বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৬৭+৬৮

বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৬৭+৬৮
রোজা রহমান

সময় চলে গেছে স্রোতের ন্যায়। ঘড়ির কাঁটা তার আপন গতিতে চলতে চলতে সময় পাড় করে এক একটা দিন গিয়েছে। দিন গিয়ে মাস গেছে, মাসের পর মাস গিয়ে গেছে বছর। হ্যাঁ বছরও চলে গেছে। আর সেটাও একটা না! দুই দুইটা বছর সকলের জীবন থেকে পাড় হয়ে গেছে। শুধুই দুইটা বছর না দুইটা বছর গিয়েও গেছে আরো কয়েকটা মাস৷ মালিথা ভিলার প্রতিটা সদস্য তাদের ছেলেদের দূরে রেখে পাড় করে এসেছে দিন, মাস, বছর। খুব সহজ ছিল না দিনগুলো! অতিশয় কঠিন তা। আদর যত্নে বড় করা ছেলেগুলোকে দূর থেকে বহুদূরে দিয়ে তারাও ভালো দিন কাটাননি।
সকলে পেছনে ফেলে এসেছে দুইটা বছরের বেশি সময়। এই দুইটা বছরের বেশি সময় গিয়ে পাল্টেছে অনেক কিছু। সময়, দিন, মাস, বছরের সাথে অনেক কিছুই পাল্টেছে। মালিথা ভিলার প্রায় প্রতিটা সদস্যের জীবন একটু না একটু হলেও পাল্টেছে।

বিগত বছরগুলোতে মনের মাঝে চাপা কষ্ট রেখেও হাসিখুশি মালিথা ভিলা হেসেখেলে দিন পাড় করেছে৷ আগের মতো সকলে মিলেমিশে হাসিখুশি পরিবার থেকে দিন পাড় না করতে পারলেও নিজেদের স্বত্ত্বাকে তারা ধরে রেখেছে। মুটিয়ে যেতে দেয়নি দিনগুলোর সাথে। রঙিন দিনগুলো কখনো সখনো ফিরে পাবার আশা বুনেছে। অপেক্ষা করেছে কেউ কারো জন্য।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আজ মালিথা ভিলা সাজছে। সাজছে মালিথা ভিলার সদস্যদের মন৷ গত দুইটা বছরের বেশি সময় কাটিয়ে সাজছে এক নতুন রূপে। অপেক্ষা প্রহর তাদের কাটতে চলেছে৷ আপন মানুষের থেকে দূরে গিয়ে রয়েছে এক একটা ছেলে। জীবনের রঙ পাল্টিয়ে তারা এখন অন্যরূপে রঙিন।
সেই শুরুর মতো নিয়ম করে চলেছে দিন। কুয়াশা শিশিরকে দিনের পর দিন মিস করেছে। দুইটা বছরের বেশি সময় স্বামী ছাড়া কাটানোটা কিন্তু মুখের কথা না! এটা যারা থাকে তারাই একমাত্র বোঝে। দুইটা বছর গিয়ে সাথে কয়েকটা মাসও সে স্বামীর অপেক্ষায়। তার প্রিয় স্বামীর, তার জীবন সঙ্গী, তার অর্ধাঙ্গ, তার ঝগড়া, চুলোচুলির সাথী তার ভাষায় বুনো ওলের৷ এক একটা রাত নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বতা নিয়ে কাটিয়ে গেছে। কাটিয়েছে একাকিত্ব দিন৷ নির্জীব প্রাণ তার কারণ ছাড়া হাসেনি। পড়াশুনো সহ বাড়ির সকলের সাথে কাজকর্ম আর একটু আড্ডার মাঝে হাসি, মজা এই তার জীবনের গতিপথ ছিল।

শিশিরের রোজ সকালের এবং রাতের ভিডিয়ো কল সহ সময় সুযোগ বুঝে দিনে একটু আধটু কল দিয়ে কথা বলা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে তারা অধিক ভালোবাসার মাঝে একটা জিনিস ধরে রেখেছে সেভাবেই আর সেটা হচ্ছে, ঝগড়া। মা-রা মা-রি, চুলোচলি করতে না পারলেও ঝগড়ার মাধ্যমে তারা নিজেদের স্বত্ত্বাকে নিজেদের মাঝে ধরে রেখেছে। কথার মাঝে বাঁধিয়ে দিত ঝগড়া।
কুয়াশা এভাবেই হাসিখুশির মাঝে স্বামীর সঙ্গছাড়া হয়ে, তাকে পাশে না পেয়ে, একাকিত্বে নিজের অন্তরের সুপ্ত, সুক্ষ্ম বেদনাটাকে দমিয়ে রেখেছে। শিশিরের সাথে কয়েক সপ্তাহ পর থেকে নরমালি কথা বলত। সাথে পড়াশুনোর একাধারে সময় দিত৷

কুয়াশা এখন এলএলবি দ্বিতীয় বর্ষে। অবশ্য দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা সামনে তৃতীয় বর্ষে উঠবে। শিশির যে ল’ কলেজে এলএলবি করেছে সেখানেই ভর্তি হয়েছে। শিশিরের সম্পূর্ণ সাপোর্ট এবং ভালোবাসার শক্তিতে স্বপ্ন পূরণের পথে এগুচ্ছে। শুধু সে না স্মৃতিও হয়েছে এলএলবিতে ভর্তি। রিজভী তাকে অভয় দিয়ে ভর্তি হতে বলেছিল। শ্বশুরের সাথে সে নিজে কথা বলেছিল। কুয়াশা স্মৃতির সাথে এখন চলাফেরা করে। ঈশা অনার্স করছে সরকারি কলেজ থেকে। সে ম্যানেজম্যান্ট ডিপার্টমেন্টে। কুয়াশাদের সাথে বন্ধুত্ব সে ধরে রেখেছে৷

মালিথা ভিলায় দুইটা ছেলে সন্তানের বাস এখন। তুহিন আর হিম ছাড়া সকলে বাহিরে। শিশির, নীহার যাবার পর তুষারেরও পোস্টিং পাল্টায়। কুষ্টিয়া থেকে সে পোস্টিং পায় খুলনায়। শিশিররা যাবার মাস ছয়-সাতেক পরেই তার বদলি হয়। তুষার খুলনায় যাবার পর বৃষ্টিকে শাশুড়ীরা তুষারের সাথে চলে যেতে বলে খুলনাতে। কিন্তু বৃষ্টি রাজি হয়না।
তার কথা, সে এই মালিথা ভিলা ছেড়ে কোথাও যাবে না। তার সংসারের লোকজন ফেলে সে একা দিন কাটাতে পারবে না। শাশুড়ীরা হাজার বুঝিয়েও কাজ হয়নি। সে বাড়িতেই থাকে বর্ষণকে সাথে নিয়ে। তুষারও বউয়ের কথায় আর জোর করেনি। মেয়েটা তার পরিবার আঁকড়ে ধরে যদি চলতে পারে তো চলুক! তাই তুষার খুলনাতেই কোয়াটারে থাকে। ছুটি অবশ্য পায় না। যদিও কখনো সখনো পায় তাতেই আসার চেষ্টা করে বউ, ছেলে ও পরিবারের কাছে। বাড়ির বড় ছেলেটাই এখন বাহিরে থাকে।

বর্ষণ এখন বড় হচ্ছে। আধো বুলিতে সে কথা বলা শিখেছে। বয়স তার দুই বছর পাড় হয়েছে তো কথা শিখবে না? আধো আধো বুলিতে পাকনা পাকনা কথা বলার চেষ্টা করে। আর খুবই দুষ্টু হয়েছে। সারা মালিথা বাড়ি সে একাই মাথায় করে নিয়ে বেড়ায় ভাবটা এমন। তবে মা’য়ের খুব বাধ্য সন্তান হচ্ছে আর ফুপু ভক্ত একটা আদুরে। কুয়াশা বলতে সে পাগল৷ গুলুমুলু, দুষ্টু, দুরন্ত স্বভাবের ছেলে হয়েছে। কুয়াশার বর্ষণের সাথে দিন বেশি কাটে।
তুষার চলে যাবার পর তুহিন এবাড়ির অধিকাংশ দায়িত্ব একা পালন করে। বলতে গেলে সেই এখন পরিবারের ঢাল৷ বাবা জাহিদ মালিথার চাকরির বয়স ক্রমেই শেষ হয়ে আসছে। জাহিদ মালিথা এখনো পাবনাতেই আছেন। বাবা সেখানে থাকে, তুষার নেই, জাকির মালিথাও সংসারের দায়িত্ব থেকে দূরে তাই তুহিনেরই সব করতে হয়। তুষার সাহায্য করে দূর থেকে। এছাড়া মা’য়ের, বাবা, চাচুদের সাহায্য সে পেড়ে ওঠে।

ইয়াসমিন সংসার জীবনে অনেক সিরিয়াস। সে সংসার করে মন দিয়ে। তার জেদ অনুযায়ী অনার্স করার পর আর পড়েনি সে। এর পরেই বেবি নিয়েছিল। আল্লাহ দিয়েও ছিলেন কিন্তু ইয়াসমিনের মিসক্যারেজ হয়ে যায়। পাঁচ মাস গিয়ে ছয় মাসের মাঝে। মেয়েটা খুব ভেঙে পড়েছিল এতে৷ বাড়ির সকলের আশ্বাস ও শক্তিতে সে নিজেকে আবার প্রকাশ করে। তবে প্রথম প্রেগনেন্সি মিসক্যারেজ হবার পর এখনো তার জীবনে সুসংবাদটি আসেনি। মেয়েটা এটা নিয়ে মন খারাপ করে থাকে। তুহিন সব সময় অভয় দেয় বলে,

” আল্লাহ দিয়ে আবার নিয়েছেন তিনিই আবার দেবেন দেখো ”
ইয়াসমিন নিজেও এটা মনে করে এবং স্বামীর সাপোর্টে ভালো থাকার চেষ্টা করে।
হিম এখন বড় হয়েছে অনেক। সে এখন ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে। ছেলেটা উচ্চতায় যেমন বেড়েছে তেমনই বেড়েছে বুদ্ধিতে। বুদ্ধি, বিচক্ষণতা সকল ভাইদের থেকে বোধহয় এগিয়ে আছে ভাবটা এমন। বাড়ির সকলে বলত শিশির সকলের থেকে বেশি বুদ্ধিমান কিন্তু সেটার নাম এই হিম ঘুচিয়ে দিয়েছে। হবে না-ই বা কেন? ভবিষ্যত ডক্টর বলে কথা! বুদ্ধিমান না হলে চলে? হ্যাঁ তার স্বপ্ন সে-ও আর ভাইদের মতো কিছু হয়ে দেখাবে এবং সেটা আলাদা কিছু৷ আর সে স্বপ্ন বুনেছে ডক্টর হবে। তার স্বপ্ন পূরণের সঙ্গী হয়েছে বাড়ির প্রতিটা সদস্য।

আজমিরা হিমের এসএসসির রেজাল্ট দেখে কেঁদে দিয়েছিলেন৷ ছেলেটা এত ভালো রেজাল্ট করেছিল যে সকলের আনন্দে প্রাণ ভরেছিল৷ জাকির মালিথা তখন জানতে চেয়েছিলেন হিমের ভবিষ্যত পরিকল্পনা। তখনই আজমিরা জানিয়েছিলেন ছেলে তার ডক্টর হবার স্বপ্ন দেখে। সকলে অনেক খুশি হয়েছিল। জাকির মালিথা, জাহিদ, তুষার, তুহিন, শিশির, নীহার সকলে সম্পূর্ণ আশ্বাস দিয়েছিল। তবে আজমিরা তার সাথে একটা কথা সকলের কাছে জানিয়েছিলেন আর সেটা হচ্ছে, তার স্বামীর অংশ থেকে যেন হিমকে পড়ানো হয়। এমনিতেও ওটা হিমের ভবিষ্যতেই কাজে লাগবে৷ আরো নানান কথা বলেছিলেন। সকলে এ নিয়ে কথা বাড়ায়নি। বলেছিলেন এর বাইরে যদি প্রয়োজন হয় তো উনারা দেবেন৷ আজমিরা আর কথা বলেননি। সকলের মতামত নিয়ে হিম জীবনে এবং স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সে আগের মতোই প্রয়োজন ছাড়া চঞ্চলতা দেখায় না।

দেখতে শুনতে হয়েছে মাশাআল্লাহ। আজমিরা বাড়িতে ছেলে ও মেয়েকে আগলে রেখে দিন পাড় করছেন।
সকলের জীবনের সাথে পাল্টিয়েছে জাকির মালিথাও। তিনি এখন টুকটাক হাঁটতে পারেন৷ আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি দিন দিন সুস্থতা পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন৷ প্যারালাইসড পা’টা টেনে টেনে ফেলে হাঁটেন। আর হাতটা এখন ভালো মতোই নাড়াচাড়া করতে পারেন সবে কিঞ্চিৎ সমস্যা আছে এখনো। তিনি নিজে থেকে হাঁটতে পারলেও সিঁড়ি বেয়ে নামতে পারেন না। সেটাতে সাহায্য করা লাগে। এসব সব কৃতিত্ব জাকিয়া, কুয়াশার। তারা বউ, মেয়ে মিলে অনেক খেঁটেছে৷ ডক্টর জানিয়েছেন আরো কয়েক বছর গেলে আরো সুস্থতা পাবেন। তখন পা’টাতে কিঞ্চিৎ হলেও সমস্যা থাকবে কিন্তু অনেকটাই কমে যাবার সম্ভবনা আছে।
এছাড়া বাড়িতে আম্বিয়াও আগের মতো তার স্কুল এবং সংসার দুইদিকেই সমানভাবে চালিয়ে যান৷ সাথে জা’য়েদের সঙ্গ।

মালিথা ভিলা গতকাল থেকে সাজানো শুরু হয়েছে৷ সাজানো বলতে ডেকোরেশন করা হচ্ছে। অনেকটা জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই সাজানো হচ্ছে। সাজানো তো লাগবেই! বাড়িতে বিয়ে বলে কথা!! আশ্চর্য হবার কথা বললাম তো? কিন্তু এটাই সত্যি। মালিথা ভিলাতে আনন্দ আবার ফিরছে। বাড়ির ছেলেরা বাড়িতে ফিরেছে এবং ফিরছে৷
গত দুইদিন হলো নীহার এসেছে। সে এতগুলো দিন ট্রেনিংয়ে ছিল। তার জবের পদও কনফার্ম হয়েছে। সে এখন নেভির কমিশন্ড অফিসার। সব ঠিকঠাক করে বাড়িতে এসেছে। তার তিন সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। এই তিনটা সপ্তাহের ছুটিতে সে বিয়ে করে রেখে যাবে শশীকে। তেমনই কথা হয়েছে৷ এরপর আবার কবে সময় সু্যোগ হবে না হবে জানা নেই। তাই এই সিদ্ধান্ত। তবে এই বিয়ে তার কর্মস্থল থেকে সম্পূর্ণ গোপন রেখে করবে। যেটা ওর ডিপার্টমেন্ট জানবে না। কারণ সে বিয়ের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। অনুমতিবিহীন বিয়ে করবে।

সাধারণত ডিফেন্স জবে বিয়ের জন্য অনুমতি হয় জব শুরু হবার তিন বছর পর থেকে।
এদিকে তিনটা বছর হয়ে এলো শশীর সাথে তার আংটিবদল হয়েছে। এতগুলো বছর পাড় করে আর অপেক্ষা করাবে না শশীকে। গ্রামের একটা মেয়ের জন্য এটাও বেশ অস্বস্থিকর। শশী গ্রামে থাকে বিষয়টা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে৷
এছাড়া শশীও এখন অনেকটা বড় হয়েছে। লোকজনের চোখে পড়ে। গ্রামে এই জিনিসটা খুবই বাজে। এসব সব জিনিয়া জাকিয়াকে জানিয়েছেন যার জন্য বাড়ির সকলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নীহার বাড়িতে এলে বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ করা হবে৷ নীহার সম্পূর্ণ মত দিয়েছে।

শশী এখন সবে অনার্স প্রথম বর্ষে উঠেছে। নীহারের কথা সে মেনেছে। সুধু এসএসসিতে না। এইচএসসিতেও সে ভালো রেজাল্ট করেছে। প্লাস অবশ্য দুইটার একটাতেও জোটেনি। তবে খারাপও করেনি৷ পড়াশুনো সহ নীহারের বউ হবার আশা, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দিন পাড় করেছে৷
আর মাত্র দুইদিন পর শুক্রবারে তাদের বিয়ে। সেই খুশিতে মেয়েটা লাফিয়ে বেড়ায়। মানে, নিজের বিয়ে নিয়ে এমন বাচ্চামি এবং লাফালাফি কেউ করে? কেউ করে না তো কি হয়েছে? শশী করে। এই মেয়ে আলাদা সকলের থেকে৷ যেমন বাচ্চামি করবে তেমনই চঞ্চল। আগের মতোই একদম আছে। একটুও পাল্টায়নি নীহারের ইঁচড়েপাকা। নিজের স্বভাব বজায় রেখেছে।
মিহির এখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে আছে। তার আর ঈশার প্রেম এখন মাখোমাখো টাইপ৷ বাড়িতে অবশ্য আজো বলেনি কেউ।

শিশির আসছে আগামীকাল বুধবার। তার পড়াশুনো শেষ হয়েছে। হয়েছে অপেক্ষার শেষ। বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরছে নিজের সফলতা নিয়ে। আপনদের কাছে আসছে। প্রত্যক সদস্য তার প্রতিক্ষায় বসে। সে সান্ত্বনা দিয়ে গেলেও আসেনি বাড়িতে। নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থেকেছে৷ হাজার বলেও সে বাড়িতে পা দেয়নি। তার সিদ্ধান্ত সে একবারে বাড়িতে ফিরবে৷ বলা চলে জেদ। ইচ্ছে করলে আসতে পারত। বাড়ির সকলের সাথে দেখা করে যেতে পারত।

সে তার সফলতা পেয়েছে। আজ তার নামের আগে অ্যাডভোকেট যোগ হয়েছে। সে হয়ে উঠেছে দেশের মানুষের কাছে, সমাজের কাছে অ্যাডভোকেট শিশির মালিথা৷ তাকে এখন সকলে চিনবে তার অর্জন করা নামে। ডাকবে অ্যাডভোকেট শিশির মালিথা। বার কাউন্সিল পরীক্ষায় সে এবং রিজভী সব থেকে ভালো নাম্বারে উত্তীর্ণ হয়েছিল৷ এরপর তারা বিসিএসের প্রস্তুতি নেয়৷ বিসিএস এর জন্যও যথেষ্ট খাটাখাটুনি করেছে। আল্লাহ সফলতা শিশিরকে দিলেও রিজভী সফলতা পায়নি। শিশির বিসিএস টিকেছে। রিজভী এই একটা জায়গাতে হেরে গেছে। যদিও চেষ্টা কম করেনি সে!
মাস খানেক আগে বিসিএসের রেজাল্ট পায় তারা৷ ক্যাডারদের মাঝে শিশিরের নাম পেয়ে আনন্দের ফোয়ারা ঝরে সকলের৷ রিজভী নিজের ব্যর্থতা পেছনে ফেলে বন্ধুকে নিয়ে মেতেছিল। সকলে তো সফলতা পায়না তাই না? তো সে-সব কি ধরে রাখলে চলে? এবার হয়নি সমস্যা কী? সে আবার চেষ্টা করবে প্রয়োজনে৷ কিন্তু আগে সে বন্ধুর সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করেছে। সে-ও একজন অ্যাডভোকেট৷

শিশির ম্যাজিস্ট্রিট পদ গ্রহণ করেনি৷ ভাবনা অনুযায়ী অ্যাডভোকেটেই আছে৷ সেসব ঠিকঠাক করার জন্য তার কিছু সময় চলে গেছে বিধায় আগামীকাল তারা বাড়িতে ফিরছে।
নীহার বাড়িতে এসে এক আনন্দ এনেছে তো আগামীকাল শিশির আসাতে আরেক আনন্দ নিয়ে আসছে। বাড়ির ছেলেরা বাড়িতে আসছে সবার আনন্দ এসে এসে ধরা দিচ্ছে মন কুঠুরিতে। তুষার বৃহস্পতিবার আসবে দুইদিনের ছুটিতে।

” তাতু তাতু..! ”
বর্ষণের আধো আধো তোতলানো ডাকে নীহার বসার ঘর থেকে উত্তর নিল,
” হ্যাঁ, চাচু!”
নীহার উত্তর নিতেই সে হাত বাড়িয়ে দিল। অর্থাৎ কোলে নিতে হবে তাকে৷ গুটিগুটি পা’য়ে কিলবিলিয়ে বেড়ায় এখন৷ সে আদুরে হয়েছে শিশিরের মতো। জাকিয়া বৃষ্টিকে বলে শিশির এই ভাবে আদুরে হয়ে সকলের আদর নিত। আর দুষ্টুমিও ঠিক চাচুর মতো করে। বর্ষণ দেখতে অনেকটা শিশিরের মতোই হয়েছে।
নীহার বর্ষণকে হেসে কোলে নিল। এসে পর্যন্ত এই দুষ্টুর দুষ্টুমি দেখছে। নীহার আসলে বৃষ্টি একবার শুধু বলেছে,
” এটা তোমার চাচু হয়।”

ব্যস তাকে আর পায় কে? তার আদর করার লোক বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা? তুহিন, হিমকে তাতু তাতু বলে ফ্যানা তুলবে। কুয়াশাকে পুপি বলে। ফুপি আসে না। দাদা টা স্পষ্টই আসে মুখ থেকে৷ জাকিয়াকে দিদি বলে। দাদি আসে না। শুধু জাকিয়া, জাকির মালিথাকে না আজমিরা, আম্বিয়া, জাহিদ মালিথাকেও ওভাবেই ডাকে।
নীহার বর্ষণকে কোলে নিলে সে নীহারের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধের উপর মাথা এলিয়ে দিল। নীহার মুচকি হাসল। বলল,

” আমার চাচুর কি হয়েছে? ”
” কিতু না। ”
নীহার আবার হাসল। বলল,
” সকালে খেয়েছে আমার চাচু? ”
” হুম কেয়েতি। ”
বলে সে নীহারের টিশার্টের সামনের বোতাম নিয়ে খেলা ধরল৷ ইশশ বাড়িতে একটা ছোট্ট বাচ্চা হয়েছে৷ কী সুন্দর কথা বলছে! ভাবতে ভাবতে নীহারের ফোন বেজে উঠল। শশী ফোন দিয়েছে৷ সে রিসিভ করে কথা বলতে লাগল।

কুয়াশার ঠোঁটের কোণা থেকে আজ হাসি সরছেই না যেন৷ আনন্দের ফোয়ারা ঝরছে। আনন্দ হবে না? তার স্বামী তার ভালোবাসা আসছে। কতদিন পর আসছে! ইশশ এই অনুভূতি কি প্রকাশ করা যায়!! কখন যে আসবে কালকের দিনটা! আজকের এই দিনটা যেন যাচ্ছেই না।
কুয়াশার হাসিখুশি মুখ সকলে লক্ষ্য করছে। আজ কতদিন পর তার আনন্দ দেখছে সকলে? এমন আনন্দ আজ কতদিন পর দেখছে! আজমিরা মেয়ের আনন্দে তিনিও আনন্দিত হচ্ছেন।
জাকিয়া দুইটা ছেলেকে কাছ ছাড়া করে শূণ্য হয়ে পড়ে থাকেন৷ ছেলে আসার খবরে তিনিও আনন্দে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাচ্ছেন। বাড়িতে বিয়ের কাজ সহ ছেলে আসার আনন্দ উপভোগ করছেন৷

সারাটাদিন গিয়ে রাত এসেছে৷ নয়টার পর খাওয়া দাওয়া করে বসার ঘরে সকলে বসে গল্পগুজব সহ বিয়ের কথাবার্তা বলছে। এমন সময় শিশির ভিডিয়ো কল দিল কুয়াশার ফোনে। কুয়াশা রিসিভ করতেই নীহার পাশে থেকে কথা বলল। জানতে চাইল কখন রওনা দেবে৷ শিশির জানাল ভোর ছয়টায় গাড়িতে উঠবে। এরপর সকলের সাথে আড্ডা দিল। সবার সাথে কথা বলা হয়ে গেল কুয়াশা ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে নিজেদের ঘরে চলে এলো।
ঘরে এসে বিছানায় আয়েশ করে বসল৷ শিশির বউয়ের দিকে তাকিয়ে৷ দিন দিন তার আহ্লাদী বউটা কি আরো অপূর্ব সুন্দরী হচ্ছে? ভেবে সে বউকে জ্বালানোর জন্য বলে উঠল,

” এ্যাই! এত সুন্দরী হচ্ছিস কেন বলত? দেখ এখনো পুরো রাতটা কাটাতে হবে আমার এই ঢাকাতে! এখনই এখানে এমন নিয়ন্ত্রণ হারা হতে পারব না।”
কুয়াশা শুনে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল৷ কটমট করতে করতে বলল,
” এ্যাই তোমার মুখে কিছু আটকায় নাহ্? মন চাই চুলগুলো ছিঁড়ে দিতে। একবার আসো শুধু!”
শিশির ভিতরে ভিতরে হাসল। মুখে প্রকাশ করল না। বলল,
” বিশ্বাস কর এই দুইটা বছর আমার চুলগুলো শান্তি তো পেয়েছেই সাথে গজিয়েছেও অনেক। এই দেখ। ”
শেষ কথাটা বলতে বলতে সত্যি সে মাথা নিচু করে কুয়াশাকে চুল দেখাল। কুয়াশা কিড়মিড় করতে করতে বলল,

” খুব মজা লাগে নাহ্? আসো কাল সব ছিঁড়ব। ”
” কি কি ছিঁড়বি তুুই আমার? দেখি লিস্ট দেখা! ”
কন্ঠে এবং কথায় স্পষ্ট দুষ্টুমিতে ভরা তার। সে কথাটা বলতে বলতে বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুলো। রিজভী পাশে নেই সে বাহিরে গেছে কিছু দরকারে। তাই এখন এমন ফাজলামোগুলো করে মজা পাওয়া যাবে৷ রিজভী থাকলে সে কুয়াশার সাথে ডিপলি মজা করে না৷ যতইহোক বউ তার! হাজার রিজভী বন্ধু হোক না কেন সে চায় না বউ তার অন্য পুরুষের সামনে আনইজি ফিল করুক।
কুয়াশা আবার রাগল। বলল,

” ঠোঁট কাটা পুরুষ লোক৷ সত্যি তোমার সব ছিঁড়ব।”
” আচ্ছা দেখা যাবে তোর জোর কতটা হয়েছে৷”
কুয়াশা চোখ গরম করে তাকাল৷ সামনে থাকলে এক চালান বেঁধে যেত নির্ঘাত! চুল শিশিরের থাকত না আর। শিশির, কুয়াশা এগুলো এই বছরগুলোতে হাজারবার মিস করেছে। শিশির এবার আদুরে ভোল ধরল। বলল,
” এ্যাই সোনা! ”
কুয়াশার মূহুর্তের মধ্যে রাগ পড়ে গেল। এটাও হয়ে আসছে বিগত দিনগুলোতে। কুয়াশা রাগ করলে এইভাবে ডাকবে আর কুয়াশার তৎক্ষনাৎ রাগ উধাও হয়ে যাবে। স্বামী তার এত সুন্দর করে এই ডাকটা দেয় একদম বুকে এসে বাড়ি দেয়। কুয়াশা তাকাল শুধু কথা বলল না। শিশির মুচকি হেসে বলল,

” ভালোবাসি আমার আহ্লাদী বউকে।”
” তোমার আহ্লাদীও ভালোবাসে তার প্রিয় স্বামীকে। ”
তারা এখন দুই সময়ে দুই ধরনের নামে সম্বোধন করে একে অপরকে। ঝগড়ার সময় ডাকে বুনো ওল আর গোবর ঠাঁসা বলে কিংবা রাগানোর জন্য বলে ডাকে নয়তো মুড একদম ফুরফুরে আর ঝগড়া করার মুডে থাকলে এগুলো বলে ডাকাডাকি করে। আর যখন দু’জন দু’জনের প্রতি ভালোবাসা এক্কেবারে উতরে উতরে ওঠে! তখন এই যে, এমন আহ্লাদের ডাক ডাকে।
শিশির হাসল কুয়াশার কথায়। বলল,

” কখন সকাল হবে বলত? কখনই বা তোর কাছে পৌঁছাব? তড় যে আর সইছে না রে বউ!”
কুয়াশা লজ্জায় নূয়ে পড়ল৷ ঠোঁটে এবং মুখে লজ্জাময় হাসি। লালাভ হয়ে উঠল কোপলজোড়া। চোখ বন্ধ হয়ে এলো। শিশির তাকিয়ে দেখল তা। আবার বলল,
” বুকে অনেক আদর জমেছে বুঝলি! গিয়ে কিন্তু সব ঢেলে মুছে দেব! মানা করতে পারবি না! প্রস্তুত হ। আসছি আমি।”
কুয়াশা আরো নূয়ে পড়ল৷ তবে উত্তর করল,
” আমি প্রস্তুত। মানা করব না একটুও। জলদি আসো৷ আমি অপেক্ষা করব৷ ”
বলে থামল৷ এরপর সে-ও বিছানায় শুলো৷ তার শোবার ধরন টা বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে বই পড়ার মতো৷ আবার বলল সে,

” তোমার ঐ বুকটা আমার বড্ড প্রয়োজন। প্রতিটা রাত খুঁজেছি আমার শান্তির জায়গা। আজকের এই রাতটাও খুঁজে বেড়াব৷ কাল থেকে পাব তো? ”
” হুম পাবি৷ আর কিছু ঘন্টা কষ্ট করে নে সোনা। এরপর তোকে বুকে নেব। আমিও যে জ্বলছি আমার তোর জন্য।”
কুয়াশার চোখ টলমল হয়ে উঠল৷ ভালোবাসা এক ছিটেফোঁটাও কমায়নি তার স্বামী৷ বরং বেড়েছে আরো৷ দূরত্ব এতটা ভালোবাসা বাড়াবে তার ধারণা ছিল না। আচ্ছা সকল দম্পতিদেরই কি এমন হয়? থাকে কি তাদের ভালোবাসা অটুট দূরে গেলে? নাকি শুধু তাদের আছে? শুধু শিশির বলে এমন? এ ছেলে বলে গেছিল বাড়িতে তিন কবুলের বউ রেখে অন্য মেয়ের দিকে তাকানোর প্রয়োজন পড়বে না। সত্যি সে কথা রেখেছে। তার একমাত্র আহ্লাদী বউ ছাড়া সে কোনো মেয়ের প্রতি আসক্ত হয়নি৷ হলে কি এতটা ভালোবাসা থাকতো তাদের? উহু থাকত না৷ একদম খাঁটি পুরুষ, খাঁটি তার ভালোবাসাও ভেবে নিয়ে বলল,

” ইনশাআল্লাহ, তুমি ভালোভাবে আসো আমার কাছে। ”
শিশির এবার নিজের আবেগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে নিল৷ দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। বলল,
” রাখছি এখন৷ খাওয়া হয়নি এখনো৷ ফ্রি হয়ে কল দেব আবার। ”
” আচ্ছা, আল্লাহ্ হাফেজ।”
” আল্লাহ হাফেজ। ”
বলেই কল কাটল শিশির। আবার একটা জোরে শ্বাস নিল আর ফেলল৷ শুধু রাতটা গেলেই হয়। বাড়িটার প্রতি মনটা ছটফট করছে৷ এতগুলো দিন, মাস কাটিয়ে দিল অথচ আজকের রাতটা মনে হচ্ছে অনেক বড়। শেষই হবে না যেন৷ তবুও জলদি শেষ হোক এ রাত।

আজকের সকালটা একদম অন্যরকম মনে হচ্ছে। সকালের মৃদুমন্দ সমীরণের সাথে সকলের মনটাও ফুরফুরে। হাসিখুশি সাথে আনন্দয় পূর্ণ মালিথা ভিলা।
সকাল সকাল সকলে উঠে পড়ছে। আজ বাড়িতে বিয়ের আমেজের সাথে আরো একটা আমেজে পরিপূর্ণ। আজ শিশির আসছে। বাড়ির সকলের আদরের ছেলে আসছে এতগুলো দিন বাদে৷ শুধু শিশির আসারা তোড়জোড়ই যে চলছে তা না৷ আজ সকল আত্মীয় স্বজনরাও আসা ধরবে। আগামীকাল নীহার, শশীর গায়ে হলুদ৷
আম্বিয়ার বোনরা আজই আসবেন। আসবে অয়ন, অনি অভিরাও। অভি অবশ্য আগামীকাল আসবে। অভির বিয়ে শিশিরের বিয়ের কিছুদিন পড়েই হয়ছিল৷ বিয়ে হয়ে গেছে অনিরও। এখন শুধু অয়নের বিয়ের তোড়জোড় চলছে। অয়ন কুয়াশার পর আর কোনো মেয়ে পছন্দ করতে পারেনি। তাই বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা পরিবারের হাতে ছেড়ে দিয়েছে৷ ছেলেটা কুয়াশাকে সত্যি ভালোবেসেছিল। সে পড়াশুনো শেষ করে একটা সরকারি ব্যাংকে জব করছে মাস কয়েক হলো।

ঈশারাও আজ মালিথা ভিলায় আসবে। আমিনুল হক, মুনিরাকে আম্বিয়া আগেই আসতে বলেছিলেন কিন্তু উনারা আজ আসার কথায় বলেছেন।
বিয়ের জন্য খুববেশি বড় আয়োজন হচ্ছে না। কিন্তু একদম ছোটও হচ্ছে না। মোটামুটি সবকিছুই ভালোভাবে আয়োজন করা হচ্ছে। শশীর বাড়িতে বড় করে সব আয়োজন করা হচ্ছে। একমাত্র মেয়ে পাড় করবেন কিনা!! একমাত্র মেয়ের জন্য হানিফ সাহেব আয়োজনের কোনো ত্রুটি রাখবেন না। সম্পূর্ণ আয়োজনের সাথেই মেয়েকে পাঠাবেন৷
বাড়ির তিন জা আপাতত সকালের নাস্তা করে দুপুরের রান্নার আয়োজনে লেগেছে৷ অনেকে আসবে সেই হিসেবে রান্না হচ্ছে আজ আর বাবুর্চি আনেননি৷ আগামীকালই আনবেন৷ মা’য়েদের সাথে আয়োজনে হাতে হাতে লেগেছে বৃষ্টি, ইয়াসনিন, কুয়াশাও।

কুয়াশা আগের থেকে একটু শরীরের দিক থেকে ভালো হয়েছে৷ দেখতে এই জন্যই আরো বেশি সুন্দরী লাগে। আগে ছিল মেদহীন, চিকনচাকন ছিমছাম শরীর। এখন একটু মাংস টাংস হয়েছে আরকি৷ গাল জোড়া একটু ফুলেছে সাথে লম্বা শরীরটা বেড়েছে বলে আকর্ষণীয় লাগে। যদিও আগেও সে আকর্ষণীয় সুন্দরীর অধিকারী ছিল৷
হাসিখুশি মুখ নিয়ে কাজ করছে৷ সে আর বৃষ্টি মিলে মাংস কাটছে৷ বৃষ্টি আস্তে করে বলল,
” কুশু..! তোমার যে স্বামী আসার আনন্দ সর্বশরীরে প্রকাশ পাচ্ছে গো!! এমন রূপ দেবর আমার আজ দেখেই ফিদা হবে ”

কুয়াশা তাকিয়েছিল বৃষ্টির ডাকে কিন্তু কথাগুলো শুনে শরীরের শিরায় শিরায় শিহরণ হলো৷ স্বামী আসার সুখ যে তাকে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে সেটা তো সে নিজেই টের পাচ্ছে। এখন বাহিরের সকলেও টের পাচ্ছে? আচ্ছা কীভাবে টের পাচ্ছে? লেখা টেখা আছে নাকি!! ভেবেই মনের অজান্তেই নিজের শরীরের দিকে তাকাল। কিন্তু কিছু পেল না৷ উত্তর করল,
” কী যে বলো না ভাবি!! ”

বৃষ্টি হাসল ফিক করে। আবার কাজে মনদিল। কুয়াশা ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে রেখে নিজের কাজ করতে লাগল।
বসার ঘরে বর্ষণকে নিয়ে মেতেছে নীহার, হিম, জাকির মালিথা। তিনজন দুষ্টু বর্ষনের কথা এবং কাজে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবার জোগার৷ তুহিন আজ অফিসে গেছে। জাহিদ মালিথাও আগামীকাল আসবেন। বাড়ির ডেকোরেশন আজই কমপ্লিট হয়ে যাবে। সে-সবের দিকে নজর নীহার আর হিমই রাখছে। তাছাড়া তো এখনো কেউ আসেনি!
বর্ষণ দাদুর কোলে বসে আছে। জাকির মালিথা দাঁড়ি রেখেছেন বছর দেড়েক হলো। খুব বেশি বড় না আবার ছোট্টও না। মাঝারি দাঁড়ি গুলো ধরে শুধু টানবে বর্ষণ৷ তার এত ভালো লাগে এটা করতে৷ জাকির মালিথা নাতিছেলের কাজে শুধু হাসেন৷

বর্ষণ এবার নেমে হিমের কোলে গেল৷ হিমকে সে ভালোই পায় বাড়িতে। হিমকে বৃষ্টি কুটি চাচু ডাক শিখিয়েছে৷ কিন্তু সে কুটি বলতে পারে না। কখনো যদি বলা হয় যাও কুটি চাচুর কাছে যাও তখন হিমকে ডাকবে,
” কুতি তাতু ”
পরে আর ডাকে না। শুধু চাচুই বলে৷ হিমের কোলে গিয়ে হিম খেলনা হাতে দিল। সে সেই খেলনা নিয়ে খেলা ধরল।

শিশির, রিজভী ভোর ছয়টাতে গাড়িতে উঠেছে। দুপুর একটার আগেই চলে আসবে জানিয়েছে৷ তারা আজো কারে করেই আসছে। শিশির রিজভীকে আগে নামিয়ে আসবে তারপর তার বাড়িতে আসবে। রিজভী প্রথমে নিজের বাড়িতে যাবে এরপর রাতে স্মৃতির সাথে দেখা করবে এমনটাই কথা হয়েছে৷ আগামীকাল শিশিরদের বাড়িতে আসবে ওরা। নীহারের বিয়েতে রিজভী আর স্মৃতিকেই শুধু দাওয়াত করা হয়েছে।
ঘড়ির কাটা সকাল এগারোটা পাড় হয়েছে। আপাতত কুয়াশাদের আর রান্নাঘরে কাজ নেই। যা আছে মা’য়েরা করে নেবেন। বৃষ্টিরা তিনজনেই বের হয়ে এলো। এসে সোফায় বসল। জাকির মালিথা উপরে চলে গেছেন৷ হিম, নীহার সাহায্য করে এসেছে। নীহার আর হিম বসার ঘরে ছিল। সেখানে বসতেই বর্ষণ

” মা মা।”
বলে বৃষ্টির কোলে এলো৷ মা মা করে যখন ডাকত প্রথম প্রথম বৃষ্টির অনুভূতি ছিল না বলা ভাষার মতো। মা ডাকের সাথে সে দাদা ডাক শিখেছিল। তারপর বাবা ডাকত৷ তুষারকে বাবা ডাকে৷ ভিডিয়ো কলে দেখলেই বাবা ডাকবে৷
সেখানে বসে আড্ডা, মজায় মাতল সকলে৷ ইয়াসমিন, নীহার আজো আগের মতোই ফাজলামো করে তুই করেই বলে৷ তেমন ভাবেই আজো ফাজলামো করছে৷

দুপুর বারটার দিকে কুয়াশা গোসল সারল। গোসল করে হালকা গোলাপি এবং সাদা মিশেলের একটা প্রিন্ট কটন সুতির লং থ্রিপিচ পরেছে৷ আজ সে শিশিরের ঘরেই গোসল করেছে৷ এবং সকাল থেকেই সেখানে। মিররে সামনে গিয়ে নিজেকে দেখল কিছুক্ষণ। চুল থেকে তোয়ালে খুলে চুল মুছল৷ এরপর হাতে মোটা বালা সহ, কানে সোনার দুল, চেইনটা এখন গলাতে থাকে কিন্তু দুল সে খুলে রাখে রাতে শুতে অসুবিধা হয় খুব৷ যখন প্রয়োজন হয় পরে। পরে নিয়ে একটু সাজল হালকা পাতলা। স্বামী আসছে তার স্পেশাল না লাগলে চলবে!!
সেজে ঘড়ির কাটার দিকে তাকাল৷ সাড়ে বারটা বেজে গেছে। আর কতক্ষণ!! তড় যে আর সইছে না! সে ভেজা রাখল চুল। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে না শুকিয়ে৷ ভেজা চুলই আঁচড়াল। নিজেকে পরিপাটি করে ফোন হাতে নিয়ে একটা ছোট্ট টেক্সট করল স্বামীকে,

” আর কতক্ষণ?”
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণের মাঝে রিপ্লাই এলো। যা দেখে তার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল৷ সর্বাঙ্গ অবস হলো। কাটার ন্যায় লোমগুলো বিঁধল৷ যেন এখান থেকে একপাও ফেলে নিচে যেতে পারবে না৷ তার শিরা-উপশিরায় কাঁপন শুরু হলো৷ এ যে স্বামীর জন্য আনন্দ! তার প্রিয় স্বামী তার কাছে ফিরছে৷ তার ভালোবাসা তার কাছে ফিরছে৷ আজ দুইটা বছরের বেশি সময় পর তাকে ছুঁতে পারবে, তাকে চোখের সামনে দেখতে পাবে, তার বুকে মাথা রাখতে পারবে যেটা তার শান্তির স্থান। তার সেই শান্তির স্থান কেউ দখল করতে পারেনি দুইটা বছরে৷ তার স্বামী করতেই দেয়নি একদম। তার জন্য দলিল করে রেখেছে। তার বুক শুধু আর শুধু মাত্র তার একমাত্র বউয়ের।
ঝটপট সে নিচে চলে গেল। আর মাত্র কিছু মিনিট এরপরেই সেই চেনা শরীরের গন্ধ সে পাবে। যেটা তার নেশা, আফিম৷

বারটা পয়তাল্লিশ সেসময়ে সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটার গাড়ি এসে থামল মালিথা ভিলার সামনে৷ আপন মানুষ আপন বাড়িতে ফিরল। তার জেদ বজায় রেখে সে দুইটা বছর ঢাকা শহরে পড়ে ছিল।
গাড়ির হর্ণের আওয়াজে নীহার, হিম বাহিরে বেড়িয়ে এলো। মেয়েরা সকলে বাড়ির ভেতরেই আছে সাথে জাকির মালিথা।
শিশির নামল গাড়ি থেকে। সেই চেনা বাড়ি তার চোখের সামনে। সেই চেনা মুখ তার চোখের সামনে। এতসব চেনা মুখ ছেড়ে সে ছিল অচেনা মুখের ভিড়ে৷ নীহার অমায়িক হাসল বলল,

” ওয়েলকাম ব্যাক অ্যাডভোকেট শিশির মালিথা”
বলেই ভাইকে জড়িয়ে ধরল৷ শিশির অমায়িক হাসল৷ সে-ও ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নীহার বলল
“অভিনন্দন, তোর সফলতা পেয়েছিস তুই।”
শিশির হাসল, বলল,
” তোকেও অভিনন্দন ভাই। নেভির অফিসার! বিশ্বাসই হচ্ছে না তাকে আমি জড়িয়ে ধরেছি! ”
শিশিরের কথা শুনে নীহার হেসে জড়িয়ে রাখা অবস্থাতেই পিঠে একটা আলত চাপ্পড় বসাল৷ বলল,
” ফাজিল, আগের মতোই রয়েছিস! ”
” হ্যাঁ একটুও পাল্টায়নি দেখ ”
” হু, আমার ভাই, একটুও পাল্টায়নি। তা আমি যে সনামধন্য মানুষকে জড়িয়ে ধরেছি তার বেলায়? একজন বিসিএস ক্যাডার আরো অ্যাডভোকেট ভাবা যায়!! তাকে জড়িয়ে ধরে আছি! আমার হজম করতেই কষ্ট হচ্ছে তোহ্! ”
শিশির হেসে ফেলল শব্দ করে৷ তারা সকলে সফল। এক একজন সফল মানুষ হয়ে হয়ে গড়েছে নিজেদের৷ সে-সময়ে হিম বলে উঠল,

” আরেহ্ আমাকে তো তোমরা দেখো? পাত্তাই যে দিচ্ছ নাহ্?”
দুইজনই হিমের কথা নিজেদের ছেড়ে দিয়ে তাকাল৷ পাশে হিমকে দেখে শিশির টাস্কি খেল। বলল,
” তুই কে? ”
ল্যাহ্ হিম, বলে কী এ!! নীহার হেসে ফেলল শব্দ করে। বলল,
” আমিও এমন টাস্কি খেয়েছিলাম প্রথমদিন৷ দেখ সেই হিম আর নেই কত লম্বা হয়েছে!”
হিম বলল,
” তোমরা এমন ভাব ধরেছ যেন আমি চিরকাল সেই লেদা বাচ্চা হিমই হয়ে থাকব! বড় টড় আর হব না। আমিও এখন বড় হচ্ছি হুহ্। দুই চারটা গার্লফ্রেন্ডও পুষছি আর শিশির ভাই তোমার শা-লা আমি চিনছ নাহ্ আমায়? স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেললে নাকি? ”
” তাই নাহ্? ”
হিমের কথায় শিশির বলে উঠল। বলে হিমকে মেকি ভাব নিয়ে মারতে গেল। হিম সহ শিশির, নীহার হাসল। শিশির বলল,

” দেখ পিচ্চি শালা এত বড় হয়ে গেছিস ঠিক আছে৷ কিন্তু রূপ তোর এমন ঝিলিক দিচ্ছে কেন? এই তোরা ভাই বোন একসাথে সুন্দর হচ্ছিস কাহীনি কি বল তোহ্? ”
” হারবাল ফেসিয়াল করছি বুঝলে তোহ্। তোমাদের থেকে দ্বিগুণ সুন্দর হতে হবে। সেটারই চেষ্টা চালাচ্ছি। ”
শিশির হেসে হিমকে জড়িয়ে ধরল।আদর করল। হিমও ভাইকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
” কেমন আছো ভাই? ”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোরা কেমন আছিস?”
” আমরাও ভালো আছি। ”
এরপর নীহার ভেতের যাবার তাগাদা দিল৷ তিনজনে মিলে এবং ড্রাইভার মিলে জিনিসপত্র গুলো বাড়ির ভেতরে নিয়ে এলো৷

শিশির বাড়ির ভেতরে পা দিতেই নাকে সেই চেনা মালিথা ভিলার গল্প পেল। মেইন দরজার সামনে আসতেই এক একটা মানুষকে চোখের সামনে পেল৷ সকলে তার অপেক্ষায়৷ ইশশ কী সুন্দর অনুভূতি!! চোখের মানসপটে সকলকে দেখল৷ তার মা, বাবা, চাচি, বউ, ভাবি সহ পিচ্চি বর্ষণও৷ বর্ষণ ফুপুর কোলে ঘুমিয়ে গেছে। জাকিয়ার চোখটা ভরে এলো। এক মানিককে তো পেলেন!! সকলের ঠোঁটে হাসি। জাকির মালিথা এগিয়ে গেলেন৷ বাবা হাঁটতে পারে জানে শিশির৷ আজ দেখে আবেগী হয়ে উঠল। দরজার সামনে থেকে ভেতরে ঢুকে বাবাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। বলল,

” আমার বাবা! কেমন আছো বাবা? ”
হাসলেন জাকির মালিথা। বললেন,
” আমার ছোট বাবা! আমি ভালো আছি ”
বাবাকে ছেড়ে মা’য়ের দিকে তাকাল। জাকিয়ার কাছে এগিয়ে গেল। জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। আহ্ শান্তি!! সেই চেনা গন্ধ। মা মা। জাকিয়া টপটপ করে চোখের পানি ফেললেন৷ বললেন,
” আমার ছোট মানিক, আমার বুকের মানিক ফিরেছে মা’য়ের কাছে। ”

শিশির আবেগি হয়ে উঠল৷ মা’কে জড়িয়ে রেখে মায়ের কাঁধের উপর চুমু দিল। এরপর জাকিয়াকে ছেড়ে দিল। জাকিয়া ছেলের কপালে চুমু দিলেন। শিশির হাসল৷ এরপর একে একে দুই চাচিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরল। কেমন আছে জিজ্ঞেস করল। তারা উত্তর দিলেন আজমিরা মেয়ে জামাইকে আদর করলেন৷ আম্বিয়াও করলেন।
কুয়াশা এক পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বর্ষণকে কোলে নিয়ে। সে শুধু পলকহীন দেখেই যাচ্ছে তার স্বামীকে৷ দেখেই চোখ জুড়চ্ছে যেন। তবুও শান্তি মিটছে না চোখের। চোখের পলকও ফেলছে না৷ মুচকি হেসে হেসে কথা বলছে স্বামী তার৷ তার হৃদয়ে এসে বাড়ি দিচ্ছে তা দেখে। অবশেষে সে ফিরেছে।

শিশির কুয়াশার দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে বউটার৷ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসল। কুয়াশা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না৷ অভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। শিশির বৃষ্টি, ইয়াসমিনের কাছে গিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল। এরপর কুয়াশার কাছে এগিয়ে গেল। কুয়াশা তাকিয়েই রইল৷ নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল ভেতরে ভেতরে। পরিবারের সামনে কোনো প্রকার লজ্জাজনক আবেগ দেখাবে না৷ স্বামীর শিক্ষা এটা। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। করছে শিশিরেরও। মা-বাবার সামনে কিভাবে নিজের ভেতরের অনুভূতিটা বোঝাবে বুঝছে না। এতদিন পর সামনে থেকে দেখছে!!
কুয়াশা এবার চোখের পানি ছেড়ে দিল। কিন্তু তা নিরবে। শিশিরের চোখমুখ লাল হয়ে উঠছে৷ তবুও নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে অতি কষ্টে। মুচকি হাসল। কুয়াশার চোখের পানি মুছিয়ে দিল৷ সকলে হাসল কুয়াশার অবস্থা দেখে৷ শিশির বলল,

” কেমন আছিস গোবর ঠাঁসা? ”
আর সহ্য হলো না। শিশির বুকে মাথা ঠেকিয়ে দিল বর্ষণকে নিয়েই। ঝরঝর করে কেঁদে দিল। নিজেকে ধরে রাখার খুবই চেষ্টা করেছে। কিন্তু ঐ যে বলে না? আবেগ কি আর মানুষ মানে? তার যে বুক পুড়েছে মানুষটার জন্য। শান্ত থাকে কি করে? ভালোবাসা জিনিসটাই এরকম৷
কুয়াশা কপাল ঠেকিয়ে দিয়ে কাঁদল। বর্ষণ উঠে গেছে কান্নার আওয়াজে। শিশির একহাতে জড়িয়ে ধরল আলতো করে৷ হাসল কিঞ্চিৎ সকলে মেয়ের কাণ্ড দেখে৷ শিশির কিছুক্ষণ পর বলল,
” চুপপ!”
বলে কুয়াশাকে তু্লে চোখ মুছিয়ে দিল। বর্ষণকে দেখল৷ সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে ঘুম ভেঙে। শিশিরকে সে ভিডিয়ো কলে দেখে৷ কিন্তু সরাসরি দেখে হয়তে তার ছোট্ট মস্তিষ্ক ভাবছে, ‘এটা কে!’ সে একবার ফুপুর দিকে তাকাচ্ছে এবার চাচুর দিকে৷ মাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। শিশির বর্ষণকে কোলে নিল৷ ছেলেটা এই দিক খুবই ভালো। কাঁদে কম৷ যে-সে কারো কাছেই যায়। আদুরে কিনা!!
শিশির কোলে নিয়ে চুমু খেল ছেলেক৷ বলল,

” কত বড় হয়ে হয়ে গেছে চাচু আমার?”
বর্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়েই রইল৷ বৃষ্টি এগিয়ে এসে বলল,
” আব্বু এটা কে বলো তো! এটাও তোমার চাচু হয়। ”
সে কোনো প্রতিক্রয়া দেখাল না৷ হয়তো ঘুম থেকে উঠল বলে। কিন্তু চুপচাপই থাকল৷ জাকিয়া বললেন,
” ঘরে যা আব্বু। ফ্রেশ হয়ে নে৷ ”
সকলেই সম্মতি দিল৷ শিশিরও সম্মতি দিয়ে বর্ষণকে বৃষ্টির কোলে দিল। উপরে যাবার আগে বলল,
” ভাই, হিম সাহায্য কর ব্যাগগুলো নিতে। ”
বলে সে দুইটা ব্যাগ নিল। নীহার, হিম এগিয়ে গিয়ে নিল৷ ব্যাগ হাতে করে কুয়াশার দিকে তাকাল। কিছু বলতে পারল না। কিন্তু বউকে সে উপরে আসার নির্দেশনা দিল চোখের ভাসায়৷ যেটা কুয়াশা স্পষ্ট দেখল। শিশির চলে গেল উপরে। দুইজনের মনের কথা, চোখের ভাসা বৃষ্টি দেখল৷ মুচকি হেসে কুয়াশাকে বলল,

” কুশু, ঘরে যাও শিশিরকে সব এগিয়ে সাহায্য করো গিয়ে।”
কুয়াশা এই কথাটার অপেক্ষা করছিল। জাকিয়াও বললেন,
” হ্যাঁ, এক গ্লাস শরবত নিয়ে যা। গরমে জার্নি করে এলো। ”
কুয়াশা ফটাফট রান্না ঘরের দিকে গেল। জাকির মালিথা সোফায় দূরে বসে আছেন। তখনই বসেছিলেন৷ বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না৷ কুয়াশা যেতেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন জাকিয়ারা। ছেলে মেয়ে দুটো এভাবেই ভালোবেসে চিরজীবন সুখী থাকুক। ভাবনার মাঝেই জোহরের আজান কানে ভেসে এলো। সকলে এবার নিজেদের কাজে গেল গোসল করবে এরপর নামাজ আদায় করে খাওয়া দাওয়া করবে। বিকেলের দিকে ইশারা সহ আম্বিয়ার বোনরা আসবেন।

সিঁড়ি দিয়ে উঠছে শরবত নিয়ে কুয়াশা। তার কাছে এক একটা সিঁড়ি যেন লাগছে হাজার বছরের পথ৷ এই সামান্য কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে সে উপরে উঠতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। মনে হচ্ছে সিঁড়িগুলো যদি পাখির মতো করে উড়ে গিয়ে শেষ করা যেত?

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তার ভেতর পর্যন্ত কাঁপতে লাগল উত্তেজনায়। বুকে মাঝে সমানে ঢিপঢিপ করছে। ধুকপুক করে আওয়াজ হচ্ছে যেন আশেপাশের মানুষজনও শুনে নেবে। অনুভূতিরা একজায়গায় সব দলা পাকাচ্ছে। এ অনুভূতি বলে প্রকাশ করার মতো না। শুধু কাজে প্রকাশ করার মতো। ভালোবাসার মানুষটিকে অনেক প্রতিক্ষার পর কাছে পাওয়ার আনন্দটা যে কতটা গভীর, গাঢ়, প্রগাঢ় হয় সেটা শুধু আর শুধু মাত্র সে-সকল ভালোবাসারা যুগল জানে, বোঝে। এতগুলো দিন, এতগুলো রাত সে একা কাটিয়েছে তার আপন, আত্মার মানুসটাকে ছাড়া। যাকে কাছে পাবার অদম্য ইচ্ছে বুকে লালন পালন করে এসেছে। এক একটা দিন তার আসার অপেক্ষা করেছে। নিজেই নিজেকে আশ্বাস দিয়েছে। দীর্ঘ শ্বাসের সাথে অনুভূতি উড়িয়েছে।

কুয়াশা সিঁড়ি ভেঙে উপরে শিশিরের অর্থাৎ তাদের ঘরের সামনে এলো। দরজা খোলাই আছে। আরো বেড়ে গেল উত্তেজনা। হাত পা কাঁপছে উত্তেজনায়। ভেতরে ঢুকল। শিশির বাথরুমে। পানির শব্দ আসছে। সে বেড সাইট টেবিলের সামনে গেল। শরবতের গ্লাস রাখল। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে আবার ছেড়ে দিল। দরজার সামনে গিয়ে দরজা আটকে দিল৷ সে দরজা আঁটকাতেই শিশির বাথরুমের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো৷ শরীরের ঢাকায় থেকে আসা পরনের প্যান্ট শার্ট চেঞ্জ করে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়েছে শুধু। টাউজার আর টিশার্ট পরনে এখন৷
বাথরুমের দরজা খুলার আওয়াজ পেয়ে কুয়াশার বুক আবার কেঁপে উঠল৷ উফফ আজ এতটা অস্থির লাগছে কেন? সে ঘুরে তাকাল। ঘুরে তাকিয়ে শিশিরের মুখ দেখল৷ শিশির ওর দিকেই তাকিয়ে আছে অপলক, অনিমেষ। কুয়াশা এক মুহুর্তের মাঝে উত্তেজনা থেকে আবেগী হয়ে উঠল৷ চোখ জোড়া জ্বলে উঠে ছলছল করতে লাগল। এই তো সেই আপন মানুষ, তার প্রিয় স্বামী৷ যার প্রতিক্ষায় দিন, রাত পাড় করে এসেছে। এখন সে সূূদূরে থেকে মাত্র কিছুটা দূরে৷ যার দূরত্ব মাত্র কিছু কদম।

কুয়াশার চোখ থেকে আবার টপটপ করে পানি পড়তে লাগল৷ তার ভেতরের অনুভূতিগুলো প্রজাপতির মতো উড়ছে, এত দিনের কষ্ট, অভিমানগুলো আজ স্বামীকে পেয়ে উপচে পড়ছে৷ শিশির দেখছে তার বউটাকে। এতগুলো দিন বউকে দূরে রেখে সে ভালো ছিল না। তারও হৃদয় পুড়েছে দিন, রাত। নিজের সেই অভ্যাস গুলো ধরে রাখতে খুঁজেছে কুয়াশাকে। এখন উত্তেজনা বেড়ে গেল সামনে তার বউকে দেখে। বুকের জ্বালা বাড়ল। এই বুকে এখন, এই মূহুর্তে তার কুয়াশাকে লাগবে। আর সহ্য হলো না৷ শিশির হাতের তোয়ালেটা কোনো রকম বিছানার দিকে ছুড়ে মে-রে দুই হাত প্রসারিত করে কুয়াশাকে বুকে আসারা আহ্বান করতে বলে উঠল,

” এ্যাই আমার আহ্লাদী বউ, জলদি আয়! ঠান্ডা কর সব।”
কুয়াশা চোখে পানিই ফেলে যাচ্ছিল। স্বামীর ডাকে, স্বামীর আদুরে আহ্বানে একপলও দেরি করল না৷ বিদ্যুৎ গতিতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিশিরের বুকে। দৌড়ে ছুটে গিয়ে শিশিরে গলা জড়িয়ে ধরেছে। আর শিশির কিঞ্চিৎ ঝুঁকে কুয়াশার কোমড় পেচিয়ে ধরে উপরে তুলে নিয়েছে। শূন্যে তার পা। শিশির নিচু হয়ে উপরে তুলে নিতেই সে সাথে সাথে গলায় মুখ গুঁজে দিয়েছে। যেটা সে আগে করত। ইশশ কতদিন পর এইভাবে জড়িয়ে ধরল তারা!! আর শিশিরের বউটাই বা কতদিন পর এভাবে গলায় মুখ গুঁজে কাঁদছে?

সে কতটা যে মিস করেছে বউয়ের এই আহ্লাদটাকে। গলায় মুখ গুঁজে কান্নার অভ্যাস এই প্রথম কারো দেখেছে সে। আর সেটাও তার একমাত্র বউকে। কেউ কি কান্না করে এমন করে? কেউ করে কিনা যানা নেই তার কিন্তু তার বউ করে।
কতদিন পর তারা একে অপরকে ছুঁতে পারল, একে অপরের স্পর্শ পেল। বুকটা চৈত্রর খরার মতো খা-খা করত। আজ যেন যুগলবন্দীর বুক ভিজল এক পশলা আষাঢ়ে বৃষ্টিতে।
তাদের দূরত্ব ঘুচেছে। তারা এক হয়েছে আবার। মিলেছে আবার ওরা। এখন তাদের দুষ্টু, মিষ্টি ভালোবাসা, খুঁনসুটিময় ভালোবাসা দিয়ে সংসার শুরু হবে সাথে তাদের স্বত্ত্বাকে জাগিয়ে রাখতে তাদের মার মারি, চুলোচুলি তো আছেই!

শিশির শক্ত করে কুয়াশাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখেছে৷ আর কুয়াশা ঝরঝরিয়ে কান্না করছে বুকের সাথে লেপ্টে থেকে। শিশির এবার কুয়াশার মুখ তুলল। তুলে সারামুখে এলোপাতাড়ি চুমু আঁকল। ছোট্ট স্বরে বলল,
” আমার সোনা। ”

শান্তি লাগছে আজ। কতদিন পর বউটাকে আদর করতে পারছে। কাছে পেয়েছে। কুয়াশা এই প্রতীক্ষিত আদর পেয়ে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আগের মতো আবার গলা জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজল। কাঁদেও আহ্লাদীর মতো করে।
কুয়াশার কাঁদতে কাঁদতে কেন যেন ভেতরকার কষ্ট, অভিমান, দূরে যাবার ক্ষোভ ঝারতে ইচ্ছে হলো। আর সেটাই করল সে। কাঁদতে কাঁদতে মুখ গুঁজে রাখা মুখ তুলল হালকা। তুলে শিশিরের কাঁধের উপর কামড় দিল। যেটা সে হরহামেশাই করে আসে। তার স্বভাব সূলভ কামড় থেরাপি। শক্তি দিয়ে দাঁত বসিয়ে দিল শিশিরের ডান কাঁধে যেটা সে ঐ রাতে কামড়িয়েছিল যে রাতে শিশির অয়নের জন্য মেরেছিল। সেদিনের কামড়ের মতো করে আজো কামড় দিল সে।
শিশির একচুলও মানা করল না। এটার জন্য সে প্রস্তুত ছিল। সে জানত বউ তার তাকে পেলেই আগে কামড়াবে। কত মিস করেছে এই কামড়টাও। দুই বছর যাবত সে সবকিছু থেকে বঞ্চিত ছিল। আজ থেকে সব শুরু হবে৷

কিছুক্ষণপর শিশির কুয়াশা আধা ভেজা চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দিল৷ পেছনের চুল মুঠোয় পুরে শক্ত করে ধরল৷ যেটাতে কুয়াশা ব্যথা পেয়ে ছেড়ে দিল কাঁধ৷ ঠিক ঐ রাতের টেকনিকই কাজে লাগাল শিশির। কলার ওয়ালা টিশার্ট বলে ততটা কিছু হলো না। কুয়াশা হিচকি তুলতে লাগল আর ফুঁপাতে লাগল। আজো কোনো অভ্যাস তার পরিবর্তন হয়নি৷ সে তো এটাই চেয়েছিল। তার বউয়ের যেন কোনো অভ্যাস পরিবর্তন না হয়৷ আর সে নিজেও তার অভ্যাস পরিবর্তন করেনি৷ কুয়াশা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শিশির মুখের দিকে তাকাল মুখ তুলে৷ শিশির কিছুক্ষণ দেখল সেই কান্না৷ এরপর কপালে চুমু দিল। কুয়াশা আদরটুকু নিয়ে বলল ,

” তুমি খারাপ লোক একটা, খুব খারাপ তুমি খুব খারাপ। আমায় দুইটা বছর কষ্ট দিলে। তোমাকে আমি একটু ছাড় দেব না দেখো। একটুও দেব না।”
” দিস না। ”
উত্তরে ছোট্ট উত্তর দিয়ে কুয়াশার অধরে অধর ডুবিয়ে দিল। পান করল অমৃত সুধা। কুয়াশা শিশিরকে আঁকড়ে ধরল। কতদিন পর স্বামীর আবেগঘন ছোঁয়া পেল! কুয়াশা সেই ছোঁয়া সাদরে গ্রহণ করল। শিশরকে সায় দিল৷ শিশির কুয়াশার চুলের মাঝে হাত গলিয়ে চুল মুঠো করে রেখে এক হাতে কোমড় জড়িয়ে রেখেছে৷ কুয়াশা গলা সহ ঘাড় জড়িয়ে ধরে আছে৷ শূণ্যে তার পা৷

কিছুক্ষণ পর শিশির কুয়াশাকে নিচে নামিয়ে দিল৷ অধর ছেড়ে দিল৷ কোলে তুলে নিল কুয়াশাকে৷ কুয়াশার ঠোঁটে লজ্জাময় হাসি। সেই হাসি শিশির দেখল৷ মন দিয়ে দেখল৷ সে-ও ঠোঁট কামড়ে হাসল। বউ তার হাসিতেই সম্মতি বুঝিয়ে দেয়। কুয়াশা শিশিরের দুষ্টু হাসিতে আরো লজ্জায় পড়ল৷ বুকে কপাল ঠেকিয়ে দিল। দু’টি হৃদয় আজ দুই টা বছর পর এক হয়েছে৷ সেই অনুভূতিরা কোনো বাঁধা মানে? নাকি অপেক্ষা-ই করে?
শিশির কুয়াশাকে কোলে করে নিয়ে বিছানায় বসল৷ কুয়াশা মুখ তুলে চায়ল। শিশির বলল,
” আগের থেকে একটু গুলুমুলু হয়েছিস। ওজনও বেড়েছে বেশ৷ রীতিমতো হাঁপ ধরে গেল এইটুকু আসতে গিয়ে৷ তাই জিড়িয়ে নিতে বসলাম৷ ”

ব্যস, বাঘা তেঁতুলের এইটুকুই যথেষ্ট ছিল নিজের আগের রূপ দেখাতে, নিজের স্বত্ত্বাতে ফিরতে৷ শিশির এমন সময় এমন কথা বলাতে সে সেকেন্ডর মাঝে শিশিরের শরীরের উপর আক্রমণ করল৷ ধাপধুপ করে কি-ল, চাপ্পড়, থাপ্পড় দিল কয়েকটা৷ সেটাতে ক্ষান্ত হলো না৷ শিশিরের চুল গুলো দুই হাতের মাঝে নিয়ে টেনে ছিঁড়ে নেবার মতো করে ঘুরিয়ে দিল মাথা সমেত৷ বলল,
” শয়তান বেটা, এ্যাই আমি মোটা হয়ে গেছি? আমাকে নিতে তোমার হাঁপ ধরে গেছে? ছাড়ো আমায় নিতে হবে না। হাঁপ ধরেছে তো কোলের উপর বসিয়েছ কেন? ছাড়োহ্! ”
রেগেমেগে গাল ফুলিয়ে ঢোল বানিয়ে বলল সে৷ শিশির সেই আগের কুয়াশাকে পেয়ে প্রশান্তিময় হাসল। কিচ্ছু পাল্টায়নি তার বউয়ের৷ সে বউকে চেঁতাতেই ওমনটা বলল। কুয়াশাকে নিজের সাথে গভীর করল। টেনে নিল। কোমড়ের বাঁকা খাঁজের মাঝে হাত চেপে ধরল। কুয়াশার সর্বাঙ্গ শিহরণ হলো। সেই আগের মতো ছোঁয়া!! শিশির দুষ্টু চোখে হাসল৷ কুয়াশার কানের কাছে মুখ ঝুঁকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

” আমার বউয়ের হাজার ওজনও আমি বয়ে বেড়াতে পারব আমার দু’হাতের আঁজলায়। এইটুকু তো সামান্য! তাকে চিরজীবন আমার বুকের উপর শুইয়ে রেখে রাত পাড় করতেও আমি পারব৷ আমার অর্ধাঙ্গিনী সে, আবার ভালোবাসা সে, আমার হৃদয়রাণী সে সর্বপরি, আমার একমাত্র আহ্লাদী বউ সে। ”
কুয়াশার শিরা উপশিরা কেঁপে উঠল। ভেতরের সব অনুভূতিরা তোলপাড় শুরু করল। আনন্দলন করল তার বিরুদ্ধে। বলতে চাইল,
” এ তুই কার নামে নালিশ করিস গোবর ঠাসা? এটা তোর স্বামী৷ তোর চিরন্তন সুখ৷ যার বুকে তোর শান্তি। যে তোর ভালোবাসা। ”
কুয়াশা অপলক চেয়ে রইল। শিশির মুচকি হাসল। হেসে কুয়াশার নাকে নাক ঘষল। বলল,
” একটুও পাল্টাসনি। আমি এটায় চেয়েছি৷ চেয়েছি আমার বাঘিনী যেন কোনো অভ্যাস না পাল্টায়৷ আমি তাকে সব সময় এক রূপেই চাই। ”

বলে কুয়াশার গলার মাঝে মুখ গুঁজে দিল। বড় একটা নিঃশ্বাস টেনে নিল৷ কুয়াশা আবেশে চোখ বুজল৷ শিশিরের টিশার্ট খামচে ধরল। এটা তার শিহরণ জাগায়৷ শিশির এই মাদকের গন্ধ নিতে না পেরে অস্থির হয়ে ছিল। বার কয়েক নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে নিয়ে ছাড়ল৷ মুখ তুলে তাকাল৷ বলল,
” এটা আমি রোজ সকালে খুঁজেছি। আমার নেশা৷ সেই নেশা সেবন করতে না পেরে আমি অস্থির হয়েছি। দমিয়ে রেখেছি সেই অস্থিরতা। ”
কুয়াশা ছলছল চোখে বলল,

” আমিও মিস করেছি। রোজ সকালে তোমার এই নেক স্মেল নেয়া আমার শিহরণের কারণ ছিল। ”
শিশির হাসল। কুয়াশার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে গাঢ় একটা চুমু খেল আবার। কুয়াশা নির্বিকার। শিশির বলল,
” তবে আগের থেকে সত্যি একটু গুলুমুলু হয়েছিস আর তাতে আমার বউকে আরো আকর্ষণীয় লাগছে। আমি নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে পড়ছি যে!”
শেষ কথাটা যেন নেশা করে বলল শিশির। তেমনটায় মনে হলো। শিশিরের কথায় কুয়াশা লজ্জা তো পেল কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। উল্টে শিশিরের বাহুতে চাপ্পড় দিয়ে বলল,
” ধেৎ…”

বলে শিশিরের বুকে মুখ ডুবাল৷ সেখানে নাক ঘষতে লাগল। এরপর মুখ ঘষল। মুখ ঘষে নিয়ে চুমু আঁকল গাঢ় একটা। শিশির হাসল৷ কুয়াশাকে আরো গভীর করে ছুঁলো সে। কুয়াশা টের পেল। মুখ তুলে শিশিরের চোখের দিকে তাকাল৷ স্বামীর চোখে নেশা। সেই নেশায় সে-ও মাতাল হলো। মাতাল হয়ে শিশিরের কন্ঠমণিতে চুমু দিল। শিশির কুয়াশার কোমড়ে চাপ দিয়ে ধরল। সে আবার তাকাল শিশিরের দিকে। শিশিরও তাকাল। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা না বলে তাকিয়ে রইল। এরপর শিশির কুয়াশার শরীর থেকে ওড়না টান দিয়ে খুলে নিল। ওড়না খুলে নিয়ে মুখ ডুবাল কুয়াশা গ্রীবাদেশে। ছোট ছোট চুমু আঁকল অসংখ্য। কুয়াশা শিশিরের চুল খামচে ধরল। শিশির কুয়াশাকে বিছানা ছেড়ে দিল। বিছানায় ছেড়ে নিজের বুকের নিচে ফেলল৷ ভরিয়ে তুলল আদরে আদরে বউকে। মাতল দু’জন আদিম নেশায়।
অনেকগুলো দিন পর তারা আবার কাছে এসেছে৷ যে বুক একে অপরকে পাবার আশায় ছিল আজ পেয়েছে। তারা অর্ধাঙ্গ অর্ধাঙ্গিনী৷ ভালোবাসা প্রকাশ করতে একচুল পরিমাণও কার্পণ্য করবে না৷

দুইটার দিকে শিশির কুয়াশাকে নিয়ে একসাথে গোসল সেরে পাক পবিত্র হয়ে জোহরের নামাজ আদায় করে নিল৷ একসাথে আবার নামাজ আদায় করতে পেরেও আনন্দ লাগল। আবার আগের মতো সব হবে।
কুয়াশা হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে চুল শুকিয়ে নিল৷ শিশির প্রয়োজনীয় জিনিস বের করছে ব্যাগ থেকে৷ এমন সময় একটা ব্যাগ থেকে কিছু জিনিস বের করল। কুয়াশাকে কাছে ডাকল,
” কুশু..! ”

কুয়াশা ঘুরে তাকাল। এগিয়ে গেলে একটা প্যাকেট দিল। কুয়াশা হাতে নিয়ে খুলল তা। সেখানে দুইটা শাড়ি সহ দুইটা থ্রি-পিচ। একটা শাড়ি সুতি আর একটা পিচলা ভারী কাতান। কাতানটা হালকা পিংক কালারের অসম্ভব সুন্দর শাড়িটা। কুয়াশাকে বলল,
” এগুলো তোর জন্য। ”
বলে পিংক কালারের কাতানটা দিয়ে বলল,
” এই শাড়িটা ভাইয়ের বিয়েতে পরশুদিন পরবি আর এটা এখন পর। ”
সুতিরটা দেখিয়ে এখন পরতে বলল। সুতিরটা গাঢ় খয়েরী জমিনের কালো পেড়ে শাড়ি। পাতলা সুতির শাড়িটাও বেশ সুন্দর। থ্রিপিচ দুইটাও অসাধারণ। একটা লং বারিশ ভারী থ্রিপিচ একটা কটনসুতির। কুয়াশা আনন্দে বিমোহিত হলো। হাসি দিয়ে বলল,

” অসম্ভব সুন্দর! ”
” হ্যাঁ তোর স্বামীর পছন্দ অসাধারণই। শুধু কপাল খারাপ বলে তোকে বিয়ে করতে হয়েছে। ”
শিশিরের কথায় চেঁতে উঠল। দিল একটা কিল বসিয়ে শিশিরের বাহুতে। শিশিরও দিল কুয়াশার চুল টেনে। বলল,
” ভুল কোথায় বললাম! ”
” হ্যাঁ ঠিকই বলেছ, কপাল আমারও খারাপ ছিল। তা না হলে কি আর তোমার মতো শয়তানকে বিয়ে করে সারাজীবন এই বাড়িতে পঁচতে হয়? ”
শিশির চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। কুয়াশা ভেঙচি কেটে শিশিরের থেকে সুতি শাড়িটা নিয়ে চলে গেল ধাপধুপ পা ফেল। সেদিকে তাকিয়ে হাসল শিশির। কতদিন পর এমন আবার দিন পেল!
এরপর আরো কিছু জিনিস আছে যেগুলো বের করে রাখল।

কুয়াশা আর শিশির এক সাথে নিচে নামল। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে। সকলে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল৷ শাড়ি পরে নিচে নামছে। শিশিরের পরনে কালো টিশার্ট আর টাউজার। কুয়াশার পরনে খয়েরী রঙের শাড়ি আহ্ পুরায় জোস লাগছে দু’জনকে। বাড়ির সকলে মুগ্ধ হলো তাদের বাড়ির বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুলকে এমন একসাথে এমন রূপে দেখে৷ আজমিরা চোখ জুড়িয়ে দেখলেন দু’জনকে। কুয়াশা গিয়ে জাকিয়ার কাছে দাঁড়াতেই বললেন,
” মাশাআল্লাহ, আমার মা’টাকে কী দারুণ লাগছে!! ”
কুয়াশা মুচকি হাসল। শিশির সেদিকে তাকিয়ে একবার দেখে নিজের চেয়ারে বসল। আজ থেকে চেয়ারের মালিক চেয়ারের দখল নিল। জাকির মালিথা এখন নিচেই খান। তিনিও আছেন৷ জাকিয়া বৃষ্টিদেরও বসতে বলল৷ বর্ষণ ঘরে ঘুমচ্ছে। বৃষ্টি, ইয়াসমিন, কুয়াশাও বসল। তিন জা পরিবেশন করল। শিশির কুয়াশা পাশাপাশি বসেছে৷ দু’জনের পাতে মাছের মাথা দেয়া হলো৷ আর কেউ খায় না তাই রাঁধেও না দু’ইটার বেশি। সকলে খেতে খেতে টুকটাক গল্প গুজব করল।

বিকেল চারটার দিকে অয়ন, অনি এলো তার মা- বাবার সাথে। অনি মা-য়ের বাড়ি থাকে মাস তিনেক হলো। সে প্রেগনেন্ট দুই মাসের। স্বামী তার ঢাকায়। আগামীকাল আসবে বলেছে। আম্বিয়া সহ সকলেই তাদের নিয়ে ব্যস্ত হলো। অয়ন, অনি একটু অসস্তিবোধ করছে৷ যদিও আসার ইচ্ছে ছিল না৷ খালাত ভাইয়ের বিয়ে এইজন্য আর থাকতে পারলনা না এসে।
ওরা আসতেই শিশির, কুয়াশা, নীহার, হিম সব নেমে এলো। বাড়িতে একটা বিয়ের আমেজ তৈরি হলো। এই তোহ্ এমন আত্নীয়রা না আসলে কি বিয়ে বিয়ে মনে হয়!! নীহার অয়নকে জড়িয়ে ধরল। কথা বলল ভালোমন্দ। শিশির এসে হাসি মুখে অয়নের সাথে কথা বলল৷ অয়ন একটু আনইজি ফিল করল। সেটা শিশির তুড়ি মেরে কাটিয়ে দিল। অয়নকে জড়িয়ে ধরল৷ বলল,

” আগে কী হয়েছে না হয়েছে ভুলে যাও ভাই। ঐ দিন একটু বাজে ব্যবহার করেছিলাম৷ রেগে গেছিলাম একটু এইজন্য। আসলে সবই পরিস্থিততে হয়েছিল। কুয়াশার সাথে বিয়েটা নরমাল ছিল না আমার। সবই তো জানো। বি ইজি ওকে?”
অয়ন আর খারাপ লাগা বা রাগ নিয়ে থাকল না৷ আসলে থাকতেও পারল না৷ সত্যি শিশিরের জায়গায় সে ঠিক ছিল৷ কোনো স্বামীই ওমনটা সহ্য করবে৷ সে সব ভুলে হেসে শিশিরকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
” ইট’স ওকে ব্রো। আসলে আমারও জানা ছিল না আর তোমারও বিষয়টা নিয়ে ওমন বিহেভ করাটাও স্বাভাবিকের কাতারে পড়ে৷ বাদ দাও ওসব। ”

বলে শিশিরকে ছাড়ল। ছেড়েই কুয়াশার দিকে নজর দিল। আটকে গেল আগের মতোই। মেয়েটা তার ফার্স্ট ভালোলাগা ছিল। হয়তো ভালোবাসাও ছিল। কষ্ট পেয়েছিল খুব বিয়ের কথা শুনে। নিয়তিতে না থাকলে কি আর কিছু হয়? অপূর্ব সুন্দরী হয়েছে৷ বিবাহিতার ছোঁয়া পুরো শরীরে তার জ্বল জ্বল করছে। চোখ সরিয়ে নিল তৎক্ষনাৎ। সে এখন অন্যের বউ। মুগ্ধ নয়নে দেখা পাপ। দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। হাসি মুখে কুয়াশাকে জিজ্ঞেস করল,
” কুয়াশা! কেমন আছো তুমি? ”

কুয়াশা একটু কেমন কেমন ফিল করছে যেন। শিশির এখন কিভাবে সেটা জানা নেই। শিশিরের দিকে চোখাচোখি হলো। সে পুরোটা আশ্বাস দিল। কুয়াশা তা বুঝে হাসি মুখে সে-ও উত্তর করল। অনির সাথে সকলে কথা বলল। অনি সকলের সাথে কথা বলে শিশিরের দিকে তাকাল৷ এই ছেলেটা তার জীবনের প্রথম অনুভূতি ছিল। টিনএজার অনুভূতি যাকে বলে। আজ এতগুলো বছর পরেও দেখে মুগ্ধ হলো সে। আগের থেকে আরো সুদর্শন হয়েছে। আরো আকর্ষণীয় হয়েছে। কুয়াশার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনকে ভালোই মানিয়েছে৷ তারা যে সম্পর্ক থেকে সংসার করছে এটায় তার কাছে কল্পনাতীত লাগে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে শিশিরের নজরে নজর পড়ল। কুয়াশাও বিষয়টা দেখল। মনে মনে একটু ঈর্ষান্বিত হলো। আগের মতোই আছে নাকি এর স্বভাব? হা করা!! হা করে করে শুধু দেখবে। আগে কিছু মনে করেনি আর মনে করবে কী? ওসব তাকিয়েও দেখেনি কখনো কিন্তু এখন সে তার স্বামী। শিশির হেসে বলল,

” কেমন আছো অনি? ”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো ভাইয়া৷ আপনি কেমন আছেন? ”
” আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। ”
এরপর কুয়াশাও জিজ্ঞেস করল। সকলের সাথে কথা টথা বলে বসল বসার ঘরে। কিছুক্ষণের মাঝে ঈশারা এলো। ঈশারা আসতেই আরো আনন্দ হলো। ঈশা অনিকে নিয়ে কুয়াশার সাথে গল্পে মাতল।
জাকিয়ার ভাইরা শশীদের বাড়িতে গেছেন। আর জাকিয়ারা এইদিক থেকেই সব করবেন।

বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৬৫+৬৬

আগামীকাল তুষার, জাহিদ মালিথা আসবেন সেই আনন্দ হলো। আরো আত্নীয়রা আসবে আগামীকাল। আনন্দে আমদে মালিথা ভিলা আবার পরিপূর্ণ হলো। বিয়ের আমেজ একদম সবার মাঝে চলে এলো। মালিথা ভিলা এখন থেকে এমনই সাজবে। সময়ে সাজবে, সময়ে আনন্দে মাতবে আবার সময়ে বিষন্নতায় কাটাবে। আগে ছেলে মেয়েরা ছোট ছিল ধরে বেঁধে নিজেদের কাছে রেখে দিন পাড় করতে পেরেছেন৷ কিন্তু এখন সব বড় হয়ে যে যার মতো ভবিষ্যতের পেছনে দৌড়ে দিন পাড় করবে৷ বাড়ি ছেড়ে দূরে যাবে আবার দূরে গিয়ে অপেক্ষা করবে কবে আসতে পারবে বাড়িতে সেই অপেক্ষা শেষ করে আবার বাড়িতে আসবে৷ বাড়িতে আসার আনন্দে মাতবে৷ এভাবে সকলের দিনপঞ্জিকার গতিপথ পরিবর্তন হবে৷ আপন মানুষদের থেকে দূরে গিয়েও কাছে আসার সুখ পাবে৷

বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৬৯+৭০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here