মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ৪৯+৫০
ইশরাত জাহান
রাজ দরজা লাগিয়ে দেওয়াতে হা হয়ে রুদ্র বলে,”নিচে একজন বাসর উপরে আরেকজন বাসর।বাড়িটাতে তো ঘরে ঘরে বাসর।আমরা কোথায় যাবো?”
আদ্র হাটা শুরু করে।পকেটে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে বলে,”আমি ছাদে যাচ্ছি।”
রুদ্র দেখলো ছাদের সিঁড়ি দিয়ে আগে আগেই দৌড় দিচ্ছে সিয়া।মুখটা পাংসুটে করে বলে,”আমি লাইব্রেরিতে যাচ্ছি।আমার বিদ্যাসাগরের কাছে।”
আদ্র জবাব না দিয়ে মৃদু হেঁসে সোজা চলে যায়।থেকে গেলো মিলি আর তারেক।তারেক অন্যদিকে যেতে নিলে মিলি বাঁধা দিয়ে বলে,”আমার সাথে চলো।”
“কোথায়?”
“দেখতেই পাবে।”
পাশে বালিশগুলো রেখে তারেকের হাত ধরে দৌড়ে নিচে যায়।এখানে কেউ দেখে ফেললে সমস্যা।দেখে তো একজন নিয়েছে।মাহমুদ সরদার দেখেছে মিলিকে তারেকের হাত ধরে দৌঁড়াতে।মিলির মুখে হাসি কিন্তু তারেকের মুখে বিরক্তি।তারেক বলে ওঠে,”আশেপাশের গুরুজন আমাদের এভাবে দেখলে বাজে দৃষ্টিতে নিবে।আপনি আমার হাত ছাড়ুন।”
মিলি ছাড়ল না বরং জব্দ করে ধরে দৌঁড়াতে থাকে,”কেউ দেখবে না বলেই তো দৌঁড়াতে হচ্ছে আমাকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড।”
“ব্ল্যাক ডায়মন্ড?”
“হুম ব্ল্যাক ডায়মন্ড।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বলেই হলরুম থেকে দুজনে বের হলো।মাহমুদ সরদার এদের এটুকু কথাই শুনতে পেলেন। আরো এগোতে নিবেন তার আগে দেখতে পেলেন রুবিকে ব্যাগ নিয়ে বাইরে বের হতে।পিছে বাঁধা দিচ্ছে সোনালী।সোনালীকে বাঁধা দিতে বারণ করছে মিহির।কিন্তু সোনালী শুনবে না।মাহমুদ সরদার মিলিকে দেখার থেকেও রুবিকে দেখাটা বেশি জরুরি মনে করলো।মেয়েটার গার্জিয়ান হিসেবে এখন তিনিই আছেন।বলা যায়না সোনালী কখন কি করে।রুবি হলরুমে আসতেই সোনালী দ্রুত সামনে এসে বলে,”তোমার বাবাকে ছেড়ে যেতে পারো না তুমি।”
রুবি বিরক্ত হয়ে বলে,”কিসের বাবা?কে বাবা? ওই লোক যদি আমার বাবা হয় তাহলে আমার মাকে ছেড়ে দিয়ে কেন আপনাকে বিয়ে করেছিল?সবথেকে বড় কথা মিহির যদি আপনার আর মোহন সরদারের সন্তান হয় আমিও যদি মোহন সরদারের সন্তান হই সেক্ষেত্রে আমাদের বয়স তো একই।তাহলে কি বলতে হবে আমার বাবা আমার মা থাকার পরেও আপনার সাথে অবৈধ সম্পর্কে ছিলো!”
সোনালী শুকনো ঢোক গিলে বলে,”তুমি একদম তোমার মায়ের মত শেয়ানা।তোমার বাবা শুধু দেখতেই সুদর্শন কোনো কাজের না।তোমার মাই ছিলো কাজের কিন্তু কালো বলে পাত্তা পেলো না।আমি ছিলাম সুন্দরী বড়লোক বাড়ির, তোমার বাবার অ্যাসিস্ট্যান্ট।তাই আমার সাথে সম্পর্ক হয় কিন্তু তোমার মায়েরও দোষ আছে।আমাদের সম্পর্কের মাঝে তো সেই তৃতীয় ব্যাক্তি।আমার আর মোহনের প্রেমের মাঝে হঠাৎ তোমার মায়ের সাথে মোহনের বিয়ে হয়।এর মধ্যে আমি মিহির আসার খবর পাই।ভেঙ্গে পড়েছিলাম খুব।তাই বাধ্য হয়ে মোহনকে বিয়ে করি তোমার মায়ের বিয়ের পরেই।”
“আর কোন মুখে থাকব আমি এই বাড়িতে?আমার প্রাক্তন আমার ভাই হয় এই ভিত্তিতে?নিজেকে হাসির পাত্রী বানাতে পারব না।হ্যাঁ আপনার ছেলের সাথে আমি আর সম্পর্ক রাখব না কিন্তু আপনার ছেলের নষ্টামি দেখবো এমনটাও না।একটা অপদার্থ জন্ম দিয়েছেন আপনি।যার নেই কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড।জন্মেছে অবৈধ হয়ে কাজও করে তেমন।মেয়েদের মন নিয়ে খেলতে তার তো ডিগ্রি করাও আছে দেখছি।ভাগ্যিস এই বাড়িতে এসেছিলাম তাই কালসাপের আসল রূপ দেখেছি।নাহলে তো জানতেই পারতাম না আমি যার অপেক্ষায় দিন গুনি সে অন্য নারীর সাথে লীলাখেলে।”
“রুবি!”
“চিৎকার করবে না মিহির।আমারও কিন্তু গলা আছে।আমি খুব ভালো করেই জানি তোমার নজর এখন কোন নারীর দিকে।কিন্তু তুমি জানো না ওই নারী না তোমার গলার সর নামাতে আমিই এনাফ।ভালোবাসার জালে আমাকে ফাঁসালেও ধোঁকার জালে আমাকে তুমি দুর্বল ভাবতে পারবে না।আমি দুর্বল ছিলাম কিন্তু এখন নই। ভালয় ভালয় তোমাদের পথ থেকে সরে যাচ্ছি যেতে দেও।নাহলে আমিও কিন্তু তোমার জীবনটা তামা তামা করতে পারি।”
মিহির শান্ত হয়ে সোনালীকে বলে,”ওকে যেতে দেও মম।”
সোনালী চোখ রাঙিয়ে মিহিরকে বলে,”খুব পেকে গেছো তুমি?তোমার সাথে পরে ডিল করবো এখন রুবিকে দেখে নেই আগে।যাও ওর ব্যাগ নিয়ে ঘরে যাও।আর তুমি আমার সাথে চলো।”
রুবির হাত ধরে নিয়ে গেলো সোনালী।মিহির হতাশ হয়ে ব্যাগ নিয়ে গেলো মোহনার মানে রুবির ঘরে।মাহমুদ সরদার বিরক্ত হয়ে ঘরে চলে গেলেন।
সুইমিং পুলের কাছে এসে তারেকের হাত ছেড়ে দিলো মিলি।তারেক বিরক্ত প্রকাশ করে বলে,”এখানে কেন এনেছেন?”
মিলি আকাশের দিকে ইশারা করে বলে,”ওই যে আকাশ ভরা চাঁদ দেখছো ওগুলো গুনতে।”
“আপনি গুনুন আমি পারবো না।”
“এছাড়া তোমার উপায়ও নেই।”
“মানে?”
“ব্রো এন্ড ভাবী দরজা খুলবে না।তুমি ঘুমানোর জায়গা পাবে না।কারণ বাকি রুম গুলোতেও গার্ড।আমার লাইফে ফার্স্ট এমন বাড়ি দেখছি যেখানে এত গার্ড আনার জন্য ঘরের অভাব পড়ে গেলো।”
“আপনার মায়ের জন্যেই তো এমন করা।বলা যায়না জারা ম্যামকে নিয়ে আবার কোথায় লুকিয়ে রাখে।”
“আমার মা এতটাও খারাপ না।”
তারেক শুধু হাসলো।মুখে কিছুই প্রকাশ করল না।মিলি তারেককে নিয়ে সুইমিং পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো।দুজনের পা ভিজছে শুধু।মিলি উপরের দিকে চোখে রেখে বলে,”দিনের আকাশের থেকে আমার কাছে রাতের আকাশ বেশি ভালো লাগে ব্ল্যাক ডায়মন্ড।”
তারেক মিলির মুখের দিকে তাকালো।মিলির মুখটা কাছে থেকে দেখে কেমন যেনো ঘোরে চলে গেলো।এই মুখের থেকে দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব হলো না তারেকের জন্য।মিলি বলে,”জিজ্ঞাসা করলে না কেন?”
“কেন?”
“কারণ দিনের আলোয় আকাশটা সাদা দেখালেও সেখানে শুধু সূর্যের বসবাস আর রাতের আকাশ কালো থাকলেও ওখানে একাধিক তারার সাথে একটা বড় চাঁদের বসবাস।দিনের আকাশটা হাস্যজ্বল থাকেনা রাতের আকাশটা হাস্যজ্বল থাকে।আমার কেন জানি না মনে হয় রাতের আকাশটা সুখী বেশি।”
মিলির কথাগুলো তারেকের মাথার উপর দিয়ে গেলেও মিলির মুখের দিকে চেয়ে এগুলো শুনতে বেশ ভালই লাগছে তারেকের।মিলি থামতেই তারেক প্রশ্ন করে,”আমাকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড বলার কারণ কি?আমি কালো এজন্য।”
মিলি ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,”ডায়মন্ড অনেক মূল্যবান।ধরা ছোঁয়ার বাইরে।হ্যাঁ তুমি কালো কিন্তু আমার কাছে মূল্যবান।তাই তোমাকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ডাকতে আমার ভালো লাগে।”
তারেক মুগ্ধ হয়ে দেখছে মিলিকে।মিলির মুখে নিজেকে মূল্যবান শুনে মনটা কেমন শীতলতায় ছেয়ে গেলো।
লাইব্রেরীতে বসে কাগজে কিছু হিসাব করছে হিয়া।মেলাচ্ছে সময়সূচি।পাশেই তার দেয়াল বইটি মেলে রাখা। মন বসছে না উপন্যাসের পাতায়। মন আজ রহস্য উন্মোচনে।কাগজের উপর একেকজনের জন্ম তারিখ লিখলো।বিশেষ করে মায়া আর মিহিরের।দুজনের বয়সটাই তো এক।আবার দুজনের বাবাও এক।হিয়া দুজনের জন্ম তারিখের সাথে আবার লিখছে দুজনের মায়ের নাম।হিয়া ভাবছে মিহিরের ফেস কাটিং নিয়ে।মায়ার চেহারায় মোহন সরদারের কিছু চিহ্ন থাকলেও মিহিরের মাঝে নেই।সে তো ছোট থেকেই শুনেছে সন্তানেরা বাবা মায়ের আংশিক রূপ পেয়ে থাকে।তাহলে মিহির কেন পেলো না!আবার হিয়া মাহমুদ সরদারের সাথে মালিনীর বিয়েটাকেও হিসাব করছে।এই বিষয়ে সিয়াকে জানায়নি হিয়া।কিছু সন্দেহের কথা গোপন রাখলো নিজের কাছে।সবকিছু বললে সিয়াও আতঙ্কে থাকবে।সোনালীর কাছে শুনেছে সিয়া আর হিয়ার জন্মের আগে তাদের একটা ভাই হয়।সেই ভাই নাকি হারিয়ে যায়।অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া গেলো না।সেদিনের পর থেকে মালিনীর মন মানসিকতা ভালো না।রগচটা হয়ে থাকে সে।এখন হিয়া ভাবছে,”আমার সেই ভাইয়ের হারিয়ে যাওয়ার পিছনে সোনালীর হাত নেই তো?”
“কিসের এত দুশ্চিন্তা হিয়াপাখি?”
কানের কাছে পুরুষালি কন্ঠে কেঁপে উঠলো হিয়া।পাশ ফিরে রুদ্রকে দেখে সাথে সাথেই ডায়েরিটা বন্ধ করে দেয়।ভ্রুকুটি করে চশমা ঠিক করলো।রাগ দেখিয়েই বলে,”আমার কাছে কি চাই?”
“রিফ্রেশমেন্ট।”
“আপনার মিনি ড্রেস পরা গার্লফ্রেন্ড কোথায়?”
“ঘুমায়।”
হিয়া রুদ্রের হাতের দিকে তাকালো।চায়ের ফ্ল্যাক্স আর দুটো কাপ।হিয়া ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে,”গার্লফ্রেন্ডকে ঘুম পাড়িয়ে আমার ঘুম হারাম করতে এসেছেন।”
“আমার বেঁচে থাকাটা হারাম করে দিচ্ছিস আর আমি তোর ঘুম হারাম করলেই দোষ।”
“আমি কিভাবে আপনার বেঁচে থাকাটা হারাম করে দিলাম?”
রুদ্র উত্তর দিলো না বরং কাপে চা ঢালছে।হিয়া ডায়েরিটা লুকিয়ে রাখলো আরেকটা বইয়ের নিচে রেখে।রুদ্রের নজর এড়ালো না।চা সহ কাপ হিয়ার দিকে এগিয়ে দিলো।হিয়া কাপ নিয়ে চুমুক দিলো।রুদ্র নিজের মত চা নিয়ে চুমুক দিচ্ছে আর আড়চোখে হিয়াকে দেখছে।হিয়ার কাপের চা প্রায় শেষের দিকে। আর তিন কি চার চুমুক আছে রুদ্র তখন হিয়ার হাত থেকে কাপ নিয়ে নেয়।হিয়া দেখলো শুধু।রুদ্র কাপে চুমুক দিতেই হিয়া বিরক্ত হয়ে বলে,”ওটা আমার কাপ ছিলো।”
“আমি অস্বীকার করেছি?”
“আপনি নিলেন কেন?”
“টেস্ট করার জন্য।”
“কিসের টেস্ট?”
“তুই বুঝবি না।”
“আমার বোঝার ইচ্ছাটাও নেই।”
রুদ্র মনের আবেশে হিয়ার কাপ থেকে চায়ের স্বাদ নিচ্ছে।হিয়ার মনক্ষুন্ন কথাকে সে পাত্তা দিলো না।জমা রাখতে চায় সে।দেখতে চায় হিয়া তাকে কত কিছু শুনাতে পারে।
ছাদে এসে সিয়া এদিক ওদিক হাঁটছে।দেখতে থাকে চারপাশটা।আচমকা সিয়া অনুভব করে তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।সিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল।সেই হাঁসি দমিয়ে রেখে পিছনে ফিরে গম্ভীর মুখ রেখে বলে,”কি চাই?”
“প্রেয়সীর অভিমান ভাঙাতে।”
“আজ সূর্য কোনদিকে!”
“সূর্য ডুবে চন্দ্রের দেখা তাই চন্দ্রকে দেখো।”
“আপনাকে দেখার থেকে ওই চন্দ্রকে দেখাই ভালো।অন্তত প্রতিদিন সময় করে হলেও দেখা দেয়।”
“ভাগ্যিস চন্দ্র কোনো মানব না।”
“মানব হলে কি করতেন?”
“জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিতাম।”
সিয়া চাঁদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে চাইলো আদ্রের দিকে।আদ্রর চোখ সিয়ার দিকেই।
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন আদ্র?”
“জানাটা কি খুব জরুরি?”
“মন চায় জানতে।”
“জানার চেষ্টা করো।উত্তর দিবো না আমি।”
“হাঃ!এভাবেই এড়িয়ে যাবেন আমার কথাগুলো।”
“ম্যাডাম আপনাকে তো আর এড়িয়ে যাই না।”
“একদিন হয়তো যাবেন।”
“সেদিন আমি থাকবো খাটিয়ায় তোমার দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ যাবে হারিয়ে।”
“আদ্র!”
সিয়ার উৎকণ্ঠা কন্ঠস্বর।চোখ ভিজে আসা ভাব।আদ্র বুঝতে পেরে বলে,”তুমি যেমন আমাকে আঘাত করতে তৈরি হবে আমিও কিন্তু তোমাকে সেই একই পথে প্রেমের মাধ্যমে আঘাত দিতে থাকব প্রেয়সী।”
সিয়ার চোখের পানি মুছে আদ্র সিয়াকে নিজের মাঝে আগলে নিলো।আকাশের দিকে চোখ স্থির রাখলো আদ্র।
এদিকে রুদ্র হিয়াকে দেখছে।হিয়া মন দিয়ে বই পড়ছে।এক সময় রুদ্রের দিকে চোখ রেখে বিরক্ত হয়ে বলে,”কি দেখছেন?”
রুদ্র আনমনা হয়ে দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে কিছু না বুঝিয়ে গুনগুন শুরু করে।হিয়া ভ্রুকুটি করে বলে,”কি?”
আচমকা রুদ্র গাইতে শুরু করে,
~যার ছবি এই মন এঁকে যায়
যার কথা ভেবে দিন কেটে যায়
সে কি জানে শুধু তাকে ভালোবাসে আমার হৃদয়।
রুদ্রের গান কর্ণপাত হয় সবার।সুইমিং পুলে পা দুলিয়ে থাকা তারেক মিলি একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে গান উপভোগ করছে এই মনোরম পরিবেশে।
আদ্র ও সিয়াও গান শুনছে আর দুজনকে দেখে মুচকি হাসে।সিয়া লজ্জায় আকাশের দিকে ফিরতেই আদ্র সিয়ার চোখের দিকে চোখ রেখে গাইতে শুরু করে,
~কাজল কালো দুটি চোখে
সে যখনই আমায় দেখে
পড়েনা চোখেতে পলক
আর আসেনা কথা মুখে
ভাইয়ের গান শুনে রুদ্র থেমে যায়।হিয়া বুঝতে পারে ছাদে তার বোন আর হবু জিজু আছে।একটু মুচকি হাসে হিয়া।রুদ্র হিয়ার হাসি দেখলো।আদ্র থামতেই রুদ্র আবারও গাইতে শুরু করে,
~তার চলে যাওয়া ফিরে একটু চাওয়া
এই বুকেতে ঝড় তুলে যায়
যার ছবি এই মন এঁকে যায়
যার কথা ভেবে দিন কেটে যায়
সে কি জানে শুধু তাকে ভালোবাসে আমার হৃদয়।
এবার আদ্র রেলিংয়ে একটু হেলান দিয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে আবারও শুরু করে,
~বলব কবে তাকে ডেকে
আমি তোমাকে ভালবাসি।
করেছে পাগল আমাকে
ওগো তোমার ওই মিষ্টি হাসি।
আদ্র আর রুদ্র একসাথে গান গাইছে এদিকে সবাই এই গান উপভোগ করছে। বিশেষ করে মিলি।তারেকের সাথে ভেজা পায়ে বসে ওদের এই গান যেনো মিলির দিক থেকেও তারেকের প্রতি একটা ইঙ্গিত। মিলি আড়চোখে তারেককে দেখছিল এতক্ষণ।হঠাৎ উপরের দিকে চোখ যেতেই দেখলো আদ্র নিচে নামছে।তারেক বলে ওঠে,”আমরা তাহলে ঘুমোতে যাই ম্যাম।নাহলে আমাকে ম্যামের সাথে অফিস যাওয়া সম্ভব হবেনা।”
মিলি আর অপেক্ষা করালো না।তারেককে যেতে দিলো।আদ্র ছাদের দরজার কাছে এসে সিয়ার দিকে একবার ঘুরে তাকালো।সিয়া লাজুক হাসিতে দেখছে আদ্রকে।আদ্র মুচকি হাসি বজায় রেখে বলে,”ভালোবাসি বলেও দূরে ঠেলে দেওয়া যায়।আমি নাহয় ভালোবাসি শব্দটা না বলেই তোমার রয়ে গেলাম।”
সিয়া আদ্রর চোখে চোখ রেখেই বলে,”এভাবে দু একটা গান শুনিয়েও মন জয় করে নিতে পারেন।আপনার গানের মাঝে আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা বুঝে নিবো।”
আদ্র হাসিটা চওড়া করে চলে গেলো ছাদ থেকে।
রুদ্রের গাওয়া প্রতিটি কথার মাঝে হিয়ার চশমা দেওয়া চোখজোড়া ছিলো রুদ্রের দিকে।হিয়া দেখতে থাকে রুদ্রের চোখমুখ।বেঘোরে আছে হিয়া।রুদ্র হিয়ার মুখের দিকে চোখ রাখতেই দেখতে পেলো হিয়ার সামনের দিকের চুলগুলো ওর ঠোঁটের কাছে।রুদ্রের মাঝে শীতলতা ছেয়ে গেলো।নিজেকে সামলে নিয়ে হিয়ার ঠোঁটের উপর ফু দিলো।হিয়া কেঁপে উঠলো।রুদ্র চেয়ার ছেড়ে উঠলো।বাইরে যেতে যেতে বলে,”তোর চুলগুলো আমাকে বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে হিয়াপাখি।বড্ড দুষ্টু তোর সামনের চুলগুলো।ওদেরকে সামলে রাখিস দয়া করে।”
হিয়া চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে জোরেই বলে উঠলো,”নষ্ট পুরুষ!নজর ঠিক রাখেনা।”
রুদ্র যেতে যেতে বলতে থাকে,”আমার নষ্ট মনকে উস্কে দিতে আসে তোর অবাধ্য চুলগুলো।পরবর্তীতে সামলে না রাখলে সত্যিই নষ্ট হয়ে যাবো আমি।হিয়ার নষ্ট পুরুষ তখন তার নষ্ট রূপ দেখিয়ে দিবে।”
হিয়ার মুখের বাকি বুলি না শুনেই রুদ্র দ্রুত কদম ছাড়লো।এখানে থাকা মানেই রুদ্রকে ঝার খাওয়া।তাই দ্রুত চলে গেলো।
আদ্র রুদ্র ও তারেক মাত্রই আসলো রাজের ঘরে।রাজের দিকে তাকিয়ে রুদ্র বলে,”ভাবিজি কাহাপার হে ব্রো?”
“তোদের গান শেষ তার সাথে আমার মিটিংটাও শেষ।”
“হোয়াট এ মিটিং!”
রুদ্রের মুখে বালিশ ছুঁড়ে মেরে রাজ বলে,”বাইরে থেকে বাকি বালিশ এনে ঘুমিয়ে পর।আমার শাশুরি আসলে তুই আর আমার শালা বের হবি।”
“তোমার শালা কি মনে রেখেছে তোমার শাশুড়ি আসবে?”
আদ্র দুটো বালিশ বাইরে থেকে ভিতরে আনতে আনতে বলে,”মনে তো তখন রাখবে যখন সে জানতে পারবে।আন্টিকে কাল আনা হচ্ছে এটা কি জানানো হয়েছে?”
“আমি জানিয়েছি।”
রাজের কথা শুনে দুজনে রিল্যাক্স হলো।আদ্র পুনরায় বলে,”আমিও যাচ্ছি কাল আন্টিকে দেখতে।ওনাকে একটি দেখা প্রয়োজন।”
বলেই সোফায় বালিশ রাখে।রুদ্র ভ্রুকুটি করে বলে,”তুমি সোফায় ঘুমাবে?”
“হুম।”
রাজ হামি তুলে বলে,”তোর মত নির্বোধ না।”
রুদ্র রাজের পাশে বালিশ রেখে বলে,”তোমার মত বিশ্বাসঘাতকও না।চোখ বন্ধ করতে বলে সোজা ঘোল খাইয়ে দিলে।”
“আব্বে ব্যাটা বিয়ে করো একবার।স্বামীর দুঃখ বুঝবে দশবার।”
রাজ মাঝখানে কোলবালিশ রাখলো।তারেক নিজের মত জায়গা করে নিলো।রাজকে মাঝখানে কোলবালিশ রাখতে দেখে সবাই একবার করে চোখ স্থির রাখলো সেদিকে।রুদ্র কোলবালিশ দেখে বলে,”ডোন্ট ওরি ব্রো আমি ঘুমের মাঝে হাত পা ছড়াই না।”
রাজ ওর বালিশে মাথা রেখে বলে,”ইউ হ্যাভ টু বি ওরি ব্যাটা।আমি বউ নিয়ে ঘুমোতে অভ্যস্ত।তাই বউ ভেবে কখন কি করে দেই নিজেরই জানা নেই।”
“মানে আমার সর্বনাশ হবার সম্ভাবনা আছে!”
“নিরানব্বই শতাংশ।বাকি এক শতাংশ গ্যারান্টি দিতে পারি।”
আদ্র ওদের কথা শুনতে চায়না তাই কানে ব্লুটুথ দিয়ে গান শুনছে।তারেক বেক্কল হয়ে সময় গুনছে কখন এরা ঘুমোবে আর এদের টেপ রেকর্ডার বন্ধ হবে।মনে মনে একবার বলেও দিলো,”এদের ভাইদের কীর্তি কলাপ দেখার থেকে ভালো ছিল ওই চুড়েলের মেয়ের সাথে সময় কাটানো।বেশ ভালই সময় পার হয়।”
রুদ্র আরো কিছু বলতে নিবে রাজ রুদ্রের মুখের উপর হাত রেখে বলে,”চুপ করে ঘুমা।নাহলে লাথি মারে বিছানা থেকে সরিয়ে দিবো।”
রুদ্র রাজের হাত সরিয়ে বলে,”আমি তোমার বউ নাকি যে ঠোঁটের উপর তোমার শক্ত হাত রেখে রোমান্টিক স্ট্যাইলে ধমক দেও?”
“ধ্যাত!”
বলেই রাজ লাইট অফ করে দেয়।তারেক হাফ ছেড়ে বাঁচে।
সিয়া ঘরে এসে মায়াকে দেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে মায়াকে জড়িয়ে ধরে,”ভাবী তুমি আজ আমাদের সাথে থাকবে বলে খুব আনন্দ হচ্ছে।”
মৌ এসে ওদের পাশে বসে মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,”I miss you so much apu.”
মায়া দুজনের মুখে আদুরে হাত রেখে বলে,”আমি এতটাই ভাগ্যবতী যে আমাকে ভালোবাসার জন্য আমার বোন সহ আমার ননদ আছে।”
মনে মনে বলে,”পৃথিবীতে আমার বাবা বেঁচে থাকলেও কখনও তার ভালোবাসাটাই পেলাম না।আমি আসলে অততাও ভাগ্যবতী না।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মায়া।রাজ থাকলে মায়াকে তার বক্ষে আলিঙ্গন করে রাখতো।মায়া এখন এটাই ভাবছে।তার স্বামী যেনো তাকে বিনাবাক্যে চিনে ফেলে।
হিয়া উপরের দিকে উঠতেই কানে কিছু অদ্ভুত শব্দ পায়।শব্দটা মিহিরের ঘর থেকে আসে।হিয়া সন্দেহ করে।তাই সেদিকে যায়।মিহিরের ঘরের কাছে আসতেই দেখে সেখানে সোনালীও আছে।নিচে একটা কাচের টুকরো। হয়তো রাগের বসে ভেঙেছে।মিহির রাগ দেখিয়ে বলে,”বেবী ডলকে আমার চাই মম।”
সোনালী ভ্রু কুঁচকে বলে,”এই বেবী ডল আবার কে?”
“মায়া যে দেখতে একদম ডলের মত।যেমন দেখতে তেমন অ্যাটিটিউড।আই লাইক ইট।”
“ঠিক তেমনই ওর দেমাগ।ওই মেয়ে আসতে পারেনা দুদিনের মাথায় আমাকে গার্ডের হাতে চাবুকের মার খাওয়ায়।সেই মেয়েকে তুমি কিভাবে চাও?”
“এট এনি কস্ট আই নিড হার।”
“তাহলে রুবি?ও কিন্তু তোমাকে ভালোবাসে।মীরার বাবাকেও আমি কথা দিয়েছি।”
“রুবিকে জাস্ট ইউজ করেছিলাম।সে যে টপকে আমার বোন হয়ে যাবে এটা তো বুঝিনি।”
“বোন না বলো সৎ বোন।এছাড়াও তোমার সাথে ওর রক্ত ম্যাচ করেনা।আফটার অল তোমার বাবা তো ওর বাবা না।”
“আই নো মম।তাই তো কোনো রিয়েক্ট করিনি।কিন্তু এই সরদার পরিবারের লোকজন দেখতে স্মার্ট হলেও চিন্তাধারায় সেকেলেই আছে।”
“যাকে বলে মোমে হালকা তাপ দিতে না দিতেই গলে যাওয়া।”
হিয়া বিড়বিড় করে বলে,”একবার শুধু রহস্য বের করে নেই তোদের মা ছেলের এই মোমের গলে যাওয়া কতদূর যায় দেখিয়ে দিবো।”
হিয়া ফোন বের করে ভিডিও করছে।মিহির ফোন বের করে কাউকে কিছু পাঠালো।সোনালী বলে,”কি করছো তুমি?”
“বেবী ডলের ইনফরমেশন খুজছি।”
“ওরটা দিয়ে তুমি কি করবে?ওর ইনফরমেশন লাগবে না।ও বীরের বোন।”
ভ্রু কুঁচকে মিহির বলে,”বীরের বোন!লাইক সিরিয়াসলি?বীরের কোনো ভাইবোন আছে এটা মালিনী খান জানতে পারবে না!”
“বীর ওদের দুই বোনকে কুড়িয়ে পেয়েছে।এটা শুনেছি ওর গার্ড সাহিলের থেকে।এছাড়া বেশি কিছু জানি না।”
“মেয়েটার ক্ষমতা শুধু বীরের থেকে আসা পসিবল না।কাহানি মে কুছ তো হে।”
“যেমন?”
“বীর মেয়েটাকে হয় আগে থেকে চেনে নাহয় এখানে বীরের ক্লোজ কানেকশন আছে।সে যেটাই হোক সবকিছু জেনে আমি মেয়েটাকে আমার করেই নিবো।”
“তুই মেয়েটাকে তোর করতে চাইবি আর মেয়েটা তোকে কবরস্থানে পার্মানেন্ট বসবাসের ব্যবস্থা করিয়ে দিবে।যেখান থেকে কোনদিন তুই ফিরতেই পারবি না।”
“ওহ মম এত কনফিডেন্ট মেয়েটাকে নিয়ে!তাহলে তো এই ডেঞ্জারাস লেডি কিলারকে নিয়ে আমার এবার মাঠে নামতেই হয়।দেখা যাক না কি হয় শেষ খেলা।”
“মিহির খেলা যেটাই হোক না কেন ওই ফর্মুলা উদ্ধার করা আমাদের জরুরি।যেটা এই মোহনার কাছেই আছে।এতগুলো বছর পর মোহনাকে পেয়েছি।ওকে বস করে রেখেছি অনেক কষ্টে।দয়া করে মোহনা মানে রুবির দিকে ফোকাস রাখো।”
“ওকে মম বাট আই নিড বেবী ডল।”
সোনালী বিরক্ত হয়ে চলে যেতে নেয়।হিয়া আড়াল হয়ে গেলো সাথে সাথে।সোনালী চলে যেতেই হিয়া হাফ ছেড়ে বলে,”ফর্মুলা!আমাকেই জানতে হবে ফর্মুলা নিয়ে।”
ভেবেই হিয়া সামনের দিকে হাটা দেয়।আচমকা কেউ একজন হিয়াকে হ্যাঁচকা টান দিলো।হিয়া আতকে ওঠে।হিয়াকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে হিয়া বুঝতে পারেনা।হিয়ার মুখ চেপে ধরে আছে সে।
সকালবেলা,
ঘুমঘুম ভাব এখনও রুদ্রের মাঝে।ঘুমের মধ্যেই মুখের উপর কারো শক্ত পুরুষালি হাতের ছোঁয়া পাচ্ছে সে।চোখ পিটপিট করে ওঠে রুদ্রের।নরম হাতের স্পর্শ পেলেও ভালো লাগতো কিন্তু পুরুষ হয়ে পুরুষালি হাতের স্পর্শ অসহ্য লাগছে।ঘুমের রেশ কাটিয়ে পাশ ফিরতেই দেখে রাজের মতিগতি ভালোনা।রাজ ঘুমুঘুমু অবস্থায় রুদ্রের দিকে এগিয়ে আসছে আর বলছে,”মাই কিউট গুলুমুলু কুটুকুটু মায়াবতী বউ।আই নিড অ্যা বেড কিস মায়াবতী।”
রাজ রাতের বেলা যে কোলবালিশ মাঝখানে রেখেছিল ওটা এখন নেই।কারণ ওটা এখন বিছানার নিচে।যেটা রাজ নিজেই লাথি মেরে নিচে সরিয়ে তার বউয়ের কাছে যেতে চায়।মায়া ভেবে ভুল করে যে রুদ্রের দিকে এগিয়ে আসছে এটা রাজ গুণক্ষরেও আন্দাজ করতে পারছে না।বেচারা রুদ্র বোঝা মাত্রই উঠে দিলো এক চিৎকার।রুদ্রের চিৎকার শুনে ঘরের সবাই লাফ দিয়ে উঠেছে।কয়েকজন তো দৌড়ে হাজির হলো রাজের ঘরের কাছে।মায়াও আছে তাদের সাথে।রুদ্র রাজের দিকে চোখ বড়বড় করে বলে,”আই সোয়ার আমি আর কখনও তোমার মত বউ পাগলার পাশে ঘুমাবো না।ইউ আর ভেরি ডেঞ্জারাস ব্রো।বউ ভেবে ভাইকে চুমু দিতে আসো!ইয়াক।”
মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ৪৭+৪৮
রুদ্র গা ঝাড়া দিয়ে বিছানা থেকে নামে। দুর্ভাগ্যবশত এখানে মাহমুদ সরদার আর আহান সরদার এসেছিলেন ছেলেদের কি বিপদ হয়েছে এটা দেখতে।এখানে এসে তারা শিখলেন সব ধরণের বিপদে তাদের থাকাটা মানায় না।বাবা হলেই যে সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা করে এগিয়ে আসতে হবে এটা কোনো বাধ্যবাধকতা না।এতে বরং বাবা হয়ে নিজেকেই বিবৃতিকর পরিস্থিতিতে যুক্ত করা।মান সম্মান লুটে যাওয়ার আগে বউমা ও কন্যাদের পিছন থেকে কেটে পড়লেন দুই বাবা।
