ডার্কসাইড পর্ব ৬৯
জাবিন ফোরকান
“ ডিয়ার লেডি কায়সার,
কখনো কি কেউ শুনেছে যে নায়ক নায়িকাকে এড়িয়ে কেউ কোনো খলচরিত্রকে উদ্দেশ্য করে পত্র লিখেছে?হাস্যকর নয় কি?উহু,মোটেও নয়।কারণ আজ আমি তা সম্ভব করে দেখাচ্ছি।
আপনি খুব শান্তিতে মৃ*ত্যুবরণ করেছেন কায়সার।ভেবেছিলেন আপনার জয় হয়েছে।চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চাঁদ এবং তার জ্যোৎস্নাকে ধ্বংস করে আপনি আপন বিজয় হাসিল করে নিয়েছেন।কিন্তু অত্যন্ত আফসোসের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে যে আপনি এবারেও ব্যর্থ হয়েছেন,প্রতিবারের মতন।সেই ব্যর্থতাটুকু আপনি নিজের চোখে দেখে যেতে পারেননি।কি ভাবছেন?আপনার মুক্তি হয়েছে তাতেই? আপনিই প্রকৃত বিজয়ী?
আফসোস,এবারেও আপনি পরাজিত।আসুন,আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলি।সেই কক্ষটি দাউদাউ আ*গুনে জ্বা*লিয়ে দেয়ার পর আপনি সেখানে উপস্থিত থাকতে পারতেন, বীরের বেশে একইসঙ্গে ভয়ংকর মৃ*ত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারতেন।কিন্তু আপনি তা করেননি, সতেরো তলার উপর থেকে লাফ দিয়ে আ*ত্মহ*ত্যা করেছেন।কি?নিজেকে দুঃসাহসী প্রমাণ করতে চেয়েছেন?দুর্ধর্ষ খলনায়িকা আপনি,যে জীবনের অন্তিম মুহূর্ত অবধি নিজের মাথা নত করেনি।কত্ত চমৎকার তাইনা?
হাহাহা!হিলারিয়াস!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আসল কারণটা আমি আপনাকে বলছি।আপনি কোনো দুঃসাহসী নন, বরং আপনি অত্যন্ত ভীতু!আপনি ভয় পেয়েছিলেন,প্রতিবারের মতন অন্তিম মুহূর্তে পরাজিত হওয়ার ভয়।আপনার অবচেতন মন নিশ্চিত ছিল যে আপনার পরাজয় সুনিশ্চিত।অন্যথায় আপনি কোনোদিন ময়দান ছেড়ে কাপুরুষের মতন আ*ত্মাহুতি দেয়ার পথ বেছে নিতেন না।ওই অগ্নিগর্ভে দাঁড়িয়েও আপনি অনুধাবনে সক্ষম ছিলেন যে এটাই সমাপ্তি নয়। চাঁদকে গ্রাস করার অভিলাষ আপনার ব্যর্থ হয়েছে, জ্যোৎস্নার নিশানা আপনার মস্তিষ্ক বরাবর।সেই মুহূর্তেই আপনার অবচেতন মস্তিষ্ক টের পায় হারের স্বাদ।সত্যিকারের বীরের মতন জ্যোৎস্নার বু*লেট হজম করার বদলে আপনি বেছে নিলেন কাপুরুষতাকে।ঝাঁপ দিলেন নিজ ইচ্ছায়,প্রমাণ করলেন আপনিই সর্বেসর্বা,আপনিই জয়ী।কিন্তু কি হলো? চাঁদ জ্যোৎস্না ঠিকই তাদের শুভসমাপ্তি হাসিল করে নিলো।একটু প্রশংসা করতেই হচ্ছে।জীবনের অন্তিম মুহূর্ত অবধি আপনি জয়ী হতে না পারলেও ম্যানিউপুলেটর অবশ্যই হয়েছেন,যার জন্য আপনি কুখ্যাত।কি সুন্দর নিজের পরাজয়ের উপাখ্যানকে বিজয়ীর উপাখ্যানে বদলে দেয়ার অপচেষ্টা করলেন!
তবে আপনি হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল চাঁদের রক্ষক,স্বয়ং জ্যোৎস্না।আপনার রচিত খেলায় আপনি খেলোয়াড় হলে সে সেই খেলার রেফারি।প্রতিদ্বন্দ্বীকে চকমা দেয়া গেলেও স্বয়ং রেফারির চোখে ধূলো দেয়ার সাধ্য কার?এই মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণের খেলায় আপনি একাই পারদর্শী নন,শি ইয ইভেন গ্রেটার ম্যানিউপুলেটর দ্যান ইউ!পার্থক্য শুধু আপনি বোনেন ধোঁকার জাল,এবং সে রচে যায় তিক্ত সত্যের মায়াজাল।সাদা এবং কালো, আঁধার এবং দীপ্তি,দুই ভিন্ন পদ্ধতি কিন্তু ফলাফল এক। ম্যানিউপুলেশন।
আফসোস হচ্ছে?আদতে আপনার কোনো জিত হাসিল হলোনা তাইনা?শুধু নির্বোধের মতন নিজের প্রাণপাখিটা বিসর্জন দিলেন।যদি আপনি সেখানেই দন্ডায়মান থেকে নিজের শরীরে বু*লেট ঠু*ক*তে দিতেন, যদি জ্যোৎস্নার হাতে আপনার বিনাশ ঘটত তবে আমি আপনাকে প্রকৃত বীর মেনে নিতাম কায়সার।কিন্তু আপনি আপন হাতে নিজেকে শেষ করার মতন ভীরুতার পরিচয় দিলেন।এখানেই আপনার অমোঘ পরাজয়। স্বীকার করুন কিংবা নাই করুন,এটাই তিক্ত সত্য।
শুধু জীবনের অন্তিম লগ্নে নয়,আপনার সারাটা জীবনই অতিবাহিত হয়েছে পরাজয়ের গ্লানিতে।জন্মের পর গোটা পঁচিশেক বছর আপনি অতিবাহিত করেছেন শুধুমাত্র ঠুনকো সুখের জোয়ারে।আদতে আপনি কোনোদিন সুখী ছিলেন না।বিকৃত একটি পরিবার,তাদের বিকৃত মানসিকতা,বন্ধুদের বিপথগামী উৎসাহ,জগতের সকল পঙ্কিলতায় নিজের অঙ্গ জড়ানো,মিথ্যা সুখের উল্লাস ব্যতীত আর কি ছিল আপনার জীবনে?বিয়ে করেছিলেন স্বামীকে, ঘর করতে পেরেছেন কি?আধুনিকতার নামে বারংবার নিজের অস্তিত্বে জড়িয়েছেন পরপুরুষের মোহ, পুরুষকে দাস বানানোর আসক্তিতে বুদ হয়ে থেকেছেন সমাপ্তি অবধি।উপভোগ,ভোগ,উল্লাস,পাপ।এছাড়া আপনার জীবনে আর কি আছে?
কখনো চাঁদ এবং জ্যোৎস্নার মতন জীবনে সংগ্রাম করেছেন?জানেন কণ্টকাকীর্ণ সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার পর একটি সুখের পরিবার লাভের আনন্দ কেমন?কখনো কোনোপ্রকার দৈহিক চাহিদা ব্যাতিত আলিঙ্গন করেছেন স্বামীকে?জানেন ভালোবাসার মানুষটার আলিঙ্গন কতটা উষ্ণ হতে পারে?কখনো ভাইবোনকে হাতের খেলনা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী বাদে বন্ধু হিসাবে ভেবেছেন?এমন বন্ধু যারা আপনার জন্য নিজ জীবন উৎসর্গেও কার্পন্যবোধ করেনা?ছোট ছোট খুশির মুহূর্ত, একে অপরের দৃষ্টির মাঝে হারিয়ে যাওয়া, বর্ষার দুপুরে খিচুড়ি এবং ডিমভাঁজা খেতে খেতে পাশাপাশি বসে বৃষ্টিবিলাস,জানেন এসবের অনুভূতি কেমন?কখনো দিমিত্রীর সঙ্গে করেছেন এসব? উপস, করবেন কিভাবে?আপনার ওই ধূসর মস্তিষ্কজুড়ে তো এসব ভাবনা আসেনা,আসে শুধুমাত্র ভোগের বাসনা।
একটা সন্তানের কথা ভেবেছেন কখনো?কল্পনাও করতে পারেন নিজের গর্ভে একটি প্রাণ ধারণের আবেগ কতটুকু?নারীত্বের শ্রেষ্ঠ অলংকার,মাতৃত্ব!জানেন কি মাতৃত্বের অর্থ কি?
আপনার গোটা জীবনটাই অনর্থক রয়ে গেলো কায়সার।আপনি কোনোদিন উপলব্ধিই করলেন না প্রকৃত সুখের মর্মার্থ!
আপনার জন্য আমার মায়া হয়।আফসোস হয় একটা কথা ভেবে,সেদিন যদি আপনি সঠিক নির্বাচন করতেন তাহলে আপনার জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো।আপনিও আপনার জীবনে একটি পরিবার পেতেন,ভাইকে পাশে পেতেন আজীবন ছায়া হয়ে রক্ষা করার জন্য, সৎ সঙ্গে আপনার জীবন হয়ে উঠত পবিত্র, পঙ্কিলতামুক্ত।হয়ত সেই সুখময় জীবনে কোনো সুপুরুষের আগমন ঘটত,যে আপনার হাতটি পরম যত্নে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বলতো, “ভালোবাসি”। সেটি হতো সত্যিকারের ভালোবাসা।ভালোবাসার নামে আসক্তি নয়।
আসক্তি কখনো ভালোবাসা হতে পারেনা কায়সার।মানুষ বলে,ভালোবাসা নাকি ক্ষণস্থায়ী,কিন্তু আসক্তি চিরস্থায়ী।বর্তমান যুগে সেটি যুক্তিযুক্ত।কিন্তু একবার চিন্তা করে দেখুন।আপনি এই দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে সেই ক্ষণস্থায়ী প্রশান্তিটুকু বেছে নেবেন, নাকি চিরস্থায়ী এক নরকমাঝে নিজেকে আজীবনের জন্য নিমজ্জিত করবেন?নির্বাচন আপনার হাতে। এবার আপনি আসক্তি চাইবেন নাকি ভালোবাসা সেটি আপনার উপরেই নির্ভরশীল।হয়ত আসক্তি মধুর লাগছে,উপন্যাসের ধূসর দুনিয়ায় তা অত্যন্ত রসিয়ে উপস্থাপনের মাঝে আপনার মস্তিষ্কও ওই বেরং আসক্তির ধূলোয় ছেয়ে গিয়েছে।অন্তত একবার ভেবে দেখবেন,উপন্যাস এবং বাস্তব জগৎ কতটা ভিন্ন!পৃথিবী আপনাকে নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন অপশন দিয়েছে।এখন আপনি যদি বিশ্রীরূপী অমৃত বর্জন করে চমৎকারদেহী বি*ষ পান করেন,তার দায় পৃথিবীর নয়!আপনার!আপনার ধূসর চিন্তাধারার!
অ্যাডাম শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ ফল গ্রহণ করে পৃথিবীতে নির্বাসিত হয়েছিল।এর দায় শয়তানের নয়, হলে অবশ্যই শয়তান যথাযথ শাস্তি পেতো।সত্যিকার দায় তো অ্যাডামের,যে নিজের বাসনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি,নিষিদ্ধ জানা সত্ত্বেও সেই ফলের স্বাদ গ্রহণের আসক্তি তাকে ঘিরে ধরেছিল।শয়তানের সামান্য উৎসাহ,এবং সেই আসক্তির জয়জয়কার।তাই সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্বাসিত হওয়ার শাস্তি ভোগ করেছিল সে,জীবন অতিবাহিত করেছে ক্ষমা ভিক্ষায়।
তদুপরি এই আসক্তির রঙিন চশমা আমাদের দৃষ্টিহীন করে দিয়েছে।আজ আমরা চোখ থাকিতে অন্ধ,মুখ থাকিতে বোবা।এর দায় পৃথিবীর কিংবা যুগের নয়,এর দায় আমার,আপনার,আমাদের সকলের।কারণ এই যুগকে পঙ্কিলতার যুগে আমরাই রূপান্তরিত করেছি!
পরিশেষে আবারো বলছি,আসক্তি কখনো ভালোবাসা হতে পারেনা কায়সার,কখনোই না!আপনি চিৎকার করে জাহির করলে,বাক্যের পর বাক্য উপন্যাসের পাতায় খচিত করলে,সেলুলয়েডের পর্দায় বিগ বাজেটে উপস্থাপন করলে,সুপুরুষের নামে নারীলোলুপ পিশাচ তৈরি করলেই সত্যি কোনোদিন মিথ্যা হয়ে যাবেনা!ওই উপন্যাসে কিংবা সেলুলয়েডে সুপুরুষ যে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেয় সে নিজের নারীর প্রতি আসক্ত, এই অনুভূতি ভালোবাসা নয় আসক্তি,যে কখনো এই আসক্তির নামে তার নারীর শরীর জর্জরিত করতেও কার্পণ্য করেনা,ঈর্ষার নামে নারীকে টেনে নিজের পদতলে নামিয়ে আনে সে আর যাই হোক,পুরুষ নয়! রোমান্টিকতার নামে চোখে কালো চশমা পরে বর্ণান্ধ হয়ে থাকার পরিণামই কিন্তু আপনি,আজকের রাফা কায়সার!
আসক্তি কোনো অনুভূতি নয়,আসক্তি অভিশাপ।
আপনি নির্বাচনে ভুল করেছেন কায়সার,এবং আপনার শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে।এটাই চিরন্তন সত্যি।
ইতি,
রোযা রেমান, চাঁদের একমাত্র জ্যোৎস্না।”
উড়োচিঠির স্থান হলো ফায়ারপ্লেসের লকলকে অগ্নিশিখামাঝে,একটু একটু করে গ্রাস হলো তা।তার ছাইসমূহ যেন বায়ুতে মিলিয়ে পৌঁছলো নরকের ঠিকানায়,ঠিক যেখানে তার পৌঁছানোর কথা।
পেরিয়েছে শরৎ এবং হেমন্তও।আরো একবার ধরিত্রীজুড়ে শীতের আবহ।শুষ্ক পুরাতন পাতার আস্তরণে ঢাকা সড়কের ধার। বিল পুকুরে টলটলে হিমেল পানি।দিবাকর নিজের তেজ হারিয়েছে,স্নিগ্ধ রশ্মির চাদরে মুড়ে আছে পৃথিবী।ঘরে ঘরে পিঠাপুলির উৎসব শুরু হয়েছে,তার সঙ্গে বছরের পাঠ্য ব্যস্ততা প্রায় ফুরিয়েছে। নব উদ্যমে এক নতুন শুষ্ক রূপে সেজেছে প্রকৃতি।সাজিয়েছে গাঁদা বাগানবিলাসের পশরা।
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের এক অভিজাত আবাসিক এলাকা।অদূরে ফ্লাইওভারে যানবাহনের ব্যস্ততা থাকলেও এই এলাকা প্রশান্ত।কর্মব্যাস্ত নগরবাসী নিজেদের অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে, স্বাস্থ্য সচেতন রমণীগণ সকালের ব্যায়াম শেষে গ্রীন টি এবং সুগারলেস কুকিজে সময় অতিবাহিত করছে।টিভির পর্দায় চলমান পাশ্চাত্য টিভি সিরিজ,নয়ত তুর্কি বিখ্যাত সিরিয়াল।উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলোর চারিপাশে সাজানো বাগানজুড়ে মালিদের ব্যস্ততা।বৃদ্ধ এবং শিশুরা সকাল সকাল হাঁটতে বেরিয়েছে পার্কে।স্কুল ছুটির আনন্দ উদযাপন দাদা নানাদের সঙ্গে।এক স্নিগ্ধ নগরজীবন যেখানে অভাব অনটনের লেশমাত্র নেই।ঝকঝকে তকতকে ছবির মতন পরিষ্কার উৎফুল্ল।
অ্যাপার্টমেন্ট থার্টিন বি জুড়ে হুলুস্থুল ব্যস্ততা।বক্সের পশরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লিভিং রুমজুড়ে।এলোমেলো জিনিসপত্রের ছড়াছড়ি।মাত্রই আনবক্স করা হয়েছে ঘর সাজিয়ে তোলার জন্য।শেলফের তাকজুড়ে নরম কাপড় দিয়ে মুছে নিচ্ছে চারুলতা।বক্স বেঁধে নিয়ে আসা সরঞ্জাম তুলতে হবে এখানে।খানিকটা দূরে একটি টিস্যুবক্স হাতে খানিক হেলেদুলে এগোলো রোযা।পরিধানে ঢোলা ফ্রক তার একদম পা অবধি ঠেকেছে।তাতেও তার উদরের ফোলাভাব স্পষ্ট টের পাওয়া সম্ভব।আধুনিক ভাষায় যাকে বলা হয়,বেবী বাম্প।সাত মাসে পড়েছে তার ভ্রূণের বয়স।শারীরিক পরিবর্তন ঘটেছে তাতে বেশ।কিঞ্চিৎ ফুলেফেঁপে উঠেছে শরীর তার,পর্যাপ্ত শারীরিক কসরত জারি রয়েছে নিয়ন্ত্রণে।তবে হাঁটাচলা,উঠাবসা এবং ঘুমানোর মতন সাধারণ কাজগুলোও দিনদিন কষ্টকর হয়ে উঠছে।
নিহাদ একটি বক্স থেকে একগাদা ফ্লাওয়ার ভাস বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে রোযাকে লক্ষ্য করে আঁতকে উঠলো।এক লাফে চড়চড় করে উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রীতিমত তার পথের সামনে।বেচারী রোযা ভড়কে গেলো।নিহাদ সুযোগ না দিয়ে এক ঝটকায় তার হাত থেকে টিস্যুবক্স কেড়ে নিয়ে হিসিয়ে উঠল,
– তোমাকে এত্ত কাজ করতে বলেছে কে?সাইজ দেখেছ নিজের? পান্ডা কোথাকার!
– এটা শুধু একটা টিস্যুর বক্স ছিলো….
মিনমিন করতে গিয়ে আরেক রামধমক খেলো রোযা।
– তো কি চাও? আসো আমার সাথে।পঞ্চাশ কেজির ডাম্বেল দুটো দুহাতে উঁচিয়ে জিমে রাখবে।আসো আসো!
– উন্নাহ…
– এখন না না করছো কেনো ফুলটুশী?খুব শখ না তোমার কাজ করার?আসো,আমি একটু তোমার কোলে উঠে আঙুল চুষি,দেখি কত্ত ক্ষমতা তোমার!পান্ডা নিজেকে সামলাতে পারেনা আবার টিস্যুবক্স সামলাতে আসে হুহ!
– এই আমাকে একদম পান্ডা বলবেনা!আমি একটু সাহায্যই করতে গিয়েছি তাতে কি এমন পাপ করেছি?
– কেনো?কাজ দেখাচ্ছ?এটা কি তোমার শ্বশুরবাড়ি লাগে?আর আমি তোমার কূটনী জাঁদরেল শ্বাশুড়ি লাগি?পান্ডা হয়েছ চুপচাপ সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে কচি কচি বাঁশ খাবে,তুমি কেনো আমাদের কাজের মাঝে বেবী বাম্প গলিয়ে বাগড়া দিতে আসবে?
– আসমাআআআন…!দেখো নিহাদ আমাকে কি বলছে!
বেডরুমের দেয়ালের অন্তরাল থেকে স্ক্রু ড্রাইভার হাতে উঁকি দিলো আসমান।পরিধানে ধূসর বর্ণের ঢোলা ফতুয়া এবং ট্রাউজার।একটি ল্যাডারের উপর দন্ডায়মান সে।দেয়ালের তাক সেট করছিলো।নিহাদ রোযার হাউকাউয়ে মনোযোগ নষ্ট হওয়ায় বেজায় বিরক্ত সে।স্ক্রু ড্রাইভার রেখে ল্যাডার বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে এলো সে। লিভিং রুমে আসতেই রোযা গুটি গুটি পদক্ষেপে তার বুক আঁকড়ে ধরে মিছিমিছি কান্নার ভান ধরে অভিযোগ দায়ের করতে আরম্ভ করলো,
– দেখোনা!ওই পাগলাগারদের দারোয়ানটা আমাকে পান্ডা বলে খেপাচ্ছে!
– পাগলাগারদের দারোয়ান!
টিস্যুর বক্স মাথায় তুলে প্রসারিত দৃষ্টিতে বিস্ময় নিয়ে তাকালো নিহাদ,তাতে রোযা ভেংচি কেটে বিড়বিড় করলো,
– পাবনার পাগলাগারদের পাগলু দারোয়ান।
– আসমান ভাই,দেখলে!দেখলে তোমার বউয়ের কত্ত বড় সাহস!পান্ডা বলে ভুল করেছি।ভাল্লুক একটা!
দুইপা দুদিকে এলিয়ে রোযাকে ভেঙিয়ে শিম্পাঞ্জির মতন হাঁটার ভঙ্গি করে নিহাদ ব্যাঙ্গ করলো,
– সারাটাদিন এভাবে পেঙ্গুইন সেজে হাঁটতে থাকে, চিৎ হলে উল্টাতে পারেনা উল্টালে চিৎ হতে পারেনা আবার মানুষকে বলে পাগলাগারদের দারোয়ান!
– এএহ….আসমাআআন…..
রোযা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে দিতেই একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত করলো আসমান।আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে এনে তীব্র দৃষ্টিতে নিহাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
– কেনো শুধুশুধু ওকে জ্বালাতন করছো?তুমি যখন পা ভেঙে হুইলচেয়ার নিয়ে ঘুরতে তখন কি ও একবারও বলেছে তোমাকে স্টিফেন হকিংয়ের মতন দেখতে লাগে?
থতমত খেয়ে গেলো নিহাদ,অপরদিকে তীর্যক হেসে আসমানের বুক থেকে মাথা উঁচিয়ে বিজয়ীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রোযা।স্বামীকে নিয়ে সে গর্বিত।নিজের হাসির উদ্রেক ঠেকাতে পারলোনা চারুলতা।মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসতে থাকলো,শরীর তার কাঁপলো তার আবহে।নিহাদ ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পরবর্তীতে আসমানের উদ্দেশ্যে ফিরলো,
– ভালো তো।স্টিফেন হকিং তো একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলো,পঙ্গুত্ব বরণ করলে হবে কি মস্তিষ্ক তো ক্ষুরধার!তোমার বউয়ের মতন অলস বাঁশ খাওয়া পান্ডা তো না!
– তুমি বাঁশ খাও,তোমার গুষ্টি বাঁশ খায়।
রোযার উত্তেজিত কণ্ঠের বিপরীতে বিস্তর হাসলো নিহাদ, মাথা কাত করে চুলে আঙুল বুলিয়ে এনে জানালো,
– গুষ্টি এখনো জন্ম দেয়ার সুযোগ হলোনা। নো টেনশন, আর পাঁচটা বছর অপেক্ষা করো,আমি আর আমার গুষ্টি মিলে বাঁশ খাবো শীঘ্রই।
হাসির পরিবর্তে এবার কেশে উঠলো চারুলতা।কন্ঠ আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে তার নিহাদের কথার অর্থ অনুধাবন করে।আসমান তার অবস্থা লক্ষ্য করে ভ্রু কুঁচকে বললো,
– তুই আবার কেশে নি*হত হচ্ছিস কেনো?ধূলোবালি ঢুকেছে?যা,কিচেনে আমি পানি ফুটিয়ে রেখেছি।
তৎক্ষণাৎ কোনোমতে মাথা নেড়ে লালিমা ছাওয়া কপোলে চারুলতা কিচেনে অদৃশ্য হলো।তার পথে চেয়ে দ্বিতীয় দফায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসমান খানিকটা নুয়ে রোযাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো।হতচকিত রোযা তার ঘাড় আঁকড়ে ধরে বললো,
– একি একি!আমি অনেক ভারী হয়ে গিয়েছি, তুলছো কেনো আশ্চর্য্য!
– আমার ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছো?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো রোযা,আসমান সামান্য মাথা কাত করে মৃদু হাসলো।অদূরে জানালা গলে আসা স্নিগ্ধ রবির রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে সেই হাসি ঠেকলো রীতিমত স্বর্গীয়।ঝুঁকে প্রিয়তমার নাকে নাক ঘষে দিয়ে আসমান বিড়বিড় করলো,
– পান্ডা বলেছে তো কি হয়েছে?বেশ হয়েছে তুমি পান্ডা হয়েছ, আই লাভ মাই পান্ডা ভেরি মাচ।
খিলখিল করে শিশুর ন্যায় হেসে উঠলো রোযা।দৃশ্যটির দিকে চেয়ে মুগ্ধতা অনুভূত হলেও নিহাদ কোমরে দুহাত রেখে এক অসামান্য বিতৃষ্ণা ফুটিয়ে বলে বসলো,
– ইয়াক!ক্রিঞ্জ!পুরোই ক্লাস এইটের নিব্বা নিব্বি!
তার ভৎসর্ণায় কোনোপ্রকার ভ্রুক্ষেপ না করে আসমান সাবধানে রোযাকে কিছুক্ষণ আগেই ঠিকঠাক করা সোফায় বসিয়ে দিলো।অতঃপর পা দুখানা নিজের হাঁটুতে রেখে আঙুল টেনে দিতে দিতে বিড়বিড় করলো,
– নিহাদ শুধু তোমার খেয়াল রাখতে চাইছিলো রোযা।তোমার পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন।
– সারাদিন তো শুয়েবসেই থাকি।সামান্য একটা টিস্যুর বক্স সরিয়ে রাখছিলাম তাতে কি এমন অনর্থ করে ফেলেছি?তোমরাও না,একেকটা পিস!
হাসলো আসমান, নিহাদও আপনমনে বিস্তর হেসে মাথা দুলিয়ে এগোলো।মেঝে থেকে ডাম্বেল দুটো নিয়ে জিমরুমে রাখতে গেলো।আসমান রোযার সামনে টেবিল টেনে বসলো।অতঃপর তার গোলগাল উদরে নিজের দুহাত স্পর্শ করে মৃদু স্বরে শুধালো,
– না,সিরিয়াসলি। এখন কেমন বোধ করছো?খারাপ লাগছে?
রোযা মাথা নাড়লো।আসমানের হাতের উপর নিজের একটি হাত স্থাপন করে জানালো,
– আমি একদম ঠিক আছি আসমান।চিন্তা করোনা।
– দুঃখিত,চিন্তা না করে থাকা সম্ভব নয়।যত দিন অতিবাহিত হচ্ছে ততই উৎকণ্ঠা বাড়ছে।
দুহাতের মাঝে আসমানের মুখ ধরে নিজের পানে ফেরালো রোযা,কোমল হাসিমাখা অধরে বিড়বিড় করলো,
– যার তোমার মতন একজন স্বামী রয়েছে তার ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই চাঁদ।তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।খুব শীঘ্রই তোমার অংশ তোমার কোলের মাঝে খেলে বেড়াবে,এটা তোমার জ্যোৎস্নার ওয়াদা।
অবশেষে প্রফুল্লতা ছাইলো আসমানের মুখাবয়বে।ঝুঁকে তার কপালে ভালোবাসাময় চুম্বন এঁকে দিলো রোযা। স্নেহটুকু অতি আগ্রহভরে গ্রহণ করার পর অতর্কিতে কেঁপে উঠলো আসমান।তার কৃষ্ণগহ্বরখচিত দৃষ্টিজুড়ে এক উত্তেজনাকর ঝিলিক খেলে গেলো।
– দ্যা বেইবি…ইটস কিকিং রোযা!
রোযা নিজেও অনুভব করেছে।তার অভ্যন্তরে বৃদ্ধিলাভ করতে থাকা অংশ নড়াচড়া আরম্ভ করেছে বহু পূর্বেই।কিন্তু বাহ্যিকভাবে তা উপলব্ধি সম্ভব হতোনা।বর্তমানে তা সম্ভব হচ্ছে প্রায়শই।যখনি আসমান সেই নড়চড় অনুভব করে তখনি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে।আজও তার ব্যতিক্রম ঘটলোনা।এক লহমায় রোযার উদরে কান ঠেকিয়ে একমনে শুনে গেলো আসমান।অনুভব করলো তার অংশের মোলায়েম লা*থি।দ্বিগুণ অনুভূতির প্রবাহ খেলে গেলো তার সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে।তার কাণ্ড দেখে রোযা অতি যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো,আসমান সামান্য গুঙিয়ে তার উদরে নিজের অধর স্পর্শ করে ফিসফিস করলো,
– আহ, কবে আসবে তুমি পাপ্পা?তোমাকে একটিবার আলিঙ্গন করার বাসনায় আমার অন্তর ছটফট করে চলেছে অংশ আমার।
প্রতি উত্তরস্বরুপ নিজের অংশের ঘা*ত অনুভব করলো আরো একবার।হেসে ফেললো আসমান, স্নেহের পরশে পরিপূর্ণ করে তুললো রোযার উদর,তার গর্ভে অবস্থানরত অংশকে।প্রাণভরে অবলোকন করে গেলো রোযা,অনুধাবন করলো সে আদতে কতটা সুখী!
– আপনাদের বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না আমায় কথা দিয়েছে মার্কা পিরিত শেষ হয়ে থাকলে একটু এদিকে আসুন।
নিহাদের কথায় ছেদ পড়তেই আসমান সামান্য বিরক্তবোধ করলো।নিহাদ একটি উঁচু শেলফ টেনে আনছে,অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়িয়ে এগোলো তাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে।লিভিং রুমের পার্শ্ববর্তী রুমে সেটি স্থাপন করে হাত ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আসমান জিজ্ঞেস করলো,
– এই রুমটা কিসের?
চারিদিকে নজর বুলিয়ে এলো সবার।বড়সড় একটি ডেস্ক,একপাশে কম্পিউটার টেবিল,অপর পাশে কর্ণার এবং শেলফ,একটি ছোট কাউচও রয়েছে।অন্যান্য সব রুমের তুলনায় এটি সর্বাধিক সাজানো গোছানো। রোযাও লক্ষ্য করেছে ব্যাপারটা।নিহাদের চেহারায় প্রস্ফুটিত খানিক লালচে লজ্জাপূর্ণ ভাব কারোরই দৃষ্টি এড়ালোনা।ঘাড়ে হাত ডলে সে জানালো,
– স্টাডিরুম।
– স্টাডিরুম?
আসমানকে বিস্মিত দেখালো,মাথা কাত করে সে শুধালো,
– তোমাকে তো এত কম্পিউটার বিষয়ক কাজ করতে দেখা যায়না।তার উপর স্টাডিরুম?ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছেনা।
– তুমি দুইশো পঞ্চাশ ডিগ্রি বেশি বোঝো আসমান ভাই!
লজ্জামিশ্রিত ক্রোধ প্রকাশ করে নিহাদ দ্রুতই পলায়ন করলো,জানে অধিক সময় নিজেকে স্থির রাখা সম্ভবপর হবেনা।একে অপরের পানে তাকালো রোযা এবং আসমান,উভয়ের অধরেই এক চিলতে হাসির রেখা। সত্যিটা দুইজনই উপলব্ধি করতে সক্ষম।এই কক্ষ নিহাদ চারুলতার জন্য সাজিয়েছে।
বিগত মাসগুলোয় নিহাদের মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।ঠিক স্বভাব চরিত্রে নয়,বরং অবস্থানে।ছন্নছাড়া বাউন্ডুলে ছেলেটি হঠাৎ করেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আরম্ভ করেছে।নিজের বাইক রাইডিং কোম্পানির পাশাপাশি শো রুম বিজনেস শুরু করেছে।সঞ্চয়টুকু কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে।বর্তমানে সেটিই সাজিয়ে তোলার প্রক্রিয়া চলমান।তার সঙ্গে কিছু ইনভেস্টমেন্টও করেছে আসমানের পরামর্শ নিয়ে। ব্যাপারগুলো আপাতদৃষ্টিতে তেমন কিছু মনে না হলেও নিহাদের মতন এক মুক্ত বিহঙ্গের জন্য এসব স্পষ্টত অসংলগ্ন।রোযা এবং আসমান বুঝতে সক্ষম,প্রস্তুতি নিচ্ছে সে ভবিষ্যতের। চারুলতা একজন ফ্রিল্যান্সার,প্রযুক্তিগত কাজকর্ম অত্যধিক করতে হয় তাকে।তাই নিজের অ্যাপার্টমেন্টে তার জন্য আলাদা একটা কক্ষ রাখা নিহাদের পরিকল্পনাকারী মানসিকতার পরিচয় দেয়।
কিচেনে পানি পান করার পর কাউন্টারের উপর পা ঝুলিয়ে বসে একটি টিকটিকির দিকে চেয়ে আছে চারুলতা।প্রাণীটি প্রা*ণহীন,শুকিয়ে এসেছে শরীর।কেনো যেনো ওই নিথর পানে চেয়ে চারু কাউন্টার পরিষ্কার করার বদলে ভাবনায় হারিয়ে গিয়েছে।
“এই আঙুলকে হীরকখচিত আংটিতে সজ্জিত করবো।ততদিন হয়ত এই দাগ থাকবেনা,কিন্তু এতে জড়ানো হৃদয় নিংড়ানো আবেদনটুকু সত্যিকার বন্ধনে প্রজ্জ্বলিত হবে।কথা দিচ্ছি…..আমার তেঁতুল গাছের পেত্নী!”
একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো চারুর অধর বেয়ে।নিহাদ কথা দিয়েছিল।সবকিছুর ইতি ঘটলে সে….. নাহ্।কেমন যেনো বিষন্ন লাগছে।ছেলেটার মাথায় আসলে কি চলছে?ইদানিং মনে হয় খানিক দায়িত্বসচেতন হয়েছে সে।কয়েক মাস যাবৎ তার সঙ্গে সময় অতিবাহনও হয়েছে খুব কম।অতঃপর ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে পাড়ি জমানো।নিহাদ ভাবছেটা কি?অন্তর আনচান অনুভূতিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছে।ছেলেটা নিজের কথা রাখার কোনো লক্ষণ এখনো পর্যন্ত দেখাচ্ছেনা।আর কত অপেক্ষা করা সম্ভব?আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তার সামনে অনুভূতির দাবী নিয়ে দাঁড়ানো সম্ভব নয় চারুর পক্ষে।অভিমান জমেছে হৃদয়ের কোণে।
– পানি পান করছো নাকি ওতে গোসল সারছো?
কণ্ঠটি চারুলতাকে মুহূর্তেই বাস্তবে টেনে আনলো।মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই নিহাদকে উঁকি দিতে লক্ষ্য করলো।কাউন্টার থেকে লাফিয়ে নামলেও জবাব দেয়ার আগ্রহ প্রদর্শন করলোনা সুদর্শনা।তাতে নিহাদ বুকে দুবাহু ভাঁজ করে এগোলো,চেহারায় গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাব ধরে রেখে জিজ্ঞেস করলো,
– ব্যাপার কি?ভাঙা রেডিওর মতন বাজতে থাকা পেত্নী এসে থেকে দেখছি বোবা হয়ে আছে।তোমার ভোকাল কর্ডে ঠা*ডা পড়েছে?
জবাব এলোনা। চারু শুধু থর উল্টে এক অবোধ্য প্রতিক্রিয়া দেখালো।তাতে তার নিকটে এগিয়ে নিহাদ মাথা কাত করে বললো,
– বেটি মানুষের এই সমস্যা।পান থেকে চুন খসলেই বো*মা হয়ে বসে থাকে।সমস্যা কি?
– তুমি চট্টগ্রামে কেনো ফ্ল্যাট কিনেছ নিহাদ?ঢাকায় থাকলে কি খুব ক্ষতি হতো?
অবশেষে চারুলতা উচ্চারণ করলো।বিষয়টি তাকে বেশ কয়েকদিন ধরে ভুগিয়ে যাচ্ছে।নিহাদ কিছুক্ষণ তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো,পরক্ষণেই ফিক করে হেসে উঠলো,মাথা ঝাঁকিয়ে জানালো,
– কারণ চট্টগ্রাম আমার জন্মস্থান,আমার প্রাণের শহর।এই চট্টলার বাতাসে একটা প্রশান্তি আছে,যেটা ওই রাজধানীর বুকের সুউচ্চ ভবনের এসির নিচে বসেও অনুভব করা যায়না।
নিহাদকে খানিক ভাবুক দেখালো। কিচেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে জ্বলজ্বল করছে তার টানা টানা নয়নজোড়া।ওই রোমন্থনী দৃষ্টিমাঝে হারিয়ে গেলো চারু।
– লোকাল বাসের ঝগড়া,কক্সবাজার – পতেঙ্গার নোনা বাতাস, অন্য অঞ্চলের জন্য দূর্বোধ্য চঞ্চল এই ভাষা, আকদ, মেজবান, মাঝে মাঝে সবকিছুর অভাববোধ করি।আর করতে চাইনা।
পরক্ষণেই চারুলতার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তীর্যক হেসে নিহাদ যুক্ত করলো,
– তাছাড়া বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যদি দুই কদমে পৌঁছে যাই তবে মজাটা কোথায় বলো?আমার বাচ্চা গাচ্চার দল ধুমধাম যাত্রা করে নানাবাড়ি বেড়াতে যাবে।যদি ডানে ফিরলে বাপের ঘর বামে ফিরলে মায়ের ঘর দেখে তাহলে কিছু হলো?
নিষ্পলক চেয়ে রইলো চারুলতা।তার কোমল মুগ্ধতায় ঘেরা অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে এগোলো নিহাদ।হাত উত্তোলন করে দুই আঙ্গুলে চিবুক ছুঁয়ে দিলো,অতঃপর বিড়বিড় করলো,
– পেত্নী আমার,অভিমান করোনা।ভাবছো আমি কি করছি,কেনো করছি তাইনা?শুধুমাত্র বিশ্বাস রাখো একটু।এইসবকিছু তোমার জন্য।
ঝুঁকলো সে সন্নিকটে,চারুর সমস্ত শরীর অবশ করে দিয়ে জড়ানো কন্ঠে ফিসফিস করলো,
– রেমানদের মেয়েকে ঘরে তুলে আনতে একটু প্রস্তুতি গ্রহণ তো করতেই হয়,বলো?
কম্পন খেলে গেলো অন্তরে।একটি শক্ত ঢোক নেমে গেলো চারুলতার কন্ঠতালু বেয়ে।দৃশ্যটি পর্যবেক্ষণ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ল নিহাদের পক্ষে।মসৃণ গ্লসছোঁয়া অধরপানে এগিয়ে গেলো।বুজে এলো নয়নপল্লব রমণীর।কিঞ্চিৎ হেসে ওই অধরের দখল হাসিলের প্রস্তুতি নিলো দেবভক্ত। চারুলতার অস্তিত্বে জড়ানো সুবাস নাকে ঠেকলো তার,অপূর্ব তা।কোমল এক ছোঁয়া,শুষ্ক এবং শীতল অনুভূত হলো।নিহাদের বন্ধ চোখের উপরে ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত হলো, আরেকটু জোরালো স্পর্শ করলো সে।কিন্তু মসৃণ অধরের বদলে শুষ্কতা ঠেকতেই দৃষ্টি মেললো।
মা*থায় বা*জ প*ড়লেও এতটা হতবাক হতোনা নিহাদ!
চারুলতা এবং তার অধরের মাঝে বাঁধা হয়ে রয়েছে একটি ম*রা টিকটিকি!রমণী বাম হাতের দুই আঙ্গুলে উঁচিয়ে ধরে রেখেছে তা।তীর্যক হাসি নিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে উত্তেজিত নয়নজোড়া।এতক্ষণ যাবৎ নিহাদ চারুলতাকে নয়,বরং একটা ম*রা টিকটিকিকে চুমু খাচ্ছিলো! তাই একবার না পরপর দুবার!
উপলব্ধি হতেই গা গুলিয়ে উঠল।
– ওয়াক…..!
দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে এক ঝটকায় লাফিয়ে সরে গেলো নিহাদ।প্রচণ্ড ক্রোধে হুংকার ছুড়লো,
– দরবেশের বাচ্চা শেওড়া গাছের ডাইনী!নাগিন টু সিরিয়ালের বি*ষধর নাগিন!দেবের মুভির নাখাস্তা মার্কা ভিলেন! চারু গরুর বাচ্চা!
অট্টহাসিতে ফে*টে পড়ল চারু।
– এবার কেমন লাগে?এটা তোমার শাস্তি।আমাকে আমার ড্যাড আর ভাইয়ার কাছ থেকে আলাদা করার ধান্দা তাইনা?কেমন বোধ করছো এখন রোডসাইড রোমিও?
– থু থু!ওয়াক থু!
অসহনীয় মাত্রায় নিজের ঠোঁট ঘষতে থাকলো নিহাদ, প্রয়োজনে র*ক্ত বের করে ফেলবে তবুও ওই স্পর্শ ঘুচিয়ে ছাড়বে। তা দেখে চারুর হাসির কোনো কমতি নেই।
– আবার বেহায়ার মতন হাসে দেখো।তোমার বিরুদ্ধে আমি পুরুষ নির্যা*তনের মামলা করবো শাকচুন্নি!
– করো করো।আমিও বলবো বিয়ের আগে তোমার ইটিশ পিটিশ করার ধান্দা!প্রোপোজ করতে পারেনা আবার কিস করতে আসে! শখ কত গণ্ডারটার!
নিহাদ জবাব দেয়ার অবস্থায় নেই।সে ছুটেছে সিংকের দিকে।
– ওয়াক….ওয়াক….
আওয়াজের তোড়ে রোযা এবং আসমান কিচেনে এসে উঁকি দিয়ে নিহাদের অবস্থা টাল হতে পর্যবেক্ষণ করলো।উভয়ই সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে পেট চেপে ধরে হাসতে থাকা চারুলতার দিকে তাকালো।
– আর আসবে আমাকে ডাইনী পেত্নী বলতে?মুখে একেবারে টিকটিকি ঘষে দিয়েছি!
– ওই টিকটিকির স্যুপ বানিয়ে মুখে চোঙা লাগিয়ে তোমাকে যদি না গিলিয়েছি তবে আমার নাম নিহাদ…. ওয়াক….ওয়াক!
গ্লাসের পর গ্লাস পানি নিয়ে কুলকুচি করে যাচ্ছে নিহাদ।শেষমেষ পাশের নতুন কেনা ডিশওয়াশ সোপটুকু সে জিভে ঘষতে থাকলো।রোযা হাসতে আরম্ভ করলো দৃশ্য লক্ষ্য করে।আসমান পিছন থেকে গিয়ে নিহাদের কাঁধে হাত রাখলো,
– আস্তে আস্তে,ওসব গিলে আবার টুকুশ করে ম*রে গেলে কি হবে?শেষমেষ একটা টিকটিকির চুম্বনে চট্টলার পাগলু ধরাশায়ী?
আ*গুনে দৃষ্টিতে আসমানের পানে চেয়ে থু করে সাবানের ফেনা সিংকে ফেলে নিহাদ হুংকার ছুড়লো,
– চুপ থাকো!যে বউয়ের সাথে সাথে নিজেও প্রেগনেন্ট হয়ে যায়,সে আবার আসে আমাকে বিচার করতে! কুভেড সিন্ড্রোম ভিকটিম কোথাকার!
ডার্কসাইড পর্ব ৬৮
– নিহাদের বাচ্চা!ভিটামিন উড়াধুরা মা*রের অভাব হয়েছে তোমার!
জোরালো এক চাটির বিপরীতে আসমানের বুজে ঘু*ষি বসালো নিহাদ।উভয়ের দূর্বার বিনিময়ের হাস্যকর দৃশ্যমাঝে চেয়ে রমণীযুগল আপনমনে হাসলো।অতঃপর একে অপরের দিকে তাকালো।সত্যিই রেমান পরিবারের মাঝে সুখের দিন ফিরে এসেছে। যাই ঘটুক না কেন ভবিষ্যতে,মোকাবেলা করবে তারা একসঙ্গে, বজায় রাখবে এই সুখের প্রবাহ আজীবন।
