শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৮১+৮২

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৮১+৮২
Nabila Ishq

অযথার্থ বাড়িতে বন্ধুবান্ধবদের আসা-যাওয়া তন্ময় পছন্দ করে না। প্রয়োজনে অথবা দাওয়াত করিয়ে বছরে একবার, দু-বার আনা ভিন্ন বিষয়। এক্ষেত্রে তার বন্ধুবান্ধবরাও বেশ ভদ্রসভ্য। না বলেকয়ে বাড়িতে অযথার্থ কখনো আসতে চায়নি, আসেওনি। প্রয়োজনে, ঠিক তন্ময়ের জন্যই হয়তোবা দু-একবার এসেছিল। অথচ এবারে ওদের মাথায় এক অন্যরকম ভূত চেপেছে যেন! মাসখানেক ধরে প্রত্যেকটা তার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে যাচ্ছে বাড়িতে আসতে চেয়ে। তন্ময়ের পরিষ্কার ‘না’ টুকু শুনেও নিজেদের ঘ্যানঘ্যানানি থামায়নি।

গত শুক্রবার তো ফের ঢাকঢোল পিটিয়ে আবদার করে বসে আছে। তন্ময় অসন্তুষ্ট গলায় না জানিয়েছে প্রত্যুত্তরে। এরপর আর আবদার করেনি এই সপ্তাহ জুড়ে। তন্ময় ভেবেছিল, ওদের মাথা থেকে বুঝি ভূতটা নেমেছে। কিন্তু না, তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে আজকের কাণ্ড! সন্ধ্যার পরপর ব্যাগ ভরতি জিনিসপাতি নিয়ে প্রত্যেকটা শাহজাহান বাড়িতে হাজির হয়েছে। মোস্তফা সাহেব প্রফুল্লচিত্তে ছেলের বন্ধুবান্ধবদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত। এগিয়ে গিয়ে ভেতরে নিয়ে এসেছেন উচ্ছ্বসিত বদনে। যেমন, তিনি ওদের আসবার খবরাখবর আগ থেকে জানতেন। তন্ময় রাজি না বলে, বাড়ির কর্তা মহাশয়কে পটিয়ে ঠিকই চলে এসেছে বাঁদর গুলো। মাহিন সোফায় বসতে বসতে আহ্লাদী স্বরে শুধায়,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘তন্ময়ের সোনামণিটা—’
রিয়ান মাহিনের পাশেই বসেছিল। মুহূর্তেই বাম হাতের কনুই দিয়ে শক্তপোক্ত এক গুঁতো দিয়ে বসে। গুঁতো খেয়ে মাহিনের মস্তিষ্ক কাজে লাগে। নিজের কথাটুকু দ্রুত শুধরে নেয়,
‘… ইয়ে না মানে চাচা, আমাদের অরু পাখিটা কই? ডাকুন না ওকে। একটু দেখি।’
মোস্তফা সাহেব আনন্দিত হোন। উচ্ছ্বসিত গলায় জবেদা বেগমকে ডাকেন। ভদ্রমহিলা আসতেই গদগদ হয়ে হেসে বলেন,

‘অরু মামণি কী করে? ওকে ডাকো। ওর ভাইয়ারা ওকে দেখতে এসেছে।’
জবেদা বেগম হেসে মাথা দোলান। ততক্ষণাৎ অরুকে আনতে যান। তন্ময় নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সৈয়দ আলগোছে উঠে গিয়ে তন্ময়কে টেনে এনে নিজের জায়গায় বসায়। সোফার পেছনে গিয়ে দু’হাতে তন্ময়ের কাধ দুটো মালিশ করার ছুঁতোয় ভাব জমায়। কণ্ঠ নামিয়ে মিষ্টি করে বলে,

‘দেখ, আমরা খুব শীঘ্রই হ্যান্ডসাম চাচা হতে যাচ্ছি। আমাদের ভাতিজাকে যদি পেটে থাকতে না দেখি তাহলে ভবিষ্যতে এমন সুদর্শন মুখটা কীভাবে দেখাব ওকে বল? যদি ওরা বড়ো হয়ে ফটর-ফটর করে জিজ্ঞেস করে বসে,
‘চাচ্চু, আমি যখন আমার মায়ের পেটে ছিলাম, তুমি কী আমায় দেখতে এসেছিলে?’
প্রত্যুত্তরে যদি বলি, ‘না।’ তখন ওরা কষ্ট পাবে না বল? তাইতো দেখতে এসেছি। যেন ভবিষ্যতে তোর পুত্র সন্তান, কন্যা সন্তানকে আদরের সাথে, গর্বের সাথে বলতে পারি তাদের আমরা পেটে থাকতেই দেখেছি।’
তন্ময় আশ্চর্য হয়ে মাথা ঘুরিয়ে উদাস চোখে দেখল সৈয়দের হাসি-হাসি মুখটা। রিয়ান ঠোঁট ভিজিয়ে বন্ধুর কাঁধে কাঁধ ঘষে বলল,

‘দোস্ত, অরুকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। বল, ও তো ভাবি হওয়ার আগে আমাদের বোন। তোর বোন মানে আমাদেরও বোন। তুই দু নাম্বারি, ফাটকাগিরি করে বউ বানিয়ে নিয়েছিস বলে তো আর ও ভাবি হয়ে যায় না! আগে বোন, তারপর হচ্ছে ভাবি। এখন বোনকে কী একটু দেখতে আসতে পারি না? তোর বিবেক কী বলে?’
তন্ময় থমথমে মুখে শুধু চেয়ে রয়। বন্ধুদের মুখ দেখে যায়। ফাটকাগিরি করে বউ বানিয়েছে মানে? আশ্চর্য! তন্ময়কে যে টেনেহিঁচড়ে জোরপূর্বক প্রেমের নদীতে ডুবানো হলো তা তো জানে না ওরা। রিয়ান তোতলায়। মোস্তফা সাহেব ফুসুরফাসুর শুনে প্রশ্ন করেন বিনয়ী স্বরে,

‘কোনো সমস্যা, বাবারা?’
মাহিন চমৎকার করে হাসে। মোস্তফা সাহেবের দু-হাতে নিজের হাতে নিয়ে রসিক গলায় বলে,
‘ভীষণ খুশিতে ফুসুরফাসুর করছে। আমাদের মধ্যে তন্ময়ই প্রথম বাবা হতে যাচ্ছে, যাকে নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র আশা ছিল না। ভেবেছিলাম এই ছেলে জীবনে শুধু মাছ দেখে যাবে, খেতে পারবে না। কিন্তু আমাদের আশ্চর্য করে দিয়ে ও মাছ খেয়ে মাছের… ’
শুহানি কেশে ওঠে। বলে, ‘হা হা হ, মাহিন তুই খুউব ফানি। হা হা হা। আংকেল ও বলতে চাচ্ছে, আমরা খুব খুশি। আমাদের চ্যাম্পের ছোটো চ্যাম্প আসতে যাচ্ছে পৃথিবীতে, খুশি না হয়ে উপায় আছে?’
মোস্তফা সাহেব পালাক্রমে হেসে বলেন, ‘তাইতো, তাইতো।’

তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবার মুখে চেয়ে। তার সরল-সহজ বাবা, তার লম্পট বন্ধুদের ইনিয়েবিনিয়ে বলা এলোমেলো কথাবার্তা বুঝতে পারছে না বলেই এমনভাবে হাসছে। নয়তো ঠিক কাঁদতো। তন্ময় সামনে চায় অরুর গলা শুনে। জবেদা বেগমের সাথে অরু এগিয়ে আসছে ধীর পায়ে। সবাইকে দেখে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছে। বদন জুড়ে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। তন্ময় অসন্তুষ্ট হয়। এতো আনন্দের কী আছে? দেখো, কেমন করে হাসছে? কতো খুশি!
শুহানি উঠে অরুকে ধরে এনে পাশে বসায়। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় শুধায়,
‘আমাদের বেবিটা ভালো আছে?’

অরু লাজুক হেসে মাথা দোলায়। জানায়, সে ভালো আছে। সবার প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে মিষ্টি করে হেসে গল্প জুড়েছে বেশ। তন্ময় বাঁকাচোখে অরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি দেখে গেল বিনাবাক্যে। অবশেষে নিজেও আনমনা সন্তুষ্ট হয়। বন্ধুদের আগমনে যেহেতু প্রিয়তমা তার আনন্দিত সেহেতু তন্ময়ও নারাজ হতে ব্যর্থ। দিনশেষে অরুর হাসিমুখই তার অস্তিত্বের বিরাট কারণ।
অরু এযাত্রায় লাজুক চোখে চাইল। তন্ময় ভ্রু তুলতেই দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখল জমিনে। ইতস্তত ওকে দেখে তন্ময় ভ্রু কুঁচকাল। কী হলো? সে কী মিস করল? শুহানি তার ভাবুক দৃষ্টি দেখে চাপাস্বরে বিচার দেবার মতো করে জানাল,
‘মাহিন অরুকে সম্বোধন করেছে, ‘তন্ময়ের সোনামণি’ বলে। তাই অরু লজ্জা পাচ্ছে।’
অরু আরও মিইয়ে গেল শুহানির কথা শুনে। মাহিন ঢোক গিলে। দ্রুত সাফাই গাইতে যাবে ওমনি তন্ময় শান্ত তবে ধীর কণ্ঠে বলে,

‘ভুল কী বলেছে? আমার সোনামণি তো।’
শুহানির মুখটা হা হয়ে আসে। আশ্চর্য হয় মাহিনও। অরু দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। লজ্জায় মেয়েটা এখান থেকে যেতে ব্যাকুল। শুহানি নিজের তাজ্জব মস্তিষ্ক কাজে লাগিয়ে অরুকে গিয়ে ধরে দু’হাতে। রিয়ান চোখ পিটপিট করে বলে,
‘মাহিন চাচা, আমার হাতে একটা চিমটি কাটুন তো।’

বাচ্চাকালে অরু ছিলো বেশ নাদুসনুদুস। তাকে দেখতে এক হুবহু পুতুলের লাগতো। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বাস্থ্য বেড়েছে বলেই হয়তোবা— গভীর ঘুমন্ত ওকে সেই বাচ্চা অরুটিই লাগছে। যে একসময় ছোট্টো হাতে তন্ময়ের টি-শার্ট টেনে ধরে আবদার ধরে আদুরে গলায় বলতো,
‘কো-কোললে নাও, ভাইয়া। আমাকে কোল-লে নাও।’
তন্ময় যেন ওকে কোলে নিতে মুখিয়ে আছে ওমনভাবে চটপট কোলে তুলে নিতো। সে কখনোই পারতপক্ষে ওর ক্ষেত্রে ‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারতো না। বাচ্চা অরু ছিলোই এতো মায়াবী যে তখনকার অবুঝ, নাবালক তন্ময়ও ওকে প্রশ্রয় দিয়ে বেড়াতো। মাথার ওপরে ওঠে নাচতে লাই দিতো রীতিমতো।

ছোটোবেলার কথা ভেবেই তন্ময় আনমনা হাসে। অরুর বাচ্চা-বাচ্চা, ফুলোফুলো চেহারাটা অনেক্ক্ষণ ধরে দেখে। সারারাত সে বিন্দুমাত্র ঘুমোতে পারেনি। কীসব হাবিজাবি চিন্তাভাবনা মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে! মনের ভেতরে অশান্তি নিয়ে কী আর ভালো ঘুম হয়? সেদিনকার অরুর ওমন কথাগুলো তন্ময়কে এখনো তাড়া করে বেড়ায়। যা সে স্বপ্নেও কখনো ভাবতে পারে না, তাই মেয়েটা কেমন অবলীলায় বলে বসল! রীতিমতো তাকে মে রে ফেলার পঁয়তারা করছে এই মেয়ে। নাহলে ওমন কথা কীভাবে বলল?

তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাথা নামিয়ে অরুর কপালে চুমু খায়। গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে জানালার দিকে চায়। আকাশের গা ঘেঁষে সূর্য এখনো পুরোপুরি ওঠেনি। উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, এই পুরোপুরি উঠলো বলেই। জানালা গলিয়ে একফালি সোনালি রোদ্দুর এসে ভিড়তে চাচ্ছে অরুর শান্ত, ঘুমন্ত মুখে। তন্ময় এবেলায় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। পা জোড়ায় জুতো গলিয়ে এসে দাঁড়ায় জানালার সামনে। পর্দা টেনে দেয় ভালোভাবে। ফিরে এসে অরুর কোমরে পড়ে থাকা কম্ফোর্টার গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে এয়ারকন্ডিশনারের পাওয়ার কমিয়ে দেয়। অরুর গরম বেশি লাগে। ঘর ঠান্ডা করে কম্ফর্টার জড়িয়ে ঘুমোতে পছন্দ করে। আর আজ এমনিতেও ভ্যাপসা গরম পড়েছে। অক্টোবরে এমন গরম পরার কথা তো নয়। প্রকৃতি যেন মাঝেমধ্যে উল্টো পথে চলতে ভালোবাসে।

তন্ময় এক মগ গরম কফি নিয়ে এসে বসেছে বাগানে। মন, মস্তিষ্ক শান্ত করতেই মূলত এখানে বসা। বাতাসের মিহি স্পর্শ উপভোগ করতে নিয়েই কফির মগে চুমুক বসায়। তখুনি চায়ের কাপ হাতে মোস্তফা সাহেবকে হাজির হতে দেখা যায়। ভদ্রলোক এতক্ষণ লিভিংরুমে বসে সংবাদপত্র পড়ছিলেন। ছেলেকে দেখেই চা নিয়ে এসেছেন বাগানে বসতে। তন্ময়ের ঠিক পাশের চেয়ারটাতেই আরাম করে বসেন। গলা পরিষ্কার করে চায়ের কাপে চুমুক বসান। আড়চোখে ছেলের মুখে কয়েকবার দৃষ্টিপাত ফেলেন। একসময় চিন্তিত হয়েই শুধিয়ে বসেন,
‘অশান্ত লাগছে তোমাকে! কী ব্যাপার?’

এহেন আচমকা প্রশ্নে তন্ময় নিঃশব্দে হাসে। বাবার দিকে ফিরে চেয়ে প্রত্যুত্তরে বলে,
‘কীভাবে বুঝলে? আমার মুখে লেখা নাকি?’
মোস্তফা সাহেব মুহূর্তেই গম্ভীর হলেন। যেন এমন প্রশ্ন তন্ময়ের মুখে মানায় না। সটানভাবে বসে ভদ্রলোক বলেন,
‘হুঁ, লেখা। তবে ওই লেখা পিতৃতান্ত্রিক লেখা। শুধু বাবারাই পড়তে জানেন।’
তন্ময় আগ্রহী হয়। উৎসুক চোখে চেয়ে থেকেই প্রশ্ন করে যায়, ‘ভবিষ্যতে আমিও আমার ছেলে-মেয়েদের মুখ পড়তে পারবো তো?’

মোস্তফা সাহেব নড়েচড়ে ওঠেন। চায়ে চুমুক বসান। অন্যদিকে ফিরে বুক ফুলিয়ে বিড়বিড় করে বলেন,
‘আমার মতো সন্তানদের ভালোবাসলে অবশ্যই পারবে।’
তন্ময় হাসে, শব্দ করে। ফিসফিস করে শুধায়, ‘বাবা, আমি তোমার মতো ভালো বাবা হতে পারবো তো?’
মোস্তফা সাহেব থমকান। নরম হোন। সময় নেন প্রত্যুত্তরে—গর্বিত কণ্ঠে আওড়ান, ‘আমার চেয়েও ভালো বাবা হবে। দেখিও কেমন বাবা ভক্ত ছেলেমেয়ে হয় তোমার।’
তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শান্ত ভঙ্গিতে কফির মগে চুমুক বসায়। অদূরেই পাখিরা উড়েউড়ে কিচিরমিচির করছে। সেদিকে চেয়েই বলে,
‘আমি ভয় পাচ্ছি, বাবা। আবার অপেক্ষাও করছি। ভয়, অপেক্ষা এই দুটোর মিশ্রিত অনুভূতি যে বড্ড অসহনীয়।’
মোস্তফা সাহেব ছেলের কাঁধে হাত রেখে নীরবে আশ্বস্ত করেন। বোঝান, সব ঠিক হবে। আল্লাহ আছেন। তিনিই উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনিই সব।

ক’দিন ধরেই শাহজাহান বাড়ির বাতিগুলো বন্ধ করা হয় না রাতবিরেত। সারারাত জ্বালানো রয় অরুর সুবিধার্থে। ঘরের বাতিও জ্বালানোই থাকে রাতভর। ওর হঠাৎ করে এটা-সেটার প্রয়োজন হয় বলে। সেদিন অক্টোবরের তেরো তারিখ। বুধবার রাত একটা তেতাল্লিশ। জানালার পাশের চেয়ারে বসে তন্ময় ল্যাপটপে কাজ করছিল। হঠাৎ করে ঘুমন্ত অরুকে আর্তনাদ করতে শোনা গেল। প্রথমে অস্পষ্ট ছিল, এরপর ধীরে ধীরে জোড়ালো গলাতেই আর্তনাদ করে ওঠে মেয়েটা।

নিস্তব্ধতা চিড়ে আসা মেয়েলি কণ্ঠের আর্তনাদে তন্ময় ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। দেখতে পায় অরুর কপালে রীতিমতো ঘাম জমেছে। চোখমুখ খিঁচিয়ে রেখেছে কেমন। মনে হচ্ছে, অনেকক্ষণ ধরে ব্যথা সহ্য করে শুয়ে আছে। না পারতে মুখ ফুটে আওয়াজ করে বসেছে। এযাত্রায় দুর্বল ভাবে উঠে বসতে চাচ্ছে পেট ধরে। তন্ময় দ্রুত কাছে এসে অরুকে দু’হাতে জাপ্টে ধরে বসায়। বিচলিত ভঙ্গিতে সারামুখ ছুঁয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
‘ব্যথা করছে?’
অরু ঢোক গিলে আওড়ায়, ‘ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে পেটে।’

অরুর ডেলিভারির তারিখ আরও পাঁচদিন পর ছিল। আজই ব্যথা উঠেছে! তন্ময় ওকে মুহূর্তেই পাজাকোলে তুলে নেয়। ঘর ছেড়ে সে বেরুতে নিয়েই চিৎকার করে ডেকে ওঠে মোস্তফা সাহেবকে। মোস্তফা সাহেবের দরজা আধখোলাই ছিল। এই সময়টাতে বাড়ির সবাই যেন চোখ-কান খোলা রেখে বসে আছে। এক ডাকেই ভদ্রলোক সহ, জবেদা বেগমও হকচকিয়ে বেরিয়ে আসেন। প্রশ্নের ধার না ধেরে, মোস্তফা সাহেব কোনোরকমে গায়ে পাঞ্জাবি জড়িয়ে নিতে নিয়ে ছোটেন ছেলের পেছনে।

ইতোমধ্যে বাড়ির সবাই জেগেছে। সুমিতা বেগম, জবেদা বেগম গুছিয়ে রাখা ব্যাগগুলো হাতে তুলে নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন মুহূর্তেই। মিনিটখানেকও তাদের প্রয়োজন পড়েনি। যেন আগে থেকেই সব প্রস্তুতি নেয়া আছে তাদের। গাড়ি বের করেছে আকাশ। মোস্তফা সাহেব গাড়ির দরজা খুলে দিতেই অরুকে পেছনের সিটে বসিয়ে দেয় তন্ময়। অরুর দু’পাশে উঠে বসেছে সুমিতা বেগম, জবেদা বেগম। দুর্বল ভাবে আর্তনাদ করা অরুকে দু’জনে জড়িয়ে রেখেছেন।
আকাশ ড্রাইভিং থেকে নামতেই তন্ময় উঠে বসে ড্রাইভিংয়ে। মোস্তফা সাহেব ছেলের পাশে উঠে বসেছেন। আনোয়ার সাহেব বসেছেন স্ত্রীর পাশে। তন্ময় গাড়ি স্টার্ট করে। এক টানে বাড়ি ছেড়ে বেরোয় গাড়িটা। নির্জন রাস্তা, জ্যাম বিহীন রাস্তা হওয়াতে—- তাদের আকাঙ্ক্ষিত প্রাইভেট হাসপাতালটিতে পৌঁছাতে পনেরো মিনিটেরও কম সময় লাগল।

অক্টোবর। আজ তেরো তারিখ। সময় —ঠিক ভোর চারটা। এখনো ফজরের আজান পড়েনি। সম্ভবত কিছুক্ষণ বাদ পড়বে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে ঘণ্টাখানেক যাবত। প্রথম দিকে ঝুম বৃষ্টি মিনিট পাঁচেকের জন্য নেমেছিল বটে। তা অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। বাইরেটা অন্ধকারে ডুবেছে। মেঘলা, গুমোট আকাশের খুব কাছ দিয়ে একটা প্লেন যাচ্ছে। প্লেনটি রীতিমতো নেমে আসছে ধরণীর খুব কাছে— আকাশের বুক থেকে যতটা দূরে আসা সম্ভব ততটা দূরে। ছমছমে বাতাসের স্রোতে উড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা, বেয়ারা গাছের পাতারা। হাসপাতালের সামনে একটি কালো রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। হাসপাতালের সদরদরজার সামনে লাঠি হাতে দাঁড়ানো দারোয়ান দু’বার সন্দেহের চোখে গাড়িটি আপদমস্তক দেখে নিয়েছে। এইতো এসে জানালার কালো কাঁচে টোকা দিলো বলে!
ওদিকে বাইরে থেকে স্তব্ধ দেখতে গাড়িটির ভেতরে তর্কবিতর্ক চলছে একনাগাড়ে। এসময়ে মাহিন হুলস্থুল বাদিয়ে গাড়ি থেকে বেরুতে চাইলে রিয়ান ওর শার্টের কলার টেনে ধরে ফের সিটে বসিয়ে দেয়, একরকম জোরপূর্বক। মাহিন মহাবিরক্ত হয়। তিরিক্ষি মেজাজ দেখিয়ে বলে,

‘তোদের যাওয়া লাগবে না। তোরা ঘুমা, তোদের তো আটকাচ্ছি না। আমারে তো যেতে দে-রে বাপ।’
শুহানির মাথা ধরেছে ভীষণ। চোখ দুটো ছোটো হয়ে আছে। সে রীতিমতো কাচা ঘুম ফেলে এমন ভোর সকালে দিকবিদিক ভুলে বাড়ি থেকে একই পোশাকে বেরিয়ে এসেছে। এপর্যায়ে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করে ধমক দেয়,
‘ভাই, মাথাটা একটু কাজে লাগিয়ে, ভাব। ভাব, প্লিজ লাগে। গাধার মতো কর্মকাণ্ড করিস না। এখন তন্ময়ের ফ্যামিলি টাইমিং। ক্রিটিকাল, ইমোশনাল সিচুয়েশন। এসময়ে আমরা আউটসাইডার্স গিয়ে উপস্থিত হলে তারা ডিস্টার্ব ফিল করতে পারে। তারওপর ইতোমধ্যে শাহজাহান বাড়ির সব ঢুকেছে হাসপাতালের ভেতর। ওটির বাইরে ফাঁকা জায়গা আছে না-কি সন্দেহের ব্যাপার।’

মাহিনের গুরুগম্ভীর, গোমড়া মুখ খানা বড্ড সরল দেখায়। সে খুব করে ভেতরে যেতে চায়। বন্ধুর কী অবস্থা নিজ চোখে দেখতে চায়! অরুকে সেই কখন ওটি-তে নেয়া হয়েছে! এখনো কোনো খবরাখবর শোনা যায়নি। মাহিন বিরবির করে বলে,
‘আরেকজন, মাত্র একজন গেলে কিচ্ছুটিইই হবে না। তোরা বস, আমি গিয়ে তোদের আপডেট করব।’
রিয়ান ভূতের মতন চমৎকার ভঙ্গিতে হেসে চোখমুখ বড়ো করে বলে,
‘তুই বোস তাহলে। আমি গিয়ে তোরে আপডেট করব।’

সৈয়দ বন্ধুদের কর্মকাণ্ডে আশ্চর্য না হয়ে পারে না। বদমাশ গুলোর সব বিষয়ে, সবখানে ঝগড়া করা লাগবে? এমন একটা ব্যাপারেও? সে অসন্তুষ্ট গলায় এবারে চিৎকার করে ওঠে,
‘তোরা এসব পরে করবি, প্লিজ? প্লিজ? একটু দোয়াদরুদ পড়লেও তো পারিস। অরুর ডিফিকাল্ট ডেলিভারি হচ্ছে। বুঝছিস না?
দুটো বেবি তো এভাবেই আকাশ থেকে টপ করে পড়বে না। আমিতো ভেতরে না গিয়ে, তন্ময়কে না দেখেও বলতে পারবো, ও লিটারেলি পাগল হয়ে যাচ্ছে বোধহয়।’

কথাগুলো তার মুখ থেকে বেরুতেই গাড়ির ভেতরটা নিশ্চুপ হয়ে গেল একমুহূর্তে। থমথমে পরিবেশে হালকা কেশে মাহিন আলগোছে দু’হাত তুলে মোনাজাত ধরল। বিরবির করে দোয়াদরুদও পড়তে শুরু করল। ভদ্রসভ্য ভাবে বসে রিয়ানও একই কাণ্ড করাতে— সৈয়দের মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে এলো। নীল হলো মুখ। আশ্চর্য হয়ে নিঃশব্দে চোখ দুটো ঘুরিয়ে জানালা গলিয়ে বাইরে চাইল। আকাশ মেসেজের রিপ্লাই করেছিল চারমিনিট আগে। অরুর নর্মাল ডেলিভারি হবার সম্ভাবনা একদমই নেই। অবস্থা বেগতিক। জমজ দুটো বাচ্চার একটি বাচ্চার অবস্থান উলটো। বাধ্যতামূলক সিজার করতে হবে। এইমুহূর্তে তন্ময়ের মানসিক অবস্থা খুব একটা অবশ্যই ভালো হওয়ার কথা নয়। তার বন্ধুর দুর্বলতাই দুর্বল হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। তার ওপর ক্রিটিকাল সিচুয়েশন! এসময়ে চেয়েও তারা —বন্ধুরা পাশে থাকতে পারবে না। দূর থেকেই অনুসরণ করতে হবে। সবকিছুর একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা তো আছে।
তবে প্রয়োজনে সেই সীমাবদ্ধ ভেঙে ফেলতেও তাদের দ্বিধা নেই। আর একটু ধৈর্যসহকারে বসে থাকলেই হবে।

ওটির সামনে —করিডোরে শাহজাহান বাড়ির প্রত্যেকে বিদ্যমান। ছোট্টো দীপ্ত অবধি বাড়িতে থাকতে রাজি নয়। কান্নাকাটি করে আকাশের সঙ্গে চলে এসেছে প্রায় নিঃশব্দে। আকাশ অবশ্য বারংবার বলেকয়ে এনেছে, কোনোপ্রকার হৈ-হুল্লোড়, প্রশ্নাবলী করা যাবে না। দীপ্তও বেশ বুঝদার বাচ্চামানুষ। আজ একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি, ওর মধ্যে চঞ্চলতা নেই বললেই চলছে। পুতুলের মতন চুপচাপ দু’হাত একত্রিত করে মুখের সামনে ধরে রেখেছে —মোনাজাত ধরেছে ঠিকই তবে ওর ছোটো ছোটো চোখদুটো শোকাহত ভঙ্গিতে ঘুরেফিরে সকলের চিন্তায় মগ্ন মুখখানি দেখতে ব্যস্ত।

পরিস্থিতি থমথমে, বাইরের আবহাওয়ার মতো গুমোট, শীতল। মোস্তফা সাহেবের বয়স হয়েছে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। তারপরও ভদ্রলোক চিন্তিত মুখে কঠোরভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘন্টাখানেক ধরে। এই পর্যায়ে একমাত্র ছেলের নারাজি দেখে একপ্রকার বাধ্য হয়েই বসেছেন। আনোয়ার সাহেব পায়চারি করছেন অস্থির ভঙ্গিতে। বারবার করে চাইছেন ওটির দিকটায়। সুমিতা বেগম এককোণে বসে আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছেন। সেই কান্নায় জবেদা বেগমের চোখ দুটোও ছলছল করছে। মুফতি বেগম সামলে নেবার চেষ্টা করছেন কান্নারত সুমিতা বেগমকে। ওহী সাহেবের ইশারায় আকাশ এযাত্রায়য় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তন্ময়ের পিছু।

তন্ময় বসেনি— বসছেও না। আরাম করে বসার মতো বোধগম্যতাই বুঝি তার আর নেই। সে হাসপাতালে ঢুকেছে অবধি এখনো দু’পায়ের ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিষ্ঠুরভাবে কাঁপছে হাত জোড়া। তার এলোমেলো ঘন কালো চুলগুলো কপাল জুড়ে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে আছে। রক্তিম চোখজোড়ার দৃষ্টি নিবদ্ধ ওই বন্ধ ওটিতেই। আকাশ কাঁধে হাত রাখলেও তার হেলদোল হলো না। মস্তিষ্ক জুড়ে বারবার করে ডাক্তারের কথাগুলোই পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে।
‘ক্রিটিকাল সিচুয়েশন। একটি বাচ্চার পজিশন উলটো। সার্জারি বাধ্যতামূলক।’

সেই বাক্যের ওজন যেন অতিমাত্রায় বেশি। তন্ময় এই ওজন নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ভাঙছে, পুড়ছে তার ভেতরের সব। এইমুহূর্তেই অনেক কিছু নিয়ে তার ভয় হচ্ছে, ভীষণভাবে হচ্ছে। নিজ অজান্তেই সেই ভয় থেকে জন্ম নিচ্ছে অনুশোচনার। কোনোভাবেই এই বাজে, বিশ্রী চিন্তাভাবনা গুলো সরিয়ে ফেলা যাচ্ছে না। বারবার করে মনে হচ্ছে, অরুকে গভীর ভাবে নিজের খুব কাছে টেনে নেয়াটাই বোধহয় সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিলো তার। নাহলে কী আর এমন পরিস্থিতি দাঁড়াতো? অরুর জীবন, তার বাচ্চাদের জীবন আজ ঝুঁকিতে পড়তো? তার নিজেকেই যে দোষী লাগছে। নিজের ওপর এতটা ক্রোধ, এতটা অসহনীয় অনুভূতি এর আগে কখনো হয়নি। দুমড়েমুচড়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ডের ব্যথা সহ্য করা যেন সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে রক্তিম হয়ে আসা চোখদুটো এবেলায় তন্ময় বুজে নেয়। চোয়াল শক্ত হয়। আকাশ ভড়কে যায় তন্ময়ের এরূপে। স্তব্ধ, মিহি স্বরে আওড়ায়,

‘শান্ত হো, ভাই! এভাবে ভেঙে পড়িস না। কিচ্ছু হবে না আমাদের অরুর, বাবুদের! একটু শক্ত হো।’
ছেলের অবস্থা বুঝে, মোস্তফা সাহেব উঠে এগিয়ে আসছেন এদিকেই। আকাশ পিছিয়ে যায় চাচ্চুকে দেখে। আশ্বস্ত করতে যান আনোয়ার সাহেবকে। মোস্তফা সাহেব এসে দাঁড়ান ছেলের পাশে। ডান হাতটা আলতোভাবে রাখেন চওড়া কাঁধে। তন্ময় চোখ খোলে ঠিকই তবে রক্তিম চোখদুটো আড়াল করতে মাথা নত করেই রাখে। ছেলের মুখ স্বচক্ষে না দেখেও যেন দেখে নিয়েছেন মোস্তফা সাহেব। ছেলের কাধ চাপড়ে দিয়ে আহ্লাদী ভঙ্গিমায় বলেন,
‘এখুনি এমন ভেঙে পড়লে হবে, বাবা? এখনো তো স্ত্রী, দুই দুটো সন্তানকে সামলানোর বাকি তোমার।’
সারামাসের ভয়, আতঙ্কের এক তাণ্ডব যেন ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছে। তন্ময় আশ্চর্যজনক ভাবে ডুকরে ওঠে। ঠোঁটে ঠোঁট শক্ত করে টিপে উগলে আসা কান্না দমিয়ে রাখে। চোখ তুলে চায় বাবার চোখে। মুহূর্তেই বাম চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রুজল গাল বেয়ে গড়াতেই সে আওড়ায়,

‘আমিওতো তাই চাই, বাবা।’
মোস্তফা সাহেবের চোখজোড়াও ছলছল করে ওঠে। ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ছেলের বাম গালের চোখের জলটুকু মুছে দেন। আহত গলায় বলেন,
‘যা চাও, তাই হবে, ইনশাআল্লাহ্।’
তন্ময় সময় নিয়ে বাবার সাথে বিরবির করে,
‘ইনশাআল্লাহ্।’

আনোয়ার সাহেবও এসে দাঁড়িয়েছেন বড়ো ভাই, ভাইপোর পাশে। তিনজনই চেয়ে আছেন ওটির দিকে। লাল বাতিটা জ্বলে যাচ্ছে। সেটি নেভার যেন নামমাত্র নেই। তা নেভার অপেক্ষাতেই আছে সবাই। তখুনি জ্বলতে থাকা লাল বাতিটা নিভে যায়। পরপরই দরজাটা হুট করে খুলে ভেতর থেকে। মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব দ্রুত বেগে এগুলেও, তন্ময়ের পা-দুটো যেন ফ্লোরের সাথে চুম্বকের মতো আটকে আছে। নাড়ানো যাচ্ছে না। পুরো তার সত্তা স্তব্ধ, বিমূঢ়। ভয়ে আঁটসাঁট হয় ভেতরটা। সামলানো সম্ভব হচ্ছে ভীত, তটস্থ হৃদয়কে। তার পৃথিবী যেন ধ্বসে পড়বে একমুহূর্তেই। সেমুহূর্তেই দুটো সাদা ইউনিফর্ম পরিহিত নার্সদের বেরুতে দেখা গেল। দু’জনের কোলেতেই শুভ্র রঙের তোয়ালেতে প্যাঁচানো শিশু। তন্ময় ভেজা চোখে দেখে সেই শিশু দুটোকে। এযাত্রায় পাজোড়াও চালাল দ্রুত বেগে। শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক হওয়া স্বত্তেও দ্রুত পায়ে ওটির ভেতরে যেতে চাইল। ডাক্তার ঠিক সেসময় বেরিয়ে আসলে মুখোমুখি হয়ে পড়ে। তন্ময়ের চোখমুখ দেখে ভদ্রমহিলা বিনয়ের সাথে হেসে বললেন,

‘শান্ত হোন, মিস্টার। আপনার স্ত্রী এবং বাচ্চারা আলহামদুলিল্লাহ্ সুস্থ আছেন। এখনো চেতনা ফেরেনি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চেতনা ফিরবে বলে আমরা আশাবাদী। চেতনা এলেই আপনি দেখা করতে পারবেন আপনার স্ত্রীর সাথে।’
নার্স দু’জনকে ঘিরে ধরেছে শাহজাহান বাড়ির সব সদস্য। নার্স একজন মিহি স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘বাচ্চাদের বাবা কে?’
মোস্তফা সাহেব টলমলে চোখে ছেলের দিক চাইলেন। তন্ময়ের হাত কাঁপে, কাঁপে কণ্ঠস্বর। কোনোরকমে অস্পষ্ট গলায় প্রত্যুত্তরে বলে,
‘আমি।’
নার্স দু’জন সর্বপ্রথম সন্তানদের পিতা অর্থাৎ তন্ময়ের দিকে বাচ্চা একটি এগিয়ে ধরে কোলে নেবার জন্য। তন্ময় বিষ্ময় নিয়ে চেয়ে আছে পুতুলের মতো চোখ বুজে থাকা বাচ্চার মুখে। তার সন্তান, তার আর অরুর সন্তান, তাদের সন্তান। এই অনুভূতি একমুহূর্তেই নির্বিকার ভাবে অনুভব করার মতন নয়। রীতিমতো তার হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে, সর্বাঙ্গ উত্তেজনায় কাঁপছে। চোখ দুটো জলে থৈথৈ করছে। আনোয়ার সাহেব কান্নার সাথে হাসছেনও। তন্ময়ের দিকে চেয়ে উচ্চ কণ্ঠে বলেন,

‘দ্রুত কোলে না নিলে কিন্তু আমি নিয়ে নেব।’
তন্ময়ের টনক নড়ে। সে দ্রুত দু’হাত বাড়ায় বাচ্চাদের মতো। হেসে নার্স একজন প্রথম বাচ্চাটি তন্ময়ের কোলে তুলে দেয়। এতো ছোটো, এতো আদুরে প্রাণটি কম্পিত হাতে কোলে নিতেই তন্ময় ভেঙে গুড়িয়ে যায়। দু’চোখ বেয়েই ঝরে কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল। নরমভাবে আগলে নেয় বুকের মধ্যে। ডান হাতে ছুঁয়ে দেয় ছোট্ট হাত দুটো। আলতোভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় লাল, বোঁচা নাকে। অস্পষ্ট গলায় আওড়ায়,
‘বাবা, আমার বাবা।’
আনোয়ার সাহেব ছুটে কাছে গেলেন এবেলায়। তাড়া দিয়ে বলেন,
‘দে, এবার আমাকে দে তন্ময়।’

তন্ময় অনিচ্ছুক হওয়া স্বত্তেও সচেতনতার সাথে আনোয়ার সাহেবের কোলে তুলে দেয়। আনোয়ার সাহেব কোলে নিয়েই ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে ওঠেন। তার পাশে মোস্তফা সাহেবও কোলে নিতে ব্যাকুল। নার্সের বাড়িয়ে দেয়া দ্বিতীয় বাচ্চাটি এবারে তন্ময় দু’হাতে আলতোভাবে কোলে নেয়। এইজন চেয়ে আছে ছোটো ছোটো চোখে। ছোটো হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। নড়চড় করছে। অস্পষ্ট গলা কাঁদতেও চাচ্ছে। নার্সটি হেসে বলেন,
‘এটিই আপনার ছেলে, স্যার। ছোটোজন, এইজনই উল্টে ছিলো। খুব দুষ্টু, চঞ্চল হবে। একবারও চোখ বোজেনি। আপনার মেয়েটা সে তুলনায় খুব শান্ত। একটুও কান্নাকাটি করেনি। চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে এখন পর্যন্ত।’
নার্সের কথাগুলো শুনতে শুনতে, সন্তানকে বুকের মধ্যে আগলে নিয়ে তন্ময় নির্নিমেষ বাচ্চা, বাচ্চা মুখপানে চেয়ে মুগ্ধ হয়, বাকরুদ্ধ হয়। চঞ্চল মুষ্টিবদ্ধ হাতটা তুলে ঠোঁটের সামনে ধরে ঠোঁট ছোঁয়ায়। ডাকে,
‘ফায়াজ! আমার আব্বাজান!’

ফায়াজ-ফাইজাকে ঘিরে পরিবারের এমন হুলস্থুল কাণ্ডকারখানা যেমন কম হচ্ছিলো, তা পোষাতেই বুঝি বন্ধুদের আগমন ঘটে এসময়ে। মাহিনের পেছনে সারি বেঁধে সবগুলো মিইয়ে যাওয়া বিড়ালের মতন ছোটো ছোটো কদমে এসে— ঠিক তন্ময়ের পেছনেই দাঁড়িয়ে পড়েছে খুব আলগোছে, সটান দেহে। আপাতত কাউকেই বিরক্ত অথবা অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না তারা। এমন এক নাজুক সময়ে বাইরের মানুষের উপস্থিতি মোটেও সভ্যতার কাতারে পড়ে না। এমনিতেও বন্ধুরা তারা সবগুলো অসভ্য, তবে নিজেদের বন্ধুর পরিবারের কাছে মোটেও অসভ্য, এঁচড়ে পাকা নয় বরঞ্চ বেশ ভদ্রসভ্য, ধোয়া তুলসীপাতার এক প্রতিবিম্ব দেখিয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে। এই কাজে তাদের আগেপিছে কারো অস্তিত্ব থাকাটাই অসম্ভব প্রায়। মাহিন নীরবে মাথাটা নুইয়ে বেশ নিপুণ দৃষ্টিতে দেখছে তন্ময়ের কোলের ছোট্টো, তুলতুলে নরম প্রাণটিকে। ছটফটে নবজাতক শিশুটিকে শুভ্র রঙের তোয়ালেতে মোড়ানো হয়েছে। ধবধবে সাদা চামড়ায় লালচে আভা। হাপুসহুপুস করছে শীর্ণ ঠোঁট দুটো। কী ভীষণ টকটকে লাল! তন্ময় টুপ করে মাথা নুইয়ে ছেলের মুখের কোণে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় বড্ড আদুরে ভাবে। তার বড়ো ডান হাতের একটি আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে ফায়াজ। তন্ময় সেই ছোট্ট মুষ্টিবদ্ধ হাতটিতেও চুমু দিয়ে মিহি স্বরে ডাকে,

‘বাবা, এইযে বাবা, ফায়াজ! আমার রাজপুত্র!’
ঠিক এক জীবন্ত পুতুলের মতোই দেখতে শিশুটিকে কোলে নেবার জন্যে রীতিমতো হাত নিশপিশ করছে প্রত্যেকের। বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে চঞ্চল, উৎসুক মাহিন আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারে না। সে ভেবে এসেছিল শুধু দূর থেকে দেখে যাবে। একদম আগ বাড়িয়ে বাচ্চাদের কোলে নেবার তাড়া দেখাবে না, আরেকজন ভাগিদার হয়ে মোটেও দাঁড়াবে না। তবে তা আর বুঝি হওয়ার নয়। মাহিন দ্রুত কদমে পেছন থেকে সামনের সবাইকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে তন্ময়ের দিকে নিজের উত্তেজিত হাত দুটো মেলে দেয়। ভারী চমৎকার হেসে উৎসুক চোখে চেয়ে বলে,
‘আমি একটু নিই, দে না রে দোস্ত। বাবাকে আমার কোলে মিনিটখানেকের জন্য দে।’

তন্ময় এতক্ষণ ওদের খেয়াল করেনি। আওয়াজ শুনে আশ্চর্য হয়ে মাথা তুলতেই পেছন থেকে সব ঝাপিয়ে পড়ে তার গায়ের ওপর। রিয়ান একপ্রকারে তন্ময়ের প্রশস্ত কাঁধ জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে গিয়ে থেমে যায় চারিপাশে চেয়ে। মোস্তফা সাহেব বড়ো চোখে চেয়ে আছেন। রিয়ান ঢোক গিলে। সাফাই গাইতে কাইকুই করে হাসার চেষ্টা করে সামান্য,
‘আসসালামু আলাইকুম, চাচা। দুঃখিত এমন অসময়ে না বলে চলে এসে বিরক্ত করলাম।’
এবেলায় হেসে ফেলেন মোস্তফা সাহেব। পালাক্রমে হাসেন বাকিরাও। আনোয়ার সাহেবের চোখের কোণ তখনো ভেজা। তার কোলে ফাইজা চোখ বুজে শুয়ে আছে। তিনি মৃদু হেসে বলেন,

‘বিরক্তির কী আছে বাবা? চাচ্চু হয়েছো—ভাতিজী, ভাতিজাকে দেখতে আসবে না?’
রিয়ান আপ্লুত হয়। সন্তুষ্টিতে যেন পাখা নাড়িয়ে আকাশে উড়ছে। দ্রুত আনোয়ার সাহেবের দিকে এগিয়ে আসে। মুগ্ধ চোখে চেয়ে ভদ্রলোকের কাঁধ ঘেঁষে হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে আদুরে গলায় আবদার ধরে,
‘চাচা, আমার কোলে একটু দিন না।’
আনোয়ার সাহেব উচ্চকণ্ঠে হেসে ওঠেন। বলেন, ‘এভাবে বলার কী আছে! নাও, নাও। এইতো…’
রিয়ান কাঁপা কাঁপা হাতে ফাইজাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। কী ভীষণ আনন্দের স্রোত বয়ে যায় তার অন্তরের ভেতরে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতন নয়। তাদের তন্ময়ের সন্তান এরা এই ভাবনাই যেন তার চোখ ভিজিয়ে তুলতে যথেষ্ট। রিয়ান ছলছল চোখে ফ্যাচফ্যাচ কণ্ঠে আওড়ায়,

‘মামণি, কী ভীষণ কষ্ট করেছি আমরা তোমাদের পৃথিবী দেখাতে তা যদি ভবিষ্যতে জানো আমাকে তুমি গুণেগুণে গালে চারটা চুমু দিবে তুমি। লিখে রাখো।’
শুহানি ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হাসি চেপে চিমটি কাটে রিয়ানের বাহুতে। শাসায় চুপিসারে, ‘তুই কী থামবি?’
তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আড়চোখে দেখে মাহিনের আগ্রহী মুখ। মাহিন মাথা নুইয়ে তন্ময়ের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,

‘কংগ্রাচুলেশনস, দোস্ত। তোর বাবা হওয়ার ক্রেডিট কিন্তু আমাদের একপার্সেন্ট হলেও আছে। হ্যাঁ, মানছি নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট তোর। কিন্তু দোস্ত, বাসর আমরাই সাজিয়েছিলাম, রিমেম্বার? নাইলে কিন্তু আজ তুই দুটো সন্তান হাতে দাঁড়াতে পারতি না। তাই এখন বাবাকে আমার কোলে দে তাড়াতাড়ি।’
তন্ময় নির্বিকার থাকতে পারে না। থমথমে চোখে বন্ধুকে কিছুক্ষণ দেখে নেয়। অগত্যা নিঃশব্দে হেসেও ফেলে ওদের কাণ্ডতে। সাথে সাথে সন্তানকে অতি সাবধানে বাড়িয়ে দেয় বন্ধুর কোলে। মাহিন উৎসাহিত তবে কম্পিত হাতে ফাইজাকে কোলে নিয়ে মোমের মতন গলে যায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তন্ময় সে দৃশ্যে হাসে। নরম চোখে দেখে সন্তানদের ঘিরে থাকা আবেগে আপ্লূত পরিবারকে। হাত ঘড়িতে দৃষ্টি বুলিয়ে তন্ময় সরে আসে। খুঁজে বেড়ায় নার্সদের।

বাইরে ঝুম বৃষ্টি নামছে তখনো। ভোররাত থেকেই নেমে যাচ্ছে। ঝড়ো বাতাস এখনো বিদ্যমান। করিডোরের মাথায় মস্তবড়ো জানালা। জানালার কাঁচে বয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির রেখা। তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে এখানটাতেই, ঠিক জানালার সামনে। দৃষ্টি শূন্যে। ভাবনারা সচেতন। গোটা একদিন পোষ্ট অপারেটিভ কেয়ারে রাখা হবে অরুকে। জ্ঞান ফিরলে শুধুমাত্র স্বামীকে সেখানে ঢোকার অনুমতি দেয়া হবে। তন্ময় অপেক্ষা করছে অরুর জ্ঞান ফেরার। ডাক্তার বলেছিলেন ঘণ্টা খানেক লাগবে। ঘণ্টা খানেক তো সেই কখন কেটে গেল। অরুর কী এখনো জ্ঞান ফেরেনি? তন্ময় কোনোভাবেই শান্তি পাচ্ছে না যে। অরুকে একনজর না দেখা অবধি বুঝি পুরোপুরি শান্তি নেই তার। অবচেতন মনটা অশান্ত হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে ঘুরছে তার চেতনাও। চোখের পাতায় ভেসে বেড়াচ্ছে অরুর আদুরে, হাস্যোজ্জ্বল দীপ্তি ছড়ানো মুখখানি। কয়েকটি ঘণ্টা তার কাছে এক যুগের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরের এমন ঝুম বৃষ্টি মনে করিয়ে দিচ্ছে কতশত স্মৃতির মেলাবন্ধন। অরুর সহস্ররকমের আবদার, ইচ্ছেদের, নানান ধরনের অদ্ভুৎ কাণ্ডের সংমিশ্রণের এক ফিল্ম যেন চোখের পাতায় ছাড়া হয়েছে। সেই ফিল্মের একটি অংশতেই তার মনোযোগ স্থির হয়।

অরু তখন সবে সতেরোতে। দুগাল ভরতি মাংস, ফুলোফুলো। চেহারা জুড়ে বাচ্চাবাচ্চা ভাব। গোলগোল চোখ দুটো তুলে তাকালে মনে হতো খরগোশ চেয়ে আছে। তন্ময় ওই চোখে চেয়ে কখনো ওর একটি আবদারও ফেলতে পারেনি। ও না তখন নতুন নতুন শাড়ি পরতে চাইতো, সুন্দর সুন্দর কামিজ পরতে চাইতো। সাজগোজ করে পরিপাটি থাকতে ব্যাকুল হয়ে পড়তো। যেই পোশাকে একটু বড়ো বড়ো দেখাবে তাই পরে তন্ময়ের চারিপাশে ঘুরতে উতলা হয়ে থাকতো। ভারী দস্যি ছিল। তন্ময় সবসময়, সবখানে, সবভাবে ওকে লক্ষ্য করতো। গোপনে খুব করে ওর পাগলামি দেখতো, আশ্চর্যও হতো। এতো ধৈর্য বুঝি কাউকে মাত্রাতিরিক্ত ভালো লাগলেই আসে? নাইলে তন্ময়ের মতন এমন নির্বিকার, চুপচাপ, গম্ভীর পুরুষকে ওমন কিশোরী বয়সে মন দেবার মানেই হয় না।

তার জন্য ওমন আধপাগল কাণ্ড করার কারণও হয় না। ওর বয়সী মেয়েরা তখন সম্ভবত একটু বেয়ারা ছেলেদের পছন্দ করে থাকতো। যারা প্রেমে টপ ক্লাসের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত। পিছু পিছু ঘুরবে, ত্যক্তবিরক্ত করবে। কিন্তু অরু ছিলো ভারী অদ্ভুৎ। তন্ময়ের মতন একজন, যে প্রেমে পাগল অরুকে এড়িয়ে বেড়িয়েছে বছরের পর বছর, এমন একজনকে কী করে কেউ পছন্দ করে যেতে পারে এমন মাত্রায়? সেক্ষেত্রে তন্ময়ের প্রেমে পড়ার, ভালোলাগার, ভালোবাসার হাজারো কারণ আছে। চোখের সামনে এমন সুন্দর দেখতে এক দস্যি মেয়ের চঞ্চলতার প্রেমে পড়া কঠিন কিছু তো নয়, বরঞ্চ সহজ এক বিষয়। তন্ময় মুগ্ধ হতো ওর সব কিছুর ওপর। তন্ময়কে দেখতে পেলেই কেমন জ্বলজ্বল করতো ওর চোখদুটো। শরীরে এক অন্যরকম আনন্দ নিয়ে ঘুরেবেড়াতো তার চতুর্দিকে।

ওর কর্মকাণ্ডই বলে দিতো মুখে বলতে না পারা হাজারো কথা। সতেরোতে ও শুধুই দূর থেকে তার পিছু নিতো। তবে আঠারোতে ওর পরিবর্তনটা ছিলো অন্যরকম, চোখে বিঁধার মতন। ওই বয়সটাই যেন মেয়েদের সৌন্দর্যের বিস্তারিত প্রকাশ ঘটে। তখন বাদলার দিন। যখনতখন ঝুম বৃষ্টি নামে ঘণ্টা পর ঘণ্টা। সেই দিনও নামছিল। ভোর থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছিল। তন্ময় সেদিন বাড়িতেই। ছুটির দিন তো। বিকেলের পরপর বৃষ্টির মাত্রা বাড়ে। আকাশ কালো হয়ে ছিলো। তন্ময় কেবলই উঠেছিল ছাঁদের উদ্দেশ্যে। ছাঁদের দুয়ারে গিয়েই তার পাজোড়া থমকে যায় পুরোপুরি। শ্বাসপ্রশ্বাস ক্ষণিকের জন্য বুকে আটকে রয়। ছাঁদে অরু ভিজছে।

টপটপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে ওর গা জুড়ে। কোমর সমান কালো চুলগুলো ছাড়া। সেগুলো ভিজে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভাঁজে ভাঁজে লেপ্টে ছিল। ওর দু’হাতে তন্ময়ের নেভিব্লু রঙের শার্টটা। বুকে তা শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে। হাসছে, ঘুরছে। বিড়বিড় করে কথাও বলছে। তন্ময়ের হৃৎপিণ্ড তখন উত্তেজিত। কী জোরসে বিট করছিল! মনে হচ্ছিল, হার্টব্লক খাবে সে। দু’হাতের শক্ত মুষ্টিবদ্ধও তার চেতনা ফেরাতে ব্যর্থ। বৃষ্টিতে ভেজা অরু আর অরুর বুকে থাকা তার শার্ট যেন তার জন্য কালবোশেখী ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল। শার্টের বদলে তন্ময় ওই বুকের মধ্যে—এই কল্পনা তার মাথা থেকে কোনোভাবেই যাচ্ছিলো না। এরপর থেকে অরুর পাগলামির মাত্রা দিন বা দিন বাড়ছিলো বৈ কমছিল না। নানাভাবে, নানা কায়দায় তন্ময়কে পাগল না করলে যেন ওর পেটের ভাত হজম হচ্ছিল না। তন্ময়ও ছিলো এক পাগল, প্রচণ্ড রকমের এক উন্মাদ।
অরুর জন্য উন্মাদ, অরুতেই উন্মাদ।

‘স্যার, পেসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।’
তন্ময় চমকে ওঠে। চেতনা ফেরে তার। সামনে-পেছনে না তাকিয়ে মুহূর্তেই দ্রুত কদমে এগোয় পোস্ট অপারেটিভ রুমের দিকে। তার ব্যাকুল, অধৈর্য্য পা-জোড়া একমুহূর্তের জন্যও থামে না। সজোরে একটানে দরজাটা খুলে ঢুকেই থমকে পড়ে। নিপুণ দৃষ্টিতে দেখে বেডে শুয়ে থাকা দেহটা। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে নার্স। অরু শুয়ে আছে। হাতে স্যালাইন চলছে। সে দরজার দিকে ফিরে চেয়েইছিল। তন্ময়কে দেখতে পেতেই ঠোঁট ফুলিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। ডাকে,
‘তন্ময় ভাই…’
তন্ময় বড়ো করে শ্বাস টেনে নেয়। অনুভব করে তার অশান্ত হৃদয় শান্ত হয়ে পড়েছে এক পলকেই। হৃৎপিণ্ডের গতি স্বাভাবিক হয়েছে। অসহনীয় হয়ে ওঠা পৃথিবীটা মুহূর্তে সহনীয় হয়ে যাচ্ছে। তন্ময়ের সাড়া না পেয়ে অরু ফুপিয়ে বিড়বিড় করে ওঠে,

‘আমাকে কী আর আপনার ভালো লাগছে না? বাচ্চাদের পেয়ে বুঝি আমাকে আর মনে নেই আপনার!’
বলতে বলতে উঠে বসতে চাইলে তন্ময় অসহায় কদমে দ্রুত এগিয়ে জাপ্টে ধরে ওকে। শুইয়ে দেয় সাবধানের সাথে। দু’হাতে অরুর ফ্যাকাসে মুখখানি ধরে অজস্র চুমু বসায় একেক করে মুখের প্রত্যেকটা অংশে। নাকের ডগায় গাঢ় চুমু খেয়ে চোখের মণিতে চায়। অরুর চোখ দুটোতে তারাদের নিবাস। তন্ময় সেই চোখ দুটোতেও ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। একটি হাতের পাতা নিজের দুটো হাতের পাতায় জড়িয়ে নিয়ে মিহি স্বরে শুধায়,
‘কেমন লাগছে এখন?’

অরু নাক টেনে বলে, ‘খুব ভালো লাগছে। আমিতো এখন আপনার বাচ্চাদের মা।’
তন্ময় ঠোঁটে ঠোঁট টিপে ধেয়ে আসা হাসিটুকু গিলে ফেলতে চেয়েও পারে না। হেসে ফেলে শব্দ করে। মাথা নুইয়ে অরুর হাসি মাখা ঠোঁটে শক্ত করে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘হুঁ, আমার বাচ্চাদের মা। এখন কী বাচ্চাদের পাশাপাশি বাচ্চার মাকেও পালতে হবে নাকি শুধু আদর করলেই হবে?’
অরু ভারী লজ্জা পায়। দৃষ্টি নামায়। তন্ময়ের দিকে চাইতেই পারে না। সেভাবেই বিড়বিড় করে বলে,
‘আমি কি বাচ্চা নাকি?’

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৭৯+৮০

তন্ময় আগ্রহী হয়, ‘ওহ, তাহলে তো পালতে হবে না। খুব আদর করতে হবে, তাই তো?’
অরু অন্যদিকে চেয়ে দু’গাল ভরে হেসে মাথা দোলায়। পরমুহূর্তেই এক হাত ছড়িয়ে দেয়। জড়িয়ে ধরার আহ্বানে সাড়া না দেবার সামর্থ্য কী তন্ময়ের আছে? নেই তো। সে ঝুঁকে অরুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আলতোভাবে। চোখজোড়া বুজে বড়ো করে শ্বাস টেনে নেয়। চুলে ঠোঁট ছুঁইয়ে হাত বুলিয়ে আওড়ায়,
‘আমার পৃথিবী তুই ছাড়া অসম্পূর্ণ, জান। তুই আমার পৃথিবীর, চাঁদ। আমার বেঁচে থাকার অনেক বড়ো কারণ।’

শাহজাহান তন্ময় শেষ পর্ব 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here