ডার্কসাইড পর্ব ৪৮
জাবিন ফোরকান
ঘন্টাখানেক পূর্বে দোয়েল চত্বর:
অনির্বাণকে পানির বোতল দিয়ে কোমরে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাবিহা।ছেলেটি এক হাঁটু মুড়ে সড়কে বসেই কিছুটা পানি পান করলো,অতঃপর বোতলটি তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করলো,
– ধন্যবাদ।
পুনরায় ক্যামেরা হাতে উঠে পড়লো সে,লেন্স ঠিকঠাক করে নিয়ে আশেপাশে গভীর দৃষ্টিপাত ঘটালো।সাবিহা ঘুরে চত্বরের নিকটে গেলো,যেখানে রোযা এবং বাকিরা অবস্থান করছে।চারিপাশ ইতোমধ্যে রীতিমত পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।বেশিরভাগ বেসরকারি এবং হাতে গোণা কিছু সরকারি ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা জমায়েত হয়েছে আজকের কর্মসূচির জন্য।এই জমায়েতের উদ্দেশ্য মূলত আগামীকালের বৃহৎ কার্যক্রম ঘোষণা করা।এতদিন অন্তরালে রোযার নেতৃত্বে আন্দোলন প্রচারিত হলেও যত অংশগ্রহণকারী বৃদ্ধি পেয়েছে ততই তার সম্মুখে আসার প্রয়োজনবোধ হয়েছে।একটি বক্তব্য উপস্থাপনের কথা রয়েছে আজ তার সকলের উদ্দেশ্যে।একপাশে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দ চারিপাশ অবলোকন করে চলেছে রোযা।তবে আজ তার চেহারায় অন্যদিনের তুলনায় উৎসাহ কিছুটা কম পরিলক্ষিত হলো।এতক্ষণ ধরে সে একপ্রকার নীরব ছিলো।সাবিহা ভাবলো,এর পিছনে উৎকণ্ঠা রয়েছে নাকি ভিন্নকিছু?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– রোযা আপু?আর ইউ অলরাইট?
মালিহাও ব্যাপারটা খেয়াল করেছে,তাই প্রশ্ন না করে থাকতে পারলোনা।সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রোযা দ্রুত মাথা দোলালো,
– হুম,আমি ঠিক আছি।
মুখে বললেও অন্তরে কিছুই ঠিক নেই রোযার।গতকাল থেকে আসমানের সঙ্গে মনোমালিন্যের ব্যাপারটা তাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে।আসমান তার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি এখনো পর্যন্ত।অভিমানের বোঝাটুকু অসহ্যকর ঠেকছে রোযার,বহন করার ক্ষমতা নেই তার।দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করে নিজের চিন্তাভাবনা প্রশান্ত করলো সে,গুরুত্বপূর্ণ সময় এটি, অন্য চিন্তায় আপাতত নিজেকে বিভ্রান্ত করা যাবেনা।
– আপনার নেমেসিসের কাহিনীটা কি?
পাশ থেকে অভিষেকের কন্ঠ ভেসে এলো, অনির্বাণকে জিজ্ঞেস করছে সে।প্রশ্নটি শুনে মৃদু হাসলো সাংবাদিক সাহেব,ক্যামেরা নয়নে তুলে ধরে জুম ঠিকঠাক সম্ভব হচ্ছে কিনা পরীক্ষা করতে করতে জানালো,
– ডকুমেন্টারিটি দেখোনি?দেখলে বোঝার কথা।
– দেখেছি।কিন্তু এই নেমেসিস কি আদও রয়েছে নাকি শুধুমাত্র থিওরি?
– কত রহস্যময় ঘটনাই তো ঘটে দুনিয়ায়,আমাদের আশেপাশেই।কিছু সত্য,কিছু মানবনির্মিত।আমরা সবকিছুকে নিজেদের চাহিদার আদলে বদল করে নেই।তুমি যদি এই ধারণাকে সত্যি করে উজ্জীবিত হতে চাও, কার সাধ্য তোমাকে ঠেকায়?
এক নজর চেয়ে থাকলো অভিষেক,চোখের চশমা ঠিকঠাক করে নিয়ে সামান্য হাসলো,
– নেমেসিস যদি সত্যি হয় তবেই আমি খুশি হবো।পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ, এটাকে সত্যি ধরেই প্রেরণা পেলাম।আমরা একা নই,বহু পূর্বেই এই সংগ্রামের খেলা ধ্বংসের অবতাররূপে কেউ খেলে গিয়েছে।
মাথা ঝাঁকালো অনির্বাণ,এক নজর তাকালো রোযার উদ্দেশ্যে।
– আপনি বক্তব্য রাখবেন না?সময় তো হয়ে এসেছে।
মাথা নাড়লো রোযা,এক নজর হাতে ধরা স্ক্রীপ্টখানি দেখলো।কেমন বিতৃষ্ণা হলো তার,যা বলার অন্তর থেকে বলবে,এত হেঁয়ালি সম্ভবপর নয়। স্ক্রীপ্ট তাই মালিহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে হনহন করে চত্বরের উদ্দেশ্যে এগোলো।
চারিপাশের ভিড় অতর্কিতেই যেন পিনপতন নীরবতা ধারণ করলো। এত সংখ্যক মানুষের একত্রে নিশ্চুপতার নিদর্শন রোযাকেও খানিক বিস্মিত করে তুললো।অবাধ্য হৃদযন্ত্রকে প্রশান্ত করলো সে।শারীরিক ইন্দ্রিয়সমূহ উত্তেজনায় দপদপ করছে।প্রথমবার একজন নেত্রীর ভূমিকায় অভিষেক ঘটতে চলেছে তার।নিজের হাতে অন্যের জীবনের নিয়ন্ত্রণ।এত ভারী দায়িত্ব পালন কি তার পক্ষে সম্ভব হবে?অতিরিক্ত চিন্তা এড়িয়ে হাতে তুলে নিলো হ্যান্ডমাইক।পরক্ষণে বলতে আরম্ভ করলো,
– আসসালামু আলাইকুম সকলকে।ভালো আছো কিনা জিজ্ঞেস করবোনা।কারণ আমরা সকলে সংগ্রামী শিক্ষার্থী।যে লড়াইয়ে আমরা নেমেছি তাতে চূড়ান্ত মোড়ে সম্ভাষণের সুযোগ নেই।
উঠলোনা করতালি,এলোনা সামান্যতম উৎসাহী আওয়াজও।বরং প্রগাঢ় হলো নীরবতা।এটাই হওয়া উচিত।রোযা বলতে থাকলো,ক্রমশ দৃপ্ত থেকে দৃপ্ততর হলো তার কন্ঠস্বর।
– আজ থেকে সাত বছর আগেকার ঘটনা।এক নামকরা সরকারি কলেজের হলে নৃশং*সভা*বে ধ*র্ষিত হয়ে খু*ন হয় তাহমিনা।কি দোষ ছিল তার?কিছুই না,শুধুমাত্র স্থানীয় এমপির পুত্রের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল।এর ঠিক দুই বছর পর, আরেক সরকারি বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী রোদেলা নির্ম*মভাবে ধ*র্ষি*ত হয় সেই বিদ্যালয়েরই প্রধান শিক্ষকের হাতে।বয়স কত ছিল মেয়েটির? দশ?এগারো?জীবন সম্পর্কে কতটুকু জানতো সে?
সুদূর থেকে নীরবতার সমুদ্রে একটিমাত্র দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে এলো।থমকালো রোযা,সকলকে যেন ধাতস্থ হওয়ার সময় দিলো।তার মৃদু হাসির আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হলো চারিপাশে।
– দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাভ নেই।কি ভেবেছ?এখানেই শেষ? উহু,ওই পিশাচদের চিনতে পারোনি তাহলে এখনো।এবার ফিরি মাত্র এক বছর পিছনে।হ্যাঁ,ঠিক ধরেছ।একটিমাত্র বছর আগেই এক বেসরকারি হাসপাতালে স্বয়ং ডাক্তারের হাতে ধ*র্ষি*ত হয়েছে এক মেয়েশিশু।শিশু কেনো বললাম?কারণ মেয়েটির বয়স ছিল সবেমাত্র পাঁচ!
গুঞ্জন উঠলো,প্রচণ্ড গুঞ্জন।এমন একটি ঘটনা গত বছর সম্পূর্ণ দেশে কিছুদিনের জন্য তোলপাড় সৃষ্টি করলেও খুব দ্রুতই বৃহৎ এক ইস্যুর কারণে ধামাচাপা পড়ে যায়।রোযার বক্তব্যে যেন সকলের সর্বাঙ্গজুড়ে শিহরণ খেলে চলেছে একের পর এক।বর্বরতার চরম সাক্ষীতে পরিণত হয়েছে আজ তারা।শুধুমাত্র শিক্ষার্থীই নয়।অদূরে যানবাহনগুলোও থমকে রয়েছে।ঠিক জ্যামের কারণে নয়,বক্তব্য শুনতে। রিকশাওয়ালারাও রিকশার হুড তুলে একমনে শুনছে অতি মনোযোগ দিয়ে।সকলের নজর কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে রোযা।পাশে দাঁড়ানো অভিষেকের দিকে হাত বাড়ালো সে,বেশ কয়েক তা কাগজ দিলো সে রোযাকে। মোটা একখানি বই সদৃশ হওয়া কাগজগুলো ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সকলকে দেখার সুযোগ করে দিয়ে রোযা ঘোষণা করলো,
– এগুলো কি জানেন?অপরাজেয় শিক্ষার্থী পরিষদের তরফ থেকে আহ্বান করা কালোর মিছিলের জমাদানকৃত নামী বেনামী পত্র।যাতে বিগত দশক ধরে সমগ্র দেশজুড়ে অঞ্চলে অঞ্চলে সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের দ্বারা নারী শিক্ষার্থী হেনস্তার পরিপূর্ণ রেকর্ড রয়েছে! বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, লাইব্রেরী,ক্লাসরুম, অফিসরুম, প্রিন্সিপালের কেবিন,বাথরুম,বাস্কেটবল গ্রাউন্ড,এমন কোনো স্থান বাদ নেই যেখানে বর্বরতা সংঘটিত হয়নি!
অনির্বাণ সম্পূর্ণ কার্যক্রম ধারণ করে চলেছে নিজের ক্যামেরায়,কখনো রোযা আবার কখনো বাকি শিক্ষার্থীদের।ভেঙে এলো রোযার কন্ঠ,চেপে ধরলো হাতের পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠাসমূহ।
– এত নৃশং*সতা কেনো?এত অধঃপতন কেনো?মাঝবয়সী শিক্ষিকা, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া ছাত্রী, কলেজগামী ছাত্রী,বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা ছাত্রী, কেউ রক্ষা পায়নি!কোথায় এদের ন্যায়বিচার?সেই রোদেলাকে ধ*র্ষণ করা প্রধান শিক্ষক আজও কেনো বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন? তাহমিনাকে হ*ত্যা ক*রা এমপিপুত্র কেনো আজ গর্বে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো রাজনীতিবিদ?কোথায় আমার একাত্তরে অর্জিত স্বাধীনতা?কোথায় আমার নিরাপত্তা?কোথায় আমার ন্যায়বিচার লাভের অধিকার?কোথায় সংবিধান?
রোযার কন্ঠ এতটা অতিমানবীয় ধ্বনির আস্ফালন ঘটালো যে তা প্রত্যেকের অন্তরকে কাপিয়ে তুললো মুহুর্মুহু বিবেকের ঘাতে।না চাইতেও নয়ন সিক্ত হলো অশ্রুজলে। নৈঃশব্দ্য এবং উপলব্ধির রাজত্ব সমগ্র স্থানজুড়ে।শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো রোযা, জনতার উপর একবার নজর বুলিয়ে এনে বললো,
– আজ এক অহনার তরে আমরা রাজপথে নেমেছি।কিন্তু আমাদের আশেপাশে,এই ইট পাথরের নগরের অলিতে গলিতে কিংবা পাড়াগ্রামের মহল্লায় মহল্লায় আরো শত সহস্র অহনার বসবাস।এই লড়াই বর্তমানে শুধু ন্যায়বিচার আদায়ের লড়াই নয়,এই লড়াই আমাদের আত্মশুদ্ধির!জাতির কুলষিত আঁধার দূর করার দায়িত্ব এই প্রজন্মের।আমরাই দেশের মেরুদন্ড, আমরাই ভবিষ্যত।ছোটবেলায় কবিতায় সবাই পড়েছি, “আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?” স্মরণে রয়েছে নিশ্চয়ই? এবার সেই জাগরণের মুহূর্ত।অহনা আপন আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গের সূত্রপাত ঘটিয়ে দিয়ে গিয়েছে তা দাবানলে রূপান্তর করার দায়িত্ব আমার,তোমার, আমাদের সকলের।
নীরবতা।এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলো রোযা,অতঃপর বললো,
– ভয় করছ ভাইয়েরা আমার? লড়তে পারবেনা বোনের সম্ভ্রমের তরে?ভেবে দেখো,তোমাদেরও ঘরে একটি বোন রয়েছে।কি তার ভবিষ্যত?যারা পিতা রয়েছেন আপনাদের নিশ্চয়ই স্ত্রী কিংবা কন্যা রয়েছে? তাদেরই বা ভবিষ্যত কি?আমার নিজেরও স্বামী আছে, যে প্রতিটা মুহূর্তে শুধুমাত্র একটাই ভয় পায়, আমার যদি কিছু হয়ে যায়!আমি তাকে কোনো ভরসা দিতে পারিনা।কারণ আমি অবহিত,আমার নিজেরও নিরাপত্তা নেই।যেকোনো মুহূর্তে ব*লি*দান হতে পারি লা*লসার বর্বর*তার।কিন্তু তবুও কি নিশ্চুপ রইব?উহু, বিবেক আছে আমার।এই বিবেক যে শান্তি দেয়না।বোনেরা আমার,তোমাদের ভবিষ্যত গড়ার দায়িত্ব তোমাদেরই।কেউ গড়ে দেবেনা।এই মুহূর্ত নিজেদের চার দেয়ালের মাঝে বন্দী করে অশ্রুপাতের মুহূর্ত নয়, বরং বিনাশীনি হয়ে দুঃসাহসের ডানায় চেপে নিজের অধিকার হাসিল করে নেয়ার।কি ভেবেছ?সম অধিকারের কথা বলছি?উহু… নিজের নিরাপত্তার অধিকার আদায় করে নাও,রাষ্ট্র এবং আইন যা তোমাকে প্রদান করতে বাধ্য।
রোযা থামতেই মুহুর্মুহু স্লোগান এবং তালে তালে করতালির ধ্বনিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠল সমগ্র চত্বর।
“ বোনের র*ক্তের মূল্য,আদায় করে ছাড়বো!”—
“ গুঁড়িয়ে দিয়ে লৌহবেড়া,এগিয়ে যাও অহনারা!”—
ক্রমশ বিস্তৃতিলাভ করলো প্রতিধ্বনি। এ যেন গণসমুদ্রের হুংকার।
এক ফোঁটা আবেগাশ্রু নির্গত হলো রোযার নয়ন বেয়ে।খুব দ্রুত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো।আরেক দফায় প্রশ্বাস টেনে কঠোর অথচ প্রশান্ত কন্ঠে ঘোষণা করলো,
– কালোর মিছিলের ন্যায় আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি আলোর মিছিল।আগামীকাল,ঠিক গোধূলী লগ্নে,যখন ধরিত্রীকে অমানিশায় ছেয়ে বিদায় নেবে দিবাকর, তখন আলোর রোশনাই নিয়ে আমরা হাজীর হব এই প্রাঙ্গণে।শিক্ষার্থী হোক কিংবা সাধারণ জনতা, নাগরিকমাত্র এই মিছিলে অংশ নিতে কোনো বাঁধা নেই। আশা করি একযোগে এই কর্মসূচিকে আমরা সফলতা দান করবো।তার পূর্বে সকালে অপরাজেয় শিক্ষার্থী পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্র দপ্তরে যাবে স্মারকলিপি প্রদান করতে।অহনা হ*ত্যা*র মূল আসামী পলাতক জিশান আহসান এবং তার অনুচরদের অতিসত্তর গ্রেফতার…..
ধুম!
গগনবিদারী এক প্রকম্পন জাগানিয়া শব্দে রোযার বাক্য অর্ধসমাপ্ত রইলো।এক লহমায় সম্পূর্ণ চত্বর ছেয়ে গেলো বিদঘুটে কালো ধোঁয়ায়।কাছে কোথাও একের পর এক ক*কটেল বি*স্ফো*রণ ঘটেছে!মুহূর্তেই ছন্নছাড়া হয়ে পড়ল সকলে,দ্বিধান্বিত জনতা। অতর্কিতে যেন নরক পদার্পণ করলো পৃথিবীতে।
ঠাস!ঠাস!
পরপর দুটি শব্দ,এরপরই দুইজনকে লুটিয়ে পড়তে দেখা গেলো সড়কে।পলকের ব্যবধানে রঞ্জিত হয়ে উঠল সড়ক,তাজা র*ক্তে!উঠলো আর্তনাদ এবং চিৎকারধ্বনি।বিশৃংখল হয়ে পড়ল সকলে এক লহমায়।শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রূপ নিলো কুরুক্ষেত্রে।রোযা এতটাই হতবিহ্বল যে স্থির হয়ে পড়ল সম্পূর্ণ,উদ্ভ্রান্ত হয়ে সকলকে দেখতে লাগলো।অন্তর তার হুহু করে উঠলো।
– ম্যাম!
পিছন থেকে তার কাধ চেপে ধরলো কেউ,অতি দ্রুত সামনে ঝুঁকিয়ে দিলো।রোযা অনুভব করলো একদম তার মাথার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে একটি বু*লে*ট!কোথায় বি*দ্ধ হ*লো তা দেখার সুযোগ হলোনা।হতভম্ব হয়ে চাইতেই আবিষ্কার করলো হাবিবকে, তার কাছাকাছিই অবস্থান করছিল সে ভিড়ের মাঝে।
– দ্রুত ম্যাম,আমাদের এক্ষুণি এই স্থান ত্যাগ করতে হবে।
– না!
বিপরীতে হুংকার দিয়ে উঠলো রোযা,হাবিব সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।রোযার অবয়বজুড়ে ভীতির সামান্যতম চিহ্ন নেই, নয়নজুড়ে রয়েছে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা।
– আমার ভাইবোনদের রেখে আমি কোত্থাও যাবনা!
– ম্যাম আপনাকে জোর করতে বাধ্য করবেন না… ম্যাম!
রোযা কর্ণপাতটুকু করলো না, হ্যান্ডমাইক ফেলে এক লাফে নেমে এলো।চারিপাশে তাকালো, অনির্বাণকে নজরে পড়ল সর্বপ্রথম।পলায়নের রেশমাত্র নেই, হাতে তার তখনো ক্যামেরা,মাথা নুইয়ে সড়কের দিকে ঝুঁকে সে অতি ঝুঁকি নিয়েও ভিডিও ধারণ বজায় রেখেছে।অপরদিকে অভিষেক এবং সাবিহাকে দেখা গেলো।একদল লাঠিয়াল বাহিনী তাদের তাড়া করছে।একজনের হাতে উদ্যত অ*স্ত্র।
ভয়?উহু….অনুভূত হলোনা রোযার।বরং তীব্র এক আক্রোশ জেঁকে বসলো সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে।অন্তরে এক র*ক্তপিপাসু বাসনা জাগ্রত হয়েছে যেন।ক্ষণিকের জন্য নিজেকে মানবী নয় বরং দানবী মনে হলো তার।হাবিব কোনোপ্রকার হস্তক্ষেপ করবার পূর্বেই সড়কে পরে থাকা প্ল্যাকার্ড তুলে নিলো।এক পায়ে চেপে ধরে জোরে টেনে উন্মুক্ত করলো লম্বা দৈর্ঘ্যের লোহার রডখানি।অতঃপর ছুটে গেলো।সাবিহাকে পাকড়াও করা লোকটির মা*থা বরাবর পিছন থেকে স*জো*রে আ*ঘাত হা*নলো।ধরাশায়ী হয়ে সে সড়কে লুটিয়ে পড়লো।
– রোযা আপু!
হুড়মুড় করে রোযাকে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটি,কিন্তু তাকে আবেগ প্রকাশের সময় দিলোনা রোযা। ঝাঁকিয়ে বললো,
– তোমার প্ল্যাকার্ড কোথায়,ওটার লাঠি বের করে নাও।
মাথা দুলিয়ে দ্রুত প্ল্যাকার্ড তুলে নিলো সাবিহা।অদূরে মালিহা একজনের নিকট হতে দৌঁড়াতে ব্যাস্ত।রোযা নিজের জিন্সের পকেটে হাত গুজলো,সঙ্গে রাখা টিজারখানি বের করে দ্রুত ছুঁড়ে দিলো তার দিকে।ক্রিকেট খেলায় পারদর্শী মালিহার ক্যাচ ধরতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলোনা।টিজার বাগরে ধরে সে তা চালু করে চেপে ধরলো আ*ক্রমণকা*রীর ঘাড় বরাবর।তড়িৎ খেলে গেলো শরীরে,ধরাশায়ী হলো সে সড়কে।
অভিষেক একপাশে গু*লিবি*দ্ধ একজনকে টেনে কাঁধে তুলেছে, হন্যে হয়ে চারিপাশে তাকাচ্ছে আশায়।রোযা এবং সাবিহা দৌঁড়ে গেলো,সব বাহনের মালিক গো*লাগু*লি আরম্ভ হতেই চম্পট দিয়েছে।রিকশা ধরলো তারা একটি,কিন্তু রিকশাওয়ালা রাজী নয়।প্রচণ্ড ক্রুব্ধ হয়ে সাবিহা বলে বসলো তাকে,
– কাপুরুষ!
– নিজের জীবনের লাইগ্যা সবাই কাপুরুষ!
রিকশাওয়ালা জানিয়েই দ্রুত পগারপার হয়ে গেলো।ঠিক ওই মুহূর্তেই যেন দেবদূতের মতন আগমন ঘটলো এক সি এনজি চালকের,দ্রুত সে দরজা খুলে দিলো।
– তাড়াতাড়ি উঠেন,পিছনে আরেক দল আইতাসে!
দেরী করলোনা অভিষেক,সি এনজিতে তুলে দিলো আহত ছে*লে*টিকে,তার বন্ধুরাও ভেতরে চেপে বসলো। দ্রুতগতিতে তা ত্যাগ করলো সেই স্থান। একে একে চারিপাশে আহ*তদের সহযোগিতা করতে ছুটলো তারা।ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে র*ক্তে*র মাত্রা, দূর হতে পুলিশের গাড়ির সাইরেনের আওয়াজ ভেসে আসছে।অস্থিরতা ভর করলো রোযার মাঝে।অতিশয় আশঙ্কা ঘিরে ধরলো তাকে।বর্তমানে অতীত কিংবা ভবিষ্যত ভাবার বিন্দুমাত্র সময় নেই।কি হচ্ছে,কেন হচ্ছে তাও উদঘাটনের সুযোগ নেই।শুধু যেকোনো মূল্যে পরিত্রাণ পেতে হবে। ধীরে ধীরে সড়কে ছড়িয়ে পড়া র*ক্তগঙ্গা রোযার চিত্ত টলিয়ে দিতে আরম্ভ করলো।আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছেনা।চারিদিকে শুধু আগুন, বিষাদ,হাহাকার,আর্তনাদ,সাহায্যের আবেদন।কতজনের কাছে যাওয়া সম্ভব?
এই কি তবে সংগ্রাম?এই কি তবে নেতৃত্ব?এই ক্ষমতার ভার যে অসহনীয়!টিকতে পারছেনা রোযা ছেলেমেয়েগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে।সেখানে ক্ষমতাশালীরা কিভাবে সমর্থ হয় আপন জনগণের বুক ঝাঁ*ঝ*রা করে শোষণ চালাতে?বিবেক নড়েনা?অন্তর কাঁদেনা তাদের?
হাবিব ক্রমশ রোযাকে রক্ষার প্রচেষ্টা করে চলেছে।ইতোমধ্যে জন চারেকের সঙ্গে লড়াইয়ে সে কিছুটা আ*হ*ত হয়েছে।যদিও তার নিকট অ*স্ত্র আছে,তথাপি তা ব্যবহার সম্ভব নয়।তাহলে এই সম্পূর্ণ আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।রোযার নির্দেশ তাই অ*স্ত্রে*র বিপরীতে অ*স্ত্র ব্যবহার চলবেনা। অপরপক্ষকে বিন্দুমাত্র সুযোগ দিতে নারাজ সে।
পুলিশের বেশ কতক গাড়ি এসে পৌঁছাল।হয়ত কুরুক্ষেত্রের অবসান ঘটবে এই আশা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো তাদের ব্যারিকেড স্থাপনে।ওদিকে পলায়নের পথ বন্ধ।শুধুমাত্র একটি দিকই খোলা রয়েছে।আ*ক্রমণকা*রীদের আটক করার পরিবর্তে পুলিশের পক্ষ থেকে টিয়ারশেল নিক্ষিপ্ত হতে আরম্ভ করলো।যা পরিস্থিতি দ্বিগুণ ভয়াবহ করে তুললো।
– এই অনাচার আল্লাহ সহ্য করবেনা!
– নাপুরুষের দল!
চারিপাশ থেকে অভিসম্পাত ভেসে আসলো।এই সবকিছুর মাঝারে দাঁড়িয়ে রোযার নিজেকে অনুভূত হলো কুলহারা পথিকের মতন।দৃষ্টির সম্মুখে তার শুধুই বিভীষিকা।
– আপু….রোযা আপু….
নিকট থেকে ভেসে আসা মালিহার কন্ঠস্বরও রোযার কানে ঠেকলো সুদূর নিশীর ডাকের ন্যায়। চট করে ঘুরে তাকালো,পুলিশের ব্যারিকেডের ওপাশে পরে গিয়েছিল সে, বাঁধা না মেনে সেটা টপকেই ছুটে আসছে। ভগ্নপ্রায় শরীর তার,আহ*ত হয়েছে।দ্রুত ছুটলো রোযা মেয়েটিকে ধরার উদ্দেশ্যে।অতঃপর তার চোখের সামনেই মালিহার শরীর ঝটকা খেয়ে উঠলো হঠাৎ,স্থির হয়ে গেলো তার পদক্ষেপ।প্রসারিত দৃষ্টি মেলে রোযা লক্ষ্য করলো তার উদর ফুঁ*ড়ে বেরিয়ে আসা র*ক্তে*র ফো*য়ারা!
– না!
আর্তচিৎকারে প্রকম্পিত হলো ধরিত্রী।মুখ থুবড়ে পড়ল মালিহা সড়কে, তা*জা থক*থকে র*ক্তে পাশের প্ল্যাকার্ডখানি রঞ্জিত হলো।ছুটলো রোযা, টিয়ারশেলের ঝাঁঝ উপেক্ষা করে রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়লো মালিহার উদ্দেশ্যে।
– এই মেয়ে এই… মালিহা…
উত্তর নেই।রোযা কোলে তার মাথাটি তুলে ধরতেই গল*গল করে মুখ থে*কে র*ক্ত বেরিয়ে এলো তার, কাশতে থাকলো সমানে।থমকে গেলো রোযার হৃদস্পন্দন।দৃষ্টির সামনে যেন তার ভয়ংকরতম দুঃস্বপ্ন রচিত হয়েছে।অদূর থেকে ছুটে এলো সাবিহা এবং অনির্বাণ।এহেন দৃশ্য যদিও হৃদয়বিদারক,তবুও রেকর্ডিং থামালোনা সাংবাদিক,এই নিষ্ঠু*রতা জাহির প্রয়োজন!মালিহাকে আঁকড়ে ধরলো সাবিহা,
– এই,মালিহা, কিরে…এই দেখ আমি তোর সাবিহা আপু….মালিহা?
কোনো জবাব নেই।উত্তেজিত নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ফেলতে ফেলতে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল মালিহা।সম্ভব হলোনা রোযার পক্ষে,ঠিক পুলিশের ব্যারিকেডের ওপাশেই দন্ডায়মান পি*স্ত*ল ধরা লোকটি,এখনো।কয়েক কদম দূরে পুলিশ,কিছু করছেনা!
দুই পায়ে লাফিয়ে উঠলো রোযা।তেজস্বী বাঘিনীর ন্যায় ছুটে গেলো ব্যারিকেডের দিকে।তার এমন অতর্কিত পদক্ষেপে হতবিহ্বল সকলে।পুলিশ কিছু করবে কিনা বুঝতে পারছেনা।তাদের আ*ক্র*মণ করার নির্দেশ নেই।পুলিশের হাতে কিছু হলে সরকারের উপর চাপ তৈরি হবে।এক লাফে ব্যারিকেড টপকালো রোযা,লোকটির দিকে ছুটে গেলো।সে এতটাই হতবিহ্বল যে প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ হলোনা।এর পূর্বেই রোযা ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর, আছড়ে ফেললো মেঝেতে।নখরে চে*পে ধর*লো গ্রীবাদেশ।
– অমানুষ!
পি*স্ত*লটি তার ঠিকরে গেলো দূরে,ছটফট করতে থাকলো।জীবনে প্রথম এক মেয়েমানুষের অতিমানবীয় প্রকারের শক্তির সঙ্গে পেরে উঠছেনা সে।এ আদতেই মেয়ে নাকি ছদ্মবেশী পরাশক্তি?তাকে বেকায়দায় দেখে দুইজন পুলিশ সদস্য এগোলো,জোর করে রোযাকে টেনে সরিয়ে আনতে গেলো।কিন্তু গর্জন করে উঠলো রোযা,
– খবরদার!এই জানো*য়ার গু*লি করার সময় যখন বাঁধা দেননি তখন একে খ*তম করার সময়েও বাঁধ সাঁধবেন না….ক্ষমতার সামনে বিকিয়ে যাওয়া কুকুরের দল!
এক পুলিশ সদস্যের বন্দু*ক টে*নে নি*লো রোযা,তবে গু*লি চা*লালো না।সেটার শক্ত প্রান্ত ব্যবহার করে একের পর এক আ*ঘা*ত হা*নতে থাকলো মাটিতে পরে কাতরাতে থাকা লোকটির উপর।র*ক্তা*ক্ত করেও ক্ষান্ত হলোনা তার অতৃপ্ত হৃদয়।পুলিশ কয়েকজন এগোলো আবারো,কিন্তু দ্রুত পৌঁছানো হাবিবের বাঁধায় সম্ভব হলোনা।বুক চিতিয়ে সে দাঁড়ালো রোযা এবং পুলিশ বাহিনীর মাঝে।এমন এক হু*ম*কি তার দৃষ্টিতে প্রদর্শিত হলো যে পুলিশ সদস্যগণ সম্পূর্ণ বেকায়দায় পরে গেলো।
নিজের চিত্ত মিটিয়ে ক্ষান্ত দিলো রোযা, র*ক্তস্নাত ব*ন্দু*কটি ছুঁ*ড়ে ফেলল পুলিশের পদক্ষেপে।লোকটি আদও বেঁচে আছে নাকি গত হয়েছে তা জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ হলোনা তার। ছুটে গেলো আবার, মালিহার উদ্দেশ্যে।ততক্ষণে অভিষেক এসে পৌঁছেছে। মালিহার জ্ঞান তখনো আছে। রোযা নিজের স্কার্ফ খুলে নিয়ে দ্রুত তার পেটের ক্ষ*ত চেপে ধরলো।অত্যন্ত উদ্বিগ্ন কন্ঠে অভিষেক জানালো,
– আপু,আমাদের কাউকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছেনা!সব বন্ধ করে রেখেছে,একজন ইতোমধ্যে মা*রা গি*য়েছে!
ডুকরে কেঁদে উঠলো রোযা,এতক্ষণে যেন তার চেপে রাখা সকল অনুভূতির পাহাড় গুঁড়িয়ে গিয়েছে।তাকে আঁকড়ে ধরলো সাবিহা।
– কি করবো আমরা এখন আপু?আমার বান্ধবী মাত্রই বললো আমরা যেন ঢাকা মেডিকেলের দিকে না যাই!
অপর আস্তিনে রাখা রোযার ফোনটি সহসাই বেজে উঠলো।যদিও এই মুহূর্তে রিসিভ করা দুষ্কর,তবুও স্ক্রিনে আরিয়ানের নাম্বার লক্ষ্য করে সে তুললো।ওপাশ থেকে আরিয়ানের কন্ঠস্বর দ্রুত জানালো,
– রোযা আপু,তুমি আহ*তদের সবাইকে হেলথ প্লাস হসপিটালে নিয়ে আসতে বলো,এখানে সবাইকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার দায়িত্ব আমার। পাপার সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে,চিন্তা নেই।আর কোন কোন হাসপাতালে ব্যবস্থা করা যায় তা দেখছি আমি….
– ধন্যবাদ….ভাই!
এটুকুই উচ্চারণ করা সম্ভব হলো রোযার পক্ষে। মালিহাকে অতি সত্তর পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো অভিষেক,আশেপাশে একটিও যানবাহন নজরে আসছেনা।দূরে একটি ভ্যান দেখা গেলো,চালক দ্রুতই চলে যাচ্ছিল কিন্তু দৌঁড়ে তাকে পাকড়াও করলো রোযা।
– মামা…প্লীজ…মামা আমাদের বন্ধুকে খুব জরুরী…
– সরেন সরেন।যাইতে দেন আমাকে দেখি!
– আপনি কি মানুষ!
চিৎকার করে উঠলো সাবিহা।
– আপনার বাসায় স্ত্রী নেই?সন্তান নেই?পরিবার নেই?আজ যদি আপনার মেয়ে আ*হ*ত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকত তখন?এভাবে পাষাণের মতন চলে যেতে পারতেন?
ভ্যানচালক কিছুটা দ্বিধান্বিত হলো,চেয়ে দেখলো অভিষেকের কোলে র*ক্তা*ক্ত মালিহাকে,তার নয়নে স্পষ্ট অশ্রু দেখা গেলো।তারপর বললো,
– উঠেন জলদি।তবে আমার পায়ে একটু সমস্যা আছে,তাড়াতাড়ি চালাইতে পারবোনা।
– ধন্যবাদ মামা।দরকার নেই,আপনি উঠে বসুন।আমি চালাচ্ছি ভ্যান।
দ্বিমত করার সময় পাওয়া গেলোনা। ভ্যানে চালক এবং সাবিহা উঠে বসলো মালিহাকে নিয়ে।অপরদিকে অভিষেক সিটে বসে দ্রুত প্যাডেল ধরলো।
– রোযা আপু….আসো?
তাদেরকে হতভম্ব করে দিয়ে রোযা নিঃশব্দে মাথা নাড়লো।একনজর মালিহাকে দেখে ঝুঁকে কপালে স্নেহের চুমু এঁকে দিলো।
– সুস্থ থেকো বোন আমার,তোমরাও সাবধান থেকো।
এটুকুই। কেউ প্রতিবাদ জানানোর পূর্বেই রোযা ছুটে কুরুক্ষেত্রের ধোঁয়াশার মাঝে আড়াল হয়ে গেলো।সেদিকে দৃষ্টিপাত করার সময় পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব হলোনা।দ্রুত এগোলো অভিষেক,পিছনে হতভম্ব সাবিহা।উভয়ের নয়ন ঝাপসা করে বইতে থাকলো অশ্রুধারা।
বর্তমান:
হাঁটু গেড়ে সড়কে বসে আছে আসমান।এক হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে রোযার রঞ্জিত স্কার্ফখানি।ক্রমশ তাতে শক্তভাবে চেপে বসছে তার আঙ্গুল।কেমন অনুভূত হচ্ছে অন্তরে?শূন্যতা?ভীতি?আশঙ্কা?অনুশোচনা?কিংবা অপরাধবোধ?কোনটা?ঠিক ঠাওর করা সম্ভব হলোনা।সকল অনুভূতির স্রোতকে ছাপিয়ে গেলো ক্রোধের জলোচ্ছ্বাস।এক লহমায় বিলীন ঘটলো তার অশ্রুরেখার,ওই কৃষ্ণগহ্বর ছেয়ে গেলো হিমশীতল আবরণে।যাতে প্রতিফলিত হলো দা*উদাউ জ্ব*লন্ত অ*গ্নিশিখা।আজ সকল শৃঙ্খল যেন গুঁড়িয়ে গিয়েছে তার।অভ্যন্তরের পিশাচখানি জাগ্রত হয়েছে, উন্মত্ত নৃত্য তার আহ্বান জানাচ্ছে ধ্বং*সকে।
র*ক্ত চাই!র*ক্তে*র বিনিময়ে র*ক্ত চাই!নি*ষ্ঠুরতার বিনিময়ে বিভীষিকা!
উঠলো আসমান,উল্টো ঘুরে ধীরপায়ে এগোলো।হাঁটতে আরম্ভ করলো একদম কুরুক্ষেত্রের কেন্দ্র বরাবর।আশেপাশে চলা দক্ষযজ্ঞে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ তার নেই। অতি সুস্থির তার চলন। অবয়বজুড়ে অমানিশার আবহ। দৌঁড়ে এলো দুজন ছেলেমেয়ে, তার পিছনে আশ্রয় নিলো।মেয়েটি একটি হাত আঁকড়ে ধরে অশ্রুসিক্ত আবেদন জানালো,
– আমাদের বাঁচান ভাইয়া!
চেয়ে থাকল আসমান,একদম স্থির।বিপরীত প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে তিনজন।মেয়েটির কবল থেকে মুক্ত করলো সে নিজের হাত,সামনে ফিরলো।ক্ষিপ্র গতিতে এগোলো,একজনের গ্রীবাদেশ চে*পে ধরে আ*ছড়ে ফেললো সড়কে।হাতের স্কার্ফে পেঁ*চিয়ে ফেললো তার ক*ন্ঠ,একটি জোরালো ঝট*কা!তারপর থমথমে নৈঃশব্দ্য। অপর দুইজন সম্পূর্ণ ভড়কে গেলো।কিন্তু পলায়নের সুযোগ ঘটলোনা তাদের ভাগ্যে।আসমানের ক্ষিপ্রতা তাদের পরাজিত করলো, লুটিয়ে ফেলল সড়কে।তারপর একের পর এক জোরালো ঘু*ষি*র আ*ঘা*তে ভে*ঙেচু*রে গেলো শারীরিক কাঠামো।পিছনে দাঁড়িয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ পর্যবেক্ষণ করে গেলো ছেলেমেয়ে দুইজন।অদ্ভুতভাবে তাদের কারো বিন্দুমাত্র ঘৃণা হলোনা,বরং তৃপ্তি পেলো অন্তর।
উঠলো আসমান,দৃশ্য লক্ষ্য করে আরো কয়েকজন যারা বিভিন্ন কোণায় লুকিয়ে ছিল তারা ছুটে এসে একজোট হলো।আসমান উঠলো,তার সম্পূর্ণ শরীর ঘর্মাক্ত,র*ক্তে সিক্ত।পিছন ফিরে তাকালো সে, ছোট্ট দলটিকে লক্ষ্য করে উচ্চারণ করলো,
– আমার পিছন পিছন অনুসরণ করো।ছেলেরা, মেয়েদের মাঝখানে দাও,তোমরা আশেপাশে থাকো।
আজ্ঞা পালন করলো সকলে।আসমান একটি গলির অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ল।লাঠিয়াল বাহিনী অপেক্ষমাণ ছিল,এই পথেই পলায়ন করতে চাইবে এমনটাই হিসাব ছিল তাদের।কিন্তু ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অপর একজনকে লক্ষ্য করে থমকে গেলো।সময় নষ্ট না করে তেড়ে এলো একে একে।কিন্তু তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী যে একজন কি*লিং মেশিন তা তাদের ধারণার অতীত।আসমানের হাতে উঠে এলো জুতোর সোলে লোকায়িত ছোট্ট হিডেন ব্লে*ড, প্রথমজনের ঘাড় বরাবর,অপরজনের বুক বরাবর।ছেলেমেয়ের দল হতবিহ্বল চেয়ে থাকল।আসমানের কর্মকাণ্ড তাদের নজরে ঠেকছে মনোমুগ্ধকর নৃত্যশৈলীর ন্যায়।বিনাশ নৃত্যে মেতেছে এক রূপকার,হাতিয়ার তার একটিই,
র*ক্ত!
তবুও খেদ নেই।পা*পিষ্ঠদের দৃষ্টি সম্মুখে দলিত মথিত হতে অবলোকন করে অন্তর প্রশান্তি পাচ্ছে,তীব্র প্রশান্তি।একটা সময় দুঃসাহস ছড়িয়ে পড়ল তাদের মাঝেও।এগিয়ে গেলো কয়েকজন,আসমানের সুবিধা হলো।দ্রুতই সকলকে বাইরের মূল সড়কে আনতে সক্ষম হলো সে।সবাই যখন প্রাণ নিয়ে সেই কুরুক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেছে তা বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা, ঠিক তখনকার দ্বিধার সুযোগ নিয়ে আসমান আপন অমানিশার সত্তাকে আড়াল করে ফেললো ধোঁয়াশার চাদরে।ফিরে তাকিয়ে ধন্যবাদ জানানোর মতন কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি দেখতে পেলোনা সংগ্রামী ছেলেমেয়েগুলো।
মেঘতীর।
ঘড়ির কাঁটা বর্তমানে পেরিয়েছে মাঝরাত্রির ভাগ, দুইটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।তবুও জ্বলজ্বলে আভায় উদ্ভাসিত সমস্ত হলঘর।কঠোর নীরবতা।হিমশীতল বায়ুর শো শো আওয়াজ এবং ঘড়ির কাঁটার প্রদক্ষিণ ব্যতিত আর কিছু কর্ণপাত হওয়া দায়। ডাইন ইন টেবিলে বসে আছেন বিলাল,একটি হাত কপালে ঠেকানো।তার কাঁধে হাত রেখে সুস্থির দন্ডায়মান চারুলতা।সিঁড়ির ধাপের উপর মাথা নুইয়ে অবস্থান করছে নিহাদ।সকলের দৃষ্টিজুড়ে শূন্যতা।কেউই নীরবতা ভঙ্গ করে যেন কিছু উচ্চারণ করতে নারাজ।দৃষ্টি তাদের আবদ্ধ সোফায় শিরদাঁড়া টানটান করে পাথরের ভাস্কর্যের ন্যায় বসা আসমানের উপর।
ইন্ডিগো বর্ণের শার্ট তার ছোপ ছোপ শুষ্ক র*ক্তে*র দাগে পরিপূর্ণ।বিদ্ধস্ত,মলিন এক অবয়ব।একটি হাতে শক্তভাবে ধরে রাখা র*ক্তা*ক্ত স্কার্ফ।আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে ক্ষ*ত স্পষ্ট।দৃষ্টি হিমশীতল।সামান্যতম নড়চড় নেই অঙ্গ প্রত্যঙ্গে।নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে কিনা তাও বোঝা সম্ভবপর নয়।একটিমাত্র বাক্য বিনিময় করেনি সে কারো সাথে এখনো পর্যন্ত।ওই একই ভঙ্গিতে বসে আছে গত দুই ঘণ্টা পূর্বে বাড়ি ফেরার পর থেকে।
আর টিকতে পারলোনা নিহাদ। লাফিয়ে উঠলো।
– আমি আবারও ফুলটুশীকে খুঁজতে যাচ্ছি।
এই নিয়ে কথাটা সে পঞ্চমবার বলল,এবং প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে ঘণ্টাখানেকের মাঝে।
– হাবিব, রোযা…কারো সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছেনা।কেনো গেলাম না আমি ওর সাথে আজ?
রাগে দুঃখে চারুলতা টেবিলে আ*ঘা*ত হান*লো।বিলাল তার হাত টেনে মুঠোয় পুরে শান্ত কন্ঠে জানালেন,
– আমার বিশ্বাস মামণি ঠিক ফিরে আসবে।
– ও কি আদও ঠিক আছে?
– আছে….আমার মন বলছে ও ঠিক আছে।ও জানে ওর একটা পরিবার রয়েছে,তাদের কাছে ফিরতে হবে ওকে,কথার বরখেলাপ কোনোদিন করবেনা আমার মামণি।
বিলালের কথায় আসমানের আঙুল ক্রমশ চেপে বসলো স্কার্ফে।নিহাদ মাথা ঝাঁকালো,
– তবুও।রোযাকে খুঁজে পেতে যদি এই পুরো শহরও চষে ফেলতে হয় তবে…..
– ধন্যবাদ নিহাদ।কিন্তু আমি ঠিক আছি।
কণ্ঠটি কর্ণগোচর হতেই সকলে সটান ঘুরে গেলো প্রবেশ পথের দিকে।শান্ত পদক্ষেপে ভেতরে এলো রোযা,পিছন পিছন হাবিব।উভয়ের শারীরিক অবয়ব বিদ্ধ*স্তপ্রায়।রোযার মুখজুড়ে কা*টাছেঁড়ার দাগ, পরিধানের টি শার্ট এবং কার্ডিগান আদতে কোন বর্ণের তা র*ক্তের ছাপে বুঝে ওঠা দুষ্কর।দৃষ্টি তার অত্যন্ত শীতল,ক্ষীণ এক হতাশা খচিত তাতে।বিলাল রেমান উঠলেন,
– মামণি!এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?তোমাদের চিন্তায় আমরা সকলে কতটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়েছিলাম জানো?যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছিল না,আসমান,নিহাদ খুঁজে খুঁজে হয়রান। পুলিশও কিছু বলতে পারছেনা।
– দুঃখিত বাবা।
একটি নিঃশ্বাস ফেলল রোযা।
– মালিহার দা*ফন পর্যন্ত ওর পরিবারের সঙ্গে ছিলাম।
রোযার কন্ঠ অত্যন্ত শুষ্ক শোনালো।মালিহা নামটা চারুলতার জানা,সে যে কয়দিন আন্দোলনে গিয়েছে তখন পরিচয় হয়েছে।
– মালিহা?অপরাজেয় শিক্ষার্থী পরিষদের নেতৃস্থানীয় সদস্য?ওই মেয়েটা….আর নেই?
– শহীদ হয়েছে ন্যায় অন্যায়ের লড়াইয়ে।
রোযার কন্ঠে এর পূর্বে এতটা অনুভূতিহীনতা কেউই উপলব্ধি করেনি।মেয়েটি সর্বদাই আবেগপ্রবণ,সেখানে আজ সে নিজের সহযো*দ্ধার মৃ*ত্যু*র কথা এভাবে উচ্চারণ করতে সক্ষম হচ্ছে বিষয়টি যথেষ্ট চিন্তাজনক।
রোযা মানসিক আ*ঘা*ত পেয়েছে….প্রচণ্ড!
কেউই আপন জায়গা থেকে নড়তে পারলোনা।এর আগেই উঠে দাঁড়ালো আসমান।এতক্ষণ পরে তাকে নড়চড় করতে লক্ষ্য করে সবাই খানিক বিহ্বল হলো।আশেপাশে কোনো নজর না দিয়ে আসমান এগোলো এক পা, হেঁটে নয়, দৌঁড়ে!দীর্ঘ কয়েক পদক্ষেপে সে রীতিমত বিদ্যুৎ গতিতে পৌঁছলো রোযার নিকট, অতঃপর বলিষ্ঠ দুবাহুর মাঝে টেনে নিলো তাকে।বক্ষের আলিঙ্গনে চেপে ধরলো, জোরালোভাবে।মাথার পিছনে হাত রেখে কাঁধে মুখ গুঁজলো,তার দৃশ্যমান অশ্রুপাত কারো দৃষ্টি এড়ালোনা।
– স…সরি…. ফরগিভ মি… আমি একজন জঘণ্য স্বামী!
আসমানের কন্ঠ এর পূর্বে এতটা কম্পিত হতে কেউ শুনেছে কিনা ঠিক স্মরণ করতে পারলোনা উপস্থিত কেউই।তার অশ্রু বিসর্জন এবং শঙ্কিত অবয়ব রোযার শীতলতার দেয়ালকে যেন ভেঙে ফেললো।পাল্টা আঁকড়ে ধরলো সে আসমানকে,এবার বাঁধা মানলোনা বহুক্ষণ যাবৎ আবদ্ধ রাখা তার অশ্রুবন্যা।আসমানের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে সশব্দে কাদতে থাকলো রোযা।
– আমি ঠিক আছি…সুস্থ আছি আসমান…
ডার্কসাইড পর্ব ৪৭
কান্নার দমকের মাঝে বললেও ক্রন্দনে ছেদ পড়লোনা।সকল অনুভূতির তোড় ভাসিয়ে নিলো যেন তাদের।দুর্বল হয়ে পড়ল শরীর।সারাদিনের অ*ত্যা*চার আর নেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।তাকে আগলে নিয়ে মেঝেতেই বসে পড়ল আসমান,এক মুহূর্তের জন্যও একে অপরের আলিঙ্গন হতে মুক্ত হলোনা।ওই অবস্থায়ই কাঁদতে থাকলো।আসমানের পক্ষে আর কোনকিছু উচ্চারণ সম্ভব হলোনা,শুধু চেপে ধরে রাখলো সে জ্যোৎস্নাকে নিজের মাঝে।
দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে কেউই নিজেদের চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলোনা…….
