বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪৬+৪৭
রোজা রহমান
তাল পাকা ভাদ্র মাস। আর এই তাল পাকা মাসে তাল দিয়ে পিঠা বানিয়ে না খেলে চলে? তাল পিঠা বানানো, খাওয়ার যে মজা সেই আমেজটাই তো ফিকে পড়ে যাবে! ভাদ্র মাসে চারিদিকে তাল পাকা গন্ধে ম-ম করে। তাল দিয়ে হরেকরকমের পিঠা তৈরি হয়। এই তালপিঠা কে না খায়? তাল পাকলে গ্রাম বলো আর শহর বলো তালদিয়ে পিঠা তৈরি করে পিঠা উৎসব হয়। বেশ আনন্দ পাওয়া যায় পিঠা তৈরির মাঝে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার স্যাপার আছে। গ্রামের প্রায় বাড়িতেই তালপিঠা বানানো হয়। গ্রামে একটু প্রচলন বেশি এই উৎসবে। তাল বড়া, তাল পাকান, তাল রুটি, তাল ভাপা, তাল খিলি, পুডিং, কেক আরো অনেক কিছু তৈরি হয় তাল দিয়ে।
আজ তাল পিঠা তৈরি করছেন জিনিয়া। বোনদের, বোনজামাইদের, বোনের ছেলে মেয়েদের, এবং হবু জামাইকে আজ জিনিয়া তালপিঠা খাওয়াবেন বলে ঠিক করেছেন৷ শশীর দাদাদের তাল গাছ আছে ঐ বাড়িতে। সৌরজ লোক নিয়ে তার দাদাদের গাছ থেকে পাকা তাল পাড়িয়ে এনেছে। সকাল থেকে সেই আয়োজনই চলছে৷ বাড়িতে পাকা তালের গন্ধে ম-ম করছে। জিনিয়ার সাথে জাকিয়া, আম্বিয়া, আজমিরা, সিমী, বৃষ্টি, ইয়াসমিনও লেগেছে৷ তাল ছিঁলে সেটার রস বের করে সেটা চাল গুঁড়ো আর গমের আটা দিয়ে বড়া বানানো হয়, পাকান করা হয়৷ বাজারের ময়দা দিয়ে রুটি হয়৷ তো জিনিয়া তাল বড়া সহ পাকান, রুটি করবেন৷
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
কুয়াশারা বাড়িতে এসে দেখল শশীদের বাড়ির উঠানের রান্নাঘরে আয়োজন করেছেন৷ রান্না ঘর থেকে পাকা তালের গন্ধ পেয়ে কুয়াশারা গেল সেদিকে৷ গিয়ে দেখল তাল ছিঁলে রস বের করছে। বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং। ঝুঁড়ির সাথে ডলে তালে রস বের করা হচ্ছে। কুয়াশা দেখে বলল,
” বড় আম্মু, এগুলো দিয়ে তাল পিঠা হবে? ”
” হ্যাঁ, তোর খালামনি তার মেয়ে জামাইয়ের জন্য পিঠা তৈরি করছেন৷ পিঠা দিয়ে জামাই আদর হবে ”
শুনে হাসল সকলে। শশী লজ্জা পেল। কুয়াশা, ঈশারাও বলল করবে ওগুলো। জাকিয়া মানা করলেন না। ওদেরও রস বের করতে দিলেন৷ হাতে হাতে করলে জলদি হবে৷ কথায় আছে ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’ বাংলা ব্যাকারণ বইয়ের ভাবসম্প্রসারণ।
যায়হোক সকলে মিলে করতে করতে জলদি হয়ে গেল রস করা। কুয়াশারা গোসল করবে বলে উঠে এলো। কিন্তু আজ তাদেরও পুকুরে গোসল করার জন্য শখ জাগল৷ আর সেটাই প্ল্যান করল৷ শশীকে বলল পুকুরে গোসল করবে। কুয়াশা কখনো পুকুরে গোসল করার সুযোগ পায়নি। করবেই বা কোথায়? থাকে শহরে তেমন জায়গা নেই পরিবেশও নেই। আর গ্রামের পরিবেশে কখনো থাকা হয়নি তার৷ আজমিরাকে বলতেই আজমিরা মানা করে দিলেন। বললেন,
” একদম না। কখনো করিসনি। অভ্যাস নেই৷ কোনো অঘটন ঘটে যাবে৷ পুকুরে অনেক পানি। বর্ষাকালে ভরে গেছে। বেশি বললে মা-ইর খাবি ”
কুয়াশা বিরক্ত হলো। করে নি তো কি হয়েছে? সে কি ছোট? বলল,
” আম্মু আমি ছোট না। আর আমি বেশি নামব না৷ স্মৃতি, শশী, ঈশাও থাকবে। তাহলে সমস্যা কি? দাও না আম্মু যেতে। আমার খুব ইচ্ছে করছে। ভাইয়ারা করছে আমারও ইচ্ছে করছে। ”
” এবার তো আরোই দিব না। অতগুলো ছেলের মাঝে গোসল করতে যাবি? মা-ইরের অভাব হচ্ছে তোর। আহ্লাদ করিস না, সর..! ”
কুয়াশা এবার না পেরে রান্না ঘরে বসে নারিকেল কুঁড়তে থাকা শাশুড়ীর গলা জড়িয়ে ধরল পেছন থেকে৷ আহ্লাদ করে বলল,
” ও বড় আম্মু..! তুমি অন্তত অনুমতি দাও! তোমার ছেলেদের তুলে দেব গিয়ে। তবুও আমি করব। দাও অনুমতি ”
” বুবু একদম নাহ্। ”
” তুমি চুপ থাকো মন্ডলের মেয়ে! তোমার সাথে কথা বলছি আমি? আমি আমার শাশুড়ীর সাথে কথা বলছি।”
কুয়াশার কথা শুনে কেউ জোরে হাসল কেউ মিটমিট করে হাসল৷ জাকিয়া জোরেই হাসলেন৷ আজমিরা হাসি হাসি মুখ করেই বললেন,
” আচ্ছা? এখন আহ্লাদ করার সময় শাশুড়ী হলো?”
মায়ের কথার প্রত্যুত্তর করল না। জাকিয়াকে আবার বলল,
” হেসো না। অনুমতি দাও তোহ্!”
থেমে আবার বলল,
” দাও না, ও আম্মু! ”
সকলে অবাক চোখে চাইল কুয়াশার দিকে। কুয়াশা লজ্জা পেয়ে গেল৷ আজ সে প্রথম আম্মু বলে ডাকল জাকিয়াকে। তাও তার কার্জ সিদ্ধি করার জন্য। জাকিয়া এবার কুয়াশাকে পেছন থেকে হাত ধরে সামনে আনলেন। তাকালেন কুয়াশার পানে। চোখ জোড়া ছলছল করে উঠল উনার। টেনে বুকে নিয়ে আবেগী স্বরে বললেন,
” মা রে..! কী যে শান্তি লাগছে আমার। আমার মেয়ে আম্মু ডাকল আমায়? ”
বলে চোখে মুখে চুমু আঁকলেন৷ বললেন,
” আমার মেয়ে তুই ছেলে বউয়ের আগে। সেই জন্মের পর থেকে তোকে মানুষ করেছি। তোর মায়ের তুই প্রথম সন্তান থাকায় কিছুই করতে পারত না, আমিই তোর সব করতাম৷ আজ আম্মু ডাক শুনে বুকে শান্তি লাগছে৷ ”
কুয়াশা বুকে থেকেই বলল,
” তোমাদেরই মেয়ে আমি। জন্ম দিলেই কি মা হওয়া যায় শুধু? এমন পরিবার কয়জনের হয়? আমার রাজকপাল৷ তাইতো তোমাদের মতো পরিবার পেয়েছি।”
আজমিরা, আম্বিয়া মুচকি হাসলেন। জাকিয়া হেসে বললেন,
” অবশেষে পারমানেন্টলি শাশুড়ী হয়েই গেলাম?”
কুয়াশা মাথা নূয়ে নিল লজ্জায়। বলল,
” অনুমতি দাও। ”
জাকিয়া এবার আজমিরার দিকে তাকালেন৷ আজমিরা বার বার মানা করছেন। কথা আজমিরার ঠিক আছে। তবে কখনো কখনো ছোট ছোট ইচ্ছেকে প্রাধাণ্য দেয়াই যায়! এতে খুব বেশি ক্ষতি হয় না৷ জাকিয়া বললেন,
” থাক করুক। শখ করছে যখন৷ কখনো করে নি৷ ”
বলে কুয়াশার উদ্দেশ্যে বললেন,
” সিঁড়িতে থাকবি৷ বেশি নিচে নামবি না৷ বেশিক্ষণ কেউ থাকবি না ”
কুয়াশা মেনে নিল৷ খুশিতে গদগদ হয়ে গেল৷ দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো রান্না ঘর থেকে। এসে শশীদের সাথে পুকুরে গেল৷
পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখল শিশিররা এখনো উঠেনি৷ দুপুর টাইমে গোসল করতে বেশ ভালোই লাগছে৷ তাছাড়া কালই সকলে চলে যাবে এইজন্য পুকুরে গোসল করার আনন্দটা উপভোগ করে নিচ্ছে। সকলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। শিশির সাঁতার কাটতে কাটতে কুয়াশার দিকে নজর গেল৷ তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়েছে এসে। ভ্রু কুঁচকে গেল। নীহারও দেখল ওরা সব তোয়ালে হাতে এসে দাঁড়িয়েছে। সাঁতার কেটে এসে থামল। শিশির মৃদু চেঁচিয়ে বলল,
” এখানে কি তোদের? ”
কুয়াশা উপর থেকে অনেকটাই চেঁচিয়ে শিশিরকে বলল,
” এ্যাই…! ওঠো তোমরা। এবার আমরা গোসল করব। ”
শিশিরের ভ্রু আরো কুঁচকে গেল৷ রাগও উঠল এখানে এসে এমন চেঁচিয়ে কথা বলতে শুনে৷ ধমকে বলল,
” এ্যাই বেয়াদব.. চেঁচাচ্ছিস কেন? বেয়াদবি কিন্তু বেশি করছিস! ”
কুয়াশা এবার আস্তে বলল,
” ওঠো তোমরা৷ আমরা গোসল করব ”
” কিহ্ বললি? ”
” কানে কম শুনো? ”
” তোর সাহস কতটা বেড়েছে? আর কোন বিবেকে এখানে গোসল করার কথা বলছিস? ”
কুয়াশা বলল,
” তো কি হয়েছে? ”
শশী বলল,
” ভাইয়া তোমরা উঠে যাও। ইচ্ছে করছে যখন করুক। ”
শিশির বলল,
” ও জীবনে পুকুরে গোসল করেছে? ”
” তো করি নি বলেই তো করব। ওঠো তোমরা ”
নীহার বলল,
” জেদ করিস না কুশু। অনেক পানি পুকুরে। আর তোরা কখনো করিস নি পারবি না। অঘটন ঘটতে সময় লাগবে না”
” ভাইয়া, তুমিও এক কথা বোলো না তোহ্! আমি বড় আম্মুর থেকে অনুমতি এনেছি৷ তোমরা উঠে এসো৷ বেশিদূর নামব না ”
শিশির এবার রেগে গেল আরো ওর তর্ক করা দেখে৷ বলল,
” তবুও তর্ক করেই যাচ্ছিস? এ্যাই যাবি তোরা এখান থেকে? ”
স্মৃতি, ঈশা, শশী কেঁপে উঠল। শিশির কথাটা অনেক রূঢ় স্বরে বলেছে৷ রিজভী বলল,
” আহ্ শিশির, এভাবে বলছিস কেন? ভালো করে বোঝা, কুয়াশা, স্মৃতি, ঈশা যাও বাসার মধ্যে করো গিয়ে ”
” ও ভালো কথার জাত না দেখছিস না? ”
” হ্যাঁ, আর নিজে যত ভালোর জাত? তোমারই তো জাত! আবার বড় বড় লেকচার মা-রছ? ভালোভাবে বলছি তবুও ত্যাড়ামি করছ! ”
কুয়াশার কথায় কটমট করে উঠল শিশির৷ বলল,
” তুই যাবি এখান থেকে? ”
” নাহ্ ”
” কুশু দেখ এখানে আমরা অনেক ছেলে আছি। অবুঝের মতো করিস না। শশীর না হয় অভ্যাস আছে তোদের নেই। শশী..! যাও এখান থেকে ওদের নিয়ে ”
শশী ভয় পেয়ে গেল নীহারের ধমকে। কথা বলতে পারল না। কুয়াশাকে বলল,
” বুবু চলো৷ বাথরুমে কোরো৷ এখানে করতে হবে না ”
” আমি তো করবই ”
শিশির তা শুনে বলল,
” কি বললি আরেকবার বল? ”
” আমি পুকুরেই গোসল করব ”
শিশির শোনা মাত্র একটা ডুব দিল। এরপর কিছুক্ষণের মাঝে উঠেও পড়ল৷ বলল,
” হ্যাঁ, এবার বল কি বলছিলি?”
সকলে দেখল শিশির ডুব দিয়ে পুকুরের পানির তলদেশ থেকে কাঁদা তুলে এনেছে৷ কুয়াশা তা দেখে রেগে উঠল। শিশির বলল,
” আরেকটা কথা বলবি তো কাঁদা ছুঁড়ব। যাবি এখান থেকে? ”
” দেখো বেশি বেশি করছ কিন্তু! আমি তো বলি নি তোমাদের সাথে করব! তবে এমন করছ কেন? ”
” তোর বোধশক্তি নেই সেটা আমরা সকলেই জানি৷ গোবর ঠাসা তো আর এমনি এমনি বলি না! এখন যাহ্ ”
” যাব নাহ্। ”
” তোকে তোহ্। ”
বলতে বলতেই শিশির হাতে থাকা কাঁদা ছুঁড়ে কুয়াশার গায়ে মারল। কুয়াশা এবার রেগে গেল দ্বিগুণ। নীহার, রিজভী বলে উঠল,
” শিশির..! কী করছিস কী! ”
” ওর সাথে এটা করাই উচিত।”
কুয়াশার শরীরে কাঁদা ছুটে আসায় সে রাগে, ক্ষোভে কেঁদে দিল। তবে শব্দ করে না। চোখে পানি নিরবে ছেড়ে দিল। একটু না হয় শখ করে গোসলই করতে চাইছে! আর কি করতে চাইল? এটাতেও এই বুনো ওলের বাচ্চার বেগড়া দিতে হবে? সে রাগে, ক্ষোভে ধেই ধেই করে চলে গেল৷ শশী বলল,
” এমনটা না করলেও পারতে ভাইয়া৷ শখ করছিল অনেক ”
বলে চলে গেল কুয়াশার পেছনে। সকলেই গেল। ওরা যেতেই নীহার বলল,
” এতটা রূঢ় না হলেও পারতি। ”
” সাফাই গাইস না বোনের৷ অনেক আহ্লাদ বেড়েছে৷ এতটাও মানব না৷ ভালোবাসার মতো বাসব শাসনও করব৷ ও যা বলবে শুনতে হবে নাকি? তা ছাড়া ওকে এত করে বলা হচ্ছে কখনো করিসনি, পারবি না৷ তবুও কেন জেদ করতে হবে ওর? অঘটন ঘটতে কী সময় লাগে? পুরো ভরা পুকুর৷ জীবনে ডুব টা কিকরে দিতে হয় সেটাও বোধহয় দেয় নি। তো পুকুরে কি করে গোসল করবে ও? ও-কে নিয়ে কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছি না। তুই লাই দিস না তোহ্। ”
বলে বসে পড়ল সিঁড়িতে। নীহার হাসল। হাসল রিজভীরাও৷ পাশে ওরাও বসল। হিম বলল,
” এতটা কী করে ভালোবাসলে ভাই আমার বোনকে? ”
তাকাল হিমের দিকে শিশির। মুচকি হেসে হিমের চুল গুলো এলোমেলো করে দিল হাত দিয়ে। বলল,
” তবুও দেখ, তোর বোনটা এই রাগের মাঝের ভালোবাসাটা বুঝল না। দেখ গিয়ে কেঁদে কেটে নাকের পানি চোখের পানি এক করছে হয়তো। নাম সার্থক করে দিল।”
হাসল সব৷ শিশির আবার নেমে ডুব দিল। বলল আমি উঠলাম। বলতে না বলতেই আবার কুয়াশা হাজির হলো। কেঁদে কেটে নাকের পানি চোখের পানি এক করে জাকিয়াকে ধরে এনেছে। তার পুকুরে গোসল করা চায় ই চায়। জেদ যখন একবার উঠেছে তার তা না করে সে থামবে না। জাকিয়া এসে ধমকে বললেন,
” এ্যাই..! কাঁদা ছুঁড়েছিস কেন ওর গায়ে?”
” আম্মু তুমি এবার এসো না তো ও’কে লাই দিতে৷ পুকুরে গোসল করবে বলছে৷ জীবনেও করেছে? ”
শিশিরের কথা শুনে কুয়াশা ফুঁসে উঠল৷ বলল,
” তোমাকে কে এতসব ভাবতে বলছে? ”
বললেই কী আর হলো! তারই তো ভাবনা!তার বউ তার ভাবনা। এটাই এই মেয়ে বুঝছে না৷ তার জেদ চেপে গেছে একদম। তারউপর শিশির কাঁদা ছুঁড়েছে আরো রেগে গেছে৷ জাকিয়া বললেন,
” শখ করছে, কখনো করেনি করুক। আর নিচে নামবে না বেশি আমি বলে দিয়েছি। একটু আধটু শখকে প্রাধাণ্য দিতে হয়৷ উঠে আয় তোরা ”
” আম্মু, তুমি অন্তুত এমন বলো না। পুকুরের সিঁড়ি অনেক পিছলা৷ আর কিসের ভরসায় নামতে দেবে তুমি? স্মৃতিরা সাঁতার পারে না৷ আমি কাউকেই এখানে গোসল করতে দেব না৷ যে শখে বিপদ হবার সম্ভবনা সে শখকে প্রাধাণ্য না দেয়াটাই ভালো ”
তা শুনে এবার কুয়াশা জোরে জোরে কেঁদে দিল। স্মৃতি, ঈশা বাথরুমে ঢুকে গেছে গোসল করতে। কিন্তু এই জেদি টা জেদ ধরে বসে আছে। জাকিয়া বললেন,
” আব্বু কিছু হবে না করতে দে ”
শিশির এবার একটু নরম হলো। কুয়াশার কান্নার দিকে তাকাল৷ এরপর নীহারের দিকে তাকাল। নীহার ভাইয়ের চোখের ভাষা বুঝে গেল। মুচকি হেসে বলল,
” আমরা উঠে যাচ্ছি। ”
বলে উঠতে লাগল একে একে। শিশির এবার চেঁচিয়ে বলল,
” নেমে আয় বদের হাড্ডি। আস্তে আস্তে নামবি৷ পিছলা সিঁড়ি অনেক। ”
তা শুনে রিজভী, শান্ত, মিহির, হিম হাসল। জাকিয়াও মুচকি হাসলেন। তবুও বউকে একা ছাড়বে না। কী দরদ ভাবা যায়!! শশী হেসে বলল,
” বুবু যাও, তোমার বরটা তোমাকে একা ছাড়বেই না বোঝা হয়ে গেছে। ”
কুয়াশা কাঁদতে ছিল। শিশিরের কথা শুনে কান্না থামিয়ে দিয়েছে৷ জাকিয়া বললেন,
” যাহ্, এবার আর ভয় নেই৷ ”
বলে জাকিয়া চলে গেলেন৷ নীহাররাও একে একে চলে গেল। কুয়াশার কেন যেন লজ্জা লাগল। একা নামতে সে দেবেই না আর তার বউও গোসল না করে ক্ষান্ত হবে না৷ দুটোই এক। এক রকম জেদ৷
তো এমন কিছুই করুক যেটাতে দু’জনই সন্তুষ্ট হয়! শিশিরেরও চিন্তা মুক্ত, কুয়াশারও গোসল হবে৷ তার থেকে বড় কথা তারা স্বামীস্ত্রী একসাথে গোসল করতে পারছে৷ আহ্ কী সুন্দর রোমান্টিক ব্যাপার স্যাপার!
কুয়াশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শিশির পানি থেকে বলল,
” আসবি? নাকি উঠে আসব আমি? দেখ অনেকক্ষণ কিন্তু পানিতে আছি আমি।”
কুয়াশা শুনে এবার নিচে নামতে লাগল। উপড়ের দুই-তিনটা সিঁড়ির পরই পিছলা সিঁড়ি। পুকুরে পানি থৈ থৈ করছে। বর্ষার পানিতে ভরে গেছে পুকুর। শিশির বলল,
” আস্তে আয়। ”
কুয়াশা পা টিপে টিপে নামল। পানিতে পা দিতে একটু ভয়ই করছিল৷ নেমে কোমড় অবধি পানিতে যেতেই শিশির বলল,
” দাঁড়া ওখানে। ”
বলে উঠে এলো কুয়াশার কাছে৷ দাঁড়াল কুয়াশার কাছে। যেখানে কুয়াশার কোমড় অবধি পানি সেখানে শিশিরে কোমড় ছুঁতেও পারছে না পানি৷ শিশির কুয়াশার কাছে এসে বলল,
” বড্ড জেদি তুই।”
বলে কোলে তুলে নিল কুয়াশাকে৷ কুয়াশা কোল থেকেই ফুঁসে উঠল,
” একশবার হব৷ আমার ইচ্ছে করেছে তুমি মানা করবে কেন? ”
কুয়াশাকে কোলে নিয়ে নামতে নামতে বলল,
” আমিই করব সব। ”
কুয়াশা তা শুনে কিছু বলল না। শিশির তার বুক অবধি পানিতে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল কুয়াশাকে৷ কুয়াশার গলা অবধি পানি হলো৷ শিশির হেসে বলল,
” এতটুকু লিলিপুটের আবার জেদ দেখো আকাশ সমান! ”
কুয়াশার খোঁটাটা গায়ে লাগল। বলল,
” ওরে আমার লম্বু খাঁ রে! একটু লম্বা হয়ে আসছে বড়াই মারাতে।”
” কী ভাষা রে তোর! মার খাচ্ছিস না তাই স্পর্ধা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন!”
কুয়াশা বলল,
” তো কি বলব? আমি ঠিকই আছি লম্বা। তুমিই একটু বেশি লম্বা তাই এমন মনে হচ্ছে। লিলিপুট না আমি। ”
শিশির হাসল। কোমড় পেচিয়ে ধরল। এক সিঁড়ি উপরে উঠল। এবার কুয়াশার একটু কম পানি হলো। বলল,
” দেখো, নাকের পানি চোখের পানিই এক করে ফেলেছে! ”
কুয়াশা শিশিরকে দূরে ঠেলতে লাগল। বলল,
” সরো আলগা পিরিত লাগবে না আমার। ”
শিশির এবার একটা অস্বাভাবিক কাজ করল। কুয়াশার কামিজ জামার নিচে হাত রাখল। কেঁপে উঠল কুয়াশা। পানির নিচে জামাবিহীন খালি শরীরের উপর স্পর্শ বুঝতে পেরে। হাতটা কুয়াশা কোমড়ের বাঁকা খাঁজের মাঝে। এবার চেপে ধরল সেখানে৷ নরম শরীরে এমন লাগাম ছাড়া স্পর্শ কুয়াশাকে কাঁপিয়ে তুলল৷ শিশির অন্য হাত দিয়ে কুয়াশার খোঁপা করা চুলগুলো খুলে দিল৷ শ্যাম্পু করা চুল গুলো ঝরঝর করে ছড়িরে পড়ল৷ এরপর কুয়াশাকে ঘুরিয়ে নিজের বুকের সাথে পিঠ নিয়ে নিল কুয়াশার৷ যে হাত কোমড়ে ছিল এতক্ষণ সেটা পানির মাঝে স্লাইড করতে করতে পেটের উপর নিয়ে গেল৷ কুয়াশা এবার জড়িয়ে গেল৷ সহ্য হলো না এত গভীর স্পর্শ। খামচে ধরল শিশিরের হাত। তড়িঘড়ি করে বলল,
” কি করছ? ”
” এখনো মনে হচ্ছে আলগা পিরিত দেখাচ্ছি আমি?”
কুয়াশা উত্তর করল না৷ শিশির বলল,
” অধিকার তুই আমার৷ আলগা পিরিত দেখানোর প্রয়োজন পড়বে আমার? ”
কুয়াশা কোনো উত্তর করতে পারল না৷ এই ছেলের সব কথার উত্তর রেডিই থাকে৷ কাজে এবং কথায় দু’টোতেই বুঝিয়ে দেবে।
কুয়াশা কানের পিঠের চুল সরিয়ে ঘাড়ের উপরের কানের পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে চুমু দিল গাঢ় একটা। চুমু দিয়ে বলল,
” বল, পড়বে? ”
” উহু।”
হাসল উত্তর শুনে৷ যেখানে চুমু দিল সেখানেই একটা ছোট্ট কামড় দিল। কুয়াশার পেটের উপরের হাতটা আরেকটু গলিয়ে ডানে থেকে বামে নিয়ে কুয়াশাকে পেট ধরেই ঘুরাল। কুয়াশা চোখ বন্ধ। সে এত এত প্রগাঢ়, গাঢ়, গভীর ছোঁয়া নিতে পারছে না। বুক হাঁপড়ের মতো উঠা নামা করছে৷
শিশির হাসল৷ একটু ছুঁয়ে দিলেই উনিয়ে পড়ে! কথাটা ভেবে হাসল আবার আপন মনে। কুয়াশাকে নিয়ে তৎক্ষনাৎ ডুব দিল৷ কুয়াশা প্রস্তুত ছিল না এটা। তাই কাশি উঠে গেল৷ আবার নিঃশব্দে হাসল সে৷ মুখে পানি সরিয়ে কুয়াশাকে দেখল। কুয়াশা দু’হাতে মুখের পানি সরাল।
সরিয়ে ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
” এটা কি হলো?”
” কি হলো? ”
নেশালো কন্ঠ তার। কুয়াশা থমকে গেল। শিশিরের নগ্ন শরীরে নজর দিল৷ লোমশ ভেজা বুক৷ পড়ে আছে লোমগুলো। বুকের উপরে কামড়ের দাগ। তা অতি নিকট থেকে স্পষ্ট তাজা মনে হচ্ছে৷ দাগ গুলো দেখে তেমনটায় মনে হচ্ছে৷ মনে পড়ল সে কামড় দিয়েছিল৷
এদিকে শিশির অভিভূত হচ্ছে কুয়াশাকে ভেজা চুলে, ভেজা শরীরে দেখে৷ আজ প্রথম কুয়াশাকে গোসলরত অবস্থায় দেখল৷ চুলগুলো ভিজে লেপ্টে আছে, ঠোঁটজোড়া ভিজে সজীবতায় ছেয়ে গেছে, চোখের পাঁপড়িগুলো ভেজা, সামনের চুল গুলো ভিজে সামনে গলা সহ বুকে এসে পড়ে আছে৷ জামার গলার খোলা অংশটুকু হলুদ ফর্সা। সেখানে পানি পরে জ্বল জ্বল করছে মনে হচ্ছে। নেশা ধরে গেল শিশিরের। শরীরে ঝিম ধরে আসছে। কুয়াশা শিশিরের চোখের দিকে তাকিয়ে সবই দেখল। লজ্জা পেল খুব৷ এভাবে আজ প্রথম৷ এসব ছোট ছোট অনুভূতির সাথে নিত্য দিন পরিচয় হচ্ছে। লজ্জারা কুঁড়ে ধরে৷
শিশির হাত তুলে কুয়াশার চুলগুলো সামনে থেকে সরিয়ে গলা আরো আলগা করে দিল৷ ওড়না শরীরে তবুও কুয়াশার ভেজা শরীরে লজ্জা করছে৷ বলল,
” লজ্জা পাচ্ছি আমি।”
” কিছু করি নি তো আমি! শুধু দেখছি। ”
কুয়াশা আরো নূয়ে পড়ল৷ শিশির দুষ্টু হাসল। এ ছেলে এক নাম্বার খাঁটি দুষ্টু। বলল,
” আমার আহ্লাদী বউয়ের গোপন সৌন্দর্যগুলো অতি আকর্ষণীয়। আমি মাতাল হচ্ছি তো! ”
” ধেৎ…!”
বলে ডুব দিল কুয়াশা। উঠে বলল
” সাঁতার শেখাও আমায়। ”
” একদিনে কি শিখবি? ”
কুয়াশা কিছু বলল না৷ শিশির বলল,
” চল সাঁতরে আসি তোকে নিয়ে। ”
” কিভাবে? ”
শিশির উত্তর না করে কুয়াশাকে বুকে নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। বলল,
” গলা জড়িয়ে ধরে রাখ। ”
কুয়াশা ভয় পেয়ে গেল। তবুও ধরে রাখল শক্ত করে। শিশির ও’কে নিয়ে চিৎ হয়ে অনেকটা দূরে সাঁতার কেটে গেল। বলল,
” অনুভূতি বল? স্বামীর বুকে চড়ে সাতাঁর কাটছিস। ”
” তুমি একটু না অনেকটা ফাজিল আর দুষ্টু এটা কি জানো তুমি? ”
” এতদিনে টের পেলি তা? ”
কুয়াশা উত্তর করল না৷ শিশির ও’কে নিয়ে সাঁতরে আবার চলে এলো। আগের জায়গায় দাঁড়াল৷ ডুব দিল দু’জন। কুয়াশা এবার শিশিরের গলা জড়িয়ে ধরে উঠে পড়ল শিশির মুখের সামনে মুখ নিল৷ তাকাল দু’জন দু’জনের দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে। শিশির হাসল বউয়ের এহেন কাজে। কুয়াশা শিশিরের কপালে চুমু আঁকল গভীর, গাঢ় করে ঠোঁট দাবিয়ে। শিশির খুবই অবাক হলো। ভালো লাগায় ছেয়ে গেল এই স্পর্শটুকু৷ অনুভূতিরা প্রজাপতির ন্যায় উড়তে লাগল৷ এই মেয়ে যে তাকে অনেক ভালো বেসে ফেলেছে তার বোঝা হয়ে গেছে৷ চুমু একে মুখ তুলে শিশিরের মুখের দিকে তাকাল৷ এরপর চোখের দিকে৷ হাসছে শিশির মিটমিট করে। বলল,
” মাতাল তো আরো করে দিলি৷ নিজের বিপদ নিজে কেন ডাকছিস?”
কুয়াশা কিছু বলল না হাসল শুধু। শিশিরকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
” এটা সুন্দর একটা অনুভূতির সাথে পরিচয় করালে বলে পারিশ্রমিক দিলাম।”
হেসে ফেলল শিশির। এরপর কুয়াশা শিশিরের কাছে আরো এগিয়ে গিয়ে সেই কামড় দেয়া স্থানে আবার কামড় দিল দুই পা উঁচু করে। শিশির কিছু বুঝে ওঠার আগেই হয়ে গেল সব৷ এ যে রোমান্টিক মুড থেকে একবারে জন্তুু মুডে চলে যাবে ধারণায় ছিল না তার৷ অনেকটা জোরে বুকের সেই স্থানে কামড় দিয়ে শিশিরকে জোড়ে একটা ধাক্কা দিল৷ শিশির উল্টে অনেকটা দূরে চলে গেল পানির উপর থেকে। দাম্ভিকতার স্বরে বলল,
” আর এটা আমাকে কাঁদা ছুঁড়ার জন্য।”
বলেই তড়িঘড়ি করে উপরে উঠে পড়ল৷ এখানে আর থাকা যাবে না। নয়তো বিপদ শরীরের উপর ধেয়ে আসবে। কুয়াশা দৌড়ে উঠে ছুট দিল কিন্তু বেচারা বেশি দূর এগুতে পারল না৷ দৌড়ে উপরে উঠে সেই দৌড়ের উপরই যেতে গিয়ে শান ছেড়ে যেই না মাটিতে পা দিয়েছে ওমনি ধপাস। পড়েছে বেশ আচ্ছা জোরেই৷ কোমড় বোধহয় আর নেই। চেঁচিয়ে উঠল।
” আহ্! মা গো…।”
বলে। পিছলার উপর পণ্ডিতি করতে গিয়ে পড়ল৷ শিশির এবার হা হা করে হেসে ফেলল। চেঁচিয়ে বলল,
” সাজা পেয়ে গেলি তো? অনুভূতি বল? পিছলার উপর পণ্ডিতি করতে গেছিলি নাহ্? বোঝ এবার কেমন লাগে।”
কুয়াশা চেঁচিয়ে চলেছে কোমড় ধরে। সে আবার বলল,
” কোমড় কি কোমড়ের জায়গায় আছে? নাকি গেছে? ”
” এ্যাই বুনো ওলের বাচ্চা আমার কোমড় গেছে। এসে ধর। ”
” তোর কোমড় আমি ধরব কেন? তোর কোমড় তুই ধর। ঘাঁ যার ব্যথাও তার। ”
বলে সে গা ছাড়া ভাব নিয়ে ডুব দিল। এরপর উঠে পড়ল৷ কুয়াশা চেঁচিয়েই চলেছে৷ লেগেছে বেশ আচ্ছা মতোই। পেছনে এসে বলল,
” কোমড় তো কোমড়ের জায়গায় আছে৷ খসে নি তো। তাহলে এমন হামলাচ্ছিস কেন নাটকবাজ? ”
” ফাউল লোক, ব্যথা পেয়েছি অনেক। উঠতে পারছি না। মা গো!”
শিশির হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। তাকে কামড় দেবার সাজা৷ হাসি দেখে কুয়াশা আরো রাগল। এবার কেঁদে দিল শব্দ করে রাগে, ব্যথায়। শিশির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখল মুখে ব্যথার ছাপ এসেছে বুঝল লেগেছে ভালোই। সে শরীরে শার্ট জড়াল। এরপর ঘাঁটের শানের উপর থেকে ফোন নিয়ে শশীকে কল দিল৷ শশী ধরতেই জিজ্ঞেস করল বাড়ির ভেতর উঠানে কেউ আছে কিনা! শশী জানাল মায়েরা রান্নাঘরে। শিশির রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করতে বলল কিছুক্ষণের জন্য। বলে আশেপাশে নজর রাখতে বলল বড়রা কেউ যেন না থাকে উঠানে। বিব্রবতবোধ হবে নয়তো৷ সব বলে কল কেটে কুয়াশাকে কোলে তুলে নিল৷ নিয়ে হাঁটা ধরল। বলল,
” নাটকবাজ। ”
শিশির কুয়াশাকে নিয়ে বাড়ির উঠানের এক পাশ দিয়ে সকলের নজর এরিয়ে উঠানে থাকা চাপকলের সাথে লাগোয়া গোসলখানার মধ্যে ঢুকে গেল। উঠানে শুধু শশীর দেখা পেয়েছে। শশী শিশিরের কথা অনুযায়ী রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
কুয়াশাকে কোলে করে আনতে দেখে তড়িঘড়ি করে গোসলখানার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” এ্যাই ভাইয়া! কি হয়েছে বুবুর? ”
” পণ্ডিতি করতে গিয়ে কামাই করেছেন তিনি।”
শশী কথার মর্মার্থ বুঝতে পারল না৷ কুয়াশাকে নিচে দাঁড় করিয়ে দিল। অমনি ব্যথায় ককিয়ে উঠল। কোমড়ের হাড়ে লেগেছে অনেকটা৷ শিশির তাকাল কুয়াশার দিকে। বুঝল ব্যথা ভালোই পেয়েছে৷ বুঝে মেজাজটাও চড়ে গেল৷ বেয়াদব সব সময় উড়নচণ্ডী হয়ে হাঁটা চলা করবে৷ বিপদ সবসময় নিজেই ডেকে আনবে। এতকরে বলা হলো পিছলা তবুও দৌড়ে যেতে গিয়ে অকাম করল। এত দৌড় ঝাঁপ কিসের তার? মনডা চাচ্ছে আগে কয়েক ঘা বসিয়ে নিতে। চোখ মুখ কুঁচকে কিড়মিড় করল শিশির। বলল,
” বেয়াদব, এখন ককাচ্ছিস কেন? যাহ্ দৌড়া! মনটা যা বলছে না তোর উপর! ঠাটিয়ে কয়েকটা দিতে পারলে শান্তি লাগত। ফাজিল কোথাকার।”
কুয়াশা চোখের পানি ছেড়ে দিল৷ সে কি বুঝেছিল এমনটা হবে? যদিও পিছলার উপর দৌড়ানো ঠিক হয়নি। কিন্তু ভয়েই তো দৌড়ে যেতে গিয়ে এমনটা হলো। শশী বলল,
” পড়ে গেছ বুবু? ”
” হ্যাঁ। ”
শিশিরের উত্তর। কুয়াশা নিরবে চোখের পানি ফেলছে। যদিও এখনো খুব একটা ব্যথা আসে নি। কিন্তু রাত হতে হতে অনেকটা ব্যথা ধরা দেবে। ভেবে শিশির শশীকে বলল,
” শশী! ঘরে পেইন রিলিভার আছে? ”
” হ্যাঁ, আছে। ”
” নিয়ে এসে দে৷ আর এর ড্রেস আনিস।”
শশী সম্মতি দিয়ে চলে গেল৷ কিছুক্ষণের মাঝে চলেও এলো৷ এসে শিশিরের হাতে দিয়ে চলে গেল। কুয়াশা নিরবে পানি ফেলছে চোখের৷ শিশির গোসলঘরের দরজা আটকে দিল। ঝাঁঝ নিয়ে ভারিক্কি, রূঢ় কন্ঠে বলল,
” দেখা কোথায় লেগেছে। ”
কুয়াশা চমকে উঠল। তাকাল শিশিরের দিকে। তা দেখে শিশির বলল,
” হাতে এবার থাপ্পড় না খেতে না চাইলে পিছন ঘোর আর দেখা কোথায় আঘাত লেগেছে! ”
” লাগবে না দাও, আমি আম্মুর থেকে দিয়ে নেব।”
এবার বেজায় রেগে গেল শিশির৷ সে কি তার পড়ের ঘরের লোক? নাকি পরপুরুষ? এই সামান্য জিনিস নিতে তার এত সমস্যা? স্বামী সে তার। কিড়মিড় করে ধমকে বলল,
” এ্যাই ফাজলামো করছি তোর সাথে আমি? ”
বলে কুয়াশার গাল চেপে ধরল রাগে৷ মেজাজ সত্যি তার গরম হয়ে গেছে৷ একে তো এমন বেপরোয়া হয়ে চলে তারউপর সবসময় ব্যস্ততা বাড়ায় আবার এখন অবুঝের মতো কথা বলছে। সে আবার বলল,
” এ্যাই বল, আমি তোর কী হই? তোর এত ফর্মালিটি করতে হবে কেন? সব হচ্ছে, হবে আর সামান্য জিনিস নিয়ে এখন তোর ন্যাকামি দেখব আমি? ”
বলে ছেড়ে দিল চোয়াল৷ কুয়াশা কিছু বলল না। স্বামী তার। কিন্তু তবুও লজ্জা লাগছে৷ শিশির বেজায় রেগে গেছে। শিশিরের দিকে পিছন ঘুরে হাত দিয়ে বোঝাল কোথায় লেগেছে৷ শিশির দেখল৷ কোমড়ের মাঝামাঝির হাড় সোজাসুজি আঘাত পেয়েছে৷ এরপর কুয়াশার শরীরের দিকে তাকাল। ভেজা জামা৷ বলল,
” জামা আগে চেঞ্জ করবি নাকি ক্রিম আগে লাগাব?”
” তোমার যেটা ভালো মনে হয় করো। ”
শিশির কিছু বলল না। এগিয়ে কুয়াশার পেছনে গিয়ে বসল। এরপর কোমড়ের কাছ থেকে জামার কিছুটা অংশ সরিয়ে আলগা করল৷ কুয়শা শিশিরের হাত পেয়ে কেঁপে উঠল। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পিছন ঘুরে। শিশিরের যদিও অস্বস্তি, অস্থিরতা ফিল হচ্ছে তবে পাত্তা দিল না এখন৷ এর জন্য জীবনটা প্যারাময় হয়ে গেল৷ একটা না একটা অঘটন ঘটাতেই আছে আর সে দায়িত্ব পালন করতেই আছে৷ ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। হলুদ ফর্সা কোমড়ের উপর নজর দিয়ে দেখল আঘাত পেয়ে মাংসপেশির উপরে কালো আস্তরণ পড়ে আছে। সাথে সাথে এতটা কালো হয়ে উঠেছে? কালসিটে পড়ে গেছে। ক্রিম নিয়ে কালসিটের উপর হাত দিতে না দিতেই ককিয়ে উঠল ‘আহ্’ শব্দ করে। শিশির নরম স্বরে বলল,
” ব্যথা তো ভালোই পেয়েছিস মনে হচ্ছে। ভেতরে যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে?”
” একটু একটু। ”
” আপাতত এটা দিয়ে দেখি কী হয়। নয়তো ডক্টরের ট্রিটম্যান্ট লাগবে। ”
বলে থেমে আবার বলল,
” আর ঘরে গিয়ে শশীর থেকে একটা ব্যথা নিরাময়ের ঔষধ নিয়ে খেয়ে নিবি। ”
কুয়াশা প্রত্যুত্তর করল না নিরব সম্মতি দিল। শিশির ক্রিম নিয়ে আলত হাতে জায়গাটায় ম্যাসাজ করতে লাগল। কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করে ভালোভাবে ক্রিমটা লাগিয়ে দিয়ে বলল,
” চেঞ্জ করে বেড়িয়ে আয়৷ আমি বাইরে গেলাম ”
কুয়াশা সম্মতি দিলে সে চলে গেল৷ আগে নিজেরও চেঞ্জ করতে হবে৷ অনেকক্ষণ ভেজা শরীরে আছে৷
‘
কুয়াশা শশীর ঘরে চলে এসেছে৷ শশীরা সব গল্প করছিল। স্মৃতি বলল,
” অনেকটা লেগেছে নাকি রে?”
” হ্যাঁ, ব্যথা হয়ে গেছে অনেক।”
ঈশা বলল,
” এসে বস, হাঁটা চলা করিস না বেশি ”
কুয়াশা বসতে গিয়েও অনেকটা ব্যথা অনুভব করল হাড়ে মাঝে৷ কষ্ট করে বসল। শশী বলল,
” আম্মুকে বলছি ডক্টর দেখানোর কথা। ”
” না থাক এখন, তোর ভাইয়া বলল এটাতে না হলে নেবে। একটু দেখি আগে। আর ব্যথার কোনো ঔষধ থাকলে দে। ”
শশী আর কিছু বলল না ঔষধ এনে দিল। এগুলো ঘরে থাকে তাদের কারণ হানিফ সাহেবের বার্ধক্যজনিত হাড়ের ব্যথা আছে। সেসময় বৃষ্টি, ইয়াসমিন এলো৷ শশীর থেকে শুনেছে। ওরাও জিজ্ঞেস করল কতটা ব্যথা পেয়েছে। একই ভাবে জবাব দিল কুয়াশা। এরপর একে একে সকলে জেনে গেল কুয়াশা পড়ে গেছে। কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে৷ ব্যস হয়ে গেল৷ সকলে ব্যস্ত হলো তাকে নিয়ে৷ শিশির সকলকে জানাল সমস্যা খুব বেশি না। ভাঙেচুড়ে নি। শুধু আঘাত পেয়েছে। ব্যথার মলম দেয়া হয়েছে। কিছু না হলে ডক্টরের ট্রিটম্যান্ট নেয়া যাবে৷ কারোর এত অস্থিরতা দেখাতে হবে না। ওর একটু শাস্তি হবারও দরকার৷ এতে যদি শিক্ষা হয়। তা শুনে কুয়াশা কাঁদো কাঁদো করে বসে থাকল৷ জাকিয়া ছেলেকে ধমকালেন। হয়ে গেছে, এখন কি করার? এসবের সাথে তো আর নিজের হাত থাকে না। তবুও সাবধানতা বজায় রেখে চলা ভালো৷
দুপুর দুটোর দিকে সকলে দুপুরের খাবার খেল। শিশিররা যে মাছ ধরেছে সেগুলো কিছুটা রান্না করেছেন জিনিয়া আর বাকি গুলো কেটেকুটে ফ্রিজে রেখেছেন। আগামীকাল বোনদের দিয়ে দেবেন। জিনিয়া পিঠা এখন বানাতে শুরু করবেন৷ দুপুরের রান্নার জন্য এখনো শুরু করেনি। খাবার খেয়ে সকলে রেস্ট করছে৷ কুয়াশা ঘুমিয়ে গেছে। টুকটাক গল্প করতে করতে সকলেই একটু ঘুমাল৷ এরই মাঝে শিশির শশীর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল সব ঘুমচ্ছে৷ একটু অপ্রস্তত হলো। চলে গেল৷ ভেবেছিল কুয়াশার শরীরের হালচাল জিজ্ঞেস করবে৷ সে-ও গিয়ে শুলো। নীহাররাও ঘুমচ্ছে।
বিকেলের দিকে সকলের ঘুম ভাঙল। সময় চারটা পয়তাল্লিশ। সবার ঘুরতে যাবার প্ল্যান ছিল। কুয়াশা যেতে পারবে না ভেবে কেউ কিছু বলছে না আর৷ কিন্তু কুয়াশা নিজেই জানাল তার বেশি আর সমস্যা হচ্ছে না। ঔষধ খেয়ে পেইন রিলিভার দিয়ে অনেকটা কম। এখন সত্যি কম কিনা ঘুরতে যাবার লোভে মিথ্যা বলল কিনা সেটা শিশির বোঝার চেষ্টা করল এবং জিজ্ঞেসও করল। কিন্তু সে জানাল কম। শিশির আর কিছু বলল না। সকলে রেডি হলো আশেপাশের গ্রাম ঘুরে দেখবে। শশী ওর কাজিনদের ডেকে আনল। দুইটা মেয়ে কাজিন তার মাঝে শোভাও আছে আর একটা হিমের বয়সের ছেলে এলো। চাচত ভাই বোন শশীর।
পরন্ত বিকেল। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। তেজ নেই কিন্তু তার লালাভ আলোক রশ্মি এখন পরিলক্ষিত বসুধায়। গাছের পাতায় পাতায় টিনের চালে চালে তার আলো জ্বলে জ্বল-জ্বল করছে৷ সারাদিন তেজ ছিল তার। এইজন্য গরমও বেশ ভালোই পড়ছে৷ কিন্তু গ্রামের মাঠের খোলা হাওয়ায় গরম কারো গায়ে লাগছে না।
সকলে শশীদের বাড়ি থেকে বের হয়েছে। পাকা রাস্তায় উঠে ডান সাইটের সোজা রাস্তায় হাঁটা ধরেছে৷ যত এগুচ্ছে গ্রামের পরিবেশে তত মুগ্ধ হচ্ছে সকলে। চোখ জুড়ানো পরিবেশ। শিশিররা হাঁটছে গ্রামের অনেক মানুষ হা করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। মূলত কৌতূহল গ্রামবাসির মনে। সকলে দেখছে এরা গ্রামের না শহরের মানুষ কারণ সাজসজ্জায়, চেহারায় সেটা ধরা দিচ্ছে। একটা মহিলা কৌতূহল দমাতে না পেরে শোভাকে জিজ্ঞেস করল,
” এ শুবা..! ইরা কারা রে? কুনতি আইয়িছে? ”
মহিলাটা শশীর গ্রামের ভাষায় বলল। শশীরা নিজেদের গ্রামের ভাষা বলে না। ওরা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। কিন্তু শশীর চাচারা, কাজিন রা বলে৷ শিশিররা থেমে গেল। তাদের এসবের প্রতি ধারণা আছে তাই কিছু মনে করল না৷ গ্রাম জিনিসটায় এমন কোনো নতুন মুখ কারো বাড়ি আসতে দেখলে জিজ্ঞেস করে করে মাথা খেয়ে ফেলবে৷ শোভা উত্তর দিল,
” শশীর খালার বাড়ির লোক। কুষ্টিয়া থিক আইসিছে।”
মহিলাটা বিজ্ঞের ন্যায় ‘ও’ বলল। শিশিররা আর কথা বাড়ালো না। কারণ গ্রামের লোকজন একটু বেশি বোঝে। বেশি বোঝে নাকি যা শুনে তা বেশি বলে কে জানে!
শিশিররা হাঁটতে লাগল। ঐ মহিলাটার মতো আরো কয়েকজন একই কথা জিজ্ঞেস করল৷ মিহির সহ শোভারা উত্তর করল৷
শশীদের বাড়ি ছেড়ে কিছু দূর হাঁটলে একটা ক্যানাল আছে। যেটার শাখা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে জানা নেই। শশীদের বাড়ির সামনের রাস্তার সোজা যাবার জন্য সেই ক্যানালে পাড়াপাড়ের জন্য ব্রিজ করা আছে৷ দেখতে ভীষণ সুন্দর পরিবেশ। একদম নিরিবিলি। সেখানে ব্রিজের পাশে ইয়া বড় মোটা বট গাছ আছে। অনেক বছরের পুরোনো। সোজাসুজি যে রাস্তাটা আগে মাটির ছিল এখন পাকা হয়েছে৷ কিন্তু সেই ক্যানালের ব্রিজের উত্তর, দক্ষিণ দিকের দুই পাশের রাস্তাগুলো চিকন আর মাটির। মাটির রাস্তা ঘেঁষে ছোট বড় বিভিন্ন রকমের গাছ। ক্যানালের ব্রিজের উপর থেকে গড়ান রাস্তা। ব্রিজ ছেড়ে অপূর্ব, অসাধারণ মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি। গ্রামের টিনের চালের বাড়ি একটা দুটো, কোনোটা মাটির বাড়ি। ছোট বড় টিন ও মাটি দিয়ে তৈরি সব বাড়ি-ঘর৷ ব্রিজের উপর দাঁড়ালে মাঠের বাতাসে শরীরের হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠে এতটা শীতল হয় মন। ভোরের পর সকালে আর পরন্ত বিকেলে এমনটা বেশি মনে হয়। রাস্তার দুই পাশের মাঠগুলো এত বড় বড় যে যতদূর চোখ যায় শুধু মাঠই দেখা যায় তার শেষ সীমানা আর পাওয়া যায় না। যদিও পাওয়া সীমানা সেটাও চোখে না লাগার মতোই।
ক্যানালের ব্রিজের উত্তর দক্ষিণে যে চিকন চিকন রাস্তা আছের সেদিকের বাম সাইটে, ডান সাইটে বড় বড় পুকুর আছে। মাছ চাষ হয়। পুকুরে সামনে উঁচু করে চড়াট পেতে সেগুলো উপরে ছন অথবা পাটকাঠি দিয়ে ছাউনি করা এবং চারকোণা ঘিরে রাখা। তার ভেতর রাতে মানুষ থাকে কারণ মাছের পুকুর পাহারা দেয় মালিকরা বা যারা পুকুল বর্গা নিয়ে মাছ চাষ করে থাকে। মাছ চাষ করাটা এই গ্রামে বেশিই হয়ে থাকে৷ এই জন্য আশেপাশে, যেখানে সেখানে পুকুর অতিরিক্ত। এরপর পাকা রাস্তা বরাবর নেমে গেলে আশেপাশে মাঠের মাঝেই অনেক পুকুর খনন করা৷ পাকা রাস্তা ঘেঁষে সেগুলো দেখতে এতটা মনোমুগ্ধকর লাগে তা বলে প্রকাশ করার মতো না৷ শুধু চোখ জুড়িয়ে যায়। বাতাসে পুকুরের পানির স্রোত গুলো দেখতে এত সুন্দর লাগে, শুধু দেখতেই মন চাই সাথে একদম টলটলা পরিষ্কার পানি৷ পানি দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে মন চাই।
হাঁটতে হাঁটতে শিশিররা সে ক্যানালে এলো। এসে ব্রিজের উপর থামতেই সকলে মুগ্ধ হয়ে গেল৷ দৃষ্টি জুড়িয়ে গেল। কেউ কেউ তো বলেই ফেলল,
” কী সুন্দর পরিবেশ! এখান থেকে যেতে মন চাইছে ”
বলে সব ছবি উঠাতে ব্যস্ত হলো। শশীরা হাসছে ওদের কার্বার দেখে৷ শিশির ব্রিজের উপর থেকেই চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক সব দেখে দেখে মুগ্ধ হচ্ছে। শশী বলল,
” সামনে আরো সুন্দর জায়গা পাবে, চলো”
মিহির বলল,
” তোমরা কোন সাইটে যাবে? সোজা রাস্তায় নাকি মাটির রাস্তায়? ”
কুয়াশা বলল,
” আমি তো সব দিকে ঘুরে দেখব। একদিকও বাদ রাখব না। এত সুন্দর পরিবেশ আগে জানলে কালই আসতাম। দুইদিন ধরে দেখে শেষ করতাম ”
সকলে হাসল। শিশির বলল,
” কোমড় ভাঙা নিয়ে আবার শখ করতে আসিস না! তখন আমারই টানা লাগবে আলুর বস্তা”
সকলে এবার জোরে হেসে দিল। কুয়াশা ফুঁসে উঠল বলল,
” এ্যাই, আলুর বস্তা কে? তুমি বুনো ওল চুপ থাকো ”
শিশির কথা বলল না। সকলে একে একে বলল আগে সোজা রাস্তায় গিয়ে ঘুরবে এরপর ডান সাইটের রাস্তা দেখিয়ে বলল এসে ঐ রাস্তায় যাবে। সকলে একমত হয়ে হাঁটতে লাগল আবার। যত যাচ্ছে তত চোখ জুড়ানো গ্রামের দৃশ্য। মিষ্টি, ফুরফুরে বাতাস৷ বাতাসে শ-শ শব্দ। ফ্রেশ নিঃশ্বাস টানছে সকলে। চলাচল রাস্তার অনেক লোকই ওদের তাকিয়ে দেখতে দেখতে চলাচল করছে৷ কুয়াশা আনন্দে ব্রিজের গড়ান রাস্তা থেকে দৌড়ে নামল। ওর ওমন দৌড়ে নামা দেখে শিশির দিল রাম ধমক,
” এ্যাই…! আবার পড়বি নাকি? তখন পড়ে কোমড় খসে নি বলে এখন খসানোর পারমানেন্ট ব্যবস্থা করতে চায়ছিস? আয় আমি খসিয়ে দিয়ে সাহায্য করছি, বে’য়াদব ”
যদিও কুয়াশা হাঁটতে গেলেও ব্যথা লাগছিল কিন্তু সে আনন্দে ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে এমনটা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। শিশিরের ধমক খেয়ে উড়নচণ্ডী ভাব বন্ধ করল। মিহির বলল,
” শিশির ভাই কুয়াশার একদম শশীর মতো স্বভাব। এটাও এমন লাফিয়ে বেড়ায় সব সময়। তোমরা আসার দুই সপ্তাহ আগে থেকে ওর ক্লাস নেয়া হয়েছে। যেন তোমরা যত দিন থাকবে উড়নচণ্ডী হয়ে না চলে। আম্মু ওর মাস্টার ছিল ”
বলে শব্দ করে হাসল। উপস্থিত সকলে হেসে ফেলল। শশী কটমট করে ভাইয়ের দিকে তাকাল। নীহার বলল,
” শিক্ষিকা হিসেবে তাহলে আমার শাশুড়ী ভালোই। ভালোই ক্লাস নিয়েছেন। মেয়ে তার পরীক্ষায় পাস করেছে৷ এই জন্য বলি এই উড়নচণ্ডী ইঁচড়েপাকা দুইদিন এত শান্তশিষ্ঠ কিকরে আছে! ”
সকলে হাসল তা শুনে৷ হাঁটতে হাঁটতে এমন অনেক ইয়ার্কি, ফাজলামো করল সব আর গ্রামের প্রকৃতি উপভোগ করল৷ অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে রাস্তার কোল ঘেঁষে একটা ছাউনি দিয়ে বসার জন্য চড়াট পাতা আছে। সকলে ওটা দেখে বসল সেখানে। সবার অবশ্য জায়গা হলো না৷ ছেলেরা দাঁড়িয়ে রইল। শান্ত শোভার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। আসলে গল্প বললে ভুল হবে সে শোভার সাথে ফ্লার্ট করছে৷
কুয়াশারা চড়াটের উপর বসে, সামনে বড় একটা পুকুর, মাঠের বাতাস, পরন্ত বিকেল, বাতাসে পানির স্রোত, নিরিবিলি কোনো সোরগোল নেই আহ্ কী যে সুন্দর মনোরম, মনোমুগ্ধকর, রোমাঞ্চকর লাগছে! এখান থেকে আর উঠতেই ইচ্ছে হচ্ছে না৷
শিশির কুয়াশার কয়েকটা ছবি তুলল৷ সকলে এক সাথে সেলফি উঠাল। এই মনোরম পরিবেশের সাথে নিজেদের ক্যাপচার করল। স্মৃতি হিসেবে রাখল৷ এমন এক জায়গায় আবার কখনো হবার সুযোগ হতেও পারে নাও পারে৷
ঐ রাস্তায় আর বেশিদূর গেল না কেউ৷ সকলে ফিরে এলো। অনেক হাঁটাহাঁটি হয়ে যাচ্ছে কুয়াশা কোমড়ের ব্যথা ফিরে আসছে৷ কিন্তু বলল না সেটা৷ সে হেঁটেই চলল৷ এসে মাটির রাস্তায় হাঁটল। মাটির রাস্তার পাশে ক্যানালের পানি বইয়ে চলে গেছে দূর বহুদূর। এর শেষ সীমানা কেউ জানে না বোধহয়। চিকন মাটির রাস্তা ডান সাইটে সারিবদ্ধ গাছগাছালি ছোট বড়৷ বাম সাইটে ক্যানালের পানি। আহ্ এই পরিবেশটাও রোমাঞ্চকর! হাঁটতে হাঁটতে সকলে বিভিন্ন গল্প করল৷ মিহির, শশী, শোভারা বিভিন্ন কথা বলল তাদের গ্রাম নিয়ে৷ অনেক দূরে গিয়ে আবার ফেরত পথে এলো। রিজভী স্মৃতি এক সাথে হাঁটছে আর নিজেদের মতো গল্প করছে৷
তুষার, তুহিন সৌরজের সাথে বাজারে গেছে। শশীদের এখানে হাট বলে।
ফিরে আবার সেই ব্রিজের কাছে এলো। বেলা গোধূলির লগ্নে এখন৷ সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। সকলে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল। এই গোধূলির লগ্নেও কিছু সুন্দর জিনিস, মূহুর্তের সাথে পরিচয় হলো ওরা। এতক্ষণ মাঠে থাকা কৃষকরা তাদের নীড়ে ফিরছে। সাথে লাঙল সহ গরু নিয়ে৷ ইশশ কী সুন্দর যে লাগছে৷ সারাদিন খাটাখাটুনি করে এখন ফিরছে৷ অনেক রাখাল গরু নিয়ে গেছিল মাঠে তারাও ফিরছে তাদের নীড়ে।
এরপর আরো একটা সুন্দর জিনিস দেখল ওরা৷ সেটা হচ্ছে দুইটা লোক অনেকগুলো পাতিহাঁস নিয়ে ফিরছে৷ কিছু না হলেও সেখানে দু’শত থেকে আড়াইশতর বা তারও অধিক পাতিহাঁস নিয়ে আসছে৷ হাঁসগুলো একদম সারিবদ্ধ হয়ে এঁকেবেঁকে পা ফেলে দৌড়ে আসছে৷ পেছনে একটা লোক আর হাঁসগুলো সামনে একটা লোক। কিছুটা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে সকলে থেমে গেল৷ কুয়াশা চোখ বড় বড় করে বলল,
” এ্যাই শশী! এতগুলো হাঁস এরকম ছেড়ে দিয়ে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল এনারা? এমন ছেড়ে দিয়েছে হারিয়ে যাবে না?”
” নাহ্, হারায় না। এগুলো খামারের হাঁস। এনারা মালিকের খামার দেখাশোনা করেন৷ আর রোজ এমন সকালে মাঠে নিয়ে যায় আর সন্ধ্যার আগে আবার নিয়ে খামারে রাখে৷ সারাদিন মাঠের, পুকুরের পানিতে থাকে আর মাঠের শামুক, ঝিনুক আরো অন্যান্য জিনিস খেয়ে বেড়ায়৷ এই সব হাঁসকে এখন আনার সময় একবার হাঁক ছেড়ে ডাকলেই চলে আসে। তারাও জানে তাদের নীড়ে ফেরার সময় হয়ে গেছে। ”
মিহিরের কথা শুনে সকলের আবার মন জুড়ালো। গ্রামের এসব জিনিসগুলো সত্যি মুগ্ধকর। হাঁসগুলো কুয়াশাদের ছেড়ে যাবে তখনই কুয়াশা হাঁসের মাঝে চলে গেল দৌড়ে। হাঁসগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল৷ প্যাক-প্যাক করে ডাকাডাকি শুরু করে দিল। কুয়াশা হেসে কুটিকুটি হলো৷ সকলে হাসল৷ শিশির বলল,
” কুয়াশা এদিকে তাকা ”
বলতে বলতে কুয়াশার কয়েকটা ছবি উঠাল৷ হাঁসগুলোর মাঝে থেকে৷ কী দারুণ লাগল মূহুর্তটা!! শিশির হাসল। নীহার বলল,
” আমি কনফার্ম ঘরজামাই থাকছি। ”
সকলে এবার আরো জোরে হেঁসে উঠল। ইয়াসমিন বলল,
” তোকে কালই এখানে রেখে যাচ্ছি। নিয়ে আর যাব না।”
” সত্যি, রেখে যা তোহ্। তার আগে কাজি ডেকে বিয়েটা পড়িয়ে দিয়ে যাইস ”
সকলে হাসল শশীও হেসে ফেলল তা শুনে। আবারও মজা করতে করতে সব বাড়ি ফিরল।
কিছু মূহুর্ত মন জুড়ানো, কিছু মূহুর্ত চোখ জুড়ানো, কিছু মূহুর্তে হৃদয়ে, স্মৃতিতে গেঁথে রাখার মতো। আজ এই পরন্ত বিকেল থেকে গোধূলির লগ্ন পর্যন্ত মূহুর্ত গুলো তাদের হৃদয়ে, স্মৃতিতে গেঁথে গেল। এসব আবার হয়তো এখানে আসলে দেখা হবে কিন্তু আজ যে প্রথম বাড়ের মতো এতটা মুগ্ধতা এলো এটা দ্বিতীয়বার আর আসবে না। কথায় আছে না? প্রথম সব কিছুই সুন্দর। তো শিশিরদের সাথেও তেমনই হচ্ছে। তারা এই প্রথম যেই সুন্দর, মনোরম, মনোমুগ্ধকর, রোমাঞ্চকর পরিবেশ, প্রকৃতি, মূহুর্তের সাথে পরিচয় হলো এটা অতি, ভয়ংকর রকমের ভালোলাগায় ছেয়ে গেল হৃদয়ে। দ্বিতীয়বার তা আর জায়গা করতে পারবে না।
বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই মাগরিবের আজান কানে ভেসে এলো৷ যারা নামাজ পড়ে তারা নামাজ পড়ে নিল। এরপর ঘরে বসল আড্ডা দিতে। কিন্তু এদিকে কুয়াশার অবস্থা বেগতিক হচ্ছে, ক্রমেই ব্যথা বাড়ছে। তার কোমড় ব্যথায় টনটন করছে ভেতরে। ঔষধ খেয়ে কমলেও বেশি হাঁটাচলা হয়ে গেছে। এখন ব্যথা ফিরে এসেছে অতিরিক্ত রূপে ধারণ করছে। বাড়াবাড়ি রকমের রূপ নিচ্ছে৷ বসতে পর্যন্ত অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু কাউকে কিছু বলল না। শক্ত মাটির উপর ঠাস করে কোমড়টা বাড়ি খেয়ে পড়েছে এটা কি কম কথা? কোমড়ের হাড়ে কতটা আঘাত লাগতে পারে! আল্লাহ রক্ষা করেছেন কোমড় ভেঙে যায়নি৷
রাতের খাবার খেয়ে সকলে বসল। কারেন্ট এখনো আজ রাতে যায় নি৷ তাই ঘরেই থাকল৷ এমন সময় কুয়াশা বার বার গুঙিয়ে উঠছে৷ ব্যথায় চোখ মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করছে। শশীরা টের পেয়ে তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করতে লাগল একের পর এক৷ কুয়াশা জানাল তার প্রচুর ব্যথা করছে কোমড়ে। এটা শিশির সহ জাকিয়াদের জানানো হলো। শুনে সকলে ছুঁটে এলো। শিশির গিয়ে পাশে বসে অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল। কিন্তু সে ব্যথায় কপোকাত। হানিফ সাহেব বললেন এখানে আশেপাশে চেকাপ করার জন্য কোনো ডক্টর নেই এমন ফার্মেসী ডক্টর ছাড়া। বড় ডক্টর, হসপিটাল অনেক দূরের পথ। শিশির বেশ চিন্তায় পড়ল৷ জাকিয়া একটু গরম পানি করে দিতে বলল জিনিয়াকে৷ গরম কিছুর সেঁক নিক। আর সৌরজ গিয়ে ফার্মেসী থেকে আপাতত ব্যথা নিরাময়ের জন্য ঔষধ এনে দিল। কালই চলে যাবে রাতটা কষ্ট করে কাটিয়ে দিতে পারল শহরে গিয়ে ডক্টরের কাছে নেবে জানালেন জাকির মালিথারা৷
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪৪+৪৫
মেয়েটার এমন জেদ, উড়নচণ্ডী স্বভাবের জন্য শুধু অঘটন ঘটে৷ নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনবে৷ শিশির অনেক বকা তো দিল কিন্তু বউয়ের জন্য অস্থিরতা কমাল না তার৷ সে নিজে পাশে বসে ব্যথা উপশমের কারণ হলো৷ এমনটা দেখে বৃষ্টি আর ইয়াসমিন গিয়ে জাকিয়াকে কিছু একটা বলল। যেটা শুনে জাকিয়ার ভালো লাগল৷ আর জিনিয়াকে বললেন শিশির আর কুয়াশাকে একটা ঘর ছেড়ে দিতে আজকের রাতটার জন্য। জিনিয়া বিষয়টা শুনে তাই-ই করলেন৷ আলাদা একটা ঘর কুয়াশা আর শিশিরকে দেয়া হলো৷
