোস মাম্মা!’
অরু লজ্জায় হতভম্ব। দ্রুত পায়ে গাড়িতে উঠে গেল। এভাবে বললে তার লজ্জা লাগেনা বুঝি। মুখের সামনে কেউ বলে এভাবে! শাবিহাও উঠে বসেছে। তন্ময় ড্রাইভিং সিটে বসলো। তার পাশে মাহিন। ইব্রাহিম বাইক নিয়ে এসেছে। সে সদরঘাট পর্যন্ত বাইক চড়েই যাবে৷ গাড়ি স্টার্ট হয়েছে। গাড়ির আগে ইব্রাহিমের বাইক সামনে চলে গেল। পরপর হাওয়া! অরু নিজের পাশের জানাল খুলে দিয়েছে। হুড়মুড়িয়ে বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে। এক আলাদাই প্রশান্তি ঘিরে ধরেছে।
আধঘন্টা গিয়ে গাড়ি হুট করে থেমে গেল মাঝপথে৷ তন্ময় শাবিহার উদ্দেশ্যে বলল,’আয়।’
অবুঝের মতো শাবিহা বেরোলো। কোনো সিরিয়াস কিছু হলো নাকি! তাদের গাড়ির সামনে আরেকটি গাড়ি রয়েছে। সাদা রঙের। শাবিহা লক্ষ্য করেনি। তন্ময় বলল, ‘ঘুরে আয়। ফিরে আসবি হাস্যজ্বল হয়ে। কোনো প্রয়োজন হলে কল দিবি!’
শাবিহা নির্বোধ, ‘হু?’
গাড়ির পেছন দিকে অয়ন দাঁড়িয়ে ছিল। এবার ঘুরে সামনে এলো। চোখে কালো সানগ্লাস। সানগ্লাস খুলে তন্ময়ের সামনে দাঁড়ালো। তন্ময় তার কাঁধে হাত রাখল। শাসানো সুরে বলল, ‘বি কেয়ারফুল।’
‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভাই।’
শাবিহা বোকার মতো তন্ময়কে যেতে দেখল। তন্ময় গাড়িতে উঠতেই তার ধ্যান হলো। চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ভাইয়া! এসব হচ্ছে কী!”
তন্ময় হাতের ইশারায় বোঝাল যেতে। এদিকে অয়ন দ্রুততম ভাবে শাবিহার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তন্ময়কে ছেড়ে তার ধ্যান অয়নের উপর চলে গেল।
প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব ৪৩+৪৪
অনেক পরিবর্তন হয়েছে ছেলেটা। গাল জুড়ে চাপদাড়ি। লম্বায় বেরেছে কিছুটা। পুরুষ বনে গিয়েছে যেমন। শাবিহা তাকিয়েই রইলো। হুট করে ঘুরে দাঁড়ালো। সে একাই চলে যাবে। পা বাড়ালো। অয়ন তৎক্ষণাৎ হাত চেপে ধরেছে। শক্তি প্রয়োগ করে টেনে নিয়ে গাড়ির দিক অগ্রসর হয়েছে। শাবিহা হাত ছাড়ানোর প্রচেষ্টায় মত্ত। সে তো সব ভুলে যেতে চাইছিল। তাহলে কেন পুনরায় সেই অনুভূতি, সেই মানুষ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
