বাদশাহ নামা পর্ব ৩৯+৪০

বাদশাহ নামা পর্ব ৩৯+৪০
আমিনা

ঘুম ভেঙে কিছুক্ষণ আশেপাশের পরিবেশ টা ঠাহর করার চেষ্টা করলো অ্যানা। মীর ওকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। কিন্তু এপাশে তো শার্লট ঘুমিয়ে ছিলো, কোথায় গেলো ও! অ্যানা মীরের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসতে নিলো। কিন্তু মীর ওকে দ্বিগুণ জোরে নিজের সাথে পিষে নিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
— লাফালাফি করো না, ঘুমাতে দাও।
মীরের চাপে মীরের বুকের সাথে লেগে গেলো অ্যনা। মীর জেগে আছে দেখে ও ওভাবে থেকেই কৌতুহলি কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

— তুমি এখানে কি করছো? শার্লট কোথায়? লিন্ডাই বা কোথায়!
নিজের নাম শুনে বিছানার এক কোণায় বসে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এদের রঙ্গলীলা দেখতে থাকা লিন্ডা মিয়াও’ শব্দ করে বোঝালো যে সে এখানেই আছে, এবং এই লাভবার্ড দ্বয়ের উপস্থিতিতে তার ঘুমে অত্যান্ত ব্যাঘাত ঘটছে।
লিন্ডা এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো দেখে মীর ওকে কিছু বলেনি। কিন্তু লিন্ডা ঘুম থেকে উঠে যাওয়ায় মীর অ্যানাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসে লিন্ডার ঘাড়ের কাছের চামড়াটা নিজের ডান হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা ধরে নিয়ে মাঞ্জারের জানালা দিয়ে আলতো করে বাইরে ছুড়ে মারলো। উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে লিন্ডা ক্যাক’ করে ডেকে উঠলো। বিছানায় শুয়ে থাকা অ্যানা তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে উঠে বসে চাপা, তেজি গলায় বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— এটা কি করলে তুমি? ও কি ব্যাথা পায়নি? আর শার্লট কোথায়?
— ওকে ফ্যালকনের সাথে হাওয়া খেতে পাঠিয়ে দিয়েছি।
আবার আয়েস করে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে, জানালা দিয়ে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বাইরে তাকিয়ে থাকা অ্যানাকে দুহাতে হেচকা টান মেরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে নিতে চোখ জোড়া বন্ধ করে নির্বিকার কন্ঠে উত্তর দিলো মীর৷ মীরের কথা শুনে অ্যানার চোখ কপালে উঠলো,
— ফ্যালকনের সাথে মানে? কোথায় পাঠিয়েছো তুমি ওকে? ও কি জেগে আছে? ও জেগে থাকলে কি হবে তুমি ভেবে দেখেছো?
ভ্রু জোড়া কুচকে উদ্বিগ্ন হয়ে এক নাগাড়ে প্রশ্ন গুলো করলো অ্যানা৷ মীর আগের মতো করেই বলে উঠলো,

— হাইপার হইয়ো না ও ঘুমিয়েই আছে, আপাতত ওর ঘুম ভাঙার কোনো চান্স নেই। ফ্যালকন ওকে কোথায় নিয়ে গেছে জানিনা, ভোরেই এসে দিয়ে যাবে। এখন আমাকে একটু ঘুমাতে দাও।
অ্যানা মীরের বুকের নিকট থেকে সরে, ওর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে কিঞ্চিৎ ছাড়িয়ে, বালিশে মাথা রেখে শুয়ে থাকা মীরের মুখ পানে তাকালো কিছুক্ষণ। ওকে তাকাতে অনুভব করে মীর নিজেও চোখ মেললো। দুজনের চোখাচোখি হতেই অ্যানা মীরের মুখ খানা ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুচকে চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,

— তুমি কি অসুস্থ?
— কই, না তো!
সাথে সাথেই মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো মীর। অ্যানা নিজের শুভ্র কোমল হাত জোড়া দিয়ে মীরের কুচকুচে কালো রঙা মুখ খানাকে আগলে নিয়ে মীরের মুগ্ধ, অপলক চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে গভীর দৃষ্টিতে মীর কে পর্যবেক্ষণ করতে করতে নরম গলায় প্রশ্ন করলো,
— কি হয়েছে তোমার? তোমার চোখ জোড়া এমন ফোলাফোলা লাগছে কেন? লালও হয়ে আছে দেখি! তোমার চোখের লেন্স এর স্বর্ণালি আভাটাও কেমন যেন ফ্যাকাসে লাগছে। মুখ খানাও কেমন যেন শুকনো শুকনো লাগছে! কি হয়েছে বলোতো!
অ্যানার প্রশ্নে মীর অপ্রস্তুত হলে যেন। ওর চোখে মুখে ভীতির আভাস দেখা গেলো সামান্য। শুকনো একটা ঢোক গিলে ও বলে উঠলো,

— গত কয়েকদিন ধরে রাতে ঘুম হচ্ছে না। অশান্তি অশান্তি ফিল হচ্ছে সারাক্ষণ। সামান্য একটু ঘুম আসলেও সেটা আধা ঘণ্টার বেশি লাস্ট করছে না। তাই হয়তো এমন লাগছে।
অ্যানা নিজের বৃধাঙ্গুলিদ্বয় মীরের শক্তপোক্ত চোয়ালের ওপর বুলিয়ে দিতে দিতে কোমল কন্ঠে শুধালো,
— কি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছো এত? কোনো অসুবিধা হচ্ছে তোমার?
— আমার দুঃশ্চিন্তা সব তোমাকে নিয়ে।
অ্যানাকে টেনে নিজের একেবারে কাছে নিয়ে এসে বলল মীর। অ্যনার মুখের ওপর মীরের ভারী নিঃশ্বাস পড়তে লাগলে ক্ষণে ক্ষণে৷ অ্যানা মীরের চোখের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কপট অভিমান করে টেনে টেনে বলল,
— ওহ! এখন বুঝি আমি তোমার দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি!
অ্যানার কথার এমন অদ্ভুত সুরে মীর হাসলো শব্দ করে। তারপর হাসি থামিয়ে অ্যানার মুখ খানার দিকে আরও এগিয়ে এসে ওর নাকে নাক লাগিয়ে দিয়ে বলল,
— এরকম মিষ্টি একটা দুঃশ্চিন্তা আছে বলেই এখনো আমি হাসতে পারি। নইলে এতদিনে আমি অনুভূতি শূন্য বন্য পশুতে পরিণত হতাম।

— আরও একটা জিনিস হতে পারতে, ভুরি ভুরি বাচ্চার বাবা। কিন্তু আমার জন্য তো তোমার সেটাও হচ্ছে না৷
মীরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তেজিয়ান কন্ঠে বলল অ্যানা। অ্যানার কথা কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই মীরের মুখ থেকে হাসিটা মিলিয়ে গেলো। মুখ খানা থমথমে হয়ে সেখানে এসে ভর করলো এক রাশ অপরাধবোধ।
মীর কে হঠাৎ এমন চুপ হয়ে যেতে দেখে বালিশে সোজা হয়ে শুয়ে থাকা অ্যানা নিজের বাদিকে তাকিয়ে দেখলো একবার মীর কে৷ মীরের এমন চেহারা দেখে ও অবাক হলো কিছুটা। এর আগে যতবার বাচ্চার কথা উঠেছে ততবারই মীর হেসে উড়িয়ে দিয়েছে, নয়তো ওকে আদর দিয়ে মানিয়েছে৷ কিন্তু আজ কি হলো? মীর এমন চুপ মেরে গেলো কেন? এর পেছনে কি কোনো কারণ লুকিয়ে আছে!

অ্যানার ভাবনার মাঝেই ওকে চমকে দিয়ে মীর হঠাৎ ঝাপিয়ে পড়ে দখল করে নিলো অ্যানার সুডৌল বুক খানা। তারপর বুকের ভাজে মুখ গুজে দিয়ে পরম আয়েসে সেখানে মাথা রেখে জড়ানো গলায় বলে উঠলো,
— আমার ঘুম প্রয়োজন শিনু! অনেক ঘুম প্রয়োজন! এত সব আর আমার মস্তিষ্ক নিতে পারছেনা। তুমি আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও, তোমার ম্যাজিকাল ভয়েস দিয়ে। নইলে ঘুমের অভাবে আমি কখন মারা যাবো!
মীরের মুখে মৃত্যুর কথা শুনে ধড়াস করে উঠলো অ্যানার বুকের ভেতর টা। মীর স্পষ্ট টের পেলো সেটা। অ্যানাকে আরও গভীরভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ও অস্ফুটস্বরে আবারও বলল,

— ঘুম পাড়িয়ে দাও আমাকে শিনু, দ্রুত!
অ্যানা নিজের দুহাত দ্বারা মীরের ঘাড় বাবরি ঝাকড়া চুল গুলোকে এলোমেলো করে দিতে দিতে একটা চুমু খেলো ওর মাথায়, তারপর শুরু করলো ওর সুরের মূর্ছনা। ওর মিষ্টি কণ্ঠনিঃসৃত সেই মোহনীয় সুরে যেন নেশা ধরে গেলো মীরের, চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করলো ওর। বিগত অনেক গুলো নির্ঘুম রাত কে বিদায় জানিয়ে পরম আয়েসে অ্যানার কোমল বুকের ওপর ঘুমের সাগরে ডুব দিলো ও। ক্রমে ভারী হয়ে এলো ওর নিঃশ্বাস।
শিরো মিদোরির প্রতিটি বৃক্ষের পাতায় পাতায় বয়ে গেলো সুক্ষ্ম আলোকরশ্মির খেলা। প্রকৃতি হয়ে এলো স্নিগ্ধ, কোমল। শীতল পরশ ছড়িয়ে গেলো সমস্ত শিরো মিদোরি জুড়ে। ওর মোহনীয় সুরে ঘুম আরও গাঢ় হলো সেইফ জোনের বাসিন্দা দের৷

৫৭. এরপর কেটে গেলো প্রায় বেশকয়েক দিন। সেরাতের পর থেকে প্রায় প্রতিরাতেই মীর ঘুমানোর বাহানা নিয়ে অ্যানার মাঞ্জারে এসে উপস্থিত হয়। অ্যানা এখনো ঠাহর করতে পারেনি সত্যিই মীরের ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে নাকি অন্য কোনো কারণ! তবে ও এটা নিশ্চিত ওর আড়ালে কিছু একটা হয়ে চলেছে, কিন্তু সেটা কি সে সম্পর্কে ও কিছুই জানে না৷ কয়েকবার ফ্যালকন কে দিয়ে স্পাইগিরি করিয়েও কোনো লাভ হয়নি, ফ্যালকন কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। কিন্তু অ্যানা মুখিয়ে আছে তার অগোচরে কি চলছে সেটা জানার জন্য। মীর কি নতুন কোনো দাসী এনেছে! রুথ তো সেই কবেই খালাস।

কিন্তু অ্যানা মনস্থির করে নিয়েছে, মীর যদি এবার আবার কোনো দাসী খুজে নিয়ে আসে তবে ও কিছুই বলবে না। মীরের এতই যখন একটা সন্তানের শখ তখন একটা সন্তান ও পাক কারো থেকে! ক্ষতি কি! সেই তো দাসীদেরকে ও ছুয়েছেই, সেখানে একটা সন্তান পেয়ে গেলে তো আর ছুবে না! নাকি ছুবে! উফফফ! চিন্তায় চিন্তায় এবার মাথা টা হয়তো শেষ হয়ে যাবে!

নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে কিচেনের পেছন দিকে ব্রায়ানের তৈরিকৃত শাকসবজীর ক্ষেতে কাজ করছিলো অ্যানা। ক্ষেত টাতে প্রচুর ঘাস জমেছে সেগুলোই পরিষ্কারের ভার পড়েছে ওর ওপর৷ ব্রায়ান আশেপাশেই আছে কোথাও, চারা গাছ গুলোতে পানি দিয়ে বেড়াচ্ছে৷
অ্যানা আবার নিজের ভাবনায় ফিরে গেলো। মীর আজকাল খুব বাচ্চামো করছে৷ রাত বিরাতে এক এক বায়না ধরে বসছে, আগের দিন গুলোর মতো! সেদিন রাতে বলল ওকে এখনি রান্না করে খাওয়াও, অ্যানার যেটা ইচ্ছা সেটা। ও নাকি খায়নি দুদিন ধরে কিছু! কিন্তু প্রাসাদে থেকেও দুদিন না খাওয়ার কোনো কারণ দেখলো না অ্যানা৷
আবার সেদিন মাঝরাতে ওকে টানাটানি করে নিয়ে গেলো রেড জোনে, জঙ্গলের রেডউড গাছ গুলোর ভেতরে। তারপর অ্যানাকে নিয়ে উঠলো সবচেয়ে লম্বা গাছটির শক্তপোক্ত মগডাল টাতে। তারপর বাকি সমস্ত রাত টা ওরা পার করলো তারাভরা সুরমা রঙা আকাশ দেখতে দেখতে।

সেরাতেও মীর অনেক হেয়ালি কথাবার্তা বলছিলো। অ্যানাকে নিজের কোলের ভেতর বসিয়ে ওর মাথা টা নিজের বুকে চেপে ধরে অ্যানার সাদা রঙা চুলের একগুচ্ছ কে নিজের বাহাতের তর্জনীতে পেচিয়ে নিতে নিতে বলেছিলো,
— লাইফে যতযাই হয়ে যাক না কেন, যা-ই ঘটুক না কেন, তুমি সবসময় জেনো আমি তোমাকে ভালোবাসি, নিজের থেকেও বেশি, অনেক অনেক বেশি।
এ কথার পর অ্যানা ব্যাকুল হয়ে ওকে সরাসরিই প্রশ্ন করেছিলো,
— তুমি আমার থেকে কি লুকোচ্ছো মীর!

কিন্তু মীর সেদিন ওর কথার কোনো সদুত্তর দেয়নি, শুধু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দুপাশে দুবার মাথা নাড়িয়ে অ্যানার সমস্ত মুখখানা জুড়ে একেরপর এক উষ্ণ চুম্বন দিয়ে গেছে।
অ্যানা দীর্ঘশ্বাস ফেললো একটা। তারপর আবার মন দিলো কাজে। আজ রাতে মীর ওর হাতের খাবার খেতে চেয়েছে আবারও, ওর নাকি প্রাসাদের খাবার ভালো লাগছে না। তার জন্য আবার কিছু রান্না করা লাগবে। সমুদ্র থেকে কয়েকটা স্যামন ধরে নিয়ে রান্না করলে মন্দ হয় না।

অ্যানা প্রাসাদে লোক লাগিয়ে খোজ নিয়ে দেখেছে, মীর কোনো খাবারই মুখ তুলতে চাচ্ছে না, যেটাই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটাই ফিরিয়ে দিচ্ছে ও। মীরের এমন কাজকর্মের কোনো কূল কিনারা খুজে পাচ্ছে না ও। মীরের হলো টা কি! এরকম চলতে থাকলে তো ও অসুস্থ হয়ে পড়বে!
নানান চিন্তাভাবনা করতে করতে ওয়ার্কিং জোনের কাজ শেষ করে দুপুরের খাবারের বিরতিতে অ্যানা চলে গেলো সমুদ্রে, মীরের জন্য কয়েকটা স্যামন জোগাড় করতে। আজ রাতে মীর কে পেট পুরে খাইয়ে ঢোল বানিয়ে দিবে৷

রাতে মীর যখন এলো তখন ঘড়ির কাটা মধ্যরাত্রি পার হয়ে তৃতীয় প্রহরের দিকে এগিয়ে চলেছে। অ্যানা নিজের নিতম্ব ছাড়ানো সাদা রঙা চুল গুলোকে চিরুনি করে বেনী করতে নিচ্ছিলো। তখনি হুড়মুড়িয়ে কামরায় ঢুকে পড়ল মীর। মীরের ভেতরে প্রবেশের দুড়ুম দাড়াম শব্দে বিছানার এক কোণায় চিৎপাত হয়ে ঘুমানো লিন্ডা হকচকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো, ধারালো নখ গুলো দিয়ে সে আকড়ে ধরলো অ্যানার বিছানা। লেজ টা খাড়া হয়ে গেলো ভয়ে। পরক্ষণেই দরজায় মীর কে দেখে নিশ্চিন্ত হলো লিন্ডা, কিন্তু মিরের দিকে তাকিয়েই স্থীর হয়ে গেলো ও।

ধুসর রঙা একটা ট্রাউজারের সাথে বুক খোলা চারকোল রঙা রোব পরিহিতা মীর কে দেখে থমকে গেলো লিন্ডা। হা করে তাকিয়ে দাঁড়ানো থেকে ধাম করে বসে পড়লো বিছানায়। অ্যানা চুলে বেনী করা রেখে তাকালো দরজার দিকে। গাঢ় ছাই রঙা ঘাড় বাবরি ঝাকড়া চুলের মীরের মুখে খোচাখোচা দাড়ীর আভাস যেন ওর সৌন্দর্য কে দ্বিগুণ করে তুলেছে। শক্তপোক্ত লোমশ বুক আর পেট টা কামরার বাতির আলোতে চকচক করে উঠছে। স্বর্ণালি চোখ জোড়ার ব্যাকুল দৃষ্টি দিয়ে ও তাকিয়ে আছে অ্যানার দিকে। অ্যানা নিজেও মীর কে দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকালো যেন।

আজ কয়েকদিন খাবারে অনিয়ম করে মীরের মুখ খানা কিঞ্চিৎ শীর্ণ হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে ওর সৌন্দর্য এক ফোটাও কমেনি, বরং ওর ম্যাজেস্টিক চেহারা টা আরও ধারালো হয়েছে। কিন্তু মীরের চোখে মুখে কেমন যেন উদভ্রান্ত ভাব! যেন কোনো কিছু নিয়ে ও প্রচন্ড চিন্তিত, বিক্ষিপ্ত, সেই চিন্তা যেন কোনো মনস্টার হয়ে দিনরাত তাড়া করে চলেছে ওকে! অ্যানা যার কোনো কূল কিনারা খুজে পাচ্ছে না।

খোলা চুলে এগিয়ে গিয়ে মীর কে আগলে নিলো অ্যানা। ওর প্রাণপ্রিয় অর্ধাংশ টা যত্নের অভাবে কেমনতর হয়ে যাচ্ছে দিন দিন৷ অ্যানার মায়া হলো প্রচন্ড। অনেক গুলো দিন পর মীরের নিকট ও নিজে থেকেই আজ অ্যাপ্রোচ করলো। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে মীরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পায়ে ভর দিয়ে উচু হয়ে মীরের কপালে চুমু খেয়ে মীরের অশান্ত মন টাকে শান্ত করে দিলো ও৷ তারপর মীর কে বিছানায় বসতে বলে মীরের জন্য তৈরি করা খাবার গুলো নিয়ে আসতে যেতে নিলো কিচেনে৷ কিন্তু তার আগেই বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসা মীর ওকে এক টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এসে ওকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে ওর বুকে মুখ ডুবিয়ে আবদারের সুরে বলল,

— এভাবে থাকো এখানে কিছুক্ষণ!
অ্যানা ওর ঝাকড়া চুল গুলোর ভেতরে নিজের আঙুল গুলো সঞ্চালন করতে করতে শুধালো,
— ক্ষিদে পায়নি? খাবে না?
— পেয়েছো তো, অনেক রকমের ক্ষিদে। তার একটা এখন মেটাচ্ছি।
নিজের বাহুবন্ধনী আরও একটু শক্ত করে নিয়ে বলল মীর৷ অ্যানা ওর মুখ খানা নিজের দুহাতে নিয়ে উচু করে নিজের দিকে ফিরিয়ে ওর ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে স্নিগ্ধ কন্ঠে বলল,
— আগে খেয়ে দেয়ে পেট ভরিয়ে নাও, তারপর তোমার অন্য ক্ষিদে গুলোর ব্যবস্থা করা হবে।

সেদিন রাতে ওদের প্রচুর ভালোবাসাবাসি হলো। এর পরের প্রায় বেশ কয়েকটা দিন মীর প্রায় আঠার মতো লেগে রইল অ্যানার পেছনে। প্রায় প্রতিটা রাত অ্যানার সাথে কাটানোর জন্য যেন মরিয়া হয়ে উঠলো ও।
অ্যানার দিন গুলো কাটতো ওয়ার্কিং জোনে, কাজের মাঝে। আর রাত গুলো কাটতো মীরের সাথে। কখনো রেড জোনের গভীর জঙ্গলের ভেতর, কখনো রেড উড গাছের এক্কেবারে মগডালে, কখনো ট্রি হাউজে, কখনো সমুদ্রের পাড়ে, কখনো বা কোকো ফ্যালকন দের সাথে আড্ডা দিয়ে।

সারাক্ষণ মীরের সাথে থেকে থেকে আবার নিজের অতীতের দিন গুলোতে ক্রমে ক্রমে ফিরে যাচ্ছে অ্যানা। নিজের গাম্ভীর্যতা হারিয়ে আবার আগের মতো প্রানোচ্ছল হয়ে উঠছে। ওর প্রাণখোলা খিলখিলে হাসিতে বারংবার মাতোয়ারা হয়ে উঠছে মীর। কিন্তু অ্যানার ওই হাসির ঝংকার ওর বুকে গিয়ে বাড়ি খেয়ে সেখান থেকে উঠে আসতে চাইছে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস, যেটাকে সন্তর্পণে অ্যানার থেকে লুকিয়ে নিয়ে চলেছে মীর। অ্যানাকে হাসিখুশি দেখতে চাওয়ার তৃষ্ণা যেন পেয়ে বসেছে ওকে। কিভাবে কি করবে সেটা ভেবে কোনো কূল কিনারা পাচ্ছে না ও৷

যদিও অ্যানা মীরকে এখন সন্দেহ করা ছেড়ে দিয়েছে। এই কয়েকদিনে আবার মীর কে আগের মতোই আপন করে নিয়েছে ও। যত্নের অভাবে মীরের শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখলেই ওর ভেতর থেকে অতীতের যত্নশীল স্ত্রী সত্তা টা বেরিয়ে এসে বার বার মীর কে বুকের ভেতর আগলে নিতে চায়, সেই চাওয়া কে বাধা দিতে পারেনি ও, আটকে রাখতে পারেনি নিজেকে বেশিক্ষণ। মীরের হাবভাবে যদিও ওর মনে হয়েছিলো মীর কিছু লুকোচ্ছে ওর থেকে, কিন্তু কিইবা লুকোবে। দাসীই তো! তো থাকুক। একটা বাচ্চাই তো চাই ওর, আর তো কিছু না। একটা শেহজাদা চলে এলে তো আর কোনো অমস্যা নেই। তাকে না হয় অ্যানা নিজের সন্তানের মতোই বড় করবে!
মীর তো ওর জন্মের পর থেকে আর কোনো দাসী কে কখনো ছুয়ে দেখেনি। শুধু অ্যানা ওর বউ হবে বলে মীর আর কোনো দাসীকেই ছোয়নি, অ্যানার জন্যই নিজেকে সবকিছু থেকে বিরতপ রেখেছে। কিন্তু বিগত পাঁচ ছয় বছরে মীরের হঠাৎ করেই এই দাসীদের বাতিক হলো, শুধুমাত্র একটা বাচ্চার জন্য।

কিন্তু ওই পাঁচ ছয় টা বছরে যতগুলো দাসীই মীরের নিকট গিয়েছে সবগুলোকে নিজের হাতে ওপরে পাঠিয়েছে অ্যানা। এবার না হয় একটু সহ্য করে নিক! কিছু সত্যি না হয় অজানাই থাকুক ওর!
ওদের পূর্বপুরুষেরা তো এভাবেই নিজেদের জীবন অতিবাহিত করেছে। আজ যদি লাইফ ট্রি ওকে মীরের সাথে না জুড়ে দিত তবে মীরের এতদিনে গাদা গাদা বাচ্চা কাচ্চা থাকতো। সেগুলো অ্যানার চারপাশে সারাদিন ক্যা ক্যা করতো, ওকে ডাকতো আপু। অ্যাহ, এইডা কিছু হইলো! ছ্যাহ!

লাইফ ট্রির নিকটে, উজ্জ্বল পানির স্রোত ওয়ালা ডোবা টার পাশের ফাকা জায়গাটিতে মীরের বুকে ঠেস দিয়ে বসে এসবই ভেবে চলেছিলো অ্যানা। আজ কয়েকদিন ধরে ওরা সবাই মিলে গেট টুগেদার করছে। কোকো, ফ্যালকন, হাইনা কাঞ্জি, ওকামি, লিও, আলফাদ, জোভি ওরা সবাই এখানেই আছে। কোকো আর ফ্যালকন কুস্তি লড়ছে সেটাই একপাশে বসে দেখছে ওরা আর ফ্যালকন কে বাহবা দিচ্ছে।

ওরা দুজন কুস্তি করছে বললে ভুল হবে, ফ্যালকন একাই কুস্তি করছে। বিশালাকার কোকো মাটিতে ঠাই বসে আছে, ফ্যালকন কে চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়েছে কোকোকে ওর জায়গা থেকে ঠেলে এক ইঞ্চি সরানোর। চ্যালেঞ্জে জয়ী হলেই ফ্যালকন কে সমুদ্র থেকে একটা ফ্রেশ টুনা ট্রফি হিসেবে দেওয়া হবে৷ সময় এক ঘন্টা। কিন্তু কোকো সে সময় কে বাড়িয়ে সারা রাত করে দিয়েছে। এর ভেতরে যদি ফ্যালকন ওকে এক সেন্টিমিটারও নিজের জায়গা থেকে সরাতে পারে তবে কোকো নিজ দায়িত্বে ওকে দুইটা জায়ান্ট সাইজের টুনা ধরে এনে দেবে সমুদ্র থেকে।
আর বেচারা ফ্যালকন চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করে নিয়ে সেই তখন থেকেই বিশালদেহী কোকো কে সজোরে ঠেলে চলেছে, কিন্তু লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না।

লিন্ডা বসে আছে লিওর কোলে। এত গুলো সুদর্শন পোলার ভেতরে ওর মন গিয়ে ঠেকেছে লিওর কাছে। জঙ্গলের লায়ন দের দলের লিডার, ঝাকড়া সোনালি চুলের লিওর ধুসর রঙা শার্টে ঢাকা পাতলা পেশিবহুল শরীরের পেটের কাছ টাতে গা লাগিয়ে শুয়ে শুয়ে লিওর পুরুষালি মুখ খানা এক নাগাড়ে মুগ্ধ চোখে দেখে চলেছে লিন্ডা। এদিকে এত্ত কিউট কিটি দেখে লোভ সামলাতে না পেরে লিন্ডাকে কোলে নেওয়া লিও এখন পড়েছে বিপদে। লিন্ডাকে সে একেবারেই বাচ্চা ভেবেছিলো, কিন্তু এ তো আর কিছুদিন পরেই উপযুক্ত বয়সে পৌছে নিজের হিউম্যান ফর্ম নিবে।
আর লিন্ডা যে তার ওপর ক্রাশিত, আর সেই তখন থেকেই এক দৃষ্টিতে লিওর কোলে শুয়ে লিওর দিকেই তাকিয়ে আছে সেটা টের পাওয়ার পর থেকেই লিও ভুগছে অস্বস্তি তে। লিন্ডার বয়স এখন আট মাসে পড়েছে, এর মানে সে হিউম্যান ফর্মে এলে এখন হবে পনেরো বছরের কিশোরি। ভয়ঙ্কর সময়, বাপ্রে বাপ! কিন্তু লিন্ডার কোনো হেলদোল নেই, সে লিওর মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যাস্ত।

অ্যানা মীরের বুকে ঠেস দিয়ে ফ্যালকন আর কোকোর এই অদ্ভুত কুস্তি দেখে মাঝে মাঝেই খিলখিল করে হেসে উঠছিলো। ওর সে উইন্ড চাইমস এর ন্যায় মিষ্টি হাসি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো মীর। আর মাঝে মাঝেই অ্যানার অলক্ষে অ্যানার মুখ খানাকে পরখ করছিলো মুগ্ধ চোখে। দিন দিন যেন মেয়েটার রূপ বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে! এমন হতে থাকলে কবে বউ এর রূপের ঝলকানি তে ও অন্ধ হয়ে যাবে।
মিষ্টি হেসে মীর অ্যানার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকালো। তারপর কিছুক্ষণ সেদিক টা পর্যবেক্ষণ করে অ্যানার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

— তোমার মেয়েটা তোমার সাথে থেকে থেকে পেকে লাল টমেটো হয়ে গেছে। দেখো, লিওর সাথে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছে কিন্তু লিও ওকে পাত্তা দিচ্ছে না।
মীরের কথা শুনে অ্যানা তাকালো সেদিকে। তাকিয়েই বিস্মিত হলো, এইটুকুনি মেয়ে কিনা…… কিন্তু পরক্ষণেই ঠোঁট টিপে হাসলো অ্যানা।

লিন্ডা দুষ্টু চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লিওর দিকে। আর লাজুক লিও লিন্ডার দিকে না তাকিয়েই লিন্ডার মুখ খানা বারবার কোকো আর ফ্যালকনের কুস্তির দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু লিন্ডা সাথে সাথেই আবার সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে লিওর দিকে তাকাচ্ছে। শেষ মেশ না পেরে লিও লিন্ডাকে নামিয়ে রেখে দিলো নিচে৷ কিন্তু পাশে বসা দুষ্টু পোলাপান গুলো এতক্ষণ লিও আর লিন্ডার কীর্তি তে বেশ মজা নিচ্ছিলো। লিন্ডাকে নামিয়ে রাখা মাত্রই লিওর পাশে বসা, জঙ্গলের রয়্যাল টাইগার দের লিডার কাঞ্জি মাটিতে হতাশ হয়ে বসা থাকা লিন্ডাকে হাতে ধরে আবার লিওর কোলে উঠিয়ে দিয়ে থ্রেট দেওয়া গলায় লিও কে বলল,

— আমাদের সকলের একমাত্র বোন, নিজে থেকে তোকে চ্যুজ করেছে। ভুলেও যদি এর কোনো অযত্ন হয়েছে রে তবে কোকো কে দিয়ে তোকে ভালোমতো যত্ন করা হবে। মাথায় রাখিস!
লিন্ডা আবার নিজের জায়গা ফেরত পেয়ে লিওর দিকে তাকিয়ে নাক কুচকে বোঝালো যে যাইবা কোথায় চান্দু! ভাইয়েরা সবাই সাপোর্টে!
লিও পাশ ফিরে অসহায় চোখে তাকালো কাঞ্জির দিকে। কাঞ্জি খিকখিক করে হেসে উঠলো ওর চাহনি দেখে। লিওর অন্য পাশে বসা পাইথন দের লিডার আলফাদ বিজ্ঞের মতো বলে উঠলো,

— আমাদের বোনের গায়ের রঙ দেখছোস? ফকফকা সাদা, একেবারে দুধ। চোখ জোড়া দেখছোস? দুই চোখে যেন দুই সমুদ্র! ও যখন ক্যাট থেকে লেইডি হবে তখন আগুন সুন্দরী হবে আমাদের শেহজাদীর মতো। তুই ঠকবি না দোস্ত, চিন্তা করিস না, আমরা বলছি! কি বলিস তোরা?
দাঁত কেলিয়ে পেছনে বসা অন্যদের উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আলফাদ। ওর কথায় সাথে সাথেই পেছন থেকে টর্নেডোর গতিতে মাথা নেড়ে সায় দিলো জঙ্গলের নেকড়ে দের লিডার ওকামি, হাইনা আর কাঞ্জি। ওদের কে সায় দিতে দেখে লিন্ডা নিজেও লিওর মনোযোগ আকর্ষণ করে ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো যে লিও একদমই ঠকবে না, বরং বলবে জিতসিই!
ওর কাজে লজ্জায় লাল হয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো লিও, আর বাকিরা কিটিকিটি করে হাসতে শুরু করলো। কিন্তু একেবারে পেছনে বসে থাকা ব্লাক প্যানথার দের লিডার গম্ভীরমুখো জোভি পেছন থেকে ভারী গলায় বলে উঠলো,

— আমাদের শেহজাদীর রূপের সাথে অন্য কারো রূপের তুলনা করবি না মোটেও। আমাদের শেহজাদী এক পিসই। হিজ ম্যাজেস্টির সৌভাগ্য যে এমন সুন্দরী বউ পেয়েছে, আমার বউ এমন সুন্দরী হলে তো আমি সারাদিন মাথায় করে রাখতাম, অন্য মেয়েদের কাছে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতাম না।
জোভির কথা শোনা মাত্রই চমকে পেছনে তাকালো সবাই। লিও চাপা গলায় হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
— জোভি, কি হচ্ছে এসব! তোকে কতবার বলেছি যেখানে সেখানে বেফাস কথাবার্তা বলবি না। হিজ ম্যাজেস্টি শুনলে ব্যাপার টা কত ভয়ানক হতে পারে সে সম্পর্কে তোর কোনো ধারণা আছে? আর তাছাড়া আমাদের শেহজাদী হিজ ম্যাজেস্টিকে কতখানি ভালোবাসেন সেটা তোর অজানা নয়, উনি যদি জানতে পারেন তার স্বামী কে নিয়ে তুই এই ধরণের কথা বলেছিস তবে তোর ধড় থেকে মাথা টা আলাদা করতে উনি দ্বিতীয় বার ভাববেন না৷ তাই চুপ থাক।
লিওর ধমকে চুপ হয়ে গেলো জোভি, কিন্তু মুখ টা গম্ভীর করেই রইলো। অ্যানার মনোযোগ ওদের দিকেই ছিলো এতক্ষণ। ওরা কথা গুলো চাপা গলায় বললেও অ্যানার কানে সেটা স্পষ্ট ভাবে এসেছে। কিন্তু শুনেও না শোনার ভান করে মীরের বুকের সাথে আরও ভালোভাবে লেগে গেলো অ্যানা। ও আর এসবে কান দিতে চায় না। মীর নিজেও অ্যানা কে নিজের বুকের সাথে আরও শক্ত করে মিশিয়ে নিলো।

অ্যানা এবার দৃষ্টি দিলো কুস্তিরত ফ্যালকনের দিকে। এই দুর্বল বাচ্চাটা তার সবচেয়ে আদরের। বাচ্চা ফ্যালকন কে ওর মা বাসা থেকে ফেলে দিয়েছিলো নিচে, দুর্বল ছিলো কিনা! প্রানী দের নিয়মই এমন, শক্তিশালী রাই টিকে থাকবে, দুর্বল দের সেখানে কোনো স্থান নেই।
সেদীন মীরের সাথে জঙ্গলে ঘোরার সময় মাটিতে পড়া ফ্যালকনকে নজরে বাধে অ্যানার, ছুটে যায় বোবা প্রাণীটার কাছে। বাচ্চা ফ্যালকনের তখনোও গায়ে পালক গজায়নি, চোখও ফোটেনি ঠিক মতো।
মাটিতে পড়ে অসহায় হয়ে ডাকতে ডাকতে গলার স্বর ওর হয়ে এসেছিলো ক্ষীন, দুর্বল। সমস্ত শরীর টা দখল করে নিয়েছিলো বিষাক্ত পিপড়া। সেই মৃতপ্রায় বাচ্চাটাকে পরম যত্নে হাতে তুলে নিয়েছিলো অ্যানা। মীর বলেছিলো ফেলে দিতে, বাচ্চাটার যে অবস্থা তাতে সে দু বেলার বেশি বাঁচবে না। কিন্তু জেদী অ্যানা সেটাকে নিজের সাথে প্রাসাদে নিয়ে এসেই ছেড়েছিলো, আর তারপর মীর কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে সেই অত্যান্ত দুর্বল, মৃতপ্রায় বাচ্চাটিকে মাতৃস্নেহ দিয়ে একটু একটু করে বড় করে তুলেছে ও। সে এখন একজন পরিপূর্ণ যুবকে পরিণত হয়ে অ্যানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, হাসি মুখে। কে বলবে ওর এই সন্তান টা দুর্বল!

অ্যানাকেই নিজের মা হিসেবে সারাজীবন মেনে এসেছে ফ্যালকন, অ্যানা জানে ওকে একটাবার আম্মা ডাকার জন্য ফ্যালকনের বুকের ভেতর টা ফেটে যায়, কিন্তু মীরের কড়া বারণ। কোকো কে অনুমতি দিয়েছে কারণ কোকো অ্যানার প্রথম পোষা প্রাণী, কিন্তু আর কাউকেই সে এই অনুমতি দিবে না। ফ্যালকন তাই বাধ্য হয়ে অ্যানাকে আম্মা ডাকার ইচ্ছাটা বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখে।
তার শেহজাদী আর এই পরম মমতার ভাই গুলো ছাড়া তার যে আর কেউ নেই। এরাই ওর সব, এদের মাঝেই ও বড় হয়েছে! অ্যানার জন্য ও নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত! অ্যানা জানে, তার এই সন্তান টা শারিরীক দিক দিয়ে দুর্বল হলেও মনের দিক থেকে ওর মতো শক্তিশালি আর কেউ নেই, কেউ না!
ফ্যালকনের ভাবনা থেকে ফিরে এলো অ্যানা, তারপর মীরের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাড়ালো। এরপর এগিয়ে গেলো ফ্যালকন আর কোকোর কুস্তির দিকে।

ফ্যালকন আর কোকোর কাছে গিয়ে ফ্যালকনের দিকে নিজের ডান হাত টা বাড়িয়ে দিয়ে অ্যানা বলে উঠলো,
— তোর হাত খানা দে এদিক।
ফ্যালকন হঠাৎ করে অ্যানার এমন কথায় তব্দা খেয়ে কোকোকে ধাক্কা দেওয়া ছেড়ে অ্যানার দিকে নিজের ডান হাত টা বাড়িয়ে দিলো। অ্যানা ফ্যালকনের হাত টা নিজের হাতের ভেতর নিয়ে সেই হাত টা দিয়েই মাটিতে বসে ওদের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা কোকোর বাহুতে ছোটখাটো একটা ধাক্কা দিলো। কিন্তু অ্যানার সেই ছোটখাটো ধাক্কা কোকোর কাছে ঠেকলো একটা বিশাল ঝটকার ন্যায়। অপর পাশের মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো কোকো। আর তারপর মাটিতে পড়া অবস্থাতেই অ্যানার দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

— আম্মা! এটা তো চিটিংবাজি!
অ্যানা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
— কোনো কথা না, আগামী কাল সন্ধ্যায় দুইটা টুনা মাছ নিয়ে চলে আসবি এখানে। ফ্যালকনের কুস্তি জেতার আনন্দে ওর ট্রফি দুটোকে তোদের রান্না করে খাওয়াবো।
অ্যানার কথা শেষ হতে না হতেই ওপাশে বসে থাকা লিও কাঞ্জি দের ভেতর হৈচৈ পড়ে গেলো। অ্যানার হাতের রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য ওদের খুব কমই হয়েছে, হাতে গোনা দুতিন বার। ফ্যালকনের বদৌলতে এতগুলো দিন পর ওরা আবার অ্যানার হাতের রান্না খেতে পারবে শুনেই বসা থেকে উঠে ছুটে এসে খুশিতে চিল্লাপাল্লা করতে করতে ফ্যালকন কে ধরে ঝাকাঝাকি করা শুরু করলো ওরা। জোভি এসে ফ্যালকনের পেছনে একটা থাবড়া দিয়ে বলে উঠলো,

— তোর জন্য শেহজাদীর হাতের ঝাক্কাস রান্না খেতে পারবো কাল, তোকে একগাদা চুম্মা।
ফ্যালকন বিরক্তি নিয়ে নাক মুখ কুচকে জোভির হাত খানা নিজের পেছন থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
— গ্যে নাকি রে তুই? চুমা দিতে আসোস! সর আমার সামনে থেকে! পাছায় হাত দিবি না মোটেও।
ফ্যালকনের এমন এক্সপ্রেশনে জোভিসহ অন্যরা হোহো করে হেসে উঠলো।
ওদের কান্ডকারখানা দেখে নিঃশব্দে হাসতে হাসতে অ্যানা আবার ফিরে এসে বসলো মীরের কোলে। মীর ওকে টেনেটুনে নিজের কোলের ভেতর ভালোভাবে নিতে নিতে খোঁচা মেরে বলল,
— তোমার ছেলে গুলো দিনে দিনে তোমার মতোই দুষ্টু হয়ে যাচ্ছে। এইখানে এসে থেকে বাদরের মতো লাফালাফি করছে। যাদের আম্মা এমন তারা আর কত ভালো হবে!
— অ্যাই মোটেও আমাকে দুষ্টু বলবে না, পাস্ট ইজ পাস্ট। আমি আগে দুষ্টু ছিলাম, এখন তো আর নেই! এখন তো আমি কোনো দুষ্টামিই করি না!
মীরের কোলের ভেতরেই তেজের চোটে লাফিয়ে উঠে মীরের দিকে ঘুরে বসে নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল অ্যানা৷ মীর ওর পাটা ফোলানো নাক টা চেপে দিয়ে ফিচেল হেসে বলল,

— দুষ্টুমি গুলো অ্যাপ্লাই করার উপযুক্ত প্লেইস পাচ্ছোনা তাই দুষ্টুমি করছো না। নইলে মানুষ এতদিনে টের পেয়ে যেতো প্রাসাদ থেকে একটা সাদা রঙের অর্কিড ওয়ার্কিং জোনে এসে ঘুরঘুর করছে। আর কিছুদিন পরেই তো প্রাসাদে ফিরে যাবে, তখন ঠিকই আবার আগের মতো তোমার সব দুষ্টুবুদ্ধি বেরিয়ে আসতে থাকবে উঁইপোকা যেভাবে গর্তথেকে বেরোয় সেভাবে। আবার তোমার মাথায় ঘুরতে শুরু করবে কিভাবে আমার গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা গুলো ভঙ্গ করা যায়, কিভাবে আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে জঙ্গলে টোটো করে বেড়ানো যায়, কিভাবে আমার ওপর স্পাইগিরি করা যায়, কিভাবে দাসী গুলোকে সবসময় কাজের ওপর রাখা যায়, কিভাবে দুষ্ট দুষ্ট পোশাক আশাক পরে আমার মাথা টা খারাপ করে দিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায়, কোথায় কার মাথা ফাটানো যায়, বাচ্চা গুলোকে নিয়ে নতুন কোন ঝামেলা বাধানো যায় এইসব! তোমাকে তো আমি ভালো করেই চিনি, তোমার এসব কীর্তিকলাপ এই জীবনে কখনো চেঞ্জ হবে বলে আমি অন্তত মনে করি না!

শেষের কথা টা বলে মীর দাঁত কেলিয়ে হাসলো। অ্যানা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে কিছুক্ষণ, তারপর হুট করেই ঝাপিয়ে পড়ে মীরের গলা চেপে ধরলো দুহাতে, সাথে সাথেই মীর চোক্‌ড হওয়ার অ্যাক্টিং করতে করতে গলা চাপা সুরে বলে উঠলো,
— ওহ, একটা বাকি থেকে গেছে, কিভাবে কথায় কথায় পঞ্চদ্বীপের বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান কে গলা টিপে হত্যা করার চেষ্টা করা যায়!
অ্যানা মীরের পেশিবহুল হৃষ্টপুষ্ট গলাটাকে আরও একটু জোরে চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

— বেশি বাড়াবাড়ি করবা তো তোমাকে চার হাত পা বেধে খাটের সাথে লাগিয়ে রাখবো বলে দিলাম!
— তারপর কি করবা?
মীরের এমন প্রশ্নে অ্যানা কটমট করে তাকালো ওর দিকে। চোক্‌ড হওয়া অবস্থাতেই আড়চোখে অ্যানার দিকে তাকিয়ে কিটকিটিয়ে হাসলো মীর৷ তারপর অ্যানার উত্তরের অপেক্ষা না করেই অ্যানার শকুনি দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আবার দুষ্টু গলায় বলল,
— শাস্তি যদি রোম্যান্টিক হয় দ্যেন আ’ ওয়ান্ট দোজ শাস্তি এভরিড্যে!
এই পর্যায়ে অ্যানা মীরের গলা ছেড়ে দিলো, তারপর মীরের বুকে একটা ছোটখাটো ঘুষি বসিয়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
— তারপর তোমার ওপর একটা মাদী হাতি এনে ছেড়ে দেবো৷ তখন বুঝবা মজা!
অ্যানার কথায় আবার জঙ্গল কাঁপিয়ে হেসে উঠলো মীর।

ভোরবেলা সূর্যের আলো ফোটার আগে শিরো মিদোরির সেইফ জোনের আন্ডারে থাকা সমুদ্রতীরের নিকট এসে নোঙর ফেললো একটি মাঝারি আকৃতির জাহাজ। জাহাজের চওড়া পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো সেদিন রাতে খুন হওয়া ছেলেগুলোর দল থেকে পালিয়ে যাওয়া ছেলেটিকে। টিমটিমে বাতি জ্বলতে থাকা আউটসাইডার্স দের রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে৷
এমন সময় জাহাজের ভেতর থেকে পাটাতনের ওপরে উঠে এলো গাবদাগোবদা ভারী চেহারার একটি মধ্যবয়সী লোক, ডান দিকের চোখের ওপর থেকে চোয়ালের ওপর পর্যন্ত একটা লম্বা কাটা দাগ তার। ভারী শরীর টা এগিয়ে নিয়ে এসে ছেলেটির পাশে দাঁড়িয়ে লোকটা প্রশ্ন করলো,
— ওই মেয়েটা একাই ওদের সবাই কে মেরেছে সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিত, বেঞ্জামিন?
বেঞ্জামিন নামক ছেলেটি মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলে উঠলো,

— হ্যাঁ বস, আমি নিশ্চিত। যে মেয়েটাকে আমরা রে*প করতে নিয়েছিলাম তাকে আর তার ভাইকে আমরা দড়ি দিয়ে বেধে রেখেছিলাম। ওদেরকে যে বাধুনি দিয়ে আমরা বেধেছিলাম সেটা কোনো ধারালো অস্ত্র ছাড়া সাধারণ কারো দ্বারা খোলা প্রায় অসম্ভব! সেটাও অতো অল্প সময়ের ভেতরে। আর তাছাড়া আমি নিজের চোখে দেখেছি ওই মেয়েটা চোখের পলকে ওদের সবাইকে কুপিয়ে দিয়েছে। ভাগ্য ভালো যে আমি পালাতে পেরেছিলাম! অন্ধকারের ভেতর যে টুকু দেখতে পেয়েছিলাম আমাদের ভেতরের কেউ একজন মেয়েটাকে আটকাতে গেছিলো, মেয়েটার হাত থেকে রাম দা টা কেড়ে নিতে গেছিলো, কিন্তু ওর হাত টা ধরে মেয়েটা একবার মোড়ালো শুধু, কোনো প্রকার জোর ও প্রয়োগ করলো না, আর তাতেই সে ছেলেটার হাত টা মুড়িয়ে ভেঙে গেলো একেবারে কনুই এর নিচ থেকে! ওই দৃশ্য দেখেই আমি সেখান থেকে দৌড় দিয়েছি, আর এক মুহুর্তও সেখানে থাকিনি। ওদের সবাই কে ওই মেয়েটা একাই মেরেছে বস!

— তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে মেয়েটা এসব বিষয়ে বেশ ভালোই পারদর্শী। তাকে হালকা ভাবে নিলে হবে না। তার হুলিয়া দেখার পর আমি তাকে প্রথমে প্রস্তাব দেবো আমার দলের সাথে আমার হয়ে কাজ করার জন্য। ও যদি প্রস্তাব গ্রহণ না করে তবে ওকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবো।
ওদের কথার মাঝেই জাহাজের ভেতর থেকে বের হয়ে ওদের কাছে এলো আরও কয়েকজন মধ্যবয়সী লোক। তাদের ভেতর থেকে একজন গাবদাগোবদা লোকটাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে উঠলো,
— হেনরি, শিরো মিদোরি বাদশাহর এলাকা। এখানে এসে এরকম কিছু করা কি আমাদের ঠিক হবে? আর তাছাড়া ওয়ার্কিং জোন টা পুরোটাই বাঘা বাঘা ক্রিমিনাল দিয়ে ভর্তি। খুব বড়সড় অপরাধ না করলে আর কাউকে এখানে পাঠানো হয় না, সুতরাং সেখানে যারা আছে তাদের কাউকেই হালকা ভাবে নেওয়া যাবে না৷ সেখানে গিয়ে য আমরা ফেসে যাই তখন কি হবে?

— আমরা কাউকে কিছুই করবো না, শুধু মেয়েটাকে নিয়ে চলে আসবো। আর তাছাড়া বাদশাহ এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন বলে আমার মনে হয় না। সামান্য একজন ওয়ার্কার এর কি হলো না হলো সেটা দেখার মতো সময় ওনার নেই। আর আমরা যা করবো এমন ভাবে করবো যেন আমরা এইখান থেকে মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ আমাদের কিছুই করতে না পারে। আমরা আউটসাইডার্স দের জিম্মি করে নিয়ে ওয়ার্কার্স দের কাছে শান্তিপূর্ণ ভাবে মেয়েটাকে চাইবো। একদিকে সমস্ত ওয়ার্কার্স অন্যদিকে ওই একটা মাত্র মেয়ে। আর ওরা যদি সংঘর্ষ চায় তবে আমরাও সংঘর্ষ করবো, এমনি এমনি তো আর এতগুলো ছেলেকে সাথে নিয়ে আসিনি! আমাদের কাছে আর্মস আছে যথেষ্ট পরিমাণে, কিন্তু ওয়ার্কার্স দের সবাই আনআর্মড। তাই জিত আমাদেরই হবে৷
পাটাতনের রেলিঙের ওপর হাত রেখে শিরো মিদোরির জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বলল হেনরি নামক লোকটি।
— কিন্তু বস……
দ্বিতীয় লোকটা আবারও কিছু বলতে নিলে হেনরি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
— আর কোনো কথা নয় অ্যাডি, যে মেয়েটা আমার এতগুলো বাঘা বাঘা ছেলেকে নিমিষেই দুখন্ড করে দিয়েছে সে কে সেটা না দেখা পর্যন্ত আমি থামছিনা।

ধীরে ধীরে জেগে উঠতে শুরু করেছে শিরো মিদোরি। শার্লট হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে মাঞ্জার থেকে বেরিয়ে মিটিং জোনের দিকে আগাচ্ছিলো। অন্যরাও একে একে বের হতে শুরু করেছে তাদের মাঞ্জার থেকে। কিচেন থেকে রান্নার টুংটাং শব্দ আসছে থেকে থেকে। ভোরের স্নিগ্ধ, তাজা হাওয়া বুক ভরে টেনে নিতে নিতে এগোচ্ছে শার্লট। এমন সময় পেছন থেকে ফাতমা ডেকে উঠলো শার্লট কে। ওকে দেখে শার্লট দাড়ালো, তারপর ফাতমা ওর কাছে আসার পর দুজনে একসাথে এগোতে শুরু করলো মিটিং জোনের দিকে।
যেতে যেতে ফাতমা কিঞ্চিৎ উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো,

— শুনেছো কিছু?
— কি শুনবো, কোন বিষয়ে?
ফাতমার দিকে তাকিয়ে কৌতুহলী গলায় পালটা প্রশ্ন করলো শার্লট।
— থিয়োডর অ্যানাকে ম্যারিয়েজ প্রপোজাল দেওয়ার কথা ভাবছে, আর খুব শিগগিরই নাকি দেবেও।
ফাতমার কথায় পা জোড়া থমকে গেলো শার্লটের, ফাতমার দিকে ফিরে ও বিস্মিত কন্ঠে বলল,
— তুমি সিরিয়াস? কে বলল তোমাকে?
— আউটসাইডার্স দের কয়েকজনের সাথে বলেছে ও এই কথা। ওখানে কাল একটা রোগী দেখতে গিয়েছিলাম তখন ওরাই আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো আমরা বিয়ের তোড়জোড় শুরু করছি কিনা। আমি তো প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, পরে ওরা খুলে বললে আমি তো শুনে থ’ বনে গেছি! অ্যানার কানে এই কথা গেলে অ্যানা ওর কি হালটা করে সেটাই দেখার বিষয়।

— অ্যানার বয়েই গেছে ওর মতো একটা রে*পি*স্ট কে বিয়ে করতে! প্রপোজাল দিয়েই দেখুক না, অ্যানা ওকে এক লাথি দিয়ে চান্দের দেশে পাঠিয়ে দিবে, সেখানে গিয়ে ও উষ্টা খেয়ে পড়ে থাকবে বাকি জীবন। তখন বুঝবে অ্যনাকে প্রপোজাল দেওয়ার কত স্বাদ!
রাগে কিড়মিড় করতে করতে কথা গুলো বলল শার্লট। ব্রায়ান এই কথা শুনলে ওই থিয়োডরের মুখ টাই ভেঙে না দিলে হয়! শালার বেয়াদব বলে কিনা অ্যানাকে প্রপোজাল দিবে, সেটাও ম্যারিয়েজ প্রপোজাল! শখ কত।’ ভাবতে ভাবতে শার্লট দাঁতে দাঁত চেপে এগোলো সামনের দিকে।

মিটিং জোনে পৌছেই অ্যানাকে নজরে বাধলো ওর। অ্যানা সেখানে আগে থেকেই এসে বসে আছে। পরণে বরাবরের মতো হুডি আর ট্রাউজার। হুডির পকেটে হা করে ঘুমুচ্ছে লিন্ডা, মাঝে মাঝে গরগর শব্দ করছে।
অ্যানার চোখে ঘুম, চোখ জোড়ার চারপাশ কিঞ্চিৎ ফুলে আছে। রাতে ওইসব কাহিনী করতে গিয়ে ওর ঘুম হয়নি। শেষ রাতের দিকে যা একটু ঘুমিয়েছিলো তা আবার এখন উঠে চলে আসতে হলো।
শার্লট এসেই অ্যানার সাথে গল্প করতে লেগে গেলো। অ্যানা ঘুম ঘুম চোখে ওর গল্প শুনতে শুনতে হা হু করতে লাগলো, মাঝে মাঝে মাথা নাড়িয়ে সায় মানতে লাগলো, আর সেই সাথে হাতে হাতে শার্লটের সাথে ডাইনিং এরিয়া ক্লিন করার কাজ শুরু করলো। চোখ জোড়া জ্বালা করছে ওর, এখন গিয়ে আবার একটা ঘুম দিতে পারলে ভাল্লাগতো কিন্তু তার তো কোনো উপায় নেই।

কিছুক্ষণ পরে চোখ থেকে ঘুম তাড়াতে কাজ ফেলে রেখে অ্যানা গেলো চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে। শার্লট একা একাই ডাইনিং এরিয়াতে কাজ করতে লাগলো। এমন সময় থিয়োডর এসে উপস্থিত হলো সেখানে। এসে অদ্ভুত কাঁপা গলায় শার্লট কে জিজ্ঞেস করলো,
— ব্রায়ান কোথায় শার্লট?
শার্লট একমনে কাজ করছিলো, হঠাৎ পেছন থেকে থিয়োডরের কন্ঠস্বর শুনে চমকে লাফিয়ে উঠলো ও। পেছনে ফিরে থিয়োডর কে দেখা মাত্রই ফাতমার তখনের বলা কথা গুলো মনে পড়ে গেলো ওর। সাথে সাথেই মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেলো, কিন্তু অতি কষ্টে সেটা চাপা দিয়ে রেখে হাসি হাসি মুখ করে বলে উঠলো,

— ভাইয়া মাঞ্জারেই আছে, এতক্ষণে হয়তো উঠেও গেছে ঘুম থেকে। ভাইয়ার মাঞ্জারে গেলেই তাকে পেয়ে যাবেন।
থিয়োডর কথা টা শুনেই ব্রায়ানের মাঞ্জারের দিকে দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে চলে গেলো। শার্লট শান্তশিষ্ট থিয়োডরের হঠাৎ এমন হন্তদন্ত হওয়ার কারণ খুজে পেলো না। কিন্তু বেশি না ভেবে আবারও নিজের কাজে মন দিলো। কিছুক্ষণ পরেই ব্রায়ানের মাঞ্জার থেকে ব্রায়ান আর থিয়োডর একত্রে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে আউটসাইডার্স দের রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার দিকে এগোলো। ব্রায়ানের চোখে মুখে আতঙ্ক, থিয়োডরেরও তাই। শার্লট খেয়াল করলো সেটা। হঠাৎ এদের কি হলো তা বুঝলো না ও। কাজে মন দিলো আবারও। অ্যানা চোখ মুখ ধুয়ে এলে শার্লট ওকে থিয়োডর আর ব্রায়ানের ব্যাপার টা বলল। অ্যানা নিজেও খুব বেশি আমলে নিলো না সে ব্যাপার টা। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়তে পারে ভেবে নিজের কাজে হাত লাগালো আবারও।

কিন্তু খানিক্ষণ বাদেই আউটসাইডার্স দের রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার দিক থেকে আবারও হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলো ওরা দুজনে৷ চোখমুখ জুড়ে ওদের স্পষ্ট ভয়। অ্যানা ওদের দিকে দেখছিলো, ওরা দুজন অ্যানাদের দিকেই আসছে। উদভ্রান্ত, আতঙ্কিত চোখ মুখ নিয়ে থিয়োডর আর ব্রায়ান নিজেদের ভেতর চোখে চোখে কথা বলছে যেন।
দ্রুত পায়ে ওরা অ্যানাদের নিকটে আসার পরই ব্রায়ান থমথমে মুখে শার্লটের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
— শার্লট, অ্যানার সাথে আমাদের কিছু কথা আছে, তুই একটু ওদিকটায় যা।
শার্লট একবার ব্রায়ান আর একবার থিয়োডরের দিকে তাকালো, দুজনের মুখই থমথমে। খুব গুরুতর কিছু হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে, তাই শার্লট কোনো বাক্যব্যয় ছাড়াই ভাইয়ের আদেশ মেনে নিয়ে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। শার্লট চলে যেতেই অ্যানা ব্রায়ানের উদ্দ্যেশ্যে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

— কি হয়েছে ব্রায়ান? তোমাদের চোখ মুখের এ অবস্থা কেন?
— অ্যানা, বড়সড় একটা প্রবলেম হয়ে গেছে।
ব্রায়ান আর কিছু বলতে পারলো না, ওর গলা টা যেন আটকে আসতে চাইলো। আজ ওর জন্যই অ্যানার এত বড় বিপদ আসতে চলেছে! ব্রায়ান চুপ হয়ে যাওয়ায় থিয়োডর ওর কথা টেনে নিয়ে চাপা গলায় বলা শুরু করলো,
— কুরো আহমার থেকে জাহাজে করে কারা জানি এসেছে। ওরা ভোর হওয়ার আগেই আউটসাইডার্স দের রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে ঢুকে সেখানের মেয়ে আর বাচ্চা দেরকে জিম্মি করে নিয়েছে। আর তাদের বিনিময়ে ওরা তোমাকে চায়। তুমি নাকি ওদের কোন গ্রুপ কে হত্যা করেছো! তারই প্রতিশোধ নিতে চায় ওরা। এখন আমরা কি করবো অ্যানা? ওদের হাতে প্রচুর অস্ত্রসস্ত্র! ওদের সাথে আমরা কখনোই পেরে দিবো না। আর তাছাড়া কারো কাছে নিউজ পাঠানোরও কোনো লাইন নেই, পুরো এরিয়াটা ওরা নেটওয়ার্ক জ্যামার দিয়ে আটকে ফেলেছে। আমাদের কে আধা ঘন্টা সময় দিয়েছে ডিসিশন নেওয়ার জন্য, হয় তোমাকে তাদের হাতে তুলে দিবো, নয়তো ওরা আউটসাইডার্স সহ আমাদের সবার ওপর অ্যাটাক করবে। কি করবো আমরা এখন?
থিয়োডরের কথাতে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো অ্যানা। টোপ গিলেছে তবে! ঠিক আছে, তারা খাতিরযত্ন চাইলে অ্যানা সেটা দিবে। কিন্তু অ্যানার তো ঘুম আসছে! কি করা যায়!
অ্যানা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে উত্তর দিলো,

— আমি যাবো ওদের সাথে।
অ্যানা কথাটা বলার সাথে সাথেই ব্রায়ান যেন একেবারে ভেঙে পড়লো, চাপা গলায় কান্নামিশ্রিত কন্ঠে ও বলে উঠলো,
— আমি তোমাকে ওদের হাতে কখনোই তুলে দিতে পারবো না অ্যানা! তুমি আমাদের জন্য সেদিন যা করেছো তার মূল্য আমি শোধ করতে পারবো না কখনো। আমি তোমাকে কোনোভাবেই হারাতে চাই না অ্যানা! আমি ওদের কে তোমার বদলে দশজন মেয়ের অফার দিয়েছি, ওরা গ্রহণ করেনি, ওরা তোমাকেই চায়। আমি ওদেরকে এও বলেছি যে ওরা চাইলে সমস্ত আউটসাইডার্সদের ভেতরের সব মেয়েকে নিয়ে যেতে পারে কিন্তু ওরা আমার কথা শোনেনি অ্যানা! আমাদের হাতে এখন আর কিছুই নেই! কিন্তু আমি তোমাকে কোনোভাবেই ওদের হাতে তুলে দিতে পারবো না। আমার প্রাণ যায় যাক তবুও না। আমরা লড়াই করবো, আমাদের কিচেনে প্রচুর নাইফ আছে, সবই ধারালো। আমাদের প্রত্যেকের কাছেই কোনো না কোনো অস্ত্র আছে, ছোটখাটো যা-ই হোক! আমরা ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো অ্যানা। লড়াই এর শব্দ পেলে প্রাসাদের লোকেরা নিশ্চয়ই খবর পাবে। কিন্তু তবুও তুমি ওদের কাছে যেতে রাজি হইয়ো না অ্যানা! পায়ে পড়ি তোমার।

ডুকরে কেঁদে উঠলো ব্রায়ান। ওর চোখ থেকে পানির স্রোত বয়ে যেতে লাগলো! ব্রায়ানের এমন কথায় অ্যানা মনে মনে হাসলো। এই ছেলেটা একটা আস্ত পাগল। ব্রায়ানের এমন আবেগী কথায় থিয়োডর পাশ থেকে বলে উঠলো,
— তুমি যা বলছো তা কখনোই সম্ভব না ব্রায়ান। ওরা সংখ্যায় প্রায় একশতর কাছাকাছি, তার ওপর পুরোপুরি অস্ত্রসজ্জিত। ওদের সাথে আমরা কখনোই পেরে দেবো না। বরং আমরা আরও ফেসে যাবো। ওরা এমনিতেও অ্যানাকে নিবে, ওমনিতেও অ্যানাকে নিবে। শুধু মাঝে পড়ে আমাদের অপশন দিচ্ছে রক্তপাত ছাড়া অথবা রক্তপাত সহ। আর এই খবর টা ওয়ার্কিং জোনে ছড়িয়ে পড়লে সবার মাঝে উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দিবে। ভয়ে কে কি করবে ভেবে না পেয়ে কি করে বসবে তার ঠিক নাই৷ তাই আমাদের উচিত অ্যানাকে ওদের হাতে কোনো বাক্যব্যয় ছাড়াই তুলে দেওয়া।
থিয়োডরের কথায় সায় জানিয়ে অ্যানাও ব্রায়ানের উদ্দ্যেশ্যে বলল,

— থিয়োডর ঠিক বলেছে ব্রায়ান। আমার জন্য সেইফ জোনের ভেতর কোনো নিষ্পাপ মানুষের রক্ত ঝরুক তা আমি কখনোই চাই না। তাই ভালো হবে আমি যদি স্বেচ্ছায় ওদের কাছে চলে যাই। তবে তুমি চিন্তা করো না। নিজেকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আমি। ভাগ্য সহায় হলে তোমাদের মাঝে আমি আবারও ফিরে আসবো। আর হ্যাঁ, এসব কথা কাউকে বলার প্রয়োজন নেই। সবকিছু গোপন রাখবে সবার থেকে। শার্লট কেও কিছু বলার প্রয়োজন নেই, ও এসব শুনলে ভেঙে পড়বে৷ ও জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি বিশেষ কাজে শিরো মিদোরির বাইরে গিয়েছি, কবে আসবো জানিনা৷

কথা গুলো বলে অ্যানা নিজের হুডির পকেট থেকে লিন্ডা কে বের করে ব্রায়ানের হাতে দিয়ে বলল,
— সন্ধ্যার পর আমার লিন্ডাকে রেড জোনের সীমানায় রেখে দিয়ে আসবে। ও ওর গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। এইটা তোমাকে দেওয়া আমার শেষ দায়িত্ব হিসেবে নিতে পারো।

বাদশাহ নামা পর্ব ৩৭+৩৮

ব্রায়ান লিন্ডাকে হাতে নিয়ে উপরের দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠলো আবারও। অ্যানা ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে এগোলো আউটসাইডার্স দের রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার দিকে। ওর পেছন পেছন এগোলো থিয়োডর আর ব্রায়ান!
নিজের যত্নে গড়া ভালোবাসাকে শেষ বিদায় জানানোর যন্ত্রণায় বুকের ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে আসতে লাগলো ব্রায়ানের। ঠোঁট চেপে নিজের গলা পাকিয়ে আসা কান্না টাকে নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়ে হয়ে উঠলো ও।

বাদশাহ নামা পর্ব ৪১+৪২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here