The Silent Manor part 28

The Silent Manor part 28
Dayna Imrose lucky

“পায়ে কাদা কেন?” প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেওয়া হয় ধীরে, কিন্তু তাতে চাপা রাগের ঝাঁঝ তাঁর ভাইয়ের।ফরদিনা চোখ নামিয়ে ফেলল নিচের দিকে। জবাব নেই। রায়ান আবার বলল
“কোথায় গিয়েছিলি?”
নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল ফারদিনার, বুক উঠানামা করল।ঠোঁট নড়ে, কিন্তু শব্দ আটকে গেল গলার কাছে এসেই। তাঁর নীরবতা আরও ঘন হয়ে পড়ে।

ফারদিনা কিছুই বলতে পারল না। খানিকক্ষণেই ভয়ে চোখ থেকে জল বেরিয়ে এলো তাঁর। সুফিয়ান কে হারানোর ভয়।আরিব বলল “তুই ভয় পাচ্ছিস কেন?যেন তোঁর সামনে বাঘ পড়েছে।”
সায়েম ফারদিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল “কাঁদছিস কেন?আমাদর বল।কেউ কিছু বলেছে?বাইরে গিয়েছিলি? কেন গিয়েছিস?তখন কি কেউ কাঁদার মধ্যে ফেলে দিয়েছে তোকে?” সায়েম একসাথে অনেক গুলো প্রশ্ন করে ফারদিনার ভয় আরো বাড়িয়ে দিল।ফারদিনা আর কান্না ধরে রাখতে পারল না।এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল।রায়ান তাৎক্ষণিক ফারদিনাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল।আরিব ও সায়েম চোখাচোখি করল। তাঁরা কিছুই বুঝতে পারলো না।সায়েম দ্বিতীয় বার নতুন করে প্রশ্ন ছুঁড়তে চাইল ফারদিনার দিকে। রায়ান আঙ্গুল এর ইশারায় চুপ করতে বলল।ফারদিনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রায়ান বলল “ভয় পেয়েছিস। বুঝতে পারছি।চল ঘরে চল।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফারদিনার ঘরে তাঁরা ঘরে চলে যায়।তাঁকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়। এরপর দাসীদের ডাকে সায়েম। ওঁরা একটা রুপার পাত্রে জল নিয়ে আসে।রায়ান এর ইশারায় ফারদিনার পা ধুতে শুরু করল দাসীরা। তাৎক্ষণিক জেবুন্নেছা উপস্থিত হয় ফারদিনার ঘরে।ফারদিনা অশ্রুসিক্ত চোখে একবার রায়ান এর দিকে দেখল।চোখ দুটো তাঁর তীব্র লাল।মনে হচ্ছে সামসুল এর শরীরের সমস্ত র’ক্ত তাঁর চোখে।রায়ান তার নীল রেশমের শার্ট এবং সাদা পায়জামকে অনায়াসভাবে সামলে আছে। গলার লকেট হালকা ঝুলছে, কিন্তু তার কাঁধে কোনো কম্পন নেই। চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চারপাশ পরীক্ষা করছে, যেন প্রতিটি ছায়া তার শ’ত্রু।

চোখ ফিরিয়ে আরিব কে দেখল।আরিব, বাদামী চোগা আর সাদা পায়জামা পড়েছে।ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। তাঁর হাঁটার ধরন এমন, যেন শীত তার উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। চুলের ছটা বাতাসে নড়ছে, কিন্তু তার অভিব্যক্তি অবিকল শান্ত।হাতের আঙুলের অস্থিরতা নেই। গলার চেইন যেন তার মারাত্মক উপস্থিতিকে আরও ঘনীভূত করছে।

ফারদিনা এবার সায়েম এর দিকে দেখল।পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করছে।শিকারি পোশাক ছিল পরনে।বদলে এখন ফতুয়া আর পাজামা পড়েছে।শালটা পেঁচিয়ে রেখেছে এমনভাবে যেন উড়ে গেলেই সর্বনাশ।তাঁদের অভিব্যক্তি ফারদিনাকে শীতল করে দিল।দাসীরা তাঁর পা ধুয়ে শুকনো কাপড় দিয়ে পা মুছে চলে যায়।ফারদিনা মনে মনে প্রার্থনা করছে, তাঁর ভাইয়েরা যেন এই বিষয়ে আর প্রশ্ন না করে।সে এখন কি করবে বুঝতে না পেরে শান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো।বলল “আমি আব্বার ঘরে যাচ্ছি।” রায়ান বলল “পায়ে কাদা কিভাবে আসলো বলে যা।”

ফারদিনা ভীষণ গোঁয়ার্তুমির সাথে বলল “ জানি না।” ফারদিনা মিথ্যা বলেছে।সে নিজেও জানে এরুপ বললে তাঁর ভাইয়েরা কখনোই বিশ্বাস করবে না।কন্ঠ তাঁর কাঁপা কাঁপা।রায়ান পায়চারি করতে করতে বলল “তালুকদার বাড়ির প্রাচীর এর মধ্যখানে কোন কাদা নেই।পাথর ব্যতীত। সমস্ত ভূমি,স্থল পাথরের তৈরি। তাহলে তুই নিশ্চয়ই বাড়ির বাইরে গিয়েছিলিস? রায়ান যেন নিশ্চিত ভঙ্গিতে বলল। জেবুন্নেছা রায়ান এর রেশ টেনে পান মুখে দিয়ে বলল “আমি আগেই বলেছিলাম,ওকে বিয়ে দিয়ে দে।বড় হয়েছে এখন। তোদের আড়ালে কি না কি করে বেড়ায় কে জানে। শুনেছি আজকাল নাকি ঘরেও থাকে না।দেখিস অবৈধ ভাবে যেন ..!” হিন দিয়ে বাকি কথা হাওয়াতে উড়িয়ে দিল।
সায়েম এর দৃষ্টি রাগে আ’গুন এর মত জ্বলে উঠল।আরিব জেবুন্নেছার দিকে এগিয়ে বলল “ফুফু,কি বলতে চাইছেন আপনি?বাইরে অবৈধ ভাবে মানে?

“ওসব আমি মুখেও আনতে পারব না। লজ্জা লজ্জা।” জেবুন্নেছা বলল।ফারদিনা যেন একটা চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে।না সে বেড়োতে পারছে, না কিছু বলতে পারছে।আরিব ফারদিনার চারপাশে ঘুরে ঘুরে বলল “ফুফু যা বলছে সত্যি?তুই আজকাল ঘরের বাইরে বের হচ্ছিস?জবাব দে।”
রায়ান বলল “আহহ..ওকে এভাবে তোরা জিজ্ঞেস করছিস কেন?বোন এমনিতেই ভয় পেয়ে আছে।তুই যা,আব্বার কাছে যা।”

সায়েম বলল “ভাই, এখানকার মেয়েদের ঘরের বাইরে কমই দেখা যায়। আমাদের বংশের মেয়ে হয়ে যদি ও রাত-বেড়োতে ঘরের বাইরে বের হয়, তাহলে আমাদের দুর্নাম হবে। সংস্কার বলে একটা কথা আছে।ভুলে যেও না।”
রায়ান ধীর পায়ে হেঁটে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।দু হাত পেছনে রেখে গম্ভীর মুখে বলল “আমাদের বোন মোটেই সংস্কার এর বাইরে যাবে না। আমাদের সম্মান নষ্ট করবে না। আমার বিশ্বাস আছে।”
জেবুন্নেছার সাথে একজন দাসী পিকদানি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।উনি পিকদানিতে পিক ফেলে বলল “আর যদি তোদের বিশ্বাস, সংস্কার এর বাইরে যায় তো?” ভ্রু কুঞ্ছিত করল সে।
রায়ান হালকা ঘাড় তাঁর দিকে ঘুরিয়ে বলল “আমরা কতটা সাংঘাতিক আপনি নিশ্চয়ই সেটি জানেন। আশাকরি বাকিটুকু বলতে হবে না।”

আরিব ঠান্ডা মাথায় শান্ত কন্ঠে ফারদিনাকে জিজ্ঞেস করল “আচ্ছা,তোর কারো সাথে প্রেম-ট্রেম হয়ে যায়নি তো?
প্রশ্ন টা ফারদিনার বুক চিরে যেন বেরিয়ে গেল।চোখের মনি প্রসারিত করে কাঁপা ঠোঁটে তাকিয়ে রইল। শুধু প্রেম নয়, তাঁদের ভালোবাসা গভীরে থেকে গভীরতায় চলে গেছে।ফারদিনা নিরুত্তর।রায়ান ফারদিনার কাছে এসে বলল “ভয় পেয়েছিস?” ফারদিনা রায়ান এর দিকে চোখ তুলে তাকায়।ফারদিনার অভিব্যক্তি দেখে তাঁরা তিন ভাই একসাথে হেসে উঠল।সায়েম বলল “ভাই আর ওকে ভয় দেখিও না।ও ভীষণ ভয় পেয়েছে।” আরিব ফারদিনার দিকে তাকিয়ে বলল “আমরা তো তোকে এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম। আমাদের বোন কখনো সংস্কার এর বাইরে যেতেই পারে না।আর রইল পায়ের কাদা,তুই নিশ্চয়ই ঝিলমিল এর সাথে চাঁদনীর আলো উপভোগ করতে বের হয়ে ছিলিস!তাই না?”

ফারদিনা মসৃণ চোখে মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বোধক নাড়াল।
“এটা বলতে এত সময় লাগল কেন,আগে বললেই পারতিস” বলল আরিব।
রায়ান বলল “ওকে জবাব দেয়ার সুযোগ কোথায় দিলাম।যা,তুই আব্বার ঘরে যা।দেখা করে আয়।” ফারদিনা এক নজরে তিন ভাইয়ের দিকে দেখল। তাঁদের দৃষ্টি স্বাভাবিক। দ্বিতীয় বার জেবুন্নেছার দিকে তাকাল। তাঁর সম্মুখে ফারদিনা অগ্রসর হয়ে মুখ ভেংচে দিয়ে ঘর থেকে চলে যায়। জেবুন্নেছা শক্ত চোয়ালে পান চিবোতে চিবোতে মনে মনে বলল ‘তোর তেজ আমি দেখে ছাড়বো। ফুফু বলে সম্মান দিচ্ছিস না তো।এর ফল ভোগ করতে হবে।’
সায়েম বেশ সূক্ষ্ম চোখে বলল “ভাই,ফারদিনার আচরণ আমার কাছে মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না। জমিদার বংশের মেয়ে হয়ে যদি ভুলত্রুটি করে ফেলে তাহলে!’ সায়েম খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল।রায়ান পায়চারি করতে করতে জবাব দিল “ফারদিনার জন্য নজরদারি বাড়া।তবে গোপনে।ও যেন টের না পায়।খাস লোক লাগিয়ে দে।”
“ভাই, তুমি যা বলবা।আমি এখুনি খাস লোকের সাথে কথা বলছি।যে ওর উপর নজর রাখবে।”

জেবুন্নেছা বলল “তাঁর চেয়ে আমি বলি কি, বিয়ে দিয়ে দে। আমাদের বাড়ি যে কিরগিজ শহর থেকে একটা ছেলে আসছে,ওর সাথে। আমাদের ফারদিনা ভিনদেশী হয়ে যাবে।ভালোই হবে।কি বলিস?”
রায়ান বিরক্তিতে জবাব দিল “আহ ফুফু,একটু হলেই ওর বিয়ে বিয়ে করবেন না।আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি, আপনার ধারণা সঠিক কিনা। তবে আমার বিশ্বাস ও কোন ভুল করতে পারে না।”
জেবুন্নেছা ফিসফিস করে বলল “বিশ্বাস বিশ্বাস করে এককালে সব হারাস না। চোখ কান খোলা রাখিস।আমি ভালো বললেও তোদের সেটা খারাপ মনে হয়। একদিন আমার কথাই সত্য হবে। মিলিয়ে নিস।” বলে আর একটা পান মুখে ঢুকাল।আরিব সাংঘাতিক চোখে বলল “আপনি জানেন না, আমাদের রীতিনীতির সম্পর্কে?যদি সে রকম কিছু হয়েই থাকে তবে..”
রায়ান বলল “আগেই ভুলভাল ভাবিস না। নজরদারির জন্য খাস লোক লাগিয়ে দে।

রশীদ তালুকদার খাটে আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছে।পাশের টেবিলে আতরের শিশি, আর বাতাসে রেশমের গন্ধ।রশীদ এর হাতে একটি বই “Self-Help” বইটির লেখক,স্যামুয়েল স্মাইলস।১৮৫৯ প্রকাশিত হয় ইংরেজি বইটি।তবে অনুবাদ আছে বইটির।এটি সেই সময়ে ব্রিটিশ ভারতে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।বইটির মূল থিম আত্মউন্নতি, অধ্যবসায়, পরিশ্রম, সততা।বইয়ে একটি উক্তি আছে। রশীদ পড়তে পড়তে ঠিক উক্তিটির কাছে এসে থেমেছে। “Heaven helps those who help themselves” এটাই যেন এই বইয়ের মূল বাণী।যার অর্থ “ইশ্বর তাদেরই সাহায্য করেন, যারা নিজের সাহায্য নিজেই করে।” রশীদ বইটি বন্ধ করে হেসে উঠল। তাঁর পায়ের কাছে কুদ্দুস বসে পা টিপছিল। রশীদ এর হাঁসি দেখে বলল “হাসছেন যে?”

“আমি যে বইটা পড়ছিলাম, তাতে লেখক একটি উক্তি বলেছে‌।শুনবি?
“শুনব”
“উক্তিটি হচ্ছে Heaven helps those who help themselves”
“এর মানে কি? কুদ্দুস বুঝতে পারল না। কিন্তু পা থেকে হাত সরায়নি।
“এর মানে হল আল্লাহ তাদেরই সাহায্য করেন যারা নিজের সাহায্য নিজেই করে।”
“যেমন? কুদ্দুস যেন গভীরে যেতে চাইল। রশীদ পা ভাঁজ করে বসল। কুদ্দুস দাঁড়িয়ে পড়ল। রশীদ বলল “আমাদের চেষ্টা ও কর্মের উপর আল্লাহ তায়ালা ভবিষ্যত নির্ধারিত করেন। মানুষ তাই পাবে যা সে চেষ্টা করে।লেখক নিশ্চয়ই খ্রিস্টান।তারপরও ধর্ম কর্ম নিয়ে তাঁর বেশ ধারণা।শোন”- রশীদ এতটুকু বলে পিক ফেলল। বাকিটুকু বলল
“মানুষের ভাগ্য পরিশ্রম ও অধ্যবসায়েই গঠিত হয়।অন্যের দয়া নয়, আত্মশক্তিই সাফল্যের মূল।
সাধারণ মানুষও সততা, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসে বড় হতে পারে। চেষ্টা করলে সফলতা আসবেই।জানিস কালু আমার দাদা এককালে অনেক কষ্ট করেছে। এরপর ধীরে ধীরে সফল হন তিনি। চেষ্টাই সফলতার মূল চাবিকাঠি।বুঝেছিস?

“বুঝেছি। কিন্তু আমি যে এত চেষ্টা করি, আমি তো সফলতার দেখা এখনো পাইনি।”
“তুই কি চেষ্টা করছিস?
“এই যে, দিনরাত আপনার সেবা করি, আপনার কথা শুনি,কই আমিত সফল হচ্ছি না।”
“এত এত কাজের লোক থাকতেও আমি তোকে আমার সাথে রাখি।আমি তোকে বিশ্বাস করি। নিজের দুঃখ কষ্ট গুলো তোর কাছে বলি,এটা তোর সফলতা কি না?
কুদ্দুস মাথা চুলকিয়ে বলল “হুঁ,হালকা পাতলা সফলতা।”
“হালকা পাতলা মানে,তুই কি এর চেয়েও বেশি কিছু চাস?
“হুঁ চাই।”
রশীদ চোখ আধখোলা করে বলল “কি চাই?
“আমি এখনো বিয়ে করি নাই।”

“বিয়ে করতে হবেনা। বিয়ে মানেই হল নিজের স্বাধীনতা কে বিসর্জন দেয়া।দেখছিস না, আমার চার ছেলে এখনো বিয়ে করেনি।”
“এটা অন্যায়। আপনি বিয়ে করে চাঁর পাঁচটা সন্তান বানিয়েছেন,অন্য কারোও তো ইচ্ছে করে।” রশীদ এবার বেশ রেগে গেল।পিকদানিতে পিক থুথু করে ফেলে বলল “হতচ্ছাড়া,আমি তোকে আজ বাড়ি থেকে বের করেই দেব। আজকাল যতই তোর সাথে ভালো ব্যবহার করছি,তুই সেসব এর অসৎ ব্যবহার করছিস। আমাকে ধাপে ধাপে কথা শোনাচ্ছিস।যা, চোখের সামনে থেকে বের হ।”

“পড়ে কিন্তু আপনিই আমায় খুঁজবেন।বলে দিলাম।”
“তোর মত একটা গেলে দশটা আসবে।মানে আমার সেবা করার লোক।যা দূর হ”
কুদ্দুস মাথা নিচু করে চলে যেতে যেতে বারবার রশীদ এর দিকে দেখল। রশীদ রাগে লাল হয়ে মাটিতে বারবার ছড়ি ঠুকল।তাঁর রাগ নিয়ন্ত্রণে আসতে না আসতেই ফারদিনা উপস্থিত হয়। রশীদ কে রেগে থাকতে দেখে বলল “আব্বা রেগে আছেন?কি হয়েছে?
“ঐ বেটা কুদ্দুস আমাকে কথা শুনিয়েছে।চার আনার কাজের লোক হয়ে আমায় কথা শোনায়।এটা অন্যায় কি না?
“অবশ্যই অন্যায়।” বলে ফারদিনা বিছানায় বসে।
বলল “আব্বা এত রাগবেন না।হাকিম বলেছে বেশি রাগলে আপনার র’ক্তের চাপ বেড়ে যাবে।এই বয়সে এতটা উত্তেজিত হওয়া ভালো না।”

রশীদ এর রাগের মাত্রা আগের থেকে আরো বেড়ে গেল। তাঁর বয়স তুলে কথা বলেছে।বয়স যাই হোক,সে নিজেকে এখনো ত্রিশ বছরের যুবক মনে করে। মোটাতাজা শরীর। দাঁড়ি, মাথার চুল এখন পর্যন্ত কুচকুচে কালো।বয়স দুটো সংখ্যা মাত্র বলে মনে করে রশীদ। বিছানা ছেড়ে নেমে ছড়ি ঠুকে ঠুকে বলল “শোন বেয়াদব মেয়ে, আমার বয়স এখনো পঞ্চাশ ছোঁয়নি। আর তুই আমাকে বুড়ো বলছিস!”
“আব্বা, আমি আপনাকে একবারো বুড়ো বলিনি। আপনি বুড়ো কে বলেছে, আপনাকে আমার ভাইদের থেকে ও জোয়ান দেখায়।” ফারদিনা রশীদ এর আড়ালে হাসল। রশীদ এর বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে সে-ই কবে।
রশীদ বলল “আজ রাগ দেখাতে চাচ্ছি না। তোকে আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করব বলে ডেকেছিলাম। কিন্তু তুই আমার মন ঘুরিয়ে দিলি।”

“আব্বা, এখন আবার মন আমার দিকে ঘুরিয়ে আনুন।বলুন,কি জিজ্ঞেস করবেন?
রশীদ ধীরে হেঁটে রেশমি গদি মোড়ানো ইজি চেয়ারে বসল। মুখের রং পুরোপুরি পাল্টে নির্বাক রুপ ধারণ করল।বলল “আমি জানতে পেরেছি তুই আজকাল রাতেও ঘরের বাইরে বের হচ্ছিস।”
“আপনার কাছে প্রমান আছে? না শুধু শুনেছেন?
“আমার কাছে প্রমাণ নেই।শুনেছি।”
“আপনার মত জ্ঞানী একজন ব্যক্তি শুধু মুখের কথা বিশ্বাস করল?” ফারদিনা খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়।
“আমি বিশ্বাস করিনি বলেই তোকে জিজ্ঞেস করছি।” রশীদ কিছুক্ষণ এর জন্য থেমে গেল। আবার বলল “জানিস ফারদিনা, আমার বাবা ব্রিটিশ প্রসাশনদের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল। আমার ও বেশ নামডাক আলিমনগর সহ শহরেও।আমি শহরে গেলে বেশ লোকজন ভির করে। সম্মান করে সবাই আমাকে। সম্মান অর্জন করা কঠিন বিষয় কিনা?

“জ্বী কঠিন।” ফারদিনা ভাবলেশহীন ভাবে বলল।
“এই সম্মান ধুলোয় মিশে গেলে কষ্ট পাব কিনা?”
ফারদিনা এবার রেগে গেল। প্রচন্ড রাগ উঠছে।আজ সকলের মুখে একই প্রশ্ন। কিন্তু কেউ পরিষ্কার করে কিছুই বলছে না।ফারদিনা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। তারপরও রাগ নরম করে বলল “জ্বী কষ্ট পাবেন।”
“আশা করি তুই বুঝেছিস আমি কি বলতে চাইছি। এরপর থেকে এমন ভাবে চলাফেরা করবে যাতে, আমার কাছে কেউ তোর নামে নালিশ না করতে পারে।মনে থাকবে?
“জ্বী।মনে থাকবে।এখন আমি যাই?
“যা তবে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কর।”

ফারদিনা রশীদ এর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রশীদ এর ঘরের পর অন্দরমহল। অন্দরমহল পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে।যতই পা বাড়াচ্ছে ক্রমাগত পায়ের শক্তি যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। চাঁদ এর আলো নিভে যাচ্ছে।সে মশাল এর আলো ধরে হাঁটছে। সুফিয়ান এর কথা তাঁর ভীষণ মনে পড়ছে। আজকে তাঁর তিন ভাই ও আব্বার কথায় মনে হচ্ছে সুফিয়ান এর সাথে তাঁর সম্পর্ক কেউ মানবে না।সে নিশ্চিত। সুফিয়ান এর কথা সে আর কাউকে জানাবে না। তাকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে বলে নিশ্চিত করল।
পথে ঝিলমিল এর সাথে দেখা হল। ঝিলমিল ছুটে কোথাও যাচ্ছিল।চোখ মুখে ওর উদ্বিগ্নতা।আজ হাতে কোন খাবার নেই ওর।ফারদিনা জিজ্ঞেস করল “ছুটে যাচ্ছিস কোথায়?
ঝিলমিল আস্তেধীরে বলল “আমি জানতে পারছি।”

“কি জানতে পেরেছিস?
“তোর ভাইয়েরা তোর উপর নজরদারি রাখার লইগা খাস লোক জোগাড় করছে।তোর উপর সবসময় নজর রাখব।”
ফারদিনা মুখে হাত চেপে ধরে থ’হয়ে গেল।বলল “কি বলছিস!’ ফারদিনা আশ্চর্য হল।
“হু,ঠিকই কইছি।এখন থেইকা যা করবি সাবধানে।”

“সাবধানে চোখের নজর কিভাবে রাখে? প্রশ্ন টা ছুড়ে দিল সোলেমান সুফিয়ান এর দিকে। সাতসকালে সোলেমান সুফিয়ান এর বাড়িতে হাজির হয়। সুফিয়ান রাঙাকে ঘাস খাওয়াচ্ছে।রাঙা হ্রেষাধ্বনি তুলল। খাবার পেয়ে খুশি হয়েছে। তাঁর থেকেও বেশি খুশি হয় যখন সুফিয়ান ওর শরীরে আদরের হাতে স্পর্শ করে।
“সাবধানে মানে, সতর্কতার সাথে চোখ কান খোলা রাখবি।”
সোলেমান সুফিয়ান এর মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখল। সুফিয়ান এর মাথায় গামছা বাধা।পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি।সাথে লুঙ্গি হাঁটুর উপরে এনে ভাঁজ করে রেখেছে। সোলেমান জিজ্ঞেস করল “আপনি কি শরীর চর্চা করেন?
সুফিয়ান ঘাস রাঙার দিকে দিতে দিতে জবাব দিল “শরীর,সৌন্দর্য আল্লাহর দান। চর্চা করতে হয় না।”

“আপনাকে দেখে মনে হয় কুস্তি করেন।”
“মনে হয় অনেক কিছু,মনে হলেই তা নিশ্চিত বলে ধরে নিতে হয় না।এটা পাপ।”
“আজ অনেক শীত। চারদিক কুয়াশায় ঘেরা। আপনি তাঁর মধ্যে গরম পোশাক পরেন নাই। ঠান্ডা লাগছে না?
“শরীরের র’ক্ত আর মস্তিষ্ক গরম থাকলে, ঠান্ডা ভর করতে পারে না”
“ঠান্ডাও মানুষের উপর ভর করে?
“অবশ্যই করে। মানুষের উপর সবকিছু ভর করতে পারে। যদি সে সেই ভর বহন করার সুযোগ দেয়।”
“মাঝেমধ্যে আপনার কথার অর্থ আমি বুঝি না।”
“সবকিছুর অর্থ বুঝলে পড়ে বিপদ বাড়ে। কখনো কখনো নিজেকে কিছু শব্দের অর্থ থেকে দূরে রাখতে হয়।”
“রাখতে হয়?”
“হুঁ।” সুফিয়ান ছোট্ট করে জবাব দিল।

সুফিয়ান রাঙাকে খাবার দিয়ে দিঘীর পাড়ের দিকে গেল। গোসল করবে। সুফিয়ান সবসময় সকালে গোসল করে। সকালে গোসল করা শরীর এর জন্য উপকারী।বলেছে নিজাম হায়দার। সোলেমান পেছন পেছন গেল। সুফিয়ান ঘাটে লুঙ্গি আর গামছা রেখে সিঁড়ি বেয়ে জলের দিকে নামল। সোলেমান আশপাশ টা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। সুফিয়ান জলে ডুব দিল। সোলেমান সতর্কতার সাথে এদিক ওদিক তাকিয়ে কোমরের ভাঁজ থেকে একটা ছোট্ট ছু’ড়ি বের করল।ছু’রি টা নিয়ে জলের দিকে নামতেই মনে হল দূর থেকে ওকে কেউ দেখছে। সোলেমান সুফিয়ান এর আড়ালে ছু’ড়িটা পুনরায় কোমরের ভাঁজে রেখে দেয়।ঘাড় ঘুরিয়ে সুফিয়ান এর বাড়ির দিকে তাকাল।এক লোক চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাঙার কাছে। সুফিয়ান জল থেকে উঠে এল। শরীর মুছতে মুছতে বলল “কি দেখছিস?
“ওই দেখেন,কেউ রাঙার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।”সুফিয়ান সরু চোখে সেদিকে খেয়াল করল।লোকটা রাঙায় দিকে নয়,বরং গাছের লতাপাতার ফাঁক দিয়ে সুফিয়ান এর দিকেই দেখছে।

সুফিয়ান কাঁধে গামছা রেখে বাড়ির দিকে হাঁটল।চাদর মুড়ি দেয়া লোকটা শক্ত হয়ে এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে।যেন সে যন্ত্রের তৈরি। সুফিয়ান লোকটির সামনে উপস্থিত হল। চাদর মুড়ি দেয়া লোকটি আর কেউ নয়, গতকাল রাতের র’ক্তশোষী বাঘের দেখভাল করার সে-ই একচোখা ব্যক্তি। লোকটিকে এখানে দেখে সুফিয়ান খানিকটা অবাক হল।লোকটির হাবভাব সাধারণ মানুষের মত নয়।সোলেমান লোকটাকে কপাল ভাঁজ করে দেখল। সুফিয়ান তাঁকে জিজ্ঞেস করল “কে আপনি? এখানে কি চাই?

লোকটা সুফিয়ান এর প্রশ্ন নয় বরং শরীর এর দিকে দিকে তাকিয়ে আছে।কখনো বুক, কখনো হাত, কখনো উরুর দিকে দেখছে। সুফিয়ান দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করল “চুপ করে আছেন যে, কি চাই? এখানে কি জন্য এসেছেন?
এখচোখা গলা পরিষ্কার করে বলল “তারেক কে খুজতাছি।ওয় আমার ক্ষেতে দুদিন কাম করছে।অহন আর ওরে খুঁজে পাইতাছি না।ওর বাড়িটা কই তুমি কি জানো?
সুফিয়ান বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। তারেক নামে আশেপাশে কেউ আছে বলে মনে হয় না তাঁর। সোলেমান এর দিকে তাকাল। সোলেমান ইশারায় বোঝাল ও তারেক নামে কাউকে চিনে না। সুফিয়ান বলল “এই নামে আমি কাউকে চিনি না। আপনি খুঁজে দেখুন।”
এখচোখা সুফিয়ান এর ঘরের দিকে দেখল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই সুফিয়ান একা থাকে বলে ভেবে বলল

“তুমি একলা থাকো?
“হুম।কেন?
“ভাই বোন নাই?
সুফিয়ান জানে এই প্রশ্ন তাকে কেন করা হয়েছে।সে নীরব থেকে কয়েক সেকেন্ড পর জবাব দিল “না,আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান”।

The Silent Manor part 27

“ওনারা কই?
“বেঁচে নেই।”
একচোখা স্থান ত্যাগ করার জন্য মনস্থির করল। চাদরের আড়াল থেকে রাঙার দিকে একবার তাকাল। এরপর ধীরে ধীরে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে যেতেই সুফিয়ান এর দিকে ঘুরে তাকালো। নির্বাক স্বরে বলল ‘তোমার রাঙা ভীষণ সুন্দর। মানুষের মতই সুঠাম দেহের অধিকারী।ওরে যত্ন কইরা খাওয়াও।_

The Silent Manor part 29

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here