বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৬১+৬২
রোজা রহমান
একেকটা দিন পার করে চলে গেল বেশ কয়েকটা সপ্তাহ। জানুয়ারি মাস শেষ হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারী মাস পড়েছে কিছুদিন আগে। সকলের দৈনন্দিন জীবন নিজ গতিতে চলছে৷ পড়াশুনো সহ সংসার জীবনের সকল কাজই সব ছেলে মেয়ে গুলো চালিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির বড়রা নিজেদের সংসার সহ প্রতিটি সন্তানকে আগলে রেখে দিন পাড় করছেন৷
কুয়াশা নিজের পড়াশুনো সহ সংসারে মন দিয়েছে। স্বামী সেবা সহ স্বামীর যত্ন নেওয়া টুকটাক সকল কাজের মাধ্যমে কাজ শেখা সবই করে। রান্না বান্না বেশ শিখে গেছে৷ মাঝে মাঝে সে আর ইয়াসমিন মিলে রান্না করে সকলকে খাওয়ায়। তার এক-দুই মাস পরেই নির্বাচনী পরীক্ষা শুরু হবে।
শিশির নিজের ক্যারিয়ারের পেছনে দৌড়ে চলেছে। বউয়ের প্রতি দায়িত্ব আর যত্ন অবশ্য কমায়নি। খু্ঁনসুটিময় ভালোবাসার সংসার তাদের মিষ্টতায় পরিপূর্ণ। নিজেদের সত্ত্বাকেও ধরে রেখেছে। সুযোগ পেলেই কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। ঝগড়া বাঁধিয়ে তা চুলোচুলি পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। দুই-এক মাস পর বউয়ের থেকে, পরিবার থেকে দূরে যাবে এই জন্য সকলকে একটু বেশি সময় দেবার চেষ্টা করে। প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতেই বেশি থাকে। আর হাসি আড্ডাতে মাতে। বাহিরে চলে গেলে বিশেষ করে এই পরিবারের এই হাসি, মজাটাই বেশি মিস করবে সে। তাদের পরিবার বেস্ট।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বৃষ্টির এই মাসের শেষে ডেলিভারি ডেট দিয়েছে। তাকে এখন সম্পূর্ণ রকম রিলাক্স মুডে চলতে বলা হয়। সব সময় ভালোকিছুর সাজেশন দেয়া হয়। এসবকিছু করেন শাশুড়ীরা। বৃষ্টির শরীর অনেকটা ফুলেছে। হরমোনাল চেঞ্জের জন্য শরীরে কিছু কিছু এলার্জি টাইপ চুলকানি হয়েছে। যেগুলো সবসময় চুলকায়।
তুষার ডিউটি সহ বউকে সামলায়। রাতে বৃষ্টির সম্পূর্ণ দেখভাল সে করে। সারাদিন ডিউটি করে এসেও তার মাঝে কোনো ক্লান্তিভাব থাকে না হবু সন্তানের জন্য। সন্তান আসার সুখ সে সব সময় টের পায়। বৃষ্টি শুধু মুগ্ধ হয়। রাতে অর্ধেক সময় ঘুমায় আর অর্ধেক তার জেগে থেকে যায়। সেই সময়ে তুষার নিজে না ঘুমিয়ে বউকে সঙ্গ দেয়।
নীহার জানুয়ারি মাসের মাঝে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে (স’শ’স্ত্র) কমিশন অফিসার ক্যাডেট পদে আবেদন করে এসেছে। আবেদন এপ্রিল মাস পর্যন্ত চলবে নাকি। এরপরই পরীক্ষার জন্য চলে যেতে হবে জানিয়েছে। সেখানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তার ট্রেনিং শুরু। শশীর সাথে আগের মতোই সম্পর্ক ধরে রেখেছে। ব্যস্ততায় অবশ্য কম কথা হয় এখন তবুও শাসন সহ ভালোবাসা কম হয়নি।
শশীর এসএসসি পরীক্ষা আর দেরি নেই। সে পুরোদমে এখন পড়াশুনোয় ডুবে থাকে৷ তাকে একটা কথা সবসময় মনে করিয়ে দেয় নীহার যে, ভালো রেজাল্ট না করলে বিয়ে ক্যান্সেল। পাগলীটা এই ভয়ে বই নিয়ে ডুবে থাকে৷
হিমেরও পরীক্ষা শুরু হয়েছে৷ সে এবার ক্লাস টেন এ উঠবে। ছেলেটার বুদ্ধি বাড়ছে। সকলের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চায় এখন৷ বড় ভাই গুলোকে দেখে তাদের মতো চলার চেষ্টা করে। সে-ও স্বপ্ন বুনা শুরু করেছে। মায়ের কাছে জানিয়েছে ডক্টর হবার ইচ্ছে তার। এটা এখনো বাড়িতে কেউ জানে না৷ সে-ও সাহস পায় না বলার৷ আজমিরা স্বামীর পাওয়া অংশ থেকে ছেলের স্বপ্ন পূরণ করার চিন্তা ভাবনা করেছেন। কুয়াশার চিন্তা করতে হয়নি কখনো। জাকির মালিথা সহ জাহিদ মালিথা, তুষার দিয়ে গেছেন৷ হিমের বেলায় একটু ভাবনা পাল্টেছেন। স্বামীর অংশ যখন আছেই সেটা না হয় ছেলের পেছনেই দিক! এখন শুধু পরিবারের সাপোর্টের প্রয়োজন৷
ইয়াসমিন, তুহিন সংসার জীবনে এগিয়ে যাচ্ছে। ইয়াসমিন ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষাটা দিয়ে জানিয়েছে আর পড়বে না। পড়াশুনোয় তার ইচ্ছে নেই৷ বেবি নেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে সে। তুহিন এমএসসি কোর্সটা কমপ্লিট করতে বলেছে এরপর এসব নিয়ে ভাবতে বলেছে। কিন্তু সে পড়বে না জানিয়েছে। তুহিনও বউকে এই নিয়ে আর কিছু বলে নি। যার নিজেরই ইচ্ছে শক্তি না থাকে তাকে অন্যরা বলে কি করবে?
জাকিয়া, আম্বিয়া, আজমিরা আগের মতো চলাফেরা করে। জাকিয়া স্বামীর সেবায় সব সময় ব্যস্ত বেশি থাকে। সঙ্গ হিসেবে দুই জা’কে পাশে পায়।
জাকির মালিথার প্রচুর সুস্থ হবার ইচ্ছে শক্তি যেটা দ্বারা তিনি দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছেন। মাসে মাসে ঢাকায় গিয়ে চেকআপ করিয়ে আনার কথা ছিল। আগের মাসে গেছিলেনও। ডক্টর জানিয়েছেন রুগীর সুস্থ হবার প্রচুর ইচ্ছেশক্তি যার জন্য রিকোভার করতে টাইম নিচ্ছে না৷ এভাবে চলতে থাকলে ইনশাআল্লাহ খুব জলদি আবার হাঁটতে পারবেন জাকির মালিথা।
জাহিদ মালিথা সুযোগ পেলেই বাড়িতে আসেন। এসে ভাইকে সঙ্গ দেন৷ তিনিও ভাইয়ের ব্যায়াম করান। বিকেলে তিনি হুইল চেয়ারে করে নিয়ে ভাইয়ের সাথে হাঁটতে যান। আগের অভ্যাসটা ধরে রেখেছেন তবে এখন তা ভিন্ন তারিকায়। ভাই তার আবার আগের মতো নিজের পায়ে হেঁটে হাঁটতে বেরুবেন এই প্রত্যাশায় দিন গুণেন।
রিজভী, স্মৃতি, ঈশা, মিহির নিজেদের জীবনে এগিয়ে যাচ্ছে। রিজভী, স্মৃতি সংসার সহ পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছে। স্মৃতি বাবার বাড়িতে থাকে। রিজভী এক-দুই সপ্তাহ পর পর শ্বশুর বাড়িতে যায়। বউয়ের সাথে সময় কাটায়।
এভাবেই সকলের গত দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। নিজের আপন সত্ত্বাকে ধরে রেখেই এগিয়ে যাচ্ছে সকলে।
আজ শিশিরের পরীক্ষা ছিল। বিকেলের দিকে মাত্রই বাড়িতে এলো। শীতের আবহাওয়াটা অনেকটা কমে আসছে৷ মাঘ মাসের অর্ধেকের বেশি চলে গেছে কিনা!
নিজের ঘরে এসে দেখল কুয়াশা নেই। হয়তো বৃষ্টির কাছে। ভেবে বাহিয়ে এসে ডাকল,
” কুয়াশা..! এ্যাই কুয়াশা! ”
ডেকে নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে এলো কফি করে আনতে মাথা ধরেছে তার। প্রচুর চাপ যাচ্ছে। কুয়াশা ডাক শুনে তৎক্ষনাৎ চলে এসেছে৷ এসে দেখল বাহিরের জামা-কাপড় চেঞ্জ করছে সে। জিজ্ঞেস করল,
” এখন কফি খাবে? দুপুরের খাবার খেয়েছ? ”
” হ্যাঁ, খেয়েছি বাহিরে। মাথা ধরেছে কফি লাগবে।”
কাটকাট কথায় কুয়াশা তাকাল শিশিরের মুখের দিকে৷ কেমন শুকনো হয়ে গেছে মুখটা। দেখে গলে গেল সে। এগিয়ে এলো দরজার সামনে থেকে৷ শিশির বিছানায় বসল। সে-ও পাশে গিয়ে বসল৷ বলল,
” এত চাপ কেন নিচ্ছ? চাপ একটু কমাও।”
শিশির তাকাল কুয়াশার পানে। বলল,
” একায় চলে আসে, চাপ নিতে হয়না৷ ”
দীর্ঘ শ্বাস ফেলল কুয়াশা তা শুনে। বলল,
” আবার কবে আছে পরীক্ষা? ”
” এগারদিন পর আছে। ”
” গোসল করবে? ”
” হ্যাঁ। ”
শুনে নিয়ে কুয়াশা উঠে যেতে নিল শিশির আঁটকে দিল। উঠে দরজা বন্ধ করে এলো। বলল,
” আগে গোসলের সঙ্গ দে।”
বলেই শুয়ে পড়ে কুয়াশাকে টেনে নিল। কুয়াশা আর উচ্চবাচ্য করল না৷ সে কখনো তা করেও না অবশ্য। অসুস্থ না থাকলে স্বামীকে কখনো ফেরায় না। এই বিষয়ের হাদিসটা বৃষ্টি তাকে শুনিয়েছিল সেই শুরুর দিকে।
রাত বাড়তে বাড়তে শিশিরের গায়ে জ্বর এসে হানা দিল। শরীরে অনেকটা জ্বর উঠেছে৷ পড়ার আর শক্তি পেল না। নয়টার দিকে উঠে পড়ল। কুয়াশাকে ডাকল৷ সে নিজের ঘরে পড়ছে। কুয়াশা এসেই দেখল শিশিরকে অনেকটা অস্বাভাবিক লাগছে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। আৎকে উঠল সে। তড়িঘড়ি করে বিছানায় বসে থাকা শিশিরের কাছে এলো। বলল,
” এই, তোমায় এমন লাগছে কেন? ”
” জ্বর উঠেছে অনেকটা। ”
বলেই শুয়ে পড়ল৷ কুয়াশা তড়িঘড়ি করে চেক করল৷ সত্যি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। সে তড়িৎ ফাস্ট এইড বক্স থেকে জ্বরের প্রাথমিক অ্যান্টিবায়োটিক গুলো বের করে পানি নিয়ে শিশিরকে উঠতে বলল৷ শিশির উঠে আগে খেয়ে নিল৷ কুয়াশা বলল,
” মাথায় পানি দিতে হবে মনে হচ্ছে! ”
শিশির কোনো কথা বলল না। ভালো লাগছে না তার৷ কুয়াশা বাথরুম থেকে বালতি করে পানি আনল। মায়ের ঘরে গেল এরপর৷ কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো হাতে পলিথিন টাইপ কাগজ নিয়ে। পেছন পেছন আজমিরাও এসেছেন৷ এসে চেক করে বললেন,
” জ্বর তো ভালো আসা এসেছে রে! ”
উত্তরে কুয়াশা বলল,
” হ্যাঁ, কি করব আম্মু?”
আজমিরা মেয়ের অস্থিরতা দেখল৷ যেন জ্বর তার শরীরে। এদের এতটা ভালোবাসা বাসি কবে কবে, কীভাবে হলো! আজমিরা বললেন,
” তুই পানি দিতে থাক, আমি বড় বুবুকে ডাকি। না হলে হসপিটালে নিতে হবে। ”
কুয়াশা সম্মতি দিয়ে স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে লাগল৷ শিশিরকে ডাকল। সে ঘুমে না কিন্তু তাকিয়েও না। একটু ঘুরে শুতে বলল। শিশির কথা না বলে তাই করল৷ কুয়াশা মাথার নিচে কাগজটা দিয়ে কাগজের নিচে বালিশ দিল। শিশিরের শরীরে কম্বলটা ভালোভাবে জড়িয়ে দিল৷ এরপর বালতির পানিতে কাগজের নিচটা ডুবিয়ে দিল৷ মগে করে পানি তুলে শিশিরের কপাল সহ মাথায় পানি দিতে থাকল৷ প্রথমে পানি পেয়ে শরীরে কাঁটা দিল শিশিরের শীতে৷ অতিরিক্ত শীত করছে আর অসহ্য লাগছে। জ্বরটা খুবই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে৷
কুয়াশা পাশে বসে একহাতে পানি ঢালতে লাগল আর এক হাতে শিশিরের চুলে বিলি কাটতে লাগল৷ কপাল সহ মাথায় ম্যাসাজ করল হাত দিয়ে। বলল,
” আরাম লাগছে? ”
” হুঁ। ”
শিশিরের ছোট্ট উত্তর। শুনে বলল,
” এতটা জ্বর ওঠল কখন কখন? এসব সব টেনশনের জন্য হচ্ছে। তুমি টেনশন কমাও তোহ্। ”
শেষ কথাটা বিরক্ত নিয়ে বলল৷ শিশির উত্তর করল না৷ এরই মাঝে জাকিয়া, নীহার আর আজমিরা এলো। এসে জিজ্ঞেস করল খুব বেশি জ্বর কিনা! কুয়াশা জানাল বেশিই। জাকিয়া বললেন,
” পানি ঢেলে দেখ কী হয়, নয়তো ডক্টরের কাছে নিতে হবে। ”
কুয়াশা সম্মতি দিল। জাকিয়া ছেলের কাছে এসে বসলেন৷ আজমিরাও একপাশে বসে রইলেন৷ নীহার ডিভানে বসল৷
অনেকক্ষণ একনাগাড়ে পানি ঢালতে ঢালতে জ্বরটা নিয়ন্ত্রণে এলো। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের জন্যও জ্বরটা ছুটল। তখন শরীর ঘেমে উঠতে লাগল৷ শিশির জেগে ছিল। জানাল তা৷ কুয়াশা চেক করে দেখল সত্যি অনেকটা ছুটেছে জ্বর৷ মা’য়েদের কাছেও বলল। জাকিয়া জানালেন আর পানি দিতে হবে না, শরীরটা মুছিয়ে দিতে বলেই আরো কিছু নির্দেশনা দিয়ে নীহার সহ ওনারা চলে গেলেন৷ মা’য়েরা যেতেই দরজা বন্ধ করে এলো৷ কম্বল সরিয়ে শিশিরকে উঠতে বলল৷ শিশির উঠে বসলে শরীর থেকে শার্ট সহ পাতলা সোয়েটার ছিল কুয়াশা নিজেই খুলে নিল একে একে৷ শিশির নির্বিকার। সামনে বসে তোয়ালে ভিজিয়ে পুরো শরীর মুছতে লাগল। শিশির এখন একটু সুস্থতা পেয়ে কুয়াশার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিল৷ কুয়াশা নিজের কাজে মগ্ন। সে বলল,
” এত দায়িত্ববান হওয়া কবে থেকে শিখলি? ”
কুয়াশা প্রশ্ন পেয়ে তাকাল৷ মুচকি হেসে বলল,
” আমার দায়িত্ববান স্বামীর থেকে শিখেছি। আমার দায়িত্ববান স্বামীকে দেখে শিখে গেছি আপনাআপনি যে, নিজের জিনিসের প্রতি কতটা দায়িত্ববান ও যত্নবান হতে হয় আর তা কতটা ভালোবাসা দিয়ে আগলো রাখতে হয়”
শিশির হৃদয় জুড়ানো উত্তর পেয়ে প্রশান্তিময় হাসল মুখ খুলে৷ কুয়াশার কপালে চুমু দিয়ে বলল,
” বড্ড পাকনা হয়েছিস তুই, সেটা কি জানিস? ”
” হ্যাঁ জানি।”
শিশির আবার হেসে ফেলল। কুয়াশার মাথায় আলতো করে চাটি মেরে বলল,
” আমার বউটা পাকনি হয়েছে। ”
কুয়াশা মাথায় মেরে আবার আহ্লাদী কথা বলায় বিরক্ত হলো৷ ভ্রু কুঁচকে বলল,
” হ্যাঁ, তো এটা মেরে বলার কি হলো?”
বলেই আবার নিজের কাজে মন দিল। শিশির বলল,
” আর লাগবে না৷ যাহ্ সব গুছিয়ে আয়। ”
কুয়াশা কথা না বাড়িয়ে বালতি তালটি নিয়ে গিয়ে বাথরুমে রেখে এলো। শিশির বলল,
” একটা পাতলা টিশার্ট দে।”
কুয়াশা এনে হাতে দিলে সে পড়ে শুয়ে পড়ল। লাইট অফ করে দিতে বলল ঘুমাবে সে। কুয়াশা বন্ধ করে এসে শুয়ে পড়ল৷ শিশির কুয়াশাকে টেনে বুকে নিয়ে গলায় মুখ গুঁজে দিল। কুয়াশা টের পেল শরীরটা এখনো গরম গরম৷ মাথার চুলে আঙুল চালাতে লাগল স্বামীর। বলল,
” শরীর এখনো গরম আছে। ”
” সেরে যাবে৷ ”
উত্তর দিয়ে কুয়াশার পেটে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। ঘুমানোর চেষ্টা করল। কুয়াশা চিৎ হয়ে শোয়া। অন্ধকার ঘরে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল। তাকিয়ে থেকে কিছু কথা ভাবতে থাকল, থাকবে কি করে সে আর কিছুদিন পর থেকে? এভাবে রাত কাটিয়ে যার ভয়ঙ্কর অভ্যাস হয়ে গেছে! যে স্বামীর আদর, ভালোবাসা তার রোজকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে! তাকে ছাড়া কী একেকটা দিন, রজনী কাটবে তার? এ তো তুষের আ-গুনের ন্যায় জ্বলবে অন্তর যা ধিকিধিকি করে জ্বলে কিন্তু সহজে নেভে না।
ভাবতে ভাবতে মাথা কাৎ করে শিশিরের কপালের পাশ বরাবর ঠোঁট দাবিয়ে গাঢ় চুমু আঁকল। শিশির ঘুমিয়ে গেছে তার নিঃশ্বাসের গাঢ়তা তা জানান দিচ্ছে। সে-ও চোখ বুজল৷ ক্ষনিকের দূরত্বটায় যেন সে ধৈর্য্যশীল হয়।
ঘড়ির সয়মের কাঁটা ঘূর্ণনমান। তেমনি তা ঘুরতে ঘুরতে আরো কয়েকটা সপ্তাহ কাটিয়ে দিল৷ আজ শিশিরের শেষ পরীক্ষা ছিল৷ পরীক্ষা দিয়ে এসে একটু রিলাক্স মুডে ছিল। কিন্তু সেই রিলাক্স মুডের ভাটা পড়ল ভোর পাঁচটার দিকে।
ভোর পাঁচটার দিকে বৃষ্টির প্রসব বেদনা শুরু হলো। তুষারের চিৎকারে জাকিয়ারা ছুটে এলেন। এসে দেখলেন পানি ভাঙছে৷ আম্বিয়া তড়িঘড়ি করে বৃষ্টিকে এসে আগলে ধরল। জাকিয়া ছেলেকে সান্ত্বনা দিলেন৷ বাড়ির কোনে জা’য়েরই নরমাল ডেলিভারির কাজও জানা নেই। শিশির কুয়াশা, নীহার, তুহিন, ইয়াসমিন হিম সকলেই ছুটে এসেছে। ওরা তিনভাই ঘরে আর ঢুকল না৷ কুয়াশা বৃষ্টির অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল৷ বৃষ্টি চিৎকার সকলকে নাড়িয়ে তুলল।
এদিকে তুষার দিশেহারা হয়ে উঠল৷ বৃষ্টির যন্ত্রণা মাপার ক্ষমতা তার হচ্ছে না কিন্তু বৃষ্টির অবস্থা দেখে তার মাথা চক্কর দিচ্ছে। ইয়াসমিন, কুয়াশা এগিয়ে এসে বৃষ্টির কাছে বসে পড়ল৷ আজমিরা আতঙ্কিত স্বরে বললেন,
” বুবু এখানে হবে না হসপিটালে নিতে হবে!”
জাকিয়াও সেটা ভাবলেন৷ আম্বিয়া বৃষ্টিকে একের পর এক সাহস দিয়ে চললেন৷ জাকিয়া তড়িঘড়ি করে ছেলেকে বললেন,
” তুষার আব্বু! ইমারজেন্সি এম্বুলেন্স ডাক।”
তা শোনা মাত্র এক সেকেন্ডও দেরি করল না৷ তৎক্ষনাৎ এম্বুলেন্স ডাকতে ফোন হাতে নিল। এদিকে আজমিরা সহ কুয়াশা, ইয়াসমিন প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে দিল৷ এত সকাল বলে এম্বুলেন্স আসল পনের মিনিটের মাঝে৷ এখন কথা হচ্ছে এতগুলো সিঁড়ি ভেঙে বৃষ্টিকে নিচে অবধি নিবে কি করে? এই চিন্তায় মাথা নষ্ট হয়ে গেল। বৃষ্টি উঠে বসতে পর্যন্ত পারছে না৷ তুষার বাহিরে এম্বুলেন্সের কাছে থেকে ছুটে এলো। শিশিররা নিচেই আছে। তারা ডক্টর ঠিক করছে ফোন দিয়ে দিয়ে সাথে রক্তের সন্ধান করছে ইমারজেন্সির মাধ্যমে। এসব আগে থেকে কিছুই করা হয়নি। তুষার এসে মা’য়েদের মুখে সব শুনে এক সেকেন্ডও দেরি করল না। জিজ্ঞেস করল,
” আম্মু কোলে তুললে বেবির সমস্যা হবে?”
জাকিয়া, আম্বিয়া, আজমিরা তিনজনই ছেলের দিকে তাকালেন। তুষারের অবস্থা একটু বোঝার চেষ্টা করলেন৷ ছেলেটা যে বৃষ্টিকে চোখে হারায়। জাকিয়া মাথা নাড়িয়ে না উত্তর বোঝাল৷ বলল,
” কোলে নে।”
তুষারকে খুব এলোমেলো লাগছে৷ শোনা মাত্র তৎক্ষনাৎ কোলে তুলে নিল বৃষ্টিকে। বৃষ্টি মূলত ব্যথাটা সহ্য করার চেষ্টা করছে কিন্তু সহ্য করতে সক্ষম হচ্ছে না৷ এ যে পিরিয়ড ব্যথার থেকে ভয়ংকর সহ্য হবে কি করে?
তুষার বৃষ্টিকে ঐ অবস্থাতেই কোলে তুলে নিল। বৃষ্টি ব্যথার চোটে তুষারের হাতের বাহু সহ কাঁধ খামচে ধরল। তুষারের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই অতি সাবধানে বৃষ্টিকে নিয়ে বেড়িয়ে এক একটা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল। কুয়াশা, ইয়াসমিন অবাক চোখে চেয়ে রইল। একটা হবু বাবা ও স্বামী কতটা যন্ত্রণায় আছে এই সময়ে? কতটা চিন্তা হতে পারে এই সময়ে?
একজন মানুষ ৪৫ ইউনিট ব্যাথা একবারে সহ্য করতে পারে। আর একজন মা যখন একটি শিশুকে জন্ম দেন, তখন তিনি ৫৭+ ইউনিট ব্যাথা সহ্য করেন! এই ব্যাথা একসাথে ২০ টি হাড় ভাঙার ব্যাথার থেকেও বেশি হয়। তাহলে প্রসব বেদনা কতটা কষ্টদায়ক, যন্ত্রণাদায়ক ভাবা যায়!!
হসপিটালে আগে বৃষ্টিকে নরমাল ডেলিভারির জন্য নেয়া হলো। বৃষ্টির ব্যথা ক্রমেই বাড়ছে। তুষারের অবস্থা দেখে তিন ভাই সাপোর্ট হলো। তবুও শান্ত হতে পারল না সে৷ বৃষ্টির সাথে এসেছে আম্বিয়া, জাকিয়া, কুয়াশা শিশিরের বাইকে এসেছে। ইয়াসমিন বাড়িতে রয়ে গেছে আজমিরাও আছে৷ বাড়িতে জাকির মালিথার কথাও ভুলে গেলে চলবে না৷
নরমাল ডেলিভারিতেও হচ্ছে না। আধা ঘণ্টা হয়ে গেল কিন্তু কিছুই হলো না৷ এদিকে বৃষ্টির অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণের মাঝে ডক্টর জানালের রুগী জ্ঞান হারিয়েছে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে৷ জ্ঞান ফিরিয়ে ইমারজেন্সি সি-সেকশনে নিতে হবে৷ তুষার শুনে সেই মূহুর্তে যা মাথায় এলো বলে দিল,
” যেটা ভালো হয় করুন কিন্তু আমার বউকে জলদি সুস্থ করুন। জ্ঞান ফেরান জলদি। ”
একদম ট্রিপিক্যাল টিভি, সিরিয়ালের মতো মনে হলো কী কথাগুলো? হয়তো যে বা যারা শুনল তাই মনে হবে। কিন্তু একবারও কি তুষারের মনের অবস্থা কেউ বোঝার চেষ্টা করল? ভালোবাসার বউ তার৷ কষ্ট কি করে নেবে? সন্তান দুনিয়ায় আসার সুখ এক আর এই যন্ত্রণা নিজের চোখে দেখার কষ্ট আরেক৷ চিৎকার দিয়ে দিয়ে বউ তার চোখের সামনে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছে এটা কি একটা ভালোবাসার মানুষ সহ্য করবে? তবুও তুষার স্ট্রোং থাকা সর্বশেষ চেষ্টা চালাচ্ছে।
কুয়াশা, শিশির, নীহার, তুহিন, আম্বিয়া, জাকিয়া সকলে শুধু আল্লাহর নাম নিচ্ছে। আল্লাহকে ডেকে বাচ্চা ও মা’কে সুস্থ থাকার কামনা করছে।
কিছুক্ষণের মাঝে বৃষ্টির জ্ঞান ফিরিয়ে সি-সেকশনে নেয়া হলো। সার্জারিই করতে হবে। সব ঠিকঠাক করল শিশিররা। রক্ত সহ্য বড় ডক্টর আনাল।
সকলের অপেক্ষা যেন শেষ হচ্ছে না। তুষার না পারছে স্থীর থাকতে না পারছে মা চাচিদের সামনে প্রকাশ করতে নিজের ভেতরের অস্থিরতা৷ এক ঘন্টা পাড় হয়ে গেছে কোনো খবর পায়নি তারা৷ টেনশনে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে সকলের৷
আরো কিছুক্ষণ পর একটা নার্স এসে জানালেন বেবি হয়েছে কিন্তু কোনো রেসপন্স করছে না। বেবির মা সুস্থ আছে। এই কথা শোনা মাত্র সকলে কেঁপে উঠল। প্রথম নতুন অতিথি আসার কথায় আনন্দিত হবে নাকি কষ্ট পাবে কোনটা? এক আনন্দ বার্তা তো দিল কিন্তু তার সাথে আতঙ্কিত বার্তা কেন দিল?
নার্সের কথা শুনে তুষার সহ প্রতিটা সদস্যের মাথায় চক্কর দিল। তুষারের বুকে ব্যথা অনুভব হলো। এতক্ষন যদিও বাবা হবার উত্তেজনা ও বউয়ের অবস্থাতে অস্থির ছিল কিন্তু এখন তা পাথর সমান ভারী বস্তুু চাপানোর মতো বুকে ব্যথা অনুভবে রূপ নিল। দিশেহারা হয়ে উঠল সে। অস্বাভাবিক দেখা গেল। একটা সদ্য বাবার কী হাল হয় এই দুঃসংবাদে তা উপস্থিত সকলে দেখল!
জাকিয়ার অবস্থা কি বলব? তিনি কিছু মাস আগে স্বামী, সন্তানকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে নিজের চোখের সামনে দেখেছেন আর এখন আবার তারই প্রথম সন্তানের প্রথম আলো ঘরে প্রবেশ না-ই করতে এমন একটা দুঃসংবাদ! সহ্য করবেন কি করে তিনি? প্রথম দাদি হবার সুখ মন,প্রাণ জুড়ে বিরাজ করত আর আজ এই সদ্য দাদি হবার সুখ গ্রহণ করতে পারছেন না? আল্লাহ ওনার এক কী পরীক্ষা নিচ্ছেন! তার সংসারের এ কি হাল হচ্ছে? বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। চোখ উপচে পানি পড়া শুরু করল। নিজেকে শক্ত করার বৃথা চেষ্টা করলেন৷ ওনার বড় মানিকের দিকে তাকালেন। তুষারের চোখে স্পষ্ট ব্যথা। সেই ব্যথা যেন উপচে আসতে চাইছে।
কুয়াশার বুক কেঁপে উঠল দুঃসংবাদ শুনে। পাশে থাকা শিশিরের হাত খামচে ধরল। চোখ টলমল পানি৷ শিশির একপলক কুয়াশাকে দেখে সে নিজেও দিশেহারা হলো৷ সদ্য চাচু হওয়ার উত্তেজনায় যেন নিমেষেই ভাঁটা পড়ল৷ হাসি মুখে আসতে গিয়েও যেন এলো না৷ নীহার, তুহিন পাশ থেকে বড় ভাইয়ের কাঁধ ধরল আশ্বাসের সঙ্গ দিতে৷ দু’জনেই এক সাথে বলল,
” ভাই! আল্লাহ আছেন ”
তুষার ব্যথাতুর নয়নে চায়ল নীহারের দিকে৷ এরপর মা’য়ের দিকে। অসহায়, নিস্প্রভ, নিষ্প্রাণ, অনির্ব নয়নে মা’কে তার ব্যথা বোঝাতে চায়ল৷ জাকিয়া কি বুঝলেন তা? হয়তো ছেলের কষ্ট বুঝলেন৷ একজন মা ছাড়া আর কে বা বুঝবে একটা সন্তানের কষ্ট, অসহায়ত্ব? জাকিয়া তড়িঘড়ি করে ছেলের কাছে ছুটে এলেন৷ অভয় দিয়ে বললেন,
” আমার আব্বু, আমার বড় মানিক! সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ আছেন আব্বু। শান্ত হ। আল্লাহকে ডাক৷ আয় বস! ”
বলে ছেলেকে বসালেন। তুষারের কিছু ভালো লাগছে না৷ আম্বিয়া অন্যপাশে বসলেন। শরীরে হাত বুলাতে লাগলেন। একজন মা’য়েরা বোঝেন এই সময়ে মনের অবস্থা কতটা ব্যাকুলতা হয়! শিশির তড়িঘড়ি করে ভাইয়ের পায়ের কাছে হাঁটু মুড়িয়ে বসল। ভাইয়ের দুই হাত হাতের মাঝে নিয়ে বলল,
” ভাই! সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে সামলাও।”
নীহার নার্স চলে যেতে নিলে জিজ্ঞেস করল,
” ওঁ কি হয়ে দুনিয়ায় এসেছে জানতে পারি? ”
” ছেলে। ”
কথাটা শ্রবণ হতেই তুষারের অন্তুর শীতল হয়ে উঠল। তড়িৎ তাকাল সেদিকে। যদিও আল্ট্রাসোনোতে জানতে পেরেছিল দুই মাস আগে। এখন শুনল একটা ছেলে সন্তানের পিতা হয়েছে সে। কিন্তু তার অবস্থা এখন জীবন মরণের সাথে জুড়ে আছে? অস্থির ভাবটা আরো বাড়ল। দেখার স্বাধও জাগল খুব। নার্সটা বলেই চলে গেছে। তুষার দু’ হাতে মাথার চুল খামচে ধরল। কোনো অনুভূতিই সে প্রকাশ করল না। কুয়াশা নিরবে ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়াল। কাঁধে হাত রাখল। এই ভাইটা তার খুব প্রিয়৷ তার সব সময় ভালো মন্দের খোঁজ এই ভাইটাই রাখে। আদর যত্ন এই ভাইটার থেকে বেশি পায়। আবদার সব এই ভাই পূরণ করে। তার এমন কষ্টের সময়ে তারও বুক কাঁদছে৷
সকলে এখন শুধু আল্লহকে ভরসা মানা শুরু করল। একমাত্র আল্লাহ-ই ভরসা। তাই মন, প্রাণ দিয়ে আল্লাহকে ডাকা শুরু করল। জাকিয়া নিজের কষ্টকে দমিয়ে ছেলের কষ্টে ঢাল হলেন। ছেলের পাশে বসে বুকে, পিঠে সমানে হাত ডলতে লাগলেন। মূলত ছেলেকে অভয় দিয়ে ব্যথা, অস্থিরতা, ব্যাকুলতা কমানোর চেষ্টা করতে থাকলেন। আর তার ঘরের প্রথম প্রদ্বীপের মুখে দাদি ডাক শোনার বাসনা পোষণ করে আল্লাহকে ডেকে ফরিয়াদ করতে লাগলেন।
দুই ঘন্টা পাড় হয়ে গেল। কিন্তু কারো অস্থিরতার এক ছিঁটেফোঁটাও কমল না৷ কারণ এখনো ডক্টররা কোনো আপডেট দেননি। কোনো সুখ-বার্তাও পাঠাননি। তুষার সকালের বেশেই এসেছিল। টিশার্ট আর টাউজারে। তেমনই আছে৷ সকাল নয়টা বেজে আসছে কিন্তু কারো মুখে পানি পর্যন্ত তোলা হয়নি৷ বৃষ্টির বাবা ও সৎ মা আসছে হসপিটালে জানিয়েছেন।
অপারেশন থিয়েটারে একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ডক্টররা। তবুও তুষার, বৃষ্টির প্রথম সন্তানের রেসপন্স আশানুরূপ পাচ্ছেন না৷ শ্বাস চলছে শুধু।
সার্জারির পর ছেলেকে তুলেই বৃষ্টিকে জানানো হয়েছিল বেবির কথা। সে সজ্ঞানে ছিল। কিন্তু বেবির রেসপন্স না পাওয়ার কথা শুনে সে বড় সড় ধাক্কা খেয়েছে। বুকের পাঁজর ভেঙে আসতে চেয়েছে। কিছুক্ষণ আগে যে মরণ যন্ত্রণা হচ্ছিল সেটাও যেন বৃথা মনে হচ্ছিল। সে-যন্ত্রণার কথা ভুলে সন্তানের জন্য চোখের দুই কোল বেয়ে পানি ছেড়ে দিয়ে আকুলতাময় আবদারে শুধু নিস্তেজ স্বরে বলেছিল,
” ডক্টর! আমার সন্তানকে আমার বুকের থাকার সুযোগ করে দিন প্লিজ..!”
এই নিদারুণ যন্ত্রণাময় বাক্যটুুকু উপস্থিত থাকা নার্স সহ ডক্টরের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলতে সক্ষম ছিল। ডক্টররা পুরোটা ভরসা দিয়ে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন৷ আর বৃষ্টি ঐ বাক্যটুকু বলেই নিজের শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। সন্তানের জন্য সে জ্ঞান হারিয়েছিল। তার বুকের কষ্টটা কি কেউ বুঝেছে? নয়টা মাস পেটে রেখে এখন দুনিয়ায় এসেই এমন দুঃসংবাদ কোন মা’টা সহ্য করবে? ডক্টর বৃষ্টির জ্ঞান ফেরাতে বলে বেবির রেসপন্স দেয়ার চেষ্টায় লেগেছেন। বৃষ্টির কিছুক্ষণের মাঝে জ্ঞান এলে তাকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়৷ সে এখনো ঘুমে।
একটা প্রাণ দেনেওয়ালার মালিক স্বয়ং মহান আল্লাহ তাআ’লা। আর সেই প্রাণ বাঁচানোর ফেরেস্তা রূপই হলেন একজন ডক্টর। ডক্টররা কখনো হার মানেন না৷ তারা সর্বস্ব চেষ্টা সব সময় করেন একটা প্রাণ বাঁচানোর জন্য। আল্লাহ চাইলে তারাও সফল হোন। এই যে দুইটা ঘন্টার বেশি সময় চলে গেল তবুও ডক্টররা নানান চেষ্টা করে চলেছেন৷ হাল ছাড়তে তারা রাজি নন৷ শেষ চেষ্টা পর্যন্ত করে যাবেন৷
আরো ঘন্টা দু’য়েক পর ডক্টর এসে তুষারদের কাছে জানালেন বেবি রেসপন্স করেছে। বেবি কেঁদেছে। এই যে ‘বেবি কেঁদেছে’ এই বাক্যটা যেন আনন্দ ফোয়ারা ছড়িয়ে দিল সকলের চোখে, মুখে, প্রাণে৷ কী অদ্ভুত নাহ্! এই কান্না নামক বাক্যটাও যে সুখের হতে পারে এটা ধারণা করা যায়! ভাবা যায়! অতি আশ্চর্য নাহ্! কিন্তু এটাই সত্যি এই কান্না সুখ থাকে, এই কান্নায় আনন্দ থাকে, এই কান্নায় প্রশান্তি থাকে আর সর্বশেষ এই কান্নাটায় সকলে মনে প্রাণে চায় এবং সুখকর হয়।
জন্মের পর বেবি না কাঁদলে তা আতঙ্ক বার্তা হয়ে ধরা দেয়। অথচ পরে বাচ্চাদের কান্না থামাতে আমরা কতকিছুই না করি! একেই হয়তো বলে, সব কান্না দুঃখের বার্তা হয় না কিছু কান্না সুখ বার্তাও হয়৷
সকলে আশানরূপ উত্তর পেয়ে একসাথে বলে উঠল,
” আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।”
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে ভুলল না কেউ। তুষার আশানুরূপ বার্তা পেয়ে আনন্দে মা’কে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি নিরবে ছেড়ে দিয়ে এতক্ষণ পর নিজের বাবা হবার সুুখ, আনন্দ প্রকাশ করে দিল। তার অস্থির হৃদয়কে সে মা’য়ের কাছে প্রকাশ করতে চাইল৷ সকলের মুখে তৃপ্তিময় হাসি চোখে টলমল পানি৷ আনন্দে তাদের কান্না চলে আসছে৷ মালিথা ভিলায় এই প্রথম ছোট ছোট হাত, পা, মুখ ওয়ালা অতিথি এলো আনন্দ হবে না? সকলে কত শত ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল সব কি ভুলে গেলে চলবে? তারা মামা, চাচা, ফুপু, চাচি নিয়ে কতই না ঝগড়া করেছিল ভুলে গেলে চলবে?
জাকিয়া কেঁদে দিয়ে ছেলেকে আগলে ধরেছেন৷ আনন্দের মূহুর্তে তিনি নিশ্চুপ হয়ে গেছেন৷ এই মূহুর্ত প্রকাশ করার মতো না, এই মূহুর্ত অনুভব করার মতো। কতটা আনন্দ হয় একজন মা, বাবা যখন নাতি-নাতনীর দাদা- দাদি হয়? এটা বোধহয় সে-সকল দাদা দাদিরাই বুঝে কতটা আনন্দের হয়! জাকিয়া দাদি হয়ে গেলেন এটাই যেন তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। ছেলেকে তুলে বললেন,
” আব্বু, আমি দাদি হয়ে গেছি?”
তুষার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটিয়ে মাথা উপর নিচ বার কয়েক ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ উত্তর বুঝাল৷ শিশির আনন্দে মৃদু চেঁচিয়ে বলে উঠল,
” এ্যাই ভাই, তুমি বাবা আর আমি চাচু হয়ে গেছি! ”
তুষার ভাইয়ের দিকে ফিরে একই ইঙ্গিতে একই ভাবে উত্তর করল। নীহার, তুহিন একসাথে জোড়া কথা বলে উঠল,
” ভাই, ভাতিজা চলে এসেছে আমাদের পরিবারে! ”
আবারও একই ভাবে উত্তর করল তুষার। সাথে সাথে তিন ভাই তুষারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তুষার হেসে তিন ভাইকেই আগলে ধরল৷ আনন্দ যেন কানায় কানায় পূর্ণ হতে লাগল৷ জাকিয়া, আম্বিয়া প্রাণ ভরে দেখলেন৷ ওরা তিন ভাই জড়িয়ে ধরে একসাথে সব বলে উঠল,
” অভিনন্দন, অভিনন্দন, অভিনন্দন ভাই তুমি বাবা হয়েছ। ”
তুষারও একই ভাবে তিনজনের উদ্দেশ্যে বলল,
” তোদেরও অভিনন্দন, তোরা চাচু হয়েছিস।”
বলতেই তিনজন ছেড়ে অমায়িক হাসল৷ ওরা ছাড়তেই এবার কুয়াশা যা বলে উঠল তা শুনে শিশির আহত হলো। আনন্দের মুখটা তৎক্ষনাৎ পাংশুটে মুখে ধারণ করল। বউ তার আনন্দে আটখানা হয়ে বড় ভাইয়ের বুকে গিয়ে পড়ে বলে উঠল,
” এ্যাই বড় ভাইয়া, আমি ফুপু হয়ে গেছি! ”
তুষার হেসে বোনকে আগলে নিয়ে বলল,
” হ্যাঁ, সকল ছানাপোনাদের একমাত্র ফুপু তুই। ”
শিশির তা শোনা মাত্র-ই মুখটা ফাঁটা বেলুনের মতো করে চুপসানো ভাব ধরে আহত স্বরে বলে উঠল,
” দ্যাট’স নট ফেয়ার ভাই! আমার ছানাপোনাদের অন্তত ফুপু বানিয়ে দিয়ো না! ওরা মা’য়ের অভাবে ভুগবে। এই জন্য বলেছিলাম এইসব আউল ফাউল বোন টোনের সাথে বিয়ে টিয়ে দিয়ো নাহ্। যত্তসব! ”
বলেই মুখটা শুটকি মাছের মতো শুকিয়ে চূড় করে ফেলল। আর সকলে? সকলের শিশিরের অবস্থা ও কথা শুনে দম ফাটা হাসিতে মত্ত হলো। আম্বিয়া হাসতে হাসতে সাবধানি বাণী দিলেন এটা হসপিটাল। কুয়াশা একে তো লজ্জা পেল সাথে শিশিরের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার যোগার৷ নীহার, তুহিন হাসতে হাসতে শিশিরকে দুই পাশ থেকে কাঁধ জড়িয়ে বগল দাবা করল। শিশির কুয়াশার হাসি সহ্য করতে পারছে না৷ সেটা যেন জ্বলা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করছে৷ সে কটমট নজরে কিড়মিড় করতে লাগল কুয়াশার দিকে তাকিয়ে৷ মনে মনে আওরাল,
” ফাজিল একটা। ফুপু হবার শখ দেখো! ”
নীহার হেসে নিয়ে বলল,
” থাক ভাই আর দুঃক্ষ প্রকাশ করিস না৷ পাবলিক তোর অবস্থা দেখলে হাসতে হাসতে শহীদ হবে। কুশু তোর ছানাপোনাদের মা-ই হবে। হ্যাপি? ”
আবার হাসল সকলে। কুয়াশা কী করবে বুঝছে না তার লজ্জা লাগছে প্রচুর। শিশির কিড়মিড় করে উঠল নীহারের উপর। বলল,
” ভালোয় সব মজা লাগছে তোদের নাহ্? ”
” বিশ্বাস কর, সেই মজা লাগছে! ”
নীহারের কাটা ঘায়ে নূনে ছিটা দেয়া উত্তর শুনে আরো দাউদাউ করে জ্বলে উঠল শিশির। আর সেই আ-গুনে যেন কুয়াশাকে জ্বালিয়ে দিয়ে ভ-স্ম করে দেবে ভাবটা এমন তার৷
তুহিন, নীহার, শিশির, তুষার খাবার আনল মা’দের জন্য ও বোনের জন্য৷ ওরা বাহিরে থেকে খেয়ে এসেছে৷ বাড়িতে জানিয়ে দেয়া হয়েছে সুসংবাদটি। সকলে টেনশনে ছিল বেবির রেসপন্স করা নিয়ে। তুষারদের এখনো দেখতে দেয়নি। বেবির রেসপন্সের পর একটু মায়ের কাছে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছেন ডক্টররা৷
বারটার দিকে বৃষ্টি ঘুম থেকে উঠল। বাচ্চার ফিডারিং করাতে নার্সরাই সাহায্য করেছে বৃষ্টি তখনো ঘুমে ছিল। উঠে সন্তানকে কাছে পেয়ে সে কেঁদে দিয়েছে। নার্স অভয় দিয়ে ডক্টর ডাকলে ডক্টর জানালেন আপাতত আর কোনো অসুবিধা নেই আর হবেও না ইনশাআল্লাহ। তুষারদের ভেতরে ঢুকারও অনুমতি দিয়ে গেলেন।
ডক্টরের অনুমতি পেয়ে কুয়াশা হুড়মুড়িয়ে ঢুকল। শিশির বিরক্ত চোখে তাকাল। সবখানে এই গোবর ঠাঁসার পাড়াপাড়ি। কুয়াশা ঢুকলে একে একে সকলে ঢুকল৷ কুয়াশা ঢুকেই ছোট্ট ছানাটাকে তোয়ালের মাঝে শুয়ে ঘুমাতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল। আনন্দে এক লাফে বাচ্চাটা কাছে চলে গেল৷
আসলে ও কখনো এমন বাচ্চার সান্নিধ্যে বড় হয়ে ইস্তক আসেনি৷ হিম যখন হয়েছিল তখন ও অনেকটাই ছোট যার জন্য এই এখনকার অনুভূতিটা তখন পায়নি। এই যে এখন এত্তটুকু একটা বাচ্চা যার- ছোট্ট হাত, ছোট্ট পা, ছোট্ট নাক, ছোট্ট মুখ, ছোট্ট চোখ এগুলো একদম নিষ্পাপ। যা দেখলে যে কারোরি আদর আদর লাগবে। আর তুষার, বৃষ্টির ছেলেটা হয়েছেও কিউটের ডিব্বা। যেটা দেখে ও আরোই নিজের উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছে না৷ এখনকার সম্পর্ক বাদ দিয়ে ওর মাঝে ফুপুর সত্ত্বা জেগে উঠেছে৷ তুষারকে ও সব সময়ই ভাই হিসেবে দেখে। সেক্ষেত্রে তুষারের বাচ্চাকে ওর আপন আপন লাগছে। খুবই আদর পাচ্ছে ওর। ভাইদের সন্তানের উপর একটা ফুপুর কতটা টান হয়? আদর আসে? ভালোবাসা জাগে?
চোখ টলমল করে বাচ্চাটার কাছে হাঁটু মুড়িয়ে ফ্লোরে বসে পড়েছে। এই প্রাণটাকে নাকি হারাতে যাচ্ছিল তারা! ভাবলেই এখনো হাত পা কাঁপছে, বুক কাঁপছে। যদি সত্যি হারিয়ে ফেলত? ডান হাত তুলে বাচ্চাটার গালের উপর রাখল আলতো করে৷ আহ্ কী সুন্দর একটা অনুভূতির সাথে পরিচয় হলো! ভেতরটা উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল। তাদের পরিবারে ছোট্ট একটা প্রাণ এসে গেছে। তার ফুপু হয়ে এতটা আনন্দ লাগছে তাহলে এই সময়ে তুষার আর বৃষ্টির কেমন লাগছে? ভেবেই বৃষ্টির দিকে এতক্ষণ পর ভালোভাবে দৃষ্টি দিল। ইশশ! মুখটা শুকিয়ে আছে কিন্তু মুখে প্রশান্তিময় হাসি। বৃষ্টিও অমায়িক হেসে তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে। কুয়াশা বাচ্চাটার গালের উপর হাত রেখেই পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা জাকিয়ার দিকে টলমল চোখে তাকিয়ে বলল,
” আম্মু, দেখো কত্তটুকু! আর কী কিউট হয়েছে দেখো!”
জাকিয়াও টলমল চোখে তাকিয়ে পাগলামী দেখছেন আর দাদি হবার আনন্দ উপভোগ করছেন৷ উপস্থিত সকলে ঠোঁটে হাসি ঝুঁলিয়ে কুয়াশার বাচ্চামি দেখছে৷ আর শিশির? ওঁ তো বউয়ের কাছে বাচ্চাটাকে কতটা সুন্দর লাগছে সেটা দেখেই আনন্দে আটখানা হয়ে গেছে৷ বাচ্চা নিয়ে বউয়ের পাগলামি দেখছে আর ঠোঁটে হাসির রেখা ঝুলিয়ে রেখেছে৷
বৃষ্টি এতক্ষণ পর তুষারের দিকে তাকাল৷ তুষার ঢুকে পর্যন্ত বউ আর তার কোলের মাঝে শুয়ে থাকা ছোট্ট প্রাণটাকে দেখতে ব্যস্ত ছিল। তার যেন চোখই সরছে না আর না মন,প্রাণ জুড়াচ্ছে। তুষারও তাকাল বৃষ্টির দিকে। অমায়িক হাসল দু’জন। এই অনুভূতি কি করে প্রকাশ করবে দু’জন? সদ্য জন্ম নেয়া নবজাতক আর সদ্য হওয়া মাতা-পিতা তারা! কেউ কি এই অনুভূতি অনুভব করতে পারছে? নাকি অনুমান করতে পারছে? পারছে কি অনুধাবন করতে?
বৃষ্টির চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। তুষারের চোখে পানির আভাস। হৃদয় জুড়ানো অনুভূতি নিয়ে এগিয়ে গেল বউ, বাচ্চার কাছে। সে পাশের টুলে বসল৷ বৃষ্টির কপাল সহ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিল৷ বলল,
” কেঁদো না সব ঠিক আছে। আমরা হারায়নি ও’কে ”
এরপর ঘুমিয়ে থাকা ছেলের গালের উপর হাত রাখল৷ অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠল অন্তর, কায়া তার। মা’য়ের দিকে তাকিয়ে মা’কে ডাকল,
” আম্মু..! ”
জাকিয়া হাসলেন। ছেলের অনুভূতি তিনি ঠিক ধরতে পারছেন৷ উনারাও যে এই অনুভূতি পাড় করে এসেছেন! বললেন,
” কেমন অনুভূতি? আমি আর তোর বাবাও তোর সময় এমন অনুভূতির সাথে পরিচয় হয়েছিলাম। ”
তুষার অমায়িক হাসল আবার। শিশির গিয়ে মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরল পেছন থেকে। জাকিয়া হেসে ডান হাতটা ছোট ছেলের গালে রাখলেন৷ জাকিয়া তুষারকে বললেন,
” কোলে নে।”
তুষার কেঁপে উঠল কথাটা শ্রবণেন্দ্রিয়তে পৌঁছাতেই। তড়িৎ বৃষ্টির দিকে তাকাল৷ বৃষ্টিও নিতে বলল৷ ফের মায়ের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
” আম্মু যদি পড়ে টরে যায়! ”
জাকিয়া সহ আম্বিয়ারা সকলে হেসে ফেলল৷ বৃষ্টিও হেসে ফেলেছে। এই লোকটা সেই শুরু থেকে পাগলামি করত। এখনো করছে। একটা পুলিশ অফিসারও ছোট্ট বাচ্চাতে পরিণত হয়েছে বাবা হবার আনন্দে। নীহার বলল,
” ভাই, তুমি স’ন্ত্রা’সি ধরে বেড়াও অথচ ছেলেকে কোলে নিতে ভয় পাচ্ছ? পড়ে যাবে কিনা? ইন্টারেস্টিং! ”
সকলে মুচকি হাসল। তুষার একটু লজ্জা পেল বটে এভাবে সরাসরি কথাটা বলাতে। তারই বা কি দোষ? সে সত্যি আনন্দে পাখির ন্যায় উড়ছে। ধমক দিল তুষার একটু নীহারকে। বলল,
” তুই চুপ থাক! আমার সত্যি ভয় হচ্ছে। ”
সকলে আবার হাসল। জাকিয়া বললেন,
” কিছু হবে না। কোলে নে। ”
তুষার তা শুনে বৃষ্টিকে একবার দেখে কাঁপা শরীরে উত্তেজনা নিয়ে আলতো করে কোলে তুলে নিল। অদ্ভুত ভাবে নবজাতকটি নড়ে তো উঠলোই সাথে একটু কান্না করল। বোধহয় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাল বাবা তার। তুষার আনন্দে হেসে উঠল৷ শব্দ বের করল মুখ দিয়ে,
” ও…..!”
বৃষ্টি হাসল। কুয়াশা ঐ ভাবেই বসে থেকে ভাইয়ের কোলের উপর থেকে নবজাতকের শরীরের উপর হাত দিল। তুষার তা দেখে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল,
” কুশু.. দেখ কী সুন্দর! ”
কুয়াশাও আহ্লাদে বলল,
” হ্যাঁ, পুচ্চু পুচ্চু একদম। ”
শিশির ভড়কে তাকাল। এটা আবার কি বলল এ? ধমক দিল মৃদু। বলল,
” এ্যাই! ওভাবে নোংরা জায়গায় বসে আছিস কেন? ওঠ! আর ওটা কি বললি? পুচ্চু পুচ্চু মানে কী? ”
কুয়াশা ধমক খেয়ে উঠে দাঁড়াল। বিরক্ত নিয়ে তাকাল শিশিরের দিকে। বলল,
” পুচ্চু পুচ্চু মানে বাচ্চা বাচ্চা। ওসব তুমি বুঝবে না তাই চুপ থাকো!”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল শিশির৷ জাকিয়া হেসে এগিয়ে গেলেন নাতিছেলের কাছে৷ ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন৷ তুষার তাকিয়ে বলল,
” ও আম্মু, কেমন কিলবিল করছে দেখো!”
জাকিয়া আবার হাসলেন। তুষার বলল,
” আম্মু কোলে নাও! ”
বলে এগিয়ে দিল। জাকিয়া কোলে নিলেন৷ অনুভূতির জোয়ারে ভেষে গেলেন। আহ্ তিনি দাদি! প্রথম নাতিছেলে তার! জাকিয়াকে কোলে নিতে দেখে কুয়াশা বলে উঠল,
” আম্মু আমিও নেব কোলে! ”
জাকিয়া কুয়াশার কথাতে তাকালেন। বললেন,
” এগিয়ে আয়।”
জাকিয়ার কথা শুনতেই শিশির বলে উঠল,
” একদম না আম্মু, ও ফেলে দেবে। এমনি নিজেই তিড়িং বিড়িং করে বেড়ায়!”
কুয়াশা কিড়মিড় করতে করতে বলল,
” এ্যাই, থামবে তুমি? ”
বলে এগিয়ে গেল৷ শিশির আগের ন্যায় তাকিয়ে রইল৷ জাকিয়া কোলে দিলেন। কুয়াশা কোলে নিতেই আবার কোলের মাঝে কিলবিল করে উঠল নবজাতকটি। কুয়াশা উত্তেজিত হলো। হাসল অমায়িক৷ শিশিরের কাছে এগিয়ে গেল কোলে নিয়ে উত্তেজনার সাথে। আনন্দে আটখানা হয়ে গদগদ স্বরে বলল,
” এ্যাই দেখো দেখো কী সুন্দর! আবার নড়ছেও।”
শিশির কুয়াশার কার্বার দেখে হাসল৷ ওর কোলে কী সুন্দর লাগছে! শিশির আর কুয়াশা বাচ্চাটাকে নিয়ে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে। সকলে দেখল ওদের কোলে বাচ্চা সমেত। মনে হচ্ছে মা বাবা তার বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জাকিয়ে মনে মনে বললেন,
” আল্লাহ আমার ছোট মানিকের ঘরও আলোকিত করুক এভাবেই। আমিন।”
বৃষ্টি নিষ্প্রাণ স্বরে বলল,
” দেবরজী, কুশু! তোমাদেরও আসবে এমন পুচ্চু পুচ্চু। ”
দু’জনেই তড়িৎ বৃষ্টির দিকে তাকাল। এরপর নিজেদের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করল। কুয়াশা লজ্জা পেল শিশিরের দিকে তাকাতেই। শরীরে অদ্ভুত শিহরণ হলো৷ শিশিরেও একই অবস্থা হলো। সকলে মুচকি হাসল ওদের অবস্থা বুঝতে পেরে৷ কুয়াশা লজ্জাটাকে হটিয়ে বলল,
” এ্যাই দেখো আমার মতো লাগছে নাহ্! ওর নাকটা একদম আমার মতো হয়েছে। এই জন্যই এত কিউট হয়েছে।”
শিশির ভ্রু ম্রু কুঁচকে তাকাল৷ দিল একটা মাথায় চাটি বসিয়ে। কুয়াশা আহ্ করে উঠল৷ তার আনন্দের ব্যন্ড বাজিয়ে দিল এই বুনো ওলটা৷ আহ্লাদী কথাটার মূল্যই দিল না। ভ্রু কুঁচকে রেগেমেগে তাকাল। কিছু বলতে যাবে তৎক্ষনাৎ শিশির বলল,
” এ্যাই ও’কে তোর মতো কোন দিক দিয়ে লাগছে? ও হয়েছে একদম চাচুর মতো৷ দেখ কী সুন্দর কিউট হয়েছে চাচুর মতো। নাক, চোখ, ঠোঁট সব আমার মতো। বড় হলেও চাচুর মতো হবে একদম”
” ওরে..আমার কিউট রে! তোমার আবার সৌন্দর্য আছে নাকি? হুঁহ্! ”
বলেই সরে আসল শিশিরের থেকে৷ নীহার বলল,
” এ্যাই তোরা ঝগড়া কর যত করার। তার আগে আমার কাছে দে ও’কে।”
বলে কুয়াশার থেকে নীহার কোলে নিল৷ একে একে আম্বিয়া, তুহিনও নিল৷ সর্বশেষ শিশির কোলে নিল৷ শিশির কোলে নিয়ে নিজের গালের সাথে গাল লাগাল বাচ্চাটার৷ কুয়াশা দেখে হাসল৷ বাচ্চাটা শিশিরের ছোট ছোট খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি পেয়ে কেঁদে উঠল। কুয়াশা বলল,
” এ্যাই তোমার দাড়িতে বিঁধছে ওর। ”
শিশির তা শুনে ভাবল সত্যি হয়তো৷ তুষার, বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,
” ভাই, ভাবি! নাম কি রাখবে বেবির?”
কথাটা শোনা মাত্র কুয়াশা বলে উঠল,
” বর্ষণ মালিথা। ”
তুষার অদ্ভুতভাবে তাকাল কুয়াশার দিকে। বৃষ্টিও তাকাল অবাক চোখে। তারা কখনো বেবির নাম নিয়ে সকলে মিলে আলোচনা করেনি। ওরা দুজন শুধু ঘরে বলাবলি করত৷ তুষার, বৃষ্টি দু’জনই বলে উঠল।
তুষার বলল,
” আরেহ্ এটা আমিও বলেছিলাম!”
বৃষ্টি বলল,
” আরেহ্ এই নামটাই তোহ্ তোমার ভাই রাখতে চেয়েছিল।”
কুয়াশা আনন্দে আটখানা হয়ে উঠল নাম মিলে গেছে বলে৷ শিশির নাম শুনে বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আওরাল,
” তুষার বৃষ্টি, তুষার বর্ষণ!”
নীহার তা শুনে বলল,
” বৃষ্টির বিশেষ্য বর্ষণ! ”
এরপর শিশির, নীহার দুইজনই এক সাথে বলে উঠল,
” আরেহ্ বাহ্ সেই তোহ্! দুই জনের নামের সাথেই বর্ষণ মিলে! ”
কুয়াশা বলল,
” হ্যাঁ ”
তুষার, বৃষ্টি হাসল৷ জাকিয়া, আম্বিয়া একসাথে বললেন,
” মাশাআল্লাহ।”
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৫৯+৬০
সকলে অমায়িক হাসল। বাচ্চাটা সকলের মুখে আনন্দের ফোয়ারা তুলে দিয়েছে। একটি বাচ্চা ঘরে কতটা আনন্দ আনতে পারে চিন্তা করা যায়! সকলের মুখে যে আনন্দটা বিরাজমান একটু আগে তা আমাবশ্যা রূপে ছিল৷ মালিথা ভিলায় কখনো দুঃখ মানায় না৷ সব সময় হাসিখুশিতে পূর্ণ থাকবে তেমন টাই মানায়৷
