বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৭১+৭২
রোজা রহমান
খাওয়া দাওয়া করে গরম লাগছিল বলে কুয়াশারা সকলে শশীদের বাড়ির সেই পুকুর পাড়ে এসেছে। এখানে কুয়াশা, বৃষ্টি, বর্ষণ, ইয়াসমিন, ঈশা, স্মৃতি, অনি, অভির বউ সহ শিশিররাও আছে৷ আছে এখানে মিহিরও। সেই এসেছিল তিন বছর হবে৷ সব একই আছে৷ সকলে আবারও মুগ্ধ হলো৷ রোদের তেজ কমে গেছে এই জন্য সেই আমগাছের নিচে বাঁধাই করা শানে মেয়েরা বসেছে৷ শিশিররা দাঁড়িয়েই আছে৷ কিছুক্ষণ মন ভরে দেখল সেই সুন্দর প্রকৃতি৷ হঠাৎ কুয়াশা বলল,
“দেখো সেই আগের মতোই সব আছে! ”
” হ্যাঁ একদম। একটুও পরিবর্তন আসেছি এক গাছপালা বড় হওয়া ছাড়া ”
বৃষ্টি উত্তর করল কুয়াশার কথায়। শিশির বলল,
” বুঝলি কুয়াশা আমি তো খুঁজছি সেই জায়গাটা যেখানে তুই ধারাম দিয়ে আছাড় খেয়ে চুপটি করে বসে ছিলি!”
শিশিরের কথায় সকলের দম ফাটা হাসিতে মত্ত হলো। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবার জোগার। বৃষ্টিরা হাসতে হাসতে এর ওর গায়ের উপর পড়ছে৷ এদিকে কুয়াশা কুলিম সা’পের মতো ফস ফস করছে। যেন এখনই শিশিরকে ছো-বল দেবে ভাব। মুখের ভঙ্গিমাও তেমনই। ফুঁসে ওঠে কিড়মিড় করতে করতে বলল,
“শয়তানের বাদশাহ, মনে আছে ঐ জায়গা থেকে তোমাকে এক ধাক্কায় পানিতে দিয়েছিলাম? আবার ধাক্কা না খেতে চাইলে চুপ থাকো! ”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
কুয়াশা কথাগুলো বলার সময় হাত দিয়ে সেই পাড়টা দেখাচ্ছিল। সকলে কুয়াশার কথায় আবার হেসে উঠল। শিশির দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” আমি ছেড়ে দেব তোকে? কাঁদা ছুড়েছিলাম মনে আছে? এবার তুলে নিয়ে গিয়ে পুকুরে চুবিয়ে আসব। সো বেশি না বলে চুপ থাক! ”
সকলে একটু গরমে রিলাক্স করতে এখানে এলো কী! এই দুটোর ঝগড়া দেখতেই দিন চলে যাচ্ছে তাদের। ওদিকে নিহারকে একা রেখে সব এদিকে এসেছে। অনি বলল,
” তোমরা এতকিছু করেছিলে এসে? এখন মনে হচ্ছে না এসেই ভুল করেছিলাম৷ আসলেই গ্রামটা মনোমুগ্ধকর!”
” হ্যাঁ, অসাধারণ এখানে যেমন তেমন, ক্যানালের দিকে আরো সুন্দর। সময় থাকলে ঘুরে আসতাম আজো। কিন্তু ওদিকে গেলে বাড়ি যেতে রাত হবে। সকলে রাগও করতে পারে ”
ইয়াসমিন উত্তর করল অনির কথায়। নাদিম বলল,
” ইশশ সত্যি মিস করে ফেলেছি। আমিও সে-সময়ে আসতে পারিনি ”
শান্ত বলল,
” তা আসবি ক্যা শালা! তুই গার্লফ্রেন্ডের কোলের মাঝে গিয়া ঘুমা। ”
শান্তর কথায় আবার হাসল সকলে। হাসতে হাসতে সাব্বির আর সাবিব একসাথেই বলল,
” আমরাও তোমাদের সাথে না আসতে পেরে মনে হচ্ছে মিস করে ফেলেছি মজাগুলো ”
মিহির বলল,
” হ্যাঁ কত বলেছিলাম ভাই আয়। আসলি নাহ্!”
ঈশা মিহিরের দিকে তাকাল। এই ছেলেটা এতটা সুন্দর কবে কবে হলো! ভিডিয়ো কলে তো বোঝা যায় না! এছাড়া দুই বছর আগে তো গেছিল। দেখেছিল তেমন তো লাগে নি! এখন শরীর স্বাস্থ্যর মনে হচ্ছে উন্নতি হয়েছে। মিহিরও তাকাল। ঈশাকে চুমু দেওয়ার মতো ভাব দেখিয়ে চোখ টিপল। সকলের আড়ালে এই ফাজলামোতে ঈশা ধানিলঙ্কার মতোই করে উঠল। হিম বলল,
” তোমরা তোমাদের কথা ভাবছ আর আমি ভাবছি যখন এসেছিলাম, আমি তো এততটুকু ছিলাম। মিহির ভাইয়ের কাছে বরশি দিয়ে মাছ ধরার জন্য আবদারও করেছিলাম। তবে যায় বলো, মুহূর্তগুলো সত্যি স্মৃতিতে আছে। মাছ ধরারদিন কতটাই না আনন্দ হয়েছিল! পুকুরে গোসল করতাম। আজো ইচ্ছে হচ্ছে। ”
সকলে হিমের কথা মুচকি হাসল। সেই সোনালী দিন কয়টা স্মৃতিচারণ করল। অয়ন বলল,
” বরশি দিয়ে মাছও ধরেছিলে তোমরা? ”
রিজভী বলল,
” হ্যাঁ,এই পুকুরে অনেক বড় বড় মাছ আছে৷ শশীর বাবা চাষ করেন। আমরা সেবার এসে ধরেছিলাম ”
সেবার যারা অনুপস্থিত ছিল সকলে একসাথে বলে উঠল,
” বাহ্, ব্যাপারটা বেশ ভালো তোহ্! ”
মুচকি হাসি ঠোঁটে ফুটাল সকলে৷ শিশির কুয়াশা একে অপরের দিকে তাকাল৷ অমায়িক হাসল দু’জন৷ সকলের কথার মাঝে তারা তো ডুব দিয়েছে সেই রোমাঞ্চকর পরিবেশে তাদের রোমান্টিক মোমেন্টগুলোতে৷ পুকুরে গোসল করা, রাতে ছাদের দুইটা দিন কাটানো, এমনকি তাদের ফার্স্ট কিস অর্থাৎ প্রথম ছোঁয়া এবং চুমু এই গ্রামের রোমাঞ্চকর পরিবেশের রাতের আলোআঁধারিতে হয়েছিল। স্বাক্ষী হয়েছিল এই গ্রামের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তাদের নতুন নতুন প্রেমের মূহুর্তগুলোর। শিশির সেসব মনে করে দুষ্টু চোখে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগল কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। কুয়াশাও শিশিরের দিকে তাকিয়ে লজ্জার মতো করে হাসছে৷ তাদের সেই প্রথম ছোঁয়া, ভালোবাসার কথা মনে উঠলে এখনো শরীর শিহরিত হয়৷ প্রথম প্রথম ভালোবাসাটা কতটা মিষ্টি, মধুর ছিল! তারা বুনো ওল বাঘা তেঁতুল দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে প্রথম কাছে এসেছিল৷ ইশশ কী দারুণ অনুভূতি!!
সকলে আরো কিছুক্ষণ জিড়িয়ে নিয়ে চলে গেল বাড়ির ভেতর৷ বাড়ির ভেতর সেই চাপ কল থেকে কুয়াশা পানি খেল৷ কুয়াশার দেখাদেখি শিশির সহ অনেকেই খেল৷ কুয়াশা পানি খাবার সময় বলল,
” এ্যাই মনে আছে তোমার কিছু? ”
সকলে শুনল কিন্তু মিহিররা, বৃষ্টিরা ভাবল সে শিশিরের গায়ে কুলি করে চলে গেছিল সে-কথা বলছে৷ কিন্তু কুয়াশা মিন করল পড়ে যাবার পর তাকে কোলে করে পাশের ঐ গোসলখানায় নিয়ে গেছিল শিশির৷ শিশির ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হেসে নিয়ে বলল,
” ভুলি তাই? চিৎপটাং হয়ে পড়েছিলি আমিই তো টেনে এনেছিলাম আলুর বস্তা।”
তা শুনে ওরা আরেক দফা দম ফাটা হাসি হাসল৷ এই বাড়ির ভেতর ওরা ছাড়া কেউ নেই৷ সকলে ঐদিকে৷ কুয়াশার রোমান্টিক মুডটাই দিল নষ্ট করে। তাই সে সেদিনের মতো মুখের পানির কুলি শিশিরের গায়ে ফেলে দিল ভৌ-দৌড়। তাকে আর পায় কে? এদিকে সকলে হাসছে আর শিশির কুয়াশার চোদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগল শরীর ঝারতে ঝারতে। ওর শেরওয়ানিতে দিয়েছে পানি।
নীহারকে শশীর কাজিনরা সহ সৌরজ, তুষার, তুহিন শশীর ঘরে নিয়ে এলো৷ ঐ বেয়াদবগুলা সব আনন্দ করে বেড়াচ্ছে তাকে একা ফেলে রেখে গিয়ে৷ নীহার শশীর ঘরে আসতে আসতে ভাবল কথাগুলো৷ রাগ উঠল ওদের উপর৷ শশীর কাছে সীমি, শোভারা সহ আরো কাজিন আছে৷ শশীর ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল তারা। তাকাল সেখান থেকে নীহার। আহ্! কতদিন পর দেখল এই পাখির ছানাটাকে! কী সুন্দর লাগছে তার বউটাকে! তার বউ! খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে টুপ করে তুলে। নীহার শশীর দিকে তাকিয়ে থেকে এগিয়ে গেল। বসানো হলো ওর পাশে।
এদিকে শশীর উত্তেজনা বেড়ে গেছে। লজ্জারা গ্রাস করেছে চোখ তুলে একবারও তাকাল না সদ্য হওয়া স্বামীর দিকে। এই লোকটা তার সামনে, আশেপাশে এলেই তার উত্তেজনা বেড়ে যায়। এটা নতুন না সেই শুরুর অভ্যাস৷ নীহার বসতেই শোভারা সকলে বিছানা থেকে নেমে এলো। এখন শুধু ওরা দু’জন বসে৷ নীহার শশীর দিকে ডেবডেব করে তাকিয়ে আছে। সকলের সামনেই নির্লজ্জের মতো শশীর মুখের দিকে হালকা ঝুঁকে বলল,
” মাই বিউটিফুল লেডি। ”
শশীর শুনে বুক ধক করে উঠল। পাশ ফিরে তাকাল নীহারের দিকে। ইশশ, কতদিন পর দেখল এই লোকটাকে! আবেগী হয়ে উঠল৷ চোখ টলমল করে উঠল৷ নীহার আস্তে করে বলল,
” কেঁদো না৷ আমরা এক হয়েছি। তোমাকে কথা দিয়েছিলাম না এই ঘর থেকে? দুই বছর পর বিয়ে করে বউ বানিয়ে নিয়ে যাব! দেখো আমি কথা রেখেছি। তোমাকে বউ করেছি। একটু পর নিয়েও যাব৷ আজকে আমাদের সম্পর্কের নাম হয়েছে৷ আমরা স্বামী স্ত্রী আজ থেকে৷ তুমি আমার বউ শশী। ”
শশীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল৷ প্রতিটাদিন এই লোকটার বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখে রাত, দিন পাড় করেছে সে। সে সময়ে কুয়াশা ঢুকল ঘরে। এরপর শিশিররা এলো। একে একে সকল নিয়ম কানুন শেষ করল। জিনিয়া মেয়ে এবং মেয়েজামাইকে দোয়া করলেন৷ হানিফ সাহেব দোয়া করলেন৷ এরপর হানিফ সাহেব নীহারের হাতে কন্যা সম্প্রদান করলেন। কেঁদে দিলেন নীহারের হাতে মেয়ে তুলে দিতে গিয়ে তিনি৷ মেয়ে পরের ঘরে দিতে সকলে বাবা-মা’দেরই কষ্ট হয় সেখানে শশীতো একমাত্র মেয়ে! আর মেয়েটাই সকলের আদরের সাথে বাচ্চামি করে ঘর দাপিয়ে বেড়ায়। এখন থেকে ঘরটা শূন্যা পড়ে থাকবে। কাঁদলেন জিনিয়াও। হাউমাউ করে জিনিয়ার কান্না দেখে শশী আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। সে-ও হাউমাউ করে কেঁদে উঠল৷ মা-কে জড়িয়ে ধরে, বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল মিহিরও৷ এই বোনটার সাথে সে খুঁনসুটিতে মেতে থাকত৷ সৌরজও চোখের পানি ফেলল একমাত্র বোন বিদায় করতে গিয়ে৷ নীহারের কাছে বোনকে তুলে দিল৷ সীমিও চোখের পানি ফেলল শশীকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটাকে সে কাছে টানে না ঠিকই কিন্তু অপছন্দও করে না। চঞ্চলতা দেখিয়ে বেড়ায় ভালোয় লাগে৷ একটা বাড়িতে এমন চঞ্চলতাপূর্ণ মেয়ে থাকলে তাকে বিদায় দিতে কষ্টই হয়৷ নানান স্মৃতি রেখে যায় বাড়িতে৷ নিরবে চোখের পানি ফেলল শশীর কাজিনরাও। এক লহমায় শোক নেমে এলো বাড়িতে। বিদায় বেলা এতটা কষ্টদায়, বেদনাদায়ক কেন হয়??
বৃষ্টিরা সকলকে থামাল। জিনিয়াদের অভয় দিল। তুষার, তুহিন, শিশির খালুকে বোঝাল৷ এরপর সকলের থেকে বিদায় নিল। নীহার হানিফ সাহেব সহ জিনিয়া, সৌরজকে অভয় দিয়ে শশীর হাত শক্ত করে ধরল৷ অর্থাৎ এই হাত কখনো ছাড়বে না, আগলে রাখবে তার পাখির ছানাকে বক্ষপিঞ্জিরায়৷ শশীকে হাত ধরে তুলল নীহার৷ নামাল সে। শশী কেঁদেই যাচ্ছে। হাঁটা ধরল শশীকে নিয়ে। সকলে একে একে বের হয়ে গেল।
গাড়ির সামনে এসে শশীকে আগে তুলে সে বসল। পাশে বৃষ্টি বসল। মিহির যাবে খালার বাড়ি শশীর সাথে৷ সে বাইক নিল। ঈশার আর জায়গা হলো না কারে তাই মিহির ওকে নিজের বাইকে নিল। এরপর যারা যেভাবে এসেছিল সকলে সেভাবে উঠে বিদায় নিল৷ সেই গ্রাম থেকে আবারও বিদায় নিতে হলো সকলকে৷ জিনিয়ারা বিদায় দিলেন৷ এরপর গাড়ি স্টার্ট দিল। চলতেও শুরু করল গাড়ি তার আপন গতিতে। চেনা গ্রামের মেয়েকে বধু সাজে দুলহানকে তার দুলহা নিয়ে গেল শহরে৷ এই ক্ষণ প্রতিটি মানুষের জীবনে আসে৷ প্রতিটি মেয়ের জীবনে আসে, যেতে হয় সব ছেড়ে অন্যের ঘরে অপরিচিতদের ভিড়ে। আপন মানুষ ছেড়ে যাওয়া যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক সেটা বোধহয় একটা মেয়ে সেই সময়টাতেই হারে হারে টের পায় যারা আপন বাড়ি ছেড়েছে অন্যর বাড়ি আপন করতে। গাড়ি চলে গেলে জিনিয়া আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সকলে উনাকে সামলাতে লাগল৷
শশী চোখের পানি ফেলেই যাচ্ছিল নীহার তা দেখে রূঢ় স্বরে বলল,
” চুপপ করো! ”
এরপর বাম হাতে বুকের সাথে আগলে নিল৷ স্বামীর বুকে পড়ে রইল সে চুপটি করে। পাশে বৃষ্টি, সামনে হিম সবই জানে এসব ভালোবাসা নতুন না। বর্ষণ গাড়ির চলছে বলে আনন্দে নাচতে লেগেছে। সেদিকে শশী তাকিয়ে মুচকি হাসল। নীহারও হাসল৷
চারিদিকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে গেছে৷ ব্যস্ত শহরে গাড়ি ঢুকল। আরো কিছুক্ষণের মাঝে মালিথা ভিলার সামনে পৌঁছেও গেল৷ একে একে কার, বাইক থামল বাড়ির মেইন গেইট পেরিয়ে। গাড়ির হর্ণের শব্দ জানান দিল তারা বরযাত্রী বউ নিয়ে চলে এসেছে।
সকলে বেড়িয়ে এলেন৷ নীহার নেমে শশীকে নামাতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” ওয়েলকাম নিউ মেম্বার টু আওয়ার মালিথা ভিলা।”
শশী লজ্জা পেল সকলের সামনে বলাতে৷ সব মুচকি হাসল৷ নেমে এলো সে স্বামীর হাত ধরে। আম্বিয়া ছেলে বউকে মিষ্টিমুখ করালেন৷ এরপর সব নিয়মকানুন মিটিয়ে শশীকে ভেতরে নিয়ে গেলেন তিন শাশুড়ী এবং তিন জা। বসার ঘরে দু’জনকে বসিয়ে দিল। জাকির মালিথা, জাহিদ মালিথা নতুন বউমার মুখ দেখলেন গিফট দিয়ে। কুয়াশারা সকলে কিছুক্ষণ বসার ঘরে বসে গল্প করে চলে এলো ঘরে সব চেঞ্জ করতে। এসব পরে আর থাকা যাচ্ছে না। নীহার শশী নিচেই থাকল৷
রাত নয়টার পর আত্মীয় স্বজনরা সহ বাড়ির সকলে রাতের খাবার খেল। খাওয়া দাওয়া পর্ব মিটিয়ে শশীকে ঘরে তোলার তোড়জোড় করা হলো। এতক্ষণ শশী নিচেই ছিল। কুয়াশা, বৃষ্টি, ইয়াসমিন, স্মৃতি, ঈশা, অনিরা সকলে শশীকে নিয়ে গেল ঘরে। নীহাররা কেউ নেই৷ খেয়ে ওরা ছাদে চলে গেছে সকলে মিলে আড্ডা দিতে৷ অনেকদিন পর এক হয়েছে কিনা!! আবার কবে সময় সুযোগ হবে না হবে জানা নেই কারো৷ আল্লাহ চাইলে আবার হবে।
নীহারের ঘর তালা দেয়া৷ কুয়াশা খুলল৷ এরপর শশীকে নিয়ে ঢুকল ওরা। দরজার মুখে থেকে ফুলের সুগন্ধ নাসিকাপথে এসে বাড়ি দিল সবার। সারাঘর ময় গোলাপ, আর রজনীগন্ধার মাতাল করা মিষ্টি সুবাস৷ ইশশ, কী সুন্দর করে সাজানো বাসর! এই ঘর সাজানোর পর সকলেই প্রথম দেখছে। শিশির কাউকে দেখতেও দেয়নি ঢুকতেও দেয়নি। শশী দেখে হা হয়ে গেল৷ তার শরীরে কিছু যেন ভর করল৷ ভারী হয়ে এলো৷ এই ঘর আজ থেকে তার!! এই ঘরের সাথে ঘরের মালিকও তার৷ ভাবতেই সর্বাঙ্গ শিহরিত হলো। তার স্বামীর ঘর এটা৷ আগে আসতে ঘুমই লজ্জা লাগত আর আজ থেকে এই ঘরেই তার রাত, দিন কাটাতে হবে৷
কুয়াশা বলল,
” কী সুন্দর করে সাজানো! ”
” হ্যাঁ সম্পূর্ণ ক্রেডিট তোমার বরের ”
বৃষ্টির কথায় লজ্জা পেল সে৷ ইয়াসমিন বলল,
” তোদের তো আর বাসর ঘর টর সাজানো লাগল না৷ তোরা বীনা বাসরঘরেই বাসর করেছিস। বিয়েটাও যে হালে করেছিস বাবাহ্ রে বাবাহ্!”
কুয়াশার গাল গরম হলো৷ টান লাগল গালজোড়ায়। তবুও সে মেকি ঝাঝ নিয়ে বলল,
” চুপ করো তোহ্! কী সব যে বলোনা তোমরা! আর আমাদের বিয়েও ইউনিক বাসরও ইউনিক। অত রাখঢাক করে বিয়ে, বাসরের প্রয়োজন নেই৷ আমরা কাপলও ইউনিক সো সব ইউনিক ”
সকলে মুখ টিপে হাসল৷ কুয়াশা শশীকে বলল,
” এ্যাই আয় তো তুই বস। ওরা সবকয়টা পাজি।”
হেসে ফেলল সকলে। শশীকে ভালোমতো বসিয়ে দিল। এরপর তারা বসে গল্প করে রাত দশটা পাড় করল।
রাত এগারটার দিকে নীহারকে শিশিররা ঘরে পাঠিয়ে দিল৷ নীহার ঘরে এলো৷ দরজা ভিড়ানো ছিল৷ সে ঘরে ঢুকে শশীকে বসা অবস্থায় দেখল। ঢুকে এগিয়ে গেল। ডাকল,
” শশী! ”
শশী আগে টের পায়নি। শব্দহীন নীহারের আগমনে। ডাকে চমকে ঘুরে তাকাল৷ আচানকের উপর কথা পেল এই জন্য। নীহার চেঞ্জ করা। গরমে সে চেঞ্জ করে সিম্পল পাঞ্জাবি পরেছিল৷ শশী নিজকে সামলে নীহারকে সালাম দিল। নীহারও সালাম নিয়ে সালাম দিল। শশী উত্তর করে চুপ থাকল৷ তাকে আজ লজ্জা গ্রাস করেছে৷ নীহার ওর অবস্থা দেখে মুচকি হাসল। এগিয়ে বিছানার উপর বসল৷ বলল,
” আমার ইঁচড়েপাকা পাখিটা আজ এত লজ্জা পাচ্ছে! তার না এত এত তাড়া ছিল আমার বউ হবার! ”
শশী চিবুক ঠেকিয়ে রাখল৷ কোনো উত্তর করতে পারল না৷ নীহার বলল,
” আচ্ছা লজ্জা টজ্জা পড়ে হবে তুমি চেঞ্জ করো আগে। তোমাকে দেখে আমারই গরম লাগছে। আর ওজু করে আসো৷ নামাজ আদায় করব ”
শশী নিজেকে নরমাল করল। এরপর কথামতো উঠল। নেমে একটা সুতির শাড়ি বের করে নিয়ে চলে গেল৷ নীহার দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল। খুবই অল্প সময়ের জন্য কাছে থেকে ভালোবাসতে পারবে মেয়েটাকে। শশীর শাড়ি খুলতে খুবই বেগ পেতে হলো। কোথায় কোথায় কী করেছে কে জানে! এরপর সব ঠিকঠাক করে ওজু করে বেড়িয়ে এলো৷ সে এলে নীহার ঢুকল। ওজু করে আগে দু’জন নামাজ আদায় করে নিল।
শশীকে নীহার একদম নরমাল রাখার জন্য আগের মতোই নরমাল ট্রিট করছে৷ সে এবার শশীর হাত ধরে বলল,
” বি নরমাল শশী। ওকে? ”
শশী মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল৷ বসল ও’কে নিয়ে বিছানায় নীহার। এক হাতে জড়িয়ে বুকের সাথে আগলে নিল। শশী এবার ঝরঝর করে কেঁদে দিল। নীহার কিছু বলল না, মানাও করল না। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমার এসব সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আমি যে আপনার বউ হতে পেরেছি বিশ্বাস হচ্ছে না৷ এত এত অপেক্ষা, দূরত্ব সব পেরিয়ে এসে আমরা এক হলাম! ”
” হ্যাঁ, এক হয়েছি৷ আমাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে। ”
” কিন্তু আমার তো হলো না৷ আমার যে এই অপেক্ষা চিরন্তন হয়েছে! ”
নীহারের বুকটা ভারী হয়ে এলো৷ শশীকে নিয়ে উঠে বসল। কোলের উপর বাচ্চাদের মতো বসিয়ে নিল৷ বলল,
” কিছু করার নেই পাখি৷ এটা আমার স্বপ্ন। আমার স্বপ্ন পূরণ করেছি সেই স্বপ্নের পথে এখন পিছুটান রেখে তা ধুলিস্যাৎ করা সম্ভব নয়৷ তুমি আমার বউ। আমার চিরসঙ্গিনী। আমার সাথে তুমি নিজেকে জুড়েছিলে৷ এইটুকু সেক্রিফাইজ তোমাকে করতে হবে৷”
শশী দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নীহারকে। পিঠের উপর দুইহাত দিয়ে পাঞ্জাবি মুঠো করে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। তার খুব কষ্ট হয় এই মানুষটাকে ছাড়া থাকতে। নীহার আগলে রাখল৷ বলল,
” আচ্ছা এখন কাঁদবেই নাকি? আজ কিন্তু আমি ছাড়ব না! বহুত জ্বালিয়েছ! পাকনা পাকনা কথা বলে আমায় এলোমেলো করেছ আজ শোধ তুলব সব! ”
শশীর সর্বাঙ্গ ঠান্ডা হয়ে এলো৷ তবুও মুখ তুলল না৷ নীহার আবার বলল,
” সেই আগের মতোই রয়ে গেলে। তুলোর মতো ওজন৷ আমি যে আস্ত একটা মানুষ কোলের উপর নিয়ে বসে আছি মনেই হচ্ছে না! বলেছিলাম খেয়েদেয়ে মোটা হও মেয়ে, এই শরীরে পোষাবে না আমার৷ আর এই তার নমুনা! ”
শশীর লজ্জায় এখান থেকে দৌড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। এভাবে কেউ বলে! মুখ গুঁজেই রাখল বুকে। তবে উত্তর করল,
” আমি খাই তবুও মোটা হই না তো কি করব আমি? এখানে আমার দোষ কোথায়? ”
” এবার হবে। নিয়মিত আদরের ডোজ পড়লে। ”
” এত নির্লজ্জ কেন আপনি? কিচ্ছু আটকায় না মুখে৷ আমি লজ্জা পাচ্ছি বুঝছেন নাহ্? ”
” আচ্ছা? তুমি লজ্জা পাচ্ছ বুঝি?”
” হ্যাঁ পাচ্ছি চুপ করেন ”
বলে ওভাবেই পড়ে রইল। নীহার ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে বউয়ের কার্বার দেখে৷ বলল,
” উহু, চুপ করলে কীকরে হবে? আজ চুপ করার রাত না। অনেক জ্বালিয়েছ৷ এতটুকু বয়স নিয়ে এসে প্রেমের ফাঁদে ফেলে আমাকে এতগুলো দিন অপেক্ষা করালে এখন এত সহজেই চুপ করব? তা তো হবে নাহ্! সুদে আসলে উসুল করব সব৷ ”
বলে শশীর মাথা ধরে মুখ তুলল। শশী জমে বরফ। ওর আর নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। নড়ার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে যেন৷ চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে রেখেছে৷ দেখবে না সে নীহারকে৷ এই লোকটা বহুত অসভ্য সে এতদিনে হারে হারে টের পেয়েছে। নীহার ভেরতে ভেরতে অনেক হাসছে শশীর অবস্থা দেখে৷ সে এবার শশীর পেট চেপে ধরল হাত দিয়ে। যা আজ প্রথম করল সে। শাড়ির নিচে উন্মুক্ত পেটের পাশে কোমড় বরাবর৷ চিকন মেদহীন পেটে হাত দিয়ে স্লাইড করল সে৷
এদিকে শশী এই প্রথম কোনো পুরুষের থেকে এমন স্পর্শ পেয়ে হার্ট অ্যাটাক করার জোগাড়। বুক ধুকপুকের সাথে ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল৷ চোখ খুলে বড় বড় করে তাকাল নীহারের দিকে৷ সে এখনো স্বামীর কোলে বসে। নীহার দুষ্টু চোখে হাসছে৷ নীহার এবার টান দিয়ে বুকে ফেলল শশীকে মিশিয়ে নিল। বলল,
” আ’র ইউ রেডি? ”
শশী কি বলবে বুঝছে না৷ তার কোনো কথাই আর আসছে না৷ নীহারের বুকের সাথে ওর দুই হাত৷ সম্মতি প্রকাশ করতে লজ্জাময় হাসি দিয়ে মাথা রাখল স্বামীর বুকে। নীহারের কেন যেন বুকে শান্তি লাগল৷ দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলল,
” আমার পাখি! আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই৷ তিন সপ্তাহের ছুটিতে এসেছি৷ এই দিনগুলো একটুও কার্পণ্য করব না তোমাকে ভালোবাসতে৷ এরপর আমাদের সংসার হবে শুধু ফোনে৷ নিজেকে সে-ভাবে আজ থেকে প্রস্তুত করে নিও। কোনো প্রকার সিনক্রিয়েট করবে না ওকে? কষ্ট তুমি একা পাবে না, আমিও পাব৷ আমি আমার এই হাসিখুশি পরিবার ছেড়ে বউ ছেড়ে দূরে পড়ে থাকব। কতটা সহ্য করব ভাবো? ”
শশী নীহারের চোখের দিকে তাকাল। এরপর গালের উপর হাত রাখল৷ ক্লিন সেভের মুখটা ভারী সুদর্শন। আগে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ছিল নেভিতে যাবার পর ক্লিন সেভ করে। শশী টলমল চোখে বড্ড আবেগী হয়ে বলল,
” চেষ্টা করব আমি আপনার কথা মেনে চলার। বড্ড ভালোবাসি আপনাকে৷”
নীহার মুচকি হেসে বলল,
” আমিও বড্ড ভালোবাসি এই পাখির ছানাটাকে৷ আজ থেকে আমার এই বক্ষপিঞ্জিরায় তাকে বন্দি করলাম৷ আদরে, সোহাগে আগলে রাখব সেখানে। ”
বলে শশীকে দুইহাতের আঁজলায় নিল। শশী তাকিয়ে রইল৷ একহাত গলিয়ে ঘাড়ের পিছনে নিয়ে চুলের মাঝে গলিয়ে শশীর অধরে অধর ডুবাল। তাদের ভালোবাসার প্রথম গভীর ছোঁয়া৷ শশীর পুরো শরীরে ঝঙ্কার তুলল। গ্রামের মেয়ে সে, বড্ড নাজুক৷ স্বামীর এই অধর চুম্বন তার কাছে অতি যন্ত্রণাদায়ক মনে হলো৷ নীহারের বুকের কাছের শুভ্র রঙা পাঞ্জাবিটা খামচে ধরল এক হাতে। আর একহাত আপনা আপনি নীহারের গাল থেকে ঘাড়ের পেছনে চলে গেল৷ নীহারের এই গভীর থেকে অতি গভীর ছোঁয়া ওর হৃদয় ছুঁয়ে নিল৷ চোখ থেকে আপনাআপনি পানি পড়ল৷ নীহার শশীকে আরো টেনে নিল। অধর ছেড়ে শশীর গ্রীবাদেশে চুমু আঁকল। শশী সামলাতে লাগল অতি কষ্টে তা। ভালোবাসা তাদের পূর্নতা পেল৷ বিয়ে থেকে নিজেদের চাহিদা পর্যন্ত গিয়ে। এমন সুখী দম্পতি আর দুটো হয় কী!! তারা সুখী, বড্ড সুখী। এভাবেই পূর্ণতা পাক সকল ভালোবাসা।
রাত বারটা অবধি শিশিররা সহ কুয়াশারা ছাদে গল্প করল। এরপর একে একে ঘুমের জন্য নেমে এলো। ক্লান্ত লাগছে সকলের৷
শিশির ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে আধ শোয়া হয়ে ফোন নিয়ে বসল। কুয়াশাও নিজের কাজ করে দরজা আঁটকে এলো৷ ফোন টিপছে শিশির তাই জিজ্ঞেস করল,
” এ্যাই লাইট কি অফ করে দেব? ”
” আমি করছি, তুই শো। ”
কুয়াশা তা শুনে শুয়ে পড়ল৷ এগিয়ে গেল শিশিরের কাছে৷ বলল,
” কি করছ? ”
” কিছু মেইল দেখছি৷ একটা কেস হ্যান্ডেল করতে হবে৷ ”
” ও…”
শিশির চুপ থাকল৷ কুয়াশা বলল,
” ভাবিরা আজ কি বলল জানো? ”
কাজ করতে করতে উত্তর করল সে,
” কি? ”
” আমরা নাকি বাসরঘরবীনা বাসর করেছি!”
এই কথা পেয়ে শিশির এবার ফোন থেকে মুখ তুলে তাকল কুয়াশার পানে। সে আবার বলল,
” নীহার ভাইয়ের বাসরঘর দেখে বলেছিলাম কী সুন্দর করে সাজিয়েছে! তা থেকে৷ ”
শিশির তা শুনে ফোন এবার রাখল পাশে। বালিশের উপর এক হাতে ভর দিয়ে মাথা ধরে শুয়ে কুয়াশার দিকে ঘুরে পূর্ণ দৃষ্টি দিল সে৷ বলল,
” তোর বাসরঘর সাজিয়ে বাসর করার ইচ্ছে? ”
” ছিল, এখন নেই। ”
” আগে বলিস নি কেন? ”
” কখন বলতাম? বিয়ে কি আমাদের তেমন হয়েছে? ওসব বিয়ের সাথেই মানায়। বিয়ে যখন আর সবার থেকে ইউনিক হয়েছে সো বাসরও ইউনিকই হয়েছে৷ আমরা কাপলও ইউনিক। ”
” অনুষ্ঠান করে বিয়ের ইচ্ছে ছিল? ”
” হুম, তুষার তুহিন,ভাইয়ার বিয়েতে দেখেছিলাম। ইচ্ছে হতো ওভাবে বিয়ে করার। ”
” আমি বাবার সাথে কথা বলব। বাবারা তো বলেছিল আমরা মানলে বড় অনুষ্ঠান করবে। ঢাকায় চলে গেলাম এই জন্য আর হয়ে ওঠেনি তারউপর বাবার ঐ অবস্থা হলো। ফ্যামিলি ক্রাইসিস দেখেছিলি তো! এই জন্য আমিও কিছু বলিনি নিজেও পড়াশুনো করছিলাম।”
” আরেহ্ ধুরর, ওসবের এখন আর কোনো ইচ্ছে নেই আমার৷ আমাদের বিয়ে ওটাই ভালো ছিল৷ এখানে আয়োজন করে আবার কি হবে এতগুলো বছর পর? আমার কি মায়ের বাড়ি আছে আলাদা? কোনোই মজা হবে না। সবই তো হয়ে গেছে! এখন আবার নতুন করে ঢং করার ইচ্ছে নাই৷ আমি বলেছি অন্য কোথাও বিয়ে হলে। মানে অন্য বাড়ি, অন্য ছেলের সাথে। সেটা তো হয়নি! এই বাড়িরই মেয়ে এই বাড়িরই ছেলে তো এসব ঢং করে এখন কি হবে? অযথা টাকা নষ্ট ছাড়া কিছু না। আমাদের ঐ বিয়েই পারফেক্ট। সারাজীবন মনে রাখার মতো৷ হায় রে! কীভাবেই না জোর করে বিয়ে দিয়েছিল। সেদিনের কথা ভাবলে এখনো বুকটা আমার ফাইট্টা যায়! কীভাবেই না একটা তেদর লোকের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল সকলে! লাইক, বানরের গলায় মুক্তর মালা।”
শিশির আগের কথা যেমন তেমন, শেষের কথা শুনে ক্রমেই ভ্রু কুঁচকে নিয়ে রেগে উঠল। কত্ত বড় সাহস এর! মানে, তাকে বানর বলল! শিশির রেগেমেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” গোবর ঠাসার বাচ্চা! ”
বলেই দুইহাতে কুয়াশার পেট ধরে নিজের শরীরে উপর তুলে নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। কুয়াশা খিলখিল করে হাসছে৷ শিশির রাগের সাথে বলল,
” এ্যাই ফাজিল আমায় তুই বানর বললি? বেয়াদব! ”
” হ্যাঁ বুঝতে লেট করো কেন এতো? ”
শিশির দিল চুল টেনে। কুয়াশা আহ্ করে উঠল৷ শিশির বলল,
” তবে তুই ঠিকই বলেছিস আমাদের সব কিছুই ইউনিক। বাসরটাও করলাম ইউনিক। আহা এখনো সেই ফার্স্ট নাইটের কথা মনে…. ”
” অসভ্য ফাউল একটা! চুপপ করো! ”
শিশিরের কথায় মুখ ধরে থামিয়ে কুয়াশা বলে উঠল উক্ত কথাটা৷ শিশির হাসছে৷ সে বলল,
” হ্যাঁ, ইউনিক৷ আমার আর ইচ্ছে নাই ওসবের৷ একবাড়িতে ওসবের দরকার নেই৷ তোমার সাথে সুখে সংসার করব সারাজীবন এটাই এখন একমাত্র ইচ্ছে, চাওয়া এর বেশি আর কিছুই চাওয়ার নেই। আল্লাহ্’র কাছে যা চেয়েছিলাম সেই কোহিনূর আমি পেয়ে গেছি।”
শিশির মুখ থেকে কুয়াশা হাত তুলল।কুয়াশাকে শরীরের উপর থেকে টেনে মুখের সামনে নিল৷ একহাত গালের উপর নিয়ে বলল,
” ইনশাআল্লাহ, আজীবন তোকে সুখী রাখার চেষ্টা করব৷ আমার মৃত চাচুর আমানতের দায়িত্ব নিয়েছি। বাবা, চাচুরা নিজে হাতে তুলে দিয়েছেন আমিও পালন করব৷ আমার বউটাকে সব সুখ দেবার চেষ্টা করব৷ ”
কুয়াশা আবেশে শিশিরের বুকের উপর মাথা রাখল৷ শিশির একটুখানি ঘুরে লাইট অফ করে দিয়ে দুইহাতে জড়িয়ে ধরল কুয়াশাকে। অভাবেই চোখ বুজল সে-ও।
আজ মালিথা ভিলায় বৌভাতের অনুষ্ঠান। সকাল ভোরে আলোআঁধারি নায়-ই কাঁটতে সব আয়োজন শুরু হয়ে গেছে৷ বড়রা অর্থাৎ জাকিয়ারা তিন জা সহ জাকির, জাহিদ মালিথারা তদারকি করছে৷ বাবুর্চিরা রান্নার কাজে লেগে পড়েছে। আত্নীয়দের সকালের খাবার রান্না করে অনুষ্ঠানের রান্না করছে৷ বাসন-কোসনের টুংটাং, আত্নীয়দের হট্টগোল। ছোটদের মাঝে অনেকেই এখনো নিচে নামে নি।
শিশির, কুয়াশা নিচে নামল সেসময়ে একসাথে৷ বৃষ্টি, ইয়াসমিনও এলো। বর্ষণ এখনো ঘুমচ্ছে। তুষার, তুহিন বাবাদের সাথে। শিশিররা নামতেই একে একে অনেকেই একটু পর চলে এলো৷ রিজভী, স্মৃতি, মিহির, ঈশা, অয়ন, শান্ত, নাদিম সকলে এলো৷ অনিরা এখনো আসেনি৷ বসার ঘরে বসে সব টুকটাক গল্প করতে লাগল।
আজানের সময় নীহার শশীকে তুলে পাকসাফ হয়ে নামাজ পড়েছে। শুধু নামাজটা কোনো রকম আদায় করেছে শশী৷ শরীর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে তার৷ একদম নেতিয়ে পড়ে আছে বিছানায়৷ ব্যথা-বিষে জর্জরিত পুরো শরীর। এদিকে পেট ব্যথায় ফুঁপাচ্ছে। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে৷ এসব দেখে নীহার পাগল প্রায়৷ কী করবে না করবে সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে তার। বউ তার একদিনেই নাজেহাল আর সে কিনা এই কয়টাদিন আদরে আহ্লাদে রাখতে চেয়েছিল!! ভবিষ্যত তার বানের জলে ভেসে যাবার মতো। সে-তো অতি সাবধানই ছিল! তবুও এই অবস্থা! মেয়েমানুষের এতটা নাজুক হলে চলে! বয়সও তো কম না৷ ঊনিশ চলে, তবুও! এই জন্যই সে বলেছিল শরীর সাস্থ ঠিক করতে। শরীরে তো হাড্ডিগুড্ডি ছাড়া কিচ্ছু নাইকো-ই সাথে জোর বলও নাই। ভেবেই একটু বিরক্ত লাগল নীহারের৷ পাশে বসে থেকে মাথা ঘুরিয়ে শশীর উদ্দেশ্যে বলল,
” বলেছিলাম শরীর স্বাস্থ্য ঠিক করো৷ একটুও জোর বল নেই এই শরীরে৷ এই শরীর নিয়ে নেচে তো ভালোই বেড়াতে পারো তিড়িং বিড়িং করে! তোমার এই অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমি রাতে অশুর হয়েছিলাম!”
শশী কিছুই বলল না৷ সে আগের ন্যায় বিছানায় বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে চলল৷ নীহার ভাবছে কাকে ইনফর্ম করলে ভালো হবে আর সব কিছুর হ্যান্ডেল করে সলিউশন পাওয়া যাবে৷ যদিও ফাস্ট এইড বক্সে নরমাল পেইন কিলার, জ্বরের অ্যান্টিবায়োটিক আছে কিন্তু এতে কাজ হবে বলে মনে হয়না। জ্বর অতিরিক্ত উঠেছে।
তাই একবারে ভালো ঔষধ দিয়ে ব্যথা, জ্বর কমানোর কথা ভাবল৷ আজ এভাবে পড়ে থাকলে ব্যাপারটা একদমই খারাপ হবে। ডক্টরের পরামর্শ নিতেই হবে৷ ভালো ঔষধ দিতে হবে। ভাবতে ভাবতে সে আগে শশীকে থামানোর প্রস্তুতি নিল৷ বউটা তার বাচ্চা সাথে অতিরিক্ত নাজুক হারে হারে টের পেয়েছে৷ এরপর থেকে নিজের আরো সাবধান হতে হবে। ভেবেই শশীকে হাত ধরে তুলল। তুলে নিজে আধ শোয়া হয়ে বসে ছিল সেই কোলে বউকে বসিয়ে জড়িয়ে নিল৷ বুকের উপর মাথাটা নিয়ে বাচ্চাদের মতো করে জড়িয়ে ধরল। শশীও চুপটি করে রইল। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে কী যে করবে মেয়েটাকে নিয়ে! বাড়ি ভর্তি আত্নীয় স্বজন কী ভাববে! লজ্জায় মাথা কাটা যাবে বউয়ের এই অবস্থা টের পেলে। একে যত জলদি সুস্থ করা যায় ততই ভালো। ভেবে বলল,
” খুব ব্যথা করছে! ”
” হ্যাঁ ”
” জ্বরও ভালোই উঠছে! ”
বলে কপালে চুমু দিল। দুইহাতের আঁজলায় নিয়ে আহ্লাদী বাণী ছুড়ল,
” স্যরি বউপাখি, কেঁদো না।”
” উহু, আমিই স্যরি। বউ হিসেবে পারফেক্ট না আমি। আপনার কোনো দোষ নেই। ”
নীহার বিদ্যুৎ গতিতে শশীর মুখের দিকে তাকাল। শশী লজ্জা পেয়ে গেল। তবুও বলল,
” আপনি পারফেক্ট স্বামী। সবদিক দিয়ে পারফেক্ট।”
” ইঁচড়েপাকা তো আর স্বাধে বলি নাহ্!! বাচ্চা বউ আমার কী পাকা দেখো!”
শশী মুখ খুলে শব্দহীন হেসে ফেলল। নীহারের বুকে কপাল ঠেকিয়ে দিল। নীহারও ঠোঁট টিপে হাসল। বুকের সাথে চেপে ধরে কল দিল শান্তকে। ওপাশ থেকে রিসিভ করলে সে বলল,
” শালা ঘুম তোদের ভাঙেনি! সারারাত কি করছিলি? ”
শান্তর কথা এলো,
” শা-লা আমাদের ঘুম ঠিকই ভাঙছে৷ তোরই ভাঙেনি। সারারাত জাইগা তুমি ছিলাও ব্যাটা আমরা নাহ্। এখন উল্টা গলাবাজি রাখ আর বল কী হইছে!”
নীহার এবার শীতল হলো৷ হুমকি দেয়া স্বর করে বলল,
” ম্যাসেজ করছি৷ যা বলব একদম কাঁটায় কাঁটায় করবি নয়তো আজ আমার নতুন জুতোজোড়া ছিঁড়েই ছাড়ব!”
বলেই কল কেটে দিল৷ ম্যাসেজ করে সেন্ড করল। শশী হতবাক হয়ে গেল৷ বলল,
” এসব কী! ”
” কি?”
” শান্ত ভাইকে এসব বললেন?”
” নাহ্। শুধু বলেছি শিশিরকে সাথে করে ডক্টরের কাছে যেতে৷ এছাড়া উপায় নেই৷ আমিও এখন বেরোতে পারব না৷ ভাইরা নানান প্রশ্ন করবে বিব্রত হব। লজ্জায় পড়তে হতো পরিবারের সামনে। তাই ওসব ঝামেলায় গেলাম না৷ শিশির সব হ্যান্ডেল করে নেবে ওদিকে৷ ভাই আমার প্রচুর বুদ্ধিমান। ডক্টরের কাছে গিয়ে কল করাবে সরাসরি। ডক্টরকে আমি নিজেই বলব।”
শশীর তবুও লজ্জা লাগছে৷ বলল,
” লজ্জা পাচ্ছি আমি!”
বলেই মুখ ঢেকল বুকে৷ নীহার হেসে বলল,
” তুমি যদি জ্বরে এভাবে আজ পড়ে থাকো এমনিতেও লজ্জায় পড়বে। একটু পর সকলে জেনে যেত, তখন কি করতে? আর পরামর্শ অনুযায়ী ভালো ঔষধ খেলে এক-দুই ঘন্টার মাঝে কমে যাবে সব৷ তাহলে ম্যানেজ করে নিতে পারব বুঝলে? আমি চাইনা আমার বউ গুরুজনদের সামনে লজ্জায় পরুক। শিশির আমার ভাই ঠিকই কিন্তু ওর সাথে আমার বন্ধুর মতোই সম্পর্ক। আর তোমার বড় ভাইও তাই ওকেও সরাসরি কিছু বললাম না৷ এমনি বুঝে নেবে৷ সব দিকেই বিবেচনা করে এটাই ব্যাটার মনে হলো আমার। সো, নরমাল হও। ”
শশী মুগ্ধ হলো স্বামীর উপর। কী সুন্দর পরিবার থেকে বউকে প্রটেক্ট করে নিচ্ছে! সত্যি এসবে পরিবারের সামনে লজ্জায় পড়তে হতো৷ নীহার বলল,
” একটু কষ্ট করো একটু পরেই ঔষধ আনবে। আমি ভাবিকে খাবার নিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেব। সব ম্যানেজ করে নেবে৷”
থেমে শশীর মুখ উঠাল৷ একটু মেকি ঝাঁঝ নিয়ে আবার বলল,
” তোমার চোখ মুখ বসে কী অবস্থা হয়েছে দেখছ? একদিনেই কুপোকাত! জ্বর টর বাঁধিয়ে বসে থাকল৷ আমার ছুটিটায় মাটি করে দিল!”
শশী নীহারের মুখের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে বসে রইল৷ কথায় বলতে পারল না৷ নীহার শশীর দিকে তাকাল৷ বলল,
” কী ওভাবে কি দেখছ? ভুল বলেছি আমি? ”
শশী বিরক্ত হয়ে নীহারের বুকে কামড় বসিয়ে দিল৷ বলল,
” হ্যাঁ, ভুলই বলেছেন। ফাজিল পুরুষলোক!”
” বাচ্চা মেয়ের সাহস দেখেছ! ”
শশী ভেঙচি কেটে কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল৷ নীহারও হেসে জড়িয়ে ধরে রাখল।
সকাল সাতটার দিকে নীহার নিচে নামল। সকলে বসার ঘরেই ছিল৷ বৃষ্টিরা সকলে বসে আছে। শিশির, শান্ত মাত্রই এলো। নীহার বৃষ্টির কাছে গিয়ে বলল,
” ভাবি! ”
” হ্যাঁ দেবরজী! ”
” উঠে আসো একটু। ”
বৃষ্টি আসলে জিজ্ঞেস করল ডাকার কারণ। সে বলল,
” একটু উপরে যাও। শশীর জ্বর উঠেছে। শিশির ঔষধ এনেছে ঐ দেখো দাঁড়িয়ে। নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দাও। একটু খাবার নিয়ে যাও। ম্যানেজ করো সব৷ ”
নীহার কথাগুলো বলতে খুবই বিব্রত হলো৷ ইয়ারকি ফাজলামি চলে কিন্তু এমন কথা একটু বিব্রতই হচ্ছে। যতোই ভাবি হোক! তাদের ভাবির সাথে গভীর ফাজলামোর কোনো সম্পর্ক নেই। যথেষ্ট সম্মান করে সবাই বৃষ্টিকে। এতগুলো দেবরের মাঝে সে-ও বেশ সাচ্ছন্দ্যেই চলাফেরা করে নতুন থেকেই৷ দেবরগুলোও তেমনই৷ এই জন্য নীহার বিব্রতই হচ্ছে। বৃষ্টি বুদ্ধিমতি বীনা কথায় মেনে নিল৷ আর কাউকে কিছু না বলে না বুঝতে দিয়ে নিজেই খাবার নিয়ে শিশিরের থেকে ঔষধ নিয়ে উপরে চলে গেল৷ বাড়ির বড় বউ সে। সব দিকে সামলানোর দায়িত্ব তার এবং এতগুলো বছরে সে শিখেও গেছে তা৷
সকাল দশটার দিকে হৈহল্লা বেঁধে গেল। সকালের খাবার খেয়ে সব কাজে নেমেছে৷ শিশিররা সকলেই ব্যস্ত। বৃষ্টি শশীকে আর এই বেলায় নিচে যেতে দিল না৷ তারা সকলে শশীকে সঙ্গ দিল ওর ঘরে৷ একটু পরেই বিউটিশিয়ান আসবে। শশীকে সাজাতে বসিয়ে তারা গোসল সারবে। তারাও সাজবে৷ এতগুলো মেয়েরা সাজবে লেট হবে। আপাতত ঘরেই কাজ চালাল৷ বৃষ্টিও তেমনটাই জানিয়েছে বলে কেউ আর শশীকে নিচে ডাকেনি।
দুপুর বারটার পর শশীকে সাজানো হয়ে গেছে৷ পরনে তার গোলাপি রঙের ভারী লেহেঙ্গা। ভারী মেকআপ সাথে জুয়েলেরী অসম্ভব সুন্দর লাগছে৷ শশীর পর কুয়াশা সাজছে। বৃষ্টি ছেলেকে তৈরি করতে গেছে৷ বর্ষণকে তৈরি করে সাজবে৷ কুয়াশাও লেহেঙ্গা পরেছে একদম গাঢ় সবুজ রঙের৷ এটা কেনা ছিল তার৷ লেহেঙ্গাটা অসম্ভব সুন্দর। গাঢ় সবুজ লেহেঙ্গা ভারী মেকআপ, সোনার গহনা পুরো অপ্সরা৷ শিশিরের অপ্সরা৷ সাজ হয়ে গেলে সে নিজেদের ঘরের দিকে গেল।
শিশির গোসল করতে ঢুকেছে। পানির শব্দ আসছে৷ তাই সে বসল বিছানায়। কিছুক্ষণ পর শিশির বের হলো৷ বের হয়ে কুয়াশাকে দেখল৷ চোখ জুড়ানো সুন্দরী বউ তার। এমন সুন্দরী বউ থাকতে কী বাহিরের মেয়েদের দিকে তাকানোর প্রয়োজন পড়বে? উহু একদম না! অন্তত তার তো পড়বে না৷ অন্যদের পড়বে কীনা জানা নেই৷ ভেবেই এগিয়ে গেল৷ সামনে দাঁড়িয়ে তার সেই উপমা আওড়াল,
” আমার অপ্সরা আহ্লাদী বউ। ”
কুয়াশা মিষ্টি হাসল৷ সেজেই সর্বপ্রথম সে স্বামীকে দেখাতে এসেছে৷ বাহিরের পুরুষের সামনে সে যায়নি আগেই৷ তার স্বামীর অধিকার সে। হাসি মুখেই কুয়াশা উঠে দাঁড়াল৷ শিশিরের গায়ে কিছু নেই পরনে শুধু পাঞ্জাবির পাজামা। সেটাও গাঢ় সবুজ৷ আজ তাদের ড্রেসআপ মেসিং হয়ে গেছে৷ কুয়াশা বিছানা থেকে সিম্পল হালকা কাজ করা গাঢ় সবুজ পাঞ্জাবিটা তুলে নিল৷ দুই কদম এগিয়ে স্বামীর সামনে দাঁড়াল। একদম অতি নিকটে। তাকাল শিশিরের দিকে। দু’জনের নজরে নজর বন্দী করা৷ কুয়াশা একহাত শিশিরের কাঁধের উপর দিয়ে স্বামীর অর্ধভেজা নগ্ন লোমশ বুকে চুমু আঁকল ঠোঁটজোড়া দাবিয়ে। শিশির অমায়িক হাসল৷ মুখ তুলে কুয়াশাও অমায়িক হাসল। এরপর হাতের পাঞ্জাবিটা শিশিরকে পরিয়ে দিল নিজেই৷ শিশির নির্বিকার। সে ঠাঁই দাঁড়িয়ে শুধু বউয়ের কাজে সায় দিচ্ছে।
আবার বিছানার উপর থেকে কালো কোটিটা তুলে নিল৷ কোটিটার বোতাম খুলল এরপর শিশিরকে হাত দিতে ইশারা করল৷ বীনা বাক্য বউয়ের থেকে পরে নিল সে৷ কুয়াশা অতি যত্নে এক একটা বোতাম লাগাল পাঞ্জাবির উপরের কালো কোটিটার৷ শেষ করে তাকাল। শিশিরের ভেজা চুলগুলোর মধ্যে হাতের আঙুল গলিয়ে দিয়ে এলোমেলো করল চুল। হাসল দু’জনেই। কুয়াশা এক হাতে লেহেঙ্গা ধরল অন্যহাতে শিশিরের ডান হাতটা। এগিয়ে গেল মিররের সামনে। তাকাল দুইজন পাশাপাশি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়৷ ইশশ কী সুন্দর মানিয়েছে দু’জনকে! পারফেক্ট কাপল। কুয়াশা কালো বেল্টের ঘড়িটা তুলে নিল ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে৷ সেটাও শিশিরের বাম হাতে পরিয়ে দিল৷ চিরুনী নিয়ে শিশিরকে মাথা ঝুঁকাতে ইশারা করল। এবার নিঃশব্দে হেসে ফেলল শিশির৷ ঝুঁকিয়ে দিল মাথা বউয়ের সামনে। কুয়াশা মুচকি হেসে সুন্দর করে চুলগুলো গুছিয়ে আঁচড়িয়ে দিল, শিশিরের হেয়ার স্টাইল অনুযায়ী৷ পারফিউম নিয়ে স্প্রে করল। এরপর তা রেখে মাথা তুলে তাকাল। কুয়াশা তার সুদর্শন স্বামীকে এবার চোখ ভরে দেখল। এরপর জড়িয়ে ধরল দুইহাতে। শিশিরের পিঠের উপর আলতো করে দুই হাত রাখল। বুকে মাথা রেখে বলল,
” আমায় সর্বপ্রথম দেখার একমাত্র অধিকার আমার সুদর্শন স্বামীর তেমনই আমার স্বামীর উপর মুগ্ধ হবার, আকৃষ্ট হবার অধিকারও একমাত্র আমারই। ”
তা শুনে শিশির বুক থেকে মুখ তুলল কুয়াশার৷ কপালে চুমু আঁকল। বলল,
” আমার একমাত্র বউয়েরই সব অধিকার। আজীবন তা বজায় থাকবে৷ এমন মায়াবিনী বউয়ের উপর থেকে নজর সরাতে আমার ইহজীবন শেষ হয়ে যাবে। পরপারে গিয়েও আমার অপ্সরাকে দেখব। ”
কুয়াশার চোখ ছলছল করে উঠল। বলল,
” মাথা ঝুঁকাও আবার! ”
শিশির মুচকি হেসে ঝুঁকাল৷ সে শিশিরের কপালে চুমু দিল। মুখ তুলে চোখের অতল গহ্বরে চেয়ে বলল,
” আল্লাহ যেন এই ইহজীবনের মতো জান্নাতি সুখ আমায় পরকালেও দেন৷ আমি যেন আমার স্বামীর সাথে পরপারেও এভাবে থাকতে পারি। সেখানেও যেন আমার জান্নাত আমার শান্তির কারণ হয়৷”
কুয়াশার কথায় বুকের কোথাও গিয়ে যেন লাগল তার৷ প্রশান্তিময় হাসল। বুকটা ভরে উঠল৷ ইশশ এত সুখ কোথায় রাখবে সে! এই মেয়েটাকে কখনো এমন ভাবেই নি৷ অপছন্দের জন্য কখনো ভালো গুণ দেখেনি৷ মেয়েটা যে অমায়িক!! পরিবারের একমাত্র মেয়েরা যদি এত এত ভালোবাসা পায় তারা হয় নাদান৷ আর তার বউ দেখো তোহ্ কী বুদ্ধিমতী! আহ্লাদী বাবা, চাচি-চাচুদের, ভাইদের কাছে আহ্লাদী। এখন তার একমাত্র আহ্লাদী। এই মেয়ের সাথে সংসার করতেও তার শান্তি মনে হয়। সারাজীবনেও বোধহয় বিরক্ত আসবে না। আসবে কি করে? মেয়েটা তো সেই সুযোগই দিচ্ছে না৷ তিনটা বছর হতে যাচ্ছে এখনো রোজ রোজ সম্পর্কের নতুনত্ব পায় সে। মেয়েটা রোজ নতুন নতুন অনুভূতির সাথে পরিচয় করায়। কুয়াশা হাসল। এরপর জুতোর র্যাক থেকে শিশিরের জুতো আনল। সামনে লেহেঙ্গা একটু তুল নিয়ে বসল হাঁটু মুড়িয়ে। শিশির হতবাক, অবাক হলো। বিমূঢ় বদনে চেয়ে রইল। একটা জুতো নিয়ে মাথা তুলে বলল,
” পা দাও! ”
শিশির তড়াক বলল,
” ওঠ আমি পরে নিচ্ছি! ”
” বেশি বলো সবসময়। পা দিতে বলছি দাও! ”
বিরক্ত আর জিদ্দি স্বর তার৷ শিশির উপায় না পেয়ে দিল। একে একে দুই পায়েই পরিয়ে দিল এরপর উঠে পড়ল। তাকাল শিশিরের পানে। শিশির অনিমেষ চেয়ে বউয়ের দিকে। এরপর হাত ধরে টেনে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে নিল৷ কুয়াশাও ধরল। হাসল সে। সময় নিয়ে জড়িয়ে নিজের বুকের প্রশান্তি মেটাল৷ বউয়ের উম্মুক্ত কাঁধে চুমু দিল ঠোঁটজোড়া রেখে৷ ছেড়ে দিয়ে উন্মুক্ত বুকে চুমু দিল। এমন লক্ষ্মীমন্ত বউয়ের প্রতি সে আবেগী হয়ে উঠল৷ তাকিয়ে দু’জনেই মুচকি হাসল। শিশির বউয়ের হাত ধরল শক্ত করে আঙুলের মাঝে আঙুল গলিয়ে দিয়ে। এরপর বলল,
” চল!”
বলে পা বাড়াল৷ কুয়াশাও বিনা বাক্যে পায়ে পা মিলাল।
নিচে নামল শিশির কুয়াশা হাত ধরে একসাথে। দুইজনের ড্রেসআপ মিলে যাওয়াতে সকলের চোখে পড়ল। মুগ্ধ হলো উপস্থিতরা৷ জাকিয়া, আজমিরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ দুই জনই অমায়িক হাসলেন৷ কী সুন্দর মানিয়েছে দু’জনকে!! প্রাণ ভরে তাদের ছেলে মেয়েকে দোয়া দিলেন। নীহার, শশীকে আগেই বৃষ্টিরা নামিয়ে এনেছে। সকল আত্নীয়রা চলে এসেছে। নীহারের পরনেও গোলাপি পাঞ্জাবির সাথে কালো কোটি। পুরুষরা একই রকম পরেছে৷
দুপুর তিনটার দিকে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করল। হানিফ সাহেব মেয়ে আর মেয়েজামাইকে নিয়ে যাওয়ার তাড়া দেখালেন৷ সকলেই সম্মতি দিলেন৷ জাকির মালিথা জলদিই বেড়িয়ে পড়তে বললেন। জাকিয়া, আম্বিয়া, আজমিরা নতুন বউমাকে বিদায় দিলেন৷ তিনটার পর ওরা চলে গেল। অনি আর ওর স্বামী চলে গেল। অভিও ওর বউকে নিয়ে চলে গেল৷ রিজভীও স্মৃতিকে নিয়ে চলে গেল। থাকল শুধু আম্বিয়ার বোন, বোনজামাই, অয়ন, ঈশা। ঈশার বাবা, মা চলে গেলেন সকলের থেকে বিদায় নিয়ে৷ সাব্বির, সাবিব আজ থাকবে বড় ফুপুর বাড়ি৷ বিকেল হতে হতে বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল অনেকটা৷
বর্ষণ দুরদুর করে বেড়াচ্ছে বসার ঘরে৷ হিম কোলে তুলে নিল৷ নিয়ে বসল সোফায়৷ চেঞ্জ করতে গেছে সকলে উপরে আর পুচ্চুটাকে নিচে রেখে গেছে৷ জাকিয়ারা অবশ্য দেখছেন বসে৷ সে খেলা করে বেড়াচ্ছে। হিমকে পেয়ে ডাকল,
” তাতু তাতু! ভুমম… ”
হিম তা শুনে চুমু দিল গালে৷ নরম তুলতুলে গাল। খেলতে লাগল হিমের সাথে সে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে৷ সকলে নামাজ কালাম আদায় করে বসেছে বসার ঘরে। জাকিয়ারা, জাকির মালিথারা বসার ঘরেই৷ অনেকে অবশ্য নেই এখানে৷ ওনারা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসেছেন৷
শিশির গরমে না পেরে গোসলে ঢুকেছে। ঐদিকে ব্যস্ত ছিল কাজ করতে হয়েছে। গা চিপচিপ করছে। সাতটা বাজে। কুয়াশা নিচে থেকে ঘরে এলো। দেখল বিছানায় বসে শিশির চুল মুচছে৷ সে দরজা আঁটকে দিল। শিশিরের সামনে এসে শিশিরের থেকে তোয়ালে নিয়ে পাশে রাখল। শিশির ভ্রু কুঁচকাল কিঞ্চিৎ। তা দেখে আহ্লাদী এবার আহ্লাদের ভোল ধরল। বসে থাকা শিশিরের কোলের উপর চড়ে সামানাসামনি বসল৷ দুই পা শিশিরে দুই পাশে গলিয়ে দিয়ে শিশিরের ঊরুর উপর বসেছে। দুই হাতে পেটের নিচে দিয়ে গলিয়ে পিঠের উপর নিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তৎক্ষনাৎ। স্বামীর কাঁধের উপর মাথা এলিয়ে দিয়ে লেপ্টে রইল চোখ বন্ধ করে বুকের সাথে৷ শিশির পুরোটা ক্ষণ চুপ থেকে আহ্লাদী বউয়ের কার্বার দেখে গেল শুধু৷ এবার সে-ও কুয়াশার পিঠে এক হাত দিয়ে অন্যহাত মাথায় রেখে বলল,
” কি হয়েছে আমার বউয়ের? ”
” কিছু না ”
” কিচ্ছু না? ”
” হুঁ ”
বলে মাথা তুলল কাঁধ থেকে দু’জনে সামনাসামনি। একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছে৷ শিশিরের পা’জোড়া মেঝেতে সেই পা’জোড়ার ঊরুর উপর কুয়াশা বসে। কুয়াশা কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল শিশিরকে। এরপর শিশিরের মুখটা দুই হাতের আঁজলায় নিয়ে অধর চুম্বন করল। শিশির বুঝল না হলোটা কি এটার? আজ হঠাৎ এত আদর পেল কেন নিজে থেকেই! তবে বউকে সঙ্গ দিল৷ একহাত কোমড়ে দিল অন্যহাত গালের উপর নিল৷ কুয়াশা দুই হাতের আঁজলায় শিশিরের মুখ ধরে রেখেছে৷
কিছুক্ষণ পর কুয়াশা ছাড়ল। শিশির দেখল বউয়ের চোখে পানি টলমল করছে৷ এখনি গড়িয়ে পড়বে। তা দেখে তড়িৎ জিজ্ঞেস করল,
” চোখে পানি কেন তোর? কি হয়েছে? কে কি বলেছে? কি লুকাচ্ছিস? ”
” কেউ কিছু বলেনি। এমনি। কে কি বলবে আমায়? আমার স্বামীর প্রতি আমি ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ হয়৷ সে সবদিক এত সহজে কীকরে সামলে নেয়? ”
শিশির ভ্রু কুঁচকাল৷ বউয়ের মুখের এক্সপ্রেশনের সাথে কথার খেই মেলাতে পারছে না৷ তার কাছে কিছু গড়বড় লাগছে৷ মুখের উপর হাত দিয়ে ঠোঁটের পাশে বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে আহ্লাদী বাণী ছুড়ল,
” কি হয়েছে সোনা? বল আমায়! ”
” বলছি তো কিছু না!”
ঝাঝ নিয়ে বলে শিশিরের শরীরের পাতলা সাদা টিশার্টের উপরেই মুখ নিয়ে নাক ঘষতে লাগল৷ নাক সহ মুখ ঘষতে লাগল৷ শিশির কথা রেখে নরমাল কথায় এলো। বলল,
” দেখ মাত্রই গোসল করে আসলাম কিন্তু! ”
” তাতে আমার কি? ”
নাক ঘষা অবস্থায় উত্তর করল৷ শিশির কুয়াশার চুলের পেছনে মুঠোয় পুরে নিয়ে মাথা উঠাল৷ চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কিছু না তো? ”
” না ”
” তো আমারও কিছু না৷ ”
বলে কুয়াশা ওড়না টেনে খুলে নিয়ে বিছানায় আউড়ে ফেলল কুয়াশাকে। কুয়াশা নির্বিকার৷ তা দেখে শিশির বলল,
” ও… আহ্লাদীর আদর লাগবে? তো এটা মুখে না বলে এত ভাজুংভুজুং করার কি আছে? ”
” তুমি যে অসভ্য একটা তাই৷ আদর দাও জলদি। ”
শিশির হেসে ফেলল। এই তার বউয়ের আহ্লাদীপনা। ভালো না বেশে থাকতে পারে!
পরের দিন নীহার শশীকে নিয়ে চলে এলো বিকেলের দিকে। শশী এসেই আনন্দে ভেঙে পড়ল। কুয়াশাদের সাথে সে পারমান্যান্ট থাকতে পারবে। সকলে মিলে বসার ঘরে আড্ডায় মত্ত হলো৷ পিচ্চি বর্ষণের কথা এবং কাজে হেসেও কুটিকুটি হলো সকলে৷ নীহার, শিশির সময় বুঝে একে অপরকে টিপ্পনী কেটে মজা করল৷ হিম সুযোগ বুঝে বরশিও ফেলল৷ কুয়াশার সাথে অলমোস্ট শিশিরের ঝগড়া, হাতাহাতি তো থাকবেই, সেটার কোনো মাফ নেই৷ তারা বুনো ওল বাঘা তেঁতুল যেখানে থাকবে লড়াই তাদের চলবেই এবং এটা চলেতেই থাকবে।
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৬৯+৭০
সন্ধ্যার আগে অয়ন তার মা বাবারা চলে গেল। ঈশাও চলে গেছে। বাড়ি এখন আবার আগের মতো ফাঁকা৷ তুষার রাত দশটার দিকে বিদায় নিয়ে চলে গেল নিজের কর্মস্থলে৷ বৃষ্টির মনটা খারাপ হয়ে গেছে এতে৷ জা’য়েরা মিলে সঙ্গ দিল অনেকটা রাত পর্যন্ত। আড্ডা করে সকলে শুতে চলে গেল৷
