বাদশাহ নামা পর্ব ৪৩+৪৪

বাদশাহ নামা পর্ব ৪৩+৪৪
আমিনা

জনমানবহীন সুনসান এক পরিত্যক্ত রাস্তার ডান পাশে নিরাবতার প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি পরিত্যক্ত তেতলা ভবন। দেয়ালগুলো যেখানে সেখানে ফেটে গেছে। উজ্জ্বল রঙ গুলো ধসুর, মলিন হয়ে পড়েছে। জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা জমে আছে। জানালার গ্লাস গুলো ভাঙা, গ্রিল গুলোতে মরিচা পড়ে গেছে। চারদিকে স্যাঁতসেঁতে, ভ্যাপসা একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে সমস্ত বিল্ডিং টা জুড়ে৷ কয়েকটি ভাঙা আসবাবপত্র পড়ে আছে এখানে সেখানে, মাকড়সার জালে ভর্তি হয়ে আছে সেগুলো। তারই দোতলার রাস্তার দিকে মুখ করা কামরাটার বা পাশের ভাঙা জানালার নিকট একটি স্বচ্ছ ল্যাপটপ হাতে, কানে হেডসেট লাগিয়ে বসে আছে ফ্যালকন। ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে প্রবল মনোযোগ দিয়ে দ্রুত হাতে কিছু একটা করতে ব্যাস্ত ও৷

পরিত্যক্ত কামরাটির ভেতরে ঘরময় পায়চারি করছে অ্যানা, আর মাঝে মাঝে ফ্যালকনের দিকে দেখছে৷ ফ্যাল্কন দুর্বল প্রকৃতির হওয়ায় ওকে যৎসামান্য ফাইটিং শিখিয়েছে অ্যানা। ফ্যালকন ফাইটিং টা পেরে দেয়না৷ একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই কাৎ হয়ে যায়। তাই ওকে ফাইটিং থেকে ইস্তফা দিয়ে আইটি এক্সপার্ট হিসেবে গড়ে তুলেছে অ্যানা৷ প্যালেসের হোয়াইট হ্যাকার হিসেবে ওকে কিছু বছর আগেই নিয়োগ দিয়েছে মীর৷
আরও কিছুক্ষণ যাবৎ ল্যাপটপে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করার পর হঠাৎ চাপা গলায় আনন্দধ্বনি করে উঠলো ফ্যালকন। তারপর হেডসেটের মাইক্রোফোনে বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— অল সিসি ক্যামস আর হ্যাক্‌ড, ইয়্যু গায়্যিজ ক্যান এন্টার ন্যাও৷
হেডসেটের অপরপাশে সংযুক্ত থাকা জোভি, লিও আর হাইনা ফ্যালকনের এই কথা টা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। ফ্যালকনের থেকে এনসিওর হওয়ার পরই নিঃশব্দে বাইক থেকে নেমে একটি নির্জন কোণে বাইক গুলো রেখে ওরা হাটতে হাটতে সন্তর্পণে ঢুকে পড়লো কুরো আহমারের এই বিশাল অ্যাবান্ডনড প্লেইস টার কেন্দ্রে অবস্থিত পরিত্যাক্ত কারখানাটিতে।
আর অ্যানা ওদের কারখানায় ঢোকার ব্যাপার টা সিওর হয়ে নিয়ে নিজেও ফ্যালকনের থেকে বিদায় নিয়ে পরিত্যক্ত ভবন থেকে নেমে ভবনটির নিচতলায় রাখা নিজের বাইক টা নিয়ে ঝড়ের গতিতে এগোলো কারখানা টির দিকে।

ভারী বাতাস শো শো করে ঢুকছে পরিত্যক্ত কারখানা টির ভেতরে। ঝুলে থাকা লোহার শিকল গুলো বাতাসের বেগে আন্দোলিত হয়ে ঠুংঠাং শব্দ তুলছে। সূর্যের আবছা আলোতে পুরো কারখানাটা জুড়ে আলো আঁধারির খেলা চলমান।
লিও তার হাতের সংকেত দিয়ে নজর কাড়ে অন্যদের। তারপর নিঃশব্দে, স্লো মোশনে ছায়ার মতো ছড়িয়ে পরে কারখানাটির চারদিকে। তিনজনের হাতেই ওদের নান চাকু আর কাস্টম মডিফাইড গান।
কারখানার ভেতরটা বিশাল এক গোলকধাঁধা। নিজেদের হেলমেটে কারখানাটির নকশা দেখে নিয়ে তিনজনেই তিন দিক থেকে পায়ে পায়ে এগোয় গোলকধাঁধাটার চারপাশে থাকা কামরা গুলোর দিকে। কানে থাকা ব্লুটুথ ডিভাইসের ওপাশ থেকে ফ্যালকন তাদের কে নির্দেশনা দিয়ে চলেছে,

— লেফট। রাইট। ব্যাক। ফোর্থ। স্টেয়ার।
তিনজনেই ফ্যালকনের কমান্ড অনুসরণ করে হাতের গান টা উঁচিয়ে এগিয়ে চলেছে নিঃশব্দে। নান চাকু জোড়া আর্মরের পেছনে বাধা, তাতে মৃদু টুংটাং বেজে চলেছে। কারখানার গোলক ধাধাটির তিন কোণায় তিনজন গিয়ে দাড়ালো। একে অপরের সাথে তিন কোণা থেকে তিনজন আলো আঁধারির ভেতর দিয়ে হাত নেড়ে ইশারায় যোগাযোগ করে নিঃশব্দে প্লান করে নিলো।

কারখানার নকশা টা ফুটে আছে ওদের আর্মরের হেলমেট টির সামনে। আর ফ্যালকন তাদের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে কোথায় কত লোক আর কোন দিক দিয়ে গেলে বিপদ কম আসবে৷
তিন জন কারখানার তিন দিকের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো বিড়ালের ন্যায় নিঃশব্দে। তারপর খুবই সন্তর্পণে দরজার কাছে থাকা গুটি কয়েক গার্ড কে নিঃশব্দে কেউ নানচাকু দিয়ে গলা পেচিয়ে দিলো, কেউ বা ঘাড় মটকে ফেলে দিলো, কেউ বা মডিফাইড গান গুলোর সাউন্ডলেস শট দিয়ে রাস্তা টা ক্লিয়ার করে ফেললো, তারপর এগোলো সামনের দিকে। আর এরপর একে একে যে যেভাবে পারলো গার্ড দের একাংশকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো গোপনে। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ আর গোপন রইলো না।

ইলহান দানবাকৃতির লোকটাকে কোকো আর আলফাদ কে শেষ করতে বলে চলে যেতে নিচ্ছিলো। তখনি ওর কানে এলো পরপর কয়েকটি গান শটের বিকট আওয়াজ। আর তার পরমুহূর্তেই একজন গার্ড হন্তদন্ত হয়ে সেখানে এসে আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠলো,
— বস, কারা জানি কারখানার ভেতর ঢুকে পড়েছে! আমাদের অনেকগুলো গার্ডকে ইতোমধ্যে ওরা ধরাশায়ী করে ফেলেছে, অনেকের রেস্পন্স পাচ্ছিনা। আমি গার্ড দের কে পাঠিয়েছি অনুপ্রবেশকারী দের পেছনে, কিন্তু ওরা খুবই ধূর্ত৷ মুহুর্তের ভেতর কোথায় জানি গায়েব হয়ে যাচ্ছে! আমরা এখন কি করবো?

ইলহানের চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। ওর এতগুলো বছর ধরে সযত্নে লালিত এই অপরাধের সাম্রাজ্য কে হুমকির মুখে ফেলে দিলো শিরো মিদোরি তে মরা ওই ছেলে গুলো। মরলো তো মরলো, ওকেও ফাসিয়ে দিয়ে গেলো। এসব কিন্তু কিছুই হতোনা যদিনা হেনরি ওকে না জানিয়েই শিরো মিদোরি তে মাতবারি করতে যেতো! কিন্তু এখন শুধু মাত্র ওই বেশি বোঝা হেনরির জন্যই ওকে এই বিপদে পড়তে হয়েছে৷ নয়তো ওকে ধরতে গেলে মীরকে এর পেছনে আরও কাঠখড় পোড়ানো লাগতো!
ইলহান মুখ থেকে বিরক্তিসূচক শব্দ করলো একটা, তারপর গার্ড টির উদ্দ্যেশ্যে গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো,

— সমস্ত কারখানা সিল্ড করে দাও, কারখানার প্রতিটা এন্ট্রিতে বেশি বেশি গার্ড মোতায়েন করো। যারা ভেতরে এসেছে তারা যেন কেউ বাইরে না যেতে পারে, আর বাইরে থেকে কেউ যেন ভুলেও ভেতরে ঢুকতে না পারে! এইখানে গার্ড দের একটা গ্রুপ কে পাঠিয়ে দাও৷ আমি এখানে এদের সাথেই থাকছি।
গার্ড টি ইলহানের কথা শোনা মাত্রই আনুগত্য জানিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে চলে গেলো আবার। ইলহানের করা আদেশ গুলো অন্যদের জানিয়ে দিতে দিতে সে ছুটলো সামনের দিকে।
ইলহাম সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে মীরের উদ্দ্যেশ্যে গালি দিতে লাগলো। তখনি পেছন থেকে ঝুলন্ত কোকো বলে উঠলো,

— ভয় পেলেন নাকি, মিস্টার…..?
— জাযিব ইলহান দেমিয়ান।
কোকোর দিকে ফিরে তীক্ষ্ণ কন্ঠে উত্তর দিলো ইলহান। ইলহানের কথায় অবাক হলো কোকো। দেমিয়ান? দেমিয়ান মানে তো রাজ পরিবারের সদস্য! তাহলে ইনি কে? এখানেই বা কি করছেন! আর তাকে দেখতেই বা হুবহু বাদশাহর মতো কেন?
কোকোকে ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে দেখে ইলহান বাঁকা হেসে বলে উঠলো,
— আমি, তোমাদের বাদশাহ, নামীর আসওয়াদের বড় ভাই, জাযিব ইলহান; শান আরহাম দেমিয়ানের বড় সন্তান; পঞ্চদ্বীপের ভবিষ্যৎ বাদশাহ এবং শেহজাদী আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ানের হবু স্বামী।
শেষোক্ত বাক্য টা উচ্চারণ করে ইলহান তার ঠোঁট প্রসারিত করে কুটিল হাসি দিলো।
কোকো ইলহানের কথাটার অর্থ পরিপূর্ণ ভাবে ধরতে পারলো না, কিন্তু তবুও দুর্বল কন্ঠে দাঁত কেলিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

— ভালো স্বপ্ন, দেখতে থাকেন৷
কোকোর এমন অবজ্ঞাপূর্ণ হাসি দেখে ইলহান চোয়াল শক্ত করে নিলো। তারপর ছুটে গিয়ে গায়ের সর্বোচ্চ জোর দিয়ে কোকোর মুখ বরাবর একটি ভারী পাঞ্চ বসিয়ে দিলো। ঝুলন্ত কোকো ঝুলে থাকা অবস্থাতেই পেন্ডুলামের মতো ছিটকে গেলো অন্যদিকে, রক্ত ছটকে পড়লো ওর মুখ থেকে। তারপর আবার ফিরে এলো নিজের জায়গায়। ঠোঁটের কোণা বেয়ে গলগল করে রক্ত পড়ে ওর খোলা বুক টা ভেসে যেতে শুরু করলো, আর তার কিছু মুহুর্ত পরেই চোখ উলটে জ্ঞান হারালো কোকো৷

ইলহানের অপরাধের জগতের সমস্ত শাখা গুলোর লিডার দের ভেতরে হৈচৈ পড়ে গেছে। রামাদি সামা থেকে কয়েকটি ব্যাটালিয়ন আর্মি ফোর্স এসে সমস্ত শাখা গুলোতে সাডেন রেইড চালাচ্ছে। লিডার গুলো যে যেদিকে পারছে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এমন হঠাৎ আক্রমণের শিকার ওরা এর আগে কখনো হয়নি৷ আর্মিদের কোনো রেইড মিশন থাকলে ওরা আগে ভাগেই এক গোপন মাধ্যম দিয়ে খবর টা পেয়ে যায় সর্বদাই। কিন্তু আজ ঠিক কি হলো তা ওদের কারো মাথায় আসছে না৷

আর্মি ফোর্স গুলো প্রতিটা লিডার কে গর্ত থেকে কেচোর ন্যায় টেনে বের করে নিয়ে আসছে তারপর হাত জোড়া লম্বা লম্বা শিকলে বেধে নিয়ে নিজেদের অত্যাধুনিক ওয়ার ভেহিকল এর পেছনে বেধে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে কোথাও৷ লিডার ছাড়া সেসব শাখা গুলোর সাথে যুক্ত সমস্ত অপরাধীদের কে গাড়িতে তোলা হচ্ছে একে একে। আজ রাতেই এদের সমস্ত কুকর্মগুলো বিবেচনা করে একদল কে পাঠানো হবে শিরো মিদোরির সেইফ জোনে, অন্যদল কে সোজাসুজি মৃত্যদন্ড দেওয়া হবে৷ কোনো জঞ্জাল কোথাও রাখা হবে না৷

কুরো আহমারের কন্ট্রোলার মুহতাসিফ শারাফ চারদিকে অন্ধকার দেখছেন। বাদশাহ হঠাৎ করেই আজ উপস্থিত হয়েছেন তার অফিসে, কোনো আগমনী বার্তা ছাড়াই! উপস্থিত হয়েই একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলেছেন মুহতাসিম কে। বাদশাহর মুখনিঃসৃত প্রতিটা শব্দে মুহতাসিমের শরীর টা কেঁপে কেঁপে উঠছে বারে বারে৷ এত গুলো দিন শেহজাদা ইলহানের হয়ে কাজ করে সমস্ত অপরাধ আর অপরাধী দের কে সুক্ষ্মভাবে ঢাকা দিয়ে গেছেন তিনি, যেন কোনো ভাবেই বাদশাহ এসবের কূলকিনারা করতে না পারেন। কিন্তু আজ তিনি ফেসে গেছেন ভয়ানক ভাবে। ঘামে জবজবে চেহারা টা কাঁপা হাতে বারবার রুমাল দিয়ে মুছছেন।

গান শটের মুহুর্মুহু আওয়াজে ভারি হয়ে উঠেছে কারখানার ভেতর টা। লিও, হাইনা আর জোভি একের পর এক গার্ড কে নিজেদের নান চাকু আর গান দিয়ে দক্ষতার সাথে ঘায়েল করে চলেছে। ওদের আর্মর টা কেমোফ্লাজ করতে পারার কারণে মুহুর্তেই নিজেদের কে লুকিয়ে নিচ্ছে ওরা, কখনো বা দেয়াকের সাথে, কখনো বা আসবাবপত্রের সাথে, কখনো বা যন্ত্রপাতির সাথে। কিন্তু ইলহানের গার্ড সংখ্যা অনেক বেশি। একটাকে মারলে যেন দুইটা এগিয়ে আসছে সেখানে, হাইনা আর জোভির ওপর ভারী পড়ে যাচ্ছে। লিও ওদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে কিন্তু পেরে দিচ্ছে না৷ নিজের পিঠ বাচাতে গিয়েই ওকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

অ্যানা কারখানার বাইরে। সমস্ত কারখানাটির ওপর থেকে নিচ দিয়ে সবখানে ও সেট করে চলেছে ছোট্ট ছোট্ট আকৃতির কিছু রোবোবম্ব, যেগুলো কমান্ড পাওয়ার সাথে সাথেই প্রচন্ড দ্রুত গতিতে বিশাল এক এরিয়া নিয়ে এক্সপ্লোড করবে। ইলহানের ক্রাইম শাখা গুলোর লিডার দের কে আজ এখানেই নিয়ে আসা হবে। সবগুলোকে আজ এইখানে কারখানার ভেতরে ঢুকিয়ে কারখানাটা শুদ্ধ উড়িয়ে দেওয়া হবে। কোনো অপরাধীর কোণাটুকুও বাচিয়ে রাখা হবে না৷ এসব জঞ্জাল বাঁচিয়ে রাখলে সেখান থেকেই আবার নতুন করে আবর্জনার জন্ম নিবে৷
সমস্ত জায়গায় রোবোবম্ব সেট করার পর অ্যানা নামলো কারখানার ওপর থেকে। তারপর নিজের আর্মরের হেলমেটের ভেতরটা ভালো ভাবে পরখ করে আন্দাজ করে নিলো কোকো আর আলফাদ ঠিক কোথায় থাকতে পারে৷ কারখানার মোটা দেয়াল আর লোহার বেষ্টনির জন্য ওর সিক্সথ সেন্স ভেতরে পৌছাচ্ছে না৷

একটা মোটামুটি আন্দাজ করে নিয়ে অ্যানা এগোলো কারখানার পেছন দিকটাতে৷ তারপর ওর আর্মরের ফিস্টের নিকট থাকা এক অদ্ভুত লেজার রশ্মি বের করে কারখানার লোহার তৈরি দেয়ালটি ভেদ করে ভেতরে যাওয়ার জন্য লেজার রশ্মি দিয়ে কেটে তৈরি করে ফেললো নিজের দেহ টা প্রবেশ করানোর মতো একটি প্রবেশ পথ৷
এরপর দ্রুত গতিতে ভেতরে ঢুকে ছুটলো সামনের দিকে। ছুটতে ছুটতে কোকোকে অনুভব করার চেষ্টা করলো ও কিছুক্ষণ। কিন্তু কোকোর সাথে সাথে ওর নাকে আসলো রক্তের গন্ধ। বুক কেঁপে উঠলো ওর, কোকো ঠিক আছে তো! দ্রুত সে রক্তের গন্ধটাকে অনুসরণ করে সামনে এগোলো ও৷ সামনে যতগুলো দেয়াল পড়লো সবগুলোকে কেটে কেটে এগোতে এগোতে একসময় ওর চোখে পড়লো কোকোকে। লোহার শিকল দিয়ে বেধে সিলিঙের সাথে ঝুকিয়ে রাখা হয়েছে ওকে। মাথাটা নেতিয়ে আছে নিচের দিকে, কোনো সাড়াশব্দ নেই, পায়ের আঙুল থেকে কিছুক্ষণ পর পর টুপ টুপ শব্দ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। পাশেই আলফাদ পড়ে আছে, ওর ও কোনো নড়াচড়া নেই! ওদের আশেপাশে বেশ কয়েকজন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে, আশপাশটায় কড়া নজর রেখে পাহারা দিয়ে চলেছে তারা।

অ্যানা ধীর গতিতে, নিঃশব্দে এগিয়ে এলো ওদের দিকে, তারপর ওর আর্মরের কব্জির ওপরের অংশ থেকে শব্দ করে বের করলো ওর সাদা আর সোনালি রঙা নকশার সৌর্ড টা। সৌর্ডের মেটালিক সাউন্ডে সেখানে থাকা গার্ড গুলো চমকে ফিরে তাকালো পেছন দিকে, আর তাকিয়েই অ্যানাকে দেখে থমকে গেলো ওরা!
অ্যানা মাথা থেকে হেলমেট টা সরিয়ে ফেলেছে আর্মরের ভেতর। ওর সাদা রঙা চুল গুলো কারখানার মৃদু বাতাসেই শূণ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে, কুচকুচে কালো রঙা পাপড়ির নিচে এক জোড়া হীরকখন্ডের ন্যায় চোখ জ্বলজ্বল করে দ্যুতি ছড়াচ্ছে চারদিকে। আর্মর টা শরীরের সাথে লেগে থাকায় শরীরের অবয়ব টা ফুটে উঠেছে স্পষ্ট ভাবে৷
গার্ড গুলো ওদের দিকে মোহনীয় ভঙ্গিতে কোমরে ঢেউ তুলে এগিয়ে আসা অসম্ভব রকম সুন্দরী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হা’ হয়ে গেলো, মেয়েটির হাতে থাকা রক্ত পিপাসু ধারালো, চকচকা সৌর্ড টার দিকে আর নজর গেলো না কারো!

অ্যানা এগিয়ে এসে ওদের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে হাতের সৌর্ড টা মাটিতে ঠেকিয়ে তার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ওদেরকে সেন্সে ফেরানোর জন্য গলা খাকারি দিলো, ও গলা খাকারি দেওয়া মাত্রই গার্ড গুলো চমকে উঠে আশেপাশের পরিবেশ টা তড়িঘড়ি করে একবার বোঝার চেষ্টা করে দ্রুত হাতে নিজেদের অস্ত্র প্রস্তুত করতে লেগে গেলো, কিন্তু তার আগেই চোখের পলকে, ঝড়ের গতিতে গিয়ে তাদের সবার ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দিলো অ্যানা, মাথা গুলো ছিটকে পড়লো একএকটা একএক দিকে। গার্ড গুলোর ধড়ের উপরিভাগ থেকে গলগল করে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে হতে ধড় গুলো ঝুপ ঝাপ করে পড়লো কারখানার মেঝেতে৷

গার্ড গুলোর ভবলীলা সাঙ্গ করে অ্যানা এবার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো আলফাদের কাছে তারপর ওর বুকের কাছটায় হাত দিয়ে দেখলো হার্টবিট চলছে কিনা। হ্যাঁ, চলছে! স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো অ্যানা। তারপর আলফাদের নিকট থেকে উঠে গিয়ে দ্রুত গতিতে কোকোর কাছে গেলো ও। তারপর মেঝেতে ভর দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে ধরলো কোকোকে বেধে রাখা শিকল টিকে। আর অ্যানা সেটা ধরা মাত্রই অ্যানার ভর সহ্য করতে না পেরে সেটা কট্টাস শব্দ করে ছিড়ে গিয়ে অ্যানা আর কোকোকে শুদ্ধ পড়লো কারখানার মেঝেতে৷
মেঝেতে আছড়ে পরার পরপরই অ্যানা তড়িঘড়ি করে কোকোর মাথার কাছে গিয়ে ওর মাথা টা তুলে নিলো নিজের কোলে, তারপর ওর বুকের ওপর হাত দিয়ে দেখতে গেলো ওর হার্টবিট আছে কিনা। তখনি কোকো তার দুর্বল, নির্জিব কন্ঠে ডেকে উঠলো,

— আম্মা!
কোকোর মুখে আম্মা ডাকটা শুনে অ্যানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কোকোর অবস্থা খুবই খারাপ, শরীরের কোথাও আঘাত পেতে বাকি নেই ওর, সমস্ত মুখ আর পিঠ জুড়ে গভীর ক্ষত, মুখের ভেতর থেকে প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে রক্ত মিশ্রিত লালা বেরিয়ে আসছে। কোকোর এমন অবস্থা দেখে অ্যানার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইলো! কোকোকে আরও একটু টেনে নিলো ও নিজের কোলের ভেতরে, তারপর ভেজা গলায় বলে উঠলো,
— কিচ্ছু হবে না তোর, কথা বলিস না! আমি সব ঠিক করে দিবো!
কোকো পরম আবেশে অ্যানার কোলে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো, বুক টা ওঠানামা করতে শুরু করলো ওর ভয়ঙ্কর ভাবে। অ্যানা ভাবলো কিছুক্ষণ ওর ম্যাজিকাল ভয়েস শোনা মাত্রই ইলহান আর তার গার্ডরা ওর উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে। ওর একএক ম্যাজিকাল ভয়েসের এক এক কাজ! এখন লুলাবি ভয়েসের পেছনে সময় দিতে গেলে কোকো আলফাদের জীবন সঙ্কটে পড়ে যাবে! অ্যানা আরও কিছুক্ষণ ভেবে কোকোকে কোলে রেখেই নিজের দুহাত উপরে করে বিশেষ পদ্ধতি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এনে ঝড়ের গতিতে দু হাত দুদিকে দিয়ে বলে উঠলো,

— আলটিমেট লক!
আর সাথে সাথেই ওর আশপাশের দেয়াল গুলো পুরোপুরি বিদ্যুতায়িত হয়ে লক হয়ে গেলো৷ অ্যানা এবার নিজের দু হাত একটার ওপর আর একটা দিয়ে কোকোর বুকে, ঠিক হৃৎপিণ্ডের ওপর ঠেকালো, তারপর আস্তে আস্তে গাইতে শুরু করলো ওর ওউন্ড হিলিং ম্যাজিকাল সং। ওর সে সুর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো সমস্ত কারখানাটা জুড়ে। কারখানা জুড়ে থাকা গার্ড গুলো এক মুহুর্তের জন্য ওর সে সুরের মূর্ছনায় থমকে গেলো, যুদ্ধ থেমে গেলো কিছু সময়ের জন্য।

ইলহান ছিলো কারখানার ওপর তলায় থাকা কন্ট্রোল রুমে, তার গার্ড দের অবস্থাটা কেমন সেটা দেখার জন্য সে কন্ট্রোল রুমের সিসিটিভি ক্যামে নজর দিতে গেছিলো, কিন্তু সেগুলোর সবকয়টা হঠাৎ করেই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ঠিক কখন থেকে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে সেটা এখন আর দেখার সময় নেই ওর।
প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে ইলহান
আবারও কোকো আর আলফাদকে বন্দি করে রাখা স্থান টিতে আসতে নিচ্ছিলো, কিন্তু এই অদ্ভুত সুন্দর ভয়েস টা শুনে দাঁড়িয়ে গেলো ও! কিছু মুহুর্তের জন্য নিজের সমস্ত শরীর আর মন জুড়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলো ও, চোখ জোড়া বুজে নিলো আবেশে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ধ্যান ভাঙলো ওর৷ নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত গতিতে এগোলো কোকো আলফাদের বন্দি করে রাখা স্থানটির দিকে।

অ্যানা গেয়ে ওঠার সাথে সাথে কোকোর বুকে হাত চেপে রাখা স্থানটি থেকে ধীরে ধীরে রেড জোনের জঙ্গলে প্রবাহিত হওয়া উজ্জ্বল রঙা আলোকরশ্মির ন্যায় আলোকরশ্মি প্রবাহিত হতে শুরু করলো কোকোর সমস্ত শরীর জুড়ে। ধীরে ধীরে সেগুলো কোকোর আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে গিয়ে সারিয়ে তুলতে শুরু করলো ওর গভীর ক্ষত গুলো।
সেই আলোকশক্তির প্রভাবে কোকোর সমস্ত শরীর জুড়ে প্রচন্ড দ্রুত গতিতে রেড ব্লাড সেল প্রবাহিত হতে শুরু করলো, রক্তের প্লাটিলেট গুলো দ্রুত গতিতে এসে ক্ষতস্থানে জমা হতে হতে প্রচন্ড দ্রুত গতিতে নিজেদের জাল তৈরি করতে শুরু করে দিলো, আর ওদিক থেকে রক্তে থাকা প্রোটিন দ্রুত গতিতে এসে নিজেদের ফাইব্রিন দিয়ে প্লাটিলেটের সাথে মিশে সে জাল টিকে মুহুর্তের ভেতর আরও মজবুত করে ফেলে কোকোর সমস্ত ক্ষতস্থান গুলোর রক্ত জমাট বাধাতে শুরু করলো।

হোয়াইট ব্লাড সেল গুলোর ভেতর হুটোপুটি শুরু হয়ে গেলো, হঠাৎ করেই তাদের কর্মক্ষমতা বেড়ে গেছে অনেক। তারা তীব্র গতিতে ছোটাছুটি করতে করতে এসে অতন্দ্রপ্রহরীর ন্যায় ক্ষতস্থান দিয়ে ঢুকতে থাকা সমস্ত ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসকে একে একে খতম করে দিতে শুরু করলো দক্ষ যোদ্ধার মতো। রেড ব্লাড সেল গুলো ঝড়ের গতিতে প্রবাহিত হতে হতে ক্ষতস্থান গুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়িয়ে দিলো। একটু একটু করে ক্ষত গুলোতে নতুন কোষ, নতুন টিস্যু উৎপন্ন হতে হতে নিজেদের শূন্যস্থান পূরণ করতে শুরু করলো, তারপর ধীরে ধীরে টিস্যু গুলো পুনর্গঠন হতে হতে ক্ষতস্থান গুলোকে আগের মতোই মজবুত করে ফেললো। আর সেই মুহুর্তেই শেষ হলো অ্যানার ওউন্ড হিলিং এর ম্যাজিকাল সং টি। আর কোকো পুরোপুরি সুস্থ সবল হয়ে চোখ মেলে তাকালো অ্যানার ফিকে, তারপর পরম আদূরে গলায় ডেকে উঠলো,

— আম্মা!
অ্যানা এতক্ষণ চোখ জোড়া বন্ধ করে ছিলো, কোকোর ডাক শুনে চোখ মেলে তাকালো ও৷ কোকোকে ওর দিকে প্রসারিত ঠোঁটে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসতে গিয়েও কেঁদে ফেললো অ্যানা। তারপর কোকোর কপালে একটা স্নেহের চুম্বন একে দিলো। এরপর আলফাদের কথা মনে পড়তেই কোকোর মাথা টা দ্রুত গতিতে কোল থেকে নামিয়ে ছুটলো ও আলফাদের কাছে।
তারপর আলফাদের কাছে বসে ওর বুকে হাত রেখে নিজের ওউন্ড হিলিং এর ম্যাজিকাল সং শুরু করার আগ মুহুর্তেই প্রচন্ড গতিতে শব্দ হলো কামরাটির প্রবেশ দ্বারে।

বাইরে থেকে কেউ সর্বশক্তি দিয়ে দরজায় একের পর এক বাড়ি দিয়ে চলেছে। অ্যানা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের কাজ শুরু করলো। আলটিমেট লক টা কিছুক্ষণ হলেও কাজে দিবে৷ কোকো দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলো দরজার নিকট, যেন কেউ ভেতরে ঢোকা মাত্রই তাকে ঘায়েল করে দিতে পারে৷ অ্যানা নিজের আর্মরের ব্যাকসাইড থেকে একটা ধারালো নাইফ বের করে ছুড়ে মারলো কোকোর দিকে । কোকো সেটাকে শূন্য থেকেই দ্রুত গতিতে ধরে ফেলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে৷ আর অ্যানা শুরু করলো ওর হিলিং সং৷

কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরেই একটা ভারী আঘাত পড়লো দরজার ওপর, আঘাতের তোপে দরজাটা বেশ খানিক টা খুলে গেলো। কোকো হাতে নাইফ টা শক্ত করে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ধরে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো, কেউ ভেতরে ঢোকা মাত্রই তার গলা বরাবর নাইফ চালিয়ে দিবে ও৷ আর তার পরমুহূর্তেই আর একটা প্রচন্ড ভারী আঘাত পড়লো লোহার দরজাটার ওপর, আর এই সর্বশেষ আঘাতের চোটে দরজাটা কাঠামো থেকে খুলে গিয়ে ছিটকে চলে গেলো ভেতরে, অ্যানা আলফাদ কে নিয়ে যেখানে ছিলো সেখানে। কিন্তু সেটা ওদের গায়ে গিয়ে লাগার আগেই কোকো ছুটে গিয়ে সেটাকে নিজের বিশাল দু হাতে ধরে নিয়ে ছুড়ে দিলো অন্যদিকে।
অ্যানা নিজের কাজে ব্যাস্ত। চোখ জোড়া ওর বন্ধ, ও এখনো আলফাদের বুকে হাত রেখে নিজের ম্যাজিকাল ভয়েসে গেয়ে চলেছে৷ আলফাদের ক্ষতস্থানে জমাট বেধে শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে৷ কিছুক্ষণ পরেই ওর ক্ষতস্থান গুলো নতুন চামড়া দিয়ে ভর্তি হতে শুরু করবে!

কোকো হাতের নাইফ টা শক্ত করে ধরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো আবার দরজার দিকে।
কিন্তু দরজার ওপাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং ইলহান। তার চোখ জোড়া দরজার ওপাশে মেঝেতে বসে থাকা খোলা চুলের অ্যানার দিকে, যার কণ্ঠনিঃসৃত মিষ্টি সুরে বার বার খেই হারিয়ে ফেলছে ইলহান৷ এতক্ষণ শুধু সেই মোহনীয় কন্ঠস্বর শুনতে পেলেও এখন সে মোহনীয় কন্ঠস্বরের মালিককে দেখছে! এবার সে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে নিজের ওপর থেকে। অ্যানার দিক থেকে চোখ সরানোই যেন দায় হয়ে পড়েছে। ওর শক্ত মন টা কেমন যেন নরম হয়ে আসছে থেকে থেকে!

কোকো দাঁড়িয়ে ছিলো আক্রমণের জন্য, কিন্তু ইলহান কে সামনে দেখে কিছুটা থমকালো ও। আর ইলহান কে এইভাবে অথর্বের মতো দাঁড়িয়ে যেতে দেখে আরও বেশি বিভ্রান্ত হলো।
ইলহানের চোখ জোড়া যে অ্যানার দিকে নিবদ্ধিত সেটা খেয়াল করা মাত্রই অ্যানাকে আড়াল করে ইলহানের সামনে এসে দাড়ালো কোকো। তারপর কঠিন গলায় বলে উঠলো,
— আমাদের আম্মা কে এইভাবে দেখার অধিকার একমাত্র এবং শুধুমাত্র আমাদের বাদশাহর, অন্য কেউ অনধিকার দেখাতে এলে তার চোখ তুলে হাতে ধরিয়ে দেবো!
নিজের ডান হাতের নাইফ টা ইলহানের সামনে দিয়ে ছুড়ে দিয়ে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে বা হাতে নিলো কোকো। হিংস্র চোখ জোড়া ওর ইলহানের কামুকতা পূর্ণ চোখের দিকে। কোকোর এমন স্পর্ধা দেখে ইলহান ঠোঁট বাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। তারপর কোকোর দিকে দুই কদম এগিয়ে এসে বলল,

— আমার অধিকার অনধিকার সম্পর্কে কি এখন তোমার মতো একটা নর্দমার জানোয়ারের থেকে শিখতে হবে?
— ওই ধবধবে সাদা প্রাসাদ যদি আপনাকে একজন বাদশাহ এবং নিজ ভাইয়ের বউয়ের দিকে কিভাবে তাকাতে হয় সেই শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয় তবে এই নর্দমার জানোয়ারই শেষ ভরসা!

ইলহানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো কোকো। আর কোকোর কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ইলহানের ডান হাতের একটা বিশাল ঘুষি এসে পড়লো কোকোর মুখে। কোকো ছিটকে গিয়ে পড়লো নিজের পেছন দিকে। কিন্তু মেঝেতে আছাড় খেয়ে আবার সাথে সাথেই উঠে দাড়ালো ও৷ তারপর এক হাত লম্বা ধারালো নাইফ টা নিয়ে এক চিৎকার দিয়ে সে ছুটে গেলো ইলহানের দিকে। কিন্তু কোকো আক্রমণ করার ঠিক আগ-মুহুর্তে ইলহান তড়িৎ গতিতে সরে গেলো সেখান থেকে। ইলহান সরে যাওয়ায় কোকো গিয়ে ধাক্কা খেলো ইলহানের পেছনে থাকা দেয়াল টিতে। আর কোকো ধাক্কা খাওয়ার পরমুহূর্তেই ইলহান ঝড়ের গতিতে ঘুরে দেয়ালের সাথে সেটে থাকা কোকোর মাথার পেছনের চুল গুলো মুঠি করে ধরে মাথাটা উঁচু করে ধরে বিদুৎ গতিতে আছাড় দিলো দেয়ালের ওপর, আর সাথে সাথেই কোকোর কপাল ফেটে গলগল করে রক্ত বের হতে শুর করলো!

ইলহান সবেগে আরও কয়েকটা আছাড় দিয়ে ছেড়ে দিলো কোকোকে। মাথায় আঘাত লাগায় কোকো বেসামাল হয়ে পড়লো, মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলো ও! ধম করে বসে পড়লো ও মেঝেতে! হাতের নাইফ টা একপাশে পড়ে গেলো হাত ফসকে। আর ইলহান ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে এবার এগোলো অ্যানার দিকে।
অ্যানার কাজ তখনো শেষ হয়নি, আলফাদের ক্ষতগুলো তখনো কাঁচা রয়ে গেছে, পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেনি! কিন্তু তার আগেই নিজের প্রচন্ড কাছে অচেনা কারো উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই গাওয়া থামিয়ে ধাম করে চোখ মেলে তাকালো ও। আর তাকাতেই ওর চোখে পড়লো ইলহানের মুখ খানা, অ্যানার মুখের একেবারেই কাছে নিয়ে এসে অ্যানার মুখ খানা দেখতে লেগে গেছে ও!

নিজের এত নিকটে ইলহানের মুখ খানা দেখা মাত্রই ছিটকে সেখান থেকে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো অ্যানা।
নিজের এত সুন্দর দৃশ্য দেখায় ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত হলো ইলহান। নিজেও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো ও। তারপর ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে মৃদু হেসে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো অ্যানার দিকে।
অ্যানা নিজের চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো, নিজের ডান দিকে চোখ পড়তেই কোকোকে চোখে পড়লো ওর। কোকোর চোখ জোড়া নড়ছে, পলক ফেলছে ও বারে বারে, কিন্তু হুসে নেই৷ কোকোর এমন অবস্থা দেখে অ্যানার চোখ মুখ এবার ভয়ানক রকম শক্ত হয়ে গেলো। নিজের আর্মরের কব্জির নিকট থেকে শব্দ করে সৌর্ড টা বের করে ও প্রস্তুতি নিলো ইলহানের সাথে সম্মুখযুদ্ধে যাওয়ার। কিন্তু অ্যানাকে এমন হিংস্র মুখে সৌর্ড বের করতে দেখে ইলহান দাঁড়িয়ে গিয়ে অ্যানার দিকে এক টুকরো মিষ্টি হাসি ছুড়ে দিয়ে বলে উঠলো,

— আরে আরে, করছো কি! আমি কি বলেছি তোমার সাথে আমি যুদ্ধে যাবো? কখনোই না। এমন মিষ্টি একটা মেয়েকে আঘাত করা আমার পক্ষে অন্তত সম্ভব হবে না।
তারপর এক পা এক পা করে অ্যানার দিকে এগোতে এগোতে বলল,
— আজ আমার হাতে তোমার বিলাভ্‌ড হাজবেন্ড শহীদ হতে চলেছেন। এবং সেই সাথে তুমিও খুব দ্রুতই আমার হতে চলেছো! এমন মিষ্টি একটা মেয়ে, তারওপর নিজের হবু বউ, তাকে কি করে আমি আঘাত করি বলো! এমন তুলতুলে মেয়ে তো আঘাত করার জন্য নয়, রাতভর বিছানায় ফেলে আদর করার জন্য!

নোংরা একটা হাসি দিয়ে ইলহান দাঁড়ালো অ্যানার একেবারে সামনে। অ্যানা দাঁতে দাঁত পিষে ওর হাতের সৌর্ড টার হাতল ধরলো শক্ত করে। তারপর ইলহানকে চমকে দিয়ে তড়িৎ গতিতে সৌর্ড টা চালিয়ে দিতে গেলো ইলহানের শরীরে, কিন্তু শেষ মুহুর্তে ইলহান টের পাওয়া মাত্রই ছিটকে সরে এলো সেখান থেকে, তারপর বুকে হাত দিয়ে জোরে দম ছেড়ে অ্যানার উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
— উফফ! তুমি তো দেখি ডেঞ্জারাস মেয়ে! ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে আমাকে। আর একটু হলেই তো একটা পিচ্চি মেয়ের হাতে নিজের জান খোয়াতাম!
ওর কথাকে অগ্রাহ্য করে অ্যানা আবারও সৌর্ড টা উঁচিয়ে এগিয়ে আসতে নিলো, কিন্তু ইলহান আগের মতোই মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,

— শোনো মেয়ে, তোমাকে আমি আঘাত করতে চাইনা! তোমার ওই মাখন কোমল, নিখুঁত, নিপুণ শরীরে কোনো ক্ষতচিহ্ন হোক তা আমি চাইনা! আমি একটা স্পেকলেস, টেন্ডার শরীর চাই, দ্যাটস অ্যল!
ইলহানের এমন কথায় গা জ্বলে গেলো অ্যানার, ও দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো,
— আমার শরীরে আপনার একটা সামান্য পশমের ছায়া পড়ার আগেই আপনি টুকরো টুকরো হয়ে যাবেন! দুঃসাহস দেখানোরও একটা সীমা থাকে, সেই সীমা অতিক্রম করবেন না। নইলে এমন বিপদে পড়বেন, যে প্রাণ বাচানোর জন্য পায়ে ধরে বসে থাকতে হবে!
অ্যানার কথা শুনে ইলহান শব্দ করে হাসলো, তারপর বলল,

— দুঃসাহসের তো এখনো কিছুই দেখোনি আনাবিয়া! ওই সাম্রাজ্য আমার হলে তুমিও আমার হবে। এর কোনো নড়চড় হবে না। আমার জীবনের বাকি সমস্ত রাত আমি তোমার ওই সফটি সফটি শরীরের ওপর কাটাবো! অ্যান্ড আ’ কান্ট ওয়্যেট ফ’ দ্যোজ মোমেন্ট!
শেষোক্ত কথা টা বলে ইলহান অ্যানার আর্মরে মোড়ানো শরীরটার দিকে নোংরা দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়ে মুখ দিয়ে লালা টেনে নেওয়ার মত শব্দ করলো।
অ্যানার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেলো এবার। ইলহানের দিকে শিকারী দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতের সৌর্ড টা ও আবার হাতের আর্মরের ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো। ইলহান ভেবে নিলো অ্যানা হয়তো ওর সাথে সম্মুখযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলেছে৷ মিষ্টি হেসে ও আবার এগোলো অ্যানার দিকে। কিন্তু দুকদম আগানোর পরই হঠাৎ করেই অদ্ভুতভাবে কাঁপতে শুরু করলো কারখানার তলার মাটি।

ভড়কে গেলো ইলহান, কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো ও একবার অ্যানার দিকে, অ্যানা অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকিয়ে হাত জোড়া মাটির দিকে শক্ত করে ধরে ইশারা করে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে! আর তার পরমুহূর্তেই মাটি ফুড়ে, কারখানার শক্ত মেঝে ছিড়ে ফুড়ে বেরিয়ে এলো এক ঝাক শক্ত পোক্ত, মোটাসোটা সুচালো অগ্রের গাছের শিকড়।
শিকড় গুলো মাটি ফুড়ে বের হতেই অ্যানা হাতের ইশারায় সেগুলোকে ইলহানের দিকে যেতে নির্দেশ করলো, শিকড় গুলো অ্যানার ইশারার সাথে সাথেই ঝড়ের গতিতে ধাওয়া করতে শুরু করলো ইলহান কে৷ ঘটনার আকস্মিকতায় ইলহান দিশেহারা হয়ে উঠলো যেন!
শেহজাদী দের কে অনেক ধরনের পাওয়ার দেওয়া হয় সেটা সম্পর্কে সে জানতো, কিন্তু এমন অদ্ভুত শক্তি যে দেওয়া হয় তা ওর জানা ছিলো না! তড়িৎ গতিতে ও নিজের জায়গা থেকে ছুটে সরে গিয়ে শিকড় গুলোর আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিলো।

অ্যানা ইলহানের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে রাখতে শিকড় গুলোকে ইলহানের পেছন পেছন তীব্র গতিতে পাঠাতে শুরু করলো। ইলহান নিজের পোশাকের পেছনে থাকা একটি ধারালো নাইফ বের করে সুচালো শিকড় গুলো কে নাইফ টা দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে একের পর এক কোপ দিয়ে কেটে দিতে দিতে নিজের শরীর টা বাঁচিয়ে নিতে লাগলো বারবার।
কিছুক্ষণ শিকড়ের থেকে পালিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ইলহানের হঠাৎ চোখ গেলো কোকোর পাশে থাকা নাইফ টার দিকে৷ ইলহান এক ফাকে ছুটে গিয়ে মেঝে থেকে তুলে নিলো সে নাইফ টা, তারপর দুহাতে অ্যানার প্রেরণ করা শিকড় গুলোর ওপর দু হাতে সমানে কুপিয়ে কেটে ফেলতে ফেলতে অ্যানার দিকে এগোতে লাগলো।
অ্যানার শরীরে আর কুলিয়ে দিচ্ছে না! শিকড় গুলো মাটি থেকে উঠিয়ে আনতে গিয়ে ওকে যথেষ্ট এনার্জি খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু ইলহান যে গতিতে শিকড় গুলোকে খতম করতে করতে এগোচ্ছে তাতে অ্যানার পক্ষে বেশিক্ষণ শিকড় গুলোকে ধরে রাখা সম্ভব হবে না!

ইলহান শিকড় গুলকে ধ্বংস করতে করতে অ্যানার কাছাকাছি চলে আসতেই অ্যানা শিকড় গুলো থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নিলো। তারপর তড়িৎ গতিতে আবার নিজের আর্মরের কব্জির ভেতর থেকে বের করলো ওর সৌর্ড খানা। আর এরপর ইলহান এগিয়ে এসে দুহাতের নাইফ দুটো দিয়ে অ্যানার ওপর আক্রমণ করতে যাওয়ার আগেই অ্যানা ওর সৌর্ড টা নিজের দুহাতে উঁচিয়ে ধরে আটকে দিলো ইলহান কে।
এরপর গায়ের সর্বোচ্চ জোর দিয়ে ইলহান কে সৌর্ড টার সাহায্যে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো ও পেছন দিকে। কিন্তু ইলহান দমে না গিয়ে দ্বিগুন শক্তিতে দুহাতের নাইফ দুটো দক্ষতার সাথে ঘুরিয়ে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করতে এলো অ্যানাকে। কিন্তু ইলহান আক্রমণ করার আগেই অ্যানা ক্ষীপ্র গতিতে নিজের জায়গা থেকে সরে গিয়ে তড়িৎ গতিতে চলে গেলো ইলহানের পেছন দিকটাতে।

ঘটনার আকস্মিকতায় ইলহান চমকালো, অ্যানা যে এমন দ্রুত গতিতে চলতে পারে তা ওর ধারণাতে ছিলো না। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই অ্যানা নিজের সৌর্ড টা তীর্যকভাবে উঁচিয়ে ইলহানের গলা বরাবর নিয়ে গেলো বিদ্যুৎ গতিতে। কিন্তু ইলহান দক্ষতার সাথে এবারও নিজের নাইফ দুটোর সাহায্যে বেচে গেলো অ্যানার হাত থেকে৷
ইলহান অ্যানার থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে অ্যানার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকালো। অ্যানার এমন ফাইটিং স্টাইলে অভিভূত হলো ও যেন। মীর বউকে ভালোই ফাইটিং শিখিয়েছে! কিন্তু এসবের মাঝেই ইলহান এবার নিজের শেষ চাল টা চাললো।

অ্যানাকে নিজের দুহাতে থাকা নাইফ জোড়া দিয়ে আক্রমণ করতে গেলো ও আবারও, অ্যানা নিজেও ইলহানের আক্রমণ ঠেকাতে নিজের সৌর্ড খানা দ্রুত গতিতে দক্ষতার সাথে বাড়িয়ে দিলো ইলহানের দিক থেকে ধেয়ে আসা নাইফ দুটোর দিকে। কিন্তু ইলহান ঠিক সেই মুহুর্তেই নাইফ দুটোকে উপর থেকে নিচু করে নিয়ে নিজেও ঝুকে গিয়ে অ্যানার আক্রমণ থেকে বেচে তড়িৎ গতিতে চলে গেলো অ্যানার পেছন দিকটাতে। আর এরপর অ্যানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই অ্যানার পিঠের নিচ বরাবর নিজের গায়ের সর্বোচ্চ জোর দিয়ে একটা লাথি দিলো ইলহান।
অ্যানা ছিটকে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো সামনে, হাত থেকে ছিটকে আর একদিকে চলে গেলো ওর সৌর্ড খানা৷ আর এই সুযোগ টাকেই কাজে লাগালো ইলহান।

হাতের নাইফ দুটোকে দক্ষতার সাথে শূন্য ছুড়ে ঘুরিয়ে এনে আবার ধরলো, তারপর ঝড়ের গতিতে এগিয়ে গেলো অ্যানার দিকে। অ্যানা নিজেকে সামলে নিয়ে উঠতে গেলো মেঝে ছেড়ে, কিন্তু তার আগেই ইলহান সেখানে পৌছে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা অ্যানাকে এক ঝটাকায় তুলে সোজা করলো তারপর নিজের হাতের নাইফ দুটোর একটাকে শক্ত করে ধরলো ওর গলায়।
মাঝেতে পড়ার ফলে অ্যানার মুখের এক পাশ টা ছড়ে গেছে, সে জায়গা টা থেকে শিশির বিন্দুর ন্যায় বিন্দু বিন্দু রক্ত বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে৷ ইলহান সেদিকে তাকিয়ে আফসোস সূচক শব্দ করে ধীর গলায় বলে উঠলো,

— আগেই বলেছিলাম আমি তোমাকে আঘাত করতে চাই না! গেলো তো লেগে আঘাত! তুলতুলে মুখ খানাতে দাগ কেটে ফেলেছো! কি হবে এইবার? সমস্যা নেই, আমি তবুও তোমাকে গ্রহণ করবো, সাদরে।
শেষোক্ত কথা টা বলে ইলহান তার দিকে অসহায়ের ন্যায় তাকিয়ে থাকা অ্যানার চোয়ালের ছড়ে যাওয়া অংশটার দিকে নিজের ঠোঁট জোড়া বাড়িয়ে দিতে নিলো, কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তেই কারখানার ডান দিক থেকে বিকট এক শব্দ হলো। আর এরপর শব্দ হতেই থাকলো একের পর এক। ইলহান স্পষ্ট টের পেলো কারখানার দেয়াল গুলো ভেঙে কেউ ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।

আর তার এই ভেবেচিন্তে উঠার ঠিক শেষ মুহুর্তেই তাদের বর্তমান কামরাটার ডান দিকের দেয়াল টা বিকট শব্দ করে ভেঙে পড়ে গেলো মেঝেতে, আর ভেঙে পড়ে যাওয়া দেয়াল টির অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো আগুন চোখের অধিকারী স্বয়ং বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান কে।
মেঝেতে বসে অ্যানার চোয়ালে ঠোঁট ছোয়ানোর চেষ্টা করার চেষ্টারত ইলহানের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে ক্ষীপ্র, হিসহিসে কন্ঠে বলে উঠলো,
— ড্যোন্ট ইয়্যু ডেয়ার!

মীরের এমন হঠাৎ উপস্থিতিতে ইলহান যেন ভড়কালো কিছুটা। হাতের নাইফ টা আলগা হয়ে এলো ওর নিজের অজান্তেই৷ অ্যানা সে সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে এক ঝটকায় ইলহানের হাত থেকে নাইফ টা ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে দিলো দূরে, তারপর তড়িৎ গতিতে ইলহানের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে এক ছুটে মীরের বুকে গিয়ে আছড়ে পড়লো। মীর এক হাতে অ্যানা কে জড়িয়ে নিয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে ইলহানের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই অ্যানার খোলা চুলের ওপর দিয়ে শব্দ করে একটা চুমু খেলো অ্যানার মাথায়।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মীর ইলহান কে পর্যবেক্ষণ করলো কিছুক্ষণ। ইলহান নিজেও মেঝে থেকে উঠে মীরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মীরের চাহনির পালটা জবাব দিতে শুরু করলো। ইলহানের পরণে ফর্মাল পোশাক; একটা সাদা রঙা শার্ট, নেভি ব্লু রঙা প্যান্ট, আর শার্টের ওপর বুক খোলা নেভি ব্লু রঙা ওভার কোট।
মীর ঘাড় কাত করে একবার দেখলো ওকে। তারপর অ্যানাকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে নিজের পেছনে দিয়ে দিলো। আর তার পরমুহূর্তেই নিজের হাত জোড়া সামনে উঁচু করে ধরে একটা ঝটকা দিলো। সাথে সাথেই মেটালিক সাউন্ড তুলে ওর শরীরের আর্মর টা অদৃশ্য হয়ে লুকিয়ে পড়লো কোথাও। আর্মর টা অদৃশ্য হতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা পাতলা ফিনফিনা শার্ট পরিহিত মীরের পেশিবহুল বলিষ্ঠ শরীর টা৷

বুকের নিকট থেকে কয়েকটি বোতাম খোলা, বুকের মাঝখানের পুরুষালি খাজ টা স্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান হয়ে রইলো। আর সেই সাথে ওর চোখের স্বর্ণালি দ্যুতি ছড়ানো লেন্স জোড়া সহ চোখের সাদা অংশ টাও পুরোপুরি কুচকুচে কালো বর্ণ ধারণ করলো। ওর কালো রঙা শরীরের সাথে চোখ জোড়া যেন একেবারে মিশে গেলো, মনে হতে লাগলো এক জোড়া ফাকা অক্ষিকোটর নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
অ্যানা একপলক তাকালো মীরের দিকে। তাকিয়েই গলা শুকিয়ে গেলো ওর, চরম বিপদসংকেত! অ্যানা দ্রুত গতিতে মীরের পেছন থেকে সরে ছুটে গেলো কোকোর কাছে, কোকো ততক্ষণে নিজেকে খানিকটা স্বাভাবিক করে নিয়েছে৷ অ্যানা দ্রুত গতিতে কোকো কে মেঝে থেকে উঠাতে উঠাতে আতঙ্কিত গলায় বলল,

— কোকো, এখনি আমাদের এজায়গা থেকে সরতে হবে!
কোকো অ্যানার কথাটা শুনে ভয়ঙ্কর কিছুর আঁচ পেয়ে নিজেও তাকালো মীরের দিকে। মীরের চোখ জোড়া দেখা মাত্রই কোকো উত্তেজিত হয়ে পড়লো৷ অ্যানার সাহায্যে এতক্ষণ উঠলেও এবার অ্যানার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

— আম্মা, আলফাদের এখনো জ্ঞান ফেরেনি, আপনি ওকে দেখুন, আমি নিজে নিজে যেতে পারবো৷
কোকোর কথায় আস্বস্ত হয়ে অ্যানা হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো আলফাদের নিকট। তারপর মেঝেতে অচেতন হয়ে পড়ে থাকা আলফাদ কে একটানে উঠিয়ে নিজের কাধের ওপর নিলো। এরপর কোকো কে ইশারায় নিজের পেছন পেছন আসতে বলে বেরিয়ে গেলো আগে আগে৷ কোকো আবারও একপলক মীরের দিকে তাকিয়ে এগোলো অ্যানার পেছন পেছন। শেষ বার বাদশাহর এমন চোখ দেখেছিলো যেবার অ্যানা ভার্সিটি থেকে কিডন্যাপ হয়েছিলো, সেদিনের কথা মনে পড়লেও কোকোর আত্মা কেঁপে উঠে৷ আজ এই ইলহানের কপালে কি আচ্ছে সেটা শুধু সৃষ্টিকর্তাই ভালো বলতে পারেন৷ যদিও ইলহান যথেষ্ট শক্তিশালি, তবুও কি হয় বলা যায় না! কোকো এসব ভাভতে ভাবতে এক প্রকার ছুটে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।

ইলহান মীরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মীরের চোখ জোড়া দেখতে লেগে পড়লো। মীরের এমন চোখ ও এর আগে কখনো দেখেনি! আর স্বর্ণালি দ্যুতি ছড়ানো চোখ জোড়া হঠাৎ এমন ঘুটঘুটে অন্ধকারের ন্যায় কালো বর্ণ কেন ধারণ করেছে সেটাও মাথায় এলো না ওর৷
মীর ইলহানের দিকে শকুনি দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করেই ওর ঝকঝকা ধারালো দাঁত গুলো বের করে ভয়ঙ্কর ভাবে হাসলো তারপর শক্ত কন্ঠে হাসি মিশিয়ে বলে উঠলো,
— লং টাইম নো স্যি, বিগ ব্রাদার!

ইলহান কোনো প্রতিউত্তর করলো না মীরের কথার। মীরের দিকে শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলো। এই ছেলেটা ওর থেকে প্রচুর শক্তিশালি! কিশোর বয়সে একবার দাদাজানের সাথে ফাইটিং প্রাকটিস করতে গিয়ে মীর অসাবধানতা বসত দাদাজানের চোয়ালে পাঞ্চ মেরে বসেছিলো, সেটা ছোটখাটো পাঞ্চ ছিলো ঠিকই কিন্তু ওই এক পাঞ্চে দাদাজানের দাঁত নড়ে গেছিলো দুটো। কিশোর বয়স পার করে মীর এখন তার যৌবনের মধ্যপথে। এখন নিশ্চয় সে আরও শক্তিশালি হয়েছে!

ইলহান নিজে কখনো মীরের সাথে সম্মুখযুদ্ধে না গেলেও লোকমুখে শুনেছে অনেক অনেক কথা, তাদের মতে মীর ‘ভয়ঙ্কর’। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনো ওকে চটিয়ে ওর সাথে সম্মুখযুদ্ধে যেতে চাইবে না।
ইলহান নিজেও এতগুলো বছরে নিজেকে রাত দিন এক করে প্রস্তুত করেছে, তবুও কোথাও না কোথাও একটা ভয় থেকেই যায়! আর এখন মিরের যে চেহারা আর দেহ ইলহান দেখছে তাতে ওর বুকের ভেতর জুড়ে একটা শীতল ঝড় বয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কিন্তু এটা মীর কে সেটা বুঝতে দিলেই কাজ শেষ!
ইলহান নিজের মুখের এক্সপ্রেশন টা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো মীরের নিকট। তারপর মীরের থেকে একটা নির্দিষ্ট দুরত্বে দাঁড়িয়ে দু হাত পেছনে বেধে ও বলে উঠলো,

— কংগ্রাচুলেশনস, আমাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য। কিন্তু একটু ল্যেইট করে ফেললি। আমি তো ভেবেছিলাম এমন যোগ্য, শক্তিশালী, বুদ্ধিমান বাদশাহর আমাকে ধরতে দু সেকেন্ডও লাগবে না। কিন্তু আমার ধারণা দেখি ভুল! আমাকে ধরতে পঞ্চদ্বীপের একমাত্র যোগ্য বাদশাহর দু বছর লেগে গেলো! কাইন্ডা ইনসাল্টিং!
শেষোক্ত কথাটা ভ্রু উঁচিয়ে ঠোঁট উলটে বলল ইলহান। ইলহানের কথা শুনে মীর আবার ঠিক আগের মতো করেই একটা ভয়ঙ্কর হাসি দিলো, তারপর হুট করেই হাসি থামিয়ে বলে উঠলো,

— আমার যোগ্যতা বিচার করার মতো যোগ্যতা যার নেই তার কথা আমি গোনায় ধরিনা। ফাঁকা মাঠ পেয়ে নেড়িকুত্তা যতই লাফাক না কেন, জঙ্গলের সিংহ কে সামনে দেখলে তার লাফানো মুহুর্তেই ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়, পালানোর জন্য সে তখন গর্ত খুজে। এখন, এই মুহুর্তে তোর অবস্থা টা তেমনই হয়েছে!
এতগুলো বছর ধরে এত প্রস্তুতি নিয়ে, এত লাফালাফি করে লাভ কি হলো? সেই তো আমার সামনে এসে ক্যাও ক্যাও করা লাগছে! আচ্ছা, যাকগে ওসব কথা। এখন বল, কি চাই তোর? কিসের জন্য এমন লাফালাফি করছিস? আমার সাম্রাজ্য?

— তোর সবকিছু। লাভ, ফেইম, প্যালেস, পাওয়ার এভরিথিং!
মীরের দিকে মুখ টা উঁচিয়ে শক্ত চোখে তাকিয়ে বলল ইলহান। ইলহানের কথা শুনে মীর এবার কারখানাটা কাঁপিয়ে হোহো করে হেসে উঠলো। ওর সে হাসিতে কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত হলো ইলহান। কিন্তু নিজের বিভ্রান্তি টা সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়ে মুখ খানা আগের মতোই স্থির করে রাখলো। কিছুক্ষণ পর মীর হাসি থামিয়ে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত রেখেই বলে উঠলো,
— মানে…… মানুষের কত রকমের স্বপ্ন!
আচ্ছা! ঠিক আছে, ল্যেটস ফাইট। তুই যদি আমাকে হারিয়ে জিততে পারিস তবে আমার এই সাম্রাজ্য, ফেইম, প্যালেস, পাওয়ার সব তোর৷

— অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবাউট আনাবিয়া?
মীরের দিকে আবারও দুকদম এগিয়ে এসে প্রশ্ন ছুড়লো ইলহান। ইলহানের এই প্রশ্নে মীর হঠাৎ করেই ওর চোয়াল জোড়া শক্ত করে নিলো। তারপর ঘাড় টা ডান দিকে সামান্য কাত করে বলে উঠলো,
— শ্যি ইজ মা’ ওয়াইফ, নট অ্যা প্রোডাক্ট যে তাকে নিয়ে তোর সাথে আমি সওদা করবো। আর হ্যাঁ, দ্বিতীয়বার কখনো আমার স্ত্রীর নাম টা মুখে উচ্চারণও করবিনা। যদি করিস তবে আমি ভুলে যাবো যে তুই আমার মায়ের পেটের আপন ভাই!

কথাটা বলে মীর নিজের পিঠের পেছনে ঘাড়ের ওপর দিয়ে দু হাত বাড়িয়ে ওর অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আর্মরের ভেতর থেকে ধাতব শব্দ সহকারে এক ঝটকায় দুহাতে দুইটা বিশালাকার নান চাকু বের করে নিয়ে এলো৷ তারপর দুটোর একটাকে ছুড়ে দিলো ইলহানের দিকে। ইলহান সেটাকে হাত উঁচু করে বিদ্যুৎ গতিতে ধরে ফেলে নিজের সামনে সোজা করে ধরে নান চাকুটার ওপর দিয়ে তাকিয়ে মীরের চোখে চাইলো। আর মীর এক হাতে নান চাকু টা ঘোরাতে ঘোরাতে ইলহানের দিকে তাকিয়ে নিজের ঠোঁটের হাসি আবারও প্রসারিত করে বলে উঠলো,

— ওখ্যেই দ্যেইন, ল্যেটস বিগ্যিন!
মীরের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইলহান হুট করেই ছুটে এসে নান চাকু টা ঘুরিয়ে তড়িৎ গতিতে আঘাত করে বসলো মীর কে, কিন্তু নান চাকুটা মীরের শরীরে আঘাত করার ঠিক আগ মুহুর্তেই ক্ষীপ্র গতিতে, চোখের পলকে সে জায়গা থেকে সরে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো মীর। ব্যাপার টা এতটাই দ্রুত ঘটলো যে ইলহানের ব্যাপারটা বুঝে উঠতে সময় লেগে গেলো কয়েক সেকেন্ড।
ওর থেকে কিছুটা দূরে কাঁধের ওপর নান চাকুটা রেখে ঘাড় কাত করে দাঁড়িয়ে থাকা মীর বাকা হেসে বলে উঠলো,
— ওপ্‌স, মিস হয়ে গেলো!

ইলহান থমকালো এক মুহুর্তের জন্য, মীর কে সে যতটা স্কিল্ড ভেবেছিলো মীর তার থেকেও বেশি স্কিল্ড। একে এক মিলি সেকেন্ড এর জন্যও হালকা ভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নিলেই বিপদে পড়তে হবে ওকে।
ইলহান এবার মীরের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মীরের প্রতিটা পদক্ষেপ অত্যান্ত মনোযোগের সাথে দেখতে দেখতে আবারও আক্রমণ চালালো। নান চাকু টা দু হাতে ধরে কয়েকবার দক্ষতার সাথে ঘুরিয়ে মীরের দিকে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে গিয়ে মীর কে লক্ষ্য করে একের পর এক আঘাত হানতে শুরু করলো ও। কিন্তু প্রত্যেকবারই ব্যর্থ হলো।
মীর প্রতিটা আঘাত থেকে নিজেকে অত্যান্ত দক্ষতার সাথে বাঁচিয়ে নিলো প্রতিবার, সেই সাথে মুখে লাগিয়ে রাখলো ওর বাকা হাসি টা, যেটা প্রতি মুহুর্তে ইলহান কে মনে করিয়ে দিতে লাগলো তার ব্যার্থতার কথা!

মীরের এমন গা জ্বলানো হাসি দেখে ইলহান যেন এবার মীর কে আঘাত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো, দাঁতে দাঁত চেপে ও মীরের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা করলো আবারও, কিন্তু মীর প্রতিবারের মতো ইলহানের প্রতিটা আঘাত থেকে নিজের শরীর কে ক্ষীপ্র গতিতে সরিয়ে নিয়ে, নিজে কোনো পালটা আঘাত করা ছাড়াই নির্বিকার মুখে তাকিয়ে রইলো ইলহানের ওই রাগে জ্বলে যাওয়া মুখ খানার দিকে।
ইলহান এবার ধৈর্যহারা হলো। হাতের নান চাকু টা ফেলে দিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা নাইফ দুটোকে কুড়িয়ে হাতে নিলো ও। মীর সে নাইফ দুটোর দিকে তাকালো একবার, ইলহানের ডান হাতের নকশা করা নাইফ টা অ্যানার। মীর নিজের হাতে যত্নসহকারে তৈরি করে তার প্রেয়সীকে উপহার দিয়েছিলো। ওই নকশা গুলো কতটা মনোযোগ দিয়েই না ও খোদাই করেছিলো!

মীর নাইফের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে ইলহানের চোখের দিকে তাকালো। ইলহানের চোখ জোড়ায় যেন আগুন জ্বলছে। মীর ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করলো আবারও। তারপর হাতের ইশারায় ইলহান কে ফাইটে আমন্ত্রণ জানালো দ্বিতীয় বার৷
ইলহান এবার শক্ত হাতে নাইফ দুটোকে ধরে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে গেলো মীরের দিকে, তারপর নাইফ জোড়া দিয়ে মীরের বুক বরাবর মুহুর্মুহু আক্রমণ চালাতে শুরু করলো ও৷ মীর নিজের নান চাকু টা দিয়ে প্রতিবারই দক্ষতার সাথে ঠেকিয়ে দিলো ইলহানের সে আক্রমণ৷ কিন্তু নিজে পালটা আক্রমণ করলো না।
কিন্তু ইলহানের হাতের ধারালো নাইফ এবার কিছুটা ভারী পড়তে শুরু করলো মীরের ওপর। সেটা দেখে ইলহানের ঠোঁটে এবার বাকা হাসি ফুটে উঠলো।

ইলহান এবার শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। মীরের থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে নাইফ দুটোকে শূণ্যে ছুড়ে দিয়ে ঘুরিয়ে এনে দক্ষতার সাথে ধরলো আবারও। তারপর ঝড়ের গতিতে তেড়ে গেলো মীরের দিকে। দুহাতের নাইফ দুটো একটা মীরের বুকের বা দিক আর অন্য টা মীরের পেটের ডান দিক টা লক্ষ্য করে সর্ব শক্তি দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে গেলো, কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে মীর নিজের নান চাকুতে থাকা ধাতব চেইনের সাহায্যে বিদ্যুৎ গতিয়ে আটকে দিলো ওর হাত জোড়া৷ এরপর ওকে আক্রমণরত ইলহানের বুক বরাবর নিজের শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লাথি কষে দিলো একটা। নান চাকুর চেইনের সাথে ঘষে হাত জোড়া ছিলে গিয়ে ইলহান ছিটকে গিয়ে বাড়ি খেলো কামরার দেয়ালে, তারপর মুখ থুবড়ে পড়লো মেঝেতে। হাত থেকে নাইফ জোড়া কোথায় যেন ছিটকে পড়লো!
ইলহান কে অস্ত্রহীন হতে দেখে মীর মেঝেতে পড়ে থাকা অন্য নান চাকুটা তুলে নিয়ে দুটোই আবার রেখে দিলো নিজের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আর্মরের ভেতরে। তারপর ইলহানের দিকে এগোতে এগোতে নিজের হাত জোড়া এক জায়গাতে নিয়ে শব্দ করে আঙুল ফোটাতে শুরু করলো। তারপর মেঝেতে পড়ে থাকা ইলহানের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে মাথাটা সামান্য ঝুকিয়ে বলে উঠলো,

— ফিল্যিং টায়্যার্ড?
মীরের কথায় ইলহান সাথে সাথেই উঠে দাড়ালো আবার। মীর কে আঙুল ফোটাতে দেখলো ইলহান।
ফ্যিস্ট ফাইট? এটাতে তো সে মাহির! মীর এতক্ষণ তাকে আক্রমণ করেনি ঠিকই, কিন্তু এখন করলেও কোনো সমস্যা নেই। ফ্যিস্ট ফাইটে মীর তাকে কোনোভাবেই হারাতে পারবে না।’
ভেবে নিয়ে নিজের নিজের হাত জোড়া একসাথে করে আঙুল ফোটাতে ফোটাতে মীরের দিকে এগোলো ইলহান। মীর ওকে এগিয়ে আসতে দেখে বাকা হাসলো আবারও। তারপর নিজের ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা দ্বারা ইশারায় ইলহানকেই আবার প্রথম আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানালো৷
ইলহাম এবার আর ভুল করলো না৷ মীরের দিকে ভালোভাবে নজর রাখলো। এই জানোয়ার টা যা কিছু করে ফেলতে পারে, একে নিয়ে কোনো ভরসা নেই৷’

ইলহান নিজের হাতের মুঠি টা শক্ত করে নিলো। তারপর দাঁতে দাঁত পিষে সজোরে আঘাত করতে নিলো মীরের চোয়াল বরাবর। কিন্তু আঘাত করার আগেই তড়িৎ গতিতে ওর মুঠি করে রাখা হাত টা সামনে থেকে ধরে ফেললো মীর।
ইলহানের মনে হলো যেন কোনো প্রস্তরখন্ডের সাথে বেধে গেছে ওর হাত টা! মীরের দিকে অবাক চোখে তাকালো ও। মীরের মুখ খানাতে এখন আর হাসির ছিটে ফোটাও নেই, চোয়াল জোড়া হয়ে আছে ভয়ঙ্কর রকমের শক্ত।
আর ইলহান কে অবাকতার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে দিয়ে মীর এবার সত্যিকার অর্থেই আঘাত করলো ওকে।
এক হাতে ইলহানের ওকে আঘাত করতে যাওয়া হাত টা ধরে অন্য হাত টা মুঠি করে নিয়ে ওর ইস্পাত-দৃঢ় হাত টা দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে একটা বিশাল আঘাত হানলো ও ইলহানের মুখে, সাথে সাথেই ইলহানের ঘাড় টা যেন ঘুরে গেলো কিছুটা অন্যদিকে। সেই সাথে ছিটকে পড়লো ও মেঝেতে। মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ছিটকে চলে গেলো এদিক ওদিক।

আঘাতের দাপটে দম আটকে যেতে লাগলো ইলহানের! ঘাড় টাতে হ্যাচকা টান পড়ায় সেটা সোজা করতে পারছে না ও আর, প্রচন্ড ব্যাথাতে চোখ মুখ কুচকে গেলো ওর!
তারপরও মেঝেতে হাত ঠেকিয়ে আবার উঠে দাড়ালো ও। ইলহান উঠে দাড়াতেই মীর ঝড়ের গতিতে এগিয়ে এলো ওর কাছে, তারপর ওর ঘাড় টা ধরে হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে এসে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো,
— কার যোগ্যতা বেশি সেটাই প্রমাণ করতে চাস তো? দ্যেইন হোয়াই নট উই গ্যো ইন ফ্রন্ট অব পিপলস!
আর কথাটা বলেই ইলহানের ঘাড় টা হাতের ভেতরে শক্ত করে ধরেই ঝড়ের গতিতে হেটে, কারখানার লৌহ নির্মিত দরজা গুলোকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে দিতে ও এগোতে শুরু করলো কারখানার এক্সিটের দিকে৷

অ্যানা বসে আছে কারখানার বাইরে, কারখানার বিপরীতে, রাস্তার ওপারে থাকা একটি পরিত্যাক্ত ভাঙা চোরা বিল্ডিং এর দ্বিতীয় তলার বর্ডার বিহীন ব্যালকনিতে। কারখানাটির দিকে মুখ করে বসে আছে ও। ফ্যালকন নিজের বার্ড ফর্মে এসে অ্যানার কাধের ওপর বসে আছে। কোকোর শরীর এখন মোটামুটি সুস্থ, মাথা টা মাঝে মাঝে ঘুরে উঠছে যদিও। আলফাদ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছে৷ লিও, হাইনা আর জোভি, তিনজনে মিলে বসে আছে অ্যানাদের বিল্ডিংয়ের নিচের মাটিতে।
অ্যানার মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ইলহান মীরের সাথে কখনোই পেরে দিবে না জানা সত্বেও বুকের ভেতর টা ওর অজানা আতঙ্কে বার বার কেঁপে উঠছে৷ হাটুতে থুতনি ঠেকিয়ে দুহাতে পা জোড়া জড়িয়ে ধরে মীরের বর্তমান অবস্থা ভেবে চলেছে ও।

কারখানার চারপাশ টা ঘেরাও করে অস্ত্রহাতে দাঁড়িয়ে আছে শয়ে শয়ে আর্মি। কারখানার ভেতর টা রেইড চালিয়ে সেখান থেকে সমস্ত অপরাধীদের কে ধরে ধরে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেছে এক দল। আর ওরা নিরাপত্তার স্বার্থে এখনো এখানেই অবস্থান করছে৷

এমন সময় কারখানার ভেতর থেকে হঠাৎ করেই বিকট দুম দাম শব্দ হতে শুরু করলো। অ্যানা নিজের ভাবনা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো সে শব্দের কারণে। বাইরে থাকা আর্মি গুলো নিজেদের অস্ত্রসস্ত্র গুলো শক্ত হাতে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। বাদশাহর ওপর কোনো আক্রমণ ভারী পড়লেই অ্যাকশনে নেমে যাবে ওরা, কাকে কি করছে দেখবে না৷
কারখানার ভেতর থেকে ভেসে আসা শব্দটা ধীরে ধীরে আরও জোরালো হতে শুরু করলো। আর তারপর শেষ মুহুর্তে এসে কারখানার প্রবেশ পথের দরজাটা ভেতর থেকে আসা কোনো দুর্বার আঘাতে কাঠামো থেকে খুলে উড়ে এসে আছড়ে পড়লো রাস্তার ওপর। আর তার পরমুহূর্তেই এক হাতে ইলহানকে ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসতে দেখা গেলো মীর কে!

ইতোমধ্যেই কুরো আহমারে জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে যে কুরো আহমারের অ্যাবানডন্ড এরিয়াতে কোনো কিছু ঘটছে। ঝাকে ঝাকে আর্মিদেরকে সেদিকে যেতে দেখে উৎসুক জনতার কিছু অংশ সেদিকে আগাতে নিলে আর্মিরা তাদের কে কড়া ভাবে নিষেধ করে যায় সেদিকে এক পাও না এগোতে। কিন্তু আর্মির কথা শুনে তারা না এগোলেও শহরেও এক ঝাক দুষ্টু পোলাপান নিজেদের ড্রোন আকাশে উড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছিলো যে সেখানে আসলে কি হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ করেই কারখানার ধাতব দরজাটা ভেঙে এমন পেশিবহুল, বলিষ্ঠ শরীরের কাউকে বের হতে দেখে তারা চমকালো ভীষণ ভাবে। এবং তাকে দেখে আর্মিদের একটা নির্দিষ্ট দুরত্বে পিছিয়ে যেতে দেখে তারা আরও অবাক হলো।

আর এরপর নিজেদের ড্রোনে ক্যাপচার করতে থাকা ভিডিওটা তারা কুরো আহমারের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং টায় থাকা লাইভ বিলবোর্ডের সাথে কানেক্ট করে দিলো। আর এতক্ষণ ধরে পরিত্যক্ত এরিয়াটায় ঠিক কি চলছে সেটা জানার জন্য উৎসুক হয়ে থাকা জনতা ভিড় জমালো বিল্ডিং টির চারপাশ জুড়ে। ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলো উনি স্বয়ং বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান। আর এই কথা টা শোনা মাত্রই হইচই পড়ে গেলো সমস্ত শহর টা জুড়ে। পুরো শহর টা যেন থমকে গেলো একেবারে, সকলে তাকিয়ে রইলো বিলবোর্ডে ফুটে থাকা কুচকুচে কালো রঙা ইস্পাত-দৃঢ় শরীরের পুরুষটির হিংস্র মুখ খানার দিকে।

মীর ইলহান কে ঘাড় ধরে বাইরে নিয়ে এসেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো নিচে। অ্যানা ব্যালকনির ওপরে ত্রস্ত ভঙ্গিতে নড়ে চড়ে বসলো। আর্মি ফোর্স টা সচকিত হয়ে অস্ত্র গুলো হাত থেকে সম্মান প্রদর্শনমূলক ভঙ্গিতে হাত থেকে নামিয়ে নিজেদের পায়ের সাথে ঠেকিয়ে রেখে দিলো নিচে৷ বাচ্চা রা সকলে মীর কে দেখা মাত্রই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।
মীর ধীর পায়ে এগিয়ে এলো মাটিতে পড়ে থাকা ইলহানের দিকে। ঘাড়ের শিরায় টান পড়ায় ইলহানের জন্য খুব অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে। তবুও ও শক্ত হাতে মাটিতে ভর দিয়ে উঠে দাড়ালো। তারপর নিজেও এগিয়ে গেলো মীরের দিকে। মীর ইলিহানের একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে নিজের মাথা খানা সামান্য ঝুকিয়ে ইলহানের উদ্দ্যেশ্যে কঠিন গলায় বলে উঠলো,

— তোকে শেষ সুযোগ দিচ্ছি, আস্ক ফ’ মা’ ফরগিভনেস। তোকে জীবিত ছেড়ে দেবো। সোজা ডার্ক প্যালেসে চলে যাবি, আর এই জীবনে কখনো ডার্ক প্যালেস থেকে ভুলেও বের হবি না।
— কখনোই না, আমার সাম্রাজ্যের অধিকার আমি আদায় করে ছাড়বো!
নিজের থেকে দুই ইঞ্চি লম্বা মীরের মুখের দিকে মাথা টা উঁচিয়ে হিসহিসে কন্ঠে উত্তর করলো ইলহান।
মীর ইলহানের দিকে কিছুক্ষণ আফসোস সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো সামান্য, তারপর বলল,

— ঠিক আছে, যেচে মরণ চাইলে আমার তো কিছুই করার নেই!
ঠিক সেই মুহুর্তে মীর কে কিছু বুঝতে না দিয়ে ইলহান হঠাৎ করেই ওর পোশাকের পেছন থেকে এক টানে বের করলো এতক্ষণ ধরে লুকিয়ে রাখা একটি ধারালো নাইফ।
মীর সেটা টের পেয়ে ইলহানের নিকট থেকে সরে যাওয়ার আগেই ইলহান সেটাকে তড়িৎ গতিতে ঢুকিয়ে দিলো মীরের বুকের ডান পাশের রিব কেজের ঠিক নিচে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো সকলে!
ব্যালকনির ওপর থাকা অ্যানা এ দৃশ্য দেখে যেন তাল হারিয়ে ফেললো, চিৎকার করে উঠে মীরের কাছে যেতে নিলো ও, কিন্তু দূর থেকে মীর অ্যানার দিকে না তাকিয়েই নিজের ডান হাত টা ওর দিকে উঁচু করে ওকে ওখানেই থাকতে নির্দেশ করে পেটের ভেতর ঢুকে যাওয়া নাইফ টা এক টানে বের করে নিয়ে আসলো, গলগল করে গাঢ় মেরুণ রঙা রক্ত বেরিয়ে আসলো ক্ষতস্থান টা থেকে৷ তীব্র ব্যাথায় মুখ কুচকে একটা অস্ফুট শব্দ বের হয়ে আসলো ওর মুখ থেকে। পুরো টা সময় ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও ইলহানের চোখ জোড়ার দিকেই নিবদ্ধ করে রাখলো!

মীরের নিজের শরীর থেকে এতটা নির্বিকার ভঙ্গিতে নাইফ টেনে বের করার দৃশ্য দেখে ইলহান ভড়কালো৷ দুকদম পেছনে সরে গেলো ও সাথে সাথেই৷ কিন্তু সেটা ওর কোনো উপকারে আসলো না৷ মীর নিজের ক্ষতস্থান টাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে ইলহানের দিকে ক্ষীপ্র গতিতে এগিয়ে ঝড়ের বেগে সজোরে একটা ফিস্ট ব্লো বসিয়ে দিলো ইলহানের মুখের ওপর। মীরের আঘাতে নিজের জায়গা থেকে ছিটকে কয়েক মিটার দূরে গিয়ে মাটিতে শব্দ করে আছড়ে পড়লো ইলহান।

কিন্তু মীর এবার আর থামলো না। তড়িৎ গতিতে ছুটে গেলো মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়া ইলহানের নিকট, তারপর ওকে মাটি থেকে হ্যাচকা টানে সোজা করে মাটিতে শুইয়েই ওর বুকের ওপর উঠে বসে ওর মুখের ওপর দু হাতে সজোরে একের পর এক ফিস্ট ব্লো দিতে শুরু করলো ও ঝড়ের গতিতে! বেসামাল হয়ে পড়লো ইলহান, দম নেওয়ার জন্য হাসফাস করতে শুরু করলো ও, কিন্তু দম নেওয়ার ও সুযোগ দিচ্ছে না মীর ওকে৷ একের পর একে সজোর আঘাতে ওর ত্রাহিত্রাহি অবস্থা হয়ে গেলো যেন। ওর মুখের মাংস গুলো থেতলে ফেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে শুরু করলো। আর মীরের প্রতিটা আঘাতে সে রক্তগুলো ছিটকে পড়তে লাগলো চারদিকটায়!

ইলহান কয়েকবার হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলো মীর কে, কিন্তু মীর ওর হাত জোড়া দুহাতে ধরে সজোরে ঘুরিয়ে মুচড়ে দিয়ে নিজের হাটুর নিচে দিয়ে মাটিতে চেপে রেখে আবারও করতে শুরু করল একের পর এক আঘাত। মীরের আঘাতের চোটে কয়েকটা দাঁত খুলে ছিটকে বেরিয়ে এলো দম নেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকা ইলহানের মুখ থেকে।
ইলহান এবার মীরের আঘাতের মাঝখানেই প্রবল চেষ্টার পর অতি কষ্টে হাসফাস করতে করতে মুখ থেকে বের করলো কয়েকটি অস্ফুট শব্দ,

— আমাকে ছেড়ে দাও, আমি ক্ষমা চাচ্ছি! আর কখনো ডার্ক প্যালেস থেকে বের হবো না!
মুখনিঃসৃত শব্দ গুলোর সাথে সাথে ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো রক্ত মিশ্রিত লালা। মীর হাত উঁচিয়ে আরও আঘাত করতে নিচ্ছিলো, কিন্তু ইলহানের কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই ওর আঘাত করার জন্য উঁচু করে রাখা হাত টা স্থীর হয়ে গেলো। ইলহান আঘাত থেকে সাময়িক সময়ের জন্য মুক্তি পেয়ে সজোরে দম নেওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করলো! কিন্তু সমস্ত নাক মুখ রক্তে ভর্তি থাকায় ক্ষণে ক্ষণে কাশি দিতে শুরু করলো ও, কাশির সাথে রক্ত বেরিয়ে সমস্ত মুখমণ্ডল জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো বারে বারে।

মীর এতক্ষণ ইলহানের মুখের দিকে ঝুকে ছিলো৷ কিন্তু ইলহানের ক্ষমা চাওয়া শুনে সোজা হয়ে বসলো ও, তারপর পাশের বিল্ডিংয়ের ব্যালকনিতে বসে থাকা অ্যানার দিকে ধীর গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে চোখ দিয়ে প্রশ্ন করলো আসলেই সে তার ভাই কে ক্ষমা করে দিবে কিনা! অ্যানা মীরের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। মীরের ইশারা প্রশ্নে ও আস্তে করে মাথাটা দুবার উপর নিচ করে সম্মতি জানালো৷

অ্যানার থেকে উত্তর পেয়ে মীর ফিরে তাকালো ইলহানের দিকে। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য ক্ষতবিক্ষত মুখ খানা হা করে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে৷ মীর এবার উঠে দাড়ালো ইলহানের বুকের ওপর থেকে, তারপর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি আর্মি অফিসার কে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে ইলহান কে নিয়ে ডার্ক প্যালেসে পৌছে দিতে বলল। আর্মি অফিসার টি অন্য আর্মিদের সহায়তায় মাটিতে পড়ে থাকা ইলহান কে টেনে তুললো গাড়িতে। তারপর রওনা দিলো শিরো মিদোরির উদ্দ্যেশ্যে।

আর্মি অফিসার আর তার সাথের আর্মি পার্সোন দের সাথে হাইনা, জোভি আর লিও কে পাঠিয়ে দিলো মীর, যেন রেড জোনে গিয়ে ওদের ওপর কোনো আক্রমণ না হয়।
সকলে সেখান থেকে চলে গেলে অ্যানা ব্যালকনি থেকে নেমে এলো নিচে। তারপর নিজের পেটের ওপর হওয়া ক্ষতস্থান টাকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মীরের নিকট এসে মীর কে নিজের বুকের ভেতর আগলে নিলো। অ্যানার হাতের আদুরে ছোয়া পাওয়া মাত্রই মীর স্বেচ্ছায় নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিলো অ্যানার ওপর, অ্যানা মীর কে ধরে ধীরে ধীরে নিচে নামালো, তারপর রাস্তার ওপর বসে মীরের মাথাটা তুলে নিলো নিজের কোলে। মীর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো পিচ ঢালা রাস্তা টার ওপর৷ আর শোয়া মাত্রই আকাশের দিকে তাকিয়ে ও দেখতে পেলো একটা ড্রোন। তীক্ষ্ণ চোখে ড্রোনের ক্যামেরা দিকে তাকালো ও।

এতক্ষণ বাদশাহর ফাইটিং দেখার পর হা হয়ে যাওয়া জনগণ বাদশাহর পাশে এমন পরমাসুন্দরী একটা মেয়েকে দেখে আরও অবাক হয়ে গেলো। মেয়েটির কোলে বাদশাহর মাথা রাখার এমন রোম্যান্টিক মোমেন্ট দেখে হইচই পড়ে গেলো সমস্ত শহর জুড়ে।

মীরকে উপরের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অ্যানা নিজেও যখন মীরের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো তখন ড্রোনের ক্যামেরায় স্পষ্ট ভেসে উঠলো অ্যানার শ্বেতশুভ্র, মাখন কোমল মুখে খানা, আর সেই সাথে দৃষ্টিগোচর হলো ওর হীরকখণ্ডের ন্যায় উজ্জ্বল চোখ জোড়া। আর সেটা দেখা মাত্রই শহরে বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকা পাবলিক বুঝে গেলো এটা তাদের একমাত্র শেহজাদী, বাদশাহর বিবাহিতা স্ত্রী, শেহজাদী আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান। সমস্ত এরিয়া টা জুড়ে ক্রেজ বয়ে গেলো যেন, চিৎকার চেচামেচি করে উদ্ধার করে ফেললো সকলে, দূর থেকে সে চিৎকার কানে এলো মীর আর অ্যানার।

বাদশাহ নামা পর্ব ৪১+৪২

মীর ড্রোন টার দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে পাশ থেকে এক টুকরো প্রস্তরখণ্ড নিয়ে ছুড়ে মারলো সুউচ্চে অবস্থান করা ড্রোনটির ক্যামেরার দিকে, প্রস্তর খন্ড টা গিয়ে ক্যামেরার লেন্সে বাড়ি খেতেই শহরের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং এর বিলবোর্ডটা থেকে হারিয়ে গেলো বাদশাহ আর তার প্রেয়সী। এতক্ষণ ধরে চিৎকার চেচামেচি করতে থাকা উচ্ছাসে পরিপূর্ণ উৎসুক জনতা মুহুর্তেই হতাশ হয়ে গেলো। এত সুন্দর মুহুর্ত টা ওদের কে দেখতে দিলো না! এটা কি মানা যায়?

বাদশাহ নামা পর্ব ৪৫+৪৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here