বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৩৮+৩৯
রোজা রহমান
বৃষ্টিকে ঘরে এনে তুষার প্রায় আধাঘন্টা ধরে জড়িয়ে ধরে আছে৷ সে বৃষ্টিকে এনে প্রথমে খাটে বসিয়ে হেলিয়ে আধশোয়া করে শুইয়েছে৷ এরপর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে বৃষ্টিকে জড়িয়ে বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে৷ কোনো কথা-ই বলছে না। শুধু চোখ বন্ধ করে অনুভূতিটাকে প্রকাশ করছে। বৃষ্টি এই পাগলামোকে কি বলবে? সে নেতানো শরীর নিয়ে স্বামীর চুলে হাত চালাচ্ছে। আর মুচকি মুচকি হাসছে৷ এবার বৃষ্টি বলল,
” এ্যাই যে এএসপি অফিসার সাহেব তোমাকে এই মূহুর্তে বাচ্চা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না। ”
” আমি বাবা হব এটার আনন্দ কি দিয়ে প্রকাশ করব বৃষ্টি?”
বৃষ্টি কী বলবে বুঝল না। তুষার আরেকটু গভীর হলো বলল,
” আমার বুক ঢিপঢিপ করছে। শুনতে পারছ না? ”
” হুঁ, আমার পুলিশ অফিসার স্ট্রোং পারসোনালিটির স্বামীর উত্তেজনা আমি গভীর থেকে বুঝছি। সে বাবা হবে। ডানা থাকলে উড়ত কি? ”
তুষার এবার দাঁত বের করে হাসল নিঃশব্দে৷ বৃষ্টি ঠোঁট টিপে দুষ্টু হাসল। তুষার বৃষ্টির গ্রীবাদেশে একটা গভীর চুমু দিল। এরপর মাথা তুলে বৃষ্টির দিকে তাকাল। কী সুন্দর মুখ! সে মুচকি হেসে বলল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
” থাকলে উড়তাম তোমাকে নিয়ে ”
বলে কপালে চুমু খেল। এরপর হাতের পিঠে খেল৷ বলল,
” বেস্ট অনুভূতি হচ্ছে। তাই বলে আর প্রকাশ করব না৷ কাল সকালে রেডি থেকো। তোমাকে ডক্টরের কাছ থেকে রেখে তবেই আমি যাব। ”
বৃষ্টি মুগ্ধ চোখে দেখেই গেল শুধু স্বামীকে। প্রত্যুত্তর করল না। তার নিজেরও মা হবার আনন্দ ভেতর প্রর্যন্ত নাড়িয়ে তুলছে। মা হবার স্বত্বাটাকে জাগিয়ে তুলছে।
” তা যাক এখন আমি বাইরে যাব কিকরে সেটা বল আগে? আজ বাবা, চাচুরা বাড়িতে”
শিশিরের কথায় কুয়াশা মুখ তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বোঝার চেষ্টা করল বললটা কি শিশির? কুয়াশাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শিশির আবার বলল,
” এই যে আমার গালে যে বাইটটা দিলি এটাকে কি বাইট ধরব? লাভবাইট নাকি এ্যাঙ্গরিবাইট? ”
কুয়াশা এবার বুঝল বিষয়টা৷ নজর দিল শিশিরের কামড় দেয়া গালে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির মাঝে কামড় দেয়ার দাগটা স্পষ্ট হয়ে আছে। দাঁত বসে তা স্পষ্ট। জোরে যে দিয়েছে কামড়। এই জন্য দাগটা স্পষ্ট। বিষয়টা বুঝতে পেরে একটু বিব্রত হলো কুয়াশা। বাইরে যে লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি হবে এটা নিশ্চিত। তবুও দমল না। এটাকে শিক্ষা দিতে পেরে আনন্দিত সে। বলল,
” তা আমি কি জানি? তোমার দায় তুমি বুঝো গিয়ে। আমার দেখার নেই। ”
” আচ্ছা? ”
” হুঁ ”
শিশির বলল,
” সকলে জিজ্ঞেস করলে বলব, তোমাদের আহ্লাদী কামড়েছে। ”
কুয়াশা থতমত খেয়ে তাকাল শিশিরের দিকে। বুনো ওলটা মজা নিচ্ছে। শিশির কুয়াশার পানে চেয়ে দুষ্টু চোখে দুষ্টু ঠোঁটে হাসছে৷ কুয়াশা তা দেখে মুখ ঝামটা দিয়ে ঘরের দরজা খুলে বাইরের পথ ধরল। যেতে যেতে বলে গেল,
” আর হ্যাঁ, ওটা অবশ্যই এ্যাঙ্গরিবাইট। তোমাকে লাভবাইট দিতে আমার বইয়ে গেছে, হুহ।”
” তোর দিতে হবে না আমি দিলেই হবে। ”
কুয়াশা সে কথা শুনেও না শোনার মতো করে মুখ ঝামটিয়ে চলে গেল। কুয়াশা যেতেই শিশির সশব্দে হেসে ফেলল। বউ জিনিসটা তো ভালোই! মনে মনে ভেবে আরো হাসল। এরপর মিররের সামনে দাঁড়িয়ে দেখল স্পষ্ট দাঁতের দাগ। করেছেটা কী ফাজিলটা! এটা নিয়ে এখন বাইরে যাবে কিকরে এটা ভেবেই বিরক্ত হচ্ছে সে। ঠিক পেলে নির্ঘাত মজা উড়াবে।
ভাবতে ভাবতে ঘড়ি দেখল৷ সকাল দশটা পাড় হয়েছে, তাই সে বাথরুমে ঢুকল। জুম্মার নামাজ আছে৷ গোসল করে ফেলা যাক৷ গোসলের পর যদি একটু দাগটা মেশে!
জাকির মালিথা ও জাহিদ মালিথা নতুন অতিথির কথা শুনে আনন্দে আটখানা হয়ে গেছেন৷ জাকির মালিথা জানিয়েছেন বিকেলে মিষ্টি বিলাতে। পরের শুক্রবারে এতিম বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের জন্য খাবার আয়োজন করবেন। আর মসজিদে মিলাদ পড়িয়ে মিষ্টি বিলাবেন। এসব শুনে বাড়ির সকলে খুশি হলো। নতুন অতিথির আগমনী বার্তায় একটু সকলের কাছে দোয়া না নিলে হয়!!
শিশির এতক্ষণ নিজের ঘরেই ছিল৷ আযান দিয়ে দিয়েছে এইজন্য নিচে যেতেই হবে এখন৷ উপায় না পেয়ে নিচে গেল। দাগটার উপর পাউডারের প্রলেপ দিয়েছে। যদিও কোনে কালে এসব দেয় না। এখন বউয়ের পাল্লায় পড়ে এসবও করতে হচ্ছে। কী দিন এলো তার!! ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। বুকে, গলায় কামড়েছে আগে সেসব শার্ট, টিশার্টেই ঢাকতে পেরেছে৷
নিচে গিয়ে দেখল বাবা, আর চাচু বাদে ভাইরা সব রেডি হয়ে বসে আছে। সে-ও পাঞ্জাবি পড়ে রেডি হয়ে নেমেছে৷ একটু পর সকলে মিলে নামাজে যাবে। বিরক্ত মুখে, বিব্রত ভাব নিয়ে গিয়ে বসল। নীহারের পাশে। এই ছেলে টের না পেলেই হবে৷ এ টের পাওয়া মানে সকলের নজরে পড়া৷ ভাগ্যক্রমে নীহারের সাইট-ই কামড়ের পাশটা পড়েছে৷ নীহার কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মুখটা তৎক্ষনাৎ বন্ধ করে শিশিরের গালের দিকে চেয়ে রইল৷ জহুরী নজর দিয়ে বলল,
” মেকআপ করা কবে থেকে ধরলি তুই? ”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল শিশির। মেকআপ! সে মেকআপ কবে, কখন করল? ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
” তোর মনে হচ্ছে আমি মেকআপ করা? ”
” হ্যাঁ এই তো স্পষ্ট ভেসে উঠেছে। সাদা সাদা কি যেন! ”
শিশির আবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কোথায় ভাবল পাউডারের প্রলেপে এদের হাত থেকে বাঁচবে আজকের মতো। তবুও এই ঈগলটার চোখে পড়ে গেল!!
শিশিরকে কিছু বলতে না দেখে নীহার কিছু বোঝার চেষ্টা করছে৷ এই ছেলেটা পাক্কা পাজি। সব তালে থাকে৷ এক ভাই হিসেবে ট্রিট করবে আবার বন্ধুর মতো মজা নেবে সব বিষয়ে। সে এবার একটু জোরেই বলল,
” তোকে কুশু কামড়েছে? তাও গালে? ”
তুষার, তুহিন, হিম এবার ওদের দিকে নজর দিল অপর পাশ থেকে। শিশির কপাল চাপড়ে বসে রইল। মাইন ইজ্জত এরা দুই ভাইবোন মে-রে দিল তার। একজন কামড়েছে তো একজন ঢোল পি’টি’য়ে ষোলকলা পূর্ণ করছে। জীবনটা তার ত্যানা ত্যানা এরা দু’টোই করল। তুষার, তুহিন চোখ মুখ কাঁচুমাচু করে ফেলল। এ দু’টো এত ফা’জিল কেন! নীহার ঠোঁট টিপে হাসছে৷ ভালোই মজা নিতে পারছে৷ সেই সময়ে ইয়াসমিন আর কুয়াশা বৃষ্টিকে নিয়ে নেমে এলো। বৃষ্টির গোসল করার পর একটু ভালো লাগছে। তাই ঘরে আর থাকল না। নীহার ওদের আসা দেখে কিছু বলতে যাবে সেসময়ে হিম বলে উঠল,
” এ্যাই বুবু.. তুমি শিশির ভাইকে কামড়েছ কেন? ”
ল্যাহ হয়ে গেল এইটারই কমতি ছিল। এই লিলিপুটটা সুযোগ বুঝে বর্শি ফেলে। কুয়াশা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকাল৷ এতগুলো বড় ভাই, ভাবির সামনে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেল। আগে যদিও কামড়েছে কিন্তু সেটা রাগ, জেদ, হিংসা, সহ্য করতে না পাড়ার জন্য। কিন্তু এখনের কামড়ের মানে অন্যরকম। শিশির কুয়াশার দিকে কিড়মিড় করে কটমট নজরে তাকাল৷ ভাবটা এমন এখনি কুয়াশাকে কাঁচায় খেয়ে ফেলতে পারলে বাঁচত। যত দোষ এই এটার৷ ফা’জিল বুক, পিট ছেড়ে এখন গালে এসেছে। কবে না ঠোঁটেও কামড়ে দেয় ভেবেই আরো রেগে উঠল৷ জীবনটা কামড়ময় হয়ে গেল এই গোবর ঠাঁসার জন্য।
শিশির ভাবতে না ভাবতেই নীহার কথাটা বলেই দিল। সে শিশিরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” এ ভাই, প্রথমে পিঠে খেয়েছিস, তারপর বুকে, আজ গালে এরপর কনফার্ম ঠোঁটে খাচ্ছিস। জীবন তোর কামড়ময়। হায় আফসোস!! ”
এই বলে সে হা-হুতাশ করতে লাগল৷ আর শিশির? সে চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইল। এরা কী দিয়ে তৈরি? বড় ভাই হয়ে এমন কমেন্ট!
এদিকে বৃষ্টি, ইয়াসমিন জোরে হেসে দিয়েছে হিমের কথা শুনে। তুষার, তুহিন মিটমিট করে হাসছে। ভাই, বোনগুলো তারা পেয়েছে বটে, পুরাই অষ্টম আশ্চর্য। শিশির এবার না পেরে হিমকে বলল,
” এ্যাই ফাজিল! তোর মুখ চুপ থাকে না?”
” ল্যাও ঠ্যালা, যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর! আমি তো তোমার প্রতি দরদ দেখালাম৷ সেই তুমিই আমাকে বকছ? বুবু তোমাকে কামড়েছে তাইতো বললাম! ”
আবার হেসে ফেলল বৃষ্টি, ইয়াসমিন এবার নীহারও হাসল শব্দ করে। কুয়াশা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না৷ সে এবার কান, নাক দু’টো-ই মলা দিল, জীবনেও আর গালে কামড় দেবে না। খুবই লজ্জাজনক পরিস্থিতি। শিশির এবার উঠে গিয়ে হিমের মুখ চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” চুপ কর ফাজিল ”
হিম হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। সে এতটাও ছোট না যে এইসব বুঝবে না। মেয়েদের সাথে এই বয়সেই ফ্লার্ট করে বেড়ায়। সে ছেলে পাকনা হবে না!!
সকলে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। বিয়ের পর থেকে শিশির, কুয়াশা মালিথা ভিলায় বিনোদনের মাধ্যমে হয়ে উঠেছে। যে যেমন পারে মজা করে বিনোদন নেয়। জীবনডা বেদনাময়, কামড়ময়, বিনোদনময় হয়ে গেল তাদের।
বিকেলের দিকে তুষার সহ তুহিন মিলে মিষ্টি নিয়ে এলো। সকলে মিষ্টি মুখ করল৷ এবং আশেপাশের কিছু বাড়িতে দেবার ব্যবস্থা করল। বৃষ্টির বাবা পরের শুক্রবারে আসতে চেয়েছেন। এসে মেয়েকে দেখে যাবেন বলেছেন৷
জাকিয়া পাড়াঘরে মিষ্টি দেবার দায়িত্ব কুয়াশা আর ইয়াসমিনকে দিলেন৷ বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে তারা বাড়ি থেকে বের হলো। বৃষ্টি বলল সে হাঁটবে একটু। জাকিয়া অনুমতি দিলেন। বললেন বাড়ির সামনেই হাঁটতে। আর কোথাও না যেতে। তিন জা একসাথে বের হলো। বৃষ্টি বাড়ির সামনে রইল আর কুয়াশা, ইয়াসমিন পাশের বাড়ি গেল।
শিশির ঘরে আধশোয়া হয়ে ফোন টিপছে। কিছুক্ষণ পর বাইরে যাবে৷ এমনই সময়ে কোথা থেকে কুয়াশা বিদ্যুৎ বেগে দৌড়ে এসে শিশিরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। শিশির চমকে উঠল৷ বিষয়টা এত তাড়াতাড়ি হলো বুঝতে একটু সময় নিল। যখন বুঝল কুয়াশা ফাঁপর দিয়ে কান্না করছে তখন বিস্মিত হলো৷ এভাবে আজ অবধি কেঁদেছে এ? আজ কি হলো তবে? কোথা থেকেই বা এলো? কান্না করছে কেন? আর সহ্য হলো না৷ হতবাক মূহুর্ত কাটিয়ে তড়িঘড়ি করে কুয়াশাকে নিয়ে উঠে বসল৷ কোলের উপর বসিয়ে নিল৷ আগলে ধরল। হতভম্ব হয়ে একের পর এক জিজ্ঞেস করতে লাগল,
” এ্যাই কুয়াশা…! কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? বল আমায়! আরে এভাবে কাঁদছিস কেন? কে কি বলেছে? এ্যাই সোনা..? আরেহ্! ”
বলতে বলতে কুয়াশাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল৷ সে শিশিরের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে৷ কাঁদছে তো কাঁদছেই৷ থামাথামি নেই। কান্নার রেশটাও বুকে লাগার মতো৷ এই আহ্লাদীকে আজ প্রর্যন্তও এমন হৃদয়বিদারক কান্না করতে দেখেছে খুব কম৷ বাবার জন্য ছাড়া কারো জন্য কান্না করে না৷ আর আজ এর কি হলো? বাবার কথা মনে পড়ছে কি? ভেবে আবার গলার মাঝে থেকে কুয়াশা মুখটা তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু সে শক্ত হয়ে আছে। শক্ত করে ধরে আছে গলা। মুখ তুলতে নারাজ৷ শিশির মাথায় হাত দিয়ে বুলোতে বুলোতে বলল,
” এ্যাই সোনা..? বাবার কথা মনে পড়ছে?”
কোনো রেসপন্স নেই তার।
” আরেহ্ বলনা রে কি হয়েছে? কে কী বলেছে আমার বউকে? থাম এবার.. চুপ কর। এ্যাই কুশু..!”
কুয়াশা এমন ভাবে কাঁদছে যে কেউ তার কান্নার আওয়াজ শুনলে নড়ে উঠবে৷ ভেতরে হৃদয় ভেঙে গেলে যেমন কষ্টের কান্না আসে তেমনই কান্নার আওয়াজ। ওর কান্নার আওয়াজে শিশিরের ভেতর তোলপাড় হলো। কি এমন হলো? সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল এবার। আগে কান্না করে নিক। এভাবে বলবে না৷ বোঝা হয়ে গেছে।
এরই মাঝে সকলে হতভম্ব হয়ে ছুটে এলো। আগে এলেন জাকিয়া। এসেই হতভম্ব হয়ে বললেন,
” কি হয়েছে? এ্যাই শিশির ও এমন কান্না করছে কেন? কি করেছিস আমার মেয়ের সাথে ”
শেষ কথাটা বেজায় রেগে বললেন জাকিয়া। আজমিরা এসে মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। এ তো পাড়ায় গেছিল মিষ্টি দিতে। এখন আবার কান্না করছে।
” শিশির! আব্বুরে কি হয়েছে ওর? কাঁদছে কেন? কিছু করেছিস? ”
মা, বড় আম্মুর কন্ঠ পেয়ে কুয়াশা কান্নার রেশ কমিয়ে শিশিরের থেকে উঠে সরে আসতে গেল কিন্তু, শিশির সরতে দিল না। এমনকি সে নিজেও ছাড়ল না। জড়িয়ে রাখল। তা টের পেয়ে কুয়াশাও আর সরল না৷ তার কান্না এবার ফুঁপানিতে রূপ নিল। এবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ইয়াসমিন হতভম্ব হয়ে এলো৷ একে একে সকলে চলে এলো এবার। সকলে এসে এক কথা জিজ্ঞেস করল,
” কি হয়েছে? ও এমন কাঁদছে কেন? কি করেছিস শিশির ওর সাথে? ”
সকলে ভাবছে শিশির মে-রেছে। শিশির এবার না পেরে উত্তর করল,
” বিশ্বাস করো আমি কিছু করিনি৷ আমি নিজেও জানি না কি হয়েছে। হঠাৎ-ই এসে এভাবে কাঁদতে লাগল। এত জিজ্ঞেস করছি কিছুতেই কিছু বলছে না। শুধু কান্না করে চলেছে ”
এবার ইয়াসমিন উত্তর করল৷ কুয়াশার সাথে সেই ছিল। কুয়াশা একদম বিদ্যুৎ গতিতে দৌড়ে এসেছে বলে ইয়াসমিন ওর সাথে আসতে পারেনি। ইয়াসমিন সবটা বলতেই শিশিরের চোয়াল আপনাআপনি শক্ত হয়ে গেল৷ শরীরের রগ ফুলে ফেঁপে উঠল। রাগে মাথা দপদপ করতে লাগল। কুয়াশাকে সেই রাগে আরো জোরে চেপে ধরল বুকের সাথে। সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ইয়াসমিনের মুখে সব শুনে৷ নীহার, তুহিন, তুষার শুনে তৎক্ষনাৎ বেড়িয়ে যেতে নিলে শিশির বলল,
” থামো ভাই.. জবাব আমি দেব।”
বলে সে কুয়াশাকে এবার তুলল বুক থেকে। বিধস্ত মুখ তার। কান্নার জেরে চোখ, মুখ লাল হয়ে গেছে। ফুঁপাচ্ছে অনেকক্ষণ কান্নার ফলে৷ শিশির যত্ন করে চোখের পানি মুছে দিল। সকলে দেখল শিশিরের যত্ন, দায়িত্ব। জাকির মালিথা, জাহিদ মালিথা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন। তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আগলে রাখতে এই ছেলেই পারবে তাদের মেয়েকে৷ শিশির বউয়ের চোখ মুছিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
” চুপপ।”
কুয়াশা বাচ্চাদের মতো ফুঁপাচ্ছে। শিশির তা দেখল। দেখে কুয়াশাকে নামিয়ে পাশে বসিয়ে দিল। এরপর কোনো কথা না বলে হনহন করে বড় বড় পা ফেলে বেড়িয়ে গেল৷ পেছন পেছন তুষার, তুহিন, নীহারও গেল।
এদিকে মা, চাচিরা, ভাবিরা কুয়াশাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন৷ জাকিয়া বৌমাকে বুকে চেপে ধরলেন। তাদের ছোট্ট মেয়ে৷ আজমিরা চোখের পানি ছেড়ে দিলেন৷ একমাত্র মেয়ের কষ্টটা বুঝতে একটুও সময় লাগছে না তার। আম্বিয়া মাথায় হাত বুলিয়ে নানান ভাবে বোঝাতে লাগলেন৷
জাকির মালিথা, জাহিদ মালিথা ওদিকে আর গেলেন না৷ উনারাও নানান ভাবে মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।
কথায় আছে না? সমাজের মানুষের কথার থেকে বড় ধারাল অস্ত্র আর দুটি নেই। যা দিয়ে অপর পাশের মানুষটির হৃদয় পর্যন্ত ক্ষত বিক্ষত করতে সক্ষম হয়। চামড়ার মুখ দিয়ে একটা কথা একবার বের করে ফেললে তা ঘোচাতে জীবন শেষ। তারা বলার দরকার বলে দেয়। সেই কথাটা যে অপর মানুষের উপর কেমন প্রভাব পড়বে সে-সব ভাবাভাবির প্রয়োজনবোধ বলে মনে করে না। মানুষের কথার রসাতলে একবার পড়লে তা তিল থেকে তাল হয়। অন্যের নামে ঘাটাঘাটি করতে কার না ভালো লাগে? এতে কত মজা পায় না? মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণী! নিজের পেছনে লেজ আছে কিনা দেখার চেষ্টা করে না, অন্যর লেজ খুঁজতে তাদের যত দুনিয়ার আগ্রহ। নিজের খাবে পরের গীত গাবে৷ এটাই মানুষজাতি।
শিশির গিয়ে সেই বাড়ির সামনে দাঁড়াল। তাদের বাড়ি থেকে দুইবাড়ি পরে। এই বাড়ির মধ্যে বয়স্ক মহিলাটা অতিরিক্ত খারাপ। তার কাছে কখনো কেউ ভালো হতে পারে না, সে যত দুনিয়ার ভালো। একটা কথা শুধু শুনবে ব্যস তখন থেকে গীত গাবে৷ আর তার নজর পাড়ার যত ছেলে-মেয়ে থেকে শুরু করে কোন বাড়ি কোন বউ কী করে! মেয়ে কী করে! এসব দেখা।
শিশির চেঁচিয়ে উঠল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। মহিলার নাম ছাবিনা। তারা কাকি বলে ডাকে। সেটা বলেই সম্মোধন করল। আগাগোড়াই এই মহিলাকে সে সহ্য করতে পারে না। মহিলার এই স্বভাবের জন্য। আর আজ তো সহ্যসীমা বাহিরে চলে এসেছে। স্বামী নেই বলে আরো বিবাগী। মহিলা ওমন বাজখাঁই কন্ঠ পেয়ে বেড়িয়ে এলো। ওদের চার ভাইকে একসাথে দেখে তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। বিভীষিকা চেহারা নিয়ে এসে দাঁড়ালেন। একটু আগে যে তিনি কী করেছেন ভেবে হাত পা ঠান্ডা করে ফেললেন। কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করল শিশির,
” কুয়াশাকে কি বলেছেন আপনি? ”
ভয়ে ঢোক গিললেন তিনি। কন্ঠটা এতটা রূঢ় তিনি রীতিমতো ঘামতে লাগলেন। কোনো উত্তর না পেয়ে শিশির আবার একই কন্ঠে বলে উঠল,
” ওর পরিচয় ও মালিথা বাড়ির একমাত্র মেয়ে। জালাল মালিথার একমাত্র নাতনী, জাকির মালিথার ছোট বৌমা, জাহিদ মালিথার একমাত্র ভাতিজি, জাহিন মালিথার একমাত্র আদরের মেয়ে। তারথেকে বড় পরিচয় ওর, ও শিশির মালিথার একমাত্র আহ্লাদী বউ। আপনার সাহস কিকরে হয় আমার বউকে এতসব জঘন্য কথা শোনানোর? ”
কেঁপে উঠলেন তিনি। কারণ শেষ বাক্যটা এতটাই বাজখাঁই, রূঢ়, গম্ভীর, ভারীক্কি ছিল যে কোনো মানুষের হৃদয়-রূহ, অন্তর-আত্না কেঁপে উঠতে বাধ্য তা শুনে। পেছনে থাকা তুষার, তুহিন, নীহারেরও হৃদয়ে গিয়ে বাড়ি দিল শিশির বলা শেষ কথাটা। তারা অবাক চোখে বিস্মিত হয়ে শুধু চেয়ে আছে।
এদিকে মহিলার অবস্থা খারাপ। কথা বলার সাহসটুকুও পাচ্ছেন না৷ কারণ শিশির অস্বাভাবিক রেগে। কিছু বললেই বোধহয় এখানে খু–ন করে দেবে। শিশির আবার বলল,
” আমার বউ বার পুরুষের খাওয়া হোক আর ওর সতীত্ব না থাকুক সেটা আপানাকে কে দেখতে বলেছে? আমার বউ আমি বুঝব, আমি দেখব। আমি ও’কে তিন কবুল বলে গ্রহণ করেছি। আপনার এসব দেখার আছে? ”
কোনো কথা নেই মহিলার। সে আবার বলল,
” ও যদি সতিত্ব খুঁয়ে-ই আসে পতিতালয় থেকে আপনাকে সেটার প্রমাণ দেবার প্রয়োজন পড়বে আমার? আছে কি আমার প্রয়োজন? ”
শিশরের প্রতিটা কথা হৃদয় কাঁপিয়ে তুলছে। চোখ মুখ অস্বাভাবিক লাল। মুখে দাম্ভিকতার ছাপ সাথে রাগের ঝাঁঝ।
” ও যেখানেই রাত কাটিয়ে আসুক তবুও ও আমার মান, ও আমার সম্মান। আপনার সাহস কিকরে হয় আমার সম্মানে আঘাত করার? ”
” উত্তর দিন…!”
আবার কেঁপে উঠলেন। বার বার শুকনো ঢোক গিলছেন৷ তিনি কোনো উত্তর করতে পারছেন না। শুধু এটা বুঝে গেছেন বাঘের গুহার আদরের সম্মানে হাত দিয়েছেন আর সব বাঘ এখন খেপে উঠেছে৷
এবার শিশির একটু মুখটা এগিয়ে ঝুঁকে কন্ঠ খাদে নামিয়ে আগের ন্যায় রূঢ় স্বরে বলল,
” ওর ভা’র্জি’নিটি আই মিন সতিত্ব দেখার বিষয় আমার৷ বউ সে আমার। সে-সব চিন্তা আপনার কেন এত? আর এসবের জন্য, বাড়ির সম্মান রক্ষা করার জন্য যদি বাড়ির ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে-ই থাকে তাহলে আপনার কি খসে পড়েছে? আপনার মেয়ের মতো আমার বউ বার-ভা** রী? বার পুরুষের খাবার দ্রব্য তো আপনার মেয়ে। পাড়ার মানুষ কিছুই টের পায় না? ঘাসে মুখ দিয়ে চলে ভাবেন? আর মেয়ের কথা বাদ দিলাম আপনার ছেলে যে বার মেয়ে খেয়ে বেড়ায়! সেটা বলতে এসেছি আমি? তবে আপনি কেন আমার বউকে কদর্যপূর্ণ কথা বলেন? কোন সাহসে বলেন? ”
আসলে যে যেমন তার সাথে তেমনভাবে কথা বলাটাই উচিত। যে যেমন ব্যাবহারে যোগ্য তার সাথে ঠিক তেমন ব্যাবহার-ই মানানসই। মহিলাটা এত এত নোংরা কথা বলেছেন কুয়াশাকে যে যেকোনো মানুষ শুনলে আস্তাগফিরুল্লাহ্ পড়তে বাধ্য হবে। আর তার ছেলে মেয়েরা ঠিক ঐ জাতের৷ কিন্তু তিনি নিজের পেছন কখনো তাকিয়েও দেখেন না। কিছু মহিলা থাকে না এমন? এই মহিলা ঠিক ঐ জাতের, ঐসব মহিলার কাতারে পরে৷
শিশির কথাগুলো আস্তে বললেও পেছনে থাকা তুষাররা ঠিকই শুনল। আর শুনে ওরা হতভম্ব, হতবাক হয়ে রইল৷ শিশির যে এমন ভাষা দেবে সেটা ধারণায় ছিল না। তারা বুঝল এ ছেলের সম্মান কুয়াশা, আত্না কুয়াশা তাকে কেউ কদর্যপূর্ণ কথা বলেছে আর সে মেনে নেবে? তার সম্মানে হাত দিয়েছে এই মহিলা। বাড়ির কোনো মানুষের আজ অবধি ক্ষমতা হয়নি কয়াশাকে এভাবে কাঁদানোর আর এই মহিলা সেই সাহস দেখিয়েছে। ভাইরা, চাচুরা যত্নে, আদরের, ভালোবাসার চাদরে ঢেকে রেখেছে সবসময়। কোনো কু-নজর পড়তে দেয়নি কখনো৷ তাদের সকলের একমাত্র আহ্লাদী ঐ মেয়ে। বিস্ময় নিয়ে শুধু মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইল তিন ভাই৷ কিচ্ছুটি বলল না। আর না শিশিরকে আঁটকানোর চেষ্টা করল।
মহিলাটা বোধহয় এখানে হার্ট অ্যাটাক করে মা-রা যাবেন এত এত ভারী কথার যাঁতাকলে পড়ে৷ তিনি কী বলবে বুঝছেন না৷ কারণ শিশির যা বলছে কিছুই মিথ্যা না৷ তিনি কুয়শাকে এসবই বলেছেন৷
কুয়াশা ইয়াসমিন মিষ্টি দিতে এসেছিল অনেক হাসি মুখে৷ কিন্তু মিষ্টি দিতে আসতেই তিনি কুয়াশাকে জিজ্ঞেস করেন,
” কিসের মিষ্টি?”
কুয়াশা বলতেই তিনি তার গীত শুরু করেন। বাড়ির ছেলে সাথে বিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে একের পর এক বলেই গেছেন৷ সে-সবের জবাব সম্পূর্ণ কুয়াশা পুরোটা দাম্ভিকতার সাথে দিয়ে গেছে এই মহিলাকে৷ কিন্তু জবাব দিয়ে সে আর ঠিক থাকতে পারেনি। তার ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলেছে কথাগুলো। একটা মেয়ের নিজের কানে যে এসব শোনা কতটা কষ্টদায়ক, যন্ত্রণাদায়ক আর সম্মানে লাগা সেটা যে মেয়ে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে সেই বুঝবে৷ কানে যেন গরম সীসা ঢালার ন্যায় যন্ত্রণাদাক মনে হয়। কোনো মেয়েই চায় না তার সম্মান নিয়ে, সতিত্ব নিয়ে কেউ কথা শোনাক৷ যেমনটা সে নাকো-ই। সে যদি ঐসব কাতারের মেয়ে হতো তবে মানতে পারত, হজম করতে পারত কথাগুলো৷
কুয়াশার সাথে যা হয়েছে সব ভাগ্যর পরিহাস সে নিজে ইচ্ছেতে তো সেখানে যায়-ই নি! আর বার-পুরুষের খাবার দ্রব, বার-পুরুষ খেয়েছে এইসব কথা তার ভেতর পর্যন্ত ভে’ঙে দিয়েছে। জীবনে যেসব শুনেনি, যেসব কথার ধারে কাছেও যায়নি সেসব শুনতে কার ভালো লাগবে? ভদ্র ঘরের, ভদ্র মেয়ে সে অথচ, তার নামের সাথে জঘন্য কলঙ্ক লেপ্টে দিয়েছে। কালি যার সম্মানে একবার লাগে তা কী কখনো ওঠে? আল্লাহর ভাগ্যর পরিহাসে সে অপহ’র’ণ হয়ে একরাত পতিতালয়ে ছিল সেটাই হয়েছে ওর জীবনের কাল। যদিও সব সত্যি সে নিজে বলেছে কিন্তু মানুষ কি মুখের সাফাইতে বিশ্বাসী? যেখানে নিজের চোখে তারা কিছুই দেখেনি৷ কুয়াশা শক্ত মনে এতদিন সকলকে বলে গেলেও, শক্ত মনে এতদিন থেকে গেলেও এতটা কদর্যপূর্ণ কথা আজ শুনল সে৷ তাই আরোই সহ্য করতে পারেনি৷ মেয়েটার ভেতরের সব ভেঙে এই জন্য কান্না এসেছে৷ এত বড় বড় কথা তার হজম করতে খুবই কষ্ট হয়েছে।
শিশির মহিলাটাকে কোনো কথা বলতে না দেখে এবার অতিশয় রাগ নিয়ে মুখে কাঠিন্যতা রেখে হাতের মুঠো পাকিয়ে রগ ফুলিয়ে বাজখাঁই কন্ঠে বলে উঠল,
” কসম আল্লাহর, আপনি যদি আমার বড় না হতেন আর মহিলা না হতেন আমি এখানেই আপনাকে পুঁ-তে রেখে যেতাম। আমার বউকে আঘাত করেছেন অর্থাৎ আমার বুকে আঘাত করেছেন৷ আজকের এইসব কথা আর দ্বিতীয়বার যদি শুনি আমি ভুলে যাব আপনি একজন মহিলা, আমার বড় ”
থেমে আবার চোখ মুখ লাল করে কপালের শিরার রগ ফুলিয়ে দাম্ভিকতার সাথে বলল,
” ওর একমাত্র জোর ওর স্বামী। ওর শক্ত মেরুদণ্ড ওর স্বামী। ও সেই জোরে, সেই মেরুদণ্ড উঁচু করে সমাজে চলবে। স্বামীর শক্তিতে বাঁচবে। আমার বউয়ের নিঃশ্বাসের বাতাস যতোদূর যাবে ততোদূর পর্যন্ত যেন আপনার ছায়াও না দেখি। আমি চাইনা আমার বউয়ের নিঃশ্বাসে কোনো দূর্গন্ধ বাতাস ঢুকুক।”
এই বলে আর এক সেকেন্ডও সেখানে পা রাখল না৷ যেই ভাবে এসেছিল ঠিক সেই রেশ ধরেই হনহন করে চলে গেল। তুষার, তুহিন, নীহার যেতে যেতে কঠিন নজর দিয়ে গেল মহিলাটাকে। মহিলাটা একটা কথাও বলার সাহস দেখাতে পারল না৷ যদি দেখাত বোধহয় আর বড় মানত না শিশির।
বাইরে আসতেই মাগরিবের আযান দিয়ে দিল৷ তাই বাড়ির দিকে আগাল না কেউ৷ চারভাই মসজিদে দিকে রওনা দিল৷ নামাজ পড়ে বাড়ি ঢুকবে। তার আগে শিশিরকে জড়িয়ে ধরে বাহবা দিতে কেউ ভুলল না। তিন ভাই একই সুরে বলল,
” বাবা, চাচুরা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেন নি৷ তারা সঠিক মানুষ বিবেচনা করেই আমাদের বোন দিয়েছেন৷ ”
উত্তরে শিশির শুধু মুচকি হেসেছে৷ এতদিনে ঐ মেয়ে তার বড্ড আপন হয়ে উঠেছে। তখন যেভাবে কাঁদল তার নিজেরও অন্তর ছিঁড়ে যাচ্ছিল। আর যখন শুনল সেই কান্নার কারণ বাইরের একটা মহিলা তখন আরো ভয়ংকর রূপ নিল। তার বউয়ের কান্নার কারণ সে হবে, তার বউকে সে-ই কাঁদাবে অন্যদের কোনো অধিকার নেই তার বউকে কাঁদানোর।
নামাজ পড়ে চার ভাই বাড়িতে ঢুকল। তখন ধরণীর বুকে আলো লুকিয়ে অন্ধকারে ঢেকে গেছে৷ শিশির আগে নিজের ঘরে গেল। দেখল পাশে ইয়াসমিন, বৃষ্টি, হিম বসে আছে৷ মায়েরা বোধহয় চলে গেছে এদের কাছে রেখে। কুয়াশা চোখমুখ ফুলিয়ে বসে আছে৷ সে যে যাবার পরও কেঁদেছে দেখেই বুঝল। শিশির দরজার কাছে দাঁড়াতেই সেদিকে কুয়াশা ফ্যালফ্যাল করে অসহায় নজরে তাকাল৷ চোখজোড়া আবার ছলছল করে উঠল। কলঙ্ক যে তার গায়ে!! কী করে ঘুচাবে সে? ইহজীবনেও বোধহয় ঘুচবে না৷ সারাজীবন লেপ্টে থাকবে তার গায়ে ‘এই মেয়েটাকে অপহ’র’ণ করে পতিতালয়ে নিয়ে গেছিল’ কথাটা যে কতটা জঘন্য শুনতে লাগছে! কুয়াশা তা মনে করেই আবার হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠল৷ এ কী মরণ যন্ত্রণা হচ্ছে তার ভেতরে? সমাজ তাকে এই নজরে দেখে? সে বার-পুরুষের খাওয়া মেয়ে? তার সতিত্ব নেই সমাজের চোখে? ভাবলেই দম আটকে কান্না আসছে। বুক ভেঙে যাচ্ছে।
শিশির আবার ও’কে গুঙিয়ে, ডুকরে কাঁদতে দেখে তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকল৷ ব্যস্ত হলো থামাতে। নানান কথা বলতে লাগল। ইয়াসমিনরা তা দেখে ওদের একা ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। যার জিনিস সেই সামলাক। সে ছাড়া কেউ পারবে না বোঝা হয়ে গেছে। এখন শিশিরকেই প্রয়োজন কুয়াশার। তাকে আঁকড়ে ধরে অভিযোগ করবে সে, তার বুকে মাথা রেখে নাকের পানি চোখের পানি এক করবে সে৷ আহ্লাদী হবে স্বামীর কাছে। তার স্বামীও তার আহ্লাদীকে নিয়ে আহ্লাদ করে কান্না থামাবে। বুকে নিয়ে আদর করে বুঝাবে। এখন প্রয়োজন সেই আহ্লাদের মানুষটার৷ প্রতিটা নারী পুরুষের এরকম কঠিন সময়ে একটা মনের মানুষের প্রয়োজন হয়। যে তাকে আগলে ধরে সাহস দেবে৷ আদর দিয়ে কষ্ট ভুলাবে। বুকে নিয়ে শান্ত করবে। নর-নারীর মধ্যেকার সম্পর্ক বড়োই আশ্চর্যপূর্ণ।
ভাবিরা যেতেই শিশির আগে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। অতিরিক্ত পাওয়ার লাইট বন্ধ করে দিয়ে জিরোলাইট রাখল। এরপর কুয়াশাকে বুকে নিয়ে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। একদম বাচ্চাদের মতো করে কোলের মধ্যে মিশিয়ে নিল। কুয়াশা শক্তহাতে গলার মাঝে মুখগুঁজে ফুঁপিয়ে চলেছে৷ শিশির কুয়াশার গালে দু’ঠোঁট দাবিয়ে গভীর চুমু দিয়ে আদুরে কন্ঠে ডাকল,
” সোনা…! ”
কুয়াশা নিরব। ফুপাচ্ছে৷ শিশির একই স্বরে আবার বলল,
” এ্যাই আহ্লাদী বউ..! তুই আমার কাছে একদম পবিত্র। পুষ্প যেমন হাজার মানুষ ছুঁলেও সে তার সৌন্দর্য বজায় রাখে, তার পবিত্রতা বজায় থাকে? তুই আমার সেই পুষ্প। আমি জানি এবং মানি তোর সাথে কোনো খারাপ কিছুই হয়নি। আর যা হয়নি তা নিয়ে কেন তুই নিজেকে গুটিয়ে নিবি? তুই না আমার সাহসী বউ? দুইদিন পর লয়ার হবি তুই। যেমন কোর্টে লড়বি, তেমনই সমাজে লড়বি তুই। তুই মেরুদণ্ড উঁচু করে বাঁচবি। আমি তোর জোর হব, ঢাল হব। তুই আমার পরিচয়ে সমাজে চলবি। ”
কুয়াশা নিরব। এখন ফুঁপানিটাও ছেড়ে দিয়েছে। শুধু শুনে গেল কথাগুলো। এই ছেলে তার হৃদয় ছুঁয়ে নিয়েছে। যে পুরুষ নারীর হৃদয় ছুঁতে পারে সেই তো আসল পুরুষ! শরীর না ছুঁয়ে হৃদয় ছুঁয়েছে। পুরুষের ভালোবাসা পাওয়া যে নারীর সাধনার বিষয়। সেই সাধনা অর্জন করতে কি সে সক্ষম হয়েছে? সে কি এই পুরুষের হৃদয় ছুঁতে পেরেছে?
শিশির কুয়াশাকে নিরব হতে দেখে মুখ নিচু করে দেখার চেষ্টা করল হালকা আলোয়৷ কিন্তু মুখ গুঁজে রাখার জন্য সক্ষম হলো না৷ ঘুম এসে গেল নাকি? ভেবে জিজ্ঞেস করল,
” ঘুমিয়ে গেছিস? ”
” উহু ”
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৩৬+৩৭
মুচকি হাসল। সে আবার গালে চুমু আঁকল কুয়াশার। কুয়াশা এবার কাঁচুমাচু করে নড়ে উঠল বাচ্চাদের মতো৷ যেমন বাচ্চাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালে করে ওঠে ঠিক তেমন। শিশিরের বুকে নাক ডলতে লাগল। সে টের পেল তা। আবারও হাসল নিঃশব্দে। এ তো সত্যি তার আহ্লাদী বউ! পুরোই বিড়াল ছানা৷ আদরে রাখতে হবে অনেক। কিন্তু শাসন করা একদম বন্ধ করা যাবে না। ভেবেই দু’হাতে ধরে আরেকটু মিশিয়ে নিয়ে গভীর হলো৷ যতটা গভীর হলে মনে হবে এখানে শুধু একটা অঙ্গ আছে। অর্ধনারী অর্ধপুরুষ দুইয়ে মিলে একঅঙ্গ।
