মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ৬৩+৬৪
ইশরাত জাহান
গাড়ি চালাতে চালাতে জারা ভাবান্তর হয়ে বলে,”তুমি শিওর এটা বয়েস গ্রুপ করেছে?”
“ওয়ান হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর আমি।আমি সেদিন ল্যাপটপ বন্ধ করে মন্ত্রী মশাইয়ের পাশে তাকাতে নেই কিন্তু ভুলবশত আমি ল্যাপটপ বন্ধ করিনি।শশুর শাশুড়ি ঝগড়া করছিল বিধায় আমি সেদিকে মাইন্ড টার্গেট করি।এটার সুযোগ নিয়েছে কেউ।নাহলে আমার ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড ব্যতীত ইনফরমেশন নিয়ে ওরা সোনালীকে খুঁজে বের করতে পারত না।”
“কিন্তু আমার কথা হলো সোনালীকে দিয়ে ওদের কি প্রয়োজন?”
“আমি জানতে পারলে তো হতই।”
তাজ ঘুমিয়ে পড়েছে।রুবির কাধে তাজের মাথাটা রাখা।মায়া হাসফাঁস করতে করতে যখন চোখটা চারপাশ আওড়িয়ে পিছনে রাখে দেখতে পায় এই দৃশ্য।রুবির চোখের দিকে তাকালো মায়া।রুবির দৃষ্টিতে ভালোলাগা কাজ করছে।মিহির রূপে এই তাজকে কি রুবি ভালোবাসে?যদিও ভালোবাসে তাহলে কাকে ভালোবাসে?মিহিরের রূপকে নাকি তাজের ব্যবহারকে?জানতে হবে মায়াকে।তাজকে অনেকটা পরিবর্তন হতে দেখেছে মায়া।একজন প্রতিবন্ধী ছেলেকে পরিপূর্ণ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।তারউপর যতটুকু পারে নিজের কন্ট্রোলে রাখা সম্ভব ওটাই অনেক।ইদানিং তাজের মাঝে এই লক্ষণ দেখা যায়।সে রুবির আশেপাশে ঘুরতে ভালোবাসে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এমনিতেও মায়া আর জারা গেলে অনেক গল্প করে কিন্তু রুবির হাতে খেতে ভালোবাসে।আড়ালে দেখেছে রুবি কি সুন্দর করে তাজকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বের হয়।বলতে গেলে এই ব্যাস্ত সময়ে তাজের জীবনে রুবির অবদান অনেক।এগুলোর কারণে একজন তাজ নিজেও আস্থা পায় রুবিকে পেলে।দুজনের মাঝে আলাদা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তবে সেটা অপ্রকাশ্য।সরদার মহলের সামনে গাড়ি থামালো জারা।মায়া নেমে বাইরে দাঁড়িয়ে একটু নিশ্বাস নিলো।জারা দেখছে মায়াকে।রুবি মহলের দরজার দিকে চোখ রেখে তাজের দিকে চোখ রাখে।তাজ ঘুমিয়ে পড়েছে।তাজের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে ডাক দেয়,”তাজ?”
তাজ গভীর ঘুমে।রুবি ধৈর্য সহকারে ডাক দিচ্ছে।বেশি জোরে ডাকা যাবেনা।এমনিতেই মানসিক রোগী তাজ ঘুমের মাঝে জোরে শব্দ করে জাগিয়ে দিকে অথবা আঘাত দিয়ে কথা বললে আরো বেশি মানসিক দুর্বল হবে।ডাক্তার সার্জারির পর এই সমস্ত ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে সবাইকে।রুবি যখন দেখলো তাজের ঘুম ভাঙ্গবে না তখন মায়াদের দিকে তাকালো।ওরা অন্যদিকে ফিরে আছে।সুযোগ বুঝে তাজের পিঠে আঙুল দিয়ে সুড়সুড়ি দেয়।তাজ ঘুমের মাঝে হেঁসে দেয়।রুবি আরো বেশি সুড়সুড়ি দিতেই তাজ উঠে বসে আর হাসতে থাকে। হাঁসি থামতেই রুবি বলে,”আমরা চলে এসেছি।”
রুবি বের হতেই তাজ বের হয়। হাঁসি হাঁসি মুখে যেই সরদার মহলের দিকে চোখ রাখে তাজের মধ্যে অন্যরকম মুখভঙ্গি দেখে যায়।রুবি যখন তাজের হাত ধরে এগিয়ে যেতে নেয় তাজ হাত সরিয়ে বলে,”আমি এই বাড়িতে যাবো না।এটা পঁচা বাড়ি।আমি মন্ত্রী ভাইকে বলে দিব সবকিছু।আমি এখানে যাবো না।এখানে গেলে আমাকে ওরা চাবুক দিয়ে মারবে।মন্ত্রী ভাইয়ের মায়াবতীকে মারতে বলে।না মারলেই আমাকে মেরে না খাইয়ে রাখে।আমি যাব না ওখানে।”
মায়া দীর্ঘশ্বাস নিলো। তাজ ভেবে রাজকে ভুল বুঝেছিল।এটা তো হবারই ছিলো।ওই সময় চোখের সামনে যেটা ঘটেছে সেটাই বিশ্বাস করেছে।সত্যিটা জানার জন্য তেমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।যেটা আমাদের অনেকেরই নেই।এই যে রাজ কিছু না করেও মিথ্যার আড়ালে চাপা পড়ে রাজ ছিলো মায়ার চোখে আসামী।তাজ সবকিছু করলেও সে ছিলো নিজের জীবনের দায়ে পরিস্থিতির শিকার।এই লুকোচুরি খেলার মাঝে মায়ার নজর থেকে অনেক কিছুই আড়াল হয়ে ছিলো।এখন মায়া নিজের মত করে খেলছে।যেনো যারা তাকে চোখে আঙুল দিয়ে অন্যকিছু বুঝিয়ে দেয় আজ সেও তাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে অন্যকিছু বুঝিয়ে দিবে।মুখে এক ঝলক হাসি ফুটিয়ে মায়া এগিয়ে এসে বলে,”আমি থাকতে তোমাকে কেউ কিছু করতে পারবে না।সবকিছু আমি দেখে নিবো।তুমি আমার মন্ত্রী মশাইয়ের কলিজার টুকরো।তার গায়ে আঘাত লাগতে দিবো না আমি।”
“যদি ওরা আমাকে আবারও বকা দেয়?”
“আমাকে বলে দিবে।”
রুবি বলে ওঠে,”তাছাড়া তুমি তো সবার সামনে মিহির।তোমার না মুখ পাল্টেছে।তাহলে ভয় পাচ্ছো কেন?”
“এই মুখ দেখলে কেউ মারবে না?”
“না।”
“এটা আবার কেমন কথা!এই মুখ দেখে কেউ মারেনা কেন?”
“কারণ এটা একটা শয়তানের মুখ তাই।”
“তোমরা আমাকে শয়তানের মুখ দিয়েছো কেন?”
এবার তাজ কান্না করে দিলো।লাফাতে লাফাতে বলে,”আমি শয়তানের মুখ রাখব না।আমি এখনই হাসপাতালে গিয়ে মন্ত্রী ভাইয়ের মুখটা নিয়ে আসব।”
“আরে আরে হাসপাতালে গেলেই কি মুখ পরিবর্তন করে?এটা কি এতই সহজ!তোমার মুখ থেতলে যায় বলেই সার্জারি করা হয়।একটা সেম্পোল হিসেবে আমরা তখন মিহিরের রূপ দিয়েছি শুধু।তাছাড়া এখন তুমি যেখানে খুশি যেতে পারবে যা খুশি করতে পারবে।সবার থেকে ভালোবাসা পাবে।পরিবারের কাছে থাকবে।তোমার মা ভাই আরো অনেকে আছে।”
তাজ এখনও হাউমাউ করে কান্না করছে।এদিকে রাজের গাড়ি এসে থামে।রাজ জানালা দিয়ে দেখছে মিহির রূপে তাজের কান্না।অবাক হয়ে বলে,”এই মালটার আবার কি হলো?”
রুদ্র মৃদু হেঁসে বলে,”সরদার মহলের একেকজনের কমেডি দেখতে দেখতে এর মনে হয় ঘিলু নড়বড়ে হয়ে গেছে।”
বীর সন্দিহান হয়ে বলে,”এমনও হতে পারে রাজের মার খেয়ে ওর স্মৃতি সত্যিই হারিয়ে গেছে।যেভাবে মুখে আর মাথায় কিল ঘুষি দিয়েছিলো তাতে সুস্থতা কামনা করে কিভাবে?”
“এই ব্যাটা নাটক করছে না তো?”
রুদ্র সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে বলে,”দেখে তো মনে হয়না।”
তাজ কান্না করতে করতে পিছনে ফিরে রাজকে দেখে বলে,”ওই তো আমার মন্ত্রী ভাই এসেছে।”
বলতে না বলতেই রুবি হাত দিয়ে তাজের মুখ চেপে ধরে বলে,”আমাদের মারবে নাকি?এখন চুপ থাকো।তুমি মিহির সরদার কোনো তাজ ফাজ না।”
মন্ত্রী ভাই শব্দটা রাজের কর্নিশে বাড়ি দিচ্ছে।আশেপাশে তাকালো।কারণ তাজ যখন খুশি হয়ে মন্ত্রী ভাই উচ্চারণ করে তখন রাজের চোখ গাড়ির দরজা বন্ধ করার দিকে থাকে।মন্ত্রী ভাই শব্দটা শুনেই রাজ যেনো কেমন দুর্বল হয়ে পড়ে।আশেপাশে ঘুরে খুঁজছে তাজকে।চোখটা চিকচিক করছে রাজের।তার দুর্বলতা তার পরিবার।তার ভাই তার আরেকটা দুর্বলতা যেমন তার মায়াবতী তার জীবনের এক দুর্বলতা।মাঝে মাঝে রাজ ফিচেল হেঁসে নিজের কপাল চাপড়ায়।এই ক্ষমতাশীল মন্ত্রীর জীবনেও একাধিক দুর্বলতা।প্রথমত তার বাবা তারপর মায়াবতী আর আছে তাজ।বাকিরাও তার কাছের কিন্তু রাজের অস্তিত্ব যেনো এরাই।অন্যান্য ব্যক্তিদের গাড়ি আসলো সাথে সাথে। বিভান খান বের হয়ে বলেন,”তোমরা বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?”
রুদ্র মজা করে বলে,”ফ্রেশ বাতাস উপভোগ করছি।আপনিও চাইলে উপভোগ করতে পারেন।এটা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো।”
বিভান খান ভ্রুকুটি করে বলেন,”বর বউ নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে এভাবে ফ্রেশ বাতাস উপভোগ করা এটা আবার কেমন কাজ?”
“ইউনিক কাজ আংকেল আপনি বুঝবেন না।সরদার মহলে তো কখনও থাকেননি তাই জানেননা আমরা কত ইউনিক কাজ করে থাকি।সবথেকে বেশি আমরা বর বউ নিয়েই করে থাকি।আপনি চাইলে আপনাদের নিয়েও এমন ইউনিক কিছু করে দেখাতে পারি।”
“নট ইন্টারেস্টেড।”
মায়া একবার রাজের দিকে চোখ রেখে বিরক্ত প্রকাশ করে ভিতরে ঢুকলো।মাহমুদ সরদার এগিয়ে এসে রাজকে বলেন,”আবার কোন অঘটন ঘটিয়েছো?”
“যেখানে অঘটন ঘটেই আছে সেখানে আমি আবার নতুন করে কি ঘটাবো!”
“তুমি মানেই তো অঘটন।”
“এই জন্যই তো আমি দেশে না থাকাকালীন তোমার আর তোমার ভাইয়ের দুই নাম্বার বউগুলো মিলে আমার একমাত্র অবলা বউকে শাশুড়ি সমেত বাড়ি থেকে বের করে দেয়।একটামাত্র অবলা বউ জুটতো আমার কপালে কিন্তু তোমার দুই নাম্বার বউয়ের যন্ত্রণায় আমার বউটা পরিবর্তন হয়ে এতই হিংস্র যে আমি নিজেই মাঝেমাঝে মাইনকার চিপায় ফাইসা যাই।”
“তোমার যে ব্যবহার তাতে এমন বউ প্রয়োজন।”
“ভুল বললে বাবা।সঠিক সময়ে বউ থাকলে এই ব্যবহার পেতে না বরং আমাকে একটা জুনিয়র নিয়ে আদর্শ বাবা হতে দেখতে।”
“এখন হাত পা বেঁধে রেখেছে কে?”
“হাত পা বাঁধা নেই বলেই তো বাবা হবার সুখবর দিতে পারলাম এখন।”
“উদ্ধার করেছো এখন যাও সামনে থেকে।”
“তোমার কি মনে হয় অত সুন্দর বউ রেখে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে মশার কাপড় খাবো?কখনোই না।আমি গেলাম এখান থেকে।তুমি ভাবো রাতে কোথায় থাকবে।কারণ তোমাকে তো আর ঘরে জায়গা দিচ্ছে না তোমার দুই নাম্বার বউ।”
মাহমুদ সরদার রক্তিম দৃষ্টি দিলেন।রাজ টেডি হাঁসি দিয়ে বলে,”আমি একটা কথা খুব ভাবী জানো তো বাবা।”
“কি কথা?”
“পুরুষ মানুষ দ্বিতীয় বিয়ে করে সুখে থাকার জন্য আর তুমি কি না আমার বাবা হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেই জীবনকে তেজপাতা করে দিলে!পুরুষ জাতির মান ইজ্জত খেয়ে দিলে বাবা।”
“তুমি যদি এখান থেকে না যাও তাহলে এই বাবা হবার মুহূর্তে আমার কাছে খাবে চাপকে একটা থাবা।”
রাজ পাত্তা না দিয়ে ভিতরে চলে যায়।সবাই সেখানে বসে আছ।রাজ সবাইকে দেখে ভ্রুকুটি করে বলে,”ঘরে না গিয়ে এখানে কেন?”
“তোমার ঘরে যাওয়া বন্ধ হয়েগেছে তাই দেখার আনন্দে ব্রো।”
রাজ ভ্রুকুটি করে তাকালো রুদ্রের দিকে।রুদ্র এবার এমন হাঁসি দিলো যেনো সে খুব আনন্দিত এসব দেখে,”তোমার বউ ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে।বাড়ি ছাড়বে এখন।”
“এ কোন জ্বালা!একটু রাগ করলেই কেন বাড়ি ছেড়ে যেতে চায় সকল বউরা?”
মায়া ল্যাকেজ নিয়ে নিচে আসে।রাজ সেদিকে তাকিয়ে বলে,”কোথায় যাচ্ছো?”
“যেদিকে ইচ্ছা যাবো।আপনাকে বলব না।”
“সে না বলো আমার কিছু পাঞ্জাবি নিয়েছো তো?সাথে করে টি শার্ট আর আমার কিছু ব্যবহারের প্রোডাক্ট।”
“আপনার জিনিসপত্র আমি নিবো কোন দুঃখে?”
“কারণ তুমি যেদিকে যাবে আমিও তো সেদিকে যাবো।”
“আমি জাহান্নামে যাচ্ছি।”
“যেখানে আছো সেখান থেকে আবার একই স্থানে পদান্তর করার কোনো মানে হয়?”
মাহমুদ সরদার গলা উঁচিয়ে বলেন,”তোমার কি এই জায়গাটা জাহান্নাম বলে মনে হয়?”
“তুমি বুঝি জান্নাতের বাতাস উপভোগ করছো বাবা।নিজের ঘরে যাওনা একটু।দেখি কেমন জান্নাত উপভোগ করো।”
মাহমুদ সরদার একবার মালিনীর দিকে চেয়ে চুপ হয়ে গেলেন।ছেলে তার ইজ্জতে হাত দিয়েছে।বেশি মুখ ফোটানো সম্ভব নয়।তার মুখ ফোটার আগেই ছেলের বোমা ফাটে।মায়া আড়চোখে জারাকে ইঙ্গিত করে বেরিয়ে যেতে নেয়।রাজ হাত ধরে পথ আটকে বলে,”রাগ হবে অভিমান হবে সেটা নিয়ে একঘরে বোঝাপড়া হবে।এভাবে ঘর ছাড়ার চেষ্টা করবে না।”
“করলে কি করবেন?”
মায়ার চোখে রাগ সাথে রাজেরও।সবাই দুজনের দিকে চেয়ে আছে।এখনই কি বোম ফাটবে নাকি?মায়ার প্রশ্নে রাজ ক্ষণিকের নিশ্চুপ থাকলেও পরে মুচকি হেঁসে মায়ার কানেকানে বলে,”দ্বিতীয়বার বাবা হবার প্রোসেসিং শুরু করে রাগ ভাঙিয়ে দিবো।”
মায়া চোখ বড়বড় করে তাকালো।কেউ শুনতে পায়নি কিন্তু সবাই মায়ার রিয়েকশন দেখে ভাবলো রাজ কোনো ভালো কথা বলেনি বরং মায়াকে রাগিয়ে দেওয়ার মতোই কিছু বলেছে।মায়া দূরে সরে বলে,”আমি আপনার সাথে এক ঘরে থাকবোই না।আজকের দিনটা সুযোগ দিলাম।আমাকে সবকিছু জানালে অনেক ভেবে চিন্তে ফেরত আসবো নাহলে না।”
রাজ কিছু বলতে নিবে মাহমুদ সরদার বলেন,”এভাবে অভিমান না করে তোমরা আলাদা একটু কথা বলে নেও।দুজনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করা দরকার।”
রাজ ও মালিনী তাকালো মাহমুদ সরদারের দিকে।দুজনের চাহনি দিয়ে মাহমুদ সরদার বিরক্তবোধ করে সোফায় বসেন।মায়া বলে ওঠে,”আপনার ছেলে আমার পিছনে পিছনে ষড়যন্ত্র করেছে বাবা।আমার জীবনের সবথেকে বড় ক্ষতি আপনার ছেলে করে দিলো।কাজটা করবার আগে আমার সাথে তো আলাপ করেনি।”
“সেই পরিস্থিতি আমাদের মধ্যে ছিলো না মায়াবতী।না আমি সঠিক সময় পাচ্ছি আর না তুমি আমাকে সঠিকভাবে কিছু জানিয়ে রেখেছো।দোষ একপাক্ষিক না এখানে দুজনেরই আছে।”
“কি ঘটেছে তোমাদের মধ্যে?”
বিভান খানের কথা শুনে চুপ হয়েগেলো সবাই।মায়া জোরেজোরে নিশ্বাস নিয়ে মাহমুদ সরদারের উদ্দেশ্যে বলে,”আপনার ছেলে যেটা করেছে তারপর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার সাথে এক ঘরে আমি থাকবো না।একঘরে না থাকা মানে তো বাড়ি ত্যাগ করা।বোন চল আমার সাথে।”
মৌকে কথাটা বললেও মাহমুদ সরদার বলেন,”এক ঘরে থাকবে না ভালো কথা কিন্তু বাড়ি থেকে যেও না।তোমার অবস্থা ভালো না।”
রাজ চোখ বড়বড় করে দেখছে দুজনকে।মাহমুদ সরদার এবার মৃদু হেঁসে রাজের দিকে তাকিয়ে মায়ার উদ্দেশে বলেন,”তুমি যতদিন চাও অন্য ঘরটায় থাকতে পারো।রু মানে মোহনার সাথে এক ঘরে থাকবে।”
মায়া একটু ভেবে বলে,”আজকের রাতটার জন্য থাকবো।কাল সকালের মধ্যে আপনার ছেলের থেকে যদি আমি আমার উত্তর না পাই আমিও থাকবো না এই বাড়িতে।”
বলে রুবির দিকে ইশারা করে ল্যাকেজ নিয়ে যেতে থাকে।মাঝপথে একটু থেমে ভাবছে বীর যদি জারাকে কিছু প্রশ্ন করে ঝামেলা তৈরি করে?তাই পিছনে ফিরে জারার উদ্দেশ্যে বলে,”তুমিও আমার সাথে আসো।আজকে আমরা গার্লস পার্টি করবো।”
জারা সম্মতি জানিয়ে যেই উঠতে নিবে বীর জারার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মায়ার উদ্দেশ্যে বলে,”রাগারাগি করেছিস তোরা স্বামী স্ত্রী মিলে।এখানে আমার বউকে টানার মানে কি?”
“কারণ তুমিও ওই মন্ত্রীর মতোই।কেউই তাদের বউকে বুঝবে না।শোনো জারা আমার ভাইটাও কিন্তু ওই মন্ত্রীর সঙ্গ নিয়ে চলে।তাই বলে দিচ্ছি সতর্ক থেকো।এরা বয়েস পার্টি মিলে আমাদের শুধু ঘোল খাওয়াতে জানে।ভালোবাসার কথা বলে পিছনে ছুরি ঘোরাবে।”
জারা পড়লো বিপাকে।তার হাতটা ধরে আছে একটা জম।যাকে জারা ভালোবাসে আবার ভয়ও পায়।বীর জারার দিকে ফিরে বলে,”একদম মাথায় উল্টোপাল্টা চিন্তা আনবে না।আমাকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবলে গুলি করে মগজের যত্তসব পোকা আছে সব উড়িয়ে দিবো।”
জারা হতভম্ব হয়ে বলে,”মগজে পোকা থাকে!”
“সে তুমি সময় হলেই দেখতে পাবে।”
বলেই বধূবেশে থাকা জারাকে কোলে নিয়ে চলে যায় বীর।বিভান খান অবাকের সাথে ছেলেকে দেখছে। বীর যেতে যেতে রাজকে বলে,”বউকে হিংস্র বানাতে চেয়েছিলিস ভালো কথা।এবার তোর সংসার তুই সামলা।তোর বউ যেনো আমার বউকে না টানে।”
“আব্বে শালা বউ আমার হলেও বোন তোর।শিক্ষা তো তুই দিয়েছিস।এখন ভোগ কর, বোঝ কেমন লাগে যখন বউ সামনে দিয়ে ছুরি চালায়।”
“আমারটা সেই সুযোগ পাচ্ছে না।তাই আমি ভোগ করছি না।”
বলেই দরজা লাগিয়ে দেয় বীর।মায়া ওদের কথায় মাথা না ঘামিয়ে চলে যেতে নেয় রুবির ঘরের দিকে।রাজ লম্বা কদম ফেলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে মায়ার সামনে দাঁড়ালো।মায়া কিছু না বলে আবারও রাজকে তোয়াক্কা না করে রুবির ঘরের দিকে যেতে নেয়।রাজ চোখ বড়বড় করে মায়াকে দেখে নিয়ে ল্যাকেজে দিলো লাথি।বেচারা ল্যাকেজ দূরে ছিটকে গেলো।আজ তার জীবন নেই বলে কান্না করতে পারল না।মায়া কিছু বলতে নিবে রাজ সেই সুযোগ না দিয়ে মায়াকে পাঁজাকোলা করে নিজের ঘরে নিয়ে যায়।এই দৃশ্য দেখে যে যার ঘরে যেতে নেয়।রুদ্র এসে মাহমুদ সরদারকে দেখে বলে,”এই দুই ভাইকে দেখে তুমি কিছু শিখতে পারো বড় বাবা।”
মাহমুদ সরদার ভ্রুকুটি করে তাকালেন।রুদ্র হেঁসে দিয়ে বলে,”বউ রাগ করলে কিন্তু ঝগড়া নয় বউকে কোলে নিয়ে ঘরে যেতে হয়।”
মাহমুদ সরদার রাগী দৃষ্টিতে তাকালেন।রুদ্র ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলে,”না মানে চোখের সামনে যেমন দৃশ্য দেখবো তেমনটাই তো ব্রেনে বুঝ দিবো।একদিক থেকে কিন্তু আমি ঠিকই বলেছি।ব্রো দুজনে বউদের নিয়ে স্ট্রেট থাকে বলেই কিন্তু তাদের ঝামেলা বেশিক্ষণ থাকেনা।”
বলেই রুদ্র চলে যায় শীষ বাজিয়ে।মাহমুদ সরদার তাকালেন মালিনীর দিকে।মালিনী কোনো কথা না বলে ঘরে চলে গেলো।
মায়াকে ঘরে এনে রাজ দরজা দিতেই একটু থেমে গেলো।মায়ার পিছনে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিনমিন করে বলে,”শালার যেদিকে যাবো সেদিকেই সিসি ক্যামেরা।আমার বেডরুমটাও ছাড়লো না।”
মায়া এসে রাজকে ধাক্কা দিয়ে বলে,”আপনি সোনা….
বলতে দিলো না রাজ।মায়ার ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে বলে,”চুপ করো মায়াবতী।”
মায়ার রাগ বাড়ছে।সে হুংকার দিয়ে বলে,”এখন আবার চুপ করতে বলছেন কেন?”
“বাথরুমে চলো।”
মায়া পারলে এখন রাজকে খুন করে দেয়।এই অসময়ে সে বাথরুম বিলাস নিয়ে ভাবছে!মায়া রাগে গজগজ করে বলে,”আপনার বাথরুম বিলাস লেগেই থাকে?ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমি আপনার ওই মস্তিষ্কের মত চলি না।”
“ইটস ইম্পর্ট্যান্ট মায়াবতী।তাড়াতাড়ি বাথরূমে চলো।”
মায়া রেগে যাচ্ছে বেশি বেশি।রাজ যে সিসি ক্যামেরা দেখেছে এটা বোঝাতে পারছে না।এদিকে নিজ মুখে বলতেও পারবে না।বললেই ওপাশের ব্যক্তি সব ধরে নিবে।মায়া রাগে গজগজ করতে করতে একটা গ্লাস ভাঙলো।অতঃপর ফুলদানি নিয়ে যেই ভাঙতে নিবে রাজ এগিয়ে এসে মায়ার হাত ধরে বলে,”ভাংচুর করে কিছু হবেনা বাথরুমে চলো দ্রুত।ওটাই আমাদের সুখের স্থান।”
“শাট আপ!”
চিৎকার করে বলে মায়া।রাজ বুঝলো তার বউ ক্ষেপেছে।এখন মুখে বলে কাজ হবেনা তাই মায়াকে কোলে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে।আশেপাশে তাকিয়ে নিখুঁতভাবে সবকিছু দেখছে।এদিকে মায়া ছোটাছুটি করছে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য।মায়ার বড়বড় নখগুলো রাজের গলায় ফুটছে। ছোপ ছোপ রক্ত দেখা দিলো রাজের গলার কাছে।মায়া রেগে আগুন।রাজ যখন দেখলো এখানে সিসি ক্যামেরা নেই শান্তিতে নিশ্বাস নিয়ে বাথরুমের দরজা লাগিয়ে দেয়।মায়া তখনও রাজকে আঘাত করছে।রাজ এবার মায়ার দিকে চোখ রেখে গলার দিকে তাকালো।শ্যামবর্ণের হওয়ায় গলার দিকে লাল দাগ না হয়ে কালো হয়ে আছে।মায়াকে আচমকা বাথটাবে শুইয়ে দিয়ে তারউপর ঝুঁকে বসে রাজ।মায়া ছটফট করছে।শাসিয়ে বলে,”একেতো আমার মায়ের খুনিকে বাঁচিয়ে রেখে আমাকে আঘাত করেছেন আবার এখন আমার সাথেই রোমান্স করতে চাইছেন?আমি আপনার সাথে থাকবো ভাবলেন কিভাবে?আমি আমার মায়ের খুনিকে শাস্তি দিয়েই ছাড়বো।”
“এতে আমাদেরই ক্ষতি মায়াবতী।”
“মানে?”
“ছোট মা বেঁচে আছে।”
মায়া ভ্রু কুঁচকে দেখছে রাজকে।রাজ আবারও বলে,”ছোট মা বেঁচে আছে কিন্তু তার বেঁচে থাকাটাও ব্যর্থ।কোমায় চলে গেছে পুরোপুরি।এতদিন ধরে শুধু নিশ্বাসের গতি আমরা ভেন্টিলেটর দিয়ে বুঝেছি।এখন একটু হাত পা অল্প স্বল্প নড়ছে।”
“আমার মা বেঁচে আছে?”
মায়ার চোখ বেয়ে পানি।রাজ সেই পানি শুষে নিয়ে বলে,”হুম,ওইদিন রাতে তোমাকে মিথ্যা বলা হয়।আসলে ছোট মা বেঁচে আছে।”
“আমাকে মিথ্যা বলেছে কেন?”
“কারণ ছোট মা চেয়েছে তার মেয়েটা তার অসুস্থ দেহটা দেখে ভেঙ্গে না পড়ে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হিসেবে পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠুক।তার মেয়েকেই তো সবকিছুর বদলা নিতে হবে।তাছাড়া তোমার অবস্থা তখন ভালো ছিল না।এসাইলামে রাখতে হয় কয়েকমাস।সুস্থ হবার পর একটু স্বাভাবিক হলেও আমি ছোট মায়ের কথা রাখতে তোমাকে কিছু জানাতে দেইনি।সকল অপারেশন কমপ্লিট করে তোমাদের মা মেয়েকে এক জায়গায় করতে চেয়েছি।”
“আমি মায়ের কাছে যাবো।”
“আজকে গেলে ধরা পড়ে যাব।তাই কাল সময় করে তুমি আগে বের হবে বাড়ি থেকে তারপর আমি।”
“ধরা পড়ব কেন?”
“আমাদের পিছনে লোক লাগানো আছে।ইনফ্যাক্ট শালারা আমার ঘরেও সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে।বউকে নিয়ে ঘরে এসে যে একটু বিশ্রাম নিবো সেই উপায়ে তালা মারা।এখন দেখছি আমার বাথরুম বিলাসটাই স্বার্থক।সব জায়গা সুরক্ষিত না থাকলেও এই জায়গাটায় সুরক্ষা আছে।”
মায়া এবার হেঁসে দেয়।একটু হেসে আবার বলে,”কিন্তু সোনালীর ব্যাপারটা কি?”
“ছোট মায়ের হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে।এটা আমাদের বিয়ের আগে ধরা পড়েছে।কিন্তু হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।কারণ বডির সাথে ম্যাচিং করা হার্ট প্রয়োজন আর একেবারে কোমায় চলে যাওয়ার কারণে তার অপারেশন করার উপায় নেই।এতে করে রোগী মারা যেতে পারে।এমনিতেও রিস্কে আছে ছোটমা কিন্তু ওই অবস্থায় হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করলে ঝুঁকি অনেক বাড়তো।আমরা অনেক জায়গায় ছোট মায়ের সাথে ম্যাচ করে এমন হার্ট খুঁজি।ভাগ্যবশত সোনালীর হার্ট ম্যাচিং করে।তাই তো সব জেনেও আমরাও চুপ আছি।যেখানে বান্দা সতিনকে হার্ট দিতে গিয়ে ওপারে চলে যাবে সেখানে আমি আর কেন আলাদা কষ্ট করতে যাবো?”
“এখন সোনালী কোথায়?”
“বৈদ্যুতিক শক নিয়ে ভুগছে।”
বলেই ফোন বের করে দেখালো মায়াকে।ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে আদ্র ও কিছু লোক মিলে সোনালীর মস্তিষ্কে ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে।সোনালী ছটফট করছে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এখন যন্ত্রণা ভোগ করছে।মায়া খুশিতে আত্মহারা হয়ে রাজকে জড়িয়ে রাজের গালে চুমু দিয়ে বলে,”আপনি তো দেখছি আমার থেকেও বড় খিলাড়ি মন্ত্রী মশাই।”
“কারণ এই খেলার সমস্ত প্ল্যান আমি আগে থেকেই সাজিয়েছি যে।”
“কিন্তু ভাই কি বিভান খান আর সোনালীর ব্যাপারে কিছু জানে?”
“উহু।”
“বলবেন?”
“না,সঠিক সময়ে প্রমাণ নিয়ে জানাবো।আগে আমার শাশুরির হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট ভালোভাবে হয়ে যাক।তারপর বিভান খানের পালা।”
মায়া মাথা উপর নিচ করে হেঁসে দিলো।রাজ মায়ার কপালে চুমু দিয়ে বলে,”এখন শুরু করে দেই?”
“কি?”
“বাথরুম বিলাস।”
“আমাদের সন্তান আছে ওখানে মন্ত্রী মশাই।”
মায়ার পেটের দিকে ইঙ্গিত করে বলে মায়া।রাজ নিচু হয়ে মায়ার পেটে চুমু দিয়ে বলে,”আমার বংশের প্রদ্বীপ।আমাদের জীবনকে নতুনরূপে আলোকিত করতে আসছে।আগমনের আগেই আমাদের জীবনের সমস্ত আপদ দূর করে দিচ্ছে।”
রাজের কথা শুনে মায়া মৃদু হেঁসে বলে,”আমিও আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ রেখেছি মন্ত্রী মশাই।”
“কি সারপ্রাইজ?”
“তাজ বেঁচে আছে।”
রাজ অবাকের সাথে একটু ভাবতে থাকে। অতঃপর কি যেন ভেবে আন্দাজে বলেই দেয়,”মিহির কি তাহলে আমার?”
মায়া মাথাটা উপর নিচে করে।রাজ প্রশ্ন করে,”কিভাবে কি?”
“সেদিন যখন তাজকে কিডন্যাপ করা হয়, আমাকেই সবার আগে জানানো হয়।আপনি সেদিন ব্যাস্ত ছিলেন।আমি অনেক আগে গেলেও আমার স্পাইম্যান আড়ালেই ছিলো।যাকে কেউ দেখতে পায়নি।আমাকে অনেক আগেই জানিয়ে রাখে গাড়িটা বান্দরবানের দিকে যাচ্ছে।যেখানে খাদ আছে।মানুষ ওখান থেকে পড়ে গেলে তাকে খুঁজে পায়না,সে যতই নামকরা হোক।অনেক ভেবেই আমি জারাকে দিয়ে ওখানে জারার মাধ্যমে কিছু উদ্ধারকারী পাঠাই।কারণ আমাদের সন্দেহ হয় ওরা নিজেদের বাঁচাতে ওই খাদ ব্যবহার করতে পারে।আমাদের সন্দেহ একদম মিলে যায়।আমরাও অভিনয় করতে থাকি।নাহলে আরশাদের লোক অন্যভাবে হলেও তাজের ক্ষতি করতো।তাই ওদের ফার্স্ট মিশনকে আমরা সুযোগ দেই।নিচে সমস্ত ফোর্স থাকলেও তাজ নিচে পড়ে গিয়ে মুখে বেশ জোরে আঘাত পায়।
তাজের মুখ থেতলে যায়।রুবি আর স্পাইম্যান মিলে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।জারা আর আমি আহত।এরপর জানানো হয় তাজের সার্জারি করা হবে।আমি কয়েকদিন হাসপাতালে অসুস্থ হবার অভিনয় করি যেন মিহির আর সোনালীর প্ল্যান জানতে পারি।মিহির বোকামি করে আমার দিকে ঝুঁকে আসে।রুবি হেল্প না করলে এটা জানতে পারতাম না।আমরাও টার্গেট করি মিহিরকে নিয়েই গেম স্টার্ট করবো।যাকে নিয়ে আমাদের গেম স্টার্ট হবে তাকে শেষ করে দিবো।হয়েছেও তাই।আমরা বড় সার্জেন্ট দিয়ে তাজকে মিহিরের রূপ দেওয়াই।আর মিহির এখন এই পৃথিবীতে নেই মন্ত্রী মশাই।সেদিন রাতেই ওকে আপনি আহত করবার পর মোহন সরদার মিহিরকে নিয়ে যায়।এম্বুলেন্সে অজ্ঞান হয়ে যায় মোহন সরদার শরবত খেয়েছিল তাই।ওই সুযোগে জারার গ্যাংয়ের একজন যে ওয়ার্ড বয় হয়ে কাজ করেছিল সে মিহিরের শরীরে বিষ ইনজেক্ট করে।যার কারণে ওই রাতেই বেচারা ইজিলি ওপারে চলে গেছে।আমরা তাজকে নিয়ে এসেছি কারণ যে কষ্ট আমি বিভান খানের চক্রান্তে পেয়েছি সেই কষ্ট এবার তাজকে দিয়েই বিভান খানকে দেওয়াবো তাই।”
“মায়াবতীর সমস্ত ইচ্ছাতে তার মন্ত্রী মশাই সমর্থন জানায়।”
“আমার আর ধৈর্য ধরতে ইচ্ছা করছে না মন্ত্রী মশাই।আমি মাকে দেখতে চাই।”
“আর তো কয়েক ঘণ্টা মায়াবতী।এরপর সকাল হলেই যাবে দেখতে।এখন একটু মান অভিমানের অভিনয় করে পাশের ঘরে চলে যাও নাহলে মামা সব বুঝে যাবে।”
“অপারেশন কবে?”
“আদ্র ভালো জানে এই ব্যাপারে।সোনালীর কিছু ডকুমেন্ট আছে যেগুলো কাল নিয়ে যেতে হবে।ওগুলো রুদ্র অনেক আগেই নিয়েছে।শুধু ওগুলো দিয়ে একটা পেপার তৈরি করে সোনালীর টিপসই লাগবে।যেখানে উল্লেখিত থাকবে সোনালী নির্দ্বিধায় নিজের হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করতে রাজি।”
“ইউ আর সো গ্রেট মন্ত্রী মশাই।আপনি আমার সব ইচ্ছাকে কত সহজেই পূরণ করে দিচ্ছেন।”
মায়ার হাতে চুমু দিয়ে রাজ বলে,”তুমি বলেছিলে একটা ছোট্ট ইচ্ছার কথা, আর আমি ভাবছি তোমার পুরো জীবনটাকেই পরিপূর্ণ করবার কথা।”
কথাটুকু বলে রাজ উঠে দাঁড়ায়।বাইরে বের হতে হতে বলে,”আবার নাটক করতে হবে এখন।”
বাইরে এসে আলমারি থেকে নীল রঙের শাড়ি ও নিজের জন্য পাঞ্জাবি নিয়ে ওয়াশরুমের মধ্যে গিয়ে মায়াকে শাড়ি দিয়ে নিজেও চেঞ্জ করে আবারও বাইরে এসে বলে,”জীবনে নারীদের কত যে রঙ্গ দেখবো এটা অগ্রিম জানার খুব ইচ্ছা হয় আমার।”
মায়া শাড়ি পাল্টে এসে রাজকে আলতো ধাক্কা দিয়ে অভিনয় করে বলে,”আপনি আমাকে কি পেয়েছেন?যখন ইচ্ছা হবে কাছে টানবেন যখন ইচ্ছা হবে পিছনে ছুরি চালাবেন?এগুলো চলবে না।”
মায়া রাগের অভিনয় করে চলে যেতে নিলে রাজ হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,”আব্বে এই মায়াবতী!শাহমীর রাজ কখনও কারো পিছনে ছুরি চালায় না সোজা সামনে থেকেই চালায়।তবে আমাকে পিছন থেকে কেউ আঘাত করতে আসলে পাল্টা আঘাত ঘুরে তার দিকেই চলে যায়।”
মায়া ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে ক্যামেরার উল্টো দিকে হয়ে বলে,”তাহলে দেখাই যাক খেলা কতটা জমে।মন্ত্রীর এই পাল্টা আঘাতটা নাহয় নিজ চোখে দেখেই নিবো।”
“জো হুকুম মেরি রানী।”
মায়া চলে গেলো।রাজ যেতে বলেছিল তাকে। সিসি ক্যামেরার সামনে বেশি অভিনয় করা সম্ভব না।মায়া এখন মৌয়ের কাছে গেলো।কিছুক্ষণ পর পিয়াশ ঢুকলো রাজের ঘরে।রাজ ভ্রু নাচিয়ে আড়মোড়া দিয়ে বলে,”বসের সাথে ঘুমাতে এসেছো পিয়ু বেবী?”
“আমি নিচে ঘুমাবো স্যার।”
“কেন?”
“আপনি ভোরবেলা বউ ভেবে পাশে যাকে পান তাকে জড়িয়ে ইয়ে খান।আমি সেই ইয়ে খাবো না।”
“ইয়ে মানে?”
“মানে যেটা আগেরবার রুদ্র ভাইকে দিয়েছিলেন নাউজুবিল্লাহ মার্কা ছিল।”
“কেন তুমি কখনও ইয়ে খাওনি যে এতটা ইয়েতে ভয় পাচ্ছো?”
পিয়াশ কথা না বাড়িয়ে সোজা চলে যায় সোফায়।রাজ এবার হেঁসে দেয়।পিয়াশের মুখটা দেখার মত ছিলো।মায়ার থেকে শুনেছে এই ঘরে সিসি ক্যামেরা আছে।বেচারা ভয়তে আছে রাজ যদি ঘুমের ঘোরে তাকে চুমু খায় তাহলে সেটা সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে স্মৃতি হয়ে থাকবে।এই রিস্ক নিতে চায়না। পিয়াশের কাণ্ডে এবার অট্টহাসিতে হেঁসে দেয় রাজ।কথা না বাড়িয়ে সেও লাইট বন্ধ করে ঘুমের প্রস্তুতি নেয়।
সকালের দিকে রাজ নিচে নেমে সবার দিকে চোখ রাখে।সবাইকে দেখার পর তাজের কাছে এসে তাজকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তুই ঠিক আছিস ভাই?”
রুদ্র জুস খেতে নেয়।এহেন দৃশ্য দেখে মুখ থেকে সব পরে যায়।মাহমুদ সরদার আকাশ থেকে পড়লেন।যাকে মেরে স্মৃতি হারিয়ে দিল তার খোঁজ নিচ্ছে রাজ।মোহন সরদার বলে,”নিজেই তো আহত করেছিলে এখন কেন দরদ দেখাচ্ছো?”
“তখন আমার বউ নিয়ে টানাটানি করেছিলো, কিন্তু এখন করছেনা।সময় পাল্টেছে তাই দরদ দেখানো হচ্ছে।”
বিভান খান নিচে আসতেই তাজের মনে পড়ে তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকা করে একটা হাসি উপহার দিতে হবে।রুবির দিকে একবার তাকিয়ে বিভান খানকে দেখিয়ে বাকা হাসি দিলো তাজ।রাজ মৃদু হেসে চলে যায় টেবিলে।সবাই মিলে খেতে বসেছে।মায়া রাগ দেখিয়ে বলে,”আমার খাবারের ইচ্ছা নেই আমি গেলাম।”
রাজ বলে,”যাও যাও,তোমার জন্য কেউ বসে নেই।”
বিভান খান দুজনকে পরখ করেন।তিনি এমনিতেও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে রাতের ঝগড়া দেখেছেন।তাই ধরে নিলেন ওরা দুজনেই ঝগড়া করে আছে।সোনালীর ব্যাপারে এদের হাত নেই।এটাই চেয়েছিল মায়ারাজ।বিভান খানের নাকের ডগা দিয়ে তার গোপন বউকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেওয়া।মায়ারাজ সে কাজে সফল হতে চলেছে।
মিরপুরে রাজের নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট কেনা আছে।এই ফ্ল্যাট পুরোটাই রাজ কিনে নিয়েছে।ফ্ল্যাটটি নয় নম্বর ফ্লোরে।উপড়ে আর
কোনো ফ্ল্যাট নেই।বুঝেশুনেই নিয়েছে এই জায়গাটা।এখানে রাখা হয়েছে শাহানা পারভীনকে।তাকে কোনো হাসপাতালে রাখেনি রাজ।রিস্ক নিবেনা তাই।মায়া এসে আজ অনেক বছর পর মায়ের দেখা পেলো।শাহানা পারভীন ঘুমে বিভোর।মায়া দৌঁড়ে এসে শাহানা পারভীনের হাতটা ধরে মনমত চুমু খেতে থাকে।চোখ দিয়ে পানি ঝরিয়ে বলে,”মা আমার মা।”
আদ্র এক কোনায় দাড়িয়ে মৃদু হেসে বলে,”একজন বাঘিনীকে কান্না করতে দেখা গেলো অবশেষে।”
রাজ এগিয়ে এসে মায়াকে আড়াল করে বলে,”আব্বে ব্যাটা,চোখটা বন্ধ করো।আমার মায়াবতীর অশ্রু গড়িয়ে বিন্দু দেখার অধিকার আমি কাউকে দেইনি।”
মায়া এমনিতেই উল্টোদিক হয়ে আছে বলে মায়ার চোখের পানি দেখতে পায়নি আদ্র।তাও রাজের কথামত বাইরে যাবার আগে বলে,”তোমাকে মায়াবতী বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছে তোমার মন্ত্রী মশাই।ওটা শুধুমাত্র তার অধিকার।তাহলে আমি তোমাকে বাঘিনী বলে ডাকি?”
মায়া উত্তর দেয়না।আদ্র যেতে যেতে বলে,”দাদু কিন্তু তোমাকে বাঘিনী বলেও ডাকত।আমি সেই সুবাদে বাঘিনী চুজ করলাম।”
আদ্র চলে গেলো।মায়া চোখ মুছে শাহানা পারভীনের কপালে হাত রাখে।কপালের উপর কয়েকটা চুমু দিয়ে বলে,”তোমাকে অনেক মিস করেছি মা।তোমার সাথে অনেক গল্প করার আছে আমার।তোমার কোলে মাথা দিয়ে আমি গল্প করতে চাই,তোমার হাতে খেতে চাই,তোমার কাছে ঘুমোতে চাই।তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আমাকে একটু আদর করে দেও মা।তোমার আদরের অভাবে আমি পাগল প্রায়।”
রাজ মায়াকে সামলে বলে,”সব ঠিক হয়ে যাবে মায়াবতী।এতদূর যখন এসেছি আমরা শেষে সফল হবই।”
মায়া তাকালো রাজের দিকে।শাহানা পারভীনের হাতটা বুকের মাঝে নিয়ে বলে,”আমার মাকে আমি ফিরে পেয়েছি।আমি যেন আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার পেয়েছি।আপনি আমাকে এই শ্রেষ্ঠ উপহার দিয়েছেন।আপনি আপনার কথা রেখেছেন।আপনার মায়াবতীর ইচ্ছা প্রতি মুহূর্তে পূরণ করেছেন।কোনো অপূর্ণতা রাখেননি আমার।”
“আর কখনও রাখবও না।”
দুজনেই মৃদু হেসে শাহানা পারভীনের দিকে তাকালো।
কেটে গেলো চারটি মাস।আজ মৌয়ের সিজারের ডেট।সকাল সকাল দুই বোন এসেছে মায়ের সাথে দেখা করতে।শাহানা পারভীনের হাতটা ধরে মায়া বলে,”আজকে তোমার ছোট মেয়ে একটা ছোট্ট শিশুকে পৃথিবীতে আনবে।তোমার নাতি আসতে চলেছে মা।আমি খালামণি হবো আজকে। তুমি আমাদের জন্য দোয়া করে দিও।”
শাহানা পারভীনের হাতটা কেঁপে উঠছে।এটুকুই তার ক্ষমতায় আছে বর্তমানে।আদ্র কতটুকু চেষ্টা করে তাতে করে অনেক উন্নতি হয়েছে।মৌ এসে শাহানা পারভীনের বুকে মাথা রেখে বলে,”আমিও তোমার মত আদর্শ মা হবো।আপু বলেছে তুমি একজন আদর্শ ব্যক্তি ছিলে।তোমার ছোঁয়ায় সবাই প্রফুল্ল হয়ে যেতো।”
“আমাদের মা সবাইকে আগলে রাখতে জানে।কাউকে নিয়ে হিংসা করেনা।”
“আমাদের মত।”
মায়া মাথা দুইদিকে নাড়িয়ে বলে,”একদম না।আমি আমার মায়ের মত মন পেলেও হিংসামিতে আমি অনেক এগিয়ে।আমি আমার স্বামীর আশেপাশে কোনো নারীকে সহ্য করবো না।একজন স্ত্রীর স্থান ধরে রাখতে আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব কিন্তু আমার সংসারের মধ্যে তৃতীয় ব্যাক্তির অস্তিত্ব আসতে নিলে নিজ হাতে আমি উবে দিবো।”
মৌ একটু দুষ্টুমি করে বলে,”যদি জিজুকে কেউ তার দিকে আকর্ষিত করে তখন?”
মায়া রক্তিম চাহনি দেয়।মৌ ভয় পায় কিছুটা।শাহানা পারভীনের বামহাত ধরে রাখার কারণে ওই হাতে চাপ পড়ে।শাহানা পারভীন হয়তো কোমায় থেকেও বুঝেছেন তার দুই মেয়ের মধ্যে আতঙ্কিত কিছু ঘটেছে।মায়া মৌয়ের চোখের দিকে চোখ রেখে বলে,”স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ঠিক ততদিন টিকে থাকে যতদিন তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি না আসে।এক দমকা হাওয়ায় ছুটে এসে যদি কারো আগমণ ঘটে আমার মন্ত্রী মশাইয়ের জীবনে,আমি তার অস্তিত্ব মুছে দিবো।কলিজা টেনে ক্ষত বিক্ষত করে দিবো।এই মায়ার সংসারে কেউ সামান্য বাম হাত ঢোকানোর সাহস রাখেনা আর তো আমার স্বামীকে আকর্ষিত করতে চাওয়া!সেই নারীকে আমি ওইদিন পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ থেকে বহিস্কার করবো।”
মায়ার কর্কশ কন্ঠে শাহানা পারভীনের কানে বারি খেতে থাকে।হয়তো তিনি বুঝতে পারছেন তার মেয়েটা তার জীবনের কষ্ট দেখে অনেক বড় একটা শিক্ষা পেয়েছে।মায়া কথা বলেই শাহানা পারভীনের দিকে চোখ রাখে।ঠোঁট কেমন কাপছে।একটু একটু করে প্রসারিত হতে নেয়।মায়া দেখে বলে,”দেখ বোন আমাদের মা হাসছে।তারমানে আমার এই পদক্ষেপ মা গ্রহণ করেছে।মা চায়না আমি তার মত দুর্বল জীবন কাটাই।তাই তো এতগুলো দিন আমার থেকে দূরে ছিলো।আমাকে সবল বানানোর পিছনে আমার মা কৃতিত্ব রাখে।নিজের জীবনে আসা দুর্ঘটনার কারণে আগে থেকেই সবাইকে সতর্ক করে দেয়।কিভাবে আমাকে বড় করা যায় এই বিষয়ে মা মন্ত্রী মশাইকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো।আসলে মা পাশে থাকলে যেকোনো কিছু সম্ভব।আমার মা আমার আড়ালে আমাকে সবল রাখতে চেষ্টা করেছে।আমি আমার মায়ের এই চেষ্টাকে ধরে রাখবো।আমি দুর্বল হবো না।আমি মায়ের মত স্বামীকে অন্ধ বিশ্বাস করে তার আশেপাশে কোনো নারীর ছায়াও পেরোতে দিবো না।যেই আসবে তাকেই শেষ করে দিবো।তুইও তাই করবি।নাহলে মনে রাখবি এক সময় সুযোগ বুঝে ওরা আমাদেরকে চোখে এক বাইরে আরেক দৃশ্য দেখিয়ে দিবে।বেঁচে থেকেও পুড়তে হবে সেই দৃশ্য দেখে।”
মৌ চোখের পানি মুছে নাক টেনে বলে,”আমি জানি আপু।আমি সেই চেষ্টাই করবো।আমি দেখছি তো তোমাকে এছাড়াও আমি দেখছি মাকে।আমি তো শিখে নিয়েছি সবকিছু।”
“তোমাদের হলো কি?সিজারের সময় হয়ে এসেছে।ডক্টর আসবেন এখন।”
রাজের কথা শুনে দুজনে পিছনে ফিরল।রাজকে দেখে মায়া বলে,”হুম,চলুন মন্ত্রী মশাই।”
মৌ শাহানা পারভীনের কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেলো।সাথে ছিল মায়া রাজ।শাহানা পারভীনের সাথে আছে আয়রা।যাকে দেখে মৃদু হেঁসে মায়া বেরিয়ে পড়লো।গাড়িতে উঠে মায়া নিজের পেটের উপর হাত রাখে।পেটে তার বাচ্চাটা লাথি দিচ্ছে।রাজ থমকে গেলো মায়াকে দেখে।প্রশ্ন ছুঁড়ে,”কি হয়েছে তোমার?”
“আমাদের বাবু পেটে কিক দিচ্ছে।”
“এখনই কি গোল মারতে চাইছে!”
“মন্ত্রী মশাই!”
“আমাদের বাবুটা এত বেশি কিক মারে কেন এটাই তো বুঝিনা।পেটে আছিস পেটেই থাক না বাপ,বেলায় বেলায় কিক মারার কি দরকার।”
“কিছু ইঙ্গিত করছে তাই।”
“আমি বলেছিলাম না ও কিছু ইঙ্গিত করছে।আজ ওর বড় ভাই আসবে তো তাই এমন করছে।”
মায়া চোখ ছোট ছোট করে রাজকে দেখে হাসছে।রাজ লুকিয়ে লুকিয়ে বিভান খানকে না দেখিয়ে মায়ার সেবা নেয়।রাতের আধারে বাড়ির বাইরে যাওয়ার নাম করে সমস্ত লাইট বন্ধ করে মায়ার কাছে চলে আসে।সবাই জানে মায়ারাজ আলাদা ঘরে থাকে।কিন্তু এসবকিছুর পরেও মন্ত্রী মশাই পারবে না তার মায়াবতীর থেকে দূরে থাকতে।একটা না একটা সুযোগ করে সেই নিজের বক্ষেতে মায়াবতীকে আগলে রাখে।বিভান খান আজও খুঁজে পেলো না সোনালীকে।চারপাশে এত লোক লাগিয়েও কোনো সুরাহা হলো না।ইদানিং লক্ষ্য করছে মিহিরের মাঝে অনেক পরিবর্তন।মিহির তাকে পাত্তাই দেয়না।বরং মিহির বেশি বেশি মাহমুদ সরদারের আশেপাশে ঘোরে।একদিন অবশ্য জানিয়েছে,”আমি মাহমুদ সরদারের থেকে এই বাড়ি নিজের করতে তার সাথে সাথে থাকবো।”
ছেলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখে মিহির রূপে তাজকে চলতে দেয়।মোহন সরদার এখন বেকার হয়ে বসে আছে ঘরের এক কোণায়।ব্যবসায় অনুন্নতি হতে হতে এখন ব্যবসাটাই বন্ধ।মাহমুদ সরদার মাঝে মাঝে এসে গল্প করে যান কিন্তু ভালোভাবে তেমন আশা দেন না।কর্মফল ভুগছে ভাই তার।এটাই হবার কথা।ঠিকই হচ্ছে তার সাথে শুধু ভাই বলেই দেখতে কষ্ট।
ওটির সামনে বসে আছে সবাই।পিয়াশ বসে নেই।এই হাঁটছে আর দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছে।দুশ্চিন্তা বাড়ছে মৌয়ের জন্য।শুধু পিয়াশের না মায়ার মনেও দুশ্চিন্তা।হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনতে পায় সবাই।ওটি থেকে বেরিয়ে আসে নার্স।কোলে একটি ফুটফুটে সন্তান। নার্স বলে,”ছেলে সন্তান হয়েছে।”
মাহমুদ সরদার এগিয়ে এসে বাচ্চাটাকে কোলে নেয়।পিয়াশের হাত কাপছে।মায়ার আগেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,”বাচ্চার মা কেমন আছে?”
বোনের প্রতি ভালোবাসা দেখে মায়া মনে মনে খুশি হয়।বড়লোক না হোক বড় মনের কাউকে পেয়েছে বোনের জন্য।এটাই বা কত নারী পায়? নার্স মৃদু হেসে বলে,”উনি এখন ঘুমিয়ে আছেন।রেস্ট প্রয়োজন ওনার।সেলাই করা স্থানে নাড়াচাড়া যেনো না হয় তাই সেভাবেই কিছুক্ষণ রাখা।বাকি ফর্মালিটি আমরা আপনাদের একজনের সাথে কথা বলে জানিয়ে দিবো।”
পিয়াশ এগিয়ে এসে বাচ্চাটাকে দেখে।মাহমুদ সরদার জানান,”আযান দিতে হয় বাচ্চার কানে।”
পিয়াশ এসে বাচ্চার মুখ দেখে নাক ঘষে বাচ্চাটার কপালে।অতঃপর আযান দিলো কানের কাছে মুখ নিয়ে।সবাই এক পলক করে বাচ্চার মুখে দেখে।সবার দেখা হলে আদ্র একটু ভ্রুকুটি করে বাচ্চার মুখ ও আশেপাশের দিকে তাকালো।কিছু একটা হয়তো সন্দেহ করে।ডক্টর হিসেবে কিছু বুঝতে পারল হয়তো।রুদ্র কল দিয়ে জানালো,”পেপার তৈরি হয়েছে ভাই।সরকার থেকে সোনালীর এই ডোনেট নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবেনা।সরকারের কাছে প্রমাণ হয়েছে সোনালী নিজ ইচ্ছায় তার হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করতে রাজি।”
আদ্র আড়ালে এসে রাজকে জানালো।রাজ মৃদু হেঁসে সবার উদ্দেশ্যে বলে,”মিষ্টি মুখ করানো হোক।আমার পিয়ু বেবীর আজ বেবী হয়েছে।পুরো হাসপাতালে মিষ্টি বিতরণ করো।”
পুরো হাসপাতালে জুড়ে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।রাজ ও আদ্র মিলে বের হয় সবার সাথে কথা বলা শেষ করে।ওদের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে ছিল মালিনী।রাজ যখন আদ্রর সাথে কথা বলা শেষ করে মায়া ও মাহমুদ সরদারের সাথে আলাদা কথা বলে তখনই মালিনীর মনে সন্দেহ জাগে।যখনই রাজ বের হয় ঠিক তখনই কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো মালিনী।রাজের গাড়ির পিছনে ফলো করছে।রাজ যে বিল্ডিংয়ের সামনে আসলো মালিনীর গাড়িও সেখানে থামালো।রাজ আর আদ্র উঠতেই মালিনী সেখানে ওঠে।
পুরো ফ্ল্যাট ফাঁকা।রাজের নিজস্ব গুটিকয়েক লোক ব্যতীত কেউ নেই।মালিনী আড়াল হয়ে রাজের দিকে এগিয়ে যায়।একেকটা দেয়াল দেখে সেদিকে গিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখে।রাজ ও আদ্র একটি বেডের সামনে দাঁড়াতেই বেডের পাশে তাকালো মালিনী।ভেন্টিলেটর ও আরো চিকিৎসার যন্ত্রপাতি আছে সেখানে।মালিনী মাথা উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করে কে আছে ওখানে কিন্তু সফল হয়না।হঠাৎ করেই তার পাশ দিয়ে স্ট্রেচারে করে কাউকে নেওয়া হয়।পাশ ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় সোনালীর শরীর।মালিনী চোখ বড়বড় করে সেদিকে তাকালো।কিছু একটা ভেবে আবারও সামনের দিকে চোখ রেখে আবারও সোনালীর দিকে তাকায়।মাথায় কিছুই আসছে না।কি করবে এখন বুঝতে না পেরে ফোনটা হাতে নেয়।কাঙ্খিত নাম্বারে কল দেওয়ার আগেই মালিনীর মাথায় কেউ আঘাত করে।স্ট্রেচার চলে যায় অনেক আগেই।শাহানা পারভীনের পাশে রাখতেই পিছন থেকে একটা শব্দ ভেসে আসে।রাজ ও আদ্র পিছনে ঘুরে তাকাতেই পুরো জায়গাজুড়ে নিজেদের কিছু লোক ছাড়া কাউকে পেলো না।ভুল কিছু শুনেছে ভেবে আবারও কাজে মন দিল।
মালিনীকে নিয়ে আড়ালে যায় মায়া।মালিনী অজ্ঞান হয়ে আছে।মায়া ফিসফিস করে বলে,”আপনি চলেন ডালে ডালে তো আমি চলি পাতায় পাতায়।আমি তো আপনাকে সবার আগেই নজরে রেখেছি।নারী বুদ্ধির পরিচয় তো আমি নিজে।সেখানে আপনাকে কিভাবে নিজের নজরের বাইরে রাখি বলুন?এখন আপনাকে কর্মফল ভোগ করতে হবে।ভয় নেই অন্যদের মত ওপারে পাঠাবো না কিন্তু শাস্তি ঠিকই দিবো।আপনাকে দেখলে মন্ত্রী মশাই আবার তার কাজ থামিয়ে আপনার দিকে মনোযোগী হবে।যেটা আমি একদমই চাইনা।মন্ত্রী মশাই ওদিক সামলাক আমি আপনাকে সামলাবো।”
বলেই মালিনীকে নিয়ে সবার পিছন থেকে চলে যায়।মালিনী অজ্ঞান হয়ে দুর্বল হয়ে যায়।যার ফলে মায়ার সুবিধা হলো মালিনীকে নিয়ে যেতে।গাড়িতে বসিয়ে মায়া গাড়ি চালানো শুরু করে।উদ্দেশ্য নিজের গার্মেন্টসের সিক্রেট রুম।যেখানে নিজের মত বোঝাপড়া করবে মালিনীর সাথে।
সোনালীকে নিয়ে অপারেশন শুরু করেছে আদ্র ও দুজন সিনিয়র ডক্টর।সাথে আছে নার্স।রাজ এখন বাইরে দাঁড়িয়ে।এর মাঝেই রুদ্রের কল আসে।রাজ ধরতেই রুদ্র জানায়,”আমি হাসপাতালে এসেছি মৌকে দেখতে কিন্তু ভাবীজী কোথায়?”
“মায়াবতী তো আজকে মৌয়ের সাথে থাকবে বলেছিলো।ছোট মায়ের অপারেশন কমপ্লিট হলে তারপর এখানে আসবে।”
“এখানে নেই ভাবীজী।মৌ তো সেই ধরে খুঁজে যাচ্ছে ভাবীজীকে।ডেসপারেট হয়ে উঠেছে চিন্তায় চিন্তায়।কান্না করছে মেয়েটা।এদিকে কল দিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না।রিং হচ্ছে কিন্তু পিক করছেনা ভাবীজী।”
“বাড়িতে গেলো না তো!কিন্তু বাড়িতে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসেনা।”
“আমি বড় বাবাকে কল দিয়েছিলাম ভাবীজী ওখানে নেই।”
“বীর?”
“ব্রো এখন বিজনেস মিটিংয়ে ব্যাস্ত,জারা আছে নিজের বাবার বাড়িতে।কিছুক্ষণ সেখানে থাকতে চায় তাই।রুবি আর তাজ আছে সাথে।সবার কাছেই কল করেছি,কোথাও নেই।”
রাজ কপালে আঙ্গুল রেখে কিছুক্ষণ ভাবছে।হঠাৎ মনে পড়ে ওই সময়ের কথা।একটা শব্দ সে পেয়েছিল।রাজ চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভেবে বলে,”ফোন রাখ আমি দেখছি।”
কল কেটে রাজ এই ফ্ল্যাটের ফুটেজ দেখে।চোখ বড়বড় হয়ে ওঠে।একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে দৌঁড়ে চলে যায় বাইরে।আদ্রকে ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছে।যে করেই হোক এই অঘটন ঘটতে দেওয়া যাবেনা।মালিনী আপন মা না হলেও এই মালিনী অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে মাহমুদ সরদারের জীবনে।এছাড়া সিয়া ও হিয়ার কথা ভাবতে হবে।মালিনী তো ইচ্ছা করে এসবে নেই।রাজ দেখেছে মালিনীর আড়ালে কান্না।তাই তো তাকে সহ্য করতে না পারলেও কখনও একদৃষ্টিতে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনা।কেউ বাধ্য হয়ে খারাপ পথে থাকলে তাকে দোষী বলতে গেলেও বিবেগে বাদে।রাজ বুঝতে পারে মালিনীর আলাদা কষ্ট।হ্যাঁ মালিনীর কারণে রোহিনী আঘাত পায় তবে সেটা ক্ষণিকের।রোহিনীর মৃত্যুর আগ দিয়েই তো মালিনী ভুল বুঝে ক্ষমাও চায়।
কিন্তু হঠাৎ করে রোহিনীর মৃত্যু রাজ মানতে পারেনা।সেই সাথে এই ব্যক্তিকে মায়ের আসনে দেখে তার মনে আঘাত লাগে।কিন্তু যত বড় হচ্ছে পরিস্থিতি বুঝতে পারছে রাজ।বৈবাহিক জীবন বা ভালোবাসার জীবনটা ভিন্ন এক জগৎ।আমরা ভালোবাসলে উন্মাদ হয়ে উঠি।ধোঁকা পেলে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনা।মালিনীর মাঝেও তাই ঘটে।পারেনি নিজেকে সংযত রাখতে।যত পেরেছে রোহিনীকে অজস্র কটূবাক্য শুনিয়ে দেয়।নিজের প্রেমিককে ভুল বুঝে তাকেও অনেক শুনিয়েছে।তারপর যখন দুজনের মৃত্যু হয় তখন মালিনী অনেক ভেঙ্গে পড়ে।এগুলো রাজের দৃষ্টিতে আসা সম্ভব না।সে তখন তার মায়ের লাশটার দিকে বেঘোরে ছিলো।
মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ৬১+৬২
কোনো না ভাবে মালিনী দায়ী ভেবেই এতদিন মহিলার থেকে নিজেকে দূরে থেকেছে।কিন্তু এখন একটু একটু বুঝতে পারে।তারও তো সব হারিয়েছে।সবথেকে বড় সম্পদ সন্তান।তাকে হারিয়ে এখনও পাওয়ার লোভে এতকিছু করা।কখনও কেউ চেষ্টা করেনি তাকে কিছু দেওয়ার বা আশ্বস্ত করার।শুধু টাকা পয়সা না একটু আশ্বাস প্রয়োজন ছিল।ইদানিং মালিনী একটু একটু রাজের প্রশংসা করে।এর মূল কারণ রাজ বুঝতে পারে মালিনীর কষ্টটা।তাই হয়তো মালিনী নিজেও নিজের জবান থেকে রাজের জন্য প্রশংসা বের করে।
