ডার্কসাইড পর্ব ৬৫
জাবিন ফোরকান
দ্বিতীয় ল্যাপের রেইস চলমান।পিনপতন নীরবতা ক্রমশ নব্য উৎসাহে রূপান্তরিত হয়েছে।গর্জনরত গ্যালারি চেঁচিয়ে নিজেদের প্রতিযোগীদের উৎসাহিত করে চলেছে।প্লেয়ার বিটার নিথ*র শ*রীর ট্র্যাক থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।শুধুমাত্র থকথকে র*ক্তা*ক্ত চিহ্ন স্পষ্ট শুষ্ক মাটিজুড়ে।সেই রক্তিম আবহে একদৃষ্টে চেয়ে আছে রোযা।মস্তিষ্ক কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা অনুভূত হচ্ছে তার।তীব্র এক শীতলতা অস্তিত্বজুড়ে।মৃ*ত্যু সে দেখেছে প্রচুর।আলাউদ্দিন নামক কোনো এক কাপুরুষের বিভী*ষিকাময় মৃ*ত্যু*র উপলব্ধির মধ্য দিয়ে তার জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।
অতঃপর শুধু মৃ*ত্যুর মিছিল।একটা সময় সকল অনুভূতি ভোঁতা হয়ে এসেছিল রোযার।কিন্তু আজ,প্লেয়ার বিটার এমন অনর্থক অন্তর্ধান তার চিত্তে চির ধরিয়ে দিয়েছে।বিশেষ করে চারিপাশের মানুষের প্রতিক্রিয়া একদমই ভিন্ন।কয়েক মুহূর্ত নীরবতা থাকলেও বর্তমানে এমন উচ্ছ্বাস তাদের যেন কিছুই হয়নি এই মাত্র দেড় মিনিট আগেই।একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত করলো রোযা,আনমনে দু আঙ্গুল কপালে ঘষে নিজেকে শান্ত করতে চাইলো।এদের মানুষ ভেবে ভুল করছে সে, আঁধার জগতে বসবাসরত নিশাচর পশুগুলো মানুষ হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা।
প্লেয়ার বিটার উপর যারা বেট করেছিল,ইতোমধ্যেই সর্বস্ব হারিয়ে তারা থমথমে চেহারায় বসে আছে।অপরদিকে টিকে থাকা প্রতিযোগীদের উপর আবদ্ধ অপর সকল মনোযোগী দৃষ্টি।রোযা তাকালো,নিহাদের জন্য হলেও তাকে সবটুকু পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পাঁচটি বাইক খুবই কম দূরত্বে অবস্থান করছে। তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে ট্র্যাক ঘিরে।দ্বিতীয় ল্যাপের অন্তিম সীমানায় পৌঁছতেই বিচলিত হয়ে উঠল রোযা।নিহাদ এখনো তিন নম্বরে রয়েছে।চতুর্থ জনের সঙ্গে তার তুমুল প্রতিযোগীতা চলছে।কেউ কাউকে ছাড় দিতে যেন নারাজ।অতর্কিতেই ঘটলো ঘটনাটি।নিহাদের পাশের বাইকের ছেলেটি পা তুলে আচমকা বাইকে লা*থি হাঁকিয়ে ঠেলে দিলো।পিছলে গেল নিহাদের বাইক,ভারসাম্য হারিয়ে ছিটকে গেলো ট্র্যাকের লাইনের প্রান্তে।গর্জে উঠল সকলে,কিছু বুঝে ওঠার আগেই রোযা চেঁচিয়ে উঠলো,
– চিটিং!প্লেয়ার সিগমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফাউল করা হয়েছে!
আশেপাশে থাকা গার্ড শুধুমাত্র মাথা ঘুরিয়ে অব্যক্ত এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো।কিছুই না বলে আবার সামনে ফিরলো।তাতে তেঁতে উঠে রোযা হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে যাচ্ছিল কিন্তু দিমিত্রীর আঙুলসমূহ অত্যন্ত জোরালোভাবে তার কব্জিজুড়ে পেঁচিয়ে গেলো।এক টানে সোফার নরম গদিতে টেনে বসালো।রোযা নিজেকে ছাড়াতে চাইলেও তৎক্ষণাৎ সক্ষম হলোনা।রাশিয়ান গ্যাংস্টারের তীব্র দৃষ্টি লাভ করলো।
– দিস ইয গ্যা*ম্বলিং,এভরিথিং ইয ফেয়ার হেয়ার!
স্থবির হয়ে পড়লো রোযা,ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ট্র্যাকের দিকে।যেখানে নিহাদ ইতোমধ্যে পঞ্চম, অর্থাৎ সর্বশেষ স্থানে পৌঁছে গিয়েছে, ল্যাপ শেষ হতে অতি সামান্য দূরত্বই বাকি!চট করে রোযা টাওয়ারের দিকে ফিরল,স্না*ইপার রাইফে*লটি উঁচিয়ে ধরেছে মুখোশ পরিধানকৃত ঘা*তক,পরবর্তী নিশা*নার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত সে।একটি শক্ত ঢোক বেয়ে গেলো রোযার কণ্ঠনালীতে।নিহাদ ট্র্যাকে ফিরে আসলেও বাকিদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে।তুমুল গুঞ্জন চারিদিকে।হ্যান্ডেলে চেপে বসলো নিহাদের উভয় হাত, অতঃপর যেন এক আ*হত প*শুর হুংকার তুলে এগোলো তার বাইক।এতটা ক্ষীপ্র গতিতে যে ট্র্যাকের শুষ্ক মাটি ধূলো হয়ে চারিপাশ ধূসরিত করে তুললো মুহূর্তেই। প্লেয়ার গামা,ভিকি,আবারো প্রথম স্থানে থেকে অতিক্রম করলো দ্বিতীয় ল্যাপ,তারপরই প্লেয়ার এক্স।তৃতীয় স্থানও দ্রুতই পেরোলো,প্লেয়ার জেড,যে একটু আগেই নিহাদকে ফাউল করে এগিয়ে এসেছে।নিহাদ এবং চতুর্থ স্থানে থাকা প্লেয়ার ওয়াইয়ের মধ্যে লড়াই।আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড।তেড়ে গেলো নিহাদের বাইক।রুদ্ধশ্বাস হয়ে শুধু দেখে গেলো রোযা।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মাঝে ঘটলো ঘটনাটি।নিহাদ এতটা উচ্চগতিতে প্লেয়ার ওয়াইকে পাশ কাটিয়ে ল্যাপ অতিক্রম করলো যে সাধারণ দৃষ্টিতে তা অবলোকনে বেশ খানিক বেগ পোহাতে হলো।মিটমিট করে তাকালো রোযা ভালোমত লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যে।শুধুমাত্র দুই সেকেন্ডের ব্যবধানে নিহাদ প্লেয়ার ওয়াইয়ের পূর্বে ল্যাপ পেরিয়েছে।বাকরুদ্ধ কিছু মুহূর্ত, নিশ্চুপ গ্যালারি।প্লেয়ার ওয়াই সহসাই গতি কমিয়ে আনলো,ফলাফল তার জানা আছে,যেন মৃ*ত্যু*কে প্রলম্বিত করা।আবারো এক ঝটকা,প্লেয়ার ওয়াইয়ের বাইক ছি*টকে গেলো, শরীরটি আছ*ড়ে পড়লো মাটিতে,গড়িয়ে গেলো খানিকটা দূরে একদম ট্র্যাকের লাইনে।তারপর নীরবতা।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে শুষ্ক মাটি আরও একবার রঞ্জিত হলো মৃ*ত্যুতুলির রক্তিম বর্ণে।কম্পিত হলো রোযার সর্বাঙ্গ,দৃষ্টি বুজে নিজে দুহাতের মাঝে মুখ গুঁজলো।বুক চি*রে বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস।
দ্রুতই প্লেয়ার ওয়াইকে সরিয়ে নেয়া হলো।খেলা গড়ালো তৃতীয় ল্যাপে।বর্তমানে কোনো প্লেয়ারের অন্তর্ধানেও কারো ভ্রুক্ষেপ হচ্ছেনা।দ্বিগুণ উৎসাহে উল্লাস করে চলেছে সমস্ত গ্যালারি।রোযা শুধুমাত্র নীরব পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।সবটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার।ইচ্ছা হচ্ছে পুনরায় রেস্টরুমে গিয়ে একাকী নিজেকে আবদ্ধ করে এক কোণায় চুপচাপ বসে থাকে।কিন্তু তা আপাতত সম্ভব নয়।তার পাশে বসে থাকা দিমিত্রীকে অবশ্য বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে।হাতের হুইস্কির গ্লাসের বরফকুচি নাড়াতে নাড়াতে প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ট্র্যাকে,যেন সে নিশ্চিত এই জু*য়ায় তার পরাজিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
– আপনি কি সত্যিই রাফা কায়সারকে ভালোবাসেন?
অতর্কিত প্রশ্নে দিমিত্রী থমকালো।মাথা কাত করে তাকালো রোযার পানে।স্থির চেয়ে আছে রমণী,এক অগ্নিগহ্বর খচিত দৃষ্টিতে তার।রাশিয়ান বান্দা সামান্য হেলে বসলো, ঝুঁকে প্রশ্ন ছুড়লো,
– এখনো সন্দেহ রয়েছে?
– যথেষ্ট।যে নারী র*ক্তের সম্পর্ককেও অবজ্ঞা করতে সক্ষম,তাকে ভালোবাসার মতন কোনো কারণ দেখিনা।
রোযার মন্তব্যে সামান্য হাসলো দিমিত্রী।হুইস্কিতে দীর্ঘ এক চুমুক দিয়ে মাথা ঝাঁকালো।জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করলো,
– জগতের প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব একটি গল্প রয়েছে। তা হোক সে মানুষ দেবতুল্য কিংবা শয়তান স্বয়ং।
অন্তিম বাক্যটি উচ্চারণের দিমিত্রীর দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত দেখালো খানিক।তার ফ্যাকাশে মরুজুড়ে খটখটে এক শূন্যতা।পর্যবেক্ষণ করলো রোযা সুচারু দৃষ্টিতে।
– বলতে চাইছেন রাফা কায়সারের নিজস্ব গল্প আপনার হৃদয়কে ছুঁয়ে গিয়েছে?আপনারও কি নিজস্ব এক গল্প রয়েছে যা আপনার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে?
বরাবর রোযার নয়ন বরাবর তাকালো দিমিত্রী, অসামান্য এক শীতলতা তার মুখাবয়বজুড়ে।এই প্রথম এই পুরুষটিকে এতটা গম্ভীর এবং ভারিক্কীরূপে অবলোকন করলো রোযা। গ্রীবাদেশজুড়ে থাকা কণ্টকা*কীর্ণ গোলাপের ট্যাটু তার যেন অব্যক্ত অনুভবে সামান্য কম্পিত হলো।কন্ঠ খাদে নেমে এলো বান্দার,জানালো,
– রোযা,আমি তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।শুধু এটুকু জেনে রাখো,যদি না অতীত স্মৃতি আজও দগদ*গে হয়ে আমার হৃদয়ে গেঁ*থে থাকতো, তবে তুমি এই মুহূর্ত অবধি অক্ষ*ত থাকতে না!
স্থির চেয়ে থাকা রোযার সন্নিকটে ঝুঁকে কানের নিকট ফিসফিস কন্ঠে দিমিত্রী ঘোষণা করলো,
– কেউ কখনো খলনায়ক হয়ে জন্ম নেয়না,এই পৃথিবী তাকে খলনায়কে রূপান্তরিত করে।
বিরতি,অতঃপর,
– তোমার জীবনের নায়ক,অন্যকারো জীবনের খলনায়ক।ভুলে যেওনা কথাটা।
মুষ্টিবদ্ধ হলো রোযার উভয় হাত,দিমিত্রী আসমানকে নির্দেশ করেছে তা স্পষ্ট।বেদনাদায়ক ব্যাপার হলো তার বক্তব্য মিথ্যা নয়।
রেইস চলমান।তৃতীয় ল্যাপ পূরণে বেপরোয়া আস্ফালন প্রত্যেক প্রতিযোগীর।রোযার দৃষ্টি আপনা আপনি আবদ্ধ হলো নিহাদের উপর।ছেলেটি সর্বশেষে,অর্থাৎ চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে।প্রথম স্থানের জন্য প্লেয়ার গামা এবং প্লেয়ার এক্সের মাঝে তুমুল লড়াই চলছে।অপরদিকে নিহাদ এখনো কিছুটা দূরত্বে রয়েছে।আরো একবার পা ঝাঁকি দিলো ছেলেটা, টান অনুভূত হচ্ছে শিরায়,ক্ষণে ক্ষণে কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। দাঁতে দাঁত চেপে তা সহ্য করে গেলো প্রাক্তন হি*টম্যান। জোরালোভাবে হ্যান্ডেলে হাত চাপলো, স্পিডমিটারে গতি ছাড়ালো হুহু করে।তীক্ষ্ণ শকুনে দৃষ্টি তার প্লেয়ার জেডের উদ্দেশ্যে নিবদ্ধ।তীর্যক হাসির প্রস্ফুটন ঘটলো বিস্তৃত অধরজুড়ে।তাকে টেক্কা দিয়ে পার পাওয়া কি এতই সহজ?প্রতিশোধের উন্মত্ত বাসনাকে কোনোদিন অগ্রাহ্য করতে শেখেনি সে,সুতীব্র য*ন্ত্রণার আখ্যান তার নখদর্পণে খচিত হয়েছে বারংবার।যেন বায়ুর বেগকেও হার মানিয়ে ছুটলো নিহাদ,রুদ্ধশ্বাস দৃষ্টিপাত তার পথজুড়ে।তৃতীয় ল্যাপের অন্তিম বাক।ইঞ্জিনের গর্জন তুলে তা পেরিয়ে গেলো প্লেয়ার গামা এবং এক্স।নিহাদ আরো একটু গতি বৃদ্ধি করলো,এতটা যে বাইকের ইঞ্জিনের জোরালো কার্যক্রমে তার শরীর অবধি কম্পিত হতে থাকলো।কানে শুধুমাত্র যান্ত্রিক গুঞ্জরণ।প্লেয়ার জেডের বরাবর পৌঁছলো সে,অতর্কিতে বাইক তীর্যক হেলিয়ে সন্নিকটে সরে এলো।গ্যালারিতে এক উত্তেজনার হিড়িক পড়লো।
প্লেয়ার জেড কিছু বুঝে উঠতেও সক্ষম হলোনা।নিহাদের বাইক তার সন্নিকটে এসেছে।বাক অতিক্রমের আশায় সে অত্যন্ত দ্রুত গতি বৃদ্ধি করলেও লাভ হলোনা। শিকারী জ*ন্তুর কাছ থেকে নিস্তার বড়ই অসাধ্য।আচমকা হ্যান্ডেল ছেড়ে এগোলো নিহাদের হাত,প্লেয়ার জেডের ঘাড় বাগড়ে ধরে সহসাই হেলমেটসমেত ঠু*কলো সে বাইকের স্পিডমিটার মনিটরে।
একবার,দুইবার,তিনবার!
প্রচণ্ড গুঞ্জনে প্রকম্পিত হলো চারিপাশ, ভৎসর্ণা এবং উৎসাহ মিশ্রিত তাতে।
– ফাউল!ফাউল!
চিৎকার ধ্বনিত হতে থাকলো,তবুও বেপরোয়া নিহাদ।
– আই চিটাইঙ্গা ফুয়া মেডিত পড়িলে লুয়া, আঁর লগে তেড়িবেড়ি কইত্তে আইয়্যুস দেনা…. মদস্টিক