শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৭
নূরজাহান আক্তার আলো
-‘এভাবে চেপে ধরে মেরে ফেলি?’
-‘আপনার বুকে মাথা রেখে যদি মরতে পারি তবে আমার মরণ সই।’
-‘মুখস্থ করে এসেছিস?’
-‘কি?’
-‘প্রেমমাখানো রসালো উক্তি-যুক্তি।’
-‘ওসব আগে মুখস্থ করা লাগত এখন আর লাগে না।’
-‘কেন লাগে না?’
শীতল জবাব দিলো না তবে সেও হাতের বাঁধন শক্ত করল। শক্ত বাঁধনে
কিছু বোঝাতে চাইল। শুদ্ধর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। বুকে শান্তি। মনে
অন্যরকম তৃপ্তি। এ হাসি যে প্রাপ্তির হাসি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
যে মেয়েটা একদিন বোকামি করে ভালোবাসা শিখতে চেয়েছিল। তাকে ভালোবাসা চেনানোর আবদার করেছিল আজ সেই নিগূঢ় ভালোবাসায় আক্রান্ত রোগী। যে প্রতিশোধ নিতে তার দেহের রন্ধে-রন্ধে তীব্র প্রেমের জীবাণু ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল আজ তার দেহে একই প্রেমের জীবাণুর বসবাস। চঞ্চল, অধৈর্য্য মেয়েটা তাকে সহ্য করতে পারত না আজ সেই যেন তাকে চোখে হারায়। যে চাইত না সে কখনো বাড়ি আসুক সময়ের জাদুবলে আজ সেই তার অনুপস্থিতিতে কাঁদে। অপেক্ষা করে সে কখন বাড়ি ফিরবে। কাছে টানবে। বুকে জড়াবে। নরম স্পর্শে ছুঁয়ে দেবে। ছুঁয়ে দিলে আবার লজ্জায় নুঁইয়ে পড়বে। কিছুদিন আগে বোকা বোকা কথা বলা মেয়েটা তার জন্যই ইয়াসিরের মতো লোকের কাছে বুদ্ধি খাঁটিয়ে নিজেকে সেভ করার চেষ্টা করেছিল। বিপদে পড়ে ব্যাকুল সুরে বিশুদ্ধ পুরুষকেই মনে প্রাণে পাশে চেয়েছিল। তার বুকে ঠাঁই চেয়েছিল। বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকতে চেয়েছিল। এমনকি তাকে বাঁচাতে ভীতু মেয়েটা দুঃসাহষিক ভাবে নিজেও গুলির সামনে দাঁড়িয়েছিল। আহত হয়েছিল।
হসপিটালের বেডে শুয়ে অন্যের পুরুষের স্পর্শ মুছতে নিজে সম্পর্কের বৈধতা চেয়েছিল। তাও কেঁদে কেঁদে ব্যাকুল সুরে জোর খাঁটিয়ে। অথচ এই মেয়েই রুবাব আর সায়নের কথায় মিথ্যা ভালোবাসার দাবি নিয়ে তার নামের কলঙ্ক মাখতে এসেছিল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল, ‘ শুদ্ধ ভাই, আমি যদি আপনার নামে দু’একটা কলঙ্ক মাখি আপনি কী খুব রাগ করবেন?’
নিঃসন্দেহে চমৎকার আবদার! কিন্তু ভালোবাসার কলঙ্ক মাখা কী এতই সহজ? সেদিন ভীষণ রাগ হয়েছিল তবে সঠিক সময়ে তার ব্যাঙাচি যে তাকে সবার সামনে চেয়েছে নিয়েছে, দখল করে নিয়েছে জোর খাঁটিয়ে অধিকার দেখিয়ে। বুঝিয়ে দিয়েছে সেও পারে। এখন যে তার বুকের বাঁ পাশে মাথা রেখে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখখানা এমন যে কিচ্ছুটি জানে না। অথচ বাইরের দেশে গিয়ে একদন্ড শান্তি দেয় নি। বুকের মধ্যে গেঁড়ে বসে খোঁচাতেই ছিল। কখন এভাবে বুকে টেনে পারবে এ আশায়
ভেতর ভেতর অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। এসব ভেবে শুদ্ধ একবার তাকাল শীতলের দিকে। শীতল চোখজোড়া বন্ধ করে কী ভাবছে কে জানে তবে মুখে অদ্ভুত এক শান্তির ছাপ। ঠোঁটে খেলেছে মিষ্টি হাসি। তাকে হাসতে দেখে শুদ্ধ তার মাথায় থুতনী ঠেঁকিয়ে আদুরে সুরে বলল,
-‘রাতে রুমে থাকতে বলেছিলাম না?’
-‘হুম।’
-‘ তাহলে পেলাম না কেন?
-‘ডিনার সেরে রুমে আসার সময় আম্মু ডেকেছিল। গিয়ে দেখি আম্মু বাবার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে৷ আমিও বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে শুয়ে গেম খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জেগেছি ফরজের আজানের অনেক পরে।’
-‘তখন আসা হলো না কেন?’
-‘এসেছিলাম, পাই নি ততক্ষণে জগিংয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন।’
-‘ পূর্ণ্যের কাজ করেছেন। আমাকে জাগা রেখে বেয়াদবের মতো ঠিকই ঘুমিয়েছিস কিন্তু আমার একফোঁটাও ঘুম হয় নি। এখন চলুন আপনাকে নিয়ে ঘুমাব।
একথা শুনে শীতল নিজেকে ছাড়িয়ে একলাফে দুপা পিছিয়ে বলল,
-‘নাস্তা তাহলে রুমে আনি? খেয়ে ঘুমান। একটু পরেই আমরা বের হবো। আপনি উঠতে উঠতে ফিরে আসব।’
-‘ফিরে আসব মানে? কোথায় যাবি?’
-‘পার্লারে। কদিন পরেই অনুষ্ঠান না? একটু ফেসিয়াল করব, চুল কাটব, পেডিকিওর-মেনিকিউর করব। ফেসিয়াল না করলে তো মেকাব বসবে না ঠিকঠাক মতো।’
-‘গিয়েই দেখেন আমিও আপনার পিঠের উপর ইচ্ছে মতো চ্যালাকাঠ ভাঙ্গব। মেকাবই করতে দেবো না আসছে আবার ফেসিয়াল টেসিয়ালের গীত নিয়ে।’
-‘মানে কি! তাহলে কি আমি সাজব না?’
-‘ বিবাহিত মেয়ের এত সাজগোছ কিসের?’
একথা শুনে শীতল বেশ বিরক্ত হলো আগ-পিছ না ভেবে বেশ গর্ব করে বলল,
-‘মোটেও আমি বিবাহিত না আমি পিওর সিঙ্গেল।’
-‘ওহ্ আচ্ছা! আমার ল্যাবে সিসি ক্যামেরা আছে জানেন? একরাতের
কিছু মিছুর ফুটেজ আছে কী না আসুন দু’জন মিলে একসাথে চেক করে দেখি।’
শীতলের মুখটা ফাঁটা বেলুনের মতো একেবারে চুপসে গেল। একরাশ লজ্জা পেলো। তবে সেটা প্রকাশ না করে খুটখাট করে এটা ওটা নাড়তে লাগল। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল হাতের কাছে থাকা জিনিসপত্র। শীতল মুখ ভেংচি দিলো। বারণ শুনলে তো? সে বড় মাকে পটিয়ে ঠিক ম্যানেজ করে ফেলেবে। তাই তর্কে না গিয়ে জানালার পর্দা সরাতে সরাতে বলল,
-‘আমার কিছু মিছু চাই। ‘
শুদ্ধ গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে তাকাল একবার। অনুষ্ঠানের অজুহাতে আজ থেকে তার পকেট ফাঁকা করার যত রকমের ধান্দাবাজি করা যায়, করবে এই মেয়ে। কোনো জবাব না পেয়ে শীতল ড্রেসিংটেবিলের উপরে থাকা টুকটাক জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতে বলল,
-‘ শুদ্ধ ভাই শুনুন না?’
মুখ দিয়ে কথাটা বলতে দেরি তড়িৎ শীতলকে ঘুরিয়ে ঠোঁট আঁকড়ে ধরে কামড় বসাতে দেরি হলো না শুদ্ধর। শক্ত এক কামড় বসিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল,
-‘ বুঝি নি কি বললি যেন? ভাই না কী যেন একটা? এই ওয়েট ওয়েট কে তোর ভাই?’
শীতল হতভম্ব। ঠোঁটে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতেই ঠোঁট চেপে ধরে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। চোখ ছলছল করছে। ঠোঁটটা বুঝি কেঁটেই ফেলেছে
অসভ্য, পাজি পুরুষটা। শুদ্ধ এবার তাকে আরেকটু কাছে টেনে কোমর জড়িয়ে ধরে কায়দা করে ভ্রুঁ জোড়া নাচিয়ে বলল,
-‘মিসেস এবার বলুন দেখি আমি আপনার কে? এখনো ভাই হই? সেদিন বললাম না ভাই না ডাকতে? আমাদের সম্পর্কের বদল ঘটেছে আমার কদিনের অনুপস্থিতিতে ভুলে গিয়েছেন? কাছে আসুন দেখি আবার মনে করিয়ে দেই।’
একথা বলে তাকে কাছে টেনে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে গলায় মুখ ডুবাবেই শীতল ছটফটিয়ে উঠল। শুদ্ধকে সরানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে সে
আমতা আমতা করে বলল,
-‘ ইচ্ছে করে বলি না তো৷ পুরনো অভ্যাস মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়।’
শুদ্ধ সেভাবে থেকেই তার কাঁধে গলায় ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে জবাব দিলো,
-‘ চ্যালাকাঠের বারি খেলে আর মুখ ফসকাবে না। দেই বারি? দেখি কাজ করে কী না?’
শীতল জবাব দিলো না চোখ মুখ খিঁচে অনড় হয়ে রইল। খুব কাতুকুতু লাগছে। তাকে চুপ থাকতে দেখে শুদ্ধ মুখপানে তাকাল। এতক্ষণ কিছু না বুঝলেও এবার খেয়াল করল শীতলের স্বাস্থ্য বেড়েছে। ফোলা ফোলা গাল দুটো টসটস করছে। অসুস্থতায় অনেকটাই শুকিয়েছিল। এখন তো জীবন্ত পুতুলের মতো আদুরে লাগছে। নাকি এতদিন পর দেখছে বিধায় এত কিউট লাগছে? আচ্ছা ঠোঁটে নেশা মিশিয়েছে নাকি কম্পিত ঠোঁট জোড়া এত টানছে কেন? একটু ছুঁয়ে দেখবে? কিন্তু এই মেয়ের যা হাল মনে হচ্ছে আর একটু ছুঁলে লজ্জায় নুুঁইয়ে গলে পড়বে। আজ এই প্রথম শুদ্ধকে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে শীতল হাত দিয়ে তার চোখ দুটো ঢেকে ফেলল। এ দৃষ্টি ঘায়েল করা। শুদ্ধ তার হাত সরিয়ে আবার তাকাল। তখন শীতল মিষ্টি করে আবদার জুড়ে বসল,
-‘ সারাদিন ঘুরব। বাইরে খাব। ব্যস্ততার অজুহাত শুনব না। আজকের দিনটা আমাকে দিতেই হবে।’
শীতলের আবদার শুনে শুদ্ধ কেমন করে যেন হাসল। ভ্রুঁ বাঁকিয়ে বলল,
-‘ তবে আমারও একটা শর্ত আছে?’
-‘কি?’
-‘ আজকে দিনটা আমি তোর নামে লিখে দিচ্ছি তুইও আজকের রাতটা আমার নামে লিখে দে? বুঝে শুনে দিস কিন্তু! ‘
শুদ্ধর কথার মানে বুঝতে সময় লাগল না শীতলের। গালে রক্তিম আভা আরো গাঢ় হলো। জোড়াজুড়ি করে কোনোমতে শুদ্ধকে সরিয়ে রুমের বাইরে যেতে যেতে বলল,
-‘মোটেও না। নাস্তা করতে আসুন আটটা বেজে গেছে।’
একথা বলে শীতল একপ্রকার পালিয়ে বাঁচল। শুদ্ধ তাকে যেতে দিলেও তার দৃষ্টি শীতলের যাওয়ার দিকে নিবদ্ধ। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। পালিয়ে আর যাবে কোথায়? ঘুরে ফিরে গন্তব্য তো ওই একটায়_শোয়াইব শুদ্ধ।
এদিকে ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করতে করতে আঁটের ঘরে নিশ্চল। একে একে সকলে হাজির হলেও রুবাব, ঐশ্বর্য এখনো অনুপস্থিত। শুদ্ধ নিচে নেমে চেয়ার টেনে বসল। রুবাব আর ঐশ্বর্য বাইরে গেছে শুদ্ধই জানাল।
তখন রান্নাঘর থেকে সিদ্ধ ডিমের বোল এনে শুদ্ধর পাশে বসল শীতল।
সিঁতারা সবাইকে খাবার বেড়ে দিলেন। সিঁতারা, সিমিন রান্নাঘরে পরোটা বেলে ভাজছিলেন দেখে শুদ্ধ বলল,
-‘আম্মু, ছোটো আম্মু এখানে এসো আমার কিছু বলার আছে।’
তার কথা শুনে সবাই তাকাল। মনোযোগী হলো কী বলে শুনতে। সিঁতারা
সিমিন চুলা অফ করে এসে দাঁড়ালে শুদ্ধ তাকাল শখ, স্বর্ণ ও শীতলের দিকে। বুঝতে বাকি রইল না ওদের তিনবোনকে কিছু বলবেন। তাই ওরা মনোযোগীশ্রোতা হলো। তখন শুদ্ধ বলল,
-‘জীবনে এমন কিছু সময় আসে পরিস্থিতি বুঝে ভীষণ শখের জিনিসও ত্যাগ করা লাগে। সেই ত্যাগ কখনো হয় নিজের জন্য কখনো বা পরের জন্য। আমি জানি তোমরা বুঝদার। তবুও আমার মনে হলো তোমাদের কিছু কথা বলা উচিত। কদিন পরে বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান। আত্মীয়ের আনাগোনা শুরু হবে কাল পরশুতে। তোমরা দুজন বাড়ির মেয়ে থেকে বউ হবে। সম্পর্কের বদল ঘটবে। ধীরে ধীরে দায়িত্ব বাড়বে। আর দায়িত্ব কাঁধে নিতে গেলে আগে সু-বিবেচক হওয়া জরুরি।’
একথা শুনে শারাফাত চৌধুরী স্নেহের দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন।
শুদ্ধও ওইটুকু বলে থামল। তারপর পুনরায় বলল,
-‘কিছুদিন আগে ঐশ্বর্যের সঙ্গে কী ঘটেছে কারো অজানা নয়। মেয়েটা যে বেঁচে আছে এটাই আমাদের কাছে বিশাল পাওয়া। তবে ডাক্তারের কথা অনুযায়ী সে কোনোভাবেই আগামী তিনমাস মেকাব জাতীয় কিছু স্কিণে ব্যবহার করতে পারবে না। এতে স্কিণের নানান জটিলতা বাড়বে। ইনফেকশনও দেখা দিতে পারে। বিয়ে হচ্ছে বলে এ রিস্ক নেওয়ায় যাবে না। নেওয়ার প্রশ্নই আসে না কারণ সাজগোছের থেকে একটি জীবনের মূল্য অনেক। মোদ্দাকথা, বাড়ির তিন ছেলের বিয়ে একসাথে। দুই বউ সাজবে আরেকজন সাজবে না। অথচ সে পাশাপাশি বসে থাকবে। সব রিচুয়্যাল একসাথে পালন করবে। তখন তার সাদামাটা লুকের ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু দেখাবে। রিলেটিভরা প্রশ্ন তুলতে পারে। ঐশ্বর্য যথেষ্ট ম্যাচিউর।
তবে তার মানসিক অবস্থা আগের মতো স্ট্যাবল নেই। তো আমি চাই তোমরাও কোনোপ্রকার মেকাব ছাড়া বউ সাজো। মেকাব ছাড়া কী বউ সাজা যায় না? স্নিগ্ধ কোনো সাজে বিয়ে করা যায় না? বিয়ে তো পবিত্র বন্ধন। মেকাব আর ভরি ভরি স্বর্ণ দিয়ে সাজলেই বিয়ের পূর্নতা পায় তা
কিন্তু নয়। আজকাল সবাই ট্রেন্ডে গা ভাসায়। আমরা অন্যকিছু করি? অন্যকিছু ভাবি? সবার যা করবে আমাদেরকে কেন সেটাই করতে হবে?মূলত এসব নানান কথা ভেবেই রুবাব বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না। আবার বোনদেরও বলতে পারবে না বিশেষ একটি দিনে সাজগোছ না করতে। ঐশ্বর্যও মেয়ে। তারও হয়তো বিশেষ দিন নিয়ে কিছু ইচ্ছে ছিল। কিন্তু..!’
শুদ্ধ থেমে যেতেই শতরুপা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন শুদ্ধর দিকে। চোখের পানিতে শুদ্ধর মুখটা বড্ড ঝাপসা দেখাল।বয়সে বড় না হলে উনি শুদ্ধর পা জড়িয়ে কেঁদে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। রুবাব যে এই নিয়ে চিন্তিত উনিও জানেন। উনার চোখের পানি খাবারের সাথে মিশে যাচ্ছিল। সেটা দেখে সিমিন ননদের কাঁধে হাত রাখতেই শতরুপা দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। তখন স্বর্ণ বলল,
-‘আমাদের কোনো সমস্যা নেই ভাইয়া। এমনিতেও আমরা কখনো ভারী মেকাব করি নি। ওসবে তেমন অভ্যস্তও নই৷ আমাদের শীতল সাজতে পছন্দ করে তবে সেটাও সাধারণভাবে লিমিট রেখে। ও তো ছোট মানুষ
পরিস্থিতি অনুযায়ী আশা করি সেও বুঝবে।’
শীতলও সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল। হাসি মুখে বলল,
-‘আমারও কোনো সমস্যা নেই।’
শুদ্ধ এবার সায়নের দিকে তাকাতেই সায়ন হেসে ফেলল। ধীরে ধীরে পরোটা চিবাতে চিবাতে বলল,
-‘ রুবাব যে আসলেই গাধা সেটা আমরা সবাই জানি। এই সামান্য একটা ব্যাপারে প্যারা খাওয়ার কিছু দেখছি না। তাছাড়া চৌধুরী বাড়ির মেয়েরা মায়েরা যে যার মতো সুন্দর একথা গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলতে পারি।
ঐশ্বর্যও তার নামের মতো সুন্দর একথা সত্য। এক্সিডেন্টে যে একেবারে তার সৌন্দর্য খুঁয়ে গেছে তাও নয়। তাই ওসব বালছাল না মাখলে আমার বউ-বোনদের কিছু আসবে যাবে না। তাছাড়া কেউ কেউ তো না সেজেই আমাদের অবস্থা যা তা করে ফেলেছে। ভাই তুইও আহত হয়ে ব্যান্ডেজ ট্যান্ডেজ নিয়ে হসপিটালে বিয়ের ফুল ফুটিয়ে ষোলো ষোলো বত্রিশকলা পূর্ণ করে ফেলেছিস। সাজগোছহীন রুপের যে এত পাওয়ার সেটা ওদের বিয়েতেই প্রমাণ পেয়েছিস।’
শেষ কথাটা সে শুদ্ধর উদ্দেশ্যের বলে দাঁত বের করে হাসল। তার কথা শুনে স্বর্ণ টেবিলের নিচ দিয়ে চিমটি কাটলেও থামল না। বরং বলল,
-‘তাছাড়া বাসর ঘরে ঢুকে বউ আনবক্সিং করা আরেক প্যারা। সাজের ঝামেলা না থাকলেই বরং ভালো হবে। ‘
সায়নের লাগামছাড়া কথা শুনে সাফওয়ান চৌধুরী এবার গলা খাঁকারি দিলেন। বোঝালেন উনারা উপস্থিত আছেন। তবে উনার গলা খাঁকারির শব্দে সায়ন থামল না। ঘাড় ঘুরিয়ে উনার উদ্দেশ্য বলল,
-‘ উহুম উহুম করছো কেন? এমন ভাব করছে যেন তুমি বউ আনবক্সিং করো নি। তোমার জমজ ছানাপোনা উড়ে উড়ে এসেছে।’
সাফওয়ান চৌধুরী বুঝলেন ভুল মানুষকে থামতে বলেছেন। যে একবার কাউকে বাঁশ দিতে শুরু করলেন স্টকে থাকা বাকি বাঁশ অন্যদের ঘাড়ে ঝুলিয়ে দেয়। তাদের কথা থামিয়ে এবার শারাফাত চৌধুরী জানালেন,
উনি ১৪ই নভেম্বর বিয়ের ডেট ঠিক করেছেন। অর্থাৎ হাতে আছে মাত্র এগারোদিন। এই কদিনের মধ্যে সব আয়োজন করতে হবে। তিন ছেলের বিয়ে কোনো কিছু কমতি রাখা যাবে না। যাতে কমতি না থাকে এজন্য প্রত্যেক সদস্যকে কাজ ভাগ করে দিলেন। নাস্তার টেবিলে ভিডিও কলে কথা হলো শাহাদত চৌধুরীর সঙ্গে, উনি বললেন সামনে সপ্তাহে ছুটিতে আসবেন। বিয়ের কার্ডও চলে এসেছে। আমন্ত্রণের কাজও শুরু হয়েছে।
শুদ্ধ নাস্তা সেরে রেডি হয়ে বের হতে গেলে শীতল ঠোঁট উল্টে তাকাল।
তখন শুদ্ধ চোখের ইশারায় বোঝাল রাতের বাইকে করে ঘুরবে। একথা শুনে শীতল কিছু বলল না স্বর্ণের সাথে কি একটা দেখতে লাগল। শুদ্ধ
কিছু কার্ড নিয়ে বের হলো। সব ফ্রেন্ডদের একে একে কার্ড পৌঁছে দিয়ে গেল অর্কের বাসায়। অর্কের ফোন করে রিসিভ না করায় ভেতরে ঢুকতে হলো। তাকে দেখে অর্কের মা হাসি মুখে কথা বললেন। সবার খোঁজখবর নিলেন। অর্কের খোঁজ করলে জানালেন অর্ক ঘুমাচ্ছে উঠে নি এখনো।
কাজের মেয়ে একগাদা নাস্তা এনে রাখল সেন্টার টেবিলের উপর। অর্ক যেহেতু ঘুমাচ্ছে তাই তাকে ডাকতে নিষেধ করল শুদ্ধ। পরে কথা বলে নেবে বলে বিয়ের কার্ড দিয়ে ধরিয়ে দিয়ে উঠতে গেলে তাকে থামিয়ে দিলেন। স্নেহের সুরে বললেন,
-‘ শুদ্ধ, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। আমি ভেবেছিলাম তোমাকে কল করব। কিন্তু নাম্বার না থাকায় কল করতে পারছিলাম না তাছাড়া তুমিও
দেশের বাইরে ছিলে।’
-‘কোনো সমস্যা আন্টি?’
-‘ সমস্যা তো বটেই। আর প্রধান সমস্যা হলো তোমার বন্ধুকে নিয়ে।’
-‘কি হয়েছে ওর?’
-‘এতদিন বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছিল না। বলত মেয়ে পছন্দ না। আমার
চেনাজানার মধ্যে একটা মেয়ে দেখেছি। সবমিলিয়ে দুটোকে মানাবেও বেশ। কিন্তু তোমার জন্য কথা এগোতে দিচ্ছে না।’
-‘আমার জন্য? আমি ঠিক বুঝলাম না আন্টি।’
উনার এবার ছেলের বয়সীর শুদ্ধর হাতটা টেনে নিলেন। মমতাময়ী সুরে বললেন,
-‘আমি যে অর্কের স্টেপ মাদার তুমি তো জানো বাবা। তবে আমি কিন্তু নিজে হাতে ওকে মানুষ করেছি। আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক ফ্রেন্ডলি তাও জানো। কথা হচ্ছে, আমি ছেলের বিয়ে দিতে চাই। এজন্য তোমার হেল্প লাগবে। গতমাসে আমরা সিঙ্গাপুর চলে যাব এর আগে বিয়েটা সারতে পারলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না।’
শুদ্ধর মনে এবার খটকা লাগল। বিশেষ করে কথা বলার ধরণে। কারণ
স্বর্ণ-সায়ন আর শীতল-শুদ্ধর বিয়ের কথা প্রায়ই জানাজানিও হয়েছে।
আর অন্যের বাড়ির মেয়ে নিলে তাকে এভাবে বলার কারণ দেখছে না।
তাকে বলছে মানে স্বর্ণ, শীতল বাদে শখ বাকি আছে। আচ্ছা উনি কি কোনোভাবে শখের কথা বলতে চাচ্ছেন? শুদ্ধর ভাবনা শেষ না হতেই
উনি বললেন,
-‘শখের দায়িত্ব কী কোনোভাবে আমার ছেলেকে দেওয়া যায় না, বাবা? তোমার বন্ধু কেমন তুমি তো ভালো করেই জানো।’
শুদ্ধ জবাব দিলো না। অর্ক চোখ ডলতে ডলতে এসে দাঁড়াতেই শুদ্ধ উঠে দাঁড়াল। অর্কের মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘ভেবে জানাব।’
একথা বলে অর্কের দিকে না তাকিয়ে শুদ্ধ পা বাড়াতেই অর্ক হতবাক হয়ে বলল,
-‘আরে ভাই কি হয়েছে? রেগে আছিস কেন?’
শুদ্ধ এবার ঘুরে তাকিয়ে অকপটে বলে বসল,
-‘শখকে পছন্দ করিস? সোজাসাপটা কথা বল।’
-‘ শখ? এর মধ্যে শখ এলো কোথা থেকে?’
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৬
-‘যদি সৎ সাহস থাকে তাহলে আজ সন্ধ্যার পর পরিবার নিয়ে আসিস। সেখানে বসেই ফাইনাল কথা হবে। আর যদি না আসিস তাহলে আমার বোনকে নিয়ে অযথা টানাহেঁচড়া করার দুঃসাহস দেখাস না। আসছি।’
একথা বলে শুদ্ধ বেরিয়ে গেল। তার কথার আগামাথা না বুঝে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অর্ক। তবে মায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে বাকি রইল না মূল ঘটনা। করুণ সুরে বলল,
-‘ আর কতবার বলব শখকে আমি যেভাবে কখনো দেখি নি। তোমার কসম, শখকে নিয়ে আমার মনে কোনো ফিলিংস নেই। তবুও কেন শুধু শুধু পাগল ক্ষেপালে, মম? এখন কি হবে বুঝতে পারছো তুমি?’
