ডার্কসাইড পর্ব ৪৭

ডার্কসাইড পর্ব ৪৭
জাবিন ফোরকান

ক্যাফে লো – ফাই।
সকাল আটটা মাত্র। ক্যাফের ভিড়ভাট্টা তুলনামূলক কম কিংবা নেই বললেই চলে। প্রায় ফাঁকা স্থানজুড়ে একদম কোণার দিককার একটি টেবিলে বসে আছে রোযা।সে একা নয়,তার সঙ্গে রয়েছে সাবিহা।উভয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করে চলেছে উল্টোপাশে বসে থাকা যুবক ছেলেটিকে।হালকা পাতলা গড়নের শরীর তার আবৃত কটকটে হলুদ বর্ণের এক হুডিতে, শ্যামবর্ণের মুখাবয়বজুড়ে প্রাণবন্ত চাহুনি,যা আচ্ছাদিত ভারী ফ্রেমের চশমায়।একটি লালচে ফাইল রাখা টেবিলের উপর, অপরপক্ষ এখনো স্পর্শ করেনি।যুবকটি সকলের চা এবং কফি পরিবেশন হওয়া অবধি অপেক্ষা করলো।অতঃপর নিজের ডান হাতখানি বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– আমি অনির্বাণ আহমেদ।আরিয়ান নিশ্চয়ই আমার কথা আপনাদের জানিয়েছে?
একে অপরের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করলো রোযা এবং সাবিহা।অতঃপর মাথা নেড়ে রোযা নিজের হাত এগিয়ে করমর্দন করলো সংক্ষিপ্ত।
– আমি রোযা রেমান।
– ফাইনালি!আপনার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
– আমি অতটাও বৃহৎ কোনো ব্যক্তিত্ব নই।
– হয়ত নন।কিন্তু বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের নিকট আপনি একজন বীর লড়াকু সৈনিক,শুধুমাত্র আপনিই নন আপনার সঙ্গে যারা রয়েছে তারা সকলেও।
সাবিহার উদ্দেশ্যে একনজর দৃষ্টিপাত ঘটিয়ে সমাপ্ত করলো অনির্বাণ।কিছুক্ষণ নীরবতা,তারপর রোযা তা ভঙ্গ করে নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানালো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– আরিয়ান বলেছে আপনি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক।আমি বিস্তারিত জানতে চাই।
যদিও রোযা পূর্বেই এই অনির্বাণ আহমেদ সম্পর্কে সকল তথ্যই ঘাঁটাঘাঁটি করে বের করেছে তবুও তার নিজ মুখ থেকে জানতে চাইলো।আরিয়ান এখনো হাসপাতালে ভর্তি,গুরুতর আ*হত হয়েছিল,বর্তমানে শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল।তবে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে মাস দুয়েক সময় প্রয়োজন হবে।তথাপি থমকে নেই সে।বর্তমানে আন্দোলনের অবস্থা অনেকটাই নাজুক।প্রতিনিয়ত পুলিশি বাঁধার মুখে পড়তে হচ্ছে।

ইতোমধ্যে আন্দোলনরত বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী গ্রেফতারও হয়েছে।সরকারের পক্ষ থেকে বারংবার বলে যাওয়া হচ্ছে যে বিষয়টির যথাযথ তদন্ত করা হবে,তবুও কোনো উন্নতির লক্ষণ নেই। জিশানসহ তার সকল সঙ্গীই বর্তমানে পলাতক।দুই দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে অপরাজেয় শিক্ষার্থী পরিষদ।অহনা হ*ত্যার সুষ্ঠু বিচার,এবং সেদিন মেরিডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হাম*লার তদন্ত।কর্তৃপক্ষ চাপে পড়ে মুখে মুখে অনেক কিছু বললেও আদতে যে কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা গৃহীত হবেনা সকলেই আন্দাজে সক্ষম।মিডিয়াও এই সম্পর্কে উদাসীন,তারা পরে আছে আন্তর্জাতিক সামিটে অংশগ্রহণ করে দেশের আমলা মন্ত্রীরা কি কি সুফল বয়ে আনছে জাতির জন্য তা প্রকাশে।এত বিকট অস্থিতিশীলতা চলছে রাজধানীজুড়ে, তা যেন তাদের কর্ণপাতে নেই।

মিডিয়া কভারেজের জন্য একমাত্র সোশাল প্ল্যাটফর্মই সঙ্গী।তাও ইন্টারনেট নিয়ে বহু গড়িমসি করা হচ্ছে।এর মাঝেই একদিন আরিয়ানকে দেখতে গেলে সে জানায় অনির্বাণ আহমেদ নামে তার পরিচিত একজন বড়ভাই রয়েছে,যিনি একজন শখের সাংবাদিক।কোনো চ্যানেলের উদ্দেশ্যে কাজ না করলেও তার অভিজ্ঞতা নেহায়েত কম নয়।রোযা পরে ঘেঁটে দেখেছে, আরিয়ান ঠিক কথাই বলেছে।একদম বিরাট কিছু না হলেও অনির্বাণ মোটামুটি পরিচিত এক মুখ ভার্চুয়াল জগতে,অনুসারীর সংখ্যা লাখখানেক।

মূলত ব্যক্তিগত তদন্ত পরিচালনা করে সে,দেশের সকল চাঞ্চল্যকর ঘটনার অন্তরালে লোকায়িত সত্য উপস্থাপন করে নির্দ্বিধায়।একদম স্বতন্ত্র মিডিয়া বলা যায় যাকে,যে কখনো ন্যায়ের পক্ষে আওয়াজ তুলতে কুণ্ঠাবোধ করেনা। নির্ভীক এক মানুষ,সত্যের সঙ্গী, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী।এই মানুষটি নিজে থেকেই আরিয়ানের মাধ্যমে অপরাজেয় শিক্ষার্থী পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করে,তাদের সত্যতা সে সকলের সম্মুখে তুলে ধরতে চায়,সঙ্গী হতে চায় মহাযাত্রার।এই সুযোগ হাতছাড়া করার মতন মহাবোকা রোযা নয়, এই মুহূর্তে তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মিডিয়া কভারেজ যাতে দেশের জনগণ জানতে পারে আদতে কি ঘটছে এই দেশজুড়ে।তবুও সম্পূর্ণ আস্থা স্থাপনের পূর্বে সামান্য বাজিয়ে দেখতে চায় অনির্বাণকে সে।

– আমি অহনার হ*ত্যা*কাণ্ডের মূল ঘটনা তুলে ধরতে চাই,সেখান থেকে আন্দোলনের সূত্রপাত এবং বর্তমান পরিস্থিতি পর্যন্ত।তার জন্য সবচেয়ে যথাযথ সাক্ষী একমাত্র আপনারাই।
– আপনার ভয় হচ্ছেনা?
সাবিহা জিজ্ঞেস করতেই অনির্বাণ হাসলো,হাসলে তার কপোলে টোল সৃষ্টি হয়,ভালোই লাগে দেখতে।
– ভয়?একদিন এই বিশ্বজগত ছেড়ে আমাদের সকলকেই ওপারের যাত্রী হতে হবে।এত ভয় করে লাভ কি?
– যদি আপনার কোনোপ্রকার ক্ষতি হয়?যেখানে কোনো মিডিয়াই আমাদের পক্ষে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেনা সেখানে আপনি একা….

– মিস সাবিহা।
নিজের চশমাখানি ঠিক করে গভীর দৃষ্টি ফেললো অনির্বাণ।
– আমার কোনো পিছুটান নেই।বলতে পারেন এই ধরিত্রীর বুকে এক যাযাবর আমি,যতদিন এই দেহে প্রাণ থাকবে সত্যের পক্ষে লড়ে যাবো।অতঃপর পরাজয়েও খেদ নেই, জানবো আমি ন্যায়ের পথে ছিলাম, লড়েছি দাম্ভিক ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে।
সন্তুষ্ট দেখালো রোযাকে।মাথা দুলিয়ে চা সমাপ্ত করে কাপ দূরে ঠেলে রুমালে মুখ মুছলো।

– আমি জানি,এখানে আসার পূর্বেই আপনি আন্দাজ করেছেন যে আমরা অবশ্যই আপনাকে সাদরে গ্রহণ করবো।
সামান্য হাসলো অনির্বাণ,চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে তাকালো সাবিহা এবং রোযার উদ্দেশ্যে।
– সত্যি বলতে শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম না,আপনারা আমার চোখে কল্পনাতীত বিধ্বংসী নারীসত্তা।যদি আমাকে ফিরিয়েও দিতেন,তবুও খুব একটা অবাক হতামনা।আপনাদের কালোর মিছিল কর্মসূচিটি আমার ভীষন নজর কেড়েছে, মেটাফোরের উপস্থাপন থেকে বুঝতে পেরেছি তখনি,যতটা নিষ্পাপ আপনাদের চেহারা ততটা নমনীয় মস্তিষ্ক নয় আপনাদের,বরং ক্ষুরধার।

– প্রশংসা নয়, ন্যায়বিচার চাই।
– পাবেন,অবশ্যই পাবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।যে শৃংখল উন্মুক্ত করেছেন, তা রূপান্তরিত হবে ঐক্যশক্তিতে। আর এই মহাযাত্রায় সামান্যতম অংশ হতে পারলেও গর্ববোধ করবো আমি।
রোযার উদ্দেশ্যে চেয়ে বললো অনির্বাণ।
– ঠিক আছে।আমি আপনাকে আমাদের দিককার সম্পূর্ণ পটভূমি জানাবো।
সাবিহা বলতেই অনির্বাণ মাথা নেড়ে ধন্যবাদ দিতে যাচ্ছিল কিন্তু রোযার প্রশ্নে থমকে গেলো।
– আপনার এই ফাইলে কি রয়েছে জানতে পারি?

ফাইলের দিকে তাকালো অনির্বাণ।এক মুহুর্ত ভাবলো যেন দ্বিধান্বিত অনুভব করছে।অতর্কিতে সাবিহার ফোন বেজে উঠল,অভিষেক কল করেছে লক্ষ্য করে টেবিল থেকে উঠে গেলো সে আলাপ সারতে।শুধুমাত্র রোযা এবং অনির্বাণ মুখোমুখি।অবশেষে ফাইলটি রোযার উদ্দেশ্যে এগিয়ে দিয়ে দৃঢ় কন্ঠে শখের সাংবাদিক জানালো,
– এটা আমার এযাবৎকালের সবথেকে চাঞ্চল্যকর তদন্ত।
ফাইলটি হাতে নিয়ে খুললো রোযা। মোটা পৃষ্ঠাজুড়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগৃহীত,পেপার ক্লিপ দিয়ে খবরের কাগজের নিউজ হতে আরম্ভ করে ফটোগ্রাফ পর্যন্ত।নাবিল কায়সারের ছবি লক্ষ্য করেই রোযা থমকে গেলো,সামান্য বিচলিত মনোভাব প্রস্ফুটিত হলো তার মুখাবয়বে।

– আশা করি এই বান্দাকে চেনেন।দেশের অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর ঘটনা কে বি গ্রুপের পতনের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আপন অন্তরের অনুভূতি চেহারায় ফুটে উঠতে না দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে অনির্বাণকে মোকাবেলা করলো রোযা।ফাইল বন্ধ করে খানিক উদাসীন ভঙ্গিতেই জানালো,
– নাবিল কায়সার চিতাবাঘের আ*ক্রমণে মা*রা গিয়েছিলেন।
– খু*ন হয়েছিলেন।

যেন রোযার প্রতিক্রিয়া নিরীক্ষণ করতে চাইলো অনির্বাণ,তথাপি মেয়েটি নির্বিকার।তাতে অবশ্য দমে গেলনা সে,চেয়ার টেনে খানিক নিকটে সরে কন্ঠ খাদে নামিয়ে ব্যক্ত করলো,
– কে বি গ্রুপের ঘটনাটি আমাকে হতবাক করেছিল।যদিও তাদের ব্যবসায়িক প্রতিপত্তির অন্তরালে থাকা কলুষিত ইতিহাস সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা ছিল, তবুও এমন অতর্কিত বিনাশ যথেষ্ট সন্দেহজনক।কোনো নিরাপত্তাবাহিনী সঠিক তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি,কিন্তু পারলেও প্রকাশ করেনি।কেনো?প্রতিপক্ষ কি তবে তার চাইতেও ক্ষমতাবান?প্রশ্নগুলো বারংবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিলো।তাই আমার নিজ তদন্তে অগ্রসর হই।শুরুতে ভাবিনি অন্তিম পর্যায়ে গিয়ে এমন এক ক্রুর অতীত আবিষ্কার করবো।

স্পষ্টত শীতল শিহরণ খেলে গেল রোযার শিরদাঁড়া বেয়ে।এবার তা তার অভিব্যক্তিতেও প্রকাশ পেলো।মাথা কাত করে কন্ঠ যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে রোযা জিজ্ঞেস করলো,
– আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাওয়ার পিছনের আসল উদ্দেশ্য কি তবে এটাই মিস্টার অনির্বাণ?যদি তাই হয়ে থাকে আমি আমাদের চুক্তিকে বাতিল ধরে নেবো।
হাসলো অনির্বাণ, তা কিছুটা স্বস্তিদায়ক ছিল যেন।নাকি রোযার মনের ভুল?

– আমার সম্পূর্ণ কথা শুনবেন মিসেস রোযা? তারপর নাহয় আমাদের চুক্তির কথা ভাবা যাবে?
বুকে দুবাহু ভাঁজ করে রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনির্বাণকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো রোযা, এই বান্দাকে আদতে যতটাই অমায়িক প্রদর্শিত হোক না কেনো অভ্যন্তরে ভীষণ চতুর।নাহলে অবশ্যই এই পথে এতদিন টিকে থাকতে সক্ষম হতোনা।
– কে বি গ্রুপের পতন সম্পর্কে আপনার কি মত? কোম্পানিতে অ*গ্নিকাণ্ড,টেন্ডার হরণ,বিরাট লস কি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নাকি ষড়যন্ত্র?

– জানিনা।
এক শব্দে উত্তর করলো রোযা।তাতে অনির্বাণের হাসি বিস্তৃত হলো। টেবিলে দুহাত রেখে আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল গুঁজে রোযার দৃষ্টিতে সরাসরি দৃষ্টিপাত ঘটিয়ে জানালো,
– নাবিল কায়সারের দে*হাংশে ফেরোমনের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল।সন্দেহজনক নয় কি?ঠিক তার পরের মাসগুলোতেই ধীরে ধীরে কে বি গ্রুপের অর্থনৈতিক ভিত্তি গুঁড়িয়ে যেতে শুরু করে।যা সমাপ্ত হয় এক অ*গ্নিকান্ডের মধ্য দিয়ে। যার সঙ্গে আবার রেমান গ্রুপের মালিকের অপহরণের ব্যাপার জড়িত ছিলো।এরপরই কে বি গ্রুপের সকল কুকর্ম প্রকাশ্যে উন্মোচিত হয়ে পড়ে।একদিন হুট করে খবর আসে, বাদশাহ কায়সার নাকি বিদেশে চিকিৎসাকালীন অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃ*ত্যুবরণ করেছেন।থ্রিলার সিনেমার ধাঁচে সজ্জিত বাস্তব ঘটনাগুলো রহস্যময়,তাইনা?

– আপনি কি বলতে চাইছেন অনির্বাণ?খোলাসা করে বলুন।
রোযার কন্ঠ অস্বাভাবিক শীতল শোনালো,যার দরুণ অনির্বাণ সামান্য বিব্রতবোধ করলো।শিরদাঁড়া টানটান করে সোজা হয়ে বসলো সে।এবার কোনোপ্রকার ভণিতা করলোনা।
– আমি সম্পূর্ণ কে বি গ্রুপের ব্যাপারটা তদন্ত করেছি, অতঃপর যে তথ্য আবিষ্কার করেছি তা রীতিমত অবিশ্বাস্য।
একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো রোযার বক্ষ থেকে, মাথা হেলিয়ে সে বিরক্তি প্রকাশ করলো।
– আমরা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে দেখা করেছি।এর মাঝখানে কে বি গ্রুপের সম্পৃক্ততা চোখে পড়ছেনা।অহেতুক বিষয় নিয়ে কথা বলে নষ্ট করার মতন সময় আমার হাতে নেই,সেটা আপনার বোঝা উচিত অনির্বাণ।

– মডার্ন প্রবলেম নিডস মডার্ন সলুইশন।
অনির্বাণের এই বাক্যটি রোযার আগ্রহ সৃষ্টিতে যথেষ্ট ছিলো।
– আপনার কালোর মিছিলের রেশ ধরে মেটাফোর টেনে যদি আমরা ভিন্ন একটি ব্যাপার উপস্থাপন করি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টিতে,তাহলে কেমন হয়?
ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো রোযার, অধরে অধর চেপে ধরলো।অনির্বাণ ঠিক কতটুকু জানে সে আন্দাজ করতে পারছেনা,তাই কি বলা উচিত তা ঠিক করতে দ্বিধান্বিত হচ্ছে।ফাইলটি টেনে খুললো অনির্বাণ,পৃষ্ঠা উল্টে দেখাতে আরম্ভ করলো,

– আজ থেকে প্রায় চার বছর আগেকার কথা।কে বি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক বিরাট পার্টির আয়োজন হয়,যা নিয়ে সমগ্র দেশের আগ্রহ ছিল যেন তুঙ্গে।সেই সময়ে একটি গুঞ্জন উঠেছিল,এই পার্টিতে নাকি কোনো এক ঘটনা ঘটিয়েছিল নাবিল কায়সার।এক গণধ*র্ষণ!
হৃদযন্ত্র সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়লো,দৃষ্টির সামনে সবকিছু ঝাপসা হতে আরম্ভ করলো,তবুও চেহারায় নির্বিকারতা ফুটিয়ে রাখতে এতটা সংগ্রামে লিপ্ত হতে হলো রোযাকে যে অন্তর তার ক্ষ*তবিক্ষ*ত হলো ধা*রালো ফলায়।অনির্বাণ থেমে নেই,তার কন্ঠস্বর যেন রোযার কন্ঠে বিষের বাঁশির সুরের ন্যায় ঠেকছে।

– একজন মেয়ে এবং তার সন্তান নির্মম মৃ*ত্যু বরণ করেছিল ধর্ষ*কদের হাতে।কিন্তু মেয়েটির পরিচয় কখনোই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।যেন জগতে বিদ্যমান থেকেও অদৃশ্যমান ছিল সে।এমন গুঞ্জনকে সেই সময়ে প্রতিপক্ষের গুজব বলে চালিয়ে দিয়েছিল কে বি গ্রুপ।নাবিল কায়সারের পূর্বইতিহাস ভালো ছিলনা এ সম্পর্কে অবহিত থাকলেও ক্ষমতা এবং অর্থের দাপটে সেই সময় সবকিছুই ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। চারটে বছর পেরিয়ে আজ সেই ক্ষমতাধর কে বি গ্রুপ সম্পূর্ণ নিঃস্ব।নাবিল কায়সার,বাদশাহ কায়সার পরকালের যাত্রী।শুধুই কি ভাগ্যের পরিহাস?নাকি কর্মফল?

চকিতে যেন তড়িৎ খেলে গেলো রোযার অঙ্গে।এক ঝটকায় সে ছিনিয়ে নিলো অনির্বাণের হাত থেকে ফাইলটি,আবারো নিগূঢ় পর্যবেক্ষণ চালালো।সম্পূর্ণ ঘটনাটি বিশ্লেষণ করেছে অনির্বাণ এভাবে,
ভিকটিম,অজ্ঞাত।ধ*র্ষক আনুমানিক পাঁচ কিংবা ছয়জন।নাবিল কায়সার হ*ত্যা।এই সময়ের এক থেকে তিন মাস ব্যবধানে রাজধানীর আশেপাশে ঘটা কিছু অস্বাভাবিক নৃ*শংস হ*ত্যা*কাণ্ড। ঊনত্রিশবার ছু*রিকা*ঘাতে হ*ত্যা,হৃ*দপি*ণ্ড উগ*ড়ে হ*ত্যা।কে বি গ্রুপের বিদেশী বন্ধু ইতালীয় কোম্পানির কর্ণধারের পুত্র উধাও, খাদ্যমন্ত্রী জোবায়দা খাতুনের কনিষ্ঠ পুত্রের অতর্কিত পলায়ন। খু*নী কিংবা অপহ*রণকারী অজ্ঞাত। কেইস সমাধানহীন।সবকিছুর কারিগর কি একজনই?নাকি ভিন্ন কেউ?যদি এক সুতোয় গাঁথা যায় তাহলে….. এরাই কি সেই ধর্ষ*ক?
স্থির নয়নে অনির্বাণের উদ্দেশ্যে মুখ তুলে তাকালো রোযা,সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ সে।অনির্বাণ ছন্নছাড়াভাবে হলেও সূত্রসমূহ ঠিকই মিলিয়েছে।সশব্দে ফাইল বন্ধ করে সে স্থির হয়ে রইলো,অনিয়ন্ত্রিত নিঃশ্বাস প্রশ্বাস সাংবাদিক মহাশয়ের দৃষ্টি এড়ালোনা।

– যদি সব ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু একটি ধরে নেই,তাহলে সবকিছু যুক্তিসঙ্গত ঠেকছে তাইনা?কেউ সেই চার বছর আগে ঘটা ধর্ষ*নের প্রতিশোধ নিচ্ছে।ক্ষমতা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা,অর্থবিত্ত তার সামনে তুচ্ছ।ক্ষমতার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সে যেন ক্ষমতার চাইতেও ক্ষমতাবান।তাই এই ক্ষমতার গদিতে অবস্থান করা ব্যক্তিবর্গও যেন সেই সত্তার টিকিটুকুও ছোঁয়ার দুঃসাহস করতে অক্ষম।
নৈঃশব্দ্য।রোযার গভীর দৃষ্টি আপতিত সুদূরের উদ্দেশ্যে,অনির্বাণ নিজের চশমা খুলে নিয়ে রুমালে মুছলো।অতঃপর পুনরায় পরিধান করে জানালো,

– আমি জানিনা আমার ধারণা কতটুকু সত্য,তবে আমার নিজের প্রতি এইটটি পার্সেন্ট আত্মবিশ্বাস রয়েছে।আমি এই সমস্ত ঘটনাকে একটি থিওরি হিসাবে উপস্থাপন করতে চাই।আর এখনি সেই সময়।ক্ষমতার বিরুদ্ধেও পরাশক্তির অবস্থান রয়েছে, কিংবদন্তী হিসাবেও যদি তা অন্তরে স্পৃহার উদগীরণ ঘটায় তবে ক্ষতি কি?এখনি সময় আমাদের নতুন উদ্যমে জাগ্রত হওয়ার।অহনা একা নয়,শত সহস্র অহনার অস্তিত্ব রয়েছে এই পৃথিবীতে,তার মাঝে কোনো এক অহনাতুল্য নারীর বিনাশ ঘটিয়ে মুক্তি পায়নি স্বয়ং ক্ষমতাও,প্রতিফল তাদের গ্রাস করেছে অচিরেই। মেটাফোরটি উত্তেজনা সৃষ্টিতে যথেষ্ট নয় কি?আমরা জানবো,আমাদের আশেপাশেই অগণিত অস্তিত্বের ভিড়ে হয়ত কোনো ধবংসাধিপতির বসবাস, বিনাশক যে অশুদ্ধতার….

– নেমেসিস।
রোযার অতর্কিতে উচ্চারণ করা একটিমাত্র শব্দে অনির্বাণ বিস্মিত হলো।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল রমণীর উদ্দেশ্যে।ফাইলটি অনির্বাণের দিকে ঠেলে দিয়ে নির্বিকারতা ঝেড়ে মৃদু হেসে রোযা পুনরায় বললো,
– আপনার থিওরিতে সেই বিনাশককে নেমেসিস হিসাবে সম্বোধন করবেন।
– ইউ মিন দ্যা গডেস অব রিভেঞ্জ অ্যাণ্ড অ্যাগোনি?
অনির্বাণের দৃষ্টি প্রজ্জ্বলন ধারণ করলো,তাতে স্পষ্ট প্রকাশ পেলো উত্তেজনা।যেন কোনো এক শিশু তার বহুদিনের শখের খেলনাটি হাতে পেয়েছে,এমন এক তৃপ্তির ছাপ চেহারাজুড়ে। হাঁটুর উপর হাঁটু তুলে বসে রোযা সামান্য সামনে ঝুঁকলো,

– গ্রীক মিথ অনুযায়ী দেবী নেমেসিস ছিলেন প্রতিশোধ এবং ন্যায়ের দেবী।আপন দম্ভে বিভোর নার্সিসাসকে তার কর্মের উপযুক্ত প্রতিদান দিয়েছিলেন তিনি তার সেই দাম্ভিক সৌন্দর্য্যকে ব্যবহার করেই।আপনার থিওরির এই অজ্ঞাত ব্যক্তিকেও খুব বেশি ভিন্ন কেউ মনে হচ্ছেনা।যদি সত্যিই সকলকিছু সত্যিই এক সুতোয় গাঁথা হয়ে থাকে তাহলে বলব,তিনি নিজেই হয়ত জলজ্যান্ত এক নেমেসিস।যে দাম্ভিক ক্ষমতাকে গুঁড়িয়ে ছিনিয়ে নিয়েছেন আপন ন্যায়বিচার।
– ইউ আর রাইট!

টেবিলে অতর্কিতে চাপড় দিয়ে উঠলো অনির্বাণ, উত্তেজনা সীমা অতিক্রম করেছে তার।পরমুহুর্তে লজ্জিত হয়ে কন্ঠ পরিষ্কার করে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লো।
– আপনি তাহলে আমার সঙ্গে একমত?
– আপনার থিওরি সময়োপযোগী।একমত না হওয়ার কারণ দেখিনা।
– ধন্যবাদ।আমি খুব দ্রুতই ব্যাপারটা জনসম্মুখে উপস্থাপন করবো।অহনাও ন্যায়বিচার পাবে,অবশ্যই পাবে।
– এই ন্যায়বিচার লড়াই করে ছিনিয়ে আনা হবে আরো শত সহস্র অহনার তরে।
রোযা এবং অনির্বাণ উভয়ের জ্বলজ্বলে দৃষ্টি মিলিত হলো,প্রফুল্ল হাসি নিয়ে মাথা দোলালো দুজনই।যদিও একে অপরের মাঝে লোকায়িত রহস্য সম্পর্কে তারা অবহিত নয়,তবুও।বাহির থেকে ফেরা সাবিহা উভয়কে এমন অর্থপূর্ণ নৈঃশব্দ্য বিনিময় করতে দেখে সামান্য বিস্মিত হলো,মনে হচ্ছে বেশ বড়সড় একটা ব্যাপার তার অনুপস্থিতিতে ঘটে গিয়েছে।

ডিস্কো ক্লাবটির চারিপাশে গুমোট আঁধারমাখা পরিবেশ। উচ্চশব্দে বাজতে থাকা মিউজিকে আচ্ছন্ন স্থানজুড়ে অ্যালকোহলের উৎকট গন্ধ।আশেপাশে তরুণ তরুণী এবং কিছুক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর কিশোরীরাও কোলাহলে মেতেছে,কেউবা সিগারেটে বুদ হয়ে কেউ আবার সকল নৈতিকতা উপেক্ষা করে অশালীনতায়। ক্লাবটির দেয়াল ঘেঁষে পার্কিং এরিয়ায় রয়েল এনফিল্ডের শরীরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিহাদ অবশ্য কোনকিছুর পরোয়া করলোনা।আপনমনে গ্লাভস পরিহিত আঙুল গুণে চলেছে সে। হেলমেটে আচ্ছাদিত চেহারায় তার ছড়ানো এক অস্বাভাবিক শীতলতা।

মিনিট পনেরো পেরোলো।অবশেষে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো চিকচিকে শুভ্র পোশাক পরিহিতা রমণীকে।ভ্রু কুঁচকে এলো নিহাদের,নেশায় বুদ হওয়া টকটকে চেহারার লাস্যময়ী আভা তার হৃদয়কে টলাতে সক্ষম হলোনা।তবুও পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো,হেলমেট পরিহিত অবস্থায়ই ক্যাব বুক করার আশায় ফোনের স্ক্রীনে ঝুঁকে থাকা রমণীর দিকে ঝুঁকে ঝকঝকে হাসিতে শুধালো,

– ইউ লুক এক্সেপশোনালি গর্জিয়াস টুডে!
গাঢ় আইলাইনার টানা নেত্রপল্লব তুলে রমণী তাকালো, আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো নিহাদকে।সন্তুষ্টির হাসি প্রস্ফুটিত হলো অধরে।ফোন কাঁধের ব্যাগে চালান করে সম্পূর্ণ অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও নিহাদের কাঁধে দুহাত ছড়িয়ে কাছে টেনে বিড়বিড় করলো,
– হোয়াট আ মিস্টেরিয়াস গাই! আই লাভ মিস্ট্রিস ভেরি মাচ।
হেলমেটের উইন্ডোর স্বচ্ছতায় নিহাদের টানা টানা নয়নজোড়া তারকার প্রজ্জ্বলনে ছেয়ে যেতে দেখা গেলো।বিনা দ্বিধায় তার দুহাত জড়িয়ে গেলো রমণীর কোমরে,কাছে টেনে নিজের মাঝে মিশিয়ে ফেলে মাদকীয় কন্ঠে উচ্চারণ করলো,

– দিনের পর দিন অবলোকন করে গিয়েছি,ইউ মেইক মি ক্রেইজি বেইবি।
– হাহা,তাই বুঝি?
মাথা দুলিয়ে রমণীর চুলে হাত বুলিয়ে আনলো নিহাদ, শিহরিত হয়ে তার বুকে স্পর্শ ঠেকালো রমণীও।এক তাড়া ফুটে উঠল তার অভিব্যক্তিতে।
– চেম্বার পর্যন্ত অনুসরণ করবে আমায়?
হাসলো নিহাদ,কন্ঠে আকুতি ফুটিয়ে জানালো,
– তোমায় আমি নরক পর্যন্ত অনুসরণ করতেও প্রস্তুত, প্রিন্সেস।
হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে নিয়ে চললো রমণী, অত্যন্ত আগ্রহভরে পিছু পিছু চললো নিহাদও।ক্লাবের ঠিক পিছনেই রীতিমত ফাঁকা নির্জন প্রান্তে লাগোয়া বেশ কয়েকটি দরজা।একটির হ্যান্ডেল টেনে নিহাদকে ভেতরে ঠেলেই রমণী তার হেলমেট পাকড়াও করলো।দরজা বন্ধ করবার সময়টুকু যেন তার বেহায়া অন্তরের নেই।নিহাদ তার দুহাত চেপে ধরলো আলতোভাবে, শুধালো,

– এত তাড়া কিসের?রিল্যাক্স,লে ডাউন প্রিন্সেস।
আগ্রহভরে বিছানায় উঠলো রমণী,তর্জনী কুঁচকে ইশারা করলো নিহাদের উদ্দেশ্যে।জ্যাকেটের জিপার টেনে অভ্যন্তরের টি শার্ট উন্মুক্ত করতে করতে এগোলো নিহাদ,কাধ ছুঁয়ে রমণীকে শুইয়ে দিলো।উঠে এলো উপরে।গ্রীবায় নিহাদের গ্লাভস পরিহিত আঙুলের শীতলতম স্পর্শে রমণী শিউরে উঠে আবেশে চোখ বুজলো। অপেক্ষায় লিপ্ত হলো অমোঘ এক পরিপূর্ণতার।অতঃপর…..

বরাবর ললাটে এক ধাতব ছোঁয়া পেতেই আবেশিত নয়নজোড়া খুলে গেলো।হতবিহ্বল হয়ে হেলমেট পরিহিত পুরুষটিকে লক্ষ্য করলো,হাতে তার লম্বাটে নলযুক্ত এক রিভ*লভার।ঠেকিয়ে রেখেছে রমণীর ললাট বরাবর,অজান্তেই চিৎকার নির্গত হচ্ছিল কিন্তু অপর হাতে তার মুখ চেপে নৈঃশব্দ্যতে ছাইলো সে চারিপাশ।
– হুশ…. বলেছিলাম না নরক পর্যন্ত অনুসরণ করবো?তার পূর্বে যে তোমার নরকে গমন প্রয়োজন…. প্রিন্সেস!
সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়লো রমণীর মস্তিষ্ক,থরথর করে কম্পিত হতে থাকলো সর্বাঙ্গ।মৃ*ত্যুদূত তার সন্নিকটে।এ যেন এক মোহময় মরীচিকা,মধুর বিষপানে তাকে বাধ্য করেছে যা।হেলমেটের অন্তরালে নিহাদের অধর বিস্তৃত হলো,ফিসফিস কন্ঠে বললো,

– আই উইল মেইক ইট লেস পেইনফুল ফর ইউ লেডি!
ট্রি*গা*রে ঠেকলো তর্জনী,রমণীর সিক্ত দৃষ্টিও অন্তরে চির সৃষ্টিতে সক্ষম হলোনা।প্রচণ্ড এক আ*ঘা*ত, রমণীর পৃথিবী সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হলো অমানিশায়।
প্রচণ্ড বিস্ময়ে পাশ ফিরে তাকালো নিহাদ।আধ আলো এবং আধ অন্ধকারে একটি ক্যান্ডেলস্টিক হাতে দন্ডায়মান দীঘল কালো এবং নীলচের মিশেলে কেশগুচ্ছের অধিকারী এক প্রস্ফুটিত নারী। সুদর্শনার নয়নজুড়ে অব্যক্ত আবহ।একটি জোরালো ধাক্কায় নিহাদকে সদ্য জ্ঞান হারানো রমণীর নিকট থেকে সরালো সে,পাশের দেয়ালে ঠেকে যেতেই হাত থেকে রিভল*ভারখানি কেড়ে নিলো।একটি জোরালো টানে খুলে নিলো হেলমেট।

– অসভ্য বর্বর!
– চারুলতা?
ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকল নিহাদ,কয়েক মুহূর্ত বিশ্বাস করতে ব্যার্থ হলো নিজের দৃষ্টিকে। চারুলতা এগিয়ে হেলমেটখানি বাগরে তার বাহুতে আ*ঘা*ত হা*নলো, কার্পণ্য করলোনা।হিসিয়ে উঠল নিহাদ,তৎক্ষণাৎ বিছানা ত্যাগ করে লাফিয়ে নেমে দূরে সরে গেলো।
– লজ্জা করেনা একটা মেয়েকে খু*ন করতে এসেছ?
– না করেনা।
নির্বিকার জবাব দিলো নিহাদ, ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। দাঁতে দাঁত পিষে চারুলতা এগিয়ে এলো,
– নির্লজ্য কোথাকার!

– আমায় বিনা কারণে অনুসরণ করেছ, নির্লজ্য আসলে কে?
দৃশ্যমানভাবে কম্পিত হলো চারুলতার সর্বাঙ্গ।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে হেলমেটটি এক ঝটকায় নিহাদের বুকে ঠেসে অপর হাতে তার উন্মুক্ত হাতখানি পাকড়াও করলো শক্তভাবে।অতঃপর হনহন করে টেনে নিয়ে চললো রুমের বাইরে।একবার পিছন ফিরে তাকালো নিহাদ,বিছানায় লুটায়িত তার টার্গেট।সঙ্গে সঙ্গে চারুলতার ধমক ধ্বনিত হলো তার কর্ণগুহরে,
– ডোন্ট ইউ ডেয়ার! অন্যথায়…আমি নিজে তোমাকে ক*বর দেবো নিহাদ!
দাঁত দিয়ে অধর কামড়ে ধরে নিঃশব্দে চারুলতাকে অনুসরণ করলো নিহাদ,তার বক্ষজুড়ে ভর করলো শূন্যতা।কিন্তু চারুলতার শক্ত মুঠোয় ধরে রাখা তার হাতখানির দৃশ্য সেই শূন্যতার মাঝেও অস্বাভাবিক এক অব্যক্ত অনুভূতির জাগরণ ঘটালো যেন।একদৃষ্টে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো নিহাদের টলটলে নয়নজোড়া।

সুউচ্চ হোটেলটির প্রেসিডেন্ট স্যুইটের টেরেস যথেষ্ট বিস্তৃত।হিম বাহুর প্রবাহের মাঝে রাত্রির আঁধারে আচ্ছাদিত ধরিত্রীর বুকে দন্ডায়মান মানুষটির অবয়বজুড়ে অদ্ভুত এক কাঠিন্য।হাতের মাঝে টকটকে বর্ণের ওয়াইনের গ্লাসখানি যেন উত্তেজক তরল নয়,বরং ধারণ করছে অশুভ র*ক্তকে।রেলিংয়ের উপর রাখা শুভ্র বর্ণের মা*থার খু*লিখানায় আনমনে বুলিয়ে চলেছে আঙুল,যেন স্নেহ খচিত করে দিচ্ছে।ঠিক পিছনেই একটি সোফা,যেখানে টানটান শিরদাঁড়ায় বসমান কালো স্যুট পরিধানকৃত….

– আকাশ?
ইতালীয় কণ্ঠের টানে বাংলা সম্বোধনটি ঠেকলো কিঞ্চিৎ অস্বস্তিকর।সামান্য নড়লো আকাশ। বাম চোখজুড়ে তার কালো আইপ্যাচে আচ্ছাদিত,দৃষ্টি হারিয়েছে সে এক পার্শ্বের দিশার।
– জ্বি আলফা।
পরিমিত কন্ঠে জবাব দিলো আকাশ। অধরে ওয়াইনের গ্লাস ছোঁয়ালেন আলফা,শরীরে জড়ানো স্লিপিং গাউন তার এলোমেলো হয়ে উড়ছে বায়ুতে।দীর্ঘ এক চুমুক গ্রহণ করে খু*লি*টিতে পোষা প্রাণীর ন্যায় স্নেহ বুলিয়ে গভীর কন্ঠে কৌতূহলী প্রশ্ন ছুঁড়লেন,

– কি চলছে এই দেশে?
– ন্যায়ের আন্দোলন।
জবাব এলো দুই সেকেন্ড বাদেই।মৃদু হাসির রেখার উদ্ভব ঘটলো আলফার অধরে,মাথা কাত করে পিছনে চাইলেন সামান্য,
– ন্যায়?ইন্টারেস্টিং!এই ন্যায়ের লড়াইকে আরো একটু বাঁধায় পূর্ণ করা যায়না?
এক মুহুর্ত থামলেন তিনি,পুনরায় ওয়াইনের গ্লাস ঠোঁটে তুলতে তুলতে বিস্তৃত আকাশের দিকে তাকালেন।আকাশ….আসমান?বাংলা ভাষায় এই শব্দ দুইটি যেন একে অপরের পরিপূরক।
– আই বেট হি উইল লাভ চ্যালেঞ্জেস সো মাচ!
হাসলেন আলফা, অর্ধচন্দ্রের জ্যোৎস্নার নিচে তা দেখালো অত্যন্ত ক্রুর।

অতর্কিতেই ঘটলো ঘটনাটি।টেবিলের একপাশে থাকা ফুলদানিটি আসমানের হাতের জোরালো স্পর্শে ধপাস করে পড়লো মেঝেতে।টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সিরামিক সম্পূর্ণ মেঝেজুড়ে।রোযা স্থবির হয়ে পড়লো,নিজের চেয়ারে একদম আষ্টেপৃষ্টে বসে রইলো।আসমানের দৃষ্টিজুড়ে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব আজ বহুদিন বাদে চোখে পড়েছে তার।এ যেন তার চির পরিচিত পিশাচ,ধ্বংস খেলায় মাততে যে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেনা।আনমনে ঢোক গিলে রোযা দৃষ্টি নমিত করে নিলো।ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছে সে।

মেঘতীর ভবনে কোম্পানির কাজ করার জন্য আলাদা অফিসকক্ষ রয়েছে। প্রয়োজনে বিলাল, আসমান এবং কদাচিৎ চারুলতা এই স্থান ব্যবহার করে।এই মুহূর্তে অফিসের টেবিলে বিপরীত পাশে অবস্থান আসমান এবং রোযার।টেবিলের উপর খোলা একটি ল্যাপটপ, যাতে অনির্বাণ আহমেদের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সাইট প্রদর্শিত হচ্ছে।ঘন্টাখানেক আগে একটি পোস্ট করেছে সে,যাতে তার অনুসারীর তুলনায় রীতিমত পাঁচ গুণ প্রতিক্রিয়া পড়েছে! টাইটেলে শোভিত,

“ সাম্প্রতিক বাংলাদেশ এবং নেমেসিস ”
– তুমি জানো তুমি কতটা অবিবেচক কাজ করেছ রোযা?
আসমানের কন্ঠ অত্যধিক শীতল শোনালো।এ যেন সেই হিমশীতল হিমালয়,যাকে টলাতে রোযার সর্বস্ব বিলীন করতে হয়েছিল।এক অদ্ভুত দোলাচলের দেয়াল তাদের মাঝে,নতুন করে উপলব্ধি করলো রোযা।আসমানকে জবাব দিতে পারলোনা,কারণ সে বুঝতে পারছে সে সত্যিই দোষী।
অনির্বাণ আহমেদের প্রস্তাবে রাজী হওয়া উচিত হয়নি।অন্তত আসমানের সঙ্গে কথা না বলে নয়।ব্যাপারটি সব হয়ে যাওয়ার পর উপলব্ধি করেছে রোযা।কিন্তু তখন তার কি করার ছিল?যদি সে অনির্বাণকে নিষেধ করতো তাহলে সেটি সাংবাদিক মহাশয়ের মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটাতো।ব্যাপারটি নিজ হাতে ঘোলাটে করেছে রোযা,এখন সেটি ঠিক করার দায়িত্বও তার।

– দুঃখিত।
ছোট্ট একটি শব্দ উচ্চারণ করলো সে।তাতে আসমান একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।টেবিলের উপর মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো তার হাতজোড়া।
– তুমি কি ভাবছিলে তখন?আমি জানতে চাই।
রোযা মুখ তুলে আসমানের দিকে তাকালো।স্থির চেয়ে আছে সে উত্তরের আশায়।তর্জনী টেবিলে ঠুকে ঠুকে এক অদ্ভুত তরঙ্গ খেলিয়ে চলেছে।দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করে নিজেকে স্থির করলো রোযা,যদি ভুল করেও তাকে স্বীকার করতে খেদ নেই।

– আমাদের চারিপাশে বহু উদাহরণ রয়েছে পাপ সম্পাদনের।কিন্তু পাপের প্রতিফলের উদাহরণ ঘাঁটতে গেলে অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে হয়।আমরা শুধু পাপের উপস্থাপন করি,শাস্তির নয়।
নিঃশব্দ আসমান,আঙুল তার থমকেছে।পিনপতন নীরবতা কক্ষজুড়ে। রোযা দৃপ্ত দৃষ্টি মেলালো তার কৃষ্ণগহ্বরে।
– অহনার সঙ্গে কি হয়েছে তা কমবেশি আমরা সকলেই জানি।ঠিক তেমনি শত সহস্র অহনার ঘটনাও জানা অজানার ভিড়ে চাপা পড়ে রয়েছে।কিন্তু সেই পাপীদের শেষ পরিণতি কজন জানে?মামলা দিয়ে গ্রেফতার হওয়া এবং দফায় দফায় শুনানি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ সবকিছু।এরপর নতুন হুজুগে মেতে উঠে জনতা,সময়ের ধূলোয় ঢাকা পড়ে যায় অতীতের আগ্রহ।

– গেট টু দ্যা পয়েন্ট।
– আমি সেই পাপীদের পরিণতি তুলে ধরতে চেয়েছি আসমান।সৃষ্টিকর্তা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।কোনো না কোনো রূপে তিনি পাপের শাস্তি প্রদান করেন,এই দুনিয়ায়ই।হয়ত সেই কারিগর একজন নেমেসিস,যে ক্ষমতার সামনে নতজানু নয়।সবাই জানুক,দেখুক এবং অনুধাবন করুক ক্ষমতার চাইতেও ক্ষমতাবান হওয়া সম্ভব,ছিনিয়ে আনা সম্ভব ন্যায়বিচার।নেমেসিস পারলে আমরাও পারবো।নেমেসিস তো একলা ছিল,কিন্তু আমরা অগণিত ঐক্য।শুধুমাত্র ভয়াল প্রতিচ্ছবি কেনো?পরিণতি সম্পর্কেও সকলের জানা উচিত,যেন পাপীরা সেই পাপকর্ম সংঘটিত করার আগে কয়েকশতবার ভাবে।
নৈঃশব্দ্য।শুধুমাত্র বাইরের হিমেল হাওয়ার ছোঁয়ায় জানালাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পর্দার মৃদু দোলন।

– তোমার কি আফসোস হয়?
প্রশ্নটি কর্ণগোচর হতেই রোযা সামান্য কম্পিত হলো।তারপর মাথা নাড়লো,
– আফসোস নেই।তবে অপরাধবোধ আছে।তোমার পরামর্শ নেয়া উচিত ছিল।
– এই সাংবাদিক যদি দুমুখো আচরণ করে কি করবে রোযা?
– আমি জানি আমি ভুল করেছি আসমান,এবং সেটা আমি যথার্থ অনুধাবনও করতে পারছি।
– পারছোনা।
ক্যাঁচ করে মৃদু শব্দ হলো।আসমান উঠে দাঁড়িয়েছে চেয়ার থেকে।পরিধানের ট্রাউজারের পকেটে একটি হাত গলিয়ে ধীরপায়ে সে ভাঙা ফুলদানি এড়িয়ে রোযার নিকটে এলো।সামান্য ঝুঁকে দৃষ্টি মেলালো।উভয়ের দৃষ্টি অদ্ভুত এক প্রজ্জ্বলন ধারণ করেছে।
– তুমি জানো চিত্রলেখা এবং মেঘ আমার হৃদয়ের কোন স্থানে রয়েছে।আমি ওদের নিয়ে টানাহেঁচড়া চাইনি রোযা।তোমার কি মনে হয়,আমি পারতাম না কোনোদিন নিজেকে সকলের সামনে জাহির করতে?অবশ্যই পারতাম।কিন্তু করিনি।

স্থির চেয়ে থাকলো রোযা।আসমান আরো একটু ঝুঁকলো,অতি সন্নিকটে।তার অবয়ব থেকে এক ক্রুর আবহ ভেসে আসছে।স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে রোযা,আসমান তার উপর রুষ্ট হয়েছে।এবং এই রুষ্টতা পূর্ববর্তী কোনো অনুভূতির সঙ্গে তুলনাহীন।আসমানের কন্ঠস্বর যেন রোযার কর্ণগুহরজুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো।
– আমার চিত্র এবং মেঘ জনগণের সম্পত্তি নয়,একান্তই আমার ব্যক্তিগত!মিথ্যা বলতে ইচ্ছুক নই, তুমি আমাকে ব্যথিত করেছ রোযা,হতাশ করেছ।

আসমান চিৎকার করছেনা,কোনোপ্রকার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও করছেনা।তার ক্রোধ হিমবাহের তুলনায়ও শীতল,সমুদ্রের চাইতেও সুগভীর।একটি অনুভূতিহীন বাক্যই যথেষ্ট—“তুমি আমাকে হতাশ করেছ”,রোযার অন্তর সহস্র ধা*রালো ফ*লায় বি*দ্ধ হলো। নয়নজুড়ে টলটলে রেখার প্রস্ফুটন ঘটলো,কিন্তু অশ্রু ফেলতে নারাজ সে।জানে ভুল করেছে,তার মাশুল তাকে গুণতেই হবে।মাথা নুইয়ে মেঝের দিকে চেয়ে থাকল রোযা,উভয় হাতে আঁকড়ে ধরলো কোলের উপর ছড়িয়ে থাকা ওড়নার আঁচল।

– আমি তোমাকে….কষ্ট দিতে চাইনি আসমান!আর না চেয়েছি চিত্রলেখা এবং মেঘকে হেয় করতে,আমি….
বলতে পারলোনা রোযা।কন্ঠ ধরে এলো।না চাইতেও একফোঁটা অশ্রু টপ করে পড়লো তার হাতের পিঠে।অতি দ্রুত তা ঢেকে ফেলল সে অপর হাতে।আসমান আর একটিও শব্দ উচ্চারণ করলোনা। উল্টো ঘুরল তৎক্ষণাৎ, অফিসকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো।তার এই নীরবতাই সকল অনুভূতি যেন ঘোষণা করে দিয়ে গেলো রোযার নিকট।আসমান চলে যেতেই মাথা চেপে ধরে বসে থাকলো রোযা।সকল দুর্বিষহ চিন্তারা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।কি ভাবছিলো সে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়?

চিত্রলেখা এবং অহনা যেন একটি মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।উভয়ের পরিণতি এক,কিন্তু সেই পরিণতির প্রতিফল ভিন্ন। চিত্রলেখার তরে নিজেকে ধ্বংস করেছে আসমান,আর অহনার তরে এখনো হাল না ছেড়ে সংগ্রাম করে চলেছে নিঃস্বার্থ ন্যায়ের সৈনিকগণ।চিত্রলেখা ন্যায়বিচার পেয়েছে বলা সম্ভব নয়,তবে তার হ*ত্যাকা*রীরা যথাযথ প্রতিদান পেয়েছে। অহনার প্রতিশোধ আদায়ের কেউ নেই, আবার যেন অনেকে রয়েছে।প্রতিদান নয়,সুষ্ঠু এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই অহনার জন্য।মেল পার্থক্যের ভিড়ে চিত্রলেখা এবং অহনা যেন এক সুতোর বাঁধনে গাঁথা দুই সত্তা।একজন নির্মল,অপরজন দুঃসাহসী।তথাপি তাদের সমাপ্তি এক।তাই হয়ত অহনার মাঝে চিত্রলেখাকে খুঁজে ফিরেছিল রোযা,কিংবা চিত্রলেখার মাঝে অহনাকে।দুই সত্তার পরিপূর্ণ মিলন ঘটাতে চেয়েছিল।তার জন্যই কি এত ব্যাতিব্যাস্ত সিদ্ধান্ত?রোযা বর্তমানে নিজেও দ্বিধান্বিত।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর রোযা রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে ডাইন ইন এরিয়ায় এলো।শুধুমাত্র বিলাল রেমানকে টেবিলে অপেক্ষারত আবিষ্কার করে চমকালো।তবুও কিছু না বলে চেয়ার টেনে বসলো।বিলাল নিজেই তাকে খাবার বেড়ে দিলেন।ময়দার রুটি মুখে পুরে নিঃশব্দ থাকলো রোযা,আনমনে তাকালো পাশের খালি চেয়ারটিতে।বিলাল মৃদু হাসলেন,
– ঝগড়া হয়েছে বুঝি?
থমকে গেলো রোযা। সত্যি বলতে আর কেউ করুক বা না করুক, আসমান বাড়িতে থাকলে সর্বদা খাবারের টেবিলে রোযার অপেক্ষা করে,কিন্তু আজ সে নেই।
– আমি অবাক হয়েছিলাম যখন এসে কোনোমতে একটি রুটি খেয়েই চলে গেলো।জিজ্ঞেস করেছি, বলেছে কিছুই হয়নি।কিন্তু বাবার মন সবই বুঝতে পারে।

– আমি দুঃখিত বাবা!
ভগ্ন কন্ঠে জানালো রোযা,তার হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো রুটির টুকরোসমেত।বিলাল নিকটে সরে রোযার পাশে বসলেন,হাতখানি ছাড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– ইটস ওকে বেইবি।মানুষমাত্রই ভুল করে,নিজের ভুল স্বীকার করে শুধরে নেয়াটাই অর্থবহ।
– আপনিও কি রাগ করেছেন বাবা?

– একদম না মামণি।বাবা কখনো সন্তানদের উপর রাগ করে থাকতে পারেনা।আমি বুঝতে পারছি তুমি কি করেছ এবং কেনো করেছ।ছোট্ট একটা মানুষ তুমি, অভিজ্ঞতাও কম।তবুও তোমার কাঁধে বর্তমানে একটি গোটা প্রজন্মের দায়িত্ব।তোমার ব্যাতিব্যস্ত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
রোযার কি হলো বলতে পারবেনা,বিলাল রেমানের বুকে মাথা ঠেকালো।এক হাতে তাকে আগলে নিয়ে স্নেহ বুলিয়ে পিতৃতুল্য মানুষটি তাকে শান্ত্বনা দিলো, যেন বটবৃক্ষ তিনি,আপন ছায়াতলে সুশীতল আশ্রয় দেন সন্তানদের।
– চিন্তা করোনা।সব ঠিক হয়ে যাবে।না হলেও সমস্যা নেই,আমি আছি কি করতে?তোমার কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে,আমি দেখব সবকিছু। আর আসমান….ওকে কিছুটা সময় দাও।দেখলে বোঝা যায়না কিন্তু ছেলেটা আমার ভীষন সেনসিটিভ।আমি ওর সঙ্গে কথা বলবো,ঠিক আছে?

– ধন্যবাদ বাবা।
এটুকুই উচ্চারণ সম্ভব হলো রোযার পক্ষে। খাওয়ার রুচি না থাকলেও বিলাল রেমানের জোরাজুরিতে সবটা শেষ করতে হলো তাকে।সবশেষে শুভরাত্রি জানিয়ে রোযা বেডরুমের দিকে এগোলো।ভেতরে ঢুকেই আরেক দফায় তাকে ব্যথিত হতে হলো।

আসমান এবং সে বিয়ের পর থেকে এক কক্ষেই থাকে।নিজেদের সঙ্গে অভ্যস্থ হতে কিছুটা সময় প্রয়োজন হয়েছিল বৈকি,তবে তারা ইতোমধ্যে মানিয়ে নিয়েছে।বর্তমানে একে অপরের অস্তিত্ব ব্যাতিত অসম্পূর্ণ মনে হয় সবকিছু।এমনিতে অধিকাংশ সময়ে আসমানের বাহুডোরে নিদ্রাজগতে বিচরণ করলেও আজ তা সম্ভব নয়।আসমান সাধারণত রোযার পরে ঘুমিয়ে অভ্যস্থ,কিন্তু আজ সে বিছানার একপাশে ইতোমধ্যে শুয়ে আছে।রোযা পিছন থেকে শুধুমাত্র তার পিঠ অবলোকন করতে পারছে,আর কিছু নয়।একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো রোযার বুক থেকে। আস্তে করে সে উঠলো বিছানায়।আসমান ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা জানা নেই,তবুও সাবধান থাকলো।

নিজের হাঁটু গুটিয়ে জড়িয়ে ধরলো,মাথা গুঁজে নিঃশব্দে বসে থাকলো দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত।তারপর পাশ ফিরে আসমানকে দেখতে লাগলো।নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে ধীরলয়ে স্পন্দিত হচ্ছে তার শরীর,এর বেশি তেমন কোনো নড়চড় নেই।খুব ইচ্ছা হলো রোযার প্রতিদিনকার মতন তার বুকে মাথা রাখতে।কিন্তু নিজেকে আটকাতে হলো।অভিমান করেছে আসমান, টলানো কি এতই সহজ?

সামান্য ঝুকলো রোযা,ওপাশে আসমানের মুখখানা অবলোকন করলো নিগূঢ় দৃষ্টিতে।মাস্ক নেই মুখে,তাতে বিভীষিকা স্পষ্ট।তবে তা যেন তার আপন বৈশিষ্ট্য, বিন্দুমাত্র অদ্ভুত ঠেকছেনা। নেত্রপল্লব বন্ধ,মুখ প্রশান্ত, কোনোপ্রকার অনুভূতির আবহ নেই।আনমনে নিজের আঙ্গুল বুলিয়ে তার ললাটে ছড়িয়ে থাকা মসৃণ কেশগুচ্ছ গুছিয়ে দিলো রোযা,অতঃপর নুয়ে নিজের অধর স্পর্শ করলো।টলটল করে উঠলো আঁখি,অত্যন্ত ক্ষীণ কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
– আমায় ক্ষমা করো চাঁদ,খুব বেশিক্ষণ অভিমান করে থেকোনা।কষ্ট হচ্ছে,প্রচণ্ড কষ্ট।
কন্ঠ মিইয়ে এলো, শব্দসমূহ দলা পাকিয়ে গেলো।রোযা সরে গেলো,কম্বল টেনে আসমানকে যথাযথভাবে ঢেকে দিয়ে উল্টোপাশে আস্তে করে শুয়ে পড়লো।চোখ বুজলো।তার দৃষ্টি যা অবলোকনে সক্ষম হলোনা, তা হলো অপরপাশের বিছানার চাদরজুড়ে চেপে বসা আসমানের মুষ্টিবদ্ধ হাত।

ক্লাবের বাইরে বাইকের নিকটে পৌঁছতেই অতর্কিতে চারুলতার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো নিহাদ।অতঃপর সামান্য ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলে বসলো,
– হোয়াই আর ইউ ডুইং দিস?
থমকালো চারু,সটান ঘুরলো পিছনে।বক্ষে দুবাহু ভাঁজ করে রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মোকাবেলা করলো নিহাদকে।
– একই প্রশ্ন আমি তোমাকে করতে পারি।
নীরব নিহাদ,দৃষ্টি ফিরিয়ে দূরপানে চাইলো। চারুলতা তাদের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনলো,উচ্চতায় নিহাদ তার তুলনায় কিছুটা লম্বা,তাই মুখ ঊর্ধ্বপানে তুলে মুখোমুখি হলো সুদর্শন চেহারাজুড়ে খচিত অব্যক্ত অনুভূতির।সর্বদা পরিপাটি থাকা নিহাদের চেহারায় মলিনতার ছাপ,যেন অতি অযত্নে রেখেছে সে নিজেকে।চিবুকের চারিপাশে সামান্য খোঁচা খোঁচা দাড়ি জন্মেছে,কানে রাখা দুলখানিও উধাও।চুলের অবস্থা বড়ই নাজুক,উষ্কখুষ্ক হয়ে রয়েছে যেন কতদিন আচর পড়েনি।কোনকিছুই নিহাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য নয়,সে সর্বদা নিজেকে কিছুটা অভিনবভাবে সজ্জিত করতে পছন্দ করে।

– অহনার জন্য কি তোমার মনে অনুভূতি জন্মেছিল?
সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটি সবথেকে অপ্রত্যাশিত মানুষটির কন্ঠে উচ্চারিত হতে শুনে নিহাদ স্থবির হয়ে পড়লো।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল,যেন অবুঝ শিশু সে। চারুলতার মাঝে কোনো দ্বিধা নেই,একদম স্থির এবং প্রশান্ত সে।
– না।
একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করলো নিহাদ,তাতে চারুর বিস্তৃত অধরজুড়ে মায়াবী এক হাসি খেলে গেলো।পাশের লাইটপোস্টের মৃদু নিয়ন আভা তার চেহারায় প্রতিফলিত হলো,এক স্বর্গীয় দ্যুতি ছড়িয়ে।ঘন দীর্ঘ কেশরাশি কাঁধে ছড়িয়ে নীলচে মায়ায় চিকচিক করে গেলো।উত্তর করেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার মনোবাসনা থাকতেও নিহাদ পারলোনা,অবাধ্য নয়ন তার অবলোকন করে গেলো।সম্পূর্ণ হতবিহ্বল হয়ে সে যেন প্রথমবারের ন্যায় আবিষ্কার করলো,চারুলতা সত্যিই সুন্দর!
– নিজের কাছ থেকে কি পালানো যায় নিহাদ?
সম্মোহন কাটলো যেন রমণীর কথায়,তৎক্ষণাৎ নয়ন জোরপূর্বক দৃষ্টিপাত ঘটালো সুদূরে।হাতের হেলমেটে আনমনে চেপে বসলো আঙুলসমূহ।
– এসবের উদ্দেশ্য কি তবে?অহনার জন্য প্রতিশোধ না হয়ে থাকলে…
– জাস্ট শাট আপ!

কি হলো নিহাদ বলতেও পারবেনা,অদ্ভুত দোলাচলে চারুলতার কাঁধে চেপে বসলো তার বলিষ্ঠ হাতখানি, প্রচণ্ড চাপে ভ্রু কুঞ্চিত হলো মেয়েটির,তবুও টললোনা।বরং মোকাবেলা করলো সাহসী হয়ে।
– কি লাভ আড়ালে আবডালে শাস্তি দিয়ে?দৃষ্টিগোচর হলো কি তা? এটা কি আদও ন্যায়বিচার?
কন্ঠে প্রত্যয় ঝরে পড়ল চারুলতার।নিহাদের আরো একটু নিকটবর্তী হলো সে।অনুভব করলো কাঁধে ছেলেটির হাতের বাঁধন আরো একটু শক্ত হয়েছে, রীতিমত বেদনাদায়ক এক পর্যায়ে।তবুও স্থির হয়ে চারু জানালো,
– নিজেকে দ্বিতীয় আসমান প্রমাণ করতে চাইছো?

বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেলো নিহাদের অভিব্যক্তি,এক ঝটকায় চারুলতাকে দূরে ঠেললো।খানিক জোর পরে গেলো,পাশের বাইকের সঙ্গে ধাক্কা লাগলো তার, সামান্য অস্ফুট স্বর ফুটলো যন্ত্রণার।কোমরে ধাতব চাপে আঘা*ত পেয়েছে চারু।দৃষ্টিতে বেদনাটুকু প্রকাশ পেতেই নিহাদ থমকালো,হাত গুটিয়ে নিল অতি দ্রুত, এগোতে চাইলো,কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দ তাকে স্থির রাখলো।জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ করলো যেন হৃদয়কে।
– আসমান ভাই একক অস্তিত্ব।তার সঙ্গে কারো তুলনা করার মতন অনর্থক কাজ বড়ই হাস্যকর।
সোজা হয়ে দাঁড়ালো চারুলতা,কয়েক পলক চেয়ে থেকে বললো,
– তবে ন্যায়বিচার হতে দাও।
নিশ্চুপ নিহাদ।

– ছেলেমেয়েগুলো রাজপথে সংগ্রাম করছে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের জন্য।রাতের আঁধারে তাদের সংগ্রামকে অহেতুক করে তুলে আপন প্রতিশোধবাসনা মেটানোর অধিকার তোমার নেই নিহাদ।
অন্তরমাঝে কেমন যেন ঘূর্ণিপাক খেলো গেলো নিহাদের,তাকালো সামনের মানুষটির দিকে,গভীর এক মনোযোগী দৃষ্টিতে।এই মেয়েটি,যার সঙ্গে কোনোদিন ঝগড়া ব্যতিত দু দণ্ড ভালো করে কথোপকথন করেছে কিনা স্মরণে আসছেনা,সেই মেয়েটিই আজ এমন বিজ্ঞের মতন প্রশান্তি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে?যে মুহূর্তে নিহাদ তাকে ধাক্কা দিয়েছিল, ওই মুহূর্তেই তার উচিত ছিল নিজের পরিধানের তিন ইঞ্চির হিলজোড়া নিয়ে তেড়ে আসা, ঠাটিয়ে দুটো পিঠের উপর দেয়া।কিন্তু চারুলতা তা করেনি।এই মেয়েটি যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কেউ,চিরায়ত সেই ললনা নয়, যার সৌন্দর্য্য অগ্নির ন্যায় দৃশ্যমান, চরিত্র বাঘিনীর ন্যায় তেজস্বী।প্রশান্তির মূর্ত প্রতীক যেন সে বর্তমানে,যার অঙ্গজুড়ে শুধুই শীতল শান্তির ছোঁয়া।

– এটাই কি আমাকে অনুসরণ করার কারণ?
জিজ্ঞেস করে বসলো নিহাদ।তাতে চারুলতা সামান্য হাসলো,দুহাত পিছনে বেঁধে জানালো,
– আবেগ দিয়ে নয়,মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবার সময় এটি।তুমি যে ধ্বংস খেলায় মেতেছ তাতে হয়ত অপরাধীরা শাস্তি পাবে,কিন্তু কোনো দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হবেনা।অহনার ঘটনাটি বর্তমানে ব্যক্তিগত পর্যায়ে থমকে নেই,তার তরে রাস্তায় নেমেছে তারই ভাইবোনেরা। আরো কতশত অহনারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই শহরে,তাদেরও উপলব্ধি করতে দাও, ন্যায়বিচার ছিনিয়ে আনা সম্ভব!অপরাধীদের যথোপযুক্ত শাস্তি হওয়া সম্ভব!
সম্পূর্ণ স্থির চেয়ে থাকল নিহাদ, চারুলতা এগোলো পায়ে পায়ে,একদম সামনে এসে থামলো।উভয়ের মাঝে বর্তমানে ব্যবধান মাত্র ইঞ্চিখানেকের।নিজের একটি হাত তুললো চারুলতা,নিহাদ দেখলো তা কম্পিত হচ্ছে।তবুও সেটি ছুঁয়ে গেলো তার কপোল, আলতো আঁচে বুলিয়ে আনলো চিবুক পর্যন্ত।যেন কোনো উন্মাদ পশুকে স্নেহের স্নিগ্ধতায় বশীকরণ করছে এক রমণী।

– তুমি আর কে বি গ্রুপের হিটম্যান নও।বর্তমানে যা হচ্ছে তা অতি ব্যাপক এক ঘটনা, যার মাঝে জড়িয়ে তুমি অচিরেই নিঃশেষ হতে পারো।রাঘব বোয়ালরা কোথায় ঘাপটি দিয়ে আছে আমরা কেউ আন্দাজও করতে পারছিনা।বুঝে ওঠার আগেই গ্রাস করে নেবে তোমাকে।কে বি গ্রুপ নেই ক্ষমতার দাপটে তোমাকে রক্ষার জন্য, রেমান আছে।কিন্তু নেতৃত্ববিরোধী শক্তি আমরা,ভুলে যেওনা।
– তুমি কি আমার জন্য চিন্তিত নাকি মেয়ে?
তীর্যক হাসি ফুটলো নিহাদের ওষ্ঠে,চেহারায় ফিরে এলো সেই পুরোনো অতি পরিচিত দুষ্টুমির ঝলক।একটি ভ্রু উঁচু করে সে এমন এক গভীর দৃষ্টিতে চারুলতার দিকে চাইলো যে নিয়ন্ত্রিত মেয়েটিরও কপোলজুড়ে লালিমা ছেয়ে গেলো।অতি দ্রুত নিহাদের কপোল থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিতে চাইলো চারু, সম্ভব হলোনা।গ্লাভস পরিহিত ছেলেটির হাত চেপে ফেললো তার স্পর্শকে,যেন স্পর্শহীন হতে নারাজ সে।
– কিপ ড্রিমিং!তুমি অসভ্যের মতন কাজগুলো করে নিজেকে আর আমাদের সবাইকে বিপদে ফেলতে যাচ্ছিলে,তাই বাঁধা দিয়েছি।আকাশকুসুম কল্পনা বাদ দাও।

– সত্যিই তাই….রাক্ষসী?
নিহাদের সম্বোধনের মাঝে কোনো কটূক্তি পাওয়া গেলোনা,বরং তা এতটাই আবেশিত শোনালো যে চারুর শিরদাঁড়া বেয়ে তরঙ্গ খেলে গেলো একদম পায়ের তালু পর্যন্ত।নিজের এমন অনিয়ন্ত্রিত মনোভাব সহ্য হলোনা তার।জোরপূর্বক আমতা আমতা কন্ঠে বলতে থাকলো,
– আমি রাক্ষসী হলে তুমি একটা রাক্ষস!
– বিয়ে করার এত তাড়া? অপমানটুকুও জোড়ায় জোড়ায় করছো।
– ছিঃ!বিয়ে?তাও তোমাকে? কচুগাছে ফাঁ*সি খাবো তার আগে!

– অত কষ্ট করতে হবেনা।আমার বাইকের ট্যাঙ্কে পেট্রোল আছে,খানিকটা গলায় ঢেলে দেবো?
চারুলতা এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ল যে তার কন্ঠ থেকে আর কোনো শব্দই নির্গত হলোনা।নাকের পাটা ফুলিয়ে সে চেয়ে থাকলো ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে।নিহাদ ঝুকলো,তর্জনী চারুলতার নাকের অগ্রভাগে ছুঁইয়ে বিস্তৃত হেসে বললো,
– নাকের ডগায় খালি রাগ,তোমার জামাইয়ের কপালে দুঃখ আছে!তার জন্য এক টাইটানিকসম সমবেদনা আমার পক্ষ থেকে।
অভূতপূর্ব কাজটি চারুলতাকে সম্পূর্ণ জমিয়ে দিলো, একদৃষ্টে সে চেয়ে থাকলো নিহাদের উদ্দেশ্যে।এই ছেলে যেন এক গিরগিটি, ক্ষণে ক্ষণে তার রং বদলায়।কিছুক্ষণ আগেও যাকে অনুভূত হচ্ছিল অশুভ শক্তির ন্যায়,তাকেই বর্তমানে ঠেকছে এক উচ্ছল সত্তা।সহ্য করা সম্ভবপর হলোনা এই নব্য অনুভূতির তোড়।

– আউচ!
চারুলতার পায়ের জোর চাপে সশব্দে চেঁচিয়ে দূরে সরে গেলো নিহাদ,নিজের বাম পা খানি চেপে তাকালো সামনে,
– কূটনী মেয়েমানুষ!
– বেহায়া পুরুষমানুষ!

ক্রোধ দেখালো নিহাদ,হনহন করে হেঁটে নিজের বাইকে চেপে বসলো।হেলমেট চড়িয়ে স্টার্ট দিলো ইঞ্জিন,তার এক নজর চারুকে মুখ ভেংচে দ্রুতগতিতে চালিয়ে আড়াল হলো দৃষ্টিসীমার। চারুলতা দাঁড়িয়ে থাকলো মুহূর্তকয়েক।তারপর হাঁটতে হাঁটতে এগোলো সড়কের দিকে, ফোনে সময় দেখলো রাত বারোটা বেজে তিপ্পান্ন মিনিট।বিলাল রেমান আর আসমান জানে সে আদতে ফারিয়ার বাসায় রয়েছে আজ,তাই কোনো ফোন কিংবা মেসেজ আসেনি।নিহাদকে গাড়ি নিয়ে অনুসরণ করা কঠিন ছিল,এই বান্দা যে ধুরন্ধর সহজেই সব উপলব্ধি করতো।এখন ভিন্ন উপায়ে ফিরতে হবে।ফারিয়াকে কল করবে কি?আসবে অবশ্যই,কিন্তু পৌঁছাতে সময় লাগবে।নাকি ক্যাব ধরে নেবে?তাই করা যাক।ভেবে অ্যাপ বের করতে করতেই নির্জন সড়কে তার সামনে এসে থামলো বাইক।চিনতে একটুও অসুবিধা হলোনা চারুলতার আরোহীকে,মাত্র মিনিট পাঁচেক আগেই তো গেলো।তার অস্তিত্বের সুবাস যেন এখনো মনে রয়েছে চারুর।

একটি হেলমেট তার দিকে ছুঁড়ে দিলো নিহাদ।বললো,
– পিছনে উঠুন নাগরাণী,দেখবেন আবার ফনা তুলে ছোবল দেবেন না।রাস্তায় ফেলে দেবো কিন্তু একদম!
প্রথমবার নিহাদের অপমানজনক কথার পাল্টা প্রতিউত্তর না করে চারুলতা হাসলো,তার খিলখিলে আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হলো যেন শীতল বায়ুর ভাঁজে ভাঁজে।অপলক চেয়ে থাকল নিহাদ,চারুলতা তার বাইকের পিছনের সিটে চেপে বসলো,জড়িয়ে ধরলো শক্তভাবে।
অতঃপর কেউই কোনোপ্রকার কথা বললোনা।নিহাদের বাইক চালু হলো,শহুরে বাতির ভিড়ে সড়কধরে ছুটে গেলো আপন দ্রুতিতে।গতি যত বাড়লো, চারুলতার হাতের বাঁধন নিহাদের অবয়বের চারিপাশে তত চেপে বসলো।

টেবিলের অপরপ্রান্তে বসে থাকা ম্যানেজারদের কোনো বাক্যই আসমানের কর্ণগোচর হচ্ছেনা।আপন চিন্তায় নিমজ্জিত তার মস্তিষ্ক।
– আমার মনে হয় আমাদের দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত স্যার।
– প্রথমে শুল্ক,এবারে ভূমিকর।গভর্নমেন্ট কি চাইছে আসলে?
– আমাদের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলার পরিকল্পনা সবকিছু।
– দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা না নিলে…. স্যার?
– স্যার?
– হুম?
আচমকা বাস্তব দুনিয়ায় পদার্পণ করে আসমান খানিক দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো। ম্যানেজারগণ কিঞ্চিৎ অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
– আপনি বোধ হয় অসুস্থ স্যার।এই মিটিংটা কি আমরা পরে করবো?
– অন্যমনস্কতা কাজের প্রতি ভালো লক্ষণ নয় স্যার।
আসমান মাথা হেলালো,

– আমি দুঃখিত।সবকিছুই আমি শুনেছি,কিছুটা ভাবার সময় দিন,সিদ্ধান্ত আপনাদের জানাবো। আপনারা আপাতত যেতে পারেন।ধন্যবাদ।
ম্যানেজার দুজন উঠে পড়ল,সম্মান জানিয়ে হেঁটে অফিসকেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।শূন্যতায় পরিপূর্ণ হয়ে আসমান সহসাই হেলান দিলো চেয়ারে,এক আঙ্গুল মাস্ক নামিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপর তাকিয়ে থাকলো সুউচ্চ সিলিংয়ের দিকে।একই ভঙ্গিতে ঠিক কতক্ষন সে চেয়ে ছিল জ্ঞানে নেই, ফোন ভাইব্রেট করতেই মনোযোগ সরলো।রিসিভ করলো, যথারীতি নিজে থেকে কথা বললোনা।ওপাশের ব্যক্তি জানালো,
– অনির্বাণ আহমেদ সম্পর্কে সকলকিছু যাচাই বাছাই হয়েছে।আপাতত সব ঠিকঠাক চলছে।তবে,বান্দা যথেষ্ট চতুর।বিস্তারিত জানতে এবং গোপন তথ্যগুলো উদ্ধার করতে আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন।

উত্তর করলোনা আসমান,তার প্রয়োজন নেই।ফোন কেটে আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপর উঠে পড়লো, ক্রপস্যুটখানি জ্বালাতন করছে, হাসফাঁস লাগছে নিজেকে।তাই সেটা খুলে ফেলে পরিধানের ইন্ডিগো বর্ণের শার্টখানির উপরের কয়েকটি বোতাম উন্মুক্ত করলো।ধীরপায়ে হেঁটে বেরোলো কোম্পানি বিল্ডিং থেকে।বাহিরে গাড়ি অপেক্ষমাণ।নিজে ড্রাইভ করার ইচ্ছা হচ্ছেনা।তাই চেপে বসলো তার ভেতরে।

– বাসায় যাবো স্যার?
এক মুহুর্ত সময় নিলো আসমান উত্তর করতে।
– উহুম,দোয়েল চত্বরের দিকে চলুন।
– ওদিকে তো আজকে আন্দোলন হচ্ছে।
এবার জবাব দিলোনা আসমান, অভিজ্ঞ ড্রাইভারও পুনরায় জিজ্ঞেস করলোনা।গাড়ি এগোলো।জানালা দিয়ে বাইরের গোধূলী লগ্নের দিগন্তের পানে চেয়ে থাকলো আসমান।অদ্ভুতভাবে আজ সম্পূর্ণ গগন ছেয়ে রয়েছে টকটকে এক হলুদাভ বর্ণে।দৃশ্যটি সুন্দর, আবার একইসঙ্গে খানিক আশঙ্কা জাগানিয়া।যেন অসীম আকাশজুড়ে র*ক্তের স্রোত খেলে চলেছে।

“ উল্টোপাল্টা ভাবছিস!”—
নিজেকেই নিজে শুধরে নিলো আসমানের অন্তর।মনোযোগ দিল শুধুমাত্র সৌন্দর্য্য অবলোকনে।মধ্যিখানে সিগন্যালে থামলো গাড়ি।চারিপাশে তাকিয়ে ফুটপাতের উপর নজরে পড়ল মাঝারি আকৃতির এক ফুলের দোকান।কি যেন ভাবলো চকিতে।
– আমি একটু আসছি,অপেক্ষা করুন।

ড্রাইভারকে বলেই দ্রুত দরজা খুলে বেরোলো আসমান।বাহনের ফাঁকফোকর গলে পৌঁছে গেলো দোকানের কাছে। দোকানী অপর একজনের ডালিয়ার বুকে তৈরি করতে ব্যাস্ত।ঝুড়িতে ঝুড়িতে সজ্জিত অন্যন্য পুষ্পরাজি অবলোকন করে গেলো আসমান অতি গভীর মনোযোগে।শেষ কবে এমনভাবে ফুলের দিকে তাকিয়েছিল স্মরণ করতে পারলোনা।ফুল নামক বস্তুটি কোনোকালেই তার প্রিয় ছিলনা,ছিলনা অপছন্দের তালিকায়ও।একপ্রকার অনুভূতিশূন্য।কিন্তু আজ অবাধ্য অন্তরে এক তীব্র বাসনা জাগ্রত হয়েছে।কাউকে এক গুচ্ছ ফুল উপহার দেয়ার।
অবশেষে শুভ্ররঙা গোলাপে আবদ্ধ হলো আসমানের দৃষ্টি।খুব বেশি নেই,গুণে গুণে সাতটি।শুভ্র গোলাপ শুদ্ধতার প্রতীক,বিষয়টি সম্পর্কে অবগত সে।একটি টকটকে লাল গোলাপ তুলে নিয়ে দোকানির দিকে ফিরল,

– সবগুলো সাদা আর এটা দিয়ে একটি বুকে তৈরি করে দিন।
– শুধুমাত্র একটা লাল?
– হুম,একটাই লাল।
– সাত ভাই চম্পা গিফট দিবেন নাকি ভাবীকে ভাইজান?
সামান্য হাসলো আসমান,দোকানিও বিস্তর হেসে সুন্দর একটি বুকে তৈরী করে দিলো। দাম মিটিয়ে সিগন্যাল ছাড়ার পূর্বেই গাড়িতে পৌঁছালো আসমান।দোয়েল চত্বরের নিকটে বিশাল জ্যামে আটকাতে হলো। অপর কিছু বাহন আবার ঘুরে উল্টোপথ ধরেছে।ড্রাইভার পার্শ্ববর্তী এক বাইক আরোহীকে প্রশ্ন করলো,

– এত বড় জ্যাম কেনো?
– জানিনা।শুনেছি ওদিকে আন্দোলনে কোনো ঝামেলা হয়েছে।
স্পষ্ট শুনতে পেলো আসমান,অনুভব করলো তার হৃদযন্ত্রজুড়ে এক তড়িৎ খেলে গিয়েছে।সময় ব্যয় না করে দ্রুত বাইরে নামলো।ড্রাইভার শুধালো,
– স্যার আপনি…
– ফিরে যান।ভিন্ন পথে পৌঁছান দ্রুত।আমি হেঁটেই যাচ্ছি।

হাঁটার কথা বললেও আসমান ফুটপাথ ধরে রীতিমত ছুটতে আরম্ভ করলো।আশেপাশের মানুষজন এমন ভঙ্গিতে কাউকে ছুটতে লক্ষ্য করে বিস্মিত হলো বটে। যত নিকটে পৌঁছলো,ততই পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে ঠেকলো আসমানের।সঙ্গে প্রচণ্ড এক কোলাহল।দোয়েল চত্বরের কিছুই দৃশ্যমান নয়,শুধুমাত্র ধোঁয়াশা।পুলিশের গাড়ির তীব্র সাইরেন,তার সঙ্গে মানুষের ছোটাছুটি,আর্তনাদ।
ঠাস!
চাপা শব্দটিও তার উত্তেজিত ইন্দ্রিয়কে এড়াতে সক্ষম হলোনা।মোচড় দিয়ে উঠলো বুক,দপদপ করে উঠলো মস্তিষ্ক।গু*লি*র শব্দ!চিনতে কোনো ভুল নেই!

যেখানে সকলে ছুটে পালাতে ব্যাস্ত,সেখানে আসমান সোজা পৌঁছলো সম্পূর্ণ ধোঁয়াটে দেয়ালে ঘেরা স্থানের কেন্দ্রবিন্দুতে।দাউদাউ করে টায়ার জ্ব*লছে।তার ঠিক পাশেই ছড়িয়ে রয়েছে… এক খাবলা থক*থকে র*ক্ত!শিহরণ খেলে গেল আসমানের সর্বাঙ্গজুড়ে।প্রচণ্ড ভূকম্পনে যেন কাপলো তার অস্তিত্ব।এক লহমায় দৃষ্টিতে ভর করলো শূন্যতা।প্রচণ্ড উদ্ভ্রান্ত হয়ে চারিপাশে চাইলো,গুটিকতক ছেলেমেয়ে ছুটে যাচ্ছে, তাদের পিছনে পিছনে লা*ঠিসোটা বাহিনী।একজনের হাতে স্পষ্ট পি*স্ত*ল দৃষ্টিগোচর হলো,একপাশের গলির অভ্যন্তরে আড়াল হলো সে।
দন্ডায়মান আসমান গোত্তা খেল বারংবার,তবুও থামলোনা।পুলিশের টিয়ারশেল গ্যাসের প্রভাব রয়েছে, জ্বালা ধরেছে চোখেমুখে।থামা অসম্ভব!

“ রোযা…রোযা….প্লীজ রোযা…প্লীজ জ্যোৎস্না ”
যেন জপতে থাকলো তার দূর্বার অন্তর। নেই।এই ভিড়ের মাঝে কুরুক্ষেত্রের কোথাও নেই তার জ্যোৎস্নার অস্তিত্ব।এক অসহনীয় যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠলো অভ্যন্তর,স্থবির হলো পদক্ষেপ। সামনের সড়ক বন্ধ,ব্যারিকেড তুলে দেয়া পুলিশের।ঠিক এপাশেই ছড়ানো ছিটানো র*ক্তা*ক্ত কয়েকটি প্ল্যাকার্ড!যার সঙ্গে জড়িয়ে একটি সবুজাভ স্কার্ফ।সবুজের মাঝে টকটকে র*ক্তবিন্দুর ফোঁটা,ঠিক যেন দেশের পতাকার এক ঠুনকো প্রতিচ্ছবি।কিছুদিন আগেও ক্লোজেটের রোযার কাপড়ের অংশে স্কার্ফটির অস্তিত্ব এখনো আসমানের স্মৃতিতে তাজা।

হাতের ফুলের গুচ্ছ সড়কে পতিত হলো,মুহূর্তেই মলিন হলো তা ধুলোয়।হাঁটু ভেঙে এলো, ধপ করে ভূমিতে বসে পড়ল আসমান, শূণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো দাউদাউ করে প্রজ্জ্বলিত অ*গ্নি*র দিকে,তার পাশেই র*ক্তভেজা অঙ্গনজুড়ে সবুজাভ স্কার্ফ।সম্পূর্ণ দৃশ্যটি প্রতিফলিত হলো তার কৃষ্ণগহ্বরজুড়ে,থামিয়ে দিলো তার হৃদস্পন্দনকে।
– ডোন্ট…. লিভ মি….

ডার্কসাইড পর্ব ৪৬

অস্ফুট উচ্চারণ ঘটলো আসমানের অধরজুড়ে,একটি প্রায় অদৃশ্যমান অশ্রুফোঁটা গড়ালো ধোঁয়ায় কালিজড়ানো কপোল বেয়ে। পরে রইলো তার প্রেয়সীর তরে আনা ফুলের গুচ্ছ,র*ক্তা*ক্ত স্কার্ফের সম্মুখে যা সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

ডার্কসাইড পর্ব ৪৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here